উপন্যাস
গল্প

‘লা’

‘লা’

এক

প্রথমে বিজয়ের খেয়াল হল।

পরীক্ষার শেষ দিন। দল বেঁধে সবাই হলের বাইরে এল। প্রশ্নপত্র খুব কঠিন হয়নি। সকলেই মোটামুটি ভালোই লিখেছে। বিজয়, পবিত্র, অলকেশ আর সরোজ।

বিজয় বলল, হ্যাঁ রে, মানস কোথায় গেল? ঘণ্টা বেজে গেছে, এখনও নিশ্চয় হলের মধ্যে নেই।

পবিত্র পাশেই ছিল। বিজয়ের দিকে ফিরে সে বলল, মানস তো আজ পরীক্ষা দিতেই আসেনি। আমার সামনেই তার সিট। সিট তো সকাল থেকে খালি।

সকলেই বেশ আশ্চর্য হয়ে গেল। মানস লেখাপড়ায় ভালো। স্কুল তার ওপর অনেক আশা রাখে। হায়ার সেকেন্ডারিতে বিজ্ঞান বিভাগে সে ভালোই করবে, শিক্ষকদের বিশ্বাস।

আজ জীববিদ্যার পরীক্ষা ছিল। মানসের প্রিয় বিষয়। আর মানসই এল না।

অলকেশ বলল, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েনি তো?

মানস অবশ্য খুব সাবধানি ছেলে। বাইরে কখনো কিছু খায় না। এমনকী বন্ধুরা যখন রেস্তরাঁয় খেতে বসে, তখন পাশে বসে মানস টিপ্পনী কাটে, আমি দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি তোদের পেটে জীবাণু কিলবিল করছে। ওইসব তোরা গোগ্রাসে গিলছিস।

খাওয়ার সময়ে এমন করলে কার মেজাজ ঠিক থাকে!

সরোজ চেঁচিয়ে উঠেছে, চুপ কর তো। নইলে তোর দিব্যচোখ উপড়ে ফেলে দেব।

মানস দমেনি। হেসেছে।

বিশ্বাস কর, আমার রঞ্জন-রশ্মি আছে চোখের কর্নিয়ায়। আমি সবকিছু একটু বেশি দেখি।

বিজয়, পবিত্র, অলকেশ, সরোজ আর মানস সব সময় এক জায়গায়। ক্লাসের অন্য ছেলেরা বলে, পঞ্চপাণ্ডব।

ছেলেদের কাছ থেকে কথাটা শিক্ষকদের কানেও গেছে।

এদের পাঁচজনকে একসঙ্গে দেখলে শিক্ষকরাও বলেন, এই যে পঞ্চপাণ্ডব, কী ব্যাপার?

আজ প্রথম পঞ্চপাণ্ডব জোটছাড়া।

একজন কম।

বিজয় প্রথমে উঠে দাঁড়াল।

চল, মানসের বাড়িতে একবার খোঁজ নিয়ে আসি।

কথা বলতে বলতে চারজন মাঠের ওপর বসে ছিল। সামনের কাগজে বাদাম আর ঝাল-নুন।

যে যতটা পারল হাতের মুঠোয় নিয়ে উঠে দাঁড়াল। মানসের বাড়ি শহরতলিতে, বাসে যেতে প্রায় ঘণ্টাখানেক লাগে।

বিজয়ের কথায় সবাই সায় দিল।

শুধু অলকেশ বলল, দেরি হলে বাড়িতে যে ভাববে। সবাই জানে পরীক্ষা দিয়েই বাড়ি ফিরব।

সরোজ বলল, কত আর দেরি হবে। মানসের সঙ্গে দেখা করেই চলে আসব।

সবাই রওনা হল।

এসপ্ল্যানেড থেকে বাস ধরতে হয়। এ সময় বাস ঠাস-বোঝাই। অনেক কষ্টে চারজনে বাসে উঠল।

ঘণ্টাখানেক পরে যখন চন্দনপুরে নামল, তখন চারদিকে আবছা অন্ধকার। কাঁচা রাস্তা। দু-ধারে গাছের সারি।

একটু এগিয়েই সুধা-নিবাস চোখে পড়ল।

সুধা মানসের মায়ের নাম। মা যখন মারা যান, তখন মানস খুব ছোটো। মা-কে তার ভালো করে মনেই পড়ে না।

মানসের বাপ গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উঁচু ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরেছেন। বাড়িতেই তাঁর গবেষণাগার। ভীষণ রাশভারী লোক। মাঝারি দোহারা চেহারা। চোখের চশমার কাচ এত পুরু যে চোখই ভালো করে দেখা যায় না।

মানসের বন্ধুদের সঙ্গে দেখাশোনা তাঁর খুবই কম হয়েছে এবং কথা বলেছেন একেবারে মাপা।

একবার মানসের বাবা দুপুরবেলা যখন বাড়ির মধ্যে খেতে গিয়েছিলেন, তখন মানস তার চার বন্ধুদের নিয়ে গবেষণাগারের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখিয়েছিল।

সারা ঘরে গাছগাছড়া ছড়ানো। এখানে-ওখানে শিশি, বোতল। কাচের আর রবারের নল লাগানো তাতে।

একটিও জানলা-দরজা নেই। একপাশে ঘর ঠান্ডা করার দুটি যন্ত্র।

তার বাবার গবেষণার বিষয় মানস সঠিক কিছু জানে না। সামান্যই শুনেছে।

সেই সামান্য খবরটুকুই সে বন্ধুদের পরিবেশন করেছে।

উদ্ভিদের হৃৎস্পন্দন জগদীশ বসুর কাছে ধরা পড়েছিল। প্রমাণিত হয়েছিল তাদের অন্তঃসংজ্ঞা আছে। বাবার ধারণা, এই উদ্ভিদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে। কাজেই মনও আছে। এই নিয়েই গবেষণা করছেন।

সুধা-নিবাসের কাছে গিয়েই চার বন্ধু থমকে দাঁড়াল। গেটের পাশে দুজন পুলিশ।

একতলার একটা ঘর থেকে ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে। তা ছাড়া সারা বাড়ি অন্ধকার।

অলকেশ বলল, কিছু একটা ব্যাপার হয়েছে মনে হচ্ছে। পুলিশ কেন?

সরোজ বলল, আমাদের হয়তো ভিতরে ঢুকতেই দেবে না।

পবিত্রর কণ্ঠ বেশ দৃঢ়—কিন্তু কী ব্যাপার আমাদের জানতেই হবে। মানসের যদি কোনও বিপদ হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। এই সময়েই প্রকৃত বন্ধুর প্রয়োজন।

গেটের ওপারে ভজুকে দেখা গেল। এক ঘর থেকে বেরিয়ে সে আর-এক ঘরে ঢুকছে।

বিজয় হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ভজু! ভজু!

পুলিশ দুজন বসে ছিল, চিৎকারে উঠে দাঁড়াল।

ভজু গেটের দিকে ছুটে এল।

সরোজ জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের বাড়িতে কিছু হয়েছে নাকি?

ভজু কপাল চাপড়াল, সর্বনাশ হয়ে গেছে দাদাবাবুরা। আজ ভোরে কর্তাবাবু মারা গেছেন।

কর্তাবাবু মানে মানসের বাবা।

সে কী, কী হয়েছিল?

ভজু তখন কাঁদতে আরম্ভ করেছে।

কী হয়েছিল কী করে বলব! স্বাভাবিক মানুষ! ভোরবেলা উঠে চা দিতে গিয়ে দরজা ঠেললাম, কোনও উত্তর নেই। পুলিশে খবর দিতে তারা দরজা ভেঙে ঢুকল। টেবিলের ওপর মাথা, আমি প্রথমে ভাবলাম বুঝি ঘুমোচ্ছেন। কাছে গিয়ে ডাকতে গিয়ে দেখি—

ভজু আর কথা শেষ করতে পারল না। ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল।

চারজনে তখন একেবারে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

মানস বাড়ি নেই?

কাপড়ের খুঁট খুলে চোখ মুছতে মুছতে ভজু বলল, না, দাদাবাবু সকাল থেকে হাসপাতালে।

বিজয় আর সকলের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখল, তারপর বলল, এখন আমরা কী করব?

অলকেশ উত্তর দিল, আমরা এখানে বরং অপেক্ষা করি। হাসপাতালে গিয়ে লাভ নেই। মানসকে হয়তো খুঁজেই পাব না।

সরোজ বলল, কিন্তু বাড়িতে যে ভাববে।

তা অবশ্য সত্যি। তার চেয়ে আমরা একটা কাজ করি। বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে আবার চলে আসি এখানে। বিপদের সময় মানসের কাছে থাকা খুবই উচিত।

বিজয়ের কথায় সবাই সায় দিল।

সেই ভালো। এমন একটা ব্যাপারে বাড়ির কেউ বারণ করবে তা মনে হয় না। ভজু, আমরা বাড়ি থেকে ঘুরে আবার আসছি।

চারজনে চলে গেল।

দুই

চারজন বন্ধুতে ফিরল প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে।

তখনও গেটে পুলিশ মোতায়েন। তারা পথ আটকাল, কোথায় যাবেন?

বিজয় বলল, আমরা এ বাড়ির ছেলে মানসের বন্ধু। এর আগে একবার এসেছিলাম।

দাঁড়ান এখানে।

একজন পুলিশ হনহন করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। ফিরল মিনিট দশেক পর। পিছনে মানস।

মানসের চেহারা দেখে বন্ধুরা শিউরে উঠল। একদিনের ব্যবধানে একজনের চেহারা যে এত বদলে যেতে পারে, সেটা তাদের ধারণারও অতীত।

মানস যথেষ্ট গৌরবর্ণ, কিন্তু সে রঙের ওপর কালো একটা আস্তরণ। কেঁদে কেঁদে দুটো চোখ জবা ফুলের মতন লাল। অবিন্যস্ত চুল।

অলকেশ এগিয়ে গিয়ে মানসের কাঁধে হাত রাখতেই সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল ভাই।

পবিত্র বলল, আমরা এর আগে এসেছিলাম, ভজুর কাছে কিছু কিছু শুনেছি। মেসোমশাইয়ের ঠিক কী হয়েছিল বুঝতে পারছি না।

বুঝতে তো আমিও পারছি না ভাই। ঘুম থেকে উঠিয়ে আমাকে এই বিপদের খবর দেওয়া হল। তারপর থেকে মনে হচ্ছে, সবই যেন স্বপ্ন। অবশ্য স্বপ্ন হলেই বাঁচতাম।

অলকেশ বলল, মনে হচ্ছে হার্ট ফেল করে মারা গেছেন।

মানস মাথা নাড়ল, না, হার্ট ফেল নয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, বিষক্রিয়ায় মৃত্যু।

সে কী, বিজয় চমকে উঠল, ভজুর কাছে শুনলাম মেসোমশাই সকালে চা খাওয়ারও অবসর পাননি।

পবিত্র জিজ্ঞাসা করল, কাল রাত্রে কী খেয়েছিলেন?

রাত্রে বাবা চারখানা রুটি খেয়েছিলেন। সঙ্গে একটু মাংস আর আলুভাজা। বাসন বেসিনে রাখা ছিল, পুলিশ সেসব নিয়ে গেছে।

পুলিশের কী ধারণা?

কী ধারণা কিছুই জানি না। তারা বাড়িসুদ্ধ সবাইকে সন্দেহ করছে। আমি মর্গে গিয়েছিলাম, সেখানেও আমার সঙ্গে পুলিশ গিয়েছিল।

তোর সঙ্গে?

হ্যাঁ, তা ছাড়া পুলিশ পিসিমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে।

মানসের কথা শুনে বন্ধুরা অবাক।

পিসিমাকে? তোর পিসিমা?

মানসের যখন মা মারা গিয়েছিলেন, তখন তার বয়স খুব কম। পিসিমাই তাকে বুকে করে মানুষ করেন। অনেক বছর পর্যন্ত মানস পিসিমাকে মা বলেই ডাকত। তারপর স্কুলের উঁচু ক্লাসে উঠে, বাপের কথায় পিসিমা বলতে শুরু করে।

নিজের দাদার মৃত্যুর অপরাধে বোনকে ধরে নিয়ে গেছে! কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলতে পারল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

সকলের চোখের সামনে পিসিমার শান্ত চেহারা ভেসে উঠল। গায়ের রং গজদন্তের মতন। বয়স হয়েছে কিন্তু মুখের কোথাও কুঞ্চন নেই। সেই অনুপাতে চুলও খুব বেশি পাকেনি।

সবচেয়ে আকৃষ্ট করত পিসিমার কালো আয়ত দুটি চোখ। মমতায় ভরা। সব সময়ে ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে থাকত।

একসময়ে অলকেশ প্রশ্ন করল, তোর পিসিমাকে ধরল কেন?

মানস একবার দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দুটোর দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর বলল, বাবা যে খাতাটায় গবেষণার ফলাফল টুকে রাখছিলেন, সেই খাতায় তাঁর হাতের শেষ লেখা—’লা’। জানিস তো পিসিমার নাম লাবণ্য। তাই পুলিশ সন্দেহ করছে পিসিমা এই মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত।

কিছুক্ষণ মানস চুপ করে রইল। পরে চাপাকণ্ঠে বলল, অথচ সে সময়ে পিসিমা বাড়িতেই ছিল না। খুব ভোরে উঠে কালীঘাটে চলে গিয়েছিল। পুলিশ বলছে তাতেই তাদের সন্দেহটা একটু বেশি হচ্ছে।

বন্ধুদের নিয়ে মানস একতলার ঘরে গিয়ে বসল।

বাবার গবেষণাগারে তোদের নিয়ে যেতাম, কিন্তু উপায় নেই, পুলিশ দরজায় তালা দিয়ে গেছে। কারো ভিতরে ঢোকা নিষেধ।

গবেষণাগার বাড়ির পাশেই। একতলায় লাইব্রেরি। দেয়াল আলমারি ভরা প্রচুর বই। দোতলায় মানসের বাবা গবেষণা করতেন।

সরোজ বলল, তুই এখন কী করবি?

মানস উত্তর দিল, কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবাকে তো আর ফিরে পাব না, কিন্তু পিসিমাকে যেমন করেই হোক বাঁচাতে হবে।

কী করে বাঁচাবি?

এখন আমি ভাবতেই পারছি না, সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

এবার বিজয় বলল, এক কাজ কর মানস।

বল?

কোনও ভালো গোয়েন্দার হাতে কেসটা তুলে দে। পুলিশ মামুলি প্রথায় কাজ করে। সময় লাগবে, ফল হয়তো আশাপ্রদ হবে না। তার ওপর তারা হাতের কাছে এক আসামি যখন পেয়ে গেছে, তখন অন্যদিকে আর খুব মন দেবে না।

কিন্তু ভালো গোয়েন্দা কে আছে? আমি তো এসবের কিছুই জানি না।

কেন, বিখ্যাত গোয়েন্দা ব্যোমকেশবাবু অবশ্য আর নেই, কিন্তু তাঁর ভাইপো পারিজাতবাবু রয়েছেন। কাকার মতনই নাম করেছেন আজকাল। তুই চল আমাদের সঙ্গে।

মানস হাত দিয়ে নিজের কপালের ওপর এসে-পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল, এখন কদিন তো আমি কোথাও যেতে পারব না। বুঝতেই পারছিস মনের অবস্থা।

বিজয় বোঝাল, সবই বুঝতে পারছি ভাই, কিন্তু দেরি করলে পারিজাতবাবুর আর কিছু করার থাকবে না। হয়তো পারিজাতবাবু কেসই হাতে নেবেন না।

তাহলে?

অলকেশ বলল, আমি বলি কী, কাল তো শ্মশানে ব্যস্ত থাকবি, কাল হবে না। পরশু চল। তোদের মোটরটা নিয়ে বের হব, তাহলে আর তোর ততটা কষ্ট হবে না।

মানস কোনও উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে রইল।

তিন

পারিজাতবাবুর বাড়ির দরজায় সবাই যখন গিয়ে পৌঁছাল, তখন বেলা চারটে।

অলকেশের দাদার সঙ্গে পারিজাতবাবুর কিছু আলাপ ছিল। দাদার কাছ থেকে সে একটা পরিচয়পত্র এনেছিল।

দরজায় বোতাম টিপতেই যে লোকটি এসে দাঁড়াল তাকে দেখে পাঁচ বন্ধুই একটু পিছিয়ে গেল। মিশকালো রং, পিঠে ছোটো তরমুজের সাইজের একটি কুঁজ। খোঁচা খোঁচা চুল।

কাকে চাই?

পারিজাতবাবু আছেন?

লোকটা পালটা প্রশ্ন করল, আপনারা?

অলকেশ তার দাদার লেখা পরিচয়পত্রটা এগিয়ে দিল।

কাগজটি নিয়ে লোকটি অদৃশ্য হল। মিনিটকয়েকের মধ্যেই ফিরে এসে বলল, আসুন আপনারা।

সবাই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠল।

পরদার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল, ঘরের মধ্যে চেয়ারে একটি তরুণ বসে। চোখে চশমা। গায়ের রং শ্যামলা। পাশের টেবিলে মোটা একটা বই খোলা। বোঝা গেল বইটি এতক্ষণ তিনি পড়ছিলেন।

পায়ের শব্দে মুখ তুলে প্রথমেই অলকেশকে দেখে বললেন, কী ব্যাপার অলকেশ, বাড়ির সব ভালো তো?

অলকেশ বলল, হ্যাঁ, আমাদের সব ভালো। তবে আমাদের বন্ধু মানসের বড়ো বিপদ।

বোসো, বোসো তোমরা। কী হয়েছে বলো তো?

সবাই সোফা কৌচে বসল।

মানস সব ঘটনা বলে গেল।

দুটো চোখ বন্ধ করে গালে হাত রেখে পারিজাতবাবু নিবিষ্টচিত্তে সব শুনলেন। শেষ হতে বললেন, আমি খবরের কাগজে কিছু পড়েছি। তোমার কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা শুনলাম। আচ্ছা, একটা কথা, তুমি তো খুব ছেলেমানুষ। তোমাদের বাড়িতে বড়ো কেউ নেই?

এই প্রশ্নের তাৎপর্য মানস বুঝল, কিংবা ভুলই বুঝল। সে বলল, আমার আর কেউ নেই। তবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার ফি-এর টাকা আমি ঠিক দিয়ে দেব।

পারিজাতবাবু মৃদু হাসলেন—ফি-এর জন্য বলছি না। আমার কাকার নাম নিশ্চয় শুনেছ? ব্যোমকেশ বক্সী। এসব কাজ করেই তাঁর আনন্দ। আমার হাতেখড়ি তাঁর কাছেই। বেশ, তোমাকেই কয়েকটা প্রশ্ন করি।

মানস সোজা হয়ে বসল।

তোমার বাবার কাছে কে কে আসত, জানো?

কিছু কিছু অধ্যাপক আসতেন।

তাঁদের নাম?

দুজনের নাম জানি, তাঁরাই বেশি আসতেন। একজন ভৈরব ঘোষাল— প্রেসিডেন্সির, আর-একজন নৈহাটি কলেজের বিশ্বনাথ বসু। দুজনেই উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপনা করতেন।

এঁরা কোথায় দেখা করতেন?

বাবার লাইব্রেরি-ঘরে।

এঁরা কেউ গবেষণাগারে যেতেন না?

না।

ঠিক জানো? ভালো করে ভেবে বলো।

হ্যাঁ, ঠিক জানি, কারণ বাবা গবেষণাগারে কাউকে ঢুকতে দিতেন না।

কাউকে না?

মানস একটু ভাবল, তারপর বলল, আমার পিসিমা দিনে একবার যেত।

কেন?

খুব সকালে বাবার এক পেয়ালা চা খাওয়ার অভ্যাস ছিল, তখন চাকররা কেউ উঠত না, তাই পিসিমা নিয়ে যেত।

কথাটা মানস আবার সংশোধন করে নিল।

তাও পিসিমা ভিতরে যেত না। দরজার কাছে একটা গোল টেবিল ছিল, তার ওপর পেয়ালা রেখে আসত।

কিন্তু তোমার বাবা কাউকে ঢুকতে দিতেন না কেন? কারণ কী?

কারণ, সারা ঘরে গাছপালা আর যন্ত্রপাতি ছড়ানো থাকত। পাছে কেউ সেগুলো মাড়িয়ে ফেলে, তাই এই সাবধানতা।

তুমি একটু সময় নিয়ে ভেবে বলো, কেউ ভিতরে ঢুকত না? কেউ যদি জোর করে ঢুকে পড়ে?

তা সম্ভব নয়, কারণ দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকত।

যেদিন প্রফেসর সেন মারা গেলেন?

সেদিনও বন্ধ ছিল। পুলিশ দরজা ভেঙে ঢুকেছে। ভজু চা দিতে গিয়ে অনেকবার ধাক্কা দিতেও দরজা খোলেনি।

তোমার পিসিমা? তিনিই না রোজ চা দিতেন?

সেদিন খুব ভোরে পিসিমা কালীঘাটে চলে গিয়েছিলেন।

পারিজাতবাবু ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর যেন নিজের মনে কথা বলছেন, এইভাবে বললেন, কিন্তু কেউ ঢুকত না ঘরের মধ্যে, তাও কি হয়, তা কি হতে পারে?

হঠাৎ মানস বলে উঠল, মনে পড়েছে—একজন আসত।

কে? কে সে?

এক নেপালি। নাম শের বাহাদুর।

সে আসত কেন?

সে দুষ্প্রাপ্য গাছগাছড়া নিয়ে আসত।

তাকে ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেওয়া হত কেন?

কথাটা একদিন আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বাবা বলেছিলেন, গাছগুলো পরীক্ষা করে নিতে হয়, সেইজন্যই লোকটাকে ভিতরে আসতে দেন। তা না হলে অনেক সময় ঠকতে হয়। বাজে গাছ দিয়ে যায়, যেগুলো গবেষণার কোনও কাজেই লাগে না।

মানসের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পারিজাতবাবু ফোন তুলে ডায়াল করলেন।

যোগাযোগ হতে বললেন, চন্দনপুর থানা? ও.সি. মিস্টার লাহিড়ীকে দিন।

ওদিক থেকে কে কী বলল, শোনা গেল না। পারিজাতবাবু বলে গেলেন, প্রফেসর সেনের কেসটা আমি হাতে নিয়েছি। কাল একবার যাব আপনাদের ওখানে, আমাকে গবেষণাগার দেখাবেন। অ্যাঁ, স্বীকার করেছেন? কে স্বীকার করেছেন? লাবণ্যদেবী?

ফোন চাপা দিয়ে পারিজাতবাবু মানসের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, লাবণ্যদেবী কে?

অশ্রুরুদ্ধ গলায় মানস উত্তর দিল, আমার পিসিমা।

তিনি স্বীকার করেছেন, বলছে?

কী জানি, কিছু বুঝতে পারছি না।

হাত সরিয়ে পারিজাতবাবু আবার ফোনে কথা বললেন, ঠিক আছে, আমি তো কাল যাচ্ছি, তখন সব কথা হবে। কাল দশটা নাগাদ। আচ্ছা, নমস্কার।

পারিজাতবাবু ফোন নামিয়ে রাখলেন।

চার

পারিজাতবাবু যখন চন্দনপুর থানার সামনে পৌঁছালেন, তখন কাঁটায় কাঁটায় দশটা।

ও.সি. এগিয়ে এল, আসুন পারিজাতবাবু।

পারিজাতবাবু বললেন, আমি আর নামব না। আপনি বরং গাড়িতে উঠে আসুন। আগে গবেষণাগারটি দেখে আসি।

ও.সি. পারিজাতবাবুর পাশে বসল।

সুধা-নিবাস পৌঁছে দুজনে সোজা গবেষণাগারে এসে ঢুকল।

মোটরের শব্দ পেয়ে মানস ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, কিন্তু পারিজাতবাবু হাত নেড়ে তাকে বারণ করলেন, তোমার এখন আমাদের সঙ্গে গবেষণাগারে আসবার দরকার নেই, মানস। আমি পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব।

ও.সি. চাবি দিয়ে দরজা খুলল। দরজার কাছে যে পুলিশ বসে ছিল, সে দাঁড়িয়ে উঠে সেলাম করল।

পারিজাতবাবু ভিতরে ঢুকে ও.সি.-র দিকে ফিরে বললেন, আশা করি আঙুলের ছাপ যা নেবার আপনার লোক সবই নিয়ে গেছে। আমি নির্বিবাদে সব জিনিস ছুঁতে পারি?

হ্যাঁ, তা পারেন।

পারিজাতবাবু প্রথমে দাঁড়িয়ে ঘরটা নিরীক্ষণ করে দেখলেন। কোনও জানালা নেই। গোটা চারেক ভেন্টিলেটার। মাথার ওপর স্কাইলাইট। বাইরের কোনও লোক তো দূরের কথা, ছোটোখাটো জন্তুজানোয়ারের পক্ষেও ভিতরে ঢোকা অসম্ভব।

আমেরিকার একটা পত্রিকায় পড়েছিলেন, হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সেখানে এক বেবুনকে কাজে লাগানো হয়েছিল। খুব ছোটো জায়গা দিয়ে তাকে গলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে তাও সম্ভব নয়।

টেবিলোর দু-পাশে ড্রয়ার। একটা ড্রয়ারে চাবির গোছা ঝুলছে।

পারিজাতবাবু টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতেই ও.সি. বলল, ওসব দেখা হয়ে গেছে, একটা নোটবই ছাড়া আর কিছু নেই। নোটবইতে গোটা দুয়েক ঠিকানা, ব্যাস, তা থেকে কিছুর হদিশ পাবার উপায় নেই।

ড্রয়ারগুলো সব দেখে পারিজাতবাবু নোটবইটা তুলে নিয়ে পাতা ওলটাতে লাগলেন। মাত্র গোটা তিনেক পাতাতে লেখা আছে। আর সব খালি।

কতকগুলো গাছের ল্যাটিন নাম, তার তলায় শের বাহাদুরের ঠিকানা। এ ছাড়া দুজন অধ্যাপকের ঠিকানাও রয়েছে।

পারিজাতবাবু বললেন, একটা জিনিস জোগাড় করে দিতে পারেন?

পারতেই হবে, আপনি ডেপুটি কমিশনারের বন্ধু, নইলে চাকরি থাকবে না। জিনিসটা কী, বলুন?

একটা কাঠ কিংবা বাঁশের মই।

ঠিক আছে, দেখছি। কিন্তু মই কী করবেন? স্কাইলাইট দেখবেন? ওখানে ডবল তালা দেওয়া।

পারিজাতবাবু হতাশকণ্ঠে বললেন, মুশকিল, সবই তো আপনারা দেখে রেখেছেন। যাহোক, মইটা আনাবার ব্যবস্থা করুন। আমি নিজে একবার দেখি।

ও.সি. বাইরে যেতেই পারিজাতবাবু নোটবইটা নিজের পকেটের মধ্যে পুরে ফেললেন। তারপর হাঁটু মুড়ে বসে টেবিলের নীচে তন্ন তন্ন করে দেখতে লাগলেন।

শুকনো একটা ডাল টেবিলের ফাঁকে আটকে ছিল, সেটাও পকেটে ভরলেন। ইতিমধ্যে ও.সি. ফিরে এল। পিছনে বাঁশের মই কাঁধে এক মালি।

পারিজাতবাবু প্রশ্ন করলেন, মইটা প্রায় নতুন দেখছি।

মালি বলল, মাস দুয়েক আগে বাড়িটা চুনকাম করা হয়েছে, সেই সময় এটা তৈরি হয়েছিল।

ঘরামিরা মই আনেনি?

তারা যে মই এনেছিল সেটা খুব পুরোনো বাঁশের, সেটা ভেঙে যাওয়াতে বাবুই এটা তৈরি করান।

পারিজাতবাবু আর কথা বললেন না। মইটা টেনে নিয়ে দেয়ালের গায়ে লাগালেন।

ও.সি. হাই তুলল। আপনার পরীক্ষা চালান মশাই, আমি ততক্ষণ মানসকে বলে একটু চায়ের বন্দোবস্ত করি।

প্রথমে স্কাইলাইট, তারপর প্রত্যেকটি ভেন্টিলেটার পারিজাতবাবু পরীক্ষা করলেন। ক্রমে তাঁর মুখ বেশ গম্ভীর হয়ে উঠল।

ও.সি. ফিরল প্রায় আধ ঘণ্টা পর। পিছনে ভজুর হাতে চায়ের সরঞ্জাম।

আসুন পারিজাতবাবু, চায়ের সদব্যবহার করা যাক। কী, ভেন্টিলেটার দিয়ে আততায়ী এসেছিল, তা-ই বুঝি আপনার মত?

এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পারিজাতবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা লাবণ্যদেবীকে গ্রেপ্তার করলেন কেন?

ও.সি. মুচকি হাসল—আপনাদের মতন গোয়েন্দারা তো পুলিশকে পাত্তাই দেন না। আপনাদের ধারণা, সব পুলিশ অফিসাররাই গোবরগণেশ।

পারিজাতবাবু জিভ কাটলেন—ছি ছি, আকাট মূর্খ না হলে এমন কথা কেউ বলে! আপনারা যখন গ্রেপ্তার করেছেন, তখন কারণ একটা নিশ্চয় আছে, সেটাই জানতে চাইছি, নিতান্ত কৌতূহল।

প্রথম কারণ, প্রফেসর সেন নিজেই কাগজে লাবণ্যদেবীর নামের প্রথম অক্ষর ‘লা’ লিখে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় কারণ, আসামি স্বীকার করেছেন, নিহত ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পুরোনো মনোমালিন্য ছিল।

মনোমালিন্য?

হ্যাঁ, লাবণ্যদেবীর এক ছেলেকে প্রফেসর সেন বাড়ি থেকে বের করে দেন। তারপর ছেলেটি আত্মহত্যা করে।

এসব কত দিনের কথা?

তা, বছর দশেক। লাবণ্যদেবী এসব মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন। সম্ভবত সুযোগ খুঁজছিলেন।

হুঁ? তা লাবণ্যদেবী ঘরের মধ্যে ঢুকলেন কী করে? দরজা তো বন্ধ ছিল।

ঢুকবেন কেন, ঢুকেই ছিলেন। আগের রাত্রে খাবার দেবার সময় এসেছিলেন। তারপর খাবারে বিষ মিশিয়ে বেরিয়ে যান।

আর দরজা বন্ধ করার ব্যাপার?

প্রফেসর সেন দরজা বন্ধ করে খেতে বসেন। তারপরই সর্বনাশ।

চা-পান শেষ করে পারিজাতবাবু উঠে দাঁড়ালেন।

চলুন, একবার আপনার থানায় যাব।

ও.সি.-ও উঠল।

থানায় এসে পারিজাতবাবু কাগজপত্র নিয়ে বসলেন।

সাদা একটা কাগজ। তার ওপর একটা অক্ষর বড়ো বড়ো করে লেখা—’লা’। অক্ষর একটু অস্পষ্ট।

পোস্টমর্টেম রিপোর্টে লেখা আছে, তীব্র বিষের প্রক্রিয়ায় মৃত্যু। কিন্তু পাকস্থলীতে কোনও বিষয় পাওয়া যায়নি। বিষের স্বরূপ সম্বন্ধে সঠিক কিছু জানা যায়নি।

দেখা শেষ হলে পারিজাতবাবু বললেন, আমি একবার লাবণ্যদেবীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

আসুন।

হাজতঘরের মধ্যে আধো-অন্ধকার একটা প্রকোষ্ঠে ঢুকতে গিয়েই পারিজাতবাবু ফিরে দাঁড়ালেন।

একটা অনুরোধ, আমি একলা দেখা করতে চাই।

ও.সি. একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল, তারপর সামলে নিয়ে বলল, বেশ, আমি অফিস-ঘরে অপেক্ষা করছি।

পাঁচ

প্রথমে মনে হয় যেন পাষাণমূর্তি। নিশ্চল নিথর। পারিজাতবাবু কাছে যেতে লাবণ্যদেবী চোখ ফেরাল, কে?

আমি মানসের কাছ থেকে আসছি।

মানসের কাছ থেকে? সে কেমন আছে?

ভালোই আছে। আমি খোলাখুলিভাবে আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে চাই।

লাবণ্যদেবী কোনও কথা বলল না। একটু সরে বসল। কম্বল পাতা রয়েছে। কম্বলের ওপর পারিজাতবাবু বসলেন।

মা, একটা কথা আপনাকে আগেই জানাতে চাই। আমি পুলিশের লোক নই। মানস আমাকে আপনার দাদার মৃত্যুর ব্যাপারটা তদারক করার ভার দিয়েছে।

তাহলে আপনি গোয়েন্দা?

এ প্রশ্নের সরাসরি কোনও উত্তর না দিয়ে পারিজাতবাবু বললেন, আপনি ব্যোমকেশবাবুর নাম শুনেছেন?

ব্যোমকেশ বক্সী?

হ্যাঁ, আমি তাঁরই ভাইপো। আমি শুধু একটা প্রশ্ন আপনাকে করব, আমি জানি আপনি নির্দোষ। অন্যায়ভাবে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কিন্তু আপনি নাকি দোষ স্বীকার করেছেন?

লাবণ্যদেবী নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। সকাল, দুপুর, বিকাল সব সময় কেবল এদের জেরা—কেন আপনি এ কাজ করলেন? কেন এ কাজ করলেন?

আপনার ছেলের ব্যাপারে কী একটা উক্তি আপনি করেছেন?

কী বলেছি?

আপনার ছেলের মৃত্যুর জন্য আপনার দাদা দায়ী!

লাবণ্যদেবী চমকে উঠল।

সে কী? অনুপমের মৃত্যুর জন্য দাদা দায়ী? দাদা তাকে অনেক উপদেশ দিয়েছে ভালো হবার। আমিই বরং গালাগাল দিয়েছি। মা হয়ে তার মৃত্যুকামনা করেছি। সে আমারই ওপর রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিল। তারপর আত্মহত্যা করেছে। সবই আমার অদৃষ্টের দোষ, দাদাকে দায়ী করব কেন?

একটু থেমে লাবণ্যদেবী বলল, শুনলাম দাদা নাকি একটা কাগজে ‘লা’ লিখে গেছে। এত দ্রুত মৃত্যু এসেছিল যে বাকি অক্ষরগুলো আর লিখতে পারেনি। পুলিশ সন্দেহ করছে, ‘লা’ আমার নামের আদ্যাক্ষর।

পারিজাতবাবু মুচকি হাসলেন—

‘লা’ শুধু লাবণ্যের আদ্যাক্ষরই নয়, আরও অনেক শব্দের আদ্যক্ষর। এই থানার ও.সি.-র নাম রাখাল লাহিড়ী। লাহিড়ীর আদ্যাক্ষরও ‘লা’। যাক, আপনি লিখে কোনও স্বীকারোক্তি দেবেন না। আপনাকে বের করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আমি শীঘ্রই করছি। নমস্কার।

পারিজাতবাবু আবার অফিস-ঘরে ঢুকলেন। কী হল?

পারিজাতবাবু উত্তর দিলেন, হয়নি কিছু। আমি চলি।

লাবণ্যদেবীর সঙ্গে কথা বলে সবই তো বুঝতে পারলেন।

কিছুই বুঝতে পারিনি। যাক, পরে আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হবে।

পারিজাতবাবু আবার সুধা-নিবাসে এলেন। মানসকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, একটা কথা মানস, তোমাদের ওই গবেষণাগারের চুনকামের কাজ কোন মিস্ত্রি করেছিল, জানো?

এসব কাজ আরিফ খাঁ-ই করে। তার সঙ্গে দুজন মজুর থাকে।

তুমি আরিফের ঠিকানা জানো?

আমি জানি না, ভজু জানে।

ভজুকে ডাকা হল।

ভজু ঠিকানা জানে না, বস্তিটা চেনে।

তুমি আমার সঙ্গে এখন যেতে পারবে?

পারব বাবু।

এসো।

মোটরে ভজু দু-একটা কথা বলার চেষ্টা করেছিল, পারিজাতবাবু উত্তর দেননি।

অনেকটা পথ গিয়ে বিরাট এক বস্তি। পাঁচমিশেলি ভাড়াটে। উঠোনে মুরগি, শুয়োর চরছে।

ওই কোণের ঘরটা। ভজু আঙুল দিয়ে দেখাল।

তুমি মোটরে থাকো ভজু, তোমার নামবার দরকার নেই। আমি যতক্ষণ না ফিরি বসে থাকবে।

পারিজাতবাবু নেমে গেলেন।

আরিফ বাড়িতেই ছিল। কঞ্চি দিয়ে মুরগির ঘর মেরামত করছিল। পারিজাতবাবুর ডাকে সামনে এসে দাঁড়াল।

তোমার সঙ্গে দরকারি কথা আছে আরিফ। আমি থানা থেকে আসছি।

স্পষ্ট দেখা গেল থানার নামে আরিফের মুখ পাংশু হয়ে গেল।

কী কথা, বলুন?

এখানে হবে না। আমার সঙ্গে এসো।

পারিজাতবাবুর সঙ্গে আরিফ হাঁটতে আরম্ভ করল। মাঠের একপাশে বট-অশত্থের জটলা। অনেকটা জায়গা জুড়ে ছায়া। পারিজাতবাবু ছায়ায় দাঁড়ালেন, সুধা-নিবাস চেনো? চন্দনপুরে?

হ্যাঁ হুজুর, চিনি। সেনবাবুর বাড়ি।

মাসকয়েক আগে সেখানে একটা ঘর তুমি চুনকাম করেছিলে?

শুধু চুনকামই নয়, স্কাইলাইট, ভেন্টিলেটারে রংও লাগিয়েছিলাম।

কাজ ঠিকমতো করেছিলে?

ও বাড়ির সব কাজ আমার তদারকিতেই হয়, হুজুর। কাজে আমি কোনওদিন ফাঁকি দিই না।

এবার পারিজাতবাবুর কণ্ঠ রীতিমতো গম্ভীর।

সত্যি কথা বলো, কে তোমাকে একটা ভেন্টিলেটার আলগা করে বসাতে বলেছিল?

ভেন্টিলেটার আলগা?

বোকা সাজার চেষ্টা কোরো না, বিপদে পড়বে।

সত্যি বলছি হুজুর, আমি—

আরিফ, ভীষণ বিপদে পড়বে। ঠিক করে বলো।

আরিফ একটু ইতস্তত করল, তারপর খুব মৃদুকণ্ঠে বলল, সে আমাদের বস্তিতেই থাকে।

কী নাম?

বলরাম।

কী করে লোকটা?

সাপ খেলিয়ে বেড়ায়।

এখন লোকটা আছে?

জানি না, হুজুর।

এসো আমার সঙ্গে।

দুজনে আবার বস্তিতে ফিরে এলেন।

বলরামের নাম ধরে ডাকতে একটা কুচকুচে কালো লোক বেরিয়ে এল। মাথায় জটা, কানে মাকড়ি, গলায় কড়ির মালা। একেবারে নিখাদ সাপুড়ের পোশাক।

ইনি তোর সঙ্গে কথা বলবেন, বলরাম।

বলরাম চোখের কোণ দিয়ে পারিজাতবাবুকে দেখে নিয়ে তাচ্ছিল্যভরা কণ্ঠে বলল, আমার সঙ্গে আবার কী কথা?

বস্তির উঠানে দু-একটা লোক ঘোরাফেরা করছে। বলা যায় না, চেঁচামেচি হলে তারাও হয়তো এসে দাঁড়াবে। দিনকাল খারাপ। পারিজাতবাবু একেবারে একলা, তবে নিঃসহায় মন, পকেটে রিভলভার আছে।

বিষধর সাপ ধরতে পারো, বলরাম?

বিষহরির আশীর্বাদে পারি বই কী হুজুর।

তবে এসো আমার সঙ্গে। আমার বাড়ির সামনে ইটের পাঁজার মধ্যে একজোড়া কালনাগিনি রয়েছে। সে দুটোকে ধরতে হবে। ভালো টাকা পাবে।

তাহলে একটু দাঁড়ান হুজুর, আসছি।

বাড়ির মধ্যে ঢুকে বলরাম একটা মাটির কলসি আর বাঁশের বাঁশি নিয়ে এল। পারিজাতবাবু দুজনকে নিয়ে মোটরের কাছে এস দাঁড়ালেন, তারপর পিছনের দরজা খুলে দিয়ে বললেন, নাও, উঠে বোসো।

আরিফ আর বলরাম উঠে বসল।

ছয়

একেবারে সোজা সুধা-নিবাস।

পারিজাতবাবু মানসকে ডেকে বললেন, তোমার পড়ার ঘরটা কোথায়?

একতলায়।

ঘরটা একটু আমাদের ছেড়ে দিতে হবে। আধ ঘণ্টার জন্য।

একটা চেয়ারে পারিজাতবাবু গিয়ে বসলেন, সামনের চেয়ার দুটোতে বসালেন আরিফ আর বলরামকে।

বলরাম অনুযোগ করল। কই বাবু, ইটের পাঁজা কই? সাপ ধরতে বলছিলেন?

পারিজাতবাবু সে কথার কোনও উত্তর না দিয়ে পকেট থেকে রিভলভার বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন।

বলরাম, তুমি আরিফকে বলেছিলে এ বাড়ির একটা ভেন্টিলেটার আলগা করে রাখতে?

আজ্ঞে বাবু, আপনার কথা আমি ঠিক—

হাতে হাতকড়ি পড়লে ঠিক বুঝতে পারবে। জানি, এটা তোমার মতলব নয়। কে তোমাকে এ কাজ করতে বলেছে, তার নামটা বলো।

বলরাম নিরুত্তর।

পারিজাতবাবু হুংকার দিলেন, কী হে, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না মনে হচ্ছে। পারিজাতবাবু রিভলভারটা হাতে তুলে নিলেন।

এবার বলরাম ভেঙে পড়ল। হাঁটু মুড়ে বসে পারিজাতবাবুর দুটো পা চেপে ধরে বলল, আমার কোনও দোষ নেই বাবু। নেপালি আমাকে এই মতলব দিয়েছিল।

নেপালি? তার নাম?

নাম তো জানি না।

তোমার সঙ্গে পরিচয় হল কী করে?

আজ্ঞে, বেশি দিনের পরিচয় নয়। লোকটা আমার কাছ থেকে বার দুয়েক সাপ কিনেছিল।

সাপ? কেন?

বাবু, আমারও একটু কৌতূহল হয়েছিল। আমি জিজ্ঞাসা করতে বলেছিল, কলেজে কলেজে নাকি সাপ বিক্রি করে। সেখানে সাপ কেটেকুটে কী সব হয়!

লোকটার আস্তানা জানো?

না আজ্ঞে। লোকটাই আমার কাছে আসত। আমার যাবার দরকার হয়নি।

লোকটাকে দেখতে কেমন?

সাধারণ নেপালি যেমন হয়। মাথায় কালো টুপি পরত। খুব সুন্দর বাংলা বলত, বাংলা পড়তেও নাকি জানত। কাঁধে সর্বদা একটা ঝোলা থাকত।

ঝোলা কেন? ঝোলাতে সাপ নিয়ে যেত?

না বাবু, ঝোলাতে কখনো সাপ নিয়ে যাওয়া যায়! ওতে সব গাছগাছড়া থাকত। সেগুলোও নাকি কলেজে কলেজে বিক্রি করত।

তোমাকে লোকটা ভেন্টিলেটারের কথা কী বলেছিল?

একদিন বিক্রি করার মতন কোনও সাপ ছিল না। লোকটা দাওয়ায় বসে গল্প করছিল, হঠাৎ বলল, বলরাম তুমি আরিফ মিস্ত্রিকে চেনো?

বললাম, খুব চিনি। আমরা তো এক বস্তিতেই থাকি। ও-ই তো আরিফের চেলা। তখন বলল, বলরাম এখন তো তোমার হাতে সাপ নেই, কিছু টাকা রোজগার করবে তো বলো। টাকা রোজগার করতে কে না চায়, হুজুর। জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে? সোজা পথে হলে করব।

লোকটা হেসে উঠে বলল, আরে সোজা পথে বই কী। এক বাবুর সঙ্গে আমার একটা ব্যাপারে বাজি হয়েছে। তাহলে সব কথা তোমায় খুলেই বলি। বলে বলল, সুধা-নিবাসের মালিক আমার অনেক দিনের চেনা। আমার কাছ থেকে গাছগাছড়া কেনেন। তাঁর ধারণা আরিফের মতন মিস্ত্রি ভূভারতে নেই। আমি আমার জানা আর-একজন মিস্ত্রির কথা বলেছিলাম, কিন্তু তিনি আরিফকে সরাতে নারাজ। তাই আমি একটা মজা করতে চাই।

দু-একদিনের মধ্যে আরিফ সুধা-নিবাসের একটা ঘর চুনকাম করতে যাবে। এই নাও তোমাকে আমি পঞ্চাশ টাকা দিচ্ছি, এ থেকে তোমার যা খুশি আরিফকে দিয়ো। তাকে শুধু বলবে বাগানের দিকের ভেন্টিলেটারটা যেন আলগা করে রাখে। ব্যাস, আর কিছু নয়।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এতে আরিফের কোনও ক্ষতি হবে না?

আরে না, না! কী ক্ষতি হবে? তা ছাড়া আমি যে মিস্ত্রির কথা বলেছিলাম, সে মারা গেছে। কাজেই আরিফকে বদলানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমি শুধু ভদ্রলোকের কাছে একশো টাকা বাজি ধরেছি। আরিফের কাজে কোনও ত্রুটি আছে প্রমাণ করতে পারলেই টাকাটা আমি জিতে যাব। কাজেই বুঝতে পারছ আমার পঞ্চাশ টাকা লাভ। তারপর আমি গিয়ে আরিফকে বললাম। প্রথমে সে কিছুতেই রাজি হয়নি। বলেছিল, না আমার ইজ্জত যাবে। বাবুর কাছে আমি কী কৈফিয়ত দেব? তারপর পঁচিশ টাকা হাতে দিয়ে অনেক বোঝানোর পর সে রাজি হয়েছিল তা-ই না, আরিফ?

আরিফ মাথা নাড়ল হ্যাঁ হুজুর, সব সত্যি। তারপর এ বাড়ির বাবু আমাকে আর ডেকে কিছু না বলাতে আমি ভেবেছিলাম, ব্যাপারটা মিটে গেছে।

পারিজাতবাবু তীক্ষ্ন দৃষ্টি দিয়ে আরিফকে দেখে নিয়ে বললেন, এ বাড়ির বাবুর কী হয়েছে জানো?

কী হয়েছে?

তাঁকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।

অ্যাঁ?

তারপরই আরিফ কেঁদে ফেলল।

বিশ্বাস করুন হুজুর, আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না। অমন শরিফ লোক আমি আর কোনওদিন দেখিনি। একবার অসুখের সময় আমাকে চল্লিশ টাকা দিয়েছিলেন, সে টাকা আর ফেরত নেননি। কিন্তু হুজুর, ওই ভেন্টিলেটার সরানোর সঙ্গে বাবুর মারা যাবার কোনও সম্পর্ক আছে?

জানি না। এখন তোমরা যেতে পারো।

পারিজাতবাবু উঠে দাঁড়ালেন। আরিফ আর বলরাম বেরিয়ে যাবার মুখে আবার তিনি বললেন, এসব কথা পাঁচকান না হয়। তাহলে কিন্তু ভীষণ মুশকিলে পড়বে।

বলরাম বলল, আজ্ঞে না, এসব কথা আমরা কাউকে বলব না। আপনি শুধু দেখবেন, বউ-ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি, যেন বিপদে না পড়ি।

আচ্ছা বলরাম, সেই নেপালি আর তোমার কাছে এসেছিল?

এখনও আসার সময় হয়নি। মাসের প্রথম সপ্তাহে আসবে বলে গেছে।

তুমি তার ঠিকানাটা জেনে নিতে পারবে?

জিজ্ঞাসা করব, যদি বলে তো জেনে নেব। কিন্তু আপনাকে কোথায় পাব হুজুর?

আমি সামনের মাসের প্রথমদিকে আবার তোমার সঙ্গে দেখা করব।

আরিফ আর বলরাম চলে যেতে পারিজাতবাবু মানসকে ডাকলেন।

এই কদিনে মানসের চেহারা যেন আরও শীর্ণ হয়ে গেছে।

মানস, যে লোকটি তোমার বাবাকে গাছগাছড়া দিত তার নাম বলেছিলেন শের বাহাদুর, তা-ই না?

মানস সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল।

তার সঙ্গে তোমার আলাপ আছে?

আলাপ মানে, মাঝে মাঝে বাবা ব্যস্ত থাকলে লোকটা আমার পড়ার ঘরে বসে থাকত।

লোকটাকে দেখতে কেমন?

দেখতে সাধারণ নেপালির মতন, কিন্তু আলোচনা করলে বোঝা যায়, লোকটার খুব পড়াশোনা আছে। ইংরেজি, বাংলা আর নেপালি ভাষায় বেশ জ্ঞান।

কিন্তু এরকম একটা জ্ঞানী লোক লোকের কাছে সাপ আর গাছগাছড়া বিক্রি করে বেড়ায়, এটা আশ্চর্য নয়?

আমিও ওকে প্রশ্ন করেছিলাম, ও আমাকে বলেছিল, এ ছাড়া ওর অন্য ব্যাবসাও আছে। কী ব্যাবসা, আমি আর জিজ্ঞাসা করিনি।

হুঁ, কিন্তু কেউ তার ঠিকানা বলতে পারছে না। তোমার বাবার নোটবইয়ে অবশ্য একটা ঠিকানা আছে, কিন্তু আমার মনে হয় ঠিকানা জাল! যাক, উঠি আজকে। বোধহয় তোমার পিসিমাকে কালই ছেড়ে দেবে।

ছেড়ে দেবে পিসিমাকে?

মানস উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।

মনে হচ্ছে। আচ্ছা, আজ চলি।

সাত

বাড়ি ফেরার সময় পারিজাতবাবু একটা বাড়ির সামনে নামলেন।

গেটের মাথায় বিরাট সাইনবোর্ড—দি ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি।

পারিজাতবাবু মোটর থেকে নেমে সোজা ভিতরে ঢুকলেন।

রুপোলি চুল ব্যাকব্রাশ করা। চোখে কড়া পাওয়ারের চশমা। রং একসময়ে উজ্জ্বল গৌরব ছিল, এখন তামাটে। প্রৌঢ় ভদ্রলোক হেসে অভ্যর্থনা করলেন, কী পারিজাত, অনেকদিন পরে এলে। কী খবর?

পারিজাতবাবু পকেট থেকে একটা খাম বের করে ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে বললেন, ডক্টর রুদ্র, এটার সম্বন্ধে আমার একটা রিপোর্ট চাই। একটা অনুরোধ আছে।

কী বলো?

এটা আপনি নিজের হাতে করবেন। গোপনীয় এবং জরুরি।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি বলছ যখন নিশ্চয় করব।

কথার সঙ্গে সঙ্গে ডক্টর রুদ্র খাম থেকে একটা ডাল বের করলেন। ডালের গায়ে ছোটো ছোটো দুটো পাতা। সেগুলো শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে।

ইস, এ যে একেবারে শুকিয়ে নিয়ে এসেছ হে।

আজই হাতে এসেছে। এর আগে আনা সম্ভব ছিল না।

বেশ, দেখি কতটা কী করতে পারি।

ডক্টর রুদ্র ডালটা পাশের জারের একটা তরল পদার্থের মধ্যে ফেলে দিলেন। তারপর পারিজাতবাবুকে উদ্দেশ করে বললেন, তোমাকে আর আসতে হবে না। কাল সকালে আমি রিপোর্টটা তোমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেব।

ধন্যবাদ।

পারিজাতবাবু নিজের মোটরে ফিরে এলেন। তাঁর চোখ-মুখে দারুণ দুশ্চিন্তার ছাপ। মনে হল গভীরভাবে কিছু ভাবছেন।

সারাদুপুর পারিজাতবাবু নোটবইটা ওলটালেন।

প্রফেসর সেনের লেখা গাছের ল্যাটিন নামগুলো আলাদা একটা কাগজে লিখে নিলেন। নিজের ডায়েরিতে লিখলেন শের বাহাদুরের ঠিকানা। ঠিকানা দেখে মনে হচ্ছে খিদিরপুরেই হবে।

বিকাল হতেই লালবাজারে ফোন করলেন। ডেপুটি কমিশনার সত্যেন সেনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন। ঠিক হল সন্ধ্যা ছ-টা নাগাদ তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন। সাড়ে চারটের সময় পারিজাতবাবু মোটর নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

মনসাতলা লেন খুঁজতে মোটেই দেরি হল না। কিন্তু বাড়ির নম্বর নিয়ে একটু মুশকিল হল।

অনেক ঘোরাঘুরির পর সন্ধান মিলল। একটা গ্যারাজের পিছনে টিনের মস্ত চালা। গ্যারাজেরই একটি লোক বলল, সেখনে কিছু নেপালি থাকে।

মোটর রেখে পারিজাতবাবু নেমে গেলেন।

একটা খাটিয়ার ওপর দুজন নেপালি আর ঘাসের ওপর আর-একজন বসে গল্প করছে।

পারিজাতবাবুকে দেখে কথা থামিয়ে সবাই ঘুরে বসল।

এখানে শের বাহাদুর কে আছে?

শের বাহাদুর! সবাই পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। একজন বলল, এখানে ও নামে তো কেউ থাকে না। ঠিকানা কী?

পারিজাতবাবু ঠিকানা বললেন।

হ্যাঁ, ওটা এই গ্যারাজেরই ঠিকানা, কিন্তু শের বাহাদুর এখানে কেউ নেই।

এখানে ছজন নেপালি থাকে, সবাই বিভিন্ন অফিসের দরোয়ান। এখানে থাকার জন্য তাদের পয়সা দিতে হয় না। পালা করে রাত জেগে গ্যারাজ পাহারা দেয়। বাবু, শের বাহাদুরকে খুঁজছেন কেন?

আমার অফিসে কাজের জন্য অনেক করে বলেছিল। এই ঠিকানাও দিয়েছিল। তখন কোনও চাকরি ছিল না, এখন আমাদের দরোয়ান তিন মাসের ছুটিতে যাচ্ছে।

একজন নেপালি উৎসাহিত হয়ে উঠল, আমার এক ভাই আছে, সাব। খুব বিশ্বাসী, তাকে রাখতে পারেন।

পারিজাতবাবু সে কথায় বিশেষ কান দিলেন না। শের বাহাদুর বলে কেউ আসেও না এখানে?

না সাব, ও নামের কাউকে আমাদের জানা নেই।

পারিজাতবাবু মোটরে এসে উঠলেন।

অবশ্য ব্যাপারটা যে এমন হবে তা তিনি আগেই আন্দাজ করেছিলেন। ঠিকানাটা জাল।

দু-একটা কলেজে খোঁজ করা যেতে পারে। বোটানি ডিপার্টমেন্ট-এ। কিন্তু বিশেষ ফল হবে বলে মনে হয় না। সব জায়গাতেই ভুল ঠিকানা দেওয়া আছে।

সন্দেহজনক কাজের মানুষ না হলে ভুল ঠিকানা দেওয়ার তাৎপর্য কী? কিন্তু কলকাতার এই জনসমুদ্রে শের বাহাদুরকে খুঁজে বের করার উপায় কী!

পারিজাতবাবু লালবাজারে এলেন।

সোজা ডেপুটি কমিশনারের ঘরে ঢুকতে সত্যেন সেন বললে, কী খবর বলো, পারিজাত? আজকাল এদিকে আসোই না।

দরকার হয় না বলে আপনাদের আর বিরক্ত করি না।

ব্যোমকেশবাবুর মতন নাম করার চেষ্টায় আছ?

পারিজাতবাবু দুটো হাত জোড় করলেন। কেন লজ্জা দেন। কার সঙ্গে কার তুলনা। কাকা এ লাইনে প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি।

যাক, কী প্রয়োজন বলো।

প্রফেসর সেনের কেসটা আমি হাতে নিয়েছি।

সে খবর পেয়েছি। কীরকম এগোচ্ছে তদন্ত? আমার চন্দনপুর থানা নাকি একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রফেসর সেনের বোন।

সেই সম্বন্ধেই আপনাকে বলতে এসেছি।

বলো।

পাইপ মুখে সত্যেন সেন চেয়ারে হেলান দিলেন। পারিজাতবাবু ধীরে ধীরে সবকিছু বললেন, নিজের মন্তব্যও।

আমার মনে হয়, ভদ্রমহিলাকে আটকে রাখা অর্থহীন।

সত্যেন সেন অ্যাশট্রেতে পাইপ ঝাড়লেন, তারপর কিছুক্ষণ কী চিন্তা করে বললেন, একেবারে ছাড়া সম্ভব হবে না। তবে বাড়িতে নজরবন্দি রাখার অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি। কার মনে কী অভিসন্ধি থাকে কিছুই বলা যায় না পারিজাত, বুঝলে।

আর-একটা কথা।

কী বলো?

নেপালি অপরাধীদের যে অ্যালবাম আছে সেটা একবার দেখা দরকার।

বেশ, আনিয়ে দিচ্ছি।

কলিং বেল বাজাতে গিয়ে সত্যেন সেন বাধা পেলেন।

পারিজাতবাবু বললেন, আজ নয়। একটি ছেলেকে, মানে প্রফেসর সেনের ছেলেকে একদিন সঙ্গে নিয়ে আসব। তখন দরকার।

ঠিক আছে, আগে থেকে ফোন করে এসো।

তারপর একটু থেমে আবার বললেন, অপরাধী কি নেপালি নাকি?

এখনও কিছুই জানি না।

সত্যেন সেন হাসলেন—জানো না, না পুলিশের লোককে কিছু বলা বারণ?

পারিজাতবাবুও হেসে উঠে পড়লেন।

পরের দিন সারাটা দুপুর পারিজাতবাবু কলেজে কলেজে ঘুরলেন। অনেক কলেজই বলল, গাছগাছড়া সংগ্রহ করার লোক তাদের আছে। কেবল দুটি কলেজ বলল, একজন নেপালি তাদের এসব দিয়ে যায়। তার ঠিকানা পাতিপুকুর আর চেহারার বর্ণনা যা দিল, তাতে পারিজাতবাবু হতাশ হলেন।

বাড়িতে ফিরে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন তিনি। ব্যোমকেশবাবুর কথা মনে হল। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন পারিজাতবাবু এ পথে আসেননি বটে, কিন্তু অসীম মনোযোগ দিয়ে ব্যোমকেশবাবুর কর্মপদ্ধতি অনুধাবন করেছিলেন।

জটিল রহস্যের জাল কত সহজে তিনি ছিন্ন করতেন। প্রায় অবিশ্বাস্য তৎপরতায়।

পারিজাতবাবুকে আবার হতাশ হতে হল।

মানসকে সঙ্গে নিয়ে তিনি লালবাজারে গিয়েছিলেন।

নেপালি অপরাধীদের অ্যালবাম তাকে দেখানো হয়েছিল।

কিন্তু না, সেখানে শের বাহাদুরের ফোটো নেই।

শুধু দুর্ধর্ষ অপরাধীদের ফোটোই অ্যালবামে থাকে। হয়তো শের বাহাদুরের এটা প্রথম অপরাধ। কিংবা তার পিছনে অন্য কেউ আছে, শের বাহাদুর যার হাতের পুতুল!

সব অপরাধীদের একটা উদ্দেশ্য থাকে। উদ্দেশ্যহীনভাবে কেউ কাউকে হত্যা করে না।

প্রফেসর সেনকে হত্যা করার পিছনে শের বাহাদুরের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? অবশ্য যদি সে প্রকৃত অপরাধী হয়!

আচ্ছা মানস, তোমার বাবার সঙ্গে শের বাহাদুরের কখনো চেঁচামেচি বা কথা কাটাকাটি হয়েছিল?

আমার তো কানে যায়নি। শের বাহাদুর লোকটি খুব শান্ত প্রকৃতির ছিল। অতি বিনয়ী। কথাও বলত খুব চাপা গলায়। আপনার কি মনে হয় সে এ কাজ করেছে?

আমার কিছুই মনে হয় না, মানস। সত্যি কথা বলতে কী, কারো বিরুদ্ধে কোনওরকম ধারণা করার সূত্র আমি এখনও খুঁজে পাইনি।

আট

দিন পনেরো বাদে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় এক বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হল:

দুষ্প্রাপ্য গাছগাছড়া সরবরাহকারীরা বিকাল চারটা থেকে ছ-টার মধ্যে যোগাযোগ করুন, উপযুক্ত মূল্যের বিনিময়ে গাছপালা ক্রয় করা হবে।

নীচে প্রেসিডেন্সি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিজ্ঞানের ঠিকানা। প্রত্যেকদিন এই সময়ে পারিজাতবাবু প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়ে বসে থাকতেন। রোজই বেশ কয়েকজন লোক আসত, কিন্তু আসল লোকের দেখা নেই। গাছগাছড়াও অতি সাধারণ।

পারিজাতবাবু যখন হতাশ হয়ে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন, তখন দরজার গোড়ায় এক নেপালি এসে দাঁড়াল।

নমস্কার, বাবু।

পারিজাতবাবু উৎফুল্ল হলেও মুখে কোনও ভাব প্রকাশ করলেন না। স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, কী চাই?

আমি ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় এক বিজ্ঞাপন দেখে এসেছি।

আসুন, ভিতরে আসুন।

নেপালি ঘরের মধ্যে ঢুকল।

মানস আর বলরাম শের বাহাদুরের চেহারার যেরকম বর্ণনা দিয়েছিল, তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।

বসুন-না চেয়ারে!

একটু ইতস্তত করে নেপালি চেয়ারে বসল।

আমার কথাটা আপনাকে বলি, পারিজাতবাবু বলতে আরম্ভ করলেন, আমি এই কলেজের বোটানির হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট। আমার নিজের রিসার্চ-এর ব্যাপারেই কিছু গাছগাছড়া দরকার। আপনি কীভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারেন?

আপনার কীরকম সাহায্যের প্রয়োজন বলুন।

আমার গবেষণার বিষয় এ দেশের বিষাক্ত গাছগাছড়া। আপনি বহুদিন এ লাইনে আছেন?

প্রায় বছর দশেক।

কিছু বিষাক্ত গাছের সন্ধান আমাকে দিতে পারেন?

আপনি বিজ্ঞাপনে বিষাক্ত গাছের কথা তো লেখেননি, শুধু দুষ্প্রাপ্য গাছের কথাই লিখেছেন, সেরকম দু-একটা লতা আমি এনেছি।

আপনি কি বাংলা পড়তে পারেন?

হ্যাঁ, লিখতে-পড়তে দুইই পারি। আমি এ দেশের স্কুলেই পড়াশোনা করেছি। আপনাকে কিছু গাছ দেখাব কি?

আপনি তো বললেন, বিষাক্ত গাছগাছড়া আপনি আনেননি। যদি আমি আপনার সঙ্গে যাই, তাহলে আজ আপনি দিতে পারবেন?

নেপালি মাথা নাড়ল—না। বাড়িতে আমার সেরকম গাছগাছড়া কিছু নেই। আমাকে আনিয়ে নিতে হবে।

কোথা থেকে আনাবেন?

ঠিক নেই। হিমালয়ের পাদদেশে অনেক কিছু পাওয়া যায়। আমার লোক আছে কাঠমান্ডু, কালিম্পং, দেরাদুনে। দেখি তারা কী পাঠায়!

নেপালি ওঠবার উপক্রম করতে পারিজাতবাবু প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, আর-একটা কথা। দু-একটা বিষধর সাপ আমায় দিতে পারেন?

নেপালির দুটি চোখ কুঞ্চিত হয়ে উঠল।

বিষধর সাপ? আপনি বরং কোনও সাপুড়ের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তারা হয়তো দিতে পারবে।

আপনার কোনও সাপুড়ের সঙ্গে চেনা আছে?

না।

নেপালি ব্যাগটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

আপনার নামটা?

বিল বাহাদুর!

ঠিকানা?

ঠিকানায় কী দরকার? আমি মাসখানেক বাদে আসব।

পারিজাতবাবু পকেট থেকে কার্ড বের করে এগিয়ে দিলেন। তাতে লেখা—ডক্টর অজয় বসু। উদ্ভিদবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান। প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা।

হাত বাড়িয়ে বিল বাহাদুর কার্ডটা নিয়ে পকেটে রাখল।

আপনি একটা ফোন করে আসবেন। তাহলে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।

ঠিক আছে। নমস্কার।

বিল বাহাদুর নেমে গেল।

সে রাস্তায় পা দিতেই সাইকেল হাতে একটি লোক যেন তারই প্রতীক্ষায় ছিল— বিল বাহাদুরের পিছন পিছন লোকটা সাইকেল চালাল।

বাড়ি ফিরে পারিজাতবাবু ডক্টর রুদ্রর পাঠানো রিপোর্টটা নিয়ে বসলেন।

রিপোর্টটা এর আগেই কয়েকবার দেখেছেন। ডাল আর পাতাগুলো তাজা থাকলে খুব ভালো হত। পরীক্ষার সুবিধা হত। তবু ডক্টর রুদ্র যা করেছেন যথেষ্ট। পারিজাতবাবু নিজের নোটবই খুলে রিপোর্টটা নকল করে রাখলেন। ঠিক আটটা নাগাদ ফোন বেজে উঠল।

এই ফোনের জন্য পারিজাতবাবু এতক্ষণ সাগ্রহে প্রতীক্ষা করছিলেন। ছুটে গিয়ে ফোন তুললেন।

তারের ওপাশ থেকে ভারী গম্ভীর গলা ভেসে এল, স্যার বলছেন?

হ্যাঁ।

নেপালিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে!

ভালো, লোকটার আস্তানা কোথায়?

টালা।

পারিজাতবাবু মনে মনে ভাবলেন, তাহলে খিদিরপুর আর পাতিপুকুর দুটোই মিথ্যে।

ফোনে প্রশ্ন করলেন, বাড়ি সার্চ করা হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে। সেরকম কিছু পাওয়া যায়নি। কিছু গাছগাছড়া আছে।

সেগুলো নিয়ে এল। আর কিছু পাওনি?

আর যা আছে মামুলি। টেবিল, চেয়ার, তক্তপোশ, বিছানা।

কোনও চিঠিপত্র?

একখানা পাওয়া গেছে।

পড়েছ?

না, বোধহয় নেপালি ভাষায় লেখা।

সেটাও নিয়ে এসো।

আচ্ছা স্যার।

নেপালিকে সোজা লালবাজার নিয়ে এসো। কতক্ষণ লাগবে?

ঘণ্টাখানেক।

ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।

পারিজাতবাবু যখন লালবাজারে পৌঁছালেন, তখনও বিল বাহাদুরকে আনা হয়নি।

এ সময় ডেপুটি কমিশনার সত্যেন সেনের থাকবার কথা নয়, কিন্তু ফোন পেয়ে তিনিও এসে গেছেন। দরজার কাছে পারিজাতবাবুকে দেখে বললেন, কী হে পারিজাত, তুমি নাকি প্রফেসর সেনের হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করেছ?

কী জানি, জোর করে কিছু বলতে পারি না। লোকটাকে এখানে আনতে বলেছি। দেখি আলাপ করে।

আমাকেও তপেশ্বর প্রসাদ ফোন করেছিল। তোমার কথায় সে-ই তো নেপালিকে অনুসরণ করেছিল। লোকটার নাম কী হে?

বলছে বিল বাহাদুর, কিন্তু প্রফেসর সেনের নোটবইতে ছিল শের বাহাদুর।

সত্যেন সেন উচ্চহাস্য করে উঠলেন, আরে ধরা পড়লে অনেক শেরই বিল্লি বনে যায়। কেসটা শেষ পর্যন্ত টিকবে তো?

বললাম যে পরখ করে দেখি আগে।

পারিজাতবাবুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের কালো ভ্যান সশব্দে প্রাঙ্গণে ঢুকল।

সত্যেন সেন বললেন, ওই তোমার অতিথি এসে গেল। কাছে দাঁড়ানো এক কনস্টেবলকে বললেন, তুলসী, আসামিকে আমার ঘরে আনতে বলো। এসো পারিজাত, কামরার মধ্যে এসো।

নেপালিকে নিয়ে দুজন পুলিশ ভিতরে এল। প্রথমে তার চোখ পড়ল সত্যেন সেনের ওপর, তারপর দেখল পারিজাতবাবুকে। সঙ্গে সঙ্গে তার দুটো চোখ জ্বলে উঠল।

কী ব্যাপার বাবু, আমাকে এরকম বেইজ্জত করার মানে?

পারিজাতবাবু শান্তকণ্ঠে বললেন, বোসো শের বাহাদুর। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

নেপালি আপত্তি জানাল।

আমার নাম শের বাহাদুর নয়, বিল বাহাদুর।

তুমি প্রফেসর সেনকে চেনো?

কে প্রফেসর? কোথায় থাকেন?

চন্দনপুর।

চন্দনপুরে একজন আমার কাছে মাঝে মাঝে গাছগাছড়া নিতেন।

বিষাক্ত গাছগাছড়া?

না, তিনি অন্য ধরনের গাছগাছড়া নিতেন।

কীরকম?

খুব নরম লতাজাতীয়।

তুমি জানো প্রফেসর সেন মারা গেছেন?

হ্যাঁ, কাগজে পড়েছি।

তীব্র বিষক্রিয়ায় তাঁর হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়।

কাগজে সেইরকমই পড়েছি।

কী করে তিনি মারা গেলেন বলতে পারো?

নেপালির সারা মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। দুটি হাত মুষ্টিবদ্ধ।

কী বলতে চান আপনি?

পারিজাতবাবু ভ্রূক্ষেপ করলেন না।

জিজ্ঞাসা করলেন, বলরামকে চেনো? সাপুড়ে বলরাম?

না।

কিন্তু বলরাম তোমাকে চেনে।

নেপালি কোনও উত্তর দিল না।

বলরাম যদি এসে বলে তুমি তাকে চেনো, তাহলে তুমি কী বলবে?

এবারও নেপালি নিরুত্তর।

সত্যেন সেন চটে উঠলেন।

চুপ করে থেকে কোনও লাভ নেই। কথা বলাবার ওষুধ আমাদের কাছে আছে।

নেপালি পারিজাতবাবুর দিকে ফিরে বলল, আমি অল্পে ছাড়ব না। আমাকে এভাবে অপদস্থ করার শাস্তি পাবেন।

সত্যেন সেন ইঙ্গিত করলেন। দুজন পুলিশ দু-হাত ধরে নেপালিকে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে গেল।

এরপর কী করবে হে?

সত্যেন সেন পাইপ টানতে টানতে জিজ্ঞাসা করলেন।

কাল বলরামকে একবার নিয়ে আসব।

ঠিক লোককে পাকড়াও করেছ তো?

কী জানি! জানেন তো, এসব ব্যাপারে জোর করে কিছু বলা যায় না। আচ্ছা চলি।

পারিজাতবাবু বেরিয়ে এলেন।

নয়

পরের দিন পারিজাতবাবু প্রথমে গেলেন সুধা-নিবাসে। মানস পড়ার ঘরে ছিল। সঙ্গে পুরোনো চার বন্ধু—বিজয়, পবিত্র, অলকেশ আর সরোজ।

পারিজাতবাবুকে দেখে অলকেশ জিজ্ঞাসা করল, কিছু কিনারা হল নাকি?

পারিজাতবাবু মাথা নাড়লেন, না, এখনও কিছু হয়নি। তবে আমি বসে নেই।

অলকেশ লজ্জিত হল।

না, না, আমি সে কথা বলিনি। ব্যাপারটার শেষ জানবার জন্য আমরা সবাই খুব উৎসুক।

দেখা যাক। মানস, তোমাকে আমার সঙ্গে একটু বের হতে হবে। এভাবে বের হতে তোমার কষ্ট হবে না তো?

মানসের মুণ্ডিত মস্তক দেখেই পারিজাতবাবু কথা বলেছিলেন।

মানস বলল, না, না, কোনও কষ্ট হবে না। তা ছাড়া আপনার কাজের সুবিধার জন্য আমি সব সময় সব জায়গায় যেতে প্রস্তুত।

পারিজাতবাবু অন্য চারজন বন্ধুর দিকে ফিরে বললেন, তোমরাও চলো আমার সঙ্গে, বাস স্ট্যান্ডে নামিয়ে দেব।

চার বন্ধুকে নামিয়ে দিয়ে পারিজাতবাবু মোটর ঘোরালেন।

মানস পাশেই বসেছিল। তাকে বললেন, মানস, শের বাহাদুর ধরা পড়েছে।

মানস চমকে উঠল।

আপনার কী ধারণা শের বাহাদুর এ কাজ করেছে?

জানি না, তবে তার আচরণ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।

মানস কিছু বলল না। নিরীহ দৃষ্টি মেলে পারিজাতবাবুর দিকে দেখল।

তোমার বাবার নোটবইতে শের বাহাদুরের ঠিকানা লেখা ছিল খিদিরপুর। অন্য দু-একটা কলেজে সে যে গাছগাছড়া বিক্রি করত, সেখানে ঠিকানা দিয়েছে পাতিপুকুর। আর আসলে থাকে টালায়। সেখানেই ধরা পড়েছে। আমার কাছে নাম বলেছে বিল বাহাদুর। তাহলে দেখো, নামধাম দুইই সে বদলেছে।

শের বাহাদুর এমন কাজ করবে, আমি কিন্তু বিশ্বাসই করতে পারছি না।

জোর করে কিছু বলা খুবই শক্ত, মানস। অনেক সময় দেখা গেছে, ভদ্র আর শান্ত লোকই মারাত্মক খুনি হয়। তাদের মুখ মুখোশের কাজ করে।

আমরা এদিকে কোথায় যাচ্ছি?

তোমাদের মিস্ত্রি আরিফ এখানে থাকে। অবশ্য তার কাছে আমরা যাচ্ছি না।

তবে?

এই বস্তিতে এক সাপুড়ে থাকে, নাম বলরাম। তার কাছে যাব।

সাপুড়ের কাছে কেন?

সে শের বাহাদুরকে চেনে। শের বাহাদুর তার কাছে গিয়েছিল।

কী জানি, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।

বোধহয় ঠিক বোঝবার এখনও সময় হয়নি।

বলরাম আর মানসকে সঙ্গে নিয়ে পারিজাতবাবু লালবাজারে ফিরে এলেন।

আশ্চর্য, একরাত্রেই শের বাহাদুরের চেহারা অনেক বদলে গেছে। চোখের কোলে কালির ছোপ, দু-চোখ রক্তবর্ণ, মনে হয় সারারাত ঘুমোয়নি।

কেমন আছ শের বাহাদুর?

সঙ্গে সঙ্গে সে উত্তর দিল, আমি শের বাহাদুর নই, বিল বাহাদুর।

পারিজাতবাবু হাসলেন—ভগবানের অনেক নাম থাকে। এক-এক লীলার সময়ে এক-একটা নাম। যাক, এদের চেনো?

শের বাহাদুর মুখ তুলতেই মানসের সঙ্গে চোখাচোখি হল। শের বাহাদুরের মুখ করুণ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। একটা হাত কপালে ঠেকিয়ে সেলাম করে বলল, সেলাম খোকাবাবু, ভালো আছেন?

মানসও হাসল।

ভালো আর কই, আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।

এবার শের বাহাদুর পারিজাতবাবুর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, এই বাবু আমাকে ধরে নিয়ে এসেছেন। বাবুর ধারণা আপনার বাবাকে আমি হত্যা করেছি। আপনিই বলুন, এ কাজ আমি করতে পারি?

এ প্রশ্নের কোনও উত্তর মানস দিতে পারল না।

পারিজাতবাবু এবার বলরামকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, একে চিনতে পারো?

শের বাহাদুর ভ্রূ কুঞ্চিত করল। কিছুক্ষণ বলরামের দিকে চেয়ে থেকে বলল, না, একে এই প্রথম দেখছি।

পারিজাতবাবু বললেন, বলরাম, তুমি একে চেনো?

চিনি হুজুর। সেই ভেন্টিলেটারের কথা বলতে এই লোকটাই গিয়েছিল। এ-ই আমাকে টাকা দিয়েছিল।

শের বাহাদুর চিৎকার করে উঠল, ঝুট, সব ঝুট। একেবারে বাজে কথা।

তোমার সঙ্গে এ লোকটার কোনও ঝগড়া আছে শের বাহাদুর? এ লোকটা অযথা মিথ্যা কথা কেন বলবে?

সব বাজে কথা। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।

পুলিশের একজন অফিসার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, তুমি খুব হিসাব করে লোক চিনছ তো? বলরামকে চিনতে বিপদ, তাই তাকে চিনতেই পারছ না। তা-ই না?

শের বাহাদুরের সারা মুখ আরক্ত। সে চুপচাপ বসে রইল।

পারিজাতবাবু বললেন, তুমি এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছ শের বাহাদুর যে, তোমার পক্ষে পিছিয়ে আসা চলে না। আচ্ছা, তুমি থাকো টালায়, অথচ প্রফেসর সেনকে বলেছ খিদিরপুর। এর কারণ কী?

শের বাহাদুর ভ্রূ কোঁচকাল।

প্রফেসরবাবু কোনওদিন আমাকে নামধাম জিজ্ঞাসা করেননি, কাজেই তাঁকে খিদিরপুরে আমার আস্তানা এ কথা বলার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমি আগে পাতিপুকুরে ছিলাম, মাস দুই হল টালায় গেছি।

প্রফেসর সেনের ওপর তোমার আক্রোশের কারণ কী?

কেন বাজে কথা বলছেন? আমি আপনার কোনও কথার উত্তর দেব না।

ঠিক আছে। একে নিয়ে যাও।

পুলিশ অফিসারের নির্দেশে শের বাহাদুরকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল।

ইতিমধ্যে নেপালি ভাষায় লেখা চিঠির পাঠোদ্ধার করা হয়েছে।

চিঠিতে মারাত্মক কিছু নেই। জনৈক বাহাদুর থাপাকে লেখা হয়েছে গোটাকয়েক গাছগাছড়ার জন্য। গাছগাছড়ার নাম নেই, শুধু বলা হয়েছে, যেগুলো বাতের ওষুধ তা কবিরাজি দোকানে দিতে হবে। কিন্তু চিঠিটা শেষ হয়নি। থাপার কোনও ঠিকানা লেখা নেই।

তলায় নামসই—বিল বাহাদুর।

এইখানেই পারিজাতবাবু একটু ধাঁধায় পড়লেন। শের বাহাদুর নিজের নাম বিল বাহাদুর লিখবে কেন? তখন তো ধরা পড়বার কোনও সম্ভাবনা ছিল না! নাকি, পাকা লোক আগে থেকেই সাবধান হয়?

দশ

দিন সাতেক পর পারিজাতবাবু নেপাল রওনা হয়ে গেলেন। এখানকার পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে নেপালের পুলিশের বড়োকর্তার কাছে একটা পরিচয়পত্র নিলেন। সাহায্যের প্রতিশ্রুতি।

কাঠমান্ডু পৌঁছে রয়েল হোটেল-এ উঠলেন।

ছোটো জায়গা, কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অতুলনীয়।

প্রথম দু-দিন পারিজাতবাবু হোটেল থেকে বের হলেন না। বসে বসে টেলিফোন ডিরেক্টরি ওলটালেন। হোটেলের ম্যানেজারের কাছে খোঁজ নিলেন, এ দেশের গাছগাছড়ার সম্বন্ধে জানতে হলে কোথায় যেতে হবে?

ম্যানেজার কিছু বলতে পারল না। ছোটো চোখ আরও ছোটো করে বলল, আমরা আদার ব্যাপারী, জাহাজের কোনও খোঁজ রাখি না।

তৃতীয় দিন হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়েই পারিজাতবাবু অবাক। বিচিত্র পোশাকে সেজে জনতা চলেছে। শুধু নেপালিরাই নয়, বিদেশিরাও আছে।

বেয়ারাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কোথায় যাচ্ছে?

বেয়ারা বলল, পশুপতিনাথের মন্দিরে। তিন দিন ধরে উৎসব চলবে।

কৌতূহলবশতই পারিজাতবাবুও পোশাক পরে বেরিয়ে পড়লেন।

মন্দির চত্বরে তিলধারণের স্থান নেই।

বিপুল জনসমাগম। কেউ গান গাইছে, কেউ বাজনা বাজাচ্ছে। সবাই আনন্দে মুখর। বিদেশিদের অনেকের হাতেই দামি ক্যামেরা। তারা ছবি তুলে চলেছে।

পারিজাতবাবু একটু সরে একটা পাথরের ওপর বসলেন, সামনের দিকে দেখতে দেখতে হঠাৎ চমকে উঠলেন। দুটো হাতে চোখ দুটো মুছে নিলেন।

তিনি কি ভুল দেখছেন?

মাথায় নেপালি টুপি, গায়ে সোয়েটার, একটু দূরে শের বাহাদুর দাঁড়িয়ে আছে।

তাঁকে না জানিয়ে পুলিশ নিশ্চয় শের বাহাদুরকে ছাড়বে না। তবে কি শের বাহাদুর পুলিশের কবল থেকে পালিয়েছে? এখন যদি পারিজাতবাবু শের বাহাদুরের সামনে যান, সে গা-ঢাকা দেবে।

কিংবা নেপালিদের খেপিয়ে তোলাও আশ্চর্য নয়। বিদেশ-বিভুঁয়ে পারিজাতবাবু বিপদে পড়ে যাবেন।

পারিজাতবাবু খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

এখন যদি হোটেলে ফিরে যান, চেহারা পালটে আসেন, ততক্ষণে শের বাহাদুর এখানে না-ও থাকতে পারে।

মন্দিরের বাইরে দু-একজন পুলিশ, রয়েছে তাদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করলে হয়।

ভাবতে ভাবতেই পারিজাতবাবু দেখলেন, শের বাহাদুর তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে। অবশ্য তাঁকে লক্ষ করে নয়, তিনি যেদিকে বসেছিলেন সেইদিকে।

পারিজাতবাবুর চোখে কালো চশমা ছিল। তিনি পকেট থেকে নেপালি টুপি, যেটা এখানে এসে শখ করে কিনেছিলেন, বের করে মাথায় দিলেন।

তিনি বুঝতে পারলেন যে, এতে তাঁর চেহারার এমন কিছু পরিবর্তন হল না।

শের বাহাদুর ঠিক পাথরের নীচে এসে দাঁড়াল। সম্ভবত সে পারিজাতবাবুকে দেখতে পায়নি।

হঠাৎ পারিজাতবাবুর মনে পড়ে গেল। তিনি পিছন ফিরে পকেট থেকে ব্যাগ বের করে নকল গোঁফজোড়া পরে নিলেন। ঝুলে-পড়া গোঁফ ঠোঁটের অনেকটা ঢেকে দিল। উপায় নেই, এই সামান্য রূপান্তরের মাধ্যমেই পারিজাতবাবুকে চেষ্টা করতে হবে।

প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে অনুভব করলেন রিভলভারটা ঠিকই আছে। পারিজাতবাবু আস্তে আস্তে নেমে শের বাহাদুরের পাশে দাঁড়ালেন।

শের বাহাদুর আড়চোখে পারিজাতবাবুকে দেখল, তারপর বলল, আপনি উৎসবে এই প্রথম?

পারিজাতবাবু মনে মনে হাসলেন। শের বাহাদুরের ধারণা, নিজের গলাটা একটু গম্ভীর করলেই সে আত্মগোপন করতে পারবে। কেউ তাকে চিনতে পারবে না। আর-একটা ব্যাপারে পারিজাতবাবু নিশ্চিন্ত হলেন। তাঁর ছদ্মবেশ সামান্য হলেও শের বাহাদুর বুঝতে পারেনি।

পারিজাতবাবু বললেন, আমি নেপালে এই প্রথম, কাজেই এ উৎসবে প্রথম তো বটেই।

ও, আপনি কি ব্যাবসা-সংক্রান্ত ব্যাপারে এদেশে এসেছেন?

ব্যাবসা-সংক্রান্ত মানে, আমি এক ওষুধের কারখানার তরফ থেকে এখানে এসেছি। মশাইয়ের নাম?

একটু ইতস্তত করে শের বাহাদুর বলল, আমি বাহাদুর থাপা।

নামটা পারিজাতবাবুর খুব পরিচিত মনে হল। শের বাহাদুর থাপাকে চিঠি লিখেছিল, হঠাৎ প্রশ্ন করায় শের বাহাদুর আর কিছু ভেবে না পেয়ে বাহাদুর থাপার নামটাই বলে ফেলেছে।

আপনি এখানে কী করেন?

আমি এখানে বনসংরক্ষণ বিভাগের অফিসার।

তাহলে আপনি আমাকে কিছু সাহায্য করতে পারেন।

কীরকম সাহায্য বলুন?

আমি এ দেশের কিছু গাছগাছড়া সংগ্রহ করতে চাই।

আপনার নামটা জানতে পারলাম না।

আমি ডক্টর গিরিজাশেখর দাস।

সঙ্গে সঙ্গে শের বাহাদুরের চেহারা পরিবর্তিত হল। জ্বলে উঠল দুটো চোখ, মুখে রক্ত এসে জমল। কর্কশকণ্ঠে বলল, মাপ করবেন, কোনও বাঙালিকে আমি সাহায্য করি না। দ্রুত হেঁটে শের বাহাদুর ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। আর তাকে দেখা গেল না।

পারিজাতবাবুর নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করল। অদ্ভুত কায়দা করে শের বাহাদুর চোখের সামনে থেকে সরে পড়ল। বোঝা গেল, শের বাহাদুর তাঁকে ঠিক চিনতে পেরেছে। শের বাহাদুরকে আর পাওয়া যাবে না।

হোটেলে ফিরে পারিজাতবাবু কিছুক্ষণ গভীর চিন্তা করলেন।

একবার ভাবলেন কলকাতায় ডেপুটি কমিশনার সত্যেন সেনকে ফোন করবেন। তারপর মনে হল, তিনি যখন শুনবেন শের বাহাদুর এভাবে পারিজাতবাবুকে ফাঁকি দিয়ে সরে পড়েছে, তখন কী ভাববেন!

কিন্তু শের বাহাদুর তো তাঁদের কড়া পাহারা এড়িয়ে পালিয়ে এসেছে।

পারিজাতবাবু চুপচাপ বসে রইলেন।…

এক ঘণ্টা পরে রয়েল হোটেল থেকে এক পাঞ্জাবি বের হল। মাথায় বিরাট পাগড়ি। একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি। পরনে দামি স্যুট। এক হাতে লোহার বালা। চোখে কালো চশমা।

হোটেলের সামনে থেকে ট্যাক্সি ধরল। আধ ঘণ্টার মধ্যে বনবিভাগের অফিসে পৌঁছে গেল। তারপর বাহাদুর থাপার টেবিলে গিয়ে দাঁড়াতে দেরি হল না।

আমি সর্দার গুরমুখ সিং। পাঞ্জাব সরকারের তরফ থেকে এসেছি।

থাপা বলল, বসুন, আমি কী করতে পারি বলুন!

আমাদের সরকার পাহাড় অঞ্চলের গাছপালার একটা এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করতে ইচ্ছুক। তার ভার এই অধমের ওপর পড়েছে। আমি নাগাল্যান্ড, অসম, সিকিম এসব অঞ্চল ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছি। এবার আপনাদের দেশে এসেছি। আপনি তো এ বিষয়ে অভিজ্ঞ লোক। আমাকে যদি একটু সাহায্য করেন। আর-একটা কথা—।

কী কথা?

এর জন্য আমার সরকার কিছু খরচও করবে। আপনাকে সামান্য দক্ষিণাও আমি দিতে পারব।

এ আর বেশি কথা কী! স্বদেশের গাছগাছড়া নিয়ে গবেষণা করা আমারও একটা বাতিক। দুঃখের বিষয়, আমার বহুদিনের কষ্ট করে সংগ্রহ করা কাগজপত্র আমি এক দুর্বৃত্তের পাল্লায় পড়ে হারিয়েছি। আমার আজীবনের সাধনা বরবাদ হয়ে গেছে। আসুন, আমাদের এখানে যে ক-টা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গাছগাছড়া আছে, তা আপনাকে দেখাচ্ছি।

প্রথমে থাপা, পিছনে গুরমুখ সিং বেরিয়ে পড়ল।

প্রায় ঘণ্টা তিনেক দুজনে ঘুরল। সরকারের সংরক্ষিত বাগানে, তা ছাড়া পার্বত্য এলাকাতেও।

গুরমুখ সিং কাগজে কী সব লিখে নিল। ছোটো ক্যামেরা বের করে অনেকগুলো ফোটোও নিল।

তারপর ফেরার সময় থাপার সঙ্গে করমর্দন করে তাকে আমন্ত্রণ জানাল।

কাল দুপুরে রয়েল হোটেলে আপনি আমার সঙ্গে লাঞ্চ খাবেন। কোনও আপত্তি শুনব না। আপনি যা সাহায্য করলেন, তা জীবনে ভোলবার নয়। বইতে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করব।

থাপা সম্মত হল।

এগারো

পারিজাতবাবুর বাইরের ঘরে পাঁচ বন্ধু। মানস, পবিত্র, অলকেশ, বিজয় আর সরোজ। তাদের সামনে নিঃশেষিত চায়ের কাপ আর খাবারের প্লেট। একপাশে বেতের ইজিচেয়ারে পারিজাতবাবু। পরনে পাঞ্জাবি আর পাজামা। মুখে পাইপ।

মানস সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, এবার আপনার কাহিনি বলুন। আমরা শোনবার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছি।

পারিজাতবাবু পাইপে টান দিয়ে সেটা টিপসের ওপর রেখে দিয়ে বললেন, শোনো তাহলে। প্রথম যখন প্রফেসর সেনের গবেষণাগারে গেলাম, দুটো ব্যাপার আমার খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হল।

প্রথম, তাঁর হাতের শেষ লিপি ‘লা’। আর দ্বিতীয়, ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। খুনি ঘর থেকে বের হল কী করে?

‘লা’ মানে লাবণ্য আমি ভাবিনি, আমি ভেবেছিলাম ‘লাউডগা’। এই বিষধর সাপটার প্রথম অক্ষর হয়তো প্রফেসর সেন লিখে রেখে গিয়েছেন।

এরকম নজির আছে, বাইরে থেকে ঘরের মধ্যে সাপ চালান দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে।

তখনও আমি পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখিনি। ঠিক কীরকম বিষে প্রফেসর সেনের মৃত্যু ঘটানো হয়েছিল, জানবার অবকাশ আমার হয়নি।

আর-একটা কথা, সাপটাকে না হয় ভিতরে ঢোকানো হল, কিন্তু সে আবার বাইরে গেল কী করে?

তবু আমি স্কাইলাইট আর ভেন্টিলেটার পরীক্ষা করতে করতে দেখলাম, একটা ভেন্টিলেটার আলগা করে বসানো রয়েছে।

তারপর আমি তন্ন তন্ন করে ঘরটা খুঁজলাম সাপের আশায়। যদি লাউডগা কোথাও কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে অবশ্য একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম, যেটার কথা পরে তোমাদের বলব।

ভেন্টিলেটারের সূত্র ধরে আরিফ আর বলরামের সঙ্গে যোগাযোগ হল।

বলরামের কাছ থেকে টাকা খেয়ে আরিফ ভেন্টিলেটার আলগা করে রেখেছিল আর বলরামকে এই মতলব দিয়েছিল এক নেপালি। এর জন্য সে তাকে টাকাও দিয়েছিল। তারপর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসতে বুঝতে পারলাম, সাপের বিষে প্রফেসর সেনের মৃত্যু হয়নি।

প্রথমে নেপালির মতলব ছিল, বিষধর সাপ ভেন্টিলেটারের মধ্যে দিয়ে ছেড়ে দেবে। কিন্তু তাতে অসুবিধা ছিল।

এমন শিক্ষিত সাপ নয় যে, দেয়াল বেয়ে নেমে ঠিক প্রফেসর সেনকে ছোবল দেবে! এমনও তো হতে পারে, প্রফেসর সেনই সাপটাকে আগে দেখতে পেয়ে মেরে ফেলবেন।

তা ছাড়া রাত্রে এ ঘরে প্রফেসর সেন থাকেন না। দিনের আলোয় বাইরে থেকে ঘরের মধ্যে সাপ ঢোকানোর চেষ্টা খুব সহজ নয়। ধরা পড়বার ষোলো আনা সম্ভাবনা।

এ সম্ভাবনা বাতিল করে দিলেও নেপালির ওপর থেকে সন্দেহ গেল না।

যাক, এবারে আগেকার এক কাহিনি শোনো। প্রায় পঁচিশ বছর আগের কাহিনি।

সদ্য কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়ে এক বাঙালি ছাত্র গবেষণার নেশায় মেতে উঠল। তার বিষয় ছিল উদ্ভিদবিদ্যা।

গাছগাছড়ার সন্ধানে সে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াল। ঠিক কী নিয়ে গবেষণা করবে তা-ই ভাবতে লাগল। এই সময় কলকাতায় বিজ্ঞানের এক অধিবেশন বসে।

বাঙালি ছাত্রটি সে অধিবেশনে যোগ দেয় শ্রোতা হিসেবে। উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে একটি নেপালি যুবক প্রবন্ধ পড়ে। বিষয়, গাছপালার লজ্জাশীলতা।

সকলেই সেটির তারিফ করে। বাঙালি ছাত্র যেচে গিয়ে নেপালির সঙ্গে আলাপ করে।

নেপালি পাঁচ দিন কলকাতায় ছিল। এই পাঁচ দিনই বাঙালি ছাত্র তার কাছে যায়। নানা বিষয়ে আলোচনা করে। ফলে দুজনের মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। নেপালি ছাত্রটিকে নেপালে আমন্ত্রণ জানায়। এ কথাও বলে, সে তাকে ওই দেশীয় অনেক গাছগাছড়ার সন্ধান দেবে।

মাস দুয়েক পর বাঙালি ছাত্রটির নেপালে যায়।

নেপালি তাকে অভ্যর্থনা করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। একটা ছোটো কুঠুরি নিয়ে থাকে। বাঙালি ছাত্রটিকে বলে, আমি দুর্ভাগ্যের শিকার, সব থেকেও আমার কিছু নেই।

নেপালে গবেষণা করার কোনও সুযোগ নেই। নেপালির খুব ইচ্ছা, কলকাতা কিংবা দিল্লি গিয়ে গবেষণা করে, কিন্তু অর্থাভাব। দু-একজন অধ্যাপকের কাছে ঘোরাফেরা করেছে, সুবিধা হয়নি।

বাঙালি ছাত্র তাকে আশ্বাস দিল, কলকাতায় ফিরে তার জন্য বিশেষ চেষ্টা করবে।

নেপালি বিশ্বাস করে বাঙালি ছাত্রকে তার গত পাঁচ বছরের পরিশ্রমের ফল সব নোটস দেখিয়েছিল। সংবেদনশীল গাছপালা নিয়ে তার গবেষণার বিষয়।

পরের দিন সকালে উঠে নেপালি দেখল যে, বাঙালি ছাত্রও নেই, তার এত কষ্টের নোটসও উধাও।

নেপালি তন্ন তন্ন করে সারা নেপালের পথঘাট খুঁজল। বাইরে বের হবার প্রত্যেকটি সড়ক। বাঙালি ছাত্র কোথাও নেই।

কিছুদিন পর কলকাতায় এসে কলেজে কলেজে অনুসন্ধান করল। কেউ বলতে পারল না।

বলতে পারল না, কারণ বাঙালি ছাত্রটি সঠিক নাম বলেনি, অর্থাৎ শুরু থেকেই তার উদ্দেশ্য অসৎ ছিল।

নেপালি প্রায় পাগলের মতন হয়ে গেল। জোড়াতালি দিয়ে একটা নোটস তৈরি করেছিল, কিন্তু তা সুবিধার হয়নি।

অনেক বছর পর আকস্মিকভাবে এক বিজ্ঞানীর ফোটো নেপালির চোখে পড়ল। দেখেই সে চমকে উঠল। সন্দেহ নেই, এই সেই বাঙালি ছাত্র। তার প্রতিশোধস্পৃহা প্রবল হয়ে উঠল। পাহাড়ি জাতের যেমন হয়। নেপালি ঠিক করল, এক ঢিলে দুই পাখি মারবে।

নেপালির এক যমজ ভাই ছিল। একেবারে একরকম দেখতে। নেপালির বাপ তার সমস্ত সম্পত্তি ওই যমজ ভাইকে উইল করে দিয়ে গিয়েছিল। কারণ, নেপালির ওপর সে মোটেই সন্তুষ্ট ছিল না।

নেপালির যমজ ভাই নেপালির চেয়ে মাত্র দশ সেকেন্ডের ছোটো।

এখন বোধহয় বুঝতে পারছ, নেপালি হচ্ছে বাহাদুর থাপা আর তার যমজ ভাই বিল বাহাদুর।

এতক্ষণ পরে মানস প্রশ্ন করল, কিন্তু বাবার খাতায় যে শের বাহাদুর লেখা ছিল?

থাপার সঙ্গে তার ভাইয়ের বাইরে কোনও বিরোধ ছিল না। বিল বাহাদুর মাঝে মাঝে গাছপালার সন্ধানে এবং নিজের সম্পত্তির তদারক করার জন্য নেপালে যেত। থাপা গাছপালা দিয়ে তাকে সাহায্যও করত, অবশ্য অর্থের বিনিময়ে। বাঙালি বিজ্ঞানীর ফোটো দেখে বিল বাহাদুর বলেছিল, এ বাবুকে সে চেনে। তাঁকে গাছগাছড়াও সরবরাহ করে। সেই সময়েই বোধহয় থাপার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি জেগে ওঠে। সে কলকাতায় চলে আসে।

বলরাম সাপুড়ের কাছ থেকে মাঝে মাঝে সাপ কেনে বিশ্বাসভাজন হবার জন্য, তারপর একদিন ভেন্টিলেটার আলগা করার পরামর্শ দেয়। নিজে আরিফের সঙ্গে দেখা করেনি।

পরে অবশ্য ভেবে বুঝতে পারে, এ উপায়ে সাফল্যলাভ সহজ নয়। একবার সুযোগ হারালে ভবিষ্যতে প্রফেসর সেন সাবধান হয়ে যাবেন। থাপা অন্য এক মতলব ঠিক করল।

গাছগাছড়া নিয়ে নিজে গেল প্রফেসর সেনের কাছে। প্রফেসর সেন তাকে বিল বাহাদুরই ভাবলেন।

একেবারে প্রথমে বিল বাহাদুরকে দেখে প্রফেসর সেনের পুরোনো কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। তারপর যাতায়াত ও কথাবার্তার পরে বুঝতে পেরেছিলেন, আগের নেপালির সঙ্গে এর চেহারার সাদৃশ্য আছে, এই পর্যন্ত। এরা এক লোক নয়।

থাপা প্রফেসর সেনকে গাছগাছড়া দিয়ে বলেছিল, আপনি আমার নাম-ঠিকানাটা লিখে নিন। যদি হঠাৎ দরকার হয়, একটা পোস্টকার্ড ফেলে দেবেন।

এর আগে প্রফেসর সেন বিল বাহাদুরের নাম জানতে চাননি। তার প্রয়োজন হয়নি।

অলকেশ জিজ্ঞাসা করল, থাপা সোজাসুজি বিল বাহাদুরের নাম-ঠিকানা দিল না কেন? তাতে তো সন্দেহটা সোজা তার ওপর আগেই হত।

পারিজাতবাবু হাসলেন, থাপা বোধহয় ইচ্ছা করেই একটু জটিলতার সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। যাতে হিসাবটা সহজ না হয়।

তারপর?

প্রফেসর সেন যখন গাছগাছড়াগুলো আরকে ডুবিয়ে রাখার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠেছিলেন, তখন থাপা গাছের খুব ছোটো একটা ডাল ড্রয়ারের ফাঁকে আটকে দিয়েছিল।

সেটাও তো আপনি পেয়েছিলেন?

হ্যাঁ পেয়েছিলাম, কিন্তু খুব শুকনো অবস্থায়। ডক্টর রুদ্রর রিপোর্টে শুধু এইটুকু জানতে পেরেছি, গাছটির নাম, তার বিষক্রিয়ার শক্তি।

নেপালে একেবারে হিমালয়ের পাদদেশে ছোটো ছোটো ঝোপ আছে। অবশ্য খুব বেশি দেখা যায় না। এদের ফুল অত্যন্ত বিষাক্ত। এত বিষাক্ত যে তার কাছ দিয়ে যে জন্তু আনাগোনা করে, সে-ই মারা যায়। হরিণ, খরগোশ, চিতা এরা এই ঝোপ দেখলেই পাগলের মতন ছুটে পালায়। গাছ বিষাক্ত নয়, শুধু ফুল থেকে অতি বিষাক্ত প্রাণঘাতী গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাও প্রায় মিনিট পনেরো। তারপরই ফুলটি শুকিয়ে যায়, তখন তার অনিষ্ট করার কোনও ক্ষমতা থাকে না।

থাপা কুঁড়িসুদ্ধ এই গাছের ডাল ড্রয়ারের ফাঁকে আটকে দিয়েছিল। সে জানত, বারো ঘণ্টার পর কুঁড়িটি ফুল হয়ে উঠবে আর তীব্র বিষগন্ধ ছড়াবে। প্রফেসর সেন যে ভোর পাঁচটায় গবেষণাগারে আসতেন সে খবর সংগ্রহ করা থাপার পক্ষে কঠিন হয়নি।

তারপর প্রফেসর সেন চেয়ারে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেই বিষাক্ত ফুল ফুটেছিল। তার পরের ঘটনা তো তোমরা জানোই। সেইজন্যই পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সেনের পেটে কোনও বিষ পাওয়া যায়নি।

থাপা জানত, অনুসন্ধান করলে বিল বাহাদুর ধরা পড়বে। সেইজন্যই হয়তো সে বলরাম, মানস এদের সব সাক্ষী সৃষ্টি করেছিল।

একটা কথা—

পারিজাতবাবু মানসের দিকে ফিরে বললেন, জানি তুমি কী জানতে চাও। তোমার বাবার ‘লা’ লেখার রহস্য, তা-ই না?

মানস ঘাড় নাড়ল।

পারিজাতবাবু বলতে লাগলেন, তোমার বাবা গাছটা চিনতে পেরেছিলেন। গাছের নাম লাইকোমেসাস। নেপালি ভাষায় বলে—পিয়োজি।

বিষগন্ধ এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল যে প্রফেসর সেন পুরো নামটা লেখার আর অবকাশ পাননি। শুধু ‘লা’ লিখেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন।

থাপার কী শাস্তি হবে?

জানি না, সেটা বিচারালয়ের এলাকায়। তবে সে স্বীকারোক্তি করেছে। দাঁড়াও, তোমাদের জন্য আর-এক প্রস্থ চায়ের কথা বলে আসি। আর-একটা ব্যাপার আমি দেখেছি, পাপ কখনো চাপা থাকে না। কখনো শীঘ্র, কখনো বা দেরিতে পাপীর বিচার ঠিকই হয়। এটা মনে রেখো।

***

পূজাবার্ষিকী ‘আনন্দমেলা’ ১৯৭২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *