পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

ললিত চ্যালেঞ্জ শিল্ড

ললিত চ্যালেঞ্জ শিল্ড

ঘটনার বিশদ বিবরণ আমরা শুনেছি হোঁৎকার কাছেই। বেশ মজাদার ঘটনা। হোঁৎকা বেশ ক’দিন ছিল না, সে গিয়েছিল বীরভূমের কোনো গ্রামে তার মামার বাড়িতে। অবশ্য দু’-চারদিনেই বাড়ি ফিরে আসবে ঠিক ছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে মামার অনুরোধে আরও বেশ কয়েকদিন থেকে যেতে হয়েছিল।

মামাদের গ্রামটা বেশ বড়ই। কয়েকটা পাড়া নিয়ে গ্রামটা। গ্রামে একজন নাকি বিরাট জমিদার পরিবার ছিলেন। তখন তাঁদের বেশ রমরমা ছিল। এখন জমিদারি গিয়েছে, তবুও তাঁদের দু’-একজন এখনও বেশ দাপটের সঙ্গেই আছেন। শশীপদবাবু তাঁদেরই একজন। বয়স হয়েছে, তবে সেটা কখনও তাঁর কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। শশীপদবাবু, তিনি বড় ফুটবলার হবেন। তাঁর ঘরে মোহনবাগান ক্লাবের নামি ফুটবলারদের ফোটোর পাশে মারাদোনা ও আরও কয়েকজন বিদেশি প্লেয়ারের ফোটোও আছে।

শশীপদবাবু নিজে অবশ্য ফুটবলার হতে পারেননি। কিন্তু এখনও তিনি গ্রামের ছেলেদের নিয়ে রোজ মাঠে ফুটবল খেলেন। নিজে ফুটবলার না হয়েও ছেলেদের ট্রেনিং দেন। শশীপদবাবু তাঁর নিজস্ব খেলার পোশাক, পায়ে ক্যাম্বিস জুতো পরে মাঠে নামেন। এসব ছেলেদের নিয়েই তাঁর দিন কাটে। বেশ কিছু ভালো ছেলে যারা ভালো খেলে, শশীপদবাবু তাদের নানাভাবে সাহায্যও করেন ।

হোঁৎকার মামা এই শশীপদবাবুর ছেলেবেলার বন্ধু। সেই মামাও ফুটবল ভালোবাসেন। তাই তিনি শশীবাবুর সহকারী হয়ে উঠেছেন।

গ্রামের পাশেই বয়ে যাওয়া নদীর চরে বিস্তীর্ণ জায়গা শশীবাবুর এলাকা। এক-একদিকে চরের পাশে অবশ্য চাষাবাদ ভালোই হয়। আখ, অন্য আনাজপত্র প্রচুর হয়। এর থেকে যা আয় হয় শশীবাবু সেটা ফুটবলের জন্যই খরচ করেন। এই আনাজখেতের একদিকে বেশ খানিকটা জায়গায় তিনি দু’টো ফুটবলের মাঠ গড়ে তুলেছেন। গোলপোস্টও তৈরি আছে। চারপাশে চুন দিয়ে মার্কিংও করা হয়েছে। মহকুমা শহর, আশপাশের গ্রাম থেকেও অনেক টিম এখানে আসে খেলতে। অবশ্য এসবের উদ্যোক্তা শশীবাবু নিজেই। সঙ্গে গজাবাবুর মত কয়েকজন বাবুও আছেন। ফলে এই গ্রামে শশীবাবুর স্বপ্নের ফুটবল বেশ আদরেই লালিতপালিত হয়।

শশীবাবু তাঁর প্রিয় ফুটবল টিমকে আশপাশের গ্রামে ম্যাচ খেলতেও পাঠান। তাঁর টিম যেসব ট্রফি জিতে আসে, শশীবাবু সেগুলোকে তাঁর বাড়ির একটা ঘরে বেশ সযত্নে সাজিয়ে রেখেছেন ওইসব দেশি-বিদেশি খেলোয়াড়দের পাশে।

শশীবাবুর পিসিমা বলেন, শশী আমার ফুটবল নিয়েই পাগল।’ শশীবাবু বলেন, ‘এটা বাংলার গৌরব পিসিমা। এর কথা তুমি বুঝবে না।’

শশীবাবুর ক’দিন থেকে মনমেজাজ ভালো নেই। ওদিকে মানিকপুর গ্রামের ভূপতি জমিদার ললিতমোহনবাবুর নামে বিরাট শিল্ডের প্রতিযোগিতা চালু করেছে মানিকপুর বয়েজ ক্লাব । ক’বছর ধরেই চলছে ওদের প্রতিযোগিতা।

মানিকপুরে এই পরিবার এখনও স্বনামে বিরাজ করছে। এরা আবার শশীবাবুর দাদার সম্বন্ধী।

মানিকপুরের ছেলেরাও ফুটবল খুব ভালোবাসে। ভূপতিবাবুর ছেলে কিশোরীবাবুর অনুরোধে শশীবাবুও বারদুয়েক ওঁর টিম নিয়ে গিয়েছিলেন সেই শিল্ডের প্রতিযোগিতায়। কিন্তু দু’বারই বেদম হেরে এসেছেন কিশোরীবাবুদের টিমের কাছে। কিশোরীবাবু বললেন, “শশী, তোমার এত মুরোদ নেই যে মানিকপুর থেকে শিল্ড নিয়ে যাবে।”

ইঙ্গিতটা শশীবাবুও বুঝেছিলেন। বললেন, “দেখা যাক। এক মাঘে তো আর শীত যায় না! এই শশীপদবাবুর দিনও একদিন আসবে।”

কিশোরী বললেন, “সেদিন কবে আসবে তার ঠিক নেই হে। তুমি আজীবন চেষ্টা করে যাও, কিন্তু পারবে না।”

মানিকপুরও বেশ সমৃদ্ধ গ্রাম। গ্রামে কিশোরীবাবুর বিরাট ধানকল রয়েছে। শশীবাবুদের মত সমগোত্রীয়। তবু এই দুই পরিবারের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা লেগেই রয়েছে। আর সেটা ছড়িয়ে পড়েছে এই দুই গ্রামেও।

শশীবাবুর ইজ্জতে ঘা লাগে কিশোরীবাবুর কথায়। শশীবাবু তখন থেকেই ভাবছেন কী করে ওই কিশোরীবাবুর টিমকে পরপর কয়েকটা গোল খাইয়ে তাঁকে মুখের মত জবাব দিতে

পারবেন।

তাই শশীবাবু এবারও ঠিক করলেন, যেভাবেই হোক মানিকপুর বয়েজ ক্লাবকে হারাতেই হবে। তাই তিনি এবার তাঁর বাবার নামে একটা চার ফুট উঁচু শিল্ড চালু করলেন। মানিকপুরের শিল্ডের উচ্চতা তিন ফুট। তাঁর শিল্ড হবে মানিকপুরের শিল্ডের চেয়েও উঁচু। আর তিনি মানিকপুরকে চ্যালেঞ্জ করলেন শিল্ড নিয়ে যেতে। এর ফলে তিনিও তাঁর টিমকে শক্তিশালী করে তুলবেন।

সেই শিল্ড তৈরি করাতে কলকাতায় পাঠিয়েছেন শশীবাবু হোঁৎকার মামাকে। কলেজ স্ট্রিটের অনেক দোকানে এসব খেলার সাজসরঞ্জাম তৈরি হয়। তাই কলকাতায় মামাবাবু এসেছিলেন। ফেরার সময় হোঁৎকা তার মামার সঙ্গে মামাবাড়িতে গিয়েছে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে।

মামাদের আমবন আছে, এবার নাকি আম-লিচু বেশ ভালোই হয়েছে। হোঁৎকা আমের ভক্ত। অবশ্য এমনিতেও সে ভোজনরসিক। সুতরাং আম-লিচুর লোভেই যে সে মামার বাড়ি গিয়েছে, এ কথাটা হোঁৎকাকে যে চেনে সেই বলবে।

বিকেলে মামাবাবু মাঠে গিয়েছেন। শশীবাবুর কোচিং-এর সহকারী তিনি। হোঁৎকা ও রয়েছে। হোঁৎকা ওদের টিমের জবরদস্ত ব্যাক। সে শুধু ভোজনরসিকই নয়, তার স্বাস্থ্যটাও দেখার মত। এমনিতে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ ক্লাবের ছেলেদেরই স্বাস্থ্য দেখার মত। একদিকে হোঁৎকা, অন্যদিকে গোবরা। ওদের শুধু বুদ্ধিই নয় গায়ের জোরও তেমনি। ফুটবলে লাথি মারলে বল নয়, যেন কামানের গোলা ছুটছে মনে হয় ।

সেই হোঁৎকা ওখানে গিয়ে খেলতে নেমেছে। শশীবাবু প্রথমে খেয়াল করেননি। তারপর হোঁৎকার দু’-একটা শট আর খেলার ধরন দেখে শশীবাবু ওর কাছে এলেন, “এটা কে রে! নতুন মনে হচ্ছে?”

একজন বলল, “শশীদা, ও তো রতনবাবুর ভাগনে।”

শশীবাবু খুশি হলেন। বললেন, “তুমি রতনের ভাগনে ?”

রতনবাবুও এবার ওদের কাছে এলেন।

শশীবাবু বললেন, “তোমার ভাগনে যে এত ভালো খেলে তা তো বলোনি?”

মামা বললেন, “ওদের টিম কলকাতার ডিভিশন খেলে।”

“খেলতেই হবে। ওর ব্যাকিং শটের সেন্স দেখেই বুঝেছি ও জাত প্লেয়ার। ভালোই হল, একজন জবরদস্ত ব্যাক খুঁজে পেলাম।”

পশুপতি বলল, “স্যার, দারুণ পজিশন জ্ঞান ওর। পায়ে দারুণ জোর, দু’টো পাই সমান চলে। আর গার্ডটা যা দিচ্ছে!”

“নে নে, খেলাটা আবার শুরু কর দেখি। আর একটু খেলা দেখি ওর।”

শশীবাবুর কথা শেষ হতেই আবার খেলা শুরু হল। হোঁৎকাও খেলতে থাকল তার নিজের স্টাইলে।

শশীবাবুও খুব খুশি হলেন। এবার শশীবাবুর মনে হল, টিমটা যা তৈরি হয়েছে তাতে করে এবার তিনি কিশোরীবাবুকে তাঁর মুখের মত জবাব দিতে পারবেন।

হোঁৎকা সেই সব কথাই ফিরে এসে আমাদের বলেছে। ক্লাবের মাঠ, আমরা সকলেই রয়েছি। পটলাও আজ বেশ খোশমেজাজেই রয়েছে। এর মধ্যে সে আজ গোবিন্দদার দোকান থেকে আইসক্রিম অর্ডার দিয়েছে।

পটলা বলল, “তা হলে মানিকপুরের শিল্ড নিয়ে এসেছিস?”

হোঁৎকা বলল, “না। হইল না। তীরে আইসাও তরী ডুইবা গেল গিয়া।”

আমি বললাম, “কেন? ফাইনালে উঠেও হেরে গেলি ?”

হোঁৎকা বলল, “হারলাম কি? তারপর যা হইল তা সাংঘাতিক কাণ্ড।”

হোঁৎকা তার অভিজ্ঞতার কথা শুরু করল, “আর একখান আইসক্রীম দে। গলা শুইখা আইতাছে।”

আরও একটা আইসক্রিম দেওয়া হল হোঁৎকাকে। হোঁৎকা শুরু করল তার মানিকপুরের কাহিনি, “শশীবাবু তো এবার একটা দুরন্ত টিমই তৈরি করেছেন। শশীবাবু সেদিন রতনবাবুকে বললেন, “কয়েকদিন তোমার ভাগনেকে থেকে যেতে বলো রতন। ওকে আমাদের দরকার । এবার ও থাকলে মনে হচ্ছে কিশোরীবাবুকে মুখের মত জবাব দিতে পারব।” ”

এর মধ্যে কয়েকটা প্র্যাকটিস ম্যাচও হয়ে গিয়েছে। শশীবাবুও তাঁর টিমকে পাঠিয়েছেন এবার মানিকপুরের শিল্ডে। এবার হোঁৎকা আসায় তাঁর টিমের চেহারাটাই বদলে গিয়েছে। এর মধ্যে মানিকপুরে ললিতমোহন শিল্ডের কয়েকটা খেলায় শশীবাবুর টিম বেশ কয়েকটা নামি টিমকে পরাজিত করে একদিক থেকে ফাইনালে উঠেছে। আর অন্য দিকে কিশোরীবাবুর টিমও বেশ কয়েকটা প্রতিপক্ষকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে। তবে এর মধ্যে শশীবাবুর টিমই গ্রামের দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। অনেকেই বলছে, “এবার বেস্ট প্লেয়ার হবে ওই শশীবাবুর ব্যাকই। কী খেলাটাই না খেলে ছেলেটা !”

শশীবাবু বললেন, “খেলবে না! ও তো কলকাতার ডিভিশন খেলে।”

কিশোরীবাবুও দেখেছেন হোঁৎকার খেলা। তিনিও বললেন, “ছেলেটা দারুণ খেলে হে গুপি! দু’টো পাই সমান চলে, আর চার্জিংও তেমনই! ওর জন্যেই না আমরা হেরে যাই !”

গুপিবাবু কিশোরীবাবুর ধানকলের দালাল। সারা এলাকার ধানচাষীদের কাছ থেকে দু’নম্বরি করে কিনে আনে। সেসব চাল পাঠায় শহরেও। গুপি এভাবে দু’দিক দিয়েই ভালোই রোজগার করে। তাই কিশোরীবাবুকে খুশি রাখতে হয় তাকে। গুপিনাথ এমনিতেই করিৎকর্মা। সে জানে, কোনো পথে কীভাবে কাজ আসান করতে হয়। এই খেলায় সেও জানে মানিকপুরকে জিতিয়ে আনতেই হবে।

কিশোরীবাবু বললেন, “শশীবাবুর টিম যদি জিতে শিল্ড নিয়ে চলে যায়, তার মানে বাবাও চলে যাবেন গ্রামের বাইরে।”

গুপিনাথ বলল, “আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। শশী চৌধুরীর টিমকে জিততে আমি দেব না । কিশোরীবাবু বললেন, “দ্যাখ, যদি কিছু করতে পারিস।”

গুপিনাথ বলল, “সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

তবু কিশোরীবাবুর ভয় গেল না। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করলেন যেন তাঁর টিম মুখরক্ষা করতে পারে। মানিকপুরের দূরত্ব শশীবাবুর গ্রাম থেকে খুব বেশি নয়। তবে মন্দারক্ষী নদী, তারপর খানিকটা ধানমাঠ, তারপরেই মন্দারক্ষীর একটা শাখানদী। সেই নদীর নাম কোনা নদী । ওর ওপারেই নদীর ধারে আমবাগানের লাগোয়া খেলার মাঠ। গ্রাম একটু দূরে। ফাইনালে উঠল একদিকে মানিকপুর বয়েজ ক্লাব, আর অন্য দিকে শশীবাবুর টিম রায়চৌধুরী ক্লাব । ফাইনাল খেলার দিন শশীবাবুর দল তৈরি হয়ে এল মানিকপুরের মাঠে। মাঠটা এর মধ্যে রঙিন কাগজের মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে। ওদিকে একটা মঞ্চও করা হয়েছে। সেখানে একটা উঁচু টেবিলের উপর সেই তিন ফুটের শিল্ডটাকে লাল জবাফুলের মালা পরিয়ে সাজানো হয়েছে। পাশে রাখা আছে বিজেতা টিমের জন্য ছোট-বড় নানা সাইজের ট্রফি। ওদিকে মাইকে তখন হিন্দি গানের রেকর্ড চলছে। মাঠের চারপাশে অসংখ্য মানুষের ভিড়। আর কিশোরীবাবুর অনুরোধে অনেক মান্যগণ্য মানুষও এসেছেন খেলার মাঠে।

শশীবাবুর টিমের সঙ্গে হোঁৎকাও এল এখানে। সে দেখল, এই গ্রাম-অঞ্চলেও ফুটবল নিয়ে কী উত্তেজনা! মাঠ ভর্তি লোক উৎসাহে দাঁড়িয়ে। তাদের তুমুল শব্দ। ওদিকে গোলপোস্টে লাগানো হয়েছে মাছ ধরার জাল। বাদ্য-বাজনার শব্দ উঠছে, সেইসঙ্গে সারামাঠে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। দেখা গেল, মাঠের একদিকে বাদ্যি বাজিয়ে প্লেয়াররা সেজেগুজে আসছে। অবাক হল হোঁৎকা, ওই গোঁফওয়ালা বিশাল চেহারাগুলো দেখে। হোঁৎকা বলল, “ওরা এই বয়েজ ক্লাবের বয় তো নয়! বাবার বয়সি হইব।”

অন্যজন হোঁৎকাকে বলল, “ওরা কিশোরীবাবুর কাছে বয়ই। ওরাই এই ক্লাবের প্লেয়ার।” “আমাদের দলে সকলে তরুণ। ওদের তুলনায় আমাদের সকলের বয়স কম। ওদের দলের প্রত্যেকটা খেলোয়াড়ই আমাদের বাবার বয়সি। লাল জার্সি, সাদা প্যান্ট। ওরা মাঠে নামার আগে একটু নেচে নিচ্ছে। কিশোরীবাবুর সমর্থকরা হাততালি দিয়ে ওদের উৎসাহ জোগাচ্ছে। সারা মাঠে জয়ধ্বনি দিচ্ছে, ‘জিতছে কে, মানিকপুর বয়েজ ক্লাব আবার কে,’। এদিকে হোঁৎকাদের জন্য কোনো জয়ধ্বনি নেই। হোঁৎকাও ক’দিন এখানে খেলে গিয়েছে। সে বুঝেছে এদের হারানো সহজ নয়।

এর মধ্যে হোঁৎকা শশীবাবুর টিমের প্রিয় নেতা হয়ে উঠেছে। সকলে ওর কথা মানে। হোঁৎকা যা বলে, তাই ওদের কাছে বেদবাক্য। হোঁৎকা দেখল মাঠের পাশেই নদী আর তাতে জলের গভীরতা প্রায় বুক-সমান। তার স্রোতও বেশ তীব্র। নদীর চরেই রয়েছে একটা ইটভাটা, ইটের পাঁজা। এই ইট গ্রামেরই নানা দরকারে কাজে আসে। সেখানে কিছু ইট নেওয়া হয়েছে আর বাকি ইট স্তূপাকার হয়ে পড়ে আছে।

হোঁৎকার মাথায় একটা মতলব এসে গেল।

হোঁৎকা দেখল, শশীবাবুর দলের সঙ্গে ওই গ্রামের কিছু উৎসাহী দর্শকও রয়েছে। তারাই বলল এসব ব্যাপার দেখে, “কিশোরীবাবু লোকটা ভালো নয় গো। ও আমাদের কিছুতেই জিততে দেবে না। আর জিতলেও শিল্ড নিয়ে যেতে দেবে না।”

অন্যরাও বলল, “তাও করতে পারে। ওই লোকটা সব পারে।”

হোঁৎকা ও তার টিম তখন চলে এসেছে। দলের তখন নেতা সে। এরকম সংকট মুহূর্তে তার বুদ্ধিটা বেশ ভালোই খোলে। হোঁৎকা বলল দলের বেশ কিছু সমর্থককে, ওরা গিয়ে নদীর ওপারে যেন ইটভাঁটার দখল নিয়ে রেডি হয়ে থাকে। গোলমাল হতে পারে।

বাকি টিমের প্লেয়ারদের বলল, “মাঠে নেমে আজ যেভাবে হোক জিততেই হইব।”

হোঁৎকারও বিশ্বাস, মানিকপুরের বয়সি খেলোয়াড়দের চেয়ে তার টিমের তরুণ খেলোয়াড়রা অনেক ভালো খেলবে। হোঁৎকা এও বুঝেছে, ওই টিমের খেলোয়াড়রা খেলার চেয়ে মারপিটটা ভালোই করবে।

ওদিকে ওদের টিমে রয়েছে দু’দিকে দুই গাট্টাগোট্টা চেহারার লোক। তার মধ্যে একজন তো গ্রামের হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, মানুষের চিকিৎসা ছাড়া গোরু-ছাগলের চিকিৎসাও করে। সে আবার কিশোরীবাবুর পেয়ারের লোক।

এদের মধ্যে একজন বেশ পাক খাওয়ানো গোঁফওয়ালাও আছে, তার আবার একটা চোখ ট্যারা। কোনো দিকে কখন সে তাকায় সেটা বোঝাই মুশকিল।

ওদিকে কিশোরীবাবুর ধানকলের দালাল গুপিনাথসহ আরও কয়েকজন ভীমদর্শন লোক রয়েছে।

খেলা শুরু হল। খেলা তো নয় যেন বয়েজ ক্লাব একজোট হয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সমানে হাত-পা চালাচ্ছে শশীবাবুর টিমের ছেলেদের উপর। তবু সফল হচ্ছে না । ওদের ফরোয়ার্ড-স্ট্রাইকারদের একটু লাগলেই বাঁশি বেজে উঠছে, ফাউল।

রেফারি শুধু সুযোগ খুঁজছে কখন পেনাল্টি দেওয়া যায় একটা। শশীবাবুর দলের দু’টো ফরোয়ার্ড প্লেয়ার ওদের কয়েকজন প্লেয়ারকে ডজ করে দূর থেকে শর্ট নিতেই বলটা জালে জড়িয়ে গেল।

চকিতের মধ্যে রেফারির বাঁশি বেজে উঠল। সকলে দেখল, মানিকপুর গোল খেয়ে গিয়েছে। কিন্তু কিশোরীবাবু গর্জন করে উঠলেন, “অফ সাইড। এ গোল, গোল নয়।”

রেফারিরও কিছু করার নেই, গোল হয়ে গিয়েছে।

এবার শশীবাবুর দলও চেঁচিয়ে উঠল। তার মধ্যে বয়েজ ক্লাবের একটা ধুমসো, শশীবাবুর ক্লাবের দু’জনকে স্রেফ ঘুসি মেরেই আধা ঘায়েল করল।

আবার খেলা চলতে-চলতে কিশোরীবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, “বল যায় যাক, ওদের ফিনিস করে দে। হরি, এই ব্যাটা হরি রেফারি হয়েছে! দে, পেনাল্টি দে।”

বল ওদিকে যাচ্ছে না। হোঁৎকাও এগিয়ে এসেছে। এবার হোঁৎকার পায়ে বল। ওদিকে একটা ব্যাক তাকে পিছন দিক থেকে বেশ জোরেই লাথি মারার জন্য পা ছুড়ল।

হোঁৎকাও চকিতের মধ্যে সরে গিয়ে ওদের গোল লক্ষ্য করে শর্ট মারল, আর সেটাও গোলপোস্টের পিছনে সেই মাছ ধরার জালে জড়িয়ে গেল।

হরিহর বাঁশিতে ফুঁ মারতেই কিশোরীবাবু গর্জন করে উঠলেন, “অ্যাঁ, ফুঁ মারছেন? খেলার পর দেখাচ্ছি ব্যাটাকে।”

এর মধ্যে হাফটাইম হয়ে গেল। শশীবাবুও খুব খুশি। কিন্তু ওদের দলের তিনজনকে বেশ জোরেই মেরে ঘায়েল করেছে ওরা।

কিশোরীবাবুর মন-মেজাজ ভালো নেই। রেফারি এসেছে কাছে, “কী করছ কী হরি? পেনাল্টি দাও! কলকাতার ছেলেটাকে লাল কার্ড দেখিয়ে বাইরে বের করে দাও । শিল্ড গাঁয়ের বাইরে চলে গেলে তোমাকেও ছাড়ব না। যাও, সেই বুঝে বাঁশিতে ফুঁ মারো।”

আবার খেলা শুরু হল। এবার বয়েজ ক্লাবের ছেলেরা আরও মারমুখী। ওদের টার্গেট এবার হোঁৎকা। বয়েজ ক্লাবের এক ধুমসো, হোঁৎকাকে মারতে রেফারি মওকা পেয়ে হোঁৎকার বিরুদ্ধেই ফাউল আর পেনাল্টি দিল।

হোঁৎকা বলল, “না। এখন কেউ কিছু করিস না। খেলাটা জিতে শিল্ড নিয়ে তারপর যা করার করতে হবে ।”

হোঁৎকা এবার সতীশকে বলল, “দলের অন্যদের নিয়ে নদীর পাশে সেই ইটভাটায় চলে যা। ওরা ফের যদি মারপিট শুরু করে, এবার আর আমরা ছাড়ুম না।”

হোঁৎকা এবার সত্যিই রেগে গেল। ওদিকে রেফারি তখন পেনাল্টি দিল। কিশোরীবাবু হাঁক পাড়লেন, “অ্যাই, বাদ্যি-বাজনা রেডি রাখ। গোল হলেই জোরে বাজাবি।”

বয়েজ ক্লাবের ক্যাপ্টেন সেই গোঁফওয়ালা বয় শট নিল, আর বাদ্যি-বাজনা বেজে উঠল। কিন্তু কোথায় গোল? বল গোলকিপারের হাতে। এমন সুযোগও চলে গেল ?

কিশোরীবাবু গর্জে উঠলেন, “বাজাও, বাজাও আরও জোরে। কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। গোল হল না, ওঁরা বাজিয়ে যাচ্ছে! অ্যাই, চোপ, চোপ।”

কিশোরীবাবুর তর্জন-গর্জনে এদের টিম আরও শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সতীশ ততক্ষণে নদীপারে সেই ইটভাঁটায় চলে গেল দলের অন্য ছেলেদের নিয়ে। সতীশও দেখল, কিশোরীবাবুর দলের ছেলেরা অন্যরকমভাবে মেরে ঘায়েল করেছে শশীবাবুর দলের ছেলেদের।

কিশোরীবাবুর দল অনেক চেষ্টা করেও কোনো গোল দিতে পারল না। কিশোরীবাবু এবার নিশ্চিত হারবেন জেনে গ্রামবাসীদের নিয়ে হইহই করে তেড়ে এলেন কোনো এক বাহানা করে।

হোঁৎকারাও তৈরি ছিল আগে থেকেই। এমন একটা কিছু হবে অনুমান করেছিল। হোঁৎকা জানত, এখান থেকে জিতে শিল্ডে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে না ।

কিশোরীবাবুর মত গ্রামবাসীরাও এই হারটাকে সহজে মেনে নিতে পারছিল না, তাই বারুদে একটা দেশলাই কাঠি পড়তেই গ্রামবাসীরাও কিশোরীবাবুর সঙ্গে হইহই করে ধেয়ে এল শশীবাবুর দলের লোকজনের উপরে। গ্রামবাসীরাও শিল্ড গ্রামের বাইরে যেতে দিতে নারাজ । তাই বুকভরা জলের মধ্যে দলবল ঝাঁপিয়ে পড়ল, এদিকে এসে শশীবাবুর দলের লোকদের তাড়া করে মারবে।

হোঁৎকা এসব আগেই ভেবেছিল। শশীবাবুর দলের লোকরা পালিয়ে এসেছে, পিছনে কিশোরীবাবুর দলের লোকরা। ওরা রে-রে করে জলে নামল পার হবে বলে। তখন নদীতে শুধু মানুষ। ঠিক তখনই শুরু হল ইট-বৃষ্টি।

লোকগুলো স্রোতের সঙ্গে লড়বে, না মাথা বাঁচাবে? বৃষ্টির মত ইট এসে পড়ছে। অনেকের মাথা ফাটছে। কারও আবার হাত ভাঙছে। কারও কপাল ফাটছে। হোঁৎকা তখন নদীর পার থেকে সেই মাছ ধরার জালে ইট পুরছে।

ওদিকে জলবন্দি লোকগুলোর তখন চোট পেয়ে বেহাল অবস্থা। হোঁৎকা এবার জালটা কিশোরীবাবুকে লক্ষ্য করে ছুড়ল, আর কিশোরীবাবুও নিজের মাথা বাঁচাতে খেয়াল করলেন না জালটাকে। তখন তিনি জালে জড়িয়ে বুক-ভর্তি জল-কাদায় নাকানি-চোবানি খাচ্ছেন।

এদিকে খেলা তো ভণ্ডুল হয়ে গেল। হোঁৎকারা খেলায় জয়ী হয়েও শিল্ড পেল না। তবে হোঁৎকারা যুদ্ধ জয় করেই ফিরে এল।

কিশোরীবাবু তবু খুশি।

গুপি বলল, “যাক, খেলা ভেস্তে গিয়ে ভালোই হয়েছে! শিল্ড তো আর হাতছাড়া হয়নি।” কিশোরীবাবু বললেন, “শশী চৌধুরীকে আমি শিল্ড ছুঁতে দেব না।”

শশীবাবুও সব শুনলেন। এ নিয়ে গ্রামের দর্শকরাও নানা আলোচনা করছে। অনেকেই বলছে, এটা মানিকপুরের অন্যায় কাজ হয়েছে।

শিবপুরের লোকরা আরও বলল, “কান ধরে ললিত চ্যালেঞ্জ শিল্ড এই গ্রামে আনা উচিত। খেলা পুরোটা হলে আমাদের দলের কাছে ওরা হারতই। তাই মারপিট শুরু করে খেলাটা ভণ্ডুল করে দিল।”

বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। হোঁৎকা আবার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। তবু বিকেলে ক্লাবে গেল।

হঠাৎ একদিন হোঁৎকার মামা এসে হাজির।

শশীবাবুর জেদও কম নয়। যেভাবেই হোক শশীবাবু ওই ধানকলের মালিক কিশোরীবাবুর কাছ থেকে শিল্ড জয় করে আনবেনই। তার জন্য যা করার তাই করবেন তিনি। শশীবাবুর কাছে এটা তাঁর ইজ্জতের প্রশ্ন।

রতনমামা ক্লাবে এলেন। তিনি এবার আমাদের টিমের সবাইকে মানিকপুর নিয়ে যেতে চান।

শশীবাবুও চান এবার তাঁর টিম আরও বেশি শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুক মানিকপুরের বিরুদ্ধে। শিল্ড তাঁকে জিততেই হবে। আর তাই শশীবাবু গাড়ি নিয়ে রতনমামাকে পাঠিয়েছেন

কলকাতায় ৷

পটলা একটু সাবধানি ছেলে, তবে দলের হোঁৎকা আর গোবরা একটু গোঁয়ার ধরনের আর ফটিকও ভালো ফরোয়ার্ড খেলে।

আমি বললাম, “ওই মারপিটের জায়গায় যাবি খেলতে? হোঁৎকার মুখে যা শুনছি, তাতে তো ভয়ই হয়। ওরা কি আমাদের খেলতে দেবে? জিতলেই তো মারপিট শুরু করে দেবে।” পটলা বলল, “তা সত্যি। সেবার ইটভাঁটার জন্যে বেঁচে এসেছিস। এবার কী হবে?” রতনমামা বললেন, “এবার আর ওসব করতে পারবে না। সেবার হাঙ্গামার পর শশীবাবু নিজে সদরে ডি এম সাহেব ও পুলিশের কাছে গিয়ে নালিশ করেছেন। পুলিশ কিশোরীবাবুদের ওয়ার্নিং দিয়ে এসেছে। এবার গ্রামে খেলা হলে পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা থাকবে। কাজেই এখন আর কোনো ভয় নেই। তোমরা চলো। শশীবাবুর খুব ইচ্ছে, তোমরা আসবে। আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি হবে না ৷ ”

হোঁৎকারও ইচ্ছে, এবার শিল্ড জিতে ফিরবে, গতবার যেটা পারেনি। এবার সেটা পারতেই হবে।

আমাদের মধ্যে গোবর্ধন ওরফে গোবরা মারপিটে ওস্তাদ। হোঁৎকার মুখে সব ঘটনা শোনার পর গোবরার তখন থেকেই হাত-পা নিশপিশ করছিল। তাই এরকম সুযোগ এসে যেতে খুশিই হল। সে বলল, “চল পটলা, হোঁৎকার মামা যখন এত করে বলছেন, আমরা যাই । তা ছাড়া আমরা গেলে শশীবাবুও খুশি হবেন।

মামা বললেন, “তোমাদের কথা বলেছি আমি। সারা এলাকার লোক পটলার গোলকিপিং দেখার জন্য বসে আছে। যা পাবলিসিটি হয়েছে তোমাদের!”

“তাই নাকি?” পটলার এবার গলা বেরোল। বলল, “তা হলে চল হোঁৎকা। আমরা যাব ।” “হ্যাঁ, যাইব। শিল্ড আমাদের এবার জিততেই হইব।” হোঁৎকাও উৎসাহ দিল পটলাকে। “তা হলে চল, ঘুরেই আসি।”

পটলার কথায় আমাদেরও আপত্তি ছিল না। আমরা সকলেই রাজি হয়ে গেলাম। মামাবাবুও খুশি। কলকাতা থেকে গাড়ি চলল শশীবাবুর গ্রামের দিকে ।

আমরা বিকেল নাগাদ শশীবাবুর গ্রামে এসে পৌঁছলাম। বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। একদিকে শশীবাবুদের পাড়া। এ পাড়াটা এঁদেরই পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে। এঁদের একজন ছিলেন এই অঞ্চলের জমিদার। এখন অবশ্য সেই জমিদারি নেই। তবে সেই বাড়িগুলো রয়ে গিয়েছে।

গ্রামের ধারে একটা বাড়িতে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। বিশাল একটা হলঘর আর তার চারদিকে আম-লিচুর বাগান। কেমন সেকেলে ধরনের জায়গাটা। এদিকটায় বিশেষ কেউ আসে না। এই হলেই রয়েছে পাঁচজনের পাঁচটা তক্তাপোশ। এ ছাড়া আলমারিও আছে। তক্তাপোশে সুন্দর করে বিছানা পাতা রয়েছে। ওদিকে বেশ বড়-বড় জানলা। সেগুলো জানলা তো নয়, যেন এক-একটা দরজা। মেঝেয় সেকালের ইতালিয়ান মার্বেল বসানো। আমাদের জন্য রাঁধুনি রেখে রান্নার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পাশে পুকুর, সেখানে বেশ বড় সাইজের মাছও রয়েছে। সব দেখেশুনে হোঁৎকা বলল, “কী রে পটলা, আম-লিচু তো কাঁড়ি-কাঁড়ি ! কত খাবি খা!”

শশীবাবু নিজে এসে তদারকি করছেন।

সেদিন বিকেলে আমরা মাঠে নেমেছি শশীবাবুর প্লেয়ারদের নিয়ে। একসঙ্গে দু’দিন প্র্যাকটিস করলাম নিজেদের মধ্যে।

এবারও সেই মানিকপুরের খেলায় ওদিক থেকে মানিকপুর হরিহর রেফারির সাহায্যে একটা-একটা করে বাধা টপকে এগিয়ে আসছে। অন্যদিকে ফাইনালে উঠতে চলেছে শশীবাবুর টিম। কিশোরীবাবু আবার এই টিমটাকে হারাবার জন্যে মতলব করছেন। কারণ, সেবার যেভাবে প্রকাশ্যে মারপিট করে খেলাটাকে ভণ্ডুল করে দিয়েছিলেন! কিন্তু শশীবাবুসহ গ্রামের সকলে চান, পরিচ্ছন্ন ফুটবল খেলা দেখতে। তাই খেলা আজ ব্যক্তিগত ভুয়ো মান-সম্মানের তোয়াক্কা না করে মাঠে ফাইনাল খেলার দিন নানা ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর সেই কারণে বাইরে থেকে নিরপেক্ষ রেফারিকেও আনা হয়েছে। খেলার সময়ও থাকবে পর্যাপ্ত পুলিশি পাহারা।

তাই কিশোরীবাবু এবার অন্য মতলব পাকাচ্ছেন, যাতে করে শশীবাবুর টিমকে হারানো যায়।

শশীবাবুর টিম এবার আরও শক্তিশালী হয়ে মাঠে নেমে গ্রামের দর্শকদের কাছে প্রিয় টিম হয়ে উঠেছে। শশীবাবুর টিমের গোলকিপার আমাদের পটলা, দুই ব্যাকে গোবরা আর হোঁৎকা। আর ওদের দলের বাছাই করা প্লেয়ার আর ফরোয়ার্ডে রয়েছে ফটিক।

ফটিকও দুর্দান্ত প্লেয়ার, সে স্ট্রাইকার। সে পায়ে বল পেলে গোলে পাঠাবেই। আর আমি ওকে এই কাজে সাহায্য করি। আমাদের দু’জনের মধ্যে বোঝাপড়াও বেশ ভালো। আমি জানি, ও কখন বল ছাড়বে। তখন আমিও গোলে শট নিই।

তাই সব মিলিয়ে শশীবাবু এবারের ম্যাচে সবচেয়ে ফেভারিট টিম। আর শশীবাবু ও আমাদের উপর যারপরনাই খুশি। এবার মনে হয়, শশীবাবু কিশোরীবাবুকে মুখের মত জবাব দিতে পারবেন।

এর মধ্যে খবর চলে গিয়েছে মানিকপুরেও। কিশোরীবাবুর লোকজনই খবর নিয়ে গিয়েছে যে, শশীবাবু এবার কলকাতা থেকে নামি-দামি পাঁচজনকে এনে খেলাচ্ছেন। তাদের একজনের খেলা দেখেছিলেন কিশোরীবাবু, আর তাতেই তাঁর দলের নাভিশ্বাস উঠেছিল। এবারে আবার একেবারে পাঁচজন প্লেয়ার! কিশোরীবাবু তাই এবার বেশ চিন্তায় পড়লেন তাঁর টিম নিয়ে। কিশোরীবাবু বলেন, “গুপিনাথ, একটা কিছু করো।”

গুপিও ভাবছে কথাটা। সেবার শিল্ডটা কোনোরকমে বাঁচানো গিয়েছিল। এবার কী হবে? কারণ, রেফারি আসছে বাইরে থেকে। তার উপর পুলিশ প্রোটেকশনও থাকছে।

কিশোরীবাবু বললেন, “তুমি সদরে যাও। টাউন ক্লাব থেকে বেশ কিছু ভালো প্লেয়ার আনো। এবার ভালো খেলতেই হবে। শিল্ড গ্রামের বাইরে যাওয়া চলবে না।”

আমাদের কাছেও খবর এল, মানিকপুর বয়েজও নাকি শহর থেকে বেছে-বেছে প্লেয়ার এনেছে।

হোঁৎকা বলল, “আনুক প্লেয়ার। আমাদের ভালো খেলতেই হইব।” গোবরা বলল, “তুই ভাবিস না। আমরাই জিতব।”

কিন্তু ভাবনার কারণ অন্যখানে। ঔরা আমাদের থাকা-খাওয়ার কোনো ত্রুটিই রাখল না। মাছ, দুধ, বাড়ির তৈরি ক্ষীর, বাগানের আম-লিচু, সবই জুটেছে। রান্নার ঠাকুরও আমাদের রাতের খাবার দিয়ে বাড়ি চলে গেল।

তারপরে নামল স্তব্ধতা। আমবাগানে নামল জমাট অন্ধকার। মাঝেমধ্যে শিয়ালের ডাকও ভেসে এল। পুরো বাড়িটায় গা ছমছম করছে। মনে হল, এই বিশাল বাড়ির চারপাশে কোনো ছায়ামূর্তির দল এসে হাজির হল।

গোবরার আবার ভূতের ভয়টা একটু বেশি। হোঁৎকা অবশ্য বেশ সাহসী। তবে সে বলল, “মানুষের সঙ্গে লড়তে পারুম। কিন্তু ভূত-প্রেতের সঙ্গে লডুম কেমন কইর‍্যা।”

পটলা বলল, “যদি ভূত আসে, তা হলে তো আমাদের ঘাড় মটকে দেবে ?”

আমি বললাম, “কী যে শুরু করলি তোরা! ভূতটুত বলে কিছু নেই। ওরা কেন আমাদের ঘাড় মটকাবে?”

গোবরা বলল, “তুই জানিস না। ওরা সব পারে।”

রাত নামল। চারপাশে নিশুতি রাতের স্তব্ধতা, তার উপর আবার অমাবস্যার রাত। হঠাৎ ঘরের আলোটা নিভে গেল। আমরা চমকে উঠলাম।

আমি বললাম, “এখানেও লোডশেডিং?”

হঠাৎ ঘরের ওদিকে কারা যেন ছায়ামূর্তির মত ঢুকল বলে মনে হল। কে যেন নাকিসুরে বলল, “শিল্ড নিয়ে যাবি? হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ…!”

ওদের বিকট হাসির শব্দে আমরা চমকে উঠলাম। সারা গা যেন কেঁপে-কেঁপে উঠছে গোবরা ভীত চোখে এদিক-ওদিক চাইছে।

হঠাৎ দেখা গেল, সাদা শাড়ি পরা সারা শরীর ঢাকা এক মূর্তি। হাসির শব্দ উঠে অন্ধকারে হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল। গোবরা আর্তনাদ করে উঠল, “ভূ-ভূ-ভূত!”

হোঁৎকার মত সাহসী ছেলেও কেমন যেন মিইয়ে গেল। সে উঠে পড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কে যেন বলল, “ওটাকে ধর। ওরই ঘাড় মটকাব।”

অন্ধকারে কে যেন এগিয়ে এল হোঁৎকা, গোবরার দিকে। হঠাৎ পটলা হাতের কাছে টর্চ পেয়ে সেটা জ্বালতেই দেখল, সেই ছায়ামূর্তি দু’টো নাকি সুরে বলছে, “কালই কেটে পড়। এখান থেকে না গেলে কাল রাতেই তোদের দু’টোকে শেষ করব।”

কার ধাক্কায় পটলার হাত থেকে টর্চটা পড়ে গেল দূরে। অন্ধকারে খুঁজে পেল না। সেই ছায়ামূর্তির দল তখন শাসাচ্ছে, “কাল সকাল হলেই চলে যা।”

গোবরা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে বলল, “তাই যাব। চলে যাব এখান থেকে ভূতমশাই।” ভূতরা হাসছে। আমি অন্ধকারে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কোথায় একটা সজোরে ধাক্কা খেলাম।

ভূতজোড়ার মধ্যে একটা শীর্ণ দেহধারী রয়েছে, সে আবার বেশ লম্বাও। ওরা কাছে আসতেই এবার আমিই সাহস করে একটা ভূতকে চেপে ধরলাম। কিন্তু ভূতটার গায়ে মনে হল, তেল চপচপে করে মাখা। ফলে তাকে ধরতে পারলাম না। সে পাঁকাল মাছের মত পালাল। আমার সন্দেহটাই সত্যি হল। এরা কেউ ভূতটুত নয়। হয়তো গ্রামেরই লোক।

এর মধ্যে পটলাও হারানো টর্চটা হাতের কাছে পেয়ে গেল। টর্চের আলো ফেলতেই দেখলাম, আরও একটা লোক শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে ছিল। তার শাড়িটা পড়ে আছে।

টর্চের আলোয় দেখলাম, লোডশেডিং নয়। বাইরে থেকে মেনটা অফ করা ছিল। সেটা অন করতেই ঘরের আলো জ্বলে উঠল। দেখা গেল, তাদের পরিত্যক্ত জিনিসগুলো পড়ে রয়েছে। আমি বললাম, “ওরা ভূত নয়। ভূতের নকল করে আমাদের ভয় দেখাতে এসেছিল।”

গোবরা এবার ব্যাপারটা বুঝে বলল, “তার মানে, এরা ওই কিশোরীবাবুর লোক। আমাদের ভয় দেখিয়ে এখান থেকে তাড়াতে চাইছে।

এর মধ্যে আমাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে সদাজাগ্রত শশীবাবু রতনমামাকে নিয়ে হাজির হলেন। ঘরের অবস্থা দেখে আর ওদের জিনিসপত্র ছড়ানো-ছিটানো দেখে তিনি বললেন, “কাল থানায় একবার খবর দাও। এসব ওই কিশোরীবাবুর দলেরই কাজ। ভয় দেখিয়ে ছেলেগুলোকে চেয়েছিল।”

আমরা বললাম, “ভয় আমরা পাইনি। আর আমরা যাচ্ছিও না। ওদের সব জারিজুরি শেষ করে শিল্ড এনে তবেই যাব এখান থেকে। এবার ওই বদমাশটাকে জবাব আমরাই দেব।” শশীবাবু খুশি হয়ে বললেন, “ভেরি গুড ইয়াংম্যান। লড়ে যাও। আমি আজই এখানে দু’জন দরোয়ান মোতায়েন করছি।”

গুপিনাথ কিশোরীবাবুর কথামতো ভজু আর গজুকে এই কাজে পাঠিয়েছিল। ভজু-গজু মানিকপুরের নামি ছিঁচকে চোর। ওরা নাকি চোখে ধুলো দিয়ে ঘর থেকে নিমেষে সব জিনিস সাফ করে দেওয়ায় ওস্তাদ। গুপিনাথ কিশোরীবাবুকে বলল, “আপনি ভাববেন না বাবু। এবার ভূতের ভয়ে পালাবেই কলকাতার ছেলেরা। মাঠে আর নামবে না ।”

কিশোরীবাবু বললেন, “তোমার বুদ্ধি আছে দেখছি।”

ঠিক এমন সময় ভজু আর গজু ঢুকল। ভজুর নাকটাই গিয়েছে ফেটে পটলার টর্চের ঘায়ে, আর গজু ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছে। গায়ে তেল মাখা ছিল বলে ধরা পড়েনি ।

সব শুনে কিশোরীবাবু বললেন, “হতভাগাগুলোকে এবার আমিই পুলিশে দেব।”

ভজু তার নাক টিপে ধরে বলল, “ওরা ধরে ফেলল যে। না হলে বেশ জমিয়েই ভূতের মজাটা শুরু করেছিলাম। ওদের দু’জন তো বলেই ফেলল যে, ‘আমরা চলে যাবই।’ তারপরই…!”

কিশোরীবাবু বললেন, “বেশ হয়েছে। তোমাদের দিয়ে যদি কোনো কাজ হয়।”

কিশোরীবাবু এবার সত্যি বিপদে পড়েছেন। শিল্ড এতদিন নিজের গ্রামে রেখে দিলেও এবার বুঝি আর শেষ রক্ষা করতে পারবেন না। কালই সব ফাইনাল হয়ে যাবে।

পরের দিন সেই মহারণ। কিশোরীবাবু তবু শেষ চেষ্টা করবেন। শহর থেকে এর মধ্যে বয়েজ ক্লাবের জন্যে জনাচারেক প্লেয়ার তুলে এনেছেন।

মাঠটাকে কিশোরীবাবুরা খুব ভালোভাবেই রঙিন কাগজে সাজিয়েছেন। কিশোরীবাবুর শিল্ডটাকেও মালা পরিয়ে সাজানো হয়েছে, সঙ্গে টেবিলে রাখা অন্য ট্রফিগুলোও।

কিশোরীবাবু শিল্ডটার দিকে চেয়ে বললেন, “গুপিনাথ, এতদিন ধরে বাবাকে এখানে রেখেছিলাম। এবার কি বাবা গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে হে? যা কড়া নজর রেখেছে পুলিশ, তাতে তো কিছু করার উপায় নেই। তোমার বুদ্ধিটাও কাজে লাগল না। ভজু-গজু সে রাতে ধরা পড়লে যে কী হত, কে জানে? এত করেও কি এবার শশী চৌধুরী আমার মুখে ঝামা ঘষে শিল্ড নিয়ে যাবে?”

গুপিনাথ বলল, “খেলার শেষ এখনও অনেক বাকি। দেখাই যাক না কী হয় ?”

এবার বর্ষা বেশ ভালোই হয়েছে। ফলে মন্দারক্ষী নদীর জল কানায় কানায় পূর্ণ। শশীবাবু বললেন, “শিল্ড জয় করতেই হবে। দু’টো নদী পার হয়ে এখান থেকে হেরে ফিরব না। মানিকপুরে আমাদের কাছারির বাড়িটা আছে। তাতে বেশ বড়-বড় ঘর। রাতে খেলার পর টিম ওখানেই থাকবে। আমিও থাকব। কাল সেসব বন্দোবস্ত করে রাখো। যেন ওখানে কোনো অসুবিধে না হয়।”

সেই মত বিছানাপত্র আনা হল। রান্নার ব্যবস্থাও হল। শশীবাবুর টিম দুপুরেই এখানে এসে পৌঁছেছে। এখানে বিশ্রাম নিয়ে টিম মাঠে নামবে ফাইনাল খেলতে।

এর মধ্যে মাঠে এসেছে বহু মানুষ। হাজির সদর থেকে স্বয়ং ডি এস পি সাহেবের নেতৃত্বে পুলিশবাহিনী। মাঠের চারদিকে পুলিশ।

ওদিকে শশীবাবুও দলবল নিয়ে মাঠের বাইরে রয়েছেন। শশীবাবু আমাদের বললেন, “জেলাসদর থেকে ডি এস পি সাহেব এসেছেন খেলা শান্তিপূর্ণ চালানোর জন্য। এবার আর কোনো ভয় নেই। রেফারিও আনা হয়েছে বাইরে থেকে। এবার আর কিশোরীবাবুর টিম ট্যা-ফুঁ করতে পারবে না। এবার তোমরা নিশ্চিন্তে খেলতে পারবে।”

রেফারির বাঁশি বেজে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে মাঠে দাঁড়ানো দর্শকদের চিৎকার ভেসে এল। শশীবাবুর সমর্থকরা চিৎকার করে তাদের মনোবল বাড়াচ্ছে।

খেলা শুরু হল। বয়েজ ক্লাবও সদর থেকে বেশ কয়েকজনকে ভালো খেলার জন্য ভুলে এনেছে। খেলার প্রথম থেকেই আমরাই ধরার চেষ্টা করছি।

ওদিকে গোবরা, হোঁৎকাও আজ প্রাণ দিয়ে খেলছে। কাল রাতে ভূতের ভয় দেখানোর জন্য কিশোরীবাবুকে তাঁর মুখের মত জবাব দিতে চায় তাদের খেলা দিয়ে।

একটা বল এসে পড়ল আমার পায়ে। হোঁকাই বলটা পাস করেছে। সামনে একজন ব্যাক এগিয়ে এল বলটা কেড়ে নিতে। আমিও সুযোগ বুঝে বলটা পাস করলাম সোজা ফটিকের পায়ে। ফটিক দু’জনকে ডজ দিয়ে বলটা কিক করল, আর বলটা সোজা গোলে।

রেফারির বাঁশিও বেজে উঠল, ‘গো-ও-ল’।

মাঠের চারধারে দর্শকরা চৌধুরী ক্লাবের জয়ধ্বনি করে উঠল।

মাঠের ওদিকে কিশোরীবাবু চুপচাপ রয়েছেন। আজ যেন তাঁর হাত-পা বাঁধা। পাশে সেই হরিহর বলল, “এ কেমন গোল? এটা পুরো অফসাইড।”

কিশোরীবাবু অসহায়ভাবে বললেন, “ওরা এবার ধরেবেঁধে হারাবেই। আজ আর তুমি রেফারি নও। আজ আমরা হারবই।”

দেখতে-দেখতে চৌধুরী ক্লাব মানিকপুর বয়েজ ক্লাবকে দু’-দু’টো গোল দিয়ে দিল।

সাত বছর হল, কিশোরীবাবু এই শিল্ড চালু করেছেন। যা এত বছর হয়নি, এবার তাই হবে। এবার কিশোরীবাবুর এনিমি নাম্বার ওয়ান শশীবাবুই এই শিল্ড নিয়ে যাবেন।

কিশোরীবাবু বসে পড়ে আর্তনাদ করছেন। ওদিকে চৌধুরী ক্লাব আরও একটা গোল দিল। শেষ বাঁশি বাজার আগে চৌধুরী ক্লাব ফাইনালে মানিকপুর বয়েজ ক্লাবকে মোট চার গোলে বেদম হারিয়ে শিল্ড জিতল।

স্বয়ং ডি এস পি ও’র হাত থেকে প্রত্যেক প্লেয়ার মেডেল নেওয়ার পর সেই কাঙ্ক্ষিত শিল্ড উঠে এল চৌধুরী ক্লাবের হাতে।

ওদিকে জয়ধ্বনি উঠল, “জয়, চৌধুরী ক্লাবের জয় ! জিতল কে চৌধুরী ক্লাব, আবার কে?” জনতা আনন্দে নাচছে, ঢাকঢোল বাজছে। শশীবাবুও আজ এই নাচে যোগ দিয়েছেন। ওদিকে গুপিনাথ ও হরিহর কিশোরীবাবুকে কোনোরকমে ধরে নিয়ে গেল বাড়িতে। আজ কিশোরীবাবু হেরে গিয়েছেন। জিতেছে তাঁর এনিমি নাম্বার ওয়ান শশী চৌধুরী। সাত বছর ধরে বাবার স্মৃতি আগলে রেখেও আজ তা হাতছাড়া হয়ে গেল !

লজ্জায়-অপমানে-গভীর মনোকষ্টে কিশোরীবাবু খুব ভেঙে পড়লেন।

এদিকে খুশির জোয়ার শশীবাবুর কাছারিবাড়িতে। শিল্ড নিয়ে সারা গ্রাম প্রদক্ষিণ করল শশীবাবুর দলবলেরা। গ্রামের মানুষও দেখল তাদের জয়ের উৎসব।

শশীবাবু আজ ভীষণ খুশি। তাঁর স্বপ্নপূরণ হয়েছে। এতদিন পর কিশোরীবাবুকে মুখের মত জবাব দিতে পেরেছেন। রাতে তাই বিরাট ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। আজ রাতটা কাটিয়ে শশীবাবু নিজের গ্রামে ফিরে আরও বড় করে জোরদার শিল্ড শোভাযাত্রা বের করবেন বলে নানা পরিকল্পনা করছেন।

আজ শশীবাবুদের খাওয়াদাওয়া করে ঘুমোতে অনেক রাত হয়ে গেল। সকলে ক্লান্ত, ঘুমও আসছে। প্রত্যেকের শোওয়ার জন্য ভালো ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তাই বিছানায় গা এলাতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল সবাই।

রাত নামল। আজ সকলে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। শশীবাবুও ক্লান্ত। সারাদিন মাঠে বেশ লাফা-ঝাঁপা করেছেন। তাই বিছানায় গিয়ে শুতেই গভীর ঘুমে চলে গেলেন।

শশীবাবু স্বপ্ন দেখলেন, গ্রামে এতদিন পর তাঁর শিল্ড জয়যাত্রা চলেছে।

কারও ডাকে ঘুম ভাঙল শশীবাবুর। কাজের লোক চা এনেছে সকালেই। শশীবাবুর আবার বেডটি’র অভ্যেস। ঘুমচোখে উঠেই শশীবাবুর চোখ গেল টেবিলে রাখা শিল্ডের দিকে। কিন্তু দেখলেন, সেখানে শিল্ড নেই। টেবিল ফাঁকা। নীচে পড়ে আছে জবা ফুলের মালা আর কুচো ফুল। শিল্ডটা নেই।

মুহূর্তের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। শিল্ডটা কাল রাতেই উধাও হয়ে গিয়েছে। বাড়ির দরজাটা এমনিতেই নড়বড়ে ছিল। কাল রাতে বোধ হয় চোর ঢুকে দামি শিল্ডটা চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। চারদিকে খোঁজা হল। গ্রামের লোকজন, পুলিশও এসেছে। শশীবাবু মাথায় হাত দিয়ে হাহাকার করছেন। “আমার ইজ্জত জড়ানো শিল্ড চুরি হয়ে গেল। আমার স্বপ্ন চুরি হয়ে গেল । হায়, হায়…!”

অনেক খোঁজ করেও শিল্ড পাওয়া গেল না। বেলা বাড়ছে। আমাদের ফিরতেও হবে। শিল্ড জিতেও মানিকপুর থেকে শিল্ড নিয়ে যাওয়া আর হল না। আমরাও আক্ষেপ করলাম। শশীবাবু বললেন, “এটা ব্যাড লাক ছাড়া আর কী!”

কিশোরীবাবুও বাড়ি ফিরলেন। তবু শান্তি পেলেন না তিনি। শশীবাবু শিল্ড জিতে মানিকপুর থেকে নিয়ে যেতে পারেননি বটে, কিন্তু তাঁর বাবার স্মৃতি কে চুরি করল? আর শিল্ডটাই বা গেল কোথায়? তাই নিয়ে চিন্তা করে যাচ্ছেন। এদিকে শিল্ড হারানোর দুঃখে কাল থেকে কিশোরীবাবু খাওয়াদাওয়া ছেড়েছেন। শেষে বাবাকে যে এভাবে কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে, এটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি ।

হঠাৎ সেই ছিঁচকে চোর দু’টো ভজু আর গজুকে দেখা গেল। পাশে গুপিনাথ। ওরা চাদরটা সরাতেই বেরিয়ে পড়ল সেই ঝকঝকে তিন ফুটের শিল্ডটা।

কিশোরীবাবু যেন হারানো বাবাকে ফিরে পেলেন, “এ কী রে! শিল্ড এখানে এল কী করে ?”

গুপিনাথ বলল, “বলেছিলাম না, শিল্ডকে ভিটেমাটি ছাড়া হতে দেব না।”

এবার ভজু আর গজু বলল, “বাবু, ওরা এগারোজন প্লেয়ার ম্যাচ জিতে শিল্ড জিতেছে, কিন্তু মহাফাইনালে ওরা এই দু’জন প্লেয়ারের কাছে হেরে ভূত হয়েছে। আসল খেলাতেই ওরা হেরে গিয়েছে।”

কিশোরীবাবু বললেন, “দেখিস, কেউ যেন টের না পায়। আর কাল থেকে ভজু, গজুর ধানকলে চাকরি পাকা । ওরাই আমার কাছে বেস্ট প্লেয়ার। তাই পুরস্কারটা ওদের প্রাপ্যই।”

আমরা গ্রামে ফিরছি। ভেবেছিলাম, শিল্ড নিয়ে এসে কত আনন্দ করব কিন্তু আমরা শিল্ড জিতেও সেই ললিত চ্যালেঞ্জ শিল্ড হেরে গেলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *