৮
কাল রাতে শেষ রাতে উঠে পড়ায় একটু দেরীতে ঘুম ভেঙেছিল। উঠে শুনলাম, দিনের আলো ফোটার অনেকক্ষণ পর অবধি হরিণীটা ছিল ক্যাম্পের মধ্যে। তারপর বুনো কুকুরের দল যেদিকে চলে গেছিল তার বিপরীত দিকে নালা টপকে জঙ্গলের গভীরে পালিয়েছিল।
আজ দোল পূর্ণিমা। বসন্তের বাতাস ফিফিস্ করছিল প্রথম ভোরে। এখন বনমর্মর উঠেছে হাওয়ায়। শুকনো পাতা গড়াচ্ছে পাথরে পাথরে। পাতায় পাতায়—ডালে ডালে কানাকানি শুরু হয়েছে। বাঁশের ফিকে-হলুদ, শুকনো, লম্বাটে পাতাগুলো কোন দূর থেকে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে দুলতে দুলতে এসে একটা ধাতব শব্দ করে পাথরের উপর পড়ছে।
আজ শরীরটা ভালো নেই। ঋতু বদলের ঠাণ্ডা লেগেছে। জ্বর জ্বর লাগছে। তাই ক্যাম্পের বাইরে একটু দূরে একটা বড় আমগাছ তলায় সতরঞ্জি পেতে বসে বহুবার পড়া আমার প্রিয় বই পড়ছিলাম নতুন করে। সরলা দেবীর “জল বনের কাব্য”। একটি কিশোরী, নববিবাহিতা; ভীতু মেয়ের চোখে সুন্দরবনকে দেখার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করা আছে এতে। শিবশঙ্কর মিত্র মহাশয়ের ‘সুন্দরবনে আর্জান সর্দার’ ছাড়া সুন্দরবনের উপরে এত ভালো ও সত্য বই বেশি পড়িনি।
চন্দনী মাঝে মধ্যে এসেছে গেছে। টুকটাক কথা হয়েছে। এখন ও নালাতে গেছে চান করতে। কি সব দিয়ে ফুল ফলের রস দিয়ে যেন মাথা ঘষে চান করে ও।
আমাদের এখানে তেমন হোলিখেলা হয়নি। রত্নাকরের কাছে একটু গোলাপী আবীর ছিল। তাই-ই একটু চেয়ে নিয়ে চন্দনী আমার পায়ে দিয়ে প্রণাম করেছিল। আমি ওর কপালে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা খেলিনি সত্যি। কিন্তু সমস্ত প্রকৃতি পলাশে, শিমূলে, মইফুলে, অর্গুনে, বনের বুকের কোরকের সুগন্ধে বড় মনোরম হোলিখেলা খেলছে ক-দিন হল। যে এ খেলা দেখেছে, যে দেখার চোখ নিয়ে জন্মেছে; তার অন্য কোনো খেলাতেই বুঝি আর প্রয়োজন নেই।
চুল ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে চন্দনী চান করে আসছিল নালা বেয়ে। ওকে দূর থেকে নালার পাথরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বালির গেরুয়াতে পা ফেলে-ফেলে হেঁটে আসতে দেখছিলাম। টুই পাখি ডাকছে টুই-টুই, টিটুই করে চলকে চলকে। বাতাসে বসন্তের গন্ধ, আরাম আবেশ, আকাশে নরম রোদ, আমার সামনে নরম লতানো লাজুক চন্দনী হেঁটে আসছে।
আমাকে দেখেনি ও। চান করে উঠে শাড়ি আলগা করে পেঁচিয়ে নিয়েছে শুধু; ঝুপড়িতে এসে জামা-টামা পরবে। অনবধানে তার বাঁ-দিকের বুক থেকে শাড়ি সরে গেছে—কি নিটোল, মসৃণ, সান্ত্বনার স্তন! এই চিরন্তন নারী চন্দনী এবং এই পরিবেশ—সব মিলেমিশে আমাকে এক নিবিড় আশ্লেষে ভরে তুলল। বড় খুশি হলাম আমি। বড় কৃতজ্ঞ হলাম। বারবার হই। বড় শান্তি, বড় নির্মল, নিঝুম, স্নিগ্ধ শান্তি চারিদিকে।
এমন সময় আমাকে চমকে দিয়ে একটা লোক দৌড়ে এল চন্দনীর পিছন দিকে থেকে নালা বেয়ে। চন্দনী ঘুরে দাঁড়াতে-না দাঁড়াতেই লোকটা চন্দনীকে জাপ্টে ধরল।
কি ব্যাপার কিছুই বুঝতে না পেরে আমি লোকটার কাছে যাওয়ার জন্যে যেই উঠেছি, অমনি একটা লোক আমার পেছন থেকে বলে উঠল, একটুও নড়াচড়া নয়; নড়লেই গুলি করব।
পিছন ফিরে দেখি ছবি নায়েকের সেই সাগরেদ। বন্দুকের নলটা প্রায় আমার পিঠে ঠেকিয়ে বলল, বসে পড়, যেমন বসেছিলে।
আমি যতক্ষণ বই পড়ছিলাম, বই থেকে মাঝে মাঝে চোখ তুলে প্রকৃতির রূপে, গন্ধে, শব্দে, বিভোর হয়ে ছিলাম, ততক্ষণে এই লোকটা নিশ্চয়ই চুপি চুপি আমার পিছনে এসে পৌঁছেছিল। শুধু এইই নয়। আরো একজন লোক দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে চন্দনীকে ধরল। চন্দনী যখন চেঁচাচ্ছিল, হাত-পা ছুঁড়ছিল, গালাগালি করছিল—বলছিল, ভগবান তোমাদের শাস্তি দেবে—ততক্ষণে অন্য একটা লোক দড়ি দিয়ে আমগাছের ডালের সঙ্গে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধছিল।
বন্দুকধারী লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, মেয়েটা বড় চেঁচাচ্ছে, ওর মুখে এক মুঠো বালি পুরে দে।
একটা লোক নালা থেকে এক মুঠো বালি তুলে নিয়ে জোর করে চন্দনীর মুখ হাঁ করিয়ে বালি পুরে দিল।
আমাকে বাঁধা শেষ হলে, আমার মুখেও ওরা জোর করে একমুঠো বালি ভরে দিল।
বন্দুকধারী লোকটা বলল, তোমার সঙ্গে আমাদের ঝগড়া নেই। তবে আমাদের পিছু নিও না। চন্দ্ৰকান্তকে মানা কোরো পিছু নিতে। পিছু নিলে তোমাদের লাশ ফিরবে এখানে, নিজের পায়ে হেঁটে ফিরতে হবে না আর। মনে থাকে যেন।
তারপর ওরা চন্দনীকে নিয়ে পথে গিয়ে উঠল। আমি যেখানে বাঁধা ছিলাম, সেখান থেকে ঝুপড়ি বা ক্যাম্প দেখা যাচ্ছিল না। ঝোপ-ঝাড়ের আড়াল ছিল। ভাবছিলাম রত্নাকর কেথায় গেল, নারাণটাই বা কি করছে?
ওরা পথে উঠে আড়ালে চলে যাওয়ার পরই একটা জিপের এঞ্জিনের স্টার্ট করার আওয়াজ পেলাম।
অবাক হলাম জিপটা আসার আওয়াজ শুনিনি বলে। বোধহয় উৎরাইতে এঞ্জিন বন্ধ করে গড়িয়ে নামিয়েছিল ওরা জিপটাকে। তাছাড়া আজ জঙ্গলে বাতাস জোর থাকায় ঝরণার মতো একটা শব্দ উঠেছিল সকাল থেকেই। সে কারণেই হয়তো শুনতে পাইনি।
কতক্ষণ সময় যে কেটে গেল জানি না। মুখের মধ্যে দুশো গ্রাম বালি নিয়ে আমার সমস্ত ভিতরটা শুকিয়ে উঠছিল। বারবার চন্দনীর কথা মনে হচ্ছিল। ওকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় ওর হাত-পা ছোঁড়া দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন গভীর জলে অথবা চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে।
আস্তে আস্তে রোদ প্রখর হল, তারপর অনেকক্ষণ পর রোদ পড়তে থাকল, গাছ- গাছালির ছায়া দীর্ঘতর হয়ে এল।
বড় পিপাসা পেয়েছে।
বোধহয় ঘোরের মধ্যে ছিলাম এমন সময় মানুষের গলা শুনলাম। কুলীরা ক্যুপ্ থেকে ফিরছে।
তাড়াতাড়িই এসেছে ওরা। ক্যাম্পে নারাণের দয়ায় একটু চা-টা খেয়ে সকলে মিলে সর্পগন্ধা গ্রামে নীলমণি চম্পতিরায়ের রাজনন্দিনী যাত্রা দেখতে যাবে।
একটু পরই ক্যাম্পের কাছে একটা সোরগোল শুনলাম। উত্তেজিত হয়ে ওরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছিল। তার বেশ কিছুক্ষণ পর ওদের চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে দেখলাম। দুজন লোক আমার দিকে দৌড়ে এল। ওরা দৌড়তে দৌড়তে বলল, বাবু এদিকে রে, এদিকে।
ওরা সকলে মিলে হাত লাগিয়ে আমার বাঁধন খুলল, তারপর মুখে আঙুল ঢুকিয়ে বালি বের করে দিল। পেতলের ঘটিতে করে ক্যাম্প থেকে জল আনল মুখ- ধোওয়ার আর খাওয়ার জন্যে।
ক্যাম্পে কাছে ফিরে গিয়ে দেখি নারাণ গাছে ঠেস দিয়ে বসে আছে। ওর হাড় পাঁজর বের করা তামাটে শরীরের উপর দড়ির দাগ কেটে বসে গেছে। কম্ফুর রুগী বলদটা দাঁড়িয়ে আছে পাশে গাছতলায়; একটু একটু করে হাঁটছে ও। ঐ বলদটার দড়ি খুলেই নারাণকে বেঁধেছিল ওরা।
কথা বলার মতো অবস্থায় ফিরলে আমি বললাম, রত্নাকরকে পেলে? ওরা বলল, রত্নাকর তো আজ ভোরে উঠেই সাইকেল নিয়ে চলে গেছে সদরে। আপনি জানতেন না বুঝি?
আমরা জল খেয়ে যখন একটু সুস্থ হয়ে উঠলাম, তখন কালিন্দী বলল, ছবি নায়েকের সঙ্গে কেউ পারবে না। ওর সঙ্গে লড়তে যেও না বাবু। ও সাপের মতো। বাঘকে দেখা যায়, বোঝা যায়, কিন্তু সাপের দেখা! এই জঙ্গলে থেকে ওর সঙ্গে টেক্কা দেওয়া সম্ভব নয়।
আমি শুধোলাম, চন্দনী?
কালিন্দী বলল, চন্দনীর কাজ ফুরোলেই চন্দনীকে ছেড়ে দেবে। চন্দ্রকান্তবাবুকে জব্দ করার জন্যেই চন্দনীকে ওরা এমন অপমান করে ক্যাম্প থেকে নিয়ে গেল। না হলে এই জঙ্গলের মধ্যে ওরা তো সহজেই ওকে নিয়ে যেতে পারত। ওরা আসলে তোমাদের সাবধান করে দিল ভয় দেখিয়ে।
আমি বললাম, কম্ফু কোথায়? কম্ফু অন্তত আমার সঙ্গে যাবে। কেউ না গেলে, আমি একাই যাবো।
নারাণ বলল, চলুন, বাবু, আমি যাই। এত অপমান! নারাণ রাগে ফুলছিল।
যুধিষ্ঠির বলল, বোকামি করিস না। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়া মরে। বাবু বা চন্দ্রকান্ত কি চিরদিন তোকে বাঁচাবেন? জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ ভালো না। বাবুর বাঁধন খুলে দিয়েছি, যা পারে করুন বাবু।
দেখলাম যুধিষ্ঠিরের কথায় সকলেই সায় দিল। একজন দুজন ছাড়া
আমি বললাম, যুধিষ্ঠির ঠিকই বলেছে। এ ব্যাপারে তোরা জড়িয়ে পড়িস না। যা করার আমিই করছি।
ওরা মুখে মুখে ছবি নায়েকের তিন পুরুষ উদ্ধার করে দিল। যদি মুখের কথায় বংশবৃদ্ধি হত তাহলে ঐ আধঘণ্টার মধ্যে ছবি নায়েকের পরিবারে হাজার হাজার ছেলেমেয়ের জন্ম হয়ে যেত—মায় ওর ভাই বোন পর্যন্ত।
কিন্তু চন্দনীকে নিয়ে যাওয়ার ও আমাদের বেঁধে রাখার ঘটনাটা ওদের যাত্রা দেখতে যাওয়ার আনন্দকে কিছুমাত্র ম্লান করল না। বিচলিতও হল না মনে হল। যাত্রা, ওরা ন-মাসে-ছ-মাসে দেখার সুযোগ পায়।
নারাণ চা বানালে ওরা চা খেয়ে যাত্রা দেখতে যাবে বলল।
নারাণ বলল, আমি যাবো না। আমার গায়ে ব্যথা।
জিপের কাছে গিয়ে দেখি সব ক-টা টায়ারের হাওয়া খুলে দিয়ে গেছে ছবির লোকেরা, এমন কি স্টেনিরও।
ওরা চলে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করে আমি পিস্তলটা কোমরে বেঁধে চন্দ্রকান্তর কাছে গেলাম। আমার তক্ষুনি দৌড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। সেই গাল-পোড়া বেনেটার কাছে, কিন্তু ওর আস্তানাতে কখনও যাইনি আমি। চিনতে পারব না হয়তো।
চন্দ্রকান্তর ডেরার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছেছি যখন, তখন দেখি চন্দ্রকান্ত নালার দিকেই আসছেন। পাছে ভুল ভাবেন, তাই আমি ওর নাম ধরে ডাকলাম। উনি চমকে উঠেই রাইফেলের কুঁদোয় হাত ছোঁওয়ালেন। তারপরই হাত নামিয়ে নিলেন। কাছে যেতেই দেখি, ওর পিছনে কম্ফু! হাতে চন্দ্রকান্তর দোনলা বন্দুক।
আমার কাছে সব শুনলেন চন্দ্ৰকান্ত চলতে চলতে। শুনতে শুনতে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, উনি বললেন, আজকে এমনিই বোঝা-পড়া করতাম আমি ছবির সঙ্গে। এমনই কিছু একটা করবে ও তা জানতাম। তবে ওর এত অসুবিধা হবে ভাবিনি।
আমি বললাম, আমিও যাবে।
উনি দৃঢ় গলায় বললেন, না!
—না কেন? আমি বললাম।
চন্দ্ৰকান্ত বললেন, আপনি চন্দনীর জন্যে যা করেছেন তার জন্যে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। চন্দনী এখনও আমার বিবাহিতা স্ত্রী। এই অপমানের শোধ আমাকেই নিতে দিন। আপনি কেন এই মারামারির খুনোখুনির মধ্যে জড়াবেন নিজেকে? সামনের মস্ত সম্ভাবনাময় জীবন পড়ে আছে আপনার।
“সম্ভাবনাময়” কথাটা আমার কানে দ্ব্যর্থক শোনাল।
চন্দ্রকান্ত বললেন, এই লড়াইটা আমাকে লড়তে দিন।
ক্যাম্পের কাছে আসতেই নারাণ চন্দ্রকান্তকে বলল, বাবু আমিও যাবো। নারাণ ওর তাল-ঢ্যাঙা রোগা-পটকা চেহারায় একটা লম্বা হাতওয়ালা টাঙ্গী নিয়েছে কাঁধে।
চন্দ্রকান্ত হাসলেন। নারাণকে হাত তুলে নিষেধ করলেন। তারপর কম্ফুর দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কি যেন ইশারা করলেন দুজনে।
চন্দ্ৰকান্ত বললেন, ক-টা বাজল আপনার ঘড়িতে?
আমি বললাম, ছ-টা
চন্দ্রকান্ত বললেন, চললাম। তারপর বললেন, খবর পাবেন।
চন্দ্রকান্ত আর কম্ফু পথের বাঁকে হারিয়ে গেলেন।
নারাণ বলল, একটু আদা দিয়ে ভাল করে চা করি, কি বলেন?
আমি হাসলাম, গলা জিভ সব বালিতে ছুলে গেছিল।
মাথা নেড়ে বলাম, কর।
ঘড়িতে যখন প্রায় সাড়ে আটটা, তখন বারিরির দিকে থেকে একটি মেয়ে-গলায় আর্ত চিৎকার কানে এল হঠাৎ।
নারাণ দৌড়ে এলো আমার কাছে।
আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। পরক্ষণেই আমি দৌড়লাম। দেখি নারাণও তার টাঙ্গী হাতে করে আমার পিছনে আসছে।
ক্যাম্পে কেউই রইল না। কিছুটা উঠে পিছন ফিরে দেখলাম যে, ক্যাম্পের আগুনটা মিট্মিট করে জ্বলছে। পাকদণ্ডীতে রাতের বেলায় পথ দেখে দেখে আগে আগে চলল নারাণ, কাঁধে টাঙ্গী ফেলে। একটু আগেই বোধহয় আফিং-এর একটা বড় গুলি পুরেছিল ও মুখে।
বারিরি থেকে ডিড-ইউ-ডু-ইট্ পাখিগুলো ডাকছিল। আর কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ বন প্রান্তর পাহাড়ের চূড়া ঢাল সব কেমন নিথর নিস্তব্ধ হয়ে উঠেছিল।
বারিরিতে পৌঁছে ঘন সেগুন বনের অন্ধকারে ঢুকে পড়লাম আমরা। আজকে বনের কোথাওই অন্ধকার নেই। যেখানে সোজাসুজি চাঁদের আলো পৌঁছয়নি সেখানে একটা রুপোলি আভা জমেছে। মাটিতে নিথর চাঁদের আলোর উপরে কম্পমান ছায়া বাঘবন্দী খেলছে। হওয়ায় সেগুন পাতা নড়ছে বলে আলো-ছায়া, ছায়া-আলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
সেগুনবনে ঢুকেই দেখলাম সেগুনের ওপাশ থেকে দুজন লোক একটি মেয়েকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে বারিরিতে পৌঁছল। মেয়েটি জোরে চেঁচাল একবার। আমি আর নারাণ চমকে উঠলাম। চন্দনী!
ওরা বেশ দূরে আছে, কিন্তু গাল-পোড়া ছবি বেনেকে তার গজকচ্ছপ চেহারায় চেনা যাচ্ছে। সঙ্গের লোকটি তার সাগরেদ—যে সকালে আমার পিঠে বন্দুকের নল ঠেকিয়েছিল।
হোলস্টার থেকে পিস্তলটা খুলে নিলাম। আমি আর নারাণ ওদিকে দৌড়তে যাব ঠিক এমন সময়, আমাদের ডানপাশে খচ্মচ্ করে শুকনো পাতা মাড়াবার আওয়াজ হল! চমকে তাকিয়ে দেখি চন্দ্ৰকান্ত।
ফিস্ফিস্ করে বললেন, ওদের ক্যাম্প একটা ঢাল পেরিয়েই—যেদিক থেকে ওরা এল, সেদিকে। আপনারা, আমি না ডাকলে বেরোবেন না। ওখানে চুপ করে বসুন।
বলেই, আবার বাঁয়ের জঙ্গলে মিলিয়ে গেলেন।
চন্দনীকে ওরা দুজনে যেন কি করছিল। চন্দনীকে আমলকী গাছের তলায় শুইয়ে ফেলেছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর লম্বা লোকটা একটু দূরে চলে গেল ছবি নায়েক আর চন্দনীকে ছেড়ে দিয়ে। বাঁ দিকের সেগুনের কাছে গিয়ে লোকটা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালো। ঠিক সময় রাইফেলের আওয়াজ হল গুম্ম্-ম্-ম্ করে। দূরে দূরে সে আওয়াজ ছড়িয়ে গেল, সেই নির্জন মালভূমি থেকে।
—লোকটা সিগারেটটা ধরাতে পারলো না—গুলিটা ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। মাটিতে—কাঁধ থেকে বন্দুকটা ছিটকে পড়ল।
গাল-পোড়া বাঁটকুল বেনেটা প্রথমে উঠে বসল, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাপড়-চোপড় সামলে নিয়ে কোনদিকে দৌড় দেবে ভেবে পেল না।
ইতিমধ্যে চন্দ্ৰকান্তকে দেখা গেল রাইফেলটা হাতেই নিয়ে এক-এক-পা করে ছবি নায়েকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমার মনে হল, গাল-পোড়াটার বোধহয় গুলি খেয়ে মরার যোগ্যতা নেই; পিটিয়ে মারা দরকার।
চন্দনীও উঠে বসেছিল। হাঁটু গেড়ে বসেছিল। চাঁদের আলোতে ওর পরিষ্কার সাদা শাড়ি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
চন্দ্ৰকান্তকে এগিয়ে আসতে দেখে ছবি নায়েক সোজা পাতাঝরা আমলকী বনের নীচ দিয়ে আমাদের দিকে দৌড়ল।
টাকাওয়ালা লোক, শুধুই টাকা সর্বস্ব লোক যখন প্রাণভয়ে দৌড়য় তখন দেখতে ভারী মজা লাগে। ওদের বড় মায়া প্রাণের। ওদের অনেক ফোটাই টাকা আছে বলে ওদের প্রাণের দাম অন্য সকলের প্রাণের দামের চেয়ে বেশি বলে মনে করে ওরা। ওর দৌড়ে আসার ভঙ্গীর মধ্যে ওর পাম্পশু, বাফতার পাঞ্জাবি, তাঁতের ধুতি সবকিছুর মধ্যে একটা ইত্রামি ফুটে উঠছিল।
ও দৌড়চ্ছিল, ওর পিছনে পিছনে চন্দ্ৰকান্তও।
ছবি যখন একেবারে আমাদের সামনে দিয়ে এসে জঙ্গলের গভীরে ঢুকে গেল, তখন আমি আর নারাণ ওকে একসঙ্গে ক্যাক্ করে ঠেসে ধরলাম। ও অবাক হয়ে মুখটা ফাঁক করল। চাঁদের আলোয় ওর ফাঁক-ফাঁক দাঁতওয়ালা কুচক্রী মুখ আর গালের পোড়া দাগটা চক্চক্ করে উঠলো।
ও আমাদের পা ছুঁয়ে বলল, আমাকে মারবেন না, যা চান তাই-ই দেবো। অর্ধনগ্ন নারাণ টাঙ্গীর ডান্ডা দিয়ে এক বাড়ি মারল ওর মাথায়। বলল, চুপ কর শালা! একটা শব্দ করেছিস কি শেষ।
আমি পিস্তলটা বের করে ওর মাথায় ঠেকিয়ে রাখলাম।
গাল-পোড়া বেনেটা জলহস্তীর মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখনও চন্দ্ৰকান্ত বারিরির আধাআধিও আসেননি! এবার দৌড়ে আসছেন।
চন্দনী কিন্তু যেখানে ছিল তেমনিই বসে ছিল।
হঠাৎ পর পর অনেকগুলো গুলির শব্দ হল রাইফেলের। মন হলে, চন্দ্রকান্তর ডান পাশ থেকে। দেখলাম, চন্দ্রকান্ত মাটিতে পড়ে গেলেন মুখ থুবড়ে। পড়বার আগে যেন অনেকখানি ছিটকে উঠলেন উপরে। দূরে সেগুনবনে অনেকগুলো টর্চ জ্বলে উঠল একসঙ্গে।
ইতিমধ্যে কম্ফু বাঁদিক থেকে এসে পড়ল দৌড়ত দৌড়তে।
আমাকে বলল, আপনি এক্ষুনি ক্যাম্পে চলে যান।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন? চন্দ্রকান্তকে এভাবে ফেলে যাওয়া যায় না। তারপর উদ্বিগ্ন গলায় শুধালাম, চন্দনী?
কম্ফু বলল, রত্নাকর ফৌজসমেত দারোগাকে নিয়ে এসেছে। ওরা নিশ্চয়ই এক্ষুনি ক্যাম্পে যাবে। ক্যাম্পে আপনার থাকা দরকার। আমাদের কথা জিজ্ঞেস করলে বলবেন, যাত্রা দেখতে গেছি।
আমি আবার বললাম, চন্দ্রকান্ত, চন্দনী?
ওরা বলল, আমরা দেখছি। চন্দ্রকান্ত শেষ? কম করে তিনটে গুলি লেগেছে। আপনি যান। আর কথা বলার সময় নেই।
বহুবার পড়তে পড়তে বেঁচে আমি দৌড়ে নামলাম পাকদণ্ডী দিয়ে। ক্যাম্পে পৌঁছে আগুনটাকে জোর করলাম।
প্রায় আধঘণ্টা পরে—কিন্তু সময়টা কি করে যে কেটে গেল বুঝলাম না।—জিপের আওয়াজ শুনলাম, আলোও দেখা গেল। দুটো জিপ কাছে এসে থেমে গেল।
সেই সেদিনের দারোগা, জিপ থেকে নেমে একগাল হেসে বলল, এসে দেখুন, আপনাদের হীরো জিপের পিছনে পড়ে আছে। সেদিন বড় বক্তৃতা দিয়েছিল।
দারোগার পিছনে পিছনে জিপ থেকে নেমে রক্তমাখা চন্দনী দৌড়েএসে আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, দেখবে এসো, আমার বরকে ওরা কি করে মেরেছে—কতগুলো গুলি লেগেছে, রক্ত—কি রক্ত! দেখবে এসো। চন্দনীর দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। অন্যদিকে মুখ ফেরালাম আমি।
দারোগা জিপের বনেটে বসে সিগারেট ধরালো।
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, এঁকে শীগগিরই হাসপাতালে নিয়ে যান। একে সেকেন্ড দেরী না করে।
দারোগা হাসল। বলল, ও মরে গেছে অনেকক্ষণ।
হঠাৎ দেখি, রত্নাকর পিছনের জিপ থেকে নেমে এসে দাঁড়াল।
দারোগা বলল, আপনার ক্যাম্পের আর লোকজন কোথায়?
আমি বললাম, সকলেই যাত্রা দেখতে গেছে।
দারোগা বলল, আমার আর কথা বলার সময় নেই। লাশ নিয়ে সদরে যাব। চন্দনীকে ফেরত দিয়ে গেলাম।
বললাম, চন্দনীকে যারা ধরে নিয়ে গেছিল, তাদের নিয়ে যাবেন না সদরে?
দারোগা হাসল। বলল, ওকে পেলাম, আপনাদের হীরোর সঙ্গে। চন্দ্রকান্তর বুকের উপর উপুড় হয়েছিল।
দারোগা জিপ স্টার্ট করে বলল, মেরে ধরে নিয়ে যাওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। জঙ্গলে এমন আকছার হয়।
রত্নাকর গিয়ে দারোগার পাশে বসল। আমার দিকে ও একবার করুণার চোখে তাকাল।
আমি বললাম, কোথাকার মর্গ থেকে পাবো চন্দ্ৰকান্তকে।
-সব হবে, সব হবে; তাড়া কিসের? এস-পি নিজে তদন্তে আসবেন কাল সকালে এখানে। তখন আবার উল্টো-পাল্টা বলবেন না যেন তাঁকে, সাবধান। সব বেয়দবীর মূলে যে, সে তো ঐ পড়ে আছে। ওকে দেখে সকলকে শিখতে বলবেন। তেজ যেন কেউ না দেখায়।
বলেই, কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, দারোগা তার ফৌজ নিয়ে খুব জোরে জিপ ছুটিয়ে চলে গেল।
চন্দনী একেবারে ভেঙে পড়ল, হাঁটু গেড়ে বসে আমার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে- কাঁদতে বলল, তোমরা পুরুষ মানুষ নয় গো, তোমরা মরদ নও, আমার এত ভালোবাসার বর, আমার মরদের মতো মরদকে ওরা এমন করে নিয়ে চলে গেল। মুখে একটু জল পর্যন্ত দিল না, আর তোমরা দেখলে চেয়ে চেয়ে?
দারোগার জিপ চলে যাওয়ার একটু পরই বারিরির দিক থেকে একটা তীক্ষ্ণ সংক্ষিপ্ত আর্তনাদ শোনা গেল। একবার, শুধু একবার। তারপর আবার সব চুপচাপ।
একটু পরে নারাণ লাফাতে লাফাতে নেমে এসে বলল, নুন চাই, নুন।
—কি হবে? আমি বললাম।
—ছবির গা কেটে তাতে নুন ভরে দেবো। ওকে গাছে বেঁধে রেখেছি। বারিরিতে বুনো কুকুরের দল আসবে মাঝরাতে। রক্তের গন্ধে ওরা আসবেই আমরা চলে এলে, ততক্ষণ ওকে চিরে চিরে ফালা ফালা করছে কম্ফু ওর সারা গায়ে নুন দিয়ে রাখব। ও জ্বালাটা বুঝবে, ও বুঝবে যে, এ সংসারে দীনবন্ধু এখনও আছে।
নিরীহ, নির্বিকার আফিংখোর নারাণের চোখ দুটো বাঘের মতো জ্বলে উঠল। নারাণ মুখবিকৃতি করে বলল, কুকুরগুলো ওকে খুবলে খুবলে খাবে।
চন্দনী পাগলির মতো বলল, আমাকে নিয়ে চল নারাণ ভাই, আমাকে নিয়ে চল।
নারাণ আধবস্তা নুন কাঁধে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল আবার। যেতে যেতে বলল, বোন তুই থাক। আমাদের হাতে ছেড়ে দে ওকে, দ্যাখ ওকে কি করি আমরা।
চন্দনী আমাকে দেখছিল অবাক চোখে।
অনেকক্ষণ পর ও শুধোল—যেন অনেক দূর থেকে, কি করবে এখন তুমি?
আমি বললাম, জানি না। কিন্তু যেখানেই যাই, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব।
চন্দনী ভুরু তুলে তাকাল আমার দিকে। ওর চোখে এখন জল ছিল না, আগুন ছিল। মুখে কিছু বলল না।
আমি বললাম, কোলকাতা যাব, চল চন্দনী, তোমাকে নিয়ে কোলকাতাতেই যাব।
চন্দনী খুব আস্তে বলল, না।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, যাবে না? মানে, এখন যেতে চাও না?
তারপরই বললাম, এখন যাওয়ার তো কথা ওঠে না। চন্দ্রকান্তকে নিয়ে ফিরে আসব, সৎকার করব, তারপর যাব।
-না। চন্দনী আবারও বলল। এবার দৃঢ়তার সঙ্গে।
আমি বললাম, কি হল? চন্দনী? কি, না? না, কি?
চন্দনী মাথা নাড়ল দুধারে। বার বার মাথা নাড়ল।
তারপর অস্ফুটে বলল, তুমি ফিরে যাও। আর আমার ভয় নেই।
বারিরির দিক থেকে পরপর তিনবার উঃ-উঃ-উঃ-উঃ-উঃ-উঃ করে তীব্র আর্তনাদ উঠল।
তারপর আবার সব চুপচাপ।
ডিড-ইউ-ডু-ইট পাখিগুলোর উত্তেজিত ডাক শোনা যেতে লাগল ওদিক থেকে। সেই পাখিগুলোর দূরাগত ডাক শুনতে শুনতে হঠাৎ আমার মনে হল যে, ঐ বধ্যভূমিতে চন্দ্রকান্তর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে চন্দনীর, কম্ফুর, নারাণের এমনকি আমারও বুকের একটি শীতল বোধ বুঝি নিহত হয়ে গেছে আজ রাতে। মেরিয়াবলির মতো আমাদের প্রত্যেকের বুক থেকেও কেউ যেন সমূলে খুবলে তুলে নিয়েছে সেই লজ্জাকর বোধটিকে চিরদিনের মতো। সে বোধের নাম ভয়!
***