লস অব ব্রিদ
বিয়ের ঠিক পরের সকালের কথা।
আমার সবে বিয়ে-করা বউটা সবে বিছানা ছেড়ে ঘরের মেঝেতে পা দিয়েছে। ঠিক সে মুহূর্তেই আমি খেঁকিয়ে উঠলাম। আমি বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম।
আমার কাণ্ড দেখে আমার নতুন বউটা তো একেবার থ বনে গেল। আমি গলা ছেড়ে তাকে গালাগালি দিতে লাগলাম–শয়তান মাগি, ডাইনি, হাড়গিলে, হতচ্ছাড়ি, মুখপুড়ি–আর কত বাছা বাছা গালাগালি ব্যবহার করে তাকে আদর সোহাগ জানাতে লাগলাম।
আমি কেবলমাত্র গালাগালি দিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারলাম না। শেষমেশ খাট থেকে শিকারি কুকুরের মতো লাফিয়ে নেমে তার গলা টিপে ধরতেও বাদ দিলাম না।
তারপর? সাধ্যমত তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে খেঁকিয়ে উঠে সবে আরও বাদ পড়া মনের মতো গালাগাল দিতে যাব, যা কানে গেলে নিজের অপদার্থতা সম্বন্ধে বউয়ের বিন্দুমাত্র সন্দেহও থাকত না, এমন সময় আচমকা আমার দম বন্ধ হয়ে গেল। ব্যস, মনের রাগ ভেতরেই রয়ে গেল। তাকে শুনিয়ে নিজেকে সন্তুষ্ট করা আর হয়ে উঠল না।
শ্বাসরোধ হয়ে যাওয়া, দম ফুরিয়ে যাওয়া, দম বন্ধ করে থাকা, নি…বের করতে পারা। এমন বহু ঘটনার কথা আগে শুনেছি বটে। কিন্তু বাস্তবে যে তা ঘটতে পারে, তা জানা তো দূরের ব্যাপার, এর আগে কল্পনাও করিনি কোনোদিন। হায়! একে, একেবারে পুরোদস্তুর ঘটে গেল, হাতেনাতে প্রমাণ পেয়ে গেলাম।
এবার আপনিই ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করুন, দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমি কতখানি ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গিয়েছিলাম। আর হতাশও হয়েছিলাম কী পরিমাণ।
বিশ্বাস করুন, আমি একটা বিশেষ প্রতিভার অধিকারী, যা মহাসঙ্কটের মুহূর্তেও আমার কাছছাড়া হয় না। সেটা কি, জানতে ইচ্ছে করছে, তাই না? বলছি শুনুন, আমার মেজাজ মর্জি যখন তিরিক্কি হয়ে থাকে তখনও লক্ষ্য করেছি, আমার মাথা খুবই ঠাণ্ডা, স্বাভাবিক থাকে। আমি কিন্তু তিলমাত্রও জ্ঞান হারিয়ে ফেলি না, মুহূর্তের জন্যও কিছুতেই না।
তবে এও সত্য যে, আমি এমন সতর্কতা অবলম্বন করলাম। সবে বিয়ে-করা বউকে টেরই পেতে দিলাম না, কী সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেই না আমি পড়েছি। ব্যাপারটা সামলে সুমলে নেবার জন্য কেবলমাত্র চমৎকার একটা মুখভঙ্গি করলাম। তার এক গালে আলতো করে টোকা মেরে আর অন্য গালটায় ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে তাকে সোহাগ জানালাম।
ব্যস, তারপর আর এক মুহূর্তও দেরি না করে লম্বা-লম্বা পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় পা দিলাম। চোখের পলকে আমি আদরের বউটার নজরের বাইরে চলে গেলাম।
আমার তখন কী হাল হয়েছিল, একবারটি বিবেচনা করুন। আমি জীবিত পুরোদস্তুর বেঁচে আছি অথচ মরে যাওয়ার লক্ষণ আমার মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে। একেবারেই মরে গেছি। কিন্তু অন্য পাঁচজন জ্যান্ত লোকের মতো হাঁটছি, চলাফেরা করছি, কথাবার্তাও বলছি পুরোদমে। আর মেজাজ-মর্জিও খুবই ঠাণ্ডা-স্বাভাবিকের চেয়েও মাটির মানুষ আমি। অথচ আমার শ্বাসক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ, দম আটকে গেছে। এরকম আর একটা বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার পৃথিবীতে আগে কোথাও, কোনোদিন ঘটেছে বলে কেউ শোনেনি, ঘটেনি।
হ্যাঁ, আমার দম পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। পুরোপুরি বলতে একেবারেই।
সে মুহূর্তে আমি লক্ষ্য করেছিলাম, আমার ঘ্রাণেন্দ্রীয়ের ছিদ্র দিয়ে ছিটেফোঁটা বাতাসও আর বইছিল না। এ-ব্যাপারে আমি পুরোপুরি শতকরা একশো ভাগই নিঃসন্দেহ ছিলাম।
সে মুহূর্তে কেউ যদি সবচেয়ে হালকা কোনো পাখির পালকও এনে আমরণ নাকের ছিদ্র দুটোর সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রাখত তবুও নাকের বাতাসে তাকে এতটুকুও নাড়াতে পারতাম না–সত্যি বলছি। সে মুহূর্তে আমি যে কী ঝকমারিতেই পড়েছিলাম তা আপনাকে আর কী বলব।
আমার এ-মর্মান্তিক পরিস্থিতিতেও শুধুমাত্র একটা ব্যাপারে একটু-আধটু স্বস্তি পাচ্ছিলাম। আমি আগের মতোই, অন্য পাঁচজনের মতো কথা বলতে পারছিলাম আর চলাফেরাও কিছুমাত্র সমস্যা ছিল না। তবে সত্যি কথা বলতে কি, কথা বলা যাকে বলে সে অবস্থা কিন্তু আমি খুইয়ে বসেছিলাম। কণ্ঠনালীর পেশীর এক বিশেষ ধরনের খিচুনির ফলে কোনোরকমে ফিসফিস করে মনের ভাব ব্যক্ত করতে পারছিলাম–ব্যস এটুকুই। সে স্বরটা কেমন? সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে কে কে করে আওয়াজ বেরিয়ে এলে যেমন বিদঘুঁটে শোনায়, ঠিক সে রকম আওয়াজের মাধ্যমে কথা বলতে পারতাম।
হঠাৎ কেন আমার গলার এ-হাল হল? বউকে মুখ ঝাটা দিতে গিয়েই আমার হাল এরকম বেহাল হল? বউকে মুখ ঝামটা দিতে গিয়েই আমার হাল এরকম বেহাল হয়ে গেল।
সকালে বউকে আদর সোহাগ জানাবার মুহূর্ত থেকেই আমার ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল, এ-জন্মে বুঝি আর ফুসফুস কায়দা কৌশল গলা দিয়ে বের করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না–কোনোদিনই না। না, গলা চিড়ে ফেললেও আমি আর ফুসফুসের হম্বিতম্বি দেখাতে পারব না।
আমার ফুসফুসনিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেও গলার পেশীগুলো সেবার কোনোরকমে আমার ইজ্জৎ বাঁচিয়ে ছিল। যাকে বলে কোনোরকমে নাজেহাল পরিস্থিতি থেকে অব্যহতি পেয়ে যাওয়া।
আমার এমন হাল হলো যেন আত্মত্যার মতো পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। ভেবে চিন্তে বাতিল করলাম–মাথা থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলে দিলাম। ধুৎ! এমন কাজও। করতে আছে! নিতান্ত আহম্মক ছাড়া এ-রকম বিতিকিচ্ছিরি কাজে কারো মতি যায় না। আসলে পরিকল্পনাটা মাথায় আসতেই আমি এমনকিউরে উঠেছিলাম, যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
আমি দুম করে চেয়ারে বসে পড়লাম। মাথানিচু করে কয়েকমুহূর্ত গোমড়ামুখে বসে থাকলাম। আমার আকস্মিক অদ্ভুত বেহালদশা নিয়ে কিছুক্ষণ অস্থিরভাবে ভাবতে লাগলাম, শুধু ভেবেই চলাম। কিছুক্ষণ মর্মান্তিক কল্পনা আমার মাথার চারদিকে ভিড় করে রইল। সেগুলোকে বার বার ঝেড়ে মুছে ফেলে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাতে লাগলাম। ঝেটিয়ে বিদায় করলেও যা পিছু ছাড়ে না, তাকে তাড়াব কি করে? আসলে প্রতিটা চিন্তাই যে হৃদয়বিদারক।
মানুষের মধ্যে বিচিত্র একটা স্বভাব স্থায়ীভাবে–একেবারে রক্তের সঙ্গে মিশে থাকে, যা অবশ্যম্ভাবী আর হাতের কাছেই থাকে, সে পথ বর্জন করে ছুটে চলে দূরের পানে। হন্যে হয়ে উদ্রান্তের মতো ছুটে যায়, সে কিন্তু নিশ্চিত জানে, কিছুতেই তার ইচ্ছা পূরণ হবার নয়, তবুও আগুন দেখে পতঙ্গ যেমন ধেয়ে যায় ঠিক তেমনি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে সে অনবরত সেদিকেই ধেয়ে যায়। পরিণামের কথা ভাববার ইচ্ছা, সুযোগ বা মানসিকতা কোনোটাই তার সে মুহূর্তে থাকে না।
ঠিক একই রকম হাল আমারও হলো। যাক, যে কথা বলছিলাম, আত্মহত্যার না। পরিকল্পনাটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম।
এদিকে আর এক অসহ্য ব্যাপার ঘরের মধ্যে ঘটে চলেছে। দুটো প্রাণী আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে অনবরত গলার কেরামতি দেখিয়ে চলেছে। আমার আকস্মিক বেহাল অবস্থার সুযোগ নিয়েনির্ঘাৎ আমাকে নিয়ে মস্করা করে চলেছে। অসহ্য! গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেবার মতো বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার।
কথায় বলে না, হাতি ফাঁদে পড়লে চামচিকেও তাকে লাথি হাঁকাতে দ্বিধা করে না। তারা কারা, যারা আমার আকস্মিম বেহাল অবস্থার সুযোগ নিয়ে আমাকে নিয়ে রঙ্গ-তামাশায় মেতেছে? তাদের একটা হচ্ছে আমারই বাড়ির হুলো বিড়াল। নচ্ছাড়টা কার্পেটের ওপর মৌজ করে বসে অনবরত গোঁফ ফোলাচ্ছে আর তড়পে চলেছে। আর দ্বিতীয়টা হতচ্ছাড়াটা? আমারই দশাসই চেহারাধারী হোঁতহকা কুকুর। মহাপ্রভু। টেবিলের তলায় বসে দিব্যি ল্যাজ নাড়াচ্ছে আর বিশিস্বরে কে কে করছে।
আমি হতাশায় রীতিমত মুষড়ে পড়ার যোগাড় হলাম। যখন সিঁড়ি থেকে পায়ের শব্দ কানে এলো।
উৎকর্ণ হয়ে শব্দটা লক্ষ্য করার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, অনুমান অভ্রান্তই মনে হলো। আমার আদরের বউটা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। যার কাছে গলার কেরামতি দেখাতে গিয়ে আমার এ-হাল হয়েছে। কেবল হাল বললে ঠিক বলা হবে না, মর্মান্তিক হাল বলাই উচিত।
পায়ের আওয়াজটা নিচে নেমে এক সময় মিলিয়ে যেতেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
যাক, আমার বউটা দূরে চলে যাওয়ায় আমি নিসঙ্গ হতে পারলাম। এখন আমি একা, একেবারেই একা। যদিও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আমার বুক অনবরত ধুকপুক করছিল, এবার জোর করে মনকে ফিরিয়ে এনে শক্ত করে বাঁধলাম। এমন। বিতিকিচ্ছিরি পরিস্থিতিটাকে কাটাবার যা হোক একটা ব্যবস্থা তো করা দরকার, করতেই হবে।
শিকারি বিড়ালের মতো সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে গিয়ে দরজায় তালা লটকে দিলাম। এতটুকুও শব্দ যাতে না হয় সে দিকে কড়া নজর রেখেছিলাম।
ব্যস, এবার মাথা ঠাণ্ডা করে যারপরনাই উৎসাহ-উদ্যমের সঙ্গে ঘরটা তল্লাশি চালাতে মেতে গেলাম। আমি যার তল্লাশ করছি,নির্ঘাৎ, সেটাকে আলমারি বা ড্রয়ারের কোণে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সেটা বাষ্পীভূত অবস্থায় থাকতে পারে, এমনকি কঠিন আকার নিয়ে থাকাও অসম্ভব নয়।
বিভিন্ন পরিস্থিতি, বিভিন্ন স্থানে বহু দার্শনিককে দেখেছি দর্শনের বহু ব্যাপার স্যাপারে অ-দার্শনিক মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়েন। তাই ম্যানডিভিল বইয়ের পাতায় উইলিয়াম গডউইন তো স্পষ্টই বলেছেন–অদৃশ্য বস্তুই একমাত্র বাস্তবতায় পরিপূর্ণ।
আমি যে চক্করে পড়েছি, শেষপর্যন্ত তাঁর বক্তব্যই পরিপূর্ণ বাস্তবে পরিণত না হয়ে যায়। দোহাই, অবিশ্বাস্য একটা কথাকে বিশ্বাস করাতে চাচ্ছি বলে দোহাই পাঠক পাঠিকা অনুগ্রহ করে মুখ ফেরাবেন না, ঠোঁট দুটোকে বাঁকিয়ে পি প্রদর্শনের চেষ্টা করবেন না। আমার অসহায় অবস্থাটা একবারটি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করার চেষ্টা করুন।
কথাটা খুবই সত্য যে, গাড্ডায় না পড়লে দার্শনিকদের কথার অন্তর্নিহিত অর্থ উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না।
দার্শনিক অ্যানাকসগোরাস তো বলেই রেখেছেন–সব বরফের রঙই সাদা সাদা। এটা একটা ঘটনাই বটে। পরবর্তীকালে তা জানতে পেরেছিলাম। সেও বহুবার বহুভাবে ঠেলাধাক্কা খাওয়ার পর।
দীর্ঘসময় ধরে তল্লাসি চালিয়েছিলাম। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিরবচ্ছিন্ন ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের বিনিময়ে এক জোড়া নকল নিতম্ব, নকল দাঁত, একটা নকল চোখ আর কয়েক বাক্স মিষ্টিদ্রব্য, মি. উইনডেনান্ড নামধারী এক ভদ্রলোক আমার সহধর্মিনীকে উপহারস্বরূপ দান করেছিলেন।
এবার ব্যাপারটা আমার কাছে খোলসা হয়ে গেল, ভদ্রলোকটির ওপর আমার স্ত্রীর পক্ষপাতিত্বের আসল কারণ কি? গূঢ় রহস্য না থাকলে তো এমনটা কিছুতেই হবার নয়। আমি নিদারুণ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। অসহ্য! আমার মধ্যে ছটফটানি শুরু হয়ে গেল।
আমি খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারলাম, যে বস্তুর সামান্যতম সাদৃশ্যও আমার সঙ্গে নেই, আমার স্ত্রী পঞ্চমুখে তারই প্রশংসা করতে আরম্ভ করে, রীতিমত অভাবনীয় ব্যাপার!
অসহ্য! এমন একটা ব্যাপার যে কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না। আমার স্ত্রীর আচার আচরণের চেয়ে জঘন্য কাজ আর কিছু থাকতে পারে না।
কার না জানা আছে, আমি মোটাসোটা গাট্টাগোট্টা চেহারার অধিকারী হলেও লম্বা-চওড়া কিছুটা কিম্ভুতকিমাকার তো অবশ্যই।
আর মি. ইউনজেন্ডর চেহারা ছবি? তার চেহারার আর পোশাক পরিচ্ছদের চাকচিক্য আর চালবাজির কথা তো এখন সবার মুখে মুখে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়ায়। জপমন্ত্রের মতো হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। কারণে অকারণে পরিচিতজনরা তার উপমা দেয়। দিনের মধ্যে অন্তত বারকয়েক তার নামটা যে কোনো উপলক্ষে মুখ দিয়ে উচ্চারণ না করতে পারলে যেন অনেকেরই অনেক কিছু বাদ রয়ে যায়। মনটা বিষিয়ে থাকে। আমার সতীলক্ষ্মী স্ত্রী-ও একই পথে হাঁটছে তা-তো অবিশ্বাস করার মতো কথা নয়। আর অবাক হবারও কিছু নেই। যাক, সে প্যাচাল পেরে ফায়দাও তো কিছু দেখছি না। অতএব তার কথা ছাড়ান দেওয়া যাক।
অক্লান্ত পরিশ্রম করে, ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়ে হন্যে হয়ে যার খোঁজ করছিলাম তার হদিস পেলাম না। কোনো জায়গাই তো তল্লাসি চালাতে বাদ দেইনি। একের পর এক আলমারি আর যতগুলো ড্রয়ার ছিল সবই পাত পাত করে খুঁজেছি। এমনকি কোনো আনাচ-কানাচও খুঁজতে বাদ দেইনি। আর সম্ভাব্য যত জায়গা ছিল, সাধ্যমত খোঁজাখুঁজি করলাম। সব চেষ্টাই বিফলে গেল। শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিতেই হলো।
শেষমেশ প্রসাধনের একটা বাক্স অবশ্য পেয়েছিলাম। ব্যস্তভাবে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে একটা শিশি ভেঙে ফেললাম। আতরের শিশি। মেঝেতে আতর ছড়িয়ে পড়ল। ঘরটা গন্ধে ভরে গেল। বলিহারি শখ বটে আমার স্ত্রীর! এতকিছুর পরও আতর মাখতে মন চায়!
আমি হতাশ হয়ে বিষণ্ণমুখে ভাবতে লাগলাম। মন-প্রাণ জুড়ে রইল জমাটবাধা বিষণ্ণতা। অতিকায় একটা পাথর যেন আমার বুকে স্থায়ীভাবে চেপে বসে রয়েছে। সে
যে কী দুঃসহ অস্বস্তিকর মর্মান্তিক অবস্থা তা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়, বললেও কে যে কতটুকু বিশ্বাস করতে উৎসাহি হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
নিদারুণ অস্থিরতার শিকার হয়ে আর একটা মুহূর্তেও যেন আমার কাটানো সম্ভব নয়। উপায়ন্তর না দেখে শেষপর্যন্ত দেশ ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নিতেই হলো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, বিবাগী হয়ে মনের দুঃখে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াব। তারপর বরাতে যা আছে দেখা যাবে।
বাড়ি ছেড়ে না পালিয়ে আত্মরক্ষার কোনো উপায়ও তো দেখছি না। যে স্বামী স্ত্রীর আতরের শিশি ভেঙে ফেলেছে তার পক্ষে বাড়িতে, স্ত্রীর কাছাকাছি থাকা তো অবশ্যই নিরাপদ নয়।
আমি আতরের শিশি ভেঙে ফেলেছি, স্ত্রীর নজরে যখন পড়বে, ততক্ষণে আমি পগার পার–অন্য দেশে পাড়ি জমিয়ে ফেলেছি।
অন্য কোনো দেশে, বাড়ি থেকে দূরে অন্য কোথাও গিয়ে নতুন করে জীবন আরম্ভ করব।
কথাটা তো মিথ্যা নয়, যে লোকের কণ্ঠনালী দিয়ে কথা বেরোয় না। যা বেরোয়। তা নিছকই ফাস ফাস শব্দ ছাড়া কিছু নয়। এমন একটা লোককে নতুন দেশের মানুষ অদ্ভুত এক জীব হিসেবেই ভাববে। অতএব, মানুষ হিসেবে ঘৃণা-অশ্রদ্ধা বা শ্রদ্ধা কোনোটাই করবে না। মানুষ হিসেবেই যাকে গণ্য করবে তখন এসবের তো প্রশ্নই ওঠে না।
আমি যখন অস্থিরভাবে কর্তব্য স্থির করার জন্য ভাবনা চিন্তায় ব্যস্ত, ঠিক তখনই হঠাৎ একট নাটকের নাম আমার স্মৃতির পটে জেগে উঠল। নায়কের গলা ছিল ভাঙা। গলা দিয়ে ফাস ফাস আওয়াজ ছাড়া কোনো শব্দ বেরোত না, কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। তার গলা দিয়ে যা বেরোত তাকে চাপা ও বিকট ঘড় ঘড় আওয়াজ ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। কিছুতেই না। এমন একটা ম্যাড় ম্যাড়ে গলা নিয়েই নায়ক গোড়া থেকে শেষ অবধি নাটকটাকে রীতিমত জমিয়ে দিয়েছিল। দর্শকরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শেষ দৃশ্য পর্যন্ত নাটকটা দেখল। আর আমি পারব না? অবশ্যই পারব। আমার যে না পেরে কোনো উপায়ই নেই।
আমার মাথায় ব্যাপারটা স্থায়ীভাবে চেপে বসল। যারপরনাই উৎসাহিত করল আমাকে। কণ্ঠস্বরের ফ্যাসফ্যাসানিও একটা দারুণ আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারে। স্বদেশে যদি না-ই হয়, বিদেশে হওয়াটা কোনো অসম্ভব কথা নয়। বিদেশে এমন একটা ফ্যাঁসফ্যাঁসে আওয়াজযুক্ত কণ্ঠস্বর যথেষ্ট সমাদর পেতে পারে।
ব্যস, আমি দেশত্যাগী হয়ে বিদেশের মাটিতে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আর একটা দিনও দেরি করতে মন চাইল না। ঘরের দরজা বন্ধ করে নাটকের মহড়া দিতে মেতে গেলাম। দুদিন কষে মহড়া দেওয়ার পর আমার উৎসাহ হাজার গুণ বেড়ে গেল। বুঝলাম, নাটক রীতিমত জমে উঠেছে।
স্ত্রী? স্ত্রীকে ধাপ্পা দিতে বেগ পেতে হবে না। এটা একটা সমস্যাই নয়। আমি যে নাটকের নায়ক বনে গিয়ে এক নাগাড়ে মহড়া দিয়ে চলেছি, স্ত্রীর তা না বোঝার কথা নয়। আমার বোকা হাঁদা স্ত্রী সহজেই ব্যাপারটাকে বুঝে নেবে।
আরে ভাই নাটক মঞ্চের কদর-টদর তো কিছু কম নয়। নাটকের নামে যে কোনো মানুষের মনই নেচে ওঠে। আর আমার স্ত্রী যার মাথায় গোবর ঠাসা সে তো আমি নাটক করতে নামছি শুনলে আহ্লাদে একেবারে গদগদ হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহ নেই। ব্যাপারটা কোনোরকমে তার মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারলেই বাজিমাৎ।
বাজি মারতে গিয়ে আমাকে যে হরেকরকম কায়দা-কৌশলের সাহায্য নিতে হয়, তা তো আর মিথ্যা নয়। অস্বীকারও করতে পারব না।
আমার কাণ্ডকারখানা দেখে স্ত্রী যতবার, যতরকম প্রশ্ন করেছে ততবারই আমি নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে তাকে ঠাণ্ডা করতে চেষ্টা করেছি।
স্ত্রীর মনে বিশ্বাস আনতে গিয়ে তার প্রশ্নের জবাবে আমি ব্যাঙের মতো ঘোৎ ঘোঁৎ করে অনবরত বিড় বিড় করে বিয়োগান্তক নাটকের সংলাপ বলে গেছি। তারই ফাঁকে কখনও দাঁত-মুখ বিকৃত করেছি, চেঁচিয়েছি, কখনও কোমর নাচিয়েছি, কখনও হাঁটুর নাচ দেখিয়েছি আবার কখনও মেঝেতে পা ঘষে ঘষে কায়দা কৌশল করতেও বাদ দেইনি।
নাটকের সে নায়কের অভিনয় অনুকরণ করতে গিয়ে যা-কিছু করা দরকার কিছুই করতে বাদ দেইনি। অবকিল তার মতো অভিনয় করে হাততালি ও বাহাবা কুড়িয়েছি। তাই তো কেউ ধরতেই পারেনি যে, আমার কণ্ঠ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, বাকশক্তি রহিত হয়ে গেছে।
এভাবে সংসারের অত্যাবশ্যক কাজকর্মের ফাঁকে নিষ্ঠার সঙ্গে মহড়া দিয়ে দিয়ে আমি অভিনয়ের কলাকৌশল রপ্ত করে ঝানু অভিনেতা বনে গেছি।
এক ভোর রাতে বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে এক ডাক গাড়িতে চেপে বসলাম।
রাস্তা ফাঁকা পেয়ে গাড়িটা উল্কার বেগে ধেয়ে চলল। কিন্তু আমি কোন্ দিকে আর কোথায় চলেছি, বলব না। দয়া করে এ-প্রশ্নটা করবেন না। আমার পক্ষে অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব নয়–কিছুতেই নয়।
আমি আগেভাগেই আমার স্ত্রী-বাড়ির সবাইকে আর পরিচিতজনদের বলে রেখেছিলাম, একটা জরুরি কাজের তাগিদে অমুক শহরে যেতে হচ্ছে। ব্যাপারটা নিয়ে কেউ-ই মাথা ঘামায়নি।
ডাক গাড়ির সে কামরাটায় লোক একেবারে ঠাসা। মুরগি চালান গাড়িও বুঝি এর চেয়ে হালকা থাকে।
তখনও প্রকৃতির বুকে ভোরের আলো ফুটে ওঠেনি। ফলে গাড়ির কামরাটার ভেতরে আলো-আঁধারির খেলা চলছিল। একে আবছা অন্ধকার, তার ওপর মুরগি গাদাগাদি অবস্থা দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড় হয়ে পড়েছিল। তার ওপর গাড়ির ঘরের ভেতরের অন্ধকারের সমস্যা তো কম-বেশি ছিলই। ফলে কারো মুখ দেখা সম্ভব হয়নি। কি করেই বা তা সম্ভব হবে? নিজের হাতটাই যে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না। আবছা অন্ধকারে আমি যে কেবল কারো মুখ দেখতে পাইনি তাই নয়, আমার মুখও কারো পক্ষে দেখা সম্ভব হয়নি। সহযাত্রীদের কাউকেই আমি চিনতে পারিনি।
কাউকে ঠেলে আর কাউকে গোত্তা মেরে আমি বেঞ্চে কোনোরকমে কুকুর-কুণ্ডুলি। হয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।
আমার দুদিকে দশাশই চেহারাধারী দুজন অনেক আগেই শুয়ে পড়েছে। তারা মানুষ, নাকি হাতি বোঝার উপায় ছিল না।
ধুমসো লোক দুটোর ফাঁকে আমি কোনোরকমে নিজেকে খুঁজে দিতে না দিতেই, শোয়াতে না শোয়াতেই আর অনেক বেশি মোটাসোটা, একেবারে শালগাছের গুঁড়ির মতো একটা হোঁতকা লোক আমার ওপরে দুম্ করে শুয়ে পড়ল। তিনজনের চাপে আমার দশা যে কী খারাপ হয়ে দাঁড়াল তা আর বলার নয়। আমি তো পৌণে-মরা হয়ে প্রায় দম বন্ধ করে পড়ে রইলাম।
আমার তো আবার চিৎকার চ্যাঁচামেচি করার উপায়ও নেই। গলা দিয়ে অনবরত সাধ্যমত জোরেই ফাঁস ফাঁস আওয়াজ করে চললাম। কাকস্য-পরিবেদনা–কে, কার কথা শোনে!
ইয়া পেল্লাই চেহারাধারী লোক তিনটি শুতে না শুতেই দিব্যি ঘোৎ ঘোৎ করে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে আরম্ভ করল। আর আমি তিনটি বিশালায়তন পাথরের মাঝখানে শক্ত কাঠ হয়ে মড়ার মতো পড়ে রইলাম।
অস্বাভাবিক চাপে আমার ঘাড়টা বেঁকে যায় আর হাত-পা, এমনকি আঙুলগুলো নাড়ানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেললাম।
হোঁতকা লোকটানির্ঘাৎ আমাকে দেখতে পায়নি, একটা লোকের ওপর যে সে নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়েছে, এটাও বুঝতে পারেনি। যদি বুঝতেই পারত তবে অবশ্যই এ কাজ করত না–মানুষ তো বটে!
আমার ওপর নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকা লোকটা ভোরের আলো ফোঁটার পর ব্যাপারটা বুঝল–আমাকে দেখতে পেল।
ঘুম ভাঙার পর ধীরে ধীরে উঠে বার কয়েক হাই তুলে, আড়ামোড়া ভেঙে বেহুদা লোকটা যখন দেখতে পেল, সে আমার ওপর শুয়ে নিশ্চিন্তে রাত কাটিয়েছে, আর আমি মরার মতো কাঠ হয়ে সারাটা রাত অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে কাটিয়েছি।
নির্ঘুম অবস্থায় তো অবশ্যই তখন বহুভাবে অনুশোচনা প্রকাশ করল। কতবার যে ইস্ আর আহা-উঁহু করে নিজের কৃতকর্মের জন্য মার্জনা ভিক্ষা করল, তা বলে শেষ করা যাবে না।
সে তৎক্ষণাৎ এক লাফে মার ওপর থেকে নেমে গেল। সহৃদয়তার সঙ্গে শালগাছের গুঁড়ির মতো ওই ধুমসো লোক দুটোর ফাঁক থেকে আমার প্রায় অসাড় দেহটাকে এক হেঁচকা টানে তুলে নিয়ে সারা গা হাতিয়ে টা নিয়ে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য সাধ্যতীত প্রয়াস চালাতে লাগল। তারপরও যখন দেখল, আমার বেঁকে যাওয়া ঘাড়টা কিছুতেই সোজা হচ্ছে না, মুখে ফাস ফাঁস আওয়াজ ছাড়া রা বেরোচ্ছে না–তখন চলন্ত গাড়ির ঘরের সবাইকে ডাকাডাকি করে তুলে আমার গলার ফুলে-থাকা শিরাটার দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাল–চলন্ত গাড়িতে মরা পাচার হচ্ছে।
লোকটা গলা-ছেড়ে চিল্লাচিল্লি করে গাড়ির মালিকের চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে লাগল। যাত্রীবোঝাই গাড়িতে মড়া পাচারের ব্যাপারটাকে তো আর কারো পক্ষেই বরদাস্ত করা সম্ভব নয়। রেগেমেগে আগুন হবার মতো ব্যাপারই তো বটে।
আমি যে নেহাৎ মড়া। আমার দেহ থেকে আত্মারাম অনেক আগেই ইহলোক ছেড়ে অন্য লোকের উদ্দেশ্য পাড়ি জমিয়েছে, তা প্রমাণ করার জন্য হোঁকা লোকটা গদার মতো হাত দিয়ে আমার মুখে, একেবারে ডান চোখের ওপর শরীরের সবটুকু শক্তি নিঙড়ে দুম করে একটা ঘুষি-হাঁকিয়ে দিল।
ঘুষি মেরে লোকটা আমাকে মড়া প্রমাণ করতে চাইল বটে। কিন্তু কাজের কাজ কী হল? আমি তো তখন শক্ত একটা কাঠের গুঁড়ি ছাড়া কিছু নই। শরীর এতটুকুও নড়ানড়ি করছে না, গলা দিয়ে রা-ও বেরোচ্ছে না। তাই ঘরের যাত্রীরা একে একে আমার কান ধরে জোরে জোরে টেনে এটাই প্রমাণ করল হোঁকা লোকটার কথাই সত্যি, আমি মড়া ছাড়া কিছুই না–অনেক আগেই আত্মারাম খাঁচা-ছাড়া হয়ে গেছে।
নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছবার পর সবাই মিলে হরেকরকম কথাবার্তা, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত পথ বের করে ফেলল। হতচ্ছাড়া মরাটাকে এ-মুহূর্তেই চলন্ত গাড়ি থেকে ছুঁড়ে বাইর ফেলে দিতে হবে।
দাঁড়কাক নামক পন্থশালার গায়ের রাস্তাটা দিয়ে গাড়িটা তখন উল্কার বেগে ধেয়ে যাচ্ছিল। আমার সহযাত্রীরা আমাকে ধরাধরি করে নিমর্মভাবে চলন্ত গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে একেবারে রাস্তার ওপর দুম করে ফেলে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার ঠিক ওপরেই আছাড় খেয়ে পড়ল আমার সবচেয়ে ভারী বাক্সটা। পথের ওপরে এত জোরে আছড়ে পড়ায় সেটার যে কী হাল হয়েছিল, তা না বললেও সহজেই অনুমান করে নেওয়া যেতে পারে।
কেবলমাত্র বাক্সটার কথাই বা বলি কেন? আমার নিজের কি হাল হলো বলছি। দু-দুটো আছাড়, একবার নিজে পড়লাম আছাড় খেয়ে শান-বাঁধানো পথের ওপর আর পর মুহূর্তেই মালপত্র বোঝাই টিনের ইয়া বড় বাক্সটা সরাসরি একেবারে আমার মাথার ওপর পড়ায় মাথার খুলিটা ভেঙেচুড়ে একাকার হয়ে গেল, আর হাত দুটো তো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে অনেক আগেই। সব মিলিয়ে আমি প্রায় একটা মাংস আর হাড়ের পিণ্ডে পরিণত হয়ে গেলাম।
পথচারীরা কোনোরকমে আমার লাশটাকে হাসপাতালের সিটের ওপর তুলে দিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিল। ডাক্তাররা সেখান থেকে আমাকে মর্গেই চালান দিত, কিন্তু কি ভেবে মর্গে না নিয়ে আমাকে নিয়ে ফেলল ঘরের টেবিলের ওপর।
ডাক্তাররা কাটা ছেঁড়া শুরু করে গোড়াতেই আমার কান দুটোকে কেটে ছেটে বাদ দিয়ে দিল। কানকাটা গেলে একটু আধটু সজীবতা না দেখালে চলবে কেন? আমিও সাধ্যতীত চেষ্টার মাধ্যমে তা একটু দেখলাম বটে।
সার্জেন লোকটা নিজে কৃতবিদ্য হলেও আমার পরিস্থিতি দেখে ভড়কে গেলেন। তাই শহরের এক বিশেষজ্ঞ শল্য চিকিৎসককে তলব করে আনলেন।
জরুরি তলব পেয়ে শল্য চিকিৎসক ভদ্রলোক হন্তদন্ত ছুটে এলেন। তিনি প্রথমে রোগীর পরিস্থিতি সম্বন্ধে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে সবকিছু শুনে নিলেন। তারপর বাস্তব ক্ষেত্রে যখন দেখলেন, ছুরির আঁচড় পড়ামাত্র লাশটা চিংড়িমাছের মতো দারুণভাবে তিড়িং তিড়িং করে পা ছুঁড়ছে, ভাঙা হাত দুটোকে নাড়াচ্ছে আর শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে–তখন তিনি নির্দিধায় মতামত ব্যক্ত করলেন–এর কারণ অবশ্যই আছে।
ডাক্তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালেন।
তার জিজ্ঞাসা নিরসনের জন্য শল্য চিকিৎসক মুচকি হেসে বললেন–হ্যাঁ ভাই, বিশেষ কারণ ছাড়া রোগীর মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়া কী কখনও সম্ভব বলুন?
কিন্তু কী সে কারণ? আপনাদের এ-বিশেষ চিকিৎসা-পদ্ধতির সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় না থাকার জন্যই এমন ধন্দে পড়ে গেছি।
মুখের মুচকি হাসিটুকু অক্ষুণ্ণ রেখেই শল্যচিকিৎসক এবার রোগীর মধ্যে আকস্মিক পরিবর্তন ঘটার কারণ সম্বন্ধে বললেন–আসলে এ-ক্ষেত্রে যে ব্যাটারিটা ব্যবহার করা হয়েছে।
নতুন ধরনের ব্যাটারি বলতে আপনি কী বুঝাতে চাইছেন?
গ্যালভানিক ব্যাটারি। খুবই তেজস্ক্রিয় এটা। এ ব্যাটারি ব্যবহার করলে কাটা পাঁঠার মাংসপেশীও রীতিমত থরথর করে কেঁপে ওঠে।
ডাক্তার ভদ্রলোক বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখ দুটো মেলে তার মুখের দিকে নীরব চাহনি মেলে তাকিয়ে রইলেন।
শল্য চিকিৎসক বলে চললেন–কাটা পাঁঠার মাংসপেশী যখন লাফায় তখন কান কাটা মানুষ তো পা ছুঁড়বেই। আর ভাঙা-হাত যে নড়ছে, সে তো আপনি নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন, ঠিক কি না? তার শরীরটা কেমন বার বার দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, চেয়ে দেখুন একবারটি।
কথা কটা শেষ করেই তিনি ঝটপট জামার হাত দুটো গুটিয়ে নিলেন।
তারপর যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুততার সঙ্গে ইয়া বড় আর চকচকে ঝকঝকে ছুরি কাঁচি হাতে তুলে নিলেন।
আমি তার পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায় প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে লাগলাম।
এবার শল্যচিকিৎসক নিতান্ত নির্মমতার সঙ্গে আচমকা ফ্যাচ করে আমার পেটে ছুরির ফলাটা গেঁথে দিয়ে, মারলেন একটা টান। ব্যস, পেটটা দু-টুকরো হয়ে গেল।
দুই আঙুলের চাপে পেটের চামড়া ফাঁক করে আমার পেটের নাড়িভুড়ি বের করে টেবিলের ওপরে রাখা একটা বড়সড় ট্রের ওপর আলতোভাবে রেখে দিলেন। উদ্দেশ্য, পরবর্তীকালে সময়-সুযোগ মতো এগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবেন–ব্যক্তিগত গবেষণাও বলা যেতে পারে।
নাড়িভুড়ির ব্যবস্থা করার পর ছুরির একটানে আমার নাকটা কেটে নামিয়ে দিলেন।
আমাকে অসম্ভব রকম নড়ানড়ি আর পা ছোঁড়াছুড়ি করতে দেখেও তিনি কিন্তু মোটেই অবাক হলেন না।
তিনি এবার ধীরস্থিরভাবেই আমার হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললেন। তারপর দরজায় ইয়া বড় একটা তালা লটকে দিলেন। আরও বড় বড় ঊড় বড় চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের এনে জড়ো করার জন্য, তার নিজের জ্ঞান-বুদ্ধির ঘাটতিটুকু তাদের দিয়ে পূরণ করানোই তার সে মুহূর্তের উদ্দেশ্য ছিল।
ইতিমধ্যে দুটো বিড়াল গুটি গুটি কখন যে ঘরে ঢুকে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল কেউ টেরও পায়নি। ঘর খালি পেয়ে তারা এবার কেরামতি দেখাতে মেতে গেল। ঝট করে আমার কাটা নাকটার ওপর দিয়ে হাইজাম্পের খেলা দেখিয়ে ফেলল।
পরমুহূর্তেই আচমকা আমার মুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো দিয়ে খানিকটা মাংস গলা থেকে খুবলে তুলে নিয়ে পরম তৃপ্তিতে খেতে আরম্ভ করল।
এখন ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটলে কোনো মড়ার পক্ষেও স্থির থাকা সম্ভব নয়। হঠাৎ বার কয়েক মোচড়া মুচড়ি দিতেই বাধন আলগা হয়ে গেল। তারপর এক ঝটকা মারতেই দড়িদড়া ছিটকে হাত কয়েক দূরে গিয়ে পড়ল।
আমার শরীরটা অস্বাভাবিক দাপাদাপি শুরু করে দিল। অতর্কিতে আমি ছিটকে গিয়ে জানালার কাছে দুম করে আছাড় খেয়ে পড়লাম। জানালাটা খোলাই রয়েছে। মুহূর্তমাত্র দেরি না করে এমন জোরে এক লাফ দিলাম যে একেবারে জানালার বাইরে চলে গেলাম। দরজার তালাটা আগের মতোই ঝুলতে লাগল। আর যার জন্য এত বড় তালা ব্যবহার করা হয়েছে, সে এখন নির্বিবাদে ঘরের বাইরে। আজব কাণ্ডই বটে।
আমি যখন জানালা দিয়ে বাইরে লাফ দিলাম, ঠিক সে মুহূর্তেই জানালারটা গা ঘেঁষে একটা কয়েদি-গাড়ি ধীরমন্থর গতিতে পথ পাড়ি দিচ্ছিল। কুখ্যাত এক চোর গাড়িতে শুয়ে অনবরত গুঙিয়ে চলেছে। শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। বুড়ো। খুবই দুর্বল। যমদূত এসে নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় প্রতিটা মুহূর্ত গুণে চলেছে। গাড়ি থেকে সটকে পড়ার মতো কোনো ক্ষমতাই তার নেই।
কয়েদিকে নিয়ে কোনো চিন্তা না থাকায় রক্ষীরা গলা পর্যন্ত মদ গিলে বেহেড মাতাল বনে গাড়ির এক কোণে শরীর এলিয়ে দিয়ে পরমানন্দে ঝিমাচ্ছে।
গাড়ির চালক জেগে রয়েছে সত্য। কিন্তু তাকেও প্রায় গিলেই ফেলেছে। আধ ঘুমন্ত অবস্থায় কোনোরকমে গাড়িটাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে চলেছে। ফলে গাড়ির ভেতরে কি হচ্ছে, কি হতে পারে, এ-নিয়ে কারোই নজর নেই, থাকার কথাও নয়।
গাড়িটায় ছাদ নেই। পুরোপুরি ভোলা। ফলে জানালা দিয়ে লাফিয়ে আমি সরাসরি গাড়িটার ভেতরে দুম্ করে পড়ে গেলাম। পড়লাম একেবারে আধ-মরা কয়েদিটার পাশে।
আরে ব্যস! হতচ্ছাড়া বুড়োটা কী সাংঘাতিক ফেরেকবাজ! আমি গাড়িতে আছাড় খেয়ে পড়ামাত্র সে তড়াক করে লাফিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে পড়ল। নিস্তেজ চোখের মণি দুটোকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাড়ির চালক আর রক্ষীদের বেহাল অবস্থাটা দেখে নিশ্চিন্ত হল, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। পরমুহূর্তেই কোলাব্যাঙের মতো লম্বা একটা লাফ দিয়ে একেবারে গাড়ির বাইরে চলে গেল। এবার উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে পাশের একটা গলির ভেতরে ঢুকে চোখের পলকে একেবারে বেপাত্তা হয়ে গেল। কী ধড়িবাজ বুড়ো রে বাবা! এতক্ষণ তবে মড়ার ভান করে ঘাপটি মেরে পড়েছিল!
বুড়োটা গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ার সময় গাড়িটা যে অস্বাভাবিক বেজে উঠেছিল, আর পরমুহূর্তে পথে দুঁপ করে আওয়াজ হয় তাতে রক্ষীরা যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল।
তারপর উঁকি ঝুঁকি মেরে যখন দেখল কয়েদি দাঁড়িয়ে রয়েছে তখন তারা অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে ঘা-কতক দমাদম বসিয়ে দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল। আসলে ডাক্তাররা লাশ কাটা টেবিলে তোলার সময় আমাকে যে বিশেষ পোশাকটা পরিয়ে দিয়েছিল তা অবিকল কয়েদিটার পোশাকের মতো। অতএব নেশার ঘোরে আমাকেই কয়েদি ভাববে, আশ্চর্য কি?
যাক, আমি বন্দুকের কুঁদোর ঘা খেয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম।
আরও কিছুটা পথ পাড়ি দেওয়ার পর গাড়িটা বধ্যভূমির গায়ে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আমাকে অনবরত গুঁতোগাতা দিতে দিতে গাড়ি থেকে নামিয়ে বধ্যভূমিতে নিয়ে গেল। আমি ব্যাপার কিছু বুঝে ওঠার আগেই ব্যস্তহাতে আমার গলায় ফাঁসির দড়ি পড়িয়ে দেওয়া হলো। পরমুহূর্তেই রক্ষীরা হৈ-হল্লা করতে করতে আমাকে লটকে দিয়ে দায়িত্ব পালন করল।
একেই বলে শাপেবর হওয়া। গলায় ফাঁসির দড়ি পড়িয়ে লটকে দেওয়ায় আমার কিন্তু উপকারই হলো। বাঁকা ঘাড়টা টান-টান মানে সিধে হয়ে গেল।
আর আমার ফাঁসিতে মৃত্যু? দম আটকে মৃত্যু? হায় ঈশ্বর আগে থেকেই যার দম আটকে রয়েছে তার আবার নতুন করে দম আটকাবার প্রশ্ন ওঠে কি করে? মরা কবার মরবে? তবে এটা খুবই সত্য যে, লটকে দেবার মুহূর্তে আমি খুবই পা ছোঁড়াছুঁড়ি করছিলাম। আর পুরো শরীরটাকে দুমড়ে মুচড়ে সার্কাস খেলা দেখাচ্ছিলাম।
আমার অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা দেখে উপস্থিত সবাই এতই মজা পাচ্ছিল যে, জোরে জোরে হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে বলছিল–আবার! আবার হোক! আবার হোক!
সেখানে রক্ষীরা ছাড়া জনা কয়েক মহিলাও ফাঁসি দেখার জন্য জড়ো হয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন তো আমার ভেল্কিবাজি দেখে চোখ উলটে, দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে দড়াম করে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়েই সম্বিৎ হারিয়ে ফেলল। আর জনা কয়েকের। ফিটের ব্যামো ছিল। তাদেরও মূচ্ছা যেতে সময় লাগল না।
আর একজন চিত্রশিল্পী সেখানে উপস্থিত ছিল। ছবি আঁকা তার পেশা নয়, নেশা। সে ফাঁসির মড়া ছবিটায় রং-তুলি দিয়ে শেষ পোচ দিতে দিতে খুশিতে ডগমগ হয়ে হয়ে পড়েছিল। তার খুশির বিবরণ কাগজ-কলমের সাহায্যে দেওয়া সম্ভব নয়।
ফাঁসির মঞ্চে আমাকে কিন্তু বেশিক্ষণ রাখা হয়নি। কেল্লা ফতে হয়ে গেছে ভেবে ব্যস্ত-হাতে দড়ি খুলে আমার লাশটাকে নামিয়ে নিয়ে আসা হলো। একজনকে যমের দুয়ারে পাঠাতে এর বেশি সময় তো আর নষ্ট করা যায় না। কারণ, ইতিমধ্যেই আরও জনাকয়েক কয়েদি এনে জড়া করা হয়েছে। তাদেরর কথাও তো জানা দরকার।
আমার গলা থেকে দড়িদাঁড়া খুলে কবরখানায় নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে আমাকে কবরস্থ করা হলো।
আমাকে মাটিচাপা দিয়ে হৈ-হল্লা করতে করতে সবাই কবরখানা ছেড়ে দূরে চলে যেতেই আমি কাজে লেগে গেলাম। ক্রোধে প্রায় ফেটে পড়ে লাথি মেরে কফিনের ডালা ভেঙে পাতালপুরী থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
এবার আমি মুক্ত, সম্পূর্ণ স্বাধীন। কারো তোয়াক্কাই আমি করি না।
পাতালপুরী থেকে উঠে এসে আমি এক অদ্ভুত খেলায় মেতে গেলাম। মাটি খুঁড়ে সারি সারি কফিনের প্রত্যেকটার ডালা ভেঙে ভেঙে ভেতরে হাত চালিয়ে দিতে লাগলাম। আর হাতিয়ে হাতিয়ে দেখতে লাগলাম, সেগুলোর ভেতরে কি ধরনের মড়া। রয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা লাভ করে ফেললাম, কম কথা!
কফিনগুলোতে কি দেখলাম? একটা কফিনে দেখতে পেলাম, হাতির দেহের মতো ইয়া বড় একটা দশাসই চেহারা। কোনো মানুষ যে এমন দীর্ঘ আর স্থূল দেহের অধিকারী হতে পারে, আগে জানা ছিল না। ব্যস, তার হাতির মতো বিশাল দেহটার অসহায়তার কথা উল্লেখ করে আমি ফাস ফাঁসে গলায় দীর্ঘ একটা ভাষণ দিয়ে দিলাম। ধারে কাছে কেউ থাকল আর না-ই বা থাকল, শ্রোতারই বা দরকার কি? ভাষণে একটা কথাই আমি বারবার বললাম–বাপধন, জীবদ্দশায় ইয়া পেল্লাই দেহটা নিয়ে কী কষ্টই না তোমাকে পোহাতে হয়েছে। আজ তোমার বিশ্রাম–স্বস্তি।
এবার দুপা এগিয়ে অন্য আর একটা কফিনের ডালা ভেঙে দেখলাম, তালগাছের মতো ধিঙ্গি আর তেমনই মোটাসোটা একটা মড়া এলিয়ে পড়ে রয়েছে। তার নাকের ছিদ্র দুটোয় আঙুল সিঁধিয়ে দিলাম। তারপর সজোরে একটা হ্যাঁচকা টান মেরে বেচারা মড়াটাকে বসিয়ে দিলাম। হতচ্ছাড়াটা বার বার কলাগাছের মতো কাৎ হয়ে পড়ে যেতে চাইল। কফিনের গায়ে ঠেস দিয়ে বসিয়ে দিলাম।
এবার ভাষণের পালা। আগের মতোই ফ্যাসফ্যাসে গলায় তার কিম্ভুতকিমাকার চেহারাটা নিয়ে জুতসই একটা ভাষণ দেবার চেষ্টা করতে অত্যাশ্চর্য একটা কাণ্ড ঘটে গেল–
হতচ্ছাড়া মড়াই দুম করে হাত দুটো তুলে এনে যন্ত্রচালিতের মতো মুখের বাধন আলগা করে ফেলল। এক ঝটকায় পটিটা খুলে ফেলল।
ব্যস, আর যাবে কোথায়! তারপরই আমার কাছা খুলে দেবার–চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে আরম্ভ করল।
ভাই, কি আর বলব, ফাঁসফেঁসে গলায় আমি যতবার, যতভাবে প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করছি, ততবারই খেঁকিয়ে, জোরসে ধমক দিয়ে আমার মুখ বন্ধ কওে দিয়েছে। আজব কাণ্ড! আমাকে টু-শব্দটিও করতে দিল না।
তার সবচেয়ে বড় আপত্তি, আমি কেন তার নাকের ছিদ্রের মধ্যে আঙুল সিঁধিয়ে দিয়েছি। বাজখাই গলায় খেঁকিয়ে উঠল–আর কত অত্যাচার আমার ওপর চালানো হবে, জানতে চাই। পরমুহূর্তেই যখন আমাকে মি. নিশ্বাস বলে মস্করা করতে লাগল, তখনই আমার মধ্যে প্রবল সন্দেহের উদ্রেক ঘটল।
সে জোরদার বক্তৃতা শুরু করল। আমি উকর্ণ হয়ে তার বক্তৃতার পরবর্তীঅংশ শুনতে লাগলাম। এখানে বলে রাখা দরকার, যদিও আমার কান দুটো অনেক আগেই কেটে হেঁটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে তবু শল্য চিকিৎসকের অপার করুণায়, তার লকলকে ছুরিটার কল্যাণে আমার শ্রবণেন্দ্রিয় অনেক, অনেক বেশি কর্মক্ষম হয়ে পড়েছিল।
তার কথাবার্তায় কি বুঝতে পারলাম, বলুন তো? পারলেন না তো? আমার গিন্নির মন পাওয়ার জন্য সোহাগ করে যে নচ্ছারটা জিনিসপত্র দিয়েছিল–এ হচ্ছে সেই উদারহৃদয় মহাপ্রভু মি. উইনডেনান্ড! রাগে আমার সর্বাঙ্গ রি রি করে করে উঠল।
আমি যখন অভিধান বহির্ভূত বাছাবাছা শব্দ ব্যবহার করে আদরের বউটাকে মুখঝামটা দিচ্ছিলাম, শয়তানটা তখন খোলা-জানালার আড়ালে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনছিল আর রাগে আমার ওপর অগ্নিশর্মা হয়ে উঠছিল।
ফুসফুস নিঙড়ে আমার সবটুকু দম বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরোটাই গলগল করে তার ফুসফুসে ঢুকে আটকে রয়েছে!
ব্যস, তারপর থেকেই সে তড়পাতে শুরু করেছে। কিন্তু হায়! আটকে যাওয়া বাতাস আর ফুসফুস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে না।
সে অনবরত বক বক করেই চলল। মুখ দিয়ে যেন খই ফুটছে। প্রতিবেশিদের পক্ষে আর কাহাতক ধৈর্য রাখা সম্ভব। তারা টিকতে না পেয়ে শেষমেশ জোর করে ঠেসে ধরে মুখে পট্টি বেঁধে দিয়ে তবেনিস্কৃতি পেল। তারপর কবরখানায় নিয়ে এসে মাটির তলায় পুঁতে দিয়ে তারা স্বস্তির নিকাস ফেলল।
আমি হ্যাঁ, একমাত্র আমার দ্বারাই তার পিতৃদত্ত জীবনটা রক্ষা পেতে পারে। উপায়? হ্যাঁ, চমৎকার একটা উপায় অবশ্যই আছে। উপায়টা হচ্ছে–আমার ফুসফুস থেকে খোয়া-যাওয়া দম তার ফুসফুস থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যদি আবার আমার ফুসফুসে চালান করে দেই, তবে মি. উইনডেনান্ডর ফুসফুস হালকা হয়ে যাবে। ব্যস, বাজিমাৎ।
আমি সম্মত হয়ে গেলাম। সে মুহূর্তেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত–না সিদ্ধান্ত বললে ঠিক বলা হবে না–শর্ত হয়ে গেল, আমি অর্থাৎ মি. বন্ধ হওয়া নিশ্বাস কী ভয়ঙ্কর প্রকৃতির তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে বাতাসখেকো শয়তান মি. ইউনডেনান্ড। এতেই তার চরম শিক্ষা অবশ্যই হয়ে গেছে। এরপর আর কোনোদিন ভুলেও আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না।
আমি নিতান্ত করুণাবশত তার ফুসফুসে আটকে থাকা আমার দমটুকু ফিরিয়ে নিলাম। ফিরে পেলাম আমার গলার আগেকার সে ধার–তীক্ষতা।
আমাদের উভয়ের তখন সে কী উল্লাস! উভয়ে মিলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনবরত চিৎকার চাঁচামেচি করে গেলাম। অর্থহীন শব্দ ব্যবহার করে চেঁচিয়ে যাওয়া যাকে বলে। আর তখন আমাদের গায়ে গতরে সে কী জোর। হাতির শক্তি যেন আমাদের উভয়ের দেহে ভর করেছে। সমাধিক্ষেত্রের সদর দরজাটার গায়ে দমাদম লাথি হাঁকাতে লাগলাম। লোহার দরজাটার পক্ষে দীর্ঘসময় আমাদের লাথির মোকাবেলা। করা সম্ভব হলো না। অচিরেই সেটা হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
আর লাথির সে কী আওয়াজ! চারদিক কাঁপানো বিকট আওয়াজ শুনে খবরের কাগজের লোকগুলো রীতিমত ভড়কে গেল। শুরু হয়ে গেল স্থানীয় খবরের কাগজের পাতায় জোর লেখালেখি।
ভল্টের চাবি নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এল চাবির গোছার জিম্মাদার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। খোলা হলো পেল্লাই দরজাটা। দরজার পাল্লা খুলেই এই দুই মূর্তিমানকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের আত্মারাম তো খাঁচাছাড়া হয়ে যাবার জোগাড় হলো।
কি বলছেন, অসম্ভব? গাঁজাখুরি? যে, যা বলেন।