লর্ড বায়রন : মানুষের মাথার খুলিতে করে মদ পান করতেন
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম লগ্নে একজন আদর্শ প্রেমিক কেমন ছিল, কী ধরনের পুরুষ আমাদের দাদি নানিদের বুকে দুপদাপ সৃষ্টি করত আর উনুনের পাশে বসা দাদা-নানিদের ঈর্ষান্বিত আশক্ষায় বুকের ভিতর মোচড় মারত কোনো নারীরা? কারা ছিল সেদিনের ডন জুয়ান, ভ্যালেন্তিনো, ক্লার্ক গেলব? উত্তরটা সহজ। তখনকার দুনিয়াতে এমন কোনো খ্যাতনামা ব্যক্তি ছিল না যে কি না মহিলাদের ব্যাপারে ভাবপ্রবণ জর্জ গর্ডন, লর্ড বায়রন-এর পাশে দাঁড়াতে পারত।
আপনারা জানেন লর্ড বায়রন ছিলেন তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর কাব্যগ্রন্থের প্রভাবে সমসাময়িক সাহিত্য অঙ্গনের সকল প্রবণতা বদলে গিয়েছিল! তার সাহিত্য রচনা ছিল আবেগময় ও স্বতন্ত্র। বায়রনের জীবনটাও ছিল বৈচিত্র্যময়। ডজন ডজন সুন্দরী মহিলার সাথেও প্রেম করেছেন। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে বায়রন তার নিজের সৎবোনের সাথেও প্রেমে লিপ্ত হয়েছেন। যে প্রেমের। অপবাদ সমস্ত ইউরোপকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। আর এতে তছনছ হয়েছিল জীবনটা। বোনের প্রেম থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর তার উদ্দেশ্যে একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা রচনা করেছেন। তার ক’টা লাইন হচ্ছে
যদি
আবার পাই গো তোমার দরশন
অনেক বছর পরে,
কেমন
করে করবো তোমায় সম্ভাষণ
নীরবতায় নিবিড় অশ্রু নীড়ে।
বায়রনের নামে কুৎসা রটানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রেমিকার সংখ্যাও বেড়ে গেল দারুণভাবে, অগণিত মহিলারা বিমুগ্ধ হয়ে গভীরভাবে তাকে ভালোবাসতে থাকে। অবশেষে মহিলাদের প্রেমের অত্যাচার আর তার বর্বরতা সহ্য করতে না পেরে বায়রনের স্ত্রী তাকে তালাক দিয়ে চলে যান। তখন ইউরোপের মহিলারা প্রকাশ্যে বায়রনের নিন্দা করতে লাগল। এই মহিলারাই তাকে প্রেমপত্র, চুলের গোছা ও নানা উপঢৌকন দিয়ে অভিভূত করেছিল।
একবার এমন হয়েছিল : এক অভিজাত পরিবারের সুন্দরী মহিলা বায়রনকে প্রেম নিবেদন করার জন্য এবং তার নাগাল পাওয়ার জন্য বালকের ছদ্মবেশ ধরেছিল। তার প্রেমে পাগল হয়ে আরেক মহিলার মাথা এমন খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তিনি ইংল্যান্ড থেকে ইতালি পর্যন্ত পুরো রাস্তা তার পিছু নিয়ে এমনভাবে চেপে ধরলেন যে বায়রনকে হার মানতে বাধ্য হতে হল।
এই মহা কুলাদর্শ প্রেমিক কেমন ছিলেন? স্বভাবতই এই প্রশ্ন পাঠকের মনে জাগবে। তিনি কি সুদর্শন ছিলেন? মোটেই না। তিনি বিশ্রীভাবে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন, একটা পা ছিল বিকৃত। তিনি আঙুলের মুখে নখ চিবোতেন, তামাক চিবোতেন। এ রকমের কতকগুলো বদস্বভাব ছিল তার। একজন গুণ্ডা প্রকৃতির লোকের মতো ব্রিটেনের রাজপথে গুলিভরা পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তার মেজাজ ছিল তিরিক্ষি। কোনো লোক যদি তার চোখের দিকে তাকাত তা হলে বায়রনের রক্তচাপ অসম্ভব রকম বেড়ে যেত, কারণ তার ধারণা যে লোকটি তার বিকৃত পায়ের দিকে তাকিয়েই উপহাস করছে।
বিখ্যাত কবি লর্ড বায়রনকে রোমিও বলে অভিনন্দিত করা হত। তিনি মহিলাদের ওপর অত্যাচার করতে ভালোবাসতেন। তার বিয়ের দু-ঘণ্টা পরেই নববধূকে তার মনের জঘন্য ইচ্ছেটা জানিয়ে দিলেন যে, তিনি তাকে ঘৃণা করেন এবং ঘৃণার বশেই তাকে বিয়ে করেছেন। আরো বলেছেন, নববধূ যখন তার সঙ্গে প্রথম দেখা করবেন তখন তাকে অনুশোচনা ও দুঃখ পেতে হবে এবং তিনি করেছিলেনও তাই। তাই তাদের দাম্পত্যজীবনের অঙ্গীকারপত্র মাত্র একটি বছর টিকে ছিল। অবশ্য স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন নি কিন্তু ঘরের আসবাবপত্র ভেঙে তছনছ করতেন এবং প্রেমিকাঁদের বাসায় নিয়ে আসতেন। অবশেষে তার স্ত্রী ভাবলেন যে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তিনি বাড়িতে ডাক্তার ডাকতে বাধ্য হলেন। তার বাড়ির পাশ্ববর্তীর ভাষ্য ছিল যে–তার সমস্ত ভৃত্য ছিল যুবতী মেয়ে–সুন্দরী এবং মিষ্টস্বভাবের। ওই সমস্ত যুবতী চাকরানিরা বায়রন ও তার বন্ধুবান্ধবদেরকে মানুষের মাথার খুলিতে মদ্য পরিবেশন করে আনন্দ দিত। খুলিগুলোকে ঘষে মেজে ঝকঝকে তকতকে করে পান পত্রের উপযোগী করা হত।
বায়রনের চেহারা ছিল একহারা গড়নের। তার চামড়া এত সাদা ছিল যে তার প্রতি আসক্ত রমণীরা প্রশংসা করে বলত যে, তিনি একটা সুন্দর কারুকাজ করা প্রদীপ্ত অ্যালবাস্টারের পাত্র। কিন্তু রমণীরা জানত না যে, তার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শরীরের মেদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও অবিরাম ক্লান্তিকর যুদ্ধ। তিনি একহারা সুদর্শন থাকার জন্য সর্বদা অদ্ভুত খাবার খেতেন।
তার খাবার ছিল অত্যন্ত অল্প পরিমাণের–দিনে একবার মাত্র ভিনেগার ছিটানো আলু বা ভাত। মাঝেমধ্যে রুচি পরিবর্তনের জন্য শুকনো বিস্কুট চিবোতেন এবং একগ্লাস সোডা পান করতেন। শরীরের মেদ কমানোর জন্য তিনি তরবারি যুদ্ধ, মুষ্টিযুদ্ধ, ঘোড়ায় চড়া এবং সাঁতারকাটা অভ্যাস করতেন। তার অদ্ভুত রকমের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তার ক্ষিধে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছিল যার ফলে তার ঘরবাড়ি পেটেন্ট ওষুধের গন্ধে ভুরভুর করত। এতে করে একজন বিশ্ববিখ্যাত প্রেমিকের মননামুগ্ধকর প্রেমনিকুঞ্জটাকে একটা ওষুধ বিক্রেতার দোকান বলে প্রতীয়মান হত।
তিনি ঘুমের ঘোরে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখতেন, তাই বিছানার পাশে দুটো গুলিভরা পিস্তল রাখতেন। আর রাতের নিস্তব্ধতায় চিৎকার করতে করতে ও দাঁত কিড়মিড় করতে করতে জেগে উঠতেন এবং পিস্তল হাতে ঘরময় পায়চারি করে বেড়াতেন। যে পুরানো বাড়িটাতে বায়রন রাত্রিকালে দুঃস্বপ্ন দেখতেন তাতে বহুদিন আগে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এক সন্ন্যাসীর প্রেতাত্মা আগমন করত, যিনি একসময় ওখানে বাস করতেন। লর্ড বায়রন শপথ করে বলেছিলেন যে, ওই প্রেতাত্মাটা কালো আলখাল্লা পরে এসে ঘরের জানালা দিয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত আর তারপর গম্ভীর ও ধীর পদেক্ষেপে হেঁটে হেঁটে চলে যেত।
একবার লর্ড বায়রন ইতালিতে এসে শপথ করে বলেছিলেন যে, তিনি বিখ্যাত কবি শেলির প্রেতাত্মাকে একটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছেন। সে সময়ে শেলি ছিলেন সেখান থেকে অনেক মাইল দূরে; বায়রন তা জানতেন। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এর অল্পকালের মধ্যেই কবি শেলি মারা গেলেন এক পাহাড়িয়াহ্রদের মধ্যে ঝড়ের কবলে ডুবে। ব্যথিত বায়রন অবশ্য নিজের হাতে চিতা প্রস্তুত করে শেলির মরদেহটাকে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। একসময় একটা অন্ধ কুসংস্কার পেয়ে বসেছিল বায়রনকে। এক যাযাবর গণকার তার রাশি নির্ণয় করে ভবিষ্যদ্বাণী করে তাকে সাবধান করে দিল যে, তিনি সাঁইত্রিশ বছর বয়সে মারা যাবেন। তার ছত্রিশতম জন্মদিনের তিনমাস পরেই বায়রন সত্যি সত্যিই মারা যান। তিনি বিশ্বাস করতেন, এক নিদারুণ অভিশাপ তার সমস্ত পরিবারের উপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। তাই তিনি বলেছিলেন ছত্রিশতম জন্মদিনটা হল তার বংশের লোকদের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। কোনো কোনো চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক তার এই কথার সাথে একমত হতেও প্রস্তুত; কারণ বায়রনের বাবা ছত্রিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন আর বায়রনের মেয়ে, যার জীবনটা ছিল ঠিক তার বাবার মতোই–তিনিও তার ছত্রিশতম জন্মদিনের ঠিক আগেই মারা যান।