লাইসেনস
কথায় বলে সাবধানের মার নেই। একটু সাবধান হলে মানুষের জীবন কত শান্তির, কত সুখের হতে পারে। যেমন কথায় সাবধানতা। সাধক সত্যানন্দ বলে গেছেন—অনেক কথার অনেক দোষ, ভেবেচিন্তে কথা কোস। তা স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় যদি একটা কথা মানুষ মনে রাখে যে, মহিলাটি তোমার সজীব জীবনসঙ্গিনী, তুলোর বস্তা কি বালির বস্তা নয়। অভ্যাসকারী সৈন্যের মতো অনবরত কথার বেয়নেট মেরে গৃহশান্তি নষ্ট কোরো না। সংসার টেনিসের সেন্টার-কোর্ট নয়। তোমার স্ত্রী স্টেফি গ্রাফ নয়। কথার সব সার্ভিস তিনি ছেড়ে দেবেন, আর তুমি মনের আনন্দে পনেরো তিরিশ চল্লিশ পয়েন্ট পেয়ে সেটের পর সেট দখল করে, উইম্বলডন জয় করবে, তা হয় না। সংসার তোমার মামার বাড়ি নয়। এ হল নারীজাগরণের যুগ। এখন, ‘ঢিলটি মারলেই পাটিকেলটি খাইতে হবে।’ অতএব সাবধান!
আনট্রেইন্ড অ্যালসেসিয়ানের মতো, আনট্রেইন্ড স্বামী সংসারের এক মহাসমস্যা। স্বামীদের একটা ট্রেইনিং ক্যাম্প থাকা উচিত। যেমন শিক্ষক হতে গেলে বিটি পাশ করতে হয়, সেইরকম স্বামী হতে গেলে টি এস পাশ করতে হবে। টি এস মানে, ট্রেইন্ড স্বামী। লোকটা চাকরি করে, ধুম্বো একটা চেহারা, মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই আছে, সেই সুবাদে ভালো মানুষের একটি মিহি মেয়েকে পাটের চাদরের কোণে বেনারসির গাঁটছড়া বেঁধে নিয়ে এসে সারাজীবন ধাঁই ধাপ্পড় ধামসাবে তা হয় না। ভালো মানুষের পোঁ-দের এখন জানতে হবে, পোঁ ধরার ট্রেইনিং নিতে হবে। বিয়ের আগে অথবা বিয়ের অব্যবহিত পরে। বিটি পাশ না করে এলে যেমন চাকরি পাকা হয় না, টি এস পাশ না করে এলে স্বামীগিরি পাকা হবে না ‘যাও, আগে পাশ করে এসো, তারপর তোমার ওগো, হ্যাগো, শুনছ, এসবের জবাব দেওয়া হবে।’
প্রথমে একটা অবজারভেশান-লেবরেটরিতে রাখা হবে স্বামীদের। অলক্ষ্যে থেকে-থেকে দেখা হবে তাদের স্বভাব। অভ্যাস। কথায় বলে, ‘স্বভাব না যায় মলে, ইল্লত না যায় ধুলে।’ ইল্লত হল নোংরামি। স্বভাব-সংশোধনী ক্যাম্পে ট্রেনার হিসেবে থাকবেন জাঁদরেল এক মহিলা। পুরুষ রাখা চলবে না। পুরুষের স্বভাবের ত্রুটি পুরুষের ধরার ক্ষমতা হবে না। বিছানা থেকে নেমেই ঘুম চোখে বাথরুমের দিকে সরে পড়ার তালে ছিল। মহিলা ট্রেনার বসেছিলেন একধারে ঘাপটি মেরে। তিনি অমনি কড়া গলায় বলবেন, ‘এই যে মশাই! ছুটছেন কোথায়, দাঁড়ান। মশারি তুলুন। বেডশিট টানটান করুন। মাথার বালিশে দুহাতের চাপড় মেরে ফোলা ফোলা ভাবটা ফিরিয়ে আনুন। হ্যাঁ, এইবার বালিশটা মাথার দিকে রেখে, পুরো বিছানাটা বেডকভার দিয়ে ঢেকে দিন। হচ্ছে না, হচ্ছে না। চারপাশ সমান হল না। একটা দিক বেশি ঝুলে গেছে। চারপাশ সমান করুন। টানটান করুন। মেক ইট ডিসেন্ট। আচ্ছা, আপনি পেলেন দশের মধ্যে তিন। প্রশ্ন করবেন না। এর নাম মশারি গোছানো? এর নাম চাদর পাতা। ফার্স্টক্লাস পেতে হলে দশের মধ্যে আট পেতে হবে। চেষ্টা করুন।’
ট্রেনি স্বামী এইবার ব্যাজার মুখে বাথরুমের দিকে ছোটার চেষ্টা করবেন। ট্রেনার আবার হুঙ্কার দেবেন, ‘আমি কি আপনাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি! সোজা হয়ে দাঁড়ান! হাত-পা ছুঁড়ুন। মাথার ওপর দুহাত তুলে সামনে ঝুঁকুন। ফ্রন্টবেন্ড, সাইড বেন্ড, ব্যাক বেন্ড। দশ, দশ, দশ। তিরিশ পেরোতে না পেরোতেই একখানি একটা ভুঁড়ি। লজ্জা করে না, যেকোনও রুচিশীল মহিলার চোখে ভুঁড়ি একটা কদর্য জিনিস। বিয়ের পর ভুঁড়ি হয়ে গেলে নড়া ধরে তো আর বাইরে ফেলে দিয়ে আসা যায় না, সহ্য করে নিতেই হয়। রাতে তো ভালোই টানলেন, তারপর ধপাস করে বিছানায়। হজমটা হবে কী করে! পেটটা কি আপনার গমকল? পাঁচ কেজি ঢেলে সুইচ অন করে শুয়ে পড়লুম। নিন বিশটা ডন মারুন। চল্লিশবার বৈঠক। লাগান পবনমুক্তাসন। এরপর তো ঢেউঢেউ করে ঢেঁকুর ব্যামোতে ধরবে। বাত, সুগার, টাক, ছানি, ফোলা-ফোলা, হিমঘরে রাখা চালতার মতো মুখ। চল্লিশের পর এদেশের স্বামীদের দিকে আর তাকানো যায় না! কুৎসিত। ভালগার। স্বামী বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করে। গর্তওয়ালা দাঁত। পায়োরিয়া ঠাসা মাড়ি। সপ্রেমে মুখের কাছে মুখ আনলে বাপ বলে পালাতে ইচ্ছে করে। পঞ্চাশ পেরোলেই স্বামী আর সংসারের অ্যাসেট নয় লায়াবিলিটি। হার্ট ঢিলে, লিভার ঝুলে নেমে গেল কুঁচকির নীচে। মরা মাছের মতো চোখ। স্বামী হবে টাট্টু ঘোড়ার মতো, পানসি নৌকার মতো। নিন, স্টার্ট জগিং।’
দেরাদুন বা পুরুলিয়ার মিলিটারি আকাদেমিতে যেভাবে পেটাই হয় সেই কায়দায় স্বামীদের গড়াই পেটাই হবে। বাথরুম থেকে বেরোলেই, বাথরুম চেক করা হবে। বেসিন পরিষ্কার করো। প্যানে ভালো করে জল ঢালো। টুথপেস্ট সোজা করে রাখো। সাবান সোপকেসে। তেলের ছিপি আঁটো। মেঝে শুকনো করো। বেরিয়ে এসো। তোয়ালে দলা পাকিয়ে কোথায় ফেলেছ। তোয়ালে ঝোলবার ডান্ডায় পরিষ্কার করে মেলে দাও। দেখি শ্রীচরণ দুখানি। এই তোমার শ্রীপদ। এ তো দেখি স্লোপদ। পা দুটো কি শরীর-ভূগোলের বাইরে। যে-কালে মেয়েরা ভোরে স্বামীর শ্রীচরণ-ধোয়া জল খেত, এই পা-ধোয়ানি খেলে ধনুষ্টঙ্কার হয়ে মারা যেত। হাফ অ্যান আওয়ার টাইম। পা দুটোকে ঝামা ঘষে মানুষের মতো করো। এ যেন অ্যাবোমিনেবল স্নোম্যানের পা।
ভোরবেলা বিছানায় আড় হয়ে পড়ে থেকে, জড়ানো গলায়—চা হল? চা হল? করে, সারাটা জীবন বউয়ের ঘাড়ে বন্দুক রেখে দেগে গেলে চলবে না। নিজের বন্দুক নিজের কাঁধে রাখার ট্রেনিং নাও। তোমার তো আর বউয়ের গ্যারেজ নেই, যে এক বউ বসে গেলে গ্যারেজ থেকে বের করে আনবে আর এক বউ। গ্যাস জ্বালতে শেখো। চা করতে শেখো। ডাল আর পোস্ত আর সরষে বাটতে শেখো। বাসন মাজতে শেখো। পরিবেশন করতে শেখো। ছেলে ধরতে শেখো, ভোলাতে শেখো। ন্যাপি পালটাতে শেখো! যৌথ পরিবার ভেঙেছ—মে-ও এবার সামলাও। লাইসেন্স ছাড়া যেমন গাড়ি চালানো যায় না, সেই রকম লাইসেন্স ছাড়া সংসার গাড়ির ড্রাইভার হওয়া যাবে না। এই হবে নিয়ম। সংসারে স্বামী-স্ত্রী যেন দুই সতীন। এই হবে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি।