ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

ললিপপ

ললিপপ

আমার নাম সম্বরণ সেন। আমার মনে হচ্ছে একটু পরেই আমি মারা যাব। আমার অন্তিমকাল উপস্থিত হয়েছে। তা প্রায় মাস তিনেক হল ভুগছি। বিছানায় পড়ে আছি। বয়েস আমার হয়েছে তবে যাওয়ার বয়েস হয়নি। আরও দশবছর থাকা যেত। আজকাল মানুষ সত্তর, আশি বছর হেসে খেলে চালিয়ে দেয়। দেখছি তো চারপাশে। দোষটা আমারই। এত বেশি ভোগ আমার সহ্য হল না। দারিদ্র্যে মানুষ মরে না। মানুষ মরে অতিরিক্ত ভোগে। ভোগ এক প্রকার দুর্ভোগ বিশেষ। আমি যে মরতে চলেছি, আমার বাড়ির লোকের তার জন্যে তেমন কোনও উদ্বেগ নেই। আমার বাড়িটা তেমন ছোট নয়। চারদিকে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সময়টা সন্ধ্যে। টিভি চলছে। গল্পগুজব হচ্ছে। সবই আমার কানে আসছে। আমার এইভাবে পড়ে পড়ে বেঁচে থাকাটা কারোরই তেমন পছন্দ হচ্ছে না। আমাকে আর প্রয়োজন নেই। দেনা-পাওনা মোটামুটি চুকে গেছে। এই যে আমি চলে যাচ্ছি কারোরই তাতে কোনও অসুবিধে নেই। বাড়ি রইল। গাড়ি রইল। ব্যাংক ব্যালেনসও মোটামুটি ভালই রইল। ছেলেরা বেশ তালেবর হয়েছে। মেয়ে দুটো নিজেরাই ভালো বিয়ে করেছে। দুজনেই বিদেশে। ভালো ছেলেরা আজকাল স্বদেশ পছন্দ করে না। বেশিরভাগই সব আমেরিকায় থাকে। মেয়ে দুটো বছরে একবার করে আসে। দাড়ি কামাবার সাবান, ব্লেড, গায়ে মাখা সাবান, সেন্ট, এইসব গুচ্ছের দিয়ে যায়। পাঁচমিশেলি কথা বলে। আমেরিকান ইংরিজি। যার কিছুই আমি বুঝি না। আসে, এখানে-ওখানে বেড়ায় আবার উড়ে চলে যায়। এবারেও এসেছিল। এসে বেশ বিপদে পড়ে গিয়েছিল। আমি ভুগছি কিন্তু মরছি না। কত আর অপেক্ষা করব। ছুটি ফুরিয়ে আসছে, নাতি, নাতনীর স্কুল, জামাইয়ের চাকরি। যাবার আগে সব বলে গেল, ‘বাপি তুমি সাবধানে থাকবে। ভালো করে চিকিৎসা করাবে। কোনও ওষুধ লাগলে জানাবে। তোমাকে একবার ওখানে নিয়ে যেতে পারলে সাতদিনে চাঙ্গা করে দিতুম।’ আমি তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম। তারা আমার কপালে হাত বোলাল। হাত দুটো কিছুক্ষণ ধরে রইল। চোখ দুটোয় সামান্য জল চিকিচিক করল। অবাক হয়ে দেখতে লাগলুম, কেমন সব পর হয়ে গেছে।

পৃথিবীতে নিজের চেয়ে আপনার কে আর আছে। এই যে আমি যাচ্ছি, এতে কার কী! আমার আমিটাই যেতে বসেছে। আমার আমিটাই চলে যাবে!

আমার বউ কোনওকালেই খুব একটা সুস্থ ছিল না। বড় লোকের মেয়ে আমার অবস্থাও ভালো ছিল। এই ভালো অবস্থাই শরীরের কাল হয়। আয়েসে বাতে ধরে। সুগার হয় প্রেসার হয়। হার্ট কমজোর হয়। চোখ খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়।

বার্ধক্যের আগেই অথর্ব হয়ে পড়ে। তাই হয়েওছে। আমাকে মাঝে-মাঝে দেখতে আসে, ওঘর থেকে এঘরে, দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মতো। আমার শরীরের কথা তিনটে হলে, নিজের শরীরের কথা তিরিশটা হয়। বেশ বুঝতে পারি বাঁচার ইচ্ছা প্রবল। সহজে মানুষ কি মরতে চায়। আমাদের দুজনের মধ্যে তেমন একটা দহরম মহরম প্রেম ছিল না। পাশাপাশি বসবাস করতুম। সম্পর্কটা ছিল দেনাপাওনার। এক তরফা কর্তব্যের বন্ধন। কার যে দোষ, তা আমি বলতে পারব না। সংসারের বিচারে আমিই অপরাধী। এই যে আমি চলে যাব, মহিলার মনে সামান্য হয়তো লাগবে, তবে অন্য সকলে বেশ একটু আরামই পাবে। আমার দুই পুত্রবধূই শিক্ষিতা, সুন্দরী। একালের মেয়ে সেবাটেবায় তেমন অভ্যস্ত নয়। ভদ্রতার খাতিরে সারা দিনে একবার দুবার আসে, যেন হাসপাতালে ভিজিটিং আওয়ার্সের ভিজিটার। সেজেগুজেই আসে। তারা সব সবসময়েই খুব সেজে থাকে, কেন তা বলতে পারব না। আমাকে দেখার জন্যে একজন নার্স রেখেছে। পয়সায় কি আর সেবা পাওয়া যায়। মেয়েদের একটা ব্যাপারে বেশ মজা লাগে, যখন তারা শ্বশুর বাড়িতে তখন তারা বাপের জন্যে হেদিয়ে মরে। আবার যখন তারা বাপের বাড়িতে তখন শ্বশুরমশাইয়ের জন্যে দরদ উথলে ওঠে। আসল ব্যাপারটা আমি ধরে ফেলেছি। তাদের সবটাই ভাসা-ভাসা উড়ু, উড়ু। মনগুলোই সব মরে গেছে। তাদের কাছে কোনও কিছুই আর কিছু নয়।

যে পৃথিবীতে আমি জন্মেছিলুম, সে পৃথিবী আর নেই। এক জীবনেই সব উলটেপালটে গেল। কে কে আমাকে শ্মশানে নিয়ে যাবে তাও জানি না। ছেলে দুটোকে তো কাল থেকেই দেখছি না। কানে একটা কথা এসেছিল। বলাবলি করছিল নিজেদের মধ্যেই, ‘বাবা এখন সহজে যাবে না। ওই পড়ে-পড়ে কত বছর চালায় একবার দেখা। আর একজন বলছে, এইভাবে পড়ে থাকার চেয়ে চলে যাওয়াই ভালো, সুনার দি বেটার।’ আমি যে শুনতে পাচ্ছি এই বোধটাও ওদের ছিল না, বা আমাকে শোনাবার জন্যেই বলছিল। আমি শুনব, লজ্জা পাব। সে লজ্জায় তাড়াতাড়ি মরে যাব। মুশকিল হল—জন্ম আর মৃত্যু দুটোই মানুষের হাতের বাইরে। খুব গর্ব নিয়ে বেঁচে ছিলুম। এখন যথেষ্ট লজ্জা নিয়েই চলে যাই। কানে নানারকম শব্দ আসছে। বাচ্চাদের হইহই। মেয়েদের ঝগড়া। আজ বোধহয় ওরা কোনও বিয়ে বাড়িতে যাবে। দুপুরে সব চিনে দোকান থেকে চুলের কায়দা করিয়ে এসেছে। আমার দুই ছেলেই পছন্দমতো বিয়ে করে এসেছে। আমাকে তারা জানিয়েছিল মত, অমতের কোনও প্রশ্ন ছিল না। তুমি শুধু শুনে রাখো। আমরা আমাদের বউ আনছি। নির্বাচন আমাদের। উৎসবাদির খরচপত্তর সব তোমার। বড় বউটি খুব খড়খড়ে। পুরুষালি গলা। আমার ছেলের ওপর তার খুব কর্তৃত্ব। ছোট বউটার মৃদু স্বভাব। একটু চাপা ধরনের। মাঝেমধ্যে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। রবীন্দ্রসংগীতে বেশ পারদর্শী।

এই মেয়েটাই মাঝে মধ্যে আমার কাছে আসে। একটু সেবা করার ইচ্ছেও দেখায়। সময় পায় না। ছোট ছেলেটা তার ভারী নেওটা। সে যতক্ষণ বাড়ি থাকবে ছোটর টিকির দেখা পাওয়া যাবে না। বাড়ির কাজকর্ম ওদের করতেই হয় না। কাজের লোকের অভাব নেই।

আমার চেতনা ক্রমশই আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। কারও সম্পর্কেই আমার আর বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। এখুনি চলে যেতে হবে বলে, আমার কোনো দু:খও নেই। আমার বাঁচা আমার পঞ্চাশ বয়সেই শেষ করে ফেলেছি। মানুষ বেগে চললে, তিন দিনের পথ একদিনেই অতিক্রম করতে পারে। আমিও তাই করেছি। আমার জীবনে কিছু পাপ ছিল। ভোগীদের যা থাকে। আমার তাই ভয়—মৃত্যুর পর আমার কি গতি হবে—স্বর্গে না নরকে!

আমার অতীত ভেসে আসছে। আমার বাবাকে আমি কী করেছিলুম। আমাদের কাগজের ব্যাবসা। বাবা অথর্ব হয়ে বসে গেলেন। আমরা দুভাই বসে গেলুম দোকানে। আমি ব্যাবসা সামলাই, দাদা সামলায় বাজার। আমি অ্যাকাউন্টস, দাদা সেলস। অ্যাকাউন্টসের কারচুপি শুরু করে দিলুম। পারিবারিক ব্যাবসায় কতদিন ভূতের বেগার খাটা যায়। নিজের ব্যাবসা চাই, যে ব্যবসায় কোনও অংশীদার থাকবে না। টাকা সরাতে লাগলুম। দাদাটা গোবেচারা মতো ছিল। গাধার মতো খাটতে পারত।

হিসেব টিসেব তেমন বুঝত না। কারচুপিটা বাবাই ধরলেন। যখন ধরলেন ব্যাবসা তখন ফোঁপরা। গাড়িটাড়ি সব বিক্রি হয়ে গেল। বাবা আমাকে স্রেফ দূর করে দিলেন। এক্ষেত্রে স্নেহ নিম্নগামী হল না। বিলিতি মেজাজের মানুষ ছিলেন তিনি। আমি তো এইটাই চেয়েছিলুম। আমার নিজের ব্যাবসা তখন শুরু হয়ে গেছে। সব খদ্দের আমার হাতের মুঠোয়। বাবা আর্থারাইটিসে পঙ্গু। আমি দেখলুম এই মওকা। আলাদা হয়ে যাই। জয়েন্ট থাকলেই ওই অথর্বের সেবায় অকারণে খরচ হবে। খেটে মরতে হবে। বড়র ওপর যখন টান, তখন বড়ই দেখুক। ঝপ করে এই ফ্ল্যাটটা কিনে ফেললুম। একদিন সামান্য ছুতোয় তুলকালাম একটা ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলুম। সেই দিনই গৃহত্যাগ।

বাবা আমাকে ক্ষমা করতে পারেননি।

আমি গ্রাহ্যও করিনি, তখন আমার রমরমা চলছে। ব্যাবসা ফুলেফেঁপে উঠেছে। দু-নম্বরি পয়সায় সাঁতার কাটছি। পৃথিবীতে বাপমায়ের আশীর্বাদের এক কানা কড়িও দাম নেই। পয়সাই হল সব। মদ আর মহিলা নিয়ে বড়-বড় পার্টিকে ঘায়েল করি। বড়র ব্যাবসা লাটে উঠে গেল। চিনে বাজারে ছোট্ট একটা দোকানে এসে দাঁড়াল। বাবা বললেন, ওই চোরের আমি আর মুখদর্শন করব না। ভালোই হল। কোনও ঝক্কি ঝামেলা আর সামলাতে হল না। মদ মেয়েমানুষে খরচের ব্যাপারে মানুষ দিলদরিয়া, বাপমায়ের ব্যাপারে যত কৃপণতা। হাত গলে একটা নয়া পয়সাও বেরোতে চায় না। বাবা কি বেদনা নিয়ে গেলেন, তখন আমার বোঝার মতো বোধ ছিল না। শ্মশানে গিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলুম। নিতান্তই এক দর্শকের মতো। দু:খ টু:খ কিছুই হল না। মনে হয়েছিল, কে কার বাবা। কে কার ছেলে। পৃথিবীতে সবাই জীব। জন্মাবে মরবে। এর মধ্যে আর কোনও ব্যাপার নেই। শ্রাদ্ধের ঝামেলাটা দাদার ঘাড়েই চাপল। পিতৃভক্ত ছেলে তুমি। পিতার আর্শীবাদ তো দেখছ। হাঁড়ি চড়ে না তোমার এমন অবস্থা। আমি কিছু চাঁদা দিতে চেয়েছিলুম। বারোয়ারি পুজোয় হাজার-হাজার টাকা চাঁদা দি, পিতার শ্রাদ্ধে না হয় কিছু দিলুম। তা তেনার প্রেস্টিজে লেগে গেল। বললে, টাকা কী হবে, পাপের টাকা।’ শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে যাবার পর দিলুম একটা কেস ঠুকে। বিষয় সম্পত্তি বলতে বসতবাটি আর চিনেবাজারের দোকানের আধখানা। আমার প্রাপ্য। কিছু কি অন্যায় করেছিলুম ভগবান। পৃথিবীতে নিজের ভাইয়ের চেয়ে ঘৃণার আর কী আছে। দাদা আমার সঙ্গে টাকার লড়াইয়ে পারবে কেন। কোর্টের রায়ে সব দু-আধখানা হল। বাড়ি দু-ভাগ, দোকান দু-ভাগ। শেষে রফা হল টাকা দিয়ে পুরোটাই আমি কিনে নোব। দাদা তার অংশটা আমাকে বেচে দিয়ে বুদ্ধিমানের মতো সরে পড়ল। আমার আনন্দ আর ধরে না। ভাইকে পথে বসাতে পেরেছি। দাদা যে-টাকা পেয়েছিল সেই টাকায় কলকাতার মতো শহরে কিছু হয় না। দাদা চলে গেল বর্ধমান, তার এক ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে।

কিন্তু শেষমেষ কে জিতল?

দাদাই জিতল। দাদার ছেলে আর মেয়ে দুজনেই মানুষ হয়েছে। ছেলে বিজ্ঞানী। মেয়ে আধুনিক ইতিহাসে ডক্টরেট। দুজনেই আমেরিকায়। দাদা ও বউদি আমেরিকায় ছেলের কাছে মহা আরামে। আর আমি? আমি পড়ে আছি অবহেলায়। পড়ে-পড়ে খাবি খাচ্ছি। আর কতক্ষণ! মরার আগে মানুষের অতীত চোখের সামনে খেলা করে যায়। যন্ত্রণা দেয়। এখন আমার পাপপুণ্যের বিচার হচ্ছে।

যৌবনে যা পাপ মনে হয়নি, এখন মনে হচ্ছে। পাপ ভয়ংকর রকমের পাপ। আমার এক বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে যে সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল তাতে আমি দুজনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি-আমার স্ত্রীর সঙ্গে, আমার সেই ভালোমানুষ বন্ধুর সঙ্গে। সেই বোকাটা তার স্ত্রীকে ভীষণ বিশ্বাস করত। উন্মাদের মতো ভালোবাসত। আমি সেই সুযোগটা নিয়েছিলুম। কেন নিয়েছিলুম! সেই প্রশ্নটাই আমি এখন আমাকে করছি। উত্তরও খুঁজে পেয়েছি, আমার মনের বিকৃতি। পবিত্রকে অপবিত্র করার আনন্দ। মানুষের ঘর ভেঙে দেবার আনন্দ। ফল কী হল! নিজের সংসারটাই এলোমেলো হয়ে গেল। আমি চোর। আমি লম্পট। আমার তো স্বর্গে স্থান হবে না। আমি লোভী। আত্মপর স্বার্থপর। আর তো সংশোধনের উপায় নেই। আর তো মাত্র কয়েকঘণ্টা আছি। একবার মনে হল আমার পরলোকগতা মা আমার মাথার কাছে এসে বসেছেন। আমার কপালে রেখেছেন তাঁর স্নিগ্ধ কোমল হাত। ওই হাত একদিন আমি ঘৃণায় ঠেলে ফেলে দিয়েছিলুম। সেই স্মৃতি আমার মনে ভেসে উঠছে। জীবনের শেষের দিকটায় মায়ের শুচিবাই হয়েছিল। আমার তখন ভীষণ অসুখ। মা আমাকে দেখতে এলেন। আমার নামে কালীঘাটে পুজো দিয়েছেন। মায়ের পায়ের ফুল আমার মাথায় ঠেকিয়ে আকুল হয়ে বললেন মা ছেলেটাকে ভালো করে দাও। আমি মনে-মনে হাসলুম—বড় বড় ডাক্তার আমাকে দেখছেন, বৃদ্ধার কী কুসংস্কার। একটা জবা ফুল আমাকে ভালো করে দেবে। মা তারপর আমার কপালে হাত রাখলেন। আঙুলের ফাঁকে-ফাঁকে হাজা। আমি হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলেছিলুম—আমাকে বিরক্ত কোরো না। একটু একা থাকতে দাও আমাকে। তুমি ও-ঘরে গিয়ে বসো। মা কেমন যেন হয়ে গেলেন। ভয়ে-ভয়ে উঠে চলে গেলেন পাশের ঘরে। তখন আমার কিছু মনে হয়নি। পরেও মনে হয়নি। আজ মনে হচ্ছে। আজ আমার চোখে জল আসছে। মায়ের কথা মনে পড়ছে। ছোট ছেলে বলে মা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। সেই মাকে আমি দেখিনি। জীবনের নেশায় ভুলে ছিলুম। মা যখন হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়, আমি তখন ব্যাঙ্গালোরে ফুর্তি করছি। একজন শুচিবায়ুগ্রস্ত বৃদ্ধা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, এ আর এমন কি ঘটনা। আমি চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। বুকের ওপর পড়ে আছে আমার অবশ দুটো হাত। জীবনের ঘড়িতে শেষ যে দু-এক পাক দম আছে ধীরে-ধীরে তা খুলে যাচ্ছে। একটু-পরেই পেন্ডুলাম থেমে যাচ্ছে। আমার চোখের সামনে ভাসছে এক রক্তাক্ত দৃশ্য। চৌত্রিশ নম্বর হাইওয়ে ধরে আমার নতুন গাড়ি চালিয়ে আমি চলেছি। একটু মত্ত অবস্থা আমার। আমার পাশে বসে আছে সন্দেহজনক চরিত্রের এক মহিলা। মালদার কাছে দূর থেকে দেখছি মা তার শিশুটির হাত ধরে চলেছে। স্পিডোমিটারে কাঁটা পঁচাত্তর আশির মধ্যে দুলছে। হঠাৎ শিশুটি মায়ের হাত ছেড়ে রাস্তার দিকে সরে এল। আমি ব্রেক কষতে পারতুম। হয় তো গাড়িটা উল্টে যেত। আমি ডানদিকে একটু কাটাতে পারতুম। কী যে করতে পারতুম আমি জানি না। আমার গাড়ি শিশুটিকে থেঁতলে দিয়ে ঝড়ের বেগে সামনে ছুটে গেল।

সেই মহিলা, যে আমার পাশে বসে নেশায় টাল খাচ্ছিল, সে একটা ছোট্ট চিৎকার করল। জড়ানো গলায় বললে, এই তুমি কী করলে! আজ আমি আমার পথের পাশে সেই মাকে দেখতে পাচ্ছি, রক্তাক্তসন্তানের দেহটি বুকে ধরে বসে আছে। সর্বোচ্চ আদালতে বিচারের আশায়।

আচ্ছা! ওটা তো ছিল দুর্ঘটনা। খুন তো নয়। তবু কেন খুন করেছি বলে মনে হচ্ছে! কিছুতেই দৃশ্যটা সরাতে পারছি না চোখের সামনে থেকে। শিশুটি কি চাপা পড়ার সময় দু-হাত তুলে মা বলে ডেকেছিল?

আমার তরুণ বয়সের চেহারাটা ভেসে উঠছে। এক মাথা চুল। অসুন্দর একটা মানুষের সুন্দর একটা মুখ। চেহারাটা তো সাংঘাতিক ভালো ছিল। হিরোর মতো। সুন্দর চেহারা হলেই যে সুন্দর মানুষ হবে এমন কোনও কথা নেই। তার প্রমাণ আমি নিজে।

আর কতক্ষণ। একটা গান শুনতে ইচ্ছে করছে—ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সংগীত ভেসে আসে। কে শোনাবে। কেউ তো নেই। আমি চলে যাবার অনেক পরে কেউ হয় তো এক ফাঁকে আসবে। এসে দেখবে আমি নেই। এবারের খেলা সাঙ্গ করে চলে গেছি।

আমার একটা ফুটফুটে সুন্দর নাতি আছে। দেবশিশুর মতো দেখতে। ছোট ছেলের ছেলে। মা খুব সুন্দরী। শুনেছি একটা দুটো সিনেমায় অভিনয় করছে। ঘাড়ে সিনেমার ভূত এখনও চেপে আছে। হিরো সে হবেই। নাতিই এই বছর চারেক হল পৃথিবীর খাতা খুলেছে। খরগোসের মতো চোখ। সিল্কের মতো মসৃণ গায়ের ত্বক। ভেতরের যন্ত্রপাতি সব ঝকঝকে নতুন। প্রাণশক্তিতে একেবারে নতুন মোটর গাড়ির মতো। হঠাৎ আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়াল। ছেলেটা মাঝে-মাঝেই আসে। আদো আদো গলায় যত আবোলতাবোল বকে। ওই আমার একমাত্র সঙ্গী। প্রশ্নে-প্রশ্নে জেরবার করে দেয়। যখন আমার শক্তি ছিল সব প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করতুম। বাছা-বাছা গল্প শোনাতুম। পৃথিবীর সৎ সুন্দর জীবনের গল্প। সাহসের গল্প বীরত্বের গল্প। বন্ধুত্বের গল্প। ভালোবাসার গল্প। মনে হত যে-পৃথিবীকে আমি ভুলে ছিলুম সেই পৃথিবীর গল্প শোনাতে শোনাতে ক্রমশই আমি পবিত্র হয়ে উঠেছি।। একটু-একটু করে আমার সমস্ত পাপ মুছে যাচ্ছে। শিশুটি বুঝতে পারে না, কেন আমি সব সময় শুয়ে থাকি। কেবলই ঠেলবে, আর বলবে, খালি-খালি শুয়ে আছ, বেড়াতে যায় না, কিছু না। ওঠ না ওঠ।’ কচি-কচি পা দিয়ে আমাকে প্রাণপণে ঠেলতে থাকবে। ঠেলতে-ঠেলতে এক সময় নিজেই শুয়ে পড়বে। তার পা দুটো আমার পায়ের ওপর শিথিল হয়ে পড়ে থাকবে। নিজের গোল-গোল হাত দুটো নিয়ে খেলা করবে। আপন মনে গান গাইবে। তারপর এক সময় হয় তো ঘুমিয়ে পড়বে।

সে এখন আমার মাথার কাছে। কী একটা চুষছে চকচক করে। বাঁ হাতটা একবার আমার কপালে রাখল। ঠান্ডা নরম কচি একটা হাত। পদ্ম ফুলের কুঁড়ির মতো। অনুযোগের গলায় বললে, এ: এখন ঘুমোচ্ছে। এখন কেউ ঘুমোয় না কি বোকা! আমি তার হাতটা ধরার চেষ্টা করলুম। অবশ হাত উঠল না। সে বললে, ‘ললিপপ খাবে?’ আমি বলতে চাইলুম, ‘তুমি খাও।’ অদ্ভুত একটা শব্দ ছাড়া আর কিছু বেরলো না কণ্ঠ দিয়ে।

সে বললে, ‘বাবা ভয় করছে।’

ভয় তো করবেই। সবে এসেছে পৃথিবীতে। মৃত্যু তো দেখেনি। মানুষের, পাপী মানুষের চলে যাওয়াটা যে ভয়ংকর। একটু-একটু করে, তিলে-তিলে প্রাণ বেরোয়। বহুক্ষণ, বহুক্ষণ পথ খোঁজে কোথা দিয়ে বেরোবে। চোখ দিয়ে, মুখ দিয়ে, নাক দিয়ে, কান দিয়ে।

নিজের মুখ থেকে আধ চোষা ললিপপটা বের করে সে আমার ঠোঁটে গুঁজে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। বড় চঞ্চল। জরুরি কোনও কাজের কথা মনে পড়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ থাকলে সে দেখতে পেত। মৃত্যুর আতঙ্কে আমার চোখ বিস্ফারিত হচ্ছে। ঠেলে বেরিয়ে আসছে বাইরে। আমার ঠোঁটে গোঁজা ললিপপ। জীবন বড় তিক্ত ছিল। মরণের মধুর স্বাদ ঠোঁটে নিয়ে চিরবিদায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *