লাইটার নেভে না – শংকর দাশগুপ্ত
এক
এক নির্জন স্টেশনে এসে থামল গভীর রাতের ট্রেন। ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্ট থেকে নামল এক যুবক। প্ল্যাটফর্মে সে পা ছোঁয়াতেই কোথায় কোন ঘণ্টা-ঘড়িতে যেন ক’টা বাজল। কোটের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে রাখল যুবক। এবার দেশলাই খুঁজতে গিয়ে কোটের পকেট, প্যান্টের পকেট খুঁজল। না, নেই। দেশলাই আনতে ভুল হয়ে গেছে তার। সে প্ল্যাটফর্মে তাকাল। নির্জন চারপাশ শীত আর কুয়াশায় ঝিমঝিম। একটা লোক, সে দেখল পরনে ওভারকোট, মাথায় একই রঙের হ্যাট, শুধু একটা বেশ লম্বা লোক প্ল্যাটফর্মের ডানদিকে একটা ফারগাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে।
ম্যাচিজ প্লিজ?—ঠোঁটে সিগারেট নিয়েই সে বলল লোকটাকে।
ভুরু পর্যন্ত দীর্ঘ টুপিতে ঢাকা, ওভারকোটের কলার ওঠানো, লোকটা পকেট থেকে দেশলাই নয়, অন্ধকার ঝকমকিয়ে একটা গ্যাস-লাইটার বের করল।
আর তখনই স্টেশন থেকে একটু দূরে যে-টানেল এতক্ষণ অন্ধকার আর কুয়াশায় ঢাকা ছিল সেখানে তীব্র এক আলো আর গুমগুম শব্দ শুনতে পেল সে। কোনও মেল ট্রেন আসছে।
—হিয়ার ইজ দ্য লাইট।
খুব শান্ত গম্ভীর গলায় ফিরে তাকাল সে। তাকিয়েই অসম্ভব চমকে তার ঠোঁট থেকে সিগারেট খসে পড়ল।
ওই দীর্ঘদেহী, ওভারকোট যার পরনে, এতক্ষণ মুখ যার ঢাকা ছিল ভুরু পর্যন্ত নেমে আসা দীর্ঘ কালো টুপিতে, এখন লাইটারের আলোতে তার মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল সে।
অবিকল আর-একজন সে। অ-বি-ক-ল!
টানেল কাঁপিয়ে গুমগুম শব্দে মেল ট্রেন এগিয়ে আসছে।
—হা-য়, এলভিস!—সেই লোকটা অথবা আর-এক এলভিস তার নাম ধরে ফিসফিস করে ডেকে ওঠে এবার, মুখে রহস্যময় হাসি।
সে দারুণ ভয়ে সরে আসে।
গুমগুম…গুমগুম…শব্দে কেঁপে ওঠে নির্জন পাহাড়ি স্টেশন। সে ছুটতে থাকে।
—এলভিস, ডোন্ট রান অ্যাওয়ে!—চাপা গলায় নিষেধ করে লোকটা : স্টপ! স্টপ, এলভিস!
লোকটা ওভারকোটে ঢাকা দীর্ঘ ডান হাতটা ছুটন্ত এলভিসের দিকে প্রসারিত করে। হাতে জ্বলন্ত লাইটার…।
ঠিক এইসময় বাবা লাইব্রেরি রুমে ঢুকেছিলেন।
কাহিনির উত্তেজনায় আর বাবার ভয়ে চমকে তাড়াতাড়ি বইটা বিশাল বুককেসে ঢুকিয়ে ফেলেছিল সোমনাথ।
ঘরে ঢুকে বাবা গম্ভীর মুখে শুধু একবার তাকিয়েছিলেন।
তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বের হয়ে গিয়েছিল সোমনাথ।
তখন কৈশোর শেষ হয়ে গিয়েছিল সোমনাথের। যা লুকোনো, যা নিভৃত, তার প্রতি কৌতূহলের আকর্ষণ তার তখন প্রবল। বাবার ছিল বিশাল লাইব্রেরি রুম। দেশবিদেশের নানা ধরনের সাহিত্য-ঠাসা দেওয়াল-জোড়া বিশাল বুককেস। সেখানে পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ, ডস্টয়ভস্কি, শেক্সপিয়র আর বঙ্কিমচন্দ্র। সেখানে জিম করবেটের রোমহর্ষক শিকার কাহিনির পাশে গাছমছম জেমস হ্যাডলি চেজ, মাইকেলের অমিত্রাক্ষরের খুব কাছে ওয়েস্টল্যান্ড।
সেই নানা ধরনের কালেকশন থেকে একদিন বিকেলে একটা বই টেনে নিয়েছিল সোমনাথ। ‘মিডনাইট এক্সপ্রেস’। কার লেখা ঠিক মনে নেই সোমনাথের। দেখাও হয়নি তাড়াতাড়িতে।
আশ্চর্য কৌতূহলে পাতার-পর-পাতা সরে যাচ্ছিল সোমনাথের চোখের সামনে থেকে।
আর ঠিক সেই জায়গাটায়…।
সেই নির্জন পাহাড়ি স্টেশনের কুয়াশায় নিষেধ…।
—স্টপ! স্টপ, এলভিস!
সেই ওভারকোট ঢাকা প্রসারিত হাত…।
হাতে জ্বলন্ত লাইটার…।
পরে বইটা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে সোমনাথ। পায়নি। ওই বিশাল বুককেস কোথায় গ্রাস করেছে সেই ছোট্ট পেপারব্যাক। ‘মিডনাইট এক্সপ্রেস’।
অথবা হয়তো অন্য কারও বই। বাবা এনেছিলেন পড়তে।
অথবা…।
বইটা আর পড়া হয়নি সোমনাথের।
অথচ ভুলতেও পারেনি সোমনাথ।
সেই নির্জন প্ল্যাটফর্ম। দীর্ঘদেহী সেই রহস্যময় লোক। ঠোঁট থেকে খসে-পড়া সিগারেট। টানেল কাঁপিয়ে ছুটে আসা গভীর রাতের মেল ট্রেন। গুমগুম। গুমগুম। গুমগুম। আর সেই শীতার্ত গম্ভীর গলায়—স্টপ! স্টপ, এলভিস…!
দুই
তখন ক্রমশ মুনমুনের সুন্দর শরীর থেকে গাঢ় ঘিয়ে রঙের নাইটিটা খুলে নিচ্ছিল সোমনাথ, এমন সময় টেলিফান বেজে উঠল।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সোমনাথ সাদা ধবধবে টেলিফোনটার দিকে। চোখ খুলে তাকাল মুনমুন। ভুরু কুঁচকে, বিরক্তির গলায় বলল, না।
—হসপিটালে রুম নাম্বার সেভেনের পেশেন্টের কন্ডিশন খুব অ্যালার্মিং।
নগ্ন দু-হাতে সোমনাথের গলা জড়িয়ে ধরল মুনমুন। আর্তির গলায় বলল, প্লিজ, নট নাউ।
মুনমুনকে একটু দেখল সোমনাথ। এতক্ষণ ধরে মুনমুনের সুন্দর শরীরকে সে একটু-একটু করে জাগিয়েছে। টানটান বাঁধা সেতারের মতো শরীর এখন মুনমুনের। অথচ টেলিফোন তখনও একইভাবে বেজে চলেছে। অথচ মুনমুনের ক্রিম-ঘষা মুখ, সুন্দর চোখ, প্লাক করা ভুরু নেশায় ঝিমঝিম।
মুনমুন সোমনাথের নাইট ড্রেসের বোতামে আঙুল ছোঁয়ায় এবার। একটা বোতাম খুলেও ফ্যালে।
সোমনাথ উঠে পড়ে। আর দেরি করলে…।
—আহঃ!—অস্ফুট শব্দ করে মুনমুন।
—ডক্টর মুখার্জি হিয়ার, এত রাত্তিরে?
—সোমনাথ, আমি মলয়।
—কী ব্যাপার, এত রাত্তিরে?
—আমার বাবা—।
—কী হয়েছে?
—অবস্থা খুব খারাপ। অসম্ভব ব্রিদিং ডিফিকালটি, হার্ট বোধহয়—।
—আমি তো লাস্ট উইকে চেকআপ করে এসেছিলাম। ই. সি. জি. রিপোর্টও তো—।
—হঠাৎ ডেটোরিয়েট করেছে। প্লিজ, তুই একবার—।
বিছানার দিকে তাকায় সোমনাথ। নিজেই কখন নাইটিটা খুলে ফেলেছে মুনমুন। সম্পূর্ণ নগ্ন শরীরে পাশ ফিরে শুয়ে আছে ও। খোলা ববড হেয়ার বালিশে, ওর মুখে ছড়িয়ে আছে। হাতের ফাঁকে মুনমুনের একলা একটা স্তন চোখে পড়ে। গত সপ্তাহে পরপর সাত দিন নাইট ডিউটি গেছে সোমনাথের। সাত দিন পর আজ প্রথম…।
—সোমনাথ!—ওপার থেকে ডেকে ওঠে মলয়, প্লিজ, তুই একবার আয়।
—আমার গাড়িটা কাল থেকে…।—সোমনাথ দ্যাখে মুনমুন পাশ ফিরে সোজা হয়ে শুয়েছে এবার। পা দিয়ে পায়ের পাতা জড়ানো, চোখ বোজা, গভীর নাভি মুনমুনের, ফরসা ধবধবে ঊরু, একটু আনত উন্মুখ দুই স্তন।
—এখন এলে তোকে আমি ফিরে আসার লাস্ট ট্রেনটা ধরিয়ে দিতে পারব—কান্নার মতো শোনায় মলয়ের গলা : আমার জন্যে এইটুকু কর, প্লিজ।
—আচ্ছা, ঠিক আছে।—কী একটু ভেবে বলে সোমনাথ।
—আসছিস তবে, সোমনাথ?—মলয়ের গলা কেঁপে ওঠে।
—আসছি।
—তুমি যাচ্ছ?—নাইটির স্ট্র্যাপ বাঁধতে-বাঁধতে বিছানায় উঠে বসে মুনমুন।
—হুঁ।—অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দেয় সোমনাথ।
—তুমি সত্যি যাচ্ছ?—এবার ঝাঁজ উঠে আসে মুনমুনের গলায়।
—আমাকে যেতে হবে মুনমুন।—কোটের ওপর মাফলারটা জড়িয়ে নিতে-নিতে বলে সোমনাথ।
—কার জন্যে। রুম নাম্বার সেভেনের পেশেন্ট?
—না।
—তবে?
—হসপিটালের কোনও পেশেন্ট নয়।
—কে?
—মলয়ের বাবা।
—কে মলয়?
—আমার বন্ধু। হার্টের অবস্থা খুব খারাপ ওর বাবার…এনি মোমেন্ট।
—তো কী হয়েছে?
মুনমুনের প্রশ্নে ফিরে তাকায় সোমনাথ।
—তা বলে এত রাতে যেতে হবে?—আবার প্রশ্ন করে মুনমুন।
—হবে।—জোর দিয়ে উত্তর দেয় সোমনাথ।
—কেন?
যেতে-যেতে ঘুরে দাঁড়ায় সোমনাথ, তারপর বলে, আমার বাবা,…আমার বাবাও ডাক্তারের নেগলিজেন্সে হার্টফেল করে মারা গিয়েছিলেন, মুনমুন।
তিন
আজ কয়েকদিন ধরে কেন যেন ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে সোমনাথের।
এই এখন—এই রাতের ফাঁকা নির্জন ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে বসে মলয়ের বাড়ি যেতে-যেতে হঠাৎ সেই পলাশপুরের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। এখন এই উত্তর তিরিশের দিনগুলোতে একা থাকলেই এরকম হয় সোমনাথের।
ছেলেবেলায় পাখি বড় প্রিয় ছিল তার। পাখি দেখলেই নাম জেনে নিত সে। ছেলেবেলার অমল সেই বয়েসে সোমনাথ ক্রমে-ক্রমে শিখছিল লোভ, কামনা, হিংসা আর ঘৃণা কাকে বলে। পাখি-ভালোবাসা সোমনাথই একবার বন্ধুদের সঙ্গে রুমনি নদীতীরে গুলতি দিয়ে বালিহাঁস মেরেছিল কেন সে নিজেই বোঝেনি। অথচ সেই হাঁসের মাংস শালবনের চড়ুইভাতিতে সে ছুঁয়েও দেখেনি।
—সোমনাথ?—কে যেন বুকের ভেতর ডেকে ওঠে তার।
—উঁ?—আনমনা উত্তর দেয় সোমনাথ।
—মনে পড়ে?
—পড়ে।
দ্রুত ছুটে যায় রাতের ট্রেন। তাকে নামতে হবে সাতটা স্টেশন পরে। ছোট শালবনে ঘেরা ‘মৌ-বাতাসী’ স্টেশনে।
বাতাসী…বাতাসী যেন কার নাম ছিল? সেই যৌবনে…।
মনে পড়ে না। আজ আর মনে পড়ে না।
সেই প্রখর শরীর, কষ্টিপাথরের মতো খুদে-খুদে তৈরি করা স্তন, স্ফুরিত ঠোঁট, সুন্দর চিবুক, নিটোল স্তন, গভীর নাভি, প্রখর জঙ্ঘা…পলাশপুরের বাড়ির চিলেকোঠায়, মাদুরে চুলের তেলের ঝিমঝিম গন্ধ, মাদুরের পাশে পড়ে থাকা ডুরে শাড়ি…দুপুর কেটে যায়…দুপুরের-পর-দুপুর…।
—সোমদাদাবাবু গো, আমি যে…।
—কী?
—তুমার…।
—বল, কী হয়েছে, বাতাসী?
—তুমার ছেইলার…।
কোন স্টেশন পার হয়ে গেল? অন্ধকারে চোখে পড়ে না। স্টেশনের নামের ওপর স্তিমিত লন্ঠনের আলো শুধু দপদপ করে ওঠে। তেল ফুরিয়ে যাচ্ছে।
তখন ফাইনাল ইয়ার চলছে মেডিকেলে।
একদিন দুপুরে হঠাৎ ফোন এল।
—কে, সোম?
—হ্যাঁ।
—আমি তোর ছোটকাকু।
—কী ব্যাপার?
—এক্ষুনি তুই চলে আয়, আর…।
—কেন? কী হয়েছে?
—তোর বাবার হার্টের অবস্থা খুব খারাপ, একজন ভালো ডাক্তার নিয়ে।
—আচ্ছা দেখছি। বিকেলে একটা ইম্পরট্যান্ট কেস—।
—আসছিস তো আজই?
—দেখছি চেষ্টা করে।
যায়নি সোমনাথ। বাবা বাঁচেননি। সেই শেষ। সেদিন বিকেলেই। ঘেমে ওঠে সোমনাথ। গলা থেকে মাফলারটা খোলে। এই শীতেও কানের পাশ দিয়ে ঘামের একটা রেখা তিরতির করে বেয়ে নামছে। ট্রেনটা থেমে আছে কেন? সোমনাথ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দু-পাশে কাটা ধানখেত। ধু-ধু করছে। দূরে সেই টাওয়ারটার আলো চোখে পড়ে সোমনাথের। তার মানে আর দেরি নেই। পরের স্টেশন মৌ-বাতাসী।
বাতাসী…বাতাসী…বাতাসী…উত্তুরে হাওয়া হাহাকারের মতো বয়ে যায়।
শিরশির করে ওঠে সোমনাথ। সে কি শীতে?
টেন নড়ে ওঠে। প্রায় মধ্যরাতের ট্রেন।
মধ্যরাতের ট্রেন! মনে হতেই মাথার ভেতর ঘুমিয়ে থাকা একটা চিন্তা জেগে ওঠে।
একটা পেপারব্যাক। কী যেন নামটা? কী যেন?
সেই রাতের ঘণ্টা-ঘড়ি…দীর্ঘদেহী সেই ওভারকোট পরা রহস্যময় লোক…কী যেন নামটা… সেই টানেল কাঁপিয়ে ছুটে আসা ট্রেন…ঠোঁট থেকে খসে-পড়া সিগারেট…সেই…কী যেন নামটা?
চার
মৌ-বাতাসী।
লন্ঠনের আলোর নীচে নামটা আবছা হলেও চোখে পড়ে।
ধীরে-ধীরে থামে ট্রেনটা।
ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় সোমনাথ। সিঁড়িতে পা রাখে।
প্ল্যাটফর্মে পা ছুঁতেই ঢং…ঢং…ঢং…।
কেঁপে ওঠে সোমনাথ! ঠিক এরকমই ছিল ঘটনাটা। কীসের ঘটনা যেন! সেই যে ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্ট থেকে পা ছোঁয়াতেই ঘণ্টা-ঘড়ি…ঢং-ঢং-ঢং…ওই তো এখনও বাজছে!
তারপর…তারপর যেন কী—!
একটা সিগারেট খেলে হয়। মনে মনে ভেবে কোটের পকেট খুঁজে একটা সিগারেট বের করল সোমনাথ। ঠোঁটে রাখল।
দেশলাই? এবার তো দেশলাই খুঁজতে হবে। খুঁজল সোমনাথ কোট আর প্যান্টের পকেট…।
এসবই তো ঠিক ছিল, এরকমই তো কথা ছিল। মনে-মনে ভাবে সোমনাথ। এই ঠোঁটে সিগারেট, দেশলাই খুঁজে-না-পাওয়া…তারপর যেন কী? হ্যাঁ, মনে পড়েছে, একটা গাছের নীচে…ওই তো…সোমনাথ দেখতে পায় জনহীন কুয়াশাঘন স্টেশনটার ডানদিকের কোণে একটা শালগাছের নীচে…হ্যাঁ, ঠিক এরকমই তো কথা ছিল…মনে পড়ে সোমনাথের…কথা ছিল, আমি ওর কাছে গিয়ে..ওই ওভারকোট, মাথায় হ্যাট, দীর্ঘদেহী ওই লোকটার কাছে গিয়ে…।
—দেশলাই আছে?—সম্মোহিতের মতো প্রশ্ন করে সোমনাথ, ঠোঁটে সিগারেট।
ভুরু পর্যন্ত দীর্ঘ টুপিতে ঢাকা, ওভারকোটের কলার ওঠানো, লোকটা পকেট থেকে দেশলাই নয়, অন্ধকার ঝকমকিয়ে গ্যাস-লাইটার বের করে। সোমনাথ এ-সবই জানে, সবই জানে সোমনাথ—এবং এ-ও জানে তক্ষুনি…ওই তো, ঠিক যেমন কথা ছিল। ওই তো এতক্ষণের অন্ধকার আর কুয়াশায় ঢাকা টানেল কাঁপিয়ে ছুটে আসছে তীব্র আলো আর গুমগুম-গুমগুম শব্দ…।
—এই যে আগুন!—গম্ভীর শান্ত গলার ডাকে ফিরে তাকায় সোমনাথ। আর তাকিয়েই দারুণ চমকে তার ঠোঁট থেকে খসে পড়ে সিগারেট। ওভারকোটের কলার আর নামানো টুপির মাঝখানে লাইটারের আলোয় সে দেখতে পায় তারই মুখ।
অবিকল আর-এক সোমনাথ! অ-বি-ক-ল!
—কী সোমনাথ? কেমন আছ?—সেই লোকটা অথবা আর-এক সোমনাথ তার নাম ধরে ফিসফিস করে ডেকে ওঠে। মুখে রহস্যময় হাসি।
দারুণ ভয়ে সরে আসে সোমনাথ। গুমগুম-গুমগুম শব্দে কেঁপে ওঠে নির্জন ছোট স্টেশন।
ছুটতে থাকে সোমনাথ।
—সোমনাথ, পালিয়ো না!—চাপা গলায় নিষেধ করে লোকটা,—থামো, থামো, সোমনাথ।
ওভারকোটে ঢাকা দীর্ঘ হাত সে প্রসারিত করে ছুটন্ত সোমনাথের দিকে। হাতে জ্বলন্ত লাইটার।
ছুটতে-ছুটতে ছুটতে-ছুটতে সোমনাথ একসময় মাঠের মাঝখানে বন্ধ একটা দরজার ওপর আছড়ে পড়ে। দরজা খুলে যায়। কয়েকটা প্যাকিং বাক্সে হোঁচট খায় সোমনাথ। অসম্ভব হাঁপাতে-হাঁপাতে বসে পড়ে।
একটু পরে হঠাৎ সোমনাথের চোখে পড়ে শূন্যে ভেসে আসছে একটা জ্বলন্ত মোমবাতি আর জটিল একটি মুখ।
ভয়ে শ্বাসরোধ হয়ে আসে সোমনাথের। হাতের আড়াল করে ভালোভাবে দেখতে চেষ্টা করে।
একটা বৃদ্ধ লোক, হাতের পাতায় কারুকাজ করা চিনেমাটির প্লেট, তার ওপর জ্বলন্ত একটা মোমবাতি। শুধু মুখে মোমবাতির আলো এসে পড়েছে, লোকটার আর-সব অন্ধকার।
—আপনি?—সোমনাথের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে সেই বৃদ্ধ।
—আমি, মানে—।—হাঁপাতে-হাঁপাতে বলে সোমনাথ, লাস্ট ট্রেনে ফিরে যাব, বাইরে বড় শীত, একটু-একটু বৃষ্টিও পড়ছে, তাই…।
—লাস্ট ট্রেন!—লোকটা ভুরু কোঁচকায়, তারপর ঘাড় ফিরিয়ে কী যেন শোনে মনোযোগ দিয়ে।—ওই তো লাস্ট ট্রেন চলে যাচ্ছে।—লোকটা না তাকিয়েই বলে।
সোমনাথ সত্যিই শুনতে পায়, চলে-যাওয়া ট্রেনের শব্দ ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
—তবে আজকের রাতটা—।—তখনও হাঁপায় সোমনাথ।—আপনার যদি আপত্তি না থাকে…।
—ঠিক আছে, থাকুন।—লোকটা ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
—যদি কিছু মনে না করেন…।—সোমনাথ বলে, ওই মোমবাতিটা—।
লোকটা ঘুরে দাঁড়ায়। মোমবাতিটার দিকে তাকায় একবার।
—একটাই আছে।—সেদিকে তাকিয়েই বলে। তারপর তাকায় সোমনাথের দিকে, দু-এক মুহূর্তৃ বলে, আচ্ছা, রাখুন আপনার কাছে।
—অনেক ধন্যবাদ, হাত বাড়িয়ে মোমবাতিটা নিতে-নিতে বলে সোমনাথ।
লোকটা কিছু বলে না। শুধু একটু হাসে।
পাঁচ
মোমবাতির আলোয় সিগারেট ধরাচ্ছিল সোমনাথ, এমন সময় মোমবাতি নিভে গেল।
খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে সেই ওভারকোট পরা দীর্ঘদেহী লোকটা।
চমকে সরে গেল সোমনাথ।
লোকটা সোমনাথের খুব কাছে একটা প্যাকিং বাক্সের ওপর বসে। মোমবাতি নিভে আছে। লোকটা মোমবাতিটার দিকে একবার তাকায়। তারপর গ্যাস-লাইটারটা জ্বেলে প্যাকিং বাক্সের ওপর রাখে।
—এটা নিভবে না।—লাইটারটার দিকে চেয়ে আশ্চর্য গলায় বলে।
সোমনাথ দ্যাখে অবিকল আর-একজন সোমনাথ তার মুখোমুখি বসে আছে। অবিকল সে, কিন্তু ওর মুখ আশ্চর্য শান্ত, পাখি-ভালোবাসা সোমনাথের সেই ছেলেবেলার মুখের মতো রেখাহীন, আবিলতাহীন, নিষ্পাপ মুখ।
—মনে পড়ে?—ধীরে-ধীরে প্রশ্ন করে সে সোমনাথকে।
—কী?—ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর বের হয়ে আসে সোমনাথের গলা থেকে।
—সেই নিহত বালিহাঁস…।
কোনও উত্তর দেয় না সোমনাথ।
—বাতাসী? বাতাসীকে মনে পড়ে?—ফিসফিস করে প্রশ্ন করে সে।
কেঁপে ওঠে সোমনাথ।
—কেউ জানে না, কেউ না…।—ফিসফিস করে সে বলেই চলে, দোলে তার দীর্ঘ দেহ সাপের মতো।—তখন তোমার মেডিকেলের সেকেন্ড ইয়ার। তোমার স্বল্প জ্ঞানের ভুল-ভাল ওষুধে যখন নষ্ট করতে পারলে না বাতাসীর গর্ভের ভ্রূণ, তখন খুব সহজ উপায়…পটাশিয়াম সায়ানাইড…।
চমকে উঠল সোমনাথ। কেউ জানে না। কেউ তো জানে না বাতাসী হঠাৎ কেন তীব্র যন্ত্রণায় নীল হয়ে…।
—আহা, তখন বড় খিদে। নতুন মা হলে এরকম খিদে হয়—তুমি তাকে মাংসের চপ এনে দিয়েছিলে আর তাতে মাখানো ছিল…হাত দিয়ে মুখ ঢাকছ কেন, সোমনাথ, ভয়ে-দুঃখে যে নয়, তা তো আমি জানি। তা না হলে তোমার বাবা লোকটা যখন অসহ্য শ্বাসকষ্টে, যন্ত্রণায়…তখন কি তুমি মুনমুনের সঙ্গে ডায়মন্ডহারবারে নৌকোর ভেতর—তোমাকে তো জানানো হয়েছিল, সোমনাথ। তোমার ছোটকাকা তো—ওই যে বললাম, দুঃখ তোমার নেই।
—নাঃ!—অস্ফুট যন্ত্রণায় মুখ তুলে তাকায় সোমনাথ।—না! নাঃ!
আর অবিকল আর-এক সোমনাথ তার চুলে হাত রাখে। চুল থেকে মুখে খেলা করে আঙুল। সোমনাথের দু-চোখ, ঠোঁট, চিবুক ছুঁয়ে-ছুঁয়ে খেলা করে আর-এক সোমনাথের আঙুল।
—নিহত বালিহাঁস…।—ফিসফিস করে বলে সে, বাতাসীর নীল শরীর…।—দশটা আঙুল খেলা করে তার। বাবার শ্বাসকষ্টে লাল দুই চোখ…।—ফিসফিস করে বলতে-বলতে সে ঝুঁকে পড়ে সোমনাথের ওপর,—মনে পড়ে না…দুঃখ হয় না…। মোমবাতি নিভে যায় সোমনাথ, লাইটার নেভে না। লাইটার জ্বলে, জ্বালায়…ঘৃণা করো না নিজেকে, সোমনাথ?
অবশেষে সোমনাথের চোখ, ঠোঁট, চিবুক ছুঁয়ে খেলা করতে-করতে তার দু-হাতের দশটা আঙুল ক্রমশ নেমে আসে সোমনাথের গলায়…।
ছয়
পরদিন সকালে একদল রাখাল বালক তাদের ডাংগুলির গুলিটা খুঁজতে-খুঁজতে মাঠের মধ্যে এক ভাঙা বাড়ির মধ্যে ঢোকে। গুলিটা খুঁজতে গিয়ে তাদের চোখে পড়ে আশ্চর্য এক দৃশ্য। সভয়ে জড়োসড়ো হয়ে তারা দ্যাখে…।
একটা লোক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে প্যাকিং বাক্সগুলোর পাশে। আর আশ্চর্য, লোকটার নিজের হাতের দশটা আঙুল নখসুদ্ধ বিঁধে আছে নিজেরই গলায়।
ক্রাইম
পুজো সংখ্যা, ১৯৭৫