লম্পট

লম্পট

হেরম্ববাবু একজন লম্পট।

বয়স পঁয়তাল্লিশ। এ কার্যে নূতন ব্রতী নহেন; দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতায় বেশ পরিপক্ক হইয়াছেন, সামান্য একটু নলচে আড়াল দিয়া কাজ করিয়া যান। আত্মীয়-বন্ধু এই লইয়া অন্তরালে একটু হাসি-তামাসা টীকা-টিপ্পনী করেন। কিন্তু হেরম্ববাবু কৃতবিদ্য ব্যবসাদার, পয়সাওয়ালা লোক; তাঁহার চরিত্র লইয়া প্রকাশ্যে ঘাঁটাঘাঁটি করিয়া তাঁহাকে অপদস্থ করিবার কথা কাহারও মনেই আসে না।

হেরম্ববাবুর লাম্পট্যে রোমান্সের গন্ধমাত্র নাই। পাকা ব্যবসাদারের মতো এ বিষয়ে তিনি লাভ-লোকসানের খতিয়ানের দিকে নজর রাখিয়া চলেন। কত খরচ করিয়া কতখানি আনন্দ ক্রয় করিলে লাভে থাকা যায়, সেদিকে তাঁহার মন সর্বদা সতর্ক থাকে। হেরম্ববাবুর মনস্তত্ত্ব আর খোলাখুলিভাবে ব্যাখ্যা করিতে গেলে অত্যন্ত বস্তুতান্ত্রিক হইয়া পড়ে, তাই যথাসাধ্য ঢাকাটুকি দিয়া বলিতে হইতেছে। মোট কথা, তিনি একজন পাতি লম্পট।

শহরের নিম্নপ্রান্তে সম্পূর্ণ অপরিচিত পাড়ায় হেরম্ববাবু একটি ঘর ভাড়া করিয়া রাখিয়াছিলেন। এই ঘরটি ছিল তাঁহার আনন্দভবন; সপ্তাহের মধ্যে অন্তত একটি রাত্রি তিনি এইখানে যাপন করিতেন। রাত্রি-যাপনের নির্জীব আসবাবপত্র সবই ঘরে মজুত থাকিত; সজীব উপকরণটি আসিত বাহির হইতে। আর কেহ এ ঘরের সন্ধান জানিত না; ইয়ারবন্ধু লইয়া আমোদ করা হেরম্ববাবুর স্বভাব নয়। এ বিষয়ে তিনি অদ্বৈতবাদী।

একদিন সন্ধ্যার পর অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়া হেরম্ববাবু নিজ আনন্দভবনে উপস্থিত হইলেন। দ্বারের চাবি খুলিয়া ঘরে প্রবেশপূর্বক আলো জ্বালিলেন; চাদরের ভিতর হইতে একটি পাঁট বোতল বাহির করিয়া টেবিলের উপর রাখিলেন; তারপর দেয়াল-আলমারি হইতে গেলাস, সোডা ও কর্ক্‌-স্কু লইয়া টেবিলের সম্মুখে চেয়ারে আসিয়া বসিলেন।

আজ তাঁহার শরীর ঈষৎ ক্লান্ত, কিন্তু মনের মধ্যে অনেকখানি চঞ্চলতা রহিয়াছে। চঞ্চলতার কারণ, যে অভিসারিকাটির আজ দশটা হইতে সাড়ে দশটার মধ্যে আসিবার কথা, সে সাধারণী নয়। হেরম্ববাবু খেলোয়াড় লোক; অনেক খেলাইয়া মাছটিকে ডাঙায় তুলিয়াছেন। ইহা হইতে অনুমান হয়, মাছটিও গভীর জলের মাছ।

একপাত্র সোডা-মিশ্রিত সোমরস পান করিবার পর হেরম্ববাবুর ক্লান্তি কাটিয়া গেল, শরীর বেশ চনমনে হইল। তিনি উঠিয়া পাঞ্জাবি ও চাদর খুলিয়া দেওয়ালে টাঙাইয়া রাখিলেন, তারপর আবার আসিয়া বসিলেন।

সিগারেট ধরাইয়া তিনি আর এক পাত্র ঢালিলেন; চুমুকে চুমুকে তাহাই আস্বাদ করিতে করিতে হাত-ঘড়ি দেখিলেন, পৌনে নয়টা। এখনও অনেক সময়; আগ্রহের প্রাবল্যে আজ হেরম্ববাবু বড় তাড়াতাড়ি আসিয়া পড়িয়াছেন। কিন্তু ক্ষতি নাই, এরূপ অবস্থায় প্রতীক্ষা করার মধ্যেও বেশ রস আছে।

দ্বিতীয় পাত্রটি শেষ হইবার পর তাঁহার ইচ্ছা হইল, গলা ছাড়িয়া গান করেন কিংবা তবলা বাজান। কিন্তু গলা ছাড়িলে লোকের মনোযোগ আকৃষ্ট হইবার সম্ভাবনা, তাহা বাঞ্ছনীয় নয়। তিনি টেবিলের উপর টপাটপ তবলা বাজাইতে লাগিলেন।

এইভাবে কিছুক্ষণ চলিল। তারপর হেরম্ববাবু আর এক পাত্র ঢালিয়া সিগারেট ধরাইলেন। ঘড়িতে দেখিলেন সওয়া-নয়। সময় বড় আস্তে কাটিতেছে; ঘড়ি কানে দিয়া দেখিলেন, চলিতেছে কি না। ঘড়ি টিকটিক করিয়া জানাইল, সে সচল আছে।

ক্রমে বোতলের রং হেরম্ববাবুর চক্ষুতে সঞ্চারিত হইতে লাগিল। তাঁহার মনে হইল, ঘরটি যেন ফিকা গোলাপী ধোঁয়ায় আবছা হইয়া গিয়াছে। চেয়ারে হেলান দিয়া তিনি ভাবিতে লাগিলেন অনাগতা অভিসারিকার কথা…মানস-বিলাসে মনের বল্‌গা ছাড়িয়া দিলেন।…

বোতলের লালিমা কমিয়া কমিয়া তলায় আসিয়া ঠেকিয়াছে। হেরম্ববাবু মানস-বিলাসে ফিক্‌ফিক্‌ করিয়া হাসিতেছেন ও সৃক্কণী লেহন করিতেছেন।

একটি রমণী নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করিল। দেখিল, হেরম্ববাবু টেবিলে মাথা রাখিয়া ঘুমাইতেছেন। বোতলটা উল্টাইয়া পড়িয়াছে।

কাছে আসিয়া রমণী তাঁহার কাঁধে হাত দিয়া ঈষৎ নাড়া দিল। হেরম্ববাবু বিজবিজ করিয়া কিছু বলিলেন, কিন্তু জাগিলেন না; স্বপ্ন-বিলাসে বাধাপ্রাপ্ত হইয়া বোধ হয় আপত্তি জানাইলেন।

রমণীর দুই অধর-কোণ হাসির অনুকৃতিতে একটু অবনত হইল। সে হেরম্ববাবুকে ধরিয়া তুলিয়া দাঁড় করাইল। হেরম্ববাবু বিজবিজ করিয়া আপত্তি করিলেন। কিন্তু রমণী তাঁহাকে দৃঢ়ভাবে ধরিয়া শয্যার কাছে লইয়া গেল এবং সন্তর্পণে শোয়াইয়া দিল। হেরম্ববাবুর বিজবিজ কথাগুলি একটি স্থির হাসিতে রূপান্তরিত হইয়া অধরে লাগিয়া রহিল।

শয্যার পাশে দাঁড়াইয়া একান্ত প্রণয়হীন চক্ষে রমণী কিছুক্ষণ তাঁহার পানে তাকাইয়া রহিল। শেষে খোঁপা হইতে একটি গোলাপ ফুল লইয়া বিছানার উপর ফেলিয়া দিল; তারপর আলো নিবাইয়া সাবধানে দরজা ভেজাইয়া দিয়া প্রস্থান করিল।

পরদিন প্রাতঃকালে হেরম্ববাবুর নিদ্রাভঙ্গ হইল।

শয্যায় উঠিয়া বসিয়া তিনি গত রাত্রির কথা স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলেন। মাথার ভিতরটা বারুদ-ঠাসা বোমার মতো হইয়া আছে, কিন্তু স্মৃতি একেবারে লুপ্ত হয় নাই। রাত্রে সে আসিয়াছিল। তারপর—?

ম্লান বিমর্দিত গোলাপটি তাঁহার চোখে পড়িল।

হেরম্ববাবু মনের মধ্যে পরম তৃপ্তি অনুভব করিলেন। বাস্তবের স্মৃতি ও মনোবিলাসের স্মৃতি মিলিয়া তাঁহাকে দৃঢ় প্রত্যয় দিল যে, কাল রাত্রিটা ভালই কাটিয়াছে।

ব্যবসাদার হেরম্ববাবু যে ঠকিয়া গিয়াছেন তাহা বুঝিতে পারিলেন না। তিনি উঠিয়া পড়িলেন। উল্টানো বোতলটার তলায় তখনও কিছু তরলদ্রব্য ছিল, তাহাই পান করিয়া তিনি খোঁয়াড়ি ভাঙিলেন।

৭ আষাঢ় ১৩৫১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *