৭
দুপুরে খেয়ে-দেয়ে উঠতে না উঠতেই নারাণরা এসে ধরল, চলো বাবু, হাটে যাবে।
বললাম, চল।
চন্দনী বলল, আমিও যাব কিন্তু।
তারপর রত্নাকরকে বলল, বাবু তুমি যাবে না?
রত্নাকর গম্ভীরমুখে খাতাপত্র নিয়ে হিসাব করছিল। মুখ না-ফিরিয়েই বলল, নাঃ।
ক্যুপ্-কাটা কুলিরা তো জুকু ক্যুপের কাজ করে সকাল থেকেই এসে জমায়েত হয়েছিল। নালার পাশে, পাথর সাজিয়ে উনুন করে মাটির হাঁড়িতে ভাত রেঁধে শালপাতার ঠোঙায় ওরাও ওদের খাওয়া সেরে নিয়েছিল। সকলেই যার যার গামছা কাঁধে ফেলে এখন হাটে যাওয়ার জন্যে তৈরি। এদের সকলকে ফেলে আমি যদি চন্দনী কম্ফু কালিন্দীকে নিয়ে জিপে যাই তাহলে মজাটাই নষ্ট। তাই ঠিক হল সকলে মিলে হেঁটেই যাব।
রওনা হওয়া গেল সর্পগন্ধা গ্রামের দিকে। কোনদিকে যে গ্রাম তা ওরাই জানে। পাকদণ্ডী দিয়ে পাহাড় উপত্যকা পেরিয়ে ওরা যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানেই যাব।
কোথা থেকে একটা কালো কুকুর এসে জুটল আমাদের সঙ্গে।
নারাণ আর কম্ফু আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছিল অন্যেরা আগে আগে কল্কল করে কথা বলতে বলতে।
নারাণকে শুধোলাম, এই কুকুরটা কার রে?
নারাণ জানে না, তাই কালিন্দীকে শুধোল।
কালিন্দী বলল, এটা যুধিষ্ঠিরের কুকুর।
বলেই, আগে-আগে যাওয়া যুধিষ্ঠিরকে আঙুল দিয়ে দেখালো। দেখিয়েই স্বগতোক্তি করল, নিজে খেতে পায় না, তার আবার কুকুর পোষার শখ আছে।
নারাণ হঠাৎ দার্শনিক হয়ে গিয়ে বলল, আহা! যুধিষ্ঠির নাম, একটা কুকুর না থাকলে স্বর্গে ওর পিছু পিছু যাবে কে?
কম্ফু হাসল। বলল, তোরা যেন সব স্বর্গেই যাবি—সেই আশাতেই থাক্।
নারাণ দুঃখিত হল। ও সত্যি বড় ভক্ত লোক। ওর দীনবন্ধুর ভজন শুনলেই তা বোঝা যায়। আফিং অথবা দীনবন্ধু এই দুইয়ের কাউকেই ও একটুও ছোট করে দেখেনি। দেখবেও না। তাই ওর স্বর্গ যাত্রা সম্বন্ধে কম্ফু সন্দেহ প্রকাশ করায়, ও একটু দুঃখিত হল।
কম্ফুকে বলল, কেন যাব না? আমার কিসের পাপ?
কম্ফু বলল, তোর জন্মটাই একটা পাপ, বেঁচে থাকাটাই একটা পাপ। মানুষের শরীর পেয়েছিসই শুধু; মানুষ হনি। অনেক জন্ম এখনও তোর বিছে, কাঁকড়া, সাপ, ব্যাঙ হয়ে জন্মে তারপর আবার মানুষ হতে হবে—। তারপর যদি মুক্তি হয়।
নারাণ বড় সরল মানুষ। কম্ফুর কথাটা ওকে খুব আঘাত করল।
কালিন্দী কম্ফুকে শুধালো, তুই যে বড় পর-পর নাম বলে গেলি, কার পরে কি জন্ম, তুই জানিস? সাপের পরে কি ব্যাঙ হওয়া নারাণের ঠিক হবে?
কম্ফু বলল, ঠিক-বেঠিক তো যার যার কর্মের উপর নির্ভর করছে। নারাণকে নাগপাশ কামড়াবে আর কামড়েই নাগশাপ মরে যাবে, পরের জন্মে নারাণ নাগশাপ হয়ে জন্মাবে। জন্মে, ব্যাঙ ধরে খাবে। তার পরের জন্মে ব্যাঙ হবে—এমনি করেই আর কি!
পরক্ষণেই বলল, এই তোরা যে, জঙ্গলে ক্যুপ্ কাটিস কি পাশাপাশি বড় বড় সাগুয়ান গাছ দেখলেই ধড়কে দিস? তা তো নয়। যার যাতে মৃত্যু লেখা আছে। তোর হাতে যে যে গাছের মুক্তি লেখা নেই, তার উপর ফরেস্ট গার্ড মার্কাই দেবে না, সেখানে তোর টাঙ্গীও পড়বে না। বুঝলি?
কালিন্দী বলল, কিছুই বুঝলাম না।
-সত্যি কথা বলতে কি, আমিও কিছু বুঝিনি।
কিন্তু কম্ফু বলল, বেশি বুঝে দরকার নেই।
হঠাৎ নারাণ বলল, আর তুই? তুই বুঝি স্বর্গে যাবি মরলেই?
তাই-ই যদি হয়, তো আয় এক্ষুনি টাঙ্গীর এক কোপে তোকে স্বর্গে পাঠাই।
কম্ফু হেসে উঠল। বলল, রাগ করছিস কেন? আমার তো তোর মতো স্বর্গে যাওয়ার বাসনা নেই। আমি ঠিক করে রেখেছি আমার মুক্তি কবে হবে, কতদিন পরে; কত জন্ম পরে।
নারাণ চোখ বড় বড় করে বলল, কি ঠিক করেছিস?
কম্ফু হাসল। টাঙ্গীটাকে ডান কাঁধ থেকে বাঁ কাঁধে নিল, সাপমুখো লাঠিটা ডান হাতেই রইল। বলল, দ্যাখ্, আমি রোজ প্রার্থনা করি যে, যত জন্ম জন্মাতেই হোক না কেন, জন্মাবো আমি। কিন্তু আমার শেষ জন্মে যেন ময়ূর হয়ে জন্মাই।
নারাণ বলল, কেন, ময়ূর কেন? নাগশাপ ধরে খাবি বলে? আমি কি মরে নাগশাপ হয়েও তোর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে না।
কম্ফু হাসছিল তখনও। বলল, নারে বোকা! আমি একটা ময়ূর হব, ভারী সুন্দর একটা ময়ূর। আর বনের একটা চক্রা-বক্রা চিতাবাঘ, এক বর্ষার দুপুরে যখন আমি আনন্দে পেখম তুলে নাচব, ঠিক সেই সময় খপ করে ধরে খেয়ে আমাকে মুক্তি দেবে। ময়ূরের পাখার মতো শ্রাবণের কালো মেঘের মধ্যে ঢুকে পড়ে মেঘের গাড়ি চড়ে আমি স্বর্গে যাব।
নারাণ চলতে চলতে কম্ফুর আশ্চর্য বাসনা ও কল্পনা দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে কম্ফুর দিকে চেয়ে রইল।
তারপরই বলল, নাঃ, তই একটা দারুণ লোক। তোর সব ব্যাপারেই একটা বিশেষত্ব আছে। তাই-ই তোকে এত ভালোবাসি।
কালো কুকুরটা মালিকের কাছ ছেড়ে আমাদের পায়ে পায়ে চলেছে এখন।
আমি চন্দনীকে বললাম, বিড়িগড়ের সেই জুড় কুকুরটার কথা মনে আছে? সেদিনই তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়।
চন্দনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বিড়িগড়ের কথা থাক।
তারপরই বলল, বুঝলাম। কুকুরটাকে মনে করে রেখেছো, আর সব কেমন ভুলে গেলে, তাই না? আমাকেও তো ভুলেই ছিলে। না ডাকলে কি আর দেখা হত?
আমি ওর দিকে কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকালাম।
ওরা এক সময় বড় রাস্তা ছেড়ে দিয়ে পাকদণ্ডীতে ঢুকল। বড় সুন্দর পথটা। ডানদিকে ধীরে ধীরে উঠে গেছে সকালে আমার যেখানে গেছিলাম সেই মালভূমির টুপি-পরা পাহাড়টা। বাঁদিকে আবার তেমনই ধীরে ধীরে গড়িয়ে নেমে গেছে একটা ঢাল—ঢালের পরে উপত্যকা।
এখন গাছে-গাছে লক্ষ-লক্ষ কোটি কোটি পাতা গরমে শুকিয়ে গেছে, শুকিয়ে যাচ্ছে। তাদের লাল আর হলুদে চর্তুদিকের সবুজের পটভূমিতে যে কী দারুণ দেখাচ্ছে। বাংলায় হলুদ লাল-সবুজের অত নাম নেই। ইংরিজিতে আছে। ইয়ালো, ইয়কার-ইয়ালো লেমন ইয়ালো। লালের মধ্যে রেড, ক্রিমসন, পিংক, স্কার্লেট, পোস্টঅফিস রেড, ব্রিক-কালার, রাস্ট-কালার আরো কত কি রঙ। রঙের সমারোহ। তার মধ্যে মধ্যে এখন জঙ্গল পাতলা হয়ে যাওয়ায় কালো কালো বড়-ছোট পাথর চোখে পড়ে, বড় গাছের কালো সাদা, ফিকে হলুদ এবং সবুজ কাণ্ড। কে এক চিত্রকর যেন নির্জনে বসে তুলি নিয়ে কী এক দারুণ জীবন্ত ছবি এঁকেছেন আদিগন্ত ক্যানভাসে। কালার-স্লাইডের মতো ক্ষণে-ক্ষণে প্রহরে প্রহরে ছবি বদলাচ্ছে।
টিয়ার ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে। টুই পাখি লেজ দুলিয়ে, লজ্জাবতী লতার মতো দেখতে যে দত্তারী পাতায় বসে ছিল এতক্ষণ সেই পাতায় হিল্লোল তুলে টি-টুই টি-টুই করে জঙ্গলের গভীরের সবুজে হারিয়ে যাচ্ছে শুকনো পাতার লালে। পাহাড়ী ময়নার বুকের লাল মিশেছে তাতে। এক রাশ আধশুকনো হলুদ পাতার মধ্যে থেকে হলুদ-কালো বসন্ত বৌরি পাখি কী উচ্ছ্বাসে সোজা উড়ে যাচ্ছে দূ-রে তীরবেগে যেন এক্ষুনি না গেলেই নয়—বিষম প্রয়োজন বুঝি তাকে এই মুহূর্তে কারোর।
আমার ভারী ইচ্ছে করে পাখি হতে। পাখি যখন উড়ে উড়ে গাছ-পালার গভীরে হারিয়ে যায়, কি পাহাড়ের অন্য পিঠে চলে যায়, কি চাঁদের মধ্যে ঢুকে যায়, অথবা যখন ডুবন্ত সূর্যকে ধাওয়া করে অন্ধকারে মিলিয়ে য়ায়, তখন আমার বড় মন খারাপ করে। ভারী জানতে ইচ্ছা করে ওদের গন্তব্যের শেষে কি আছে? কোথায় গিয়ে ওরা পৌঁছয়?
কখনও কখনও তা দেখেওছি বা।
পাখি এক গাছকে হঠাৎ পরম ঔদাসীন্যে ছেড়ে দিয়ে অতি আগ্রহের সঙ্গে গিয়ে অন্য গাছে বসে—কিন্তু সেখানেও থাকে না বেশীক্ষণ—আবার ঔদাসীন্যে তাকে ছেড়ে অন্য গাছে উড়ে যায়। পাখির সঙ্গে তাই নারীর এত মিল দেখি। শুধু পাখির সঙ্গে কেন? সমস্ত প্রকৃতির সঙ্গেই। নারী তো প্রকৃতিরই এক টুকরো। বড় রমণীয় টুকরো। পাখি, ফুল, প্রজাপতি, চৈত্রবনের হাওয়ায় ওড়া আম-মহুয়ার গন্ধ, শীতের বনের শিশিরের ফিফিস্, বর্ষার কেয়ার গন্ধ, গ্রীষ্মের তীব্র শুকনো মাটির ঝাঁঝ এইসব মিলিয়ে মিশিয়ে ভেঙেচুরে একজন নারীকে সৃষ্টি করেন বিধাতা। হয়তো পুরুষকেও তাই-ই করেন। কিন্তু আমি তো নিজেকে দেখতে পাই, আমার পরিপূরককে পাই, প্রকৃতির হৃদয়ের, শরীরের, নিভৃততম প্রকৃতিকে দেখতে পাই—তার নারীসত্তায়।
তাই-তো চন্দনীকে বড় ভালোবেসে ফেলেছি। পুরুষ কি নারীকে ভালো না বেসে পারে? নারীর ভালোবাসা নইলে কি সার্থক হয় কোনো পুরুষ? সার্থক হয় কি কোনো নারীও। পুরুষের ভালোবাসা ছাড়া?
চন্দনীর প্রতি আমার যে অনুভূতি তাকে নিবিড় ভলোলাগা বলাই শ্রেয় হবে। কারণ, ভালোবাসা অনেক গভীর বোধ
কম্ফু ঠিকই বলেছিল, জীবনে বার বার ভালোবাসা যায় না; ভালোবাসা পাওয়াও যায় না। একবার দুবারই তা জোটে কারো কপালে, সারা জীবনে।
এত কষ্ট : আর্থিক, মানসিক, সাংসারিক, সামাজিক, তবু আশ্চর্য! ভালোবাসা ঠিকই জেগে থাকে মানুষ-মানুষীর বুকে। তাদের মানুষ হতে, মানুষ থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। আমি বড় বোকা মানুষ। ভালোবাসা, এই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, চন্দনীর প্রতি ভালোবাসা, নারাণ, কম্ফু, কালিন্দী, চন্দ্রকান্ত এমনকি রত্নাকরের প্রতি ভালোবাসাও আমাকে বড় আচ্ছন্ন করে। ভালোবাসার পাত্র আমার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। ভালো যে বাসতে পারি, কাউকে, কিছুকে; এই বোধটাই আমাকে বড় মুগ্ধ করে তোলে।
এত ধাক্কা খাই, আঘাত পাই, প্রতি পদে পদে, শহরে, বনে, তবুও মনে মনে মানুষকে না ভালোবেসে পারি না। মানুষকে ভালোবাসতে পারার অপারগতা সে তো মানুষের প্রতি অবিশ্বাসেরই নামান্তর!
নারাণ ও ক্যুরা পরজন্মে যা হতে চায় তাই-ই হোক। মুক্তি পেতে চায়, পাক। আমি যেন আবার মানুষ হয়েই জন্মাই, আমার এই সুন্দর, বড় সুন্দর দেশে, আবারও যেন এই প্রকৃতিতে, নিরুপদ্রব গভীর ভারতীয় শান্তিতে বড় হয়ে উঠি, তারপর এই দেশেরই কোনো সাধারণ শ্যামলা নরম নিভৃত নারীর কবোক্ষ কবুতরী শুনে মায়ের স্নিগ্ধ শ্বেতা হাঁসী স্তন থেকে স্থানান্তরিত হই। আবারও, আমের বোলের গন্ধ-ভরা এমনই বিলোল বসন্তের বনে।
মাঝে মাঝে আমার গর্ব হয়। আমি যে ভারতবর্ষেই জন্মেছি, এখানেই বড় হয়েছি। এখানেই পড়াশুনা করেছি আর পড়াশুনা করেও যা শেখা যায় না তা শেখার সাধ এবং দেখার চোখ দিয়ে এ-দেশকে দেখেছি সেই জন্যে।
একটা চড়াই পেরিয়ে, একটা উত্রাই নেমে, কিছুটা সমতলে গিয়েই দূর থেকে সর্পগন্ধা গ্রামের হাট চোখে পড়ল। একটা সেগুন বনের ভিতর অল্প একটু জায়পা— নিয়ে হাটটা। গাছতলায় অৰ্গুন পাতা বিছিয়ে দোকানিরা বসেছে। কোনো জায়গায় মোটা চাল, ডাল, শুধু মুসুর। শাড়ি গামছা। নানারঙা কাচের চুড়ি। আয়না, দুর্গার পট, জগন্নাথের পট। কয়েকটা এঁচড়, আলু, পেঁয়াজ, হলুদ, আদা, শিমুল মূল, কন্দমূল, নানারকম জংলী মূল, মাটির হাঁড়ি-কলসী আফিং-এর গুঁড়ো। মোটা দানার নুন। গুড়। আলতা, সিঁদুর।
এই পাহাড়ী গাঁয়ের চারপাশের লোকেরা এত গরিব যে মেয়েদের রুপোর গয়না, বা পেতলের বাসন বা চুল-বাঁধা রিবন কিছুই এই হাটে জমেনি। কিন্তু সিঁদুর এবং আলতা উঠেছে। বন-পাহাড়ের মেয়েদের বোধহয় এর চেয়ে বড় আভরণ নেই। হয়ও না।
এক পাশে একটা বিড়ি-বড়া ও গুগুলার দোকান। ভাঁটিখানা। শালপাতার দোনা ছড়ানো ছিটানো। বড় একটা বটগাছের একপাশে একজন নাপিত বসে একজন লোকের বগল কামাচ্ছে মনোযোগ দিয়ে। অন্যদিগকে সবুজ শাড়ি আর গোলাপী জামা এবং কালো রিবন মাথায় দিয়ে একজন মাঝবয়সী দারিয়ানী একটা পাথরের উপর বসে আছে।
আমি কম্ফুকে ডেকে বললাম, ওদের সকলকে বলে দাও যে, আমি প্রত্যেককে পেট ভরে গুল্গুলা আর বিড়ি-বড়া খাওয়াব এবং খাওয়ার পরে বিড়ি—যদি কেউ না ভাঁটিখানায় যায়।
ওরা সকলে শুনে হৈ হৈ করে উঠল।
নারাণ বলল, আফিং কোনো নেশা নয়। তা বাবু, আমি তো ভাঁটিখানায় যাই না বহুবছর। আফিং কিনলে কি তুমি আমাকে খাওয়াবে না?
আমি বললাম, নারাণ হচ্ছে নারাণ। নারাণের সঙ্গে কার তুলনা? নিশ্চয়ই খাওয়াবো।
আমি চন্দনীকে দশটা টাকা দিলাম। বললাম, তোমার যদি কিছু কেনার থাকে কেনো।
চন্দনী আমার মুখের দিকে এমনভাবে তাকাল যে, আমার বুকটা বড় নরম হয়ে গেল। বিয়ে না করেও, সহবাস না করেও বুঝতে পারলাম সেই মুহূর্তে যে দাম্পত্য সম্পর্ক কত গভীর ও মিষ্টি সম্পর্ক। এ দেশে। এখনও
এই টাকাটা আমার দেওয়া এবং ওর গ্রহণ করার মধ্যে এমন একটা বোঝাবুঝি ছিল যে, সেটা ভাষায় প্রকাশের নয়। প্রকাশের হলেও, সে ভাষা আমার নেই।
দু-পা এগিয়ে গিয়ে গ্রীবা বেঁকিয়ে চন্দনী একবার আমার দিকে ভালোবাসার জ্বরজ্বর চোখ তুলে চাইল। একটু হাসল। শেষ বিকেলে গাছ-গাছালির আড়াল ছিঁড়ে এক ফালি হলুদ-সোনা আলো এসে ওর মুখে পড়েছিল। আমার চন্দনী জ্যোতির্ময়ী হয়ে উঠেছিল।
ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে-যাওয়া চন্দনীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হল চাকরি পাওয়ার দিনের পর থেকে এত খুশি আমি কখনও হইনি। খুশিতে আমি উজ্জ্বল হয়ে উঠলাম। সকলকে ডেকে বললাম, আয়রে, তোরা বিড়ি-বড়া আর গুগুলা খা।
এই বিড়ি-বড়া—বিড়ি (কলাই) ডাল দিয়ে তৈরি করে ওরা। দক্ষিণ ভারতীয় বড়ার মতোই প্রায়। উড়িষ্যার সব অঞ্চলেই এর খুব চল্। যে যার হাট সেরে গুগুলা বিড়ি-বড়ার দোকানের সামনে এসে ভিড় করল। হৈ হৈ করে সকলে খেতে লাগল। দোকানি ও তার ছোট ছেলে গলদঘর্ম হয়ে গেল হঠাৎ এত খদ্দেরের ভিড়ে এই মুহূর্তে ওদের দশটা করে হাত থাকলে খুশি হত ওরা খুব।
দেখতে দেখতে বেলা পড়ে এল। দুটো মোষের গাড়ির মালিক মোষগুলোকে খুলে রেখেছিল। এখন মোষ জুতে একজন চাল-ডাল বস্তাবন্দী করে তুলতে লাগল। অন্যটাতে মাটির হাঁড়ি কলসী। ওরা বোধহয় দূর থেকে এসেছে। আলো থাকতে থাকতে গ্রামে পৌঁছতে চায়।
দারিয়ানী মেয়েটির কাছে একজনকেও যেতে দেখলাম না। ওর আজ হাট করার পয়সাটুকুও রোজগার হল না। আমি ভাবছিলাম, কোনো খদ্দের পেলেও তাকে নিয়ে ও যেত কোথায়? কালিন্দীকে শুধোলাম সে কথা। কালিন্দী হেসে ফেলল আমার অর্বাচীনতায়। বলল, এই জঙ্গল-পাহাড়ে ঘর-বাড়ি দিয়ে কি হবে বাবু? দেখতেন খদ্দের পেলেই চলে যেত গাছ-গাছালির ওপাশে, পাথরের আড়ালে, কি নালার ছায়ায়। এখানে ঘর কোনো সমস্যা নয়। লোকই সমস্যা; পয়সা সমস্যা।
আমি কালিন্দীর সঙ্গে কথা বলছি, এমন সময় দেখি চন্দনী গিয়ে মেয়েটার কাছে দাঁড়াল। মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে চন্দনীকে কি সব বলল।
মেয়েটার মুখে যেন কালি ঢেলে দিয়েছিল। দেখলাম চন্দনী তার হাতে কি যেন দিল। মেয়েটার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মেয়েটা দৌড়ে এসে ভাঙা হাটে যা পারে তাই তাড়াতাড়ি কিনে নিল।
চন্দনী আস্তে আস্তে আমার কাছে ফিরে এল। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। চন্দনী মুখ নামিয়ে নিল। তারপরই আমার মুখে প্রসন্নতা দেখে মুখ তুলে চাইল। দারুণ এক কৃতজ্ঞতার অনুভূতিতে ওর কালো মুখটি কাজললতার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আমি সবাইকে বললাম, খাও খাও। বিড়ি-বড়া খাও। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে নইলে। নারাণ বলল, বাবু, কম্ফুর বউ গুগুলা খেতে খুব ভালোবাসে। কম্ফুকে ওর বউ ছেলের জন্যে একটু কিনে দাও।
কফু লজ্জা পেল। নারাণকে বলল, ভাগ্।
আমি বললাম, নাও, কম্ফু গামছায় বেঁধে নাও।
কম্ফু বলল বউটা বড় পেটুক। ছেলেটাও হয়েছে তেমনি। ধুলো-বালি গোবর- চ্যবনপ্রাশ যা হাতের কাছে পায়, তাই-ই খায়।
এই ক-দিনে কম্ফুর বউকে দু-একদিন ছাড়া দেখতে পাইনি। মেয়েটি বেশ সুন্দরী। গায়ের রঙ ফর্সা। নাকে পেতলের নথ। পরনে গেরুয়া শাড়ি—এখানের মেয়েরা যেমন পরে। শুধুই শাড়ি; কোনোরকমে পেঁচানো। আর কোনো জামা- কাপড় নেই। মাথায় একরাশ কালো চুল। বিনা তেলে, বিনা চিরুনিতে রুক্ষ হয়ে গেছে। কিন্তু শরীরের বাঁধন এখনও খুব ভালো। মনে হয় কম্ফুর চেয়ে বয়সে কম করে পঁচিশ-তিরিশ বছরের ছোট হবে। নাম সীতা। ওকে কথা বলতে দেখিনি কখনও। এমন কি কম্ফুর সঙ্গেও। ওকে এমনিতেও ঝুপড়ির বাইরে একটা দেখা যায় না। শুধু দুপুরবেলা সকলের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে, ক্যাম্পের উপর একটা অলস মন্থরতা নেমে আসে যখন, কম্ফু যখন খল-নড়া হামানদিস্তা এসব নিয়ে নানারকম গাছপাতা শিকড় ছাল থেকে, রোদে পা-ছড়িয়ে বসে ওষুধ বানায়, তখন ওর বউ কম্ফুর দিকে পিছন ফিরে বসে অলস উদাসীনতায় নিজের মাথার উকুন মারে। চন্দনীর মতো নয়। নোরা, অপরিষ্কার। চন্দনী তো আদিবাসী উপজাতি। ওরা তা নয়। কম্ফুর বউকে দেখে মনে হয়নি কখনও যে, ও কিছু ভালোবাসতে পারে, ওরও পছন্দ অপছন্দ, দাবি-দাওয়া বলে কিছু থাকতে পারে। তাই-ই, ও যে গুগুলা খেতে ভালোবাসে একথা শুনে আমার একটা খবরের মতো খবর বলে মনে হয়েছিল।
কম্ফু যখন ওর গামছাতে গুগুলা আর বিড়ি-বড়া বেঁধে নিচ্ছিল তখন ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে ওর বউ-ছেলেকে বড় ভালোবাসে কম্ফু।
এবার ফেরার পালা। সকলেই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলেছে। আমি আর চন্দনী পিছন পিছন। যদিও আলো আছে এখনও যথেষ্ট কিন্তু এখনই চাঁদ উঠে পড়েছে সূর্য ডোবার আগেই। ধ্রুবতারাও উঠেছে পশ্চিমাকাশের নাকে সবুজাভ দ্যুতিময় হীরের নথের মতো।
নারাণ বলল, বাবু দলছাড়া হয়ো না।
-কেন? আমি শুধোলাম।
—না। ছবি নায়েক আর তার দলবল। মেয়েরা আজকাল ভয়ে হাটে আসে না একা। আমাদেরও ভয় করে। কখন যে কাকে ধরে মার-ধোর করে ঠিক-ঠিকানা নেই। বড় ভয় করে বাবু। জঙ্গলের বাঘকেও এত ভয় করে না।
আমি বললাম, চিন্তা নেই কোনো। তুই এগো।
চন্দনীর হাতে তখনও একটা বিড়ি-বড়া ছিল। আমাকে ভেঙে আধখানা দিল।
আমি বললাম, তুমি খাও। আমি খাবো না।
ও বলল, কেউ আদর করে কিছু দিলে তা না বলতে নেই।
কিছু না বলে আমি আধখানা বিড়ি-বড়া হাতে নিলাম।
বিড়ি-বড়াটা খেয়ে গাছের পাতা ছিঁড়ে তাতে হাত মুছে চন্দনী বলল, তুমি রাগ করলে, না? আমি তোমার টাকাটা ঐ মেয়েটাকে দিয়ে দিলাম বলে?
আমি বললাম, রাগ করব কেন? টাকাটা যখন থেকে তুমি হাত নিয়েছ, তা তোমারই হয়ে গেছে। ওতে আমার কি অধিকার?
চন্দনী বলল, জানো, মেয়েটা নীচু জাতের। ও থাকে এক ব্রাহ্মণের গাঁয়ে। যেখানে যে-কোনো কাজ পেলে, ধান-ভানার, ঘরের কাজের, ওর দিন চলে যেত, কিন্তু ছোট জাত বলে কাজ দিতে চায়নি কেউ। ওর স্বামীর বড় অসুখ; বুকের ব্যারাম, সারছে না। তাই গত তিন বছর হল এই করে কোনোরকমে চালাচ্ছে।
তারপর বলল, ওর বয়স হয়ে গেছে। তাছাড়া দেখতেও যে খুব একটা ভালো তাও নয়। বেচারীর খুবই মুশকিল।
আমি কম্ফুকে ডাকলাম।
কম্ফু থেমে পড়ল চলতে চলতে। ওর দল ওকে ছাড়িয়ে উৎরাইয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমরা গিয়ে ওর কাছে পৌঁছতেই ওকে বললাম, দেখি তুমি কেমন বদ্যি। একজন রুগীকে সারাতে পারো?
কোন রুগী?
কম্ফু ভুরু তুলে সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল।
আমি বললাম, রুগীর কথা।
কম্ফু খুব অসন্তুষ্ট হল। আমার দিকে ও চন্দনীর দিকেও রোষকষায়িত চোখে চেয়ে বল, ও ছোট জাত। ওর চিকিৎসা আমি মরে গেলেও করব না।
আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। বললাম, কম্ফু, বদ্যির আবার জাত-বিচার আছে নাকি, ভগবান তোমাকে যে বিদ্যা দিয়েছেন তা তো অন্যকে দেননি। তুমি সব অসুস্থ লোককে সুস্থ করে তুলবে, তবে না তোমার বিদ্যা সার্থক।
তারপর বললাম, রুগীতো রুগীই। রুগীরও আবার জাত থাকে কি?
কম্ফু শ্লেষের সঙ্গে হাসল।
বলল, তোমার অনেক জ্ঞান বাবু, তুমি বড় শহরের লেখাপড়া জানা লোক। তোমার বিদ্যা নিয়ে তুমি থাকো। আমরা জাত-বেজাত, জম্মা-বেজম্মা মানি।
আমি বললাম, তুমি যা চাও সব দেবো। যাবে?
কম্ফু বলল, আমি বদ্যি কম্ফু! আমাকে লোভ দেখিও না। আমি আমার জ্ঞান- গম্মি নিয়ে বেঁচেছি, বাঁচব। তোমার টাকার লোভে আমি জাত খোয়াবো না।
কম্ফু এই বলে হন্হন করে আমাদের ফেলে এগিয়ে গেল।
চন্দনী আমার পাশে গাঢ় হয়ে এসে বলল, লোকটার বউ যে দারিয়ানী—সেই জন্যেই ও রাজী হল না। তোমাকেও আসলে ওরা সহ্য করে ন—নেহাৎ তুমি বলেই কিছু বলে না। আমার কারণে তোমার এত অপমান আমার বড় লাগে। তুমি আমাকে মেরে ফেলো। না মারতে পারলে, যেখানে ইচ্ছে পেলে রেখে ফিরে যাও। আমি একটা হতভাগী।
আমি ওর হাতটা হাতে নিলাম।
বললাম, তুমি চুপ করো তো!
আমরা সবচেয়ে পিছনে আসছিলাম। যখন বড় রাস্তায় এসে পড়লাম তখন চাঁদটা পাহাড়ের বাধা ছাড়িয়ে উপরে উঠেছে। দিনের শেষ আলোর দিগন্তে বনজ্যোৎস্নার প্রথম আলো মাখামাখি হয়ে এক আশ্চর্য আলোর না-রাত, না-দিন, সৃষ্টি হয়েছে। না-প্রদোষ, না-ঊষা, একে কি বলে ডাকব?
ক্যাম্পের কাছে যেতেই একটা গোলমাল শুনতে পেলাম। তার মধ্যে কম্ফুর গলাই সবচেয়ে জোর।
রত্নাকর লুঙ্গির ওপরে শার্ট চড়িয়ে, প্লাস্টিকের জুতো পরে ঘড়ি লাগিয়ে, পকেটে ফাউন্টেনপেন গুঁজে কাঠের গুঁড়ির উপর বসে আছে সামনে আগুন করে। কুলিরা সব তাকে ঘিরে আছে। ভিড়ের মধ্যে কম্ফুর বউ এবং একটি অল্পবয়সী লোক। দেখে মনে হয়, কাঠ-কাটা কুলি
কম্ফুর বউ-এর গলা শুনলাম এই প্রথম। গলাটা ভাঙা-ভাঙা কর্কশ। চেহারার সঙ্গে গলার কোনো মিল নেই। সে রত্নাকরের দিকে চেয়ে আঙুল নাড়িয়ে বলছিল, বলো ম্যানেজারবাবু! আমি কি বলদ? কম্ফু কি আমাকে কিনে রেখেছে?
রত্নাকর, জজ সাহেবের মতো বাহ্যিক গম্ভীরতা বজায় রেখে নৈর্ব্যক্তিক চোখে চেয়ে ছিল কম্ফুর বউয়ের মুখের দিকে। মুখে কোনো কথা বলছিল না। তখন ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে, ওর বয়সের তুলনায় যথেষ্টে বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান হয়েছে রত্নাকর।
কম্ফু বলল, এই সীতা দ্যাখ, একবার চেয়ে দ্যাখ, তোর জন্যে গুগুলা এনেছি। বিড়ি-বড়া এনেছি, খাবি না? তুই কত ভালোবাসিস।
সীতা অর্থাৎ কম্ফুর বউ বলল, না।
তারপর বলল, বুড়ো বদ্যি! আমি কি ছাগলাদ্য না চ্যবনপ্রাশ? তুই তো আমার বাবার বয়সী—মেয়ের আদরটুকুও তো দিতে পারতিস? তুই কেবল নিজেকে নিয়ে থাকলি, তোর নিজের বিদ্যা, তোর কর্কট রোগের ওষুধ, তোর জড়া তেল, পুটকাসিয়ার গোড়া আর হাড়-কঙ্কালির ছাল। তুই একটা জোয়ান মেয়েকে কি দিয়েছিস্? শাড়ি? পেতলের মল? আদর? তোর কী আছে আমাকে রাখবার মতো? পাশের ছেলেটি মুখ নীচু করে দাঁড়িয়েছিল। শক্ত-সমর্থ কালো চেহারা, মাথার চুল পাতলা, ছেলেটির কাঁধে একটি ছেঁড়া ঝোলা!
কম্ফু বিড়বিড় করে বলল, কুশ? কুশের কি হবে সীতা? তোর কুশকে ছেড়ে থাকতে পারবি?
সীতা কর্কশ গলায় বলল, কুশকে ছেড়ে থাকব কোন দুঃখে? ওকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো।
—কুশকে নিয়ে যাস না রে সীতা, আমি তাহলে মরে যাবো। ও আমার ছেলে। ওকে রেখে যা।
সীতা ওর উলঙ্গ ধুলোমাখা ছেলের হাত ধরে চিৎকার করে বলল, তবে সবাইকে শুনিয়েই বলি—শুনুন সবাই—কুশ তোর ছেলে নয়, কুশের বাবাকে এই দ্যাখ, দাঁড়িয়ে আছে আমার পাশে। চেয়ে দ্যাখ্ ভালো করে।
কম্ফুর চোখটা দপ করে জ্বলেই নিভে গেল।
আমি ভাবলাম, কম্ফু ওর কাঁধের টাঙ্গী দিয়ে বুঝি দুজনকেই কেটে দু-ফালা করে ফেলবে এক্ষুনি। কিন্তু কম্ফু কিছুই করল না। মুখ নামিয়ে নিল। দেখলাম, ওর দু-চোখে জল।
কম্ফু বলল, তুই তাহলে এতদিন এতবছর আমাকে ঠকিয়ে এসেছিস?
—এসেছি। নির্লজ্জ দম্ভভরে বলল সীতা। একটু থেমে বলল, বেশ করেছি!
তারপর আর কথা না বলে সীতা সঙ্গের লোকটাকে বলল, চলো, যাই আমরা।
বলেই, ছেলের হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান লাগাল।
ছেলেটা, যার নাম এক্ষুনি প্রথম জানলাম, কুশ, ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল। ধুলো খেয়ে, ছাই খেয়ে, লাথি খেয়ে, ঝাঁটা খেয়েও যে গলায় এত জোর কি করে হল দু-বছরের ছেলেটার, তা ভেরে অবাক হলাম আমি।
সীতা হন্হন করে এগিয়ে যেতে লাগল।
নারাণ বলল, সীতা বোন, এই রাতে কোথায় যাবি?
সীতা বলল, ছবি ঠিকাদারের কাছে কামীনের কাজ করব। ভালো শাড়ি পরব, ভালো খাব। এখানে আর নয়।
ছেলেটার হাতে আর এক হ্যাঁচকা টান লাগাতেই ছেলেটা বাপ্পা, ও বাপ্পা বলে কাঁদতে লাগল। মায়ের সঙ্গে অনিচ্ছায় যেতে যেতে সমানে বাবা গো ও বাবা, বাবারে-এ-এ-এ বলে কাঁদতেই থাকল ছেলেটা মুখটা ফিরিয়ে রইল কম্ফুর দিকে।
যতক্ষণ লোক ওখানে ছিল সকলেই নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে ছিল। কারো মুখে কোনো কথা ছিল না। রাতের নিস্তব্ধতা, ঝিঁঝির ডাক, সমস্ত পরিবেশকে একটি দু-বছরের সরল, ধুলোমাখা শিশুর গলার বাবা গো, ও বাবা–বাবা-আ-আ-আ-আ রব অনেকক্ষণ অবধি মথিত করে রাখল।
কুশের চিৎকার যখন আর শোনা গেল না, শিশির পড়ার শব্দ যখন তার কচি গলার স্বরকে ঢেকে দিল; তখন প্রথম কথা বলল রত্নাকর।
বলল, কম্ফু শেষে তোর বউ একটা ছোট জাতের ছেলের সঙ্গে পালাল। তার ছেলে পেটে ধরল। তুই একটা পাঁঠা!….
আমি রত্নাকরকে মেরে বসতাম, কিন্তু সামলে নিলাম। এরা বড় নিষ্ঠুর, বড় কঠোর, বড় কূপমণ্ডূক এরা। আবার এরাই কখনও বড় দয়ালু, ভালো; মহৎ।
নিজেকে সামলে নিয়ে আমি চন্দনীকে নিয়ে ঘরে গেলাম। একটু পর হঠাৎ একটা বুক-ফাটা চিৎকার শুনলাম। সে হাহাকার বড় মর্মভেদী।
কিন্তু পরক্ষণেই চুপ করে গেল কম্ফু। একটি ক্ষণিক কিন্তু তীক্ষ্ণ আর্তস্বর। তবুও অনেকক্ষণ সেই স্বর পাহাড়ে জঙ্গলে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরল।
জানি না, এখন অনেকদূরে চলে-যাওয়া একটি নিষ্পাপ সরল শিশু, কম্ফুকে যে প্রথম চোখ মেলে এ পৃথিবীতে বাবা বলে জেনেছিল, যাকে ভালোবেসে ও যার ভালোবাসা পেয়ে পৃথিবীতে অপত্য স্নেহের স্বাদ পেয়েছিল, সে বড় হয়েও তার এই নকল বাবাকে মনে রাখবে কিনা।
হয়তো রাখবে না।
কিন্তু কম্ফু বুঝি তার নকল ছেলেকে কখনও ভুলতে পারবে না। কম্ফুর তো আর কোনো অবলম্বন রইল না; কোনো গাছ-গাছড়া শেকড়-বাকড় জড়ি-বুটি কোনো কিছুই রইল না আর জঙ্গলের এই মহান বদ্যির আঁকড়ে ধরার মতো। ওর বুকের সব ভালোবাসা অবিশ্বাসের হামানদিস্তায় গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়ে গেছে সীতা।
কুশ যে তার কেউ নয় একথা জানলে ও কুশকে ভালোবাসতো না হয়তো, কিন্তু ভালোবেসে ফেলার পরে নকল জানতে পেরেও কি সে ভালোবাসা ফিরিয়ে নিতে পারবে কম্ফু? কম্ফুই জানে।
মনটা এত খারাপ হয়ে গেল যে সেদিন আর খাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। চন্দনীও খেল না।
নালায় হাত-মুখ ধুয়ে জামা কাপড় বদলে এসে ক্যাম্পের বাইরে কাঠের গুঁড়িতে বসেছিলাম।
কালিন্দী যুধিষ্ঠির ও আরও ক্যুপ্-কাটা কুলীরা আজ সকলে ক্যাম্পের আশ- পাশেই থেকে যাবে রাতের মতো। এদিকে-ওদিকে ওরা পাথরের উনুন বানিয়ে আগুন করে রান্না চড়িয়েছে। ভাত ফোটার গন্ধ, তার সঙ্গে আফিং-এর গুঁড়োর গন্ধ মিশে অদ্ভুত এক গন্ধ বেরোচ্ছে। সে গন্ধ মিশে গেছে রাতের বনের গায়ের গন্ধের সঙ্গে।
ওরা সকলে বলেছিল যে, সীতার এই চলে যাওয়ার পিছনেও ছবি নায়েকের হাত আছে। এই বন-পাহাড়ে যা কিছু অনৈসর্গিক অশুভ ঘটনা ঘটে সবকিছুর পিছনেই তার হাত আছে।
ছবি নায়েক এ জঙ্গলে স্বৈরাচারের প্রতিমূর্তি। ছবি নায়েক ওদের কাজ করিয়ে টাকা দেয় না; মারধোর করে। যে-কোনো মেয়েকে সে চায় নিয়ে যেতে। কোনো চক্ষুলজ্জা, ভয়, বিবেক কোনো কিছুই নেই লোকটার।
চাঁদের আলোয় ওদের পাণ্ডুর মুখের দিকে তাকিয়ে বড় করুণা হল আমার। যদিও ওরা ছবি নায়েকের কাছে কাজ করে না; তবুও যেন সর্বক্ষণ ভয়ে সিঁটিয়ে আছে সকলে। ওদের ম্যানেজার রত্নাকরের মধ্যে ওরা আর একজন ছবি নায়েকের বীজ দেখতে পায়, বলেই কি?
ওরা নিজেদের মধ্যে পুটুর পুটুর করে অস্ফুটে কি সব কথা বলছে শোনা যায় না তা। ওরা যেন কত দূর থেকে, অচেতন থেকে কথা বলছে। ওদের পুটুর পুটুর কথা ভাত ফোটার পুটুর পুটুর আওয়াজের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
নারাণ ঝুপড়ির সামনে বসে যথারীতি ওর গান শুরু করেছিল।
দয়া করো দীনবন্ধু আজ যাউ শুভ দিন।
দীনবন্ধুকে যতই আকুল হয়ে ডাকুক না কেন নারাণ, সব দিন কারোই শুভ যায় না। আজকের কম্ফুর দিনের মতো।
হঠাৎ কচ্ কচ্ চক্ চক্ শব্দ শুনে পিছন ফিরে দেখি যুধিষ্ঠিরের কালো কুকুরটা কম্ফুর ঝুপড়ির সামনে খুব মনোযোগ দিয়ে মুখ নিচু করে কি যেন খাচ্ছে।
উঠে গিয়ে দেখি, গুগুলা আর বিড়ি-বড়া। কম্ফু তার কোঁচড় শূন্য করে সব ঢেলে দিয়েছে ধুলোর মধ্যে, কুকুরের সামনে।
কিন্তু কম্ফু কি কোঁচড়ে করে শুধু গুগুলা আর বিড়ি-বড়াই এনেছিল তার ভালোবাসার স্ত্রী আর সন্তানের জন্যে? ওর কোঁচড়ে ওর বুকের পাঁজরের মধ্যে তাদের জন্যে আরও যা ছিল, যা দেখা যায় না, হাত দিয়ে ছোঁওয়া যায় না; সেই বোধগুলোকেও কি ধুলোয় ফেলে কুকুর দিয়ে খাওয়ানো যায়?
বেচারী কম্ফু! আমি ডাকলাম, কম্ফু।
কোনো সাড়া পেলাম না।
আমি আবারও ডাকলাম, কম্ফু।
তবু সাড়া দিল না কেউ।
তখন আমি ঝুপড়ির কাছে গিয়ে ভিতরে উঁকি মারলাম। উঁকি মেরে দেখি, ঝুপড়ি ফাঁকা। কেউ নেই সেখানে।
ফিরে এসে নারাণকে শুধোলাম, কম্ফু কোথায় গেছে জানে কি না!
নারাণ গান থামিয়ে বলল, জানে না। অন্য কেউও জানে না। এত রাতে কোথা গেল লোকটা একা একা জঙ্গলে?
কাক-জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে বন-পাহাড়। একটা কোকিল কুহু কুহু করে পুলক ভরে ডেকে চলেছে। এতদিন কোকিলের ডাক শুনিনি একেবারে। বসন্ত এসে গেছে সমারোহে। তাকে স্বাগত জানাচ্ছে কোকিল। বনে-পাহাড়ে বসন্ত একটু দেরীতে আসে—শীতও যায় দেরীতে। একটা কোকিল বারিরির দিক থেকে ডাকছে আর একটা সাড়া দিচ্ছে আরো নীচ থেকে। আরো কত পাখি ডেকে ফিরছে। দোল পূর্ণিমার আগের রাতে সমস্ত প্রকৃতি বুঝি হোলিখেলার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। কাল কিন্তু এখানে কারো ছুটি নেই। জঙ্গলের মধ্যের এই ছায়ানিবিড় খোলে ক্যালেণ্ডারের দাম নেই কোনো, সময়েরও নেই, আইন-কানুন, ইউনিয়ন, কিছুরই নেই। এখানে একদল কাজ করে, একদল কাজ করায়, আর একদল এই সমস্ত ব্যাপারটাকে নিয়ন্ত্রণ করে নেপথ্যে থেকে। যাদের টাকা আছে এবং আরও টাকা রোজগারের উৎসাহ আছে।
কিন্তু এই লোকগুলোর কোনো বিকার নেই। এই নারাণ, কালিন্দী, যুধিষ্ঠিররা। এরা অদ্ভুত মানুষ। এই কূপমণ্ডূক শান্ত অথচ বড় দুঃখের জীবন নিয়ে এদের কোনো অভিযোগ নেই। শুধু আফিংই নয়, সমর্পণের প্রতিবাদহীনতার মরফিনে এরা এক দারুণ ঘোরের মধ্যে আছে। এক ধরনের নিরীহ জংলী জানোয়ারের মতো। আশ্চর্য লাগে ভাবলে। এদের সুখ-দুঃখ, ভালো মন্দ, বর্তমান ভবিষ্যৎ সমস্ত দীনবন্ধুর উপরে ছেড়ে দিয়ে আফিং-এর গুঁড়োর সঙ্গে চাল সেদ্ধ করে একটু নুন দিয়ে খেয়ে এরা দিব্যি হাসিমুখে বেঁচে রয়েছে। এদের খুব কাছ থেকে দেখার পরে সবচেয়ে বেশি যা আমাকে অবাক করে তা হল এদের অভাববোধের অভাব। এটা একদিকে যেমন খারাপ, আবার অন্যদিকে ভালো নিশ্চয়ই। এরা এক মেরুর, আমরা অন্য মেরুর। শহরের আমরা অভাববোধকে নিরন্তর বাড়াতে বাড়াতে অভাববোধ আর প্রাপ্তির, সুখহীনতা ও সুখের মধ্যে ব্যবধানটা দিনের পর দিন বাড়িয়েই তুলেছি। সুখের পাখিকে তাই আর কিছুতেই মনের খাঁচায় ধরে রাখতে পারছি না। নারাণ আমার চেয়ে কত গরিব, কত হতভাগা, ও হয়তো মনুষ্যেতর জীবের পর্যায়ের জীবনই যাপন করে, কিন্তু ওর মধ্যে আবার একধরনের মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্ব সর্বক্ষণ প্রতিভাত দেখি যা আমার মধ্যে একেবারেই অনুপস্থিত বলেই জানি আমি।
যেসব সুখের পিছনে আমরা শহুরে শিক্ষিত লোকেরা ঘুরে বেড়াই সেইসব সুখের প্রয়োজন বোধহয় আমাদের নিজেদেরই তৈরি করা। তার অনেক কিছুই না থাকলেও অনায়াসে হয়তো দিন চলে যেত আমাদের। অথচ অন্য দশজন যা করে, যা চায়, আমাদের তাই-ই করতে হয়, যা চায়, তাই-ই চাইতে হয়। তাদের মতো করে টাইয়ের নট্ বাঁধতে হয়, ফ্লেয়ার বানাতে হয়, টি-ভিও কিনতে হয় রাজনীতির মিথ্যুক ও কুদৃশ্য নেতাদের এবং চিড়িয়াখানার কচ্ছপ দেখার জন্যে। প্রতিবেশী ট্যাক্সি চড়লে আমাকেও চড়তে হয়, গাড়ি কিনলে গাড়িও, না পারলে ঈর্ষার অম্বলে বুক জ্বলে যায়।
অথচ এসব অনেক কিছু ব্যতিরেকেই দিব্যি চলে যেত দিন। অনেক অবকাশ থাকত, যে যা করতে চেয়েছিলাম তা করতে পারতাম, আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব অনুসারে এক-একজন সম্পূর্ণ নিটোল স্বয়ংস্বরূপ ব্যক্তি হয়ে উঠতেও বা পারতাম।
কিন্তু জীবনের মাঝামাঝি এসেও কিছুই হওয়া হল না। দৌড়ে দৌড়ে জুতো ক্ষয়ে গেল, পড়ে পড়ে চোখ ম্লান হল, উপরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘাড়ে ব্যথা জন্মালো, ঈর্ষার পরশ্রীকাতরতার গরলে এককালীন অনাবিল মনের পদ্মরঙা অমৃত গরলে নীলাভ হয়ে উঠল—তবু চাওয়া ফুরোল না; লোভ ফুরোল না।
ওরা একসঙ্গে গোল হয়ে বসে গল্প করছিল। নারাণটা ফ্যাঁস্ ফ্যাস্ করে পাতিহাঁসের মতো হাসছিল। হাসতেও পারে ওরা। একটা বড় গামছা দুভাগ করে পরে ও গায়ে দিয়ে, খালি গায়ে, খালি পায়ে আয়ের ঘরে সামান্য কিছু মুদ্রা ও সম্পত্তির ঘরে একটি নিখুঁত গোলাকার শূন্য ভরে দিব্যি হেসে খেলে গান গেয়ে দীনবন্ধুর ভরসায় কেমন চালিয়ে যাচ্ছে এরা। কূপমণ্ডূকতাকে লোকে খারাপ বলে বটেই—কিন্তু সুখী হবার এমন প্রকৃষ্ট উপায় বোধহয় আর দুটি নেই
কাল যাত্রা হবে সর্পগন্ধা গাঁয়ের কাছের মাঠে। নীলমণি চম্পতিরায়ের যাত্রার দল সেখানে রাজনন্দিনী যাত্রা করবে। কাল সকালেই তাড়াতাড়ি কাজকর্ম সেরে বন-জ্যোৎস্নায় ভেসে ভেসে দল বেঁধে গান গাইতে গাইতে ওরা যাত্রা দেখতে যাবে সারারাত যাত্রা দেখে আবার ভোরে ভোরে ফিরে এসেই কাজে লাগবে।
এই বাসন্তী পূর্ণিমার নেশাটা বড় আচ্ছন্ন করে ফেলেছে আমায়। এইজন্যেই জঙ্গলে আসি না। আসতে চাই না আমি। এলেই কেমন নেশা লাগে। শহরের সঙ্গে এখানকার তুলনা করে শহরকে বড় গোলমেলে, নোংরা, দীন, ছোটমনের জন্তুদের বাসস্থান বলে মনে হয়। এখানে এলেই কেন এখানে এসেছিলাম, সে কথা ভুলে যাই, একদিন যে ফিরে যেতে হবেই, ভুলে যাই সে কথাও। ফিরে যাওয়ার কথা মনে আনলেই কান্না পায়।
একা বসে ভাবছিলাম যে, চন্দ্রকান্তর কারণেই চন্দনীর বোঝা চাপল আমার ঘাড়ে। বোঝাই বলি। যা সত্যি, তাকে সত্যি করে বলাই ভালো। যার স্ত্রী সে তাকে বেমালুম অস্বীকার করে দিব্যি টঙে চড়ে দিন কাটাচ্ছেন, আর আমি কেন মরতে এ-ঝামেলা কাঁধে নিই! আমি না হয়ে অন্য কেউ হলে চন্দনীর শরীরটাকে এক পাথরবাটি ক্ষীরের পায়েসের মতো চেটেপুটে খেয়ে বাটিটি ছুঁড়ে ফেলে, বনে ফিরে যেত মুখ মুছে হয়তো। কিন্তু আমি কি, তা চন্দনী যেমন জানে, তেমন জানেন চন্দ্ৰকান্তও। আমি একটা আকাট ইডিয়ট্। হামাগুড়ি দেওয়ার পরবর্তী সময় থেকেই পায়ে আঠা নিয়ে ঘুরছি আমি। যেখানে যাই, সেখানেই ফেঁসে যাই, সেঁটে যাই পালিয়ে আসতে পারি না।
ঠিক করলাম, কাল পূর্ণিমার রাতে আরেকবার চন্দ্রকান্তর কাছে যাবো —গিয়ে শেষবারের মতো চন্দনী সম্বন্ধে একটা বোঝাপড়া করে চন্দনীকে নিয়ে গিয়ে বিড়িগড়েই ছেড়ে দিয়ে আসবো।
আসলে আমি শহরের কীট। পীচ রাস্তার হাউড্রেন্ট-এর তেলাপোকার মতো। ময়লা, ধুলো, বীজাণু ও ডিজেলের ধোঁয়ার মধ্যে আমার প্রোটিন, ভিটামিন, সব। আমি কেন বনের নির্মল সুদৃশ্য প্রজাপতি হতে পারব? সবাই কি সব হতে পারে? আমি অস্পষ্ট, প্রচ্ছন্ন, সংস্কৃত, আমি আধুনিক, উদগ্র অথচ নরম, লাজুক। আমি পর্দা ভালোবাসি, ভালোবাসি ঘেরাটোপের আলো, ভালোবাসি আস্তে কথা বলা, এক চিলতে আকাশে অভ্যস্ত আমি। এতবড় আকাশে আমার চোখ বেঁধে যায়।
হঠাৎ চন্দনী বলল, কী করছ একা বসে?
আমি চমকে উঠলাম।
আমি বললাম, ভাবছি।
—কি ভাবছ? চন্দনী বলল।
-এই কম্ফুর কথা, তোমার কথা, চন্দ্রকান্তর কথা।
—ওঃ। ও বলল। তারপর বলল, এত মুখ-গোমড়া করে ভাবাভাবির কি আছে? আমি তো আমার কথা বলেইছি তোমাকে।
আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, তা তো বলেইছ।
ভাবলাম চন্দনী একটু বেশি আত্মবিশ্বাসী।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম। আমার এই বিরক্তিই আমাকে বুঝিয়ে দিল যে, কোনো কোনো মুহূর্তে আমি এদের সকলকে পরমাত্মীয় বলে মনে করলেও এই জঙ্গলের ওরা আর আমরা যে আলাদা এ-কথাটা প্রায়ই সোচ্চার হয়ে ওঠে।
মনে মনে ঠিক করে ফেললাম যে, কালকের দিনটা থেকে তার পরদিনই চন্দনীকে নিয়ে বিড়িগড়ে ছেড়ে দিয়ে আসবো।
আমার বিরক্তি চন্দনী বুঝেছিল।
একটু চুপ করে থেকে বলল, চলে যাব আমি? তোমাকে বিরক্ত করলাম?
মনে মনে বললাম, বিরক্ত তো বিলক্ষণই করলে। কিন্তু ভদ্রলোকের মতো মুখে বললাম, না, যাবে কেন? থাকো।
চন্দনী চুপ করে রইল।
আমি বললাম, তুমি নিজে যাও না একবার চন্দ্রকান্তর কাছে। এত কাছে রয়েছ, দেখাও হল একবার, মিটমাট করে নাও না তোমরা। আমাকে ছুটি করে দাও।
চন্দনী চকিতে মুখ তুলে চাইল। বুঝলাম ও আমার কথার মর্মাহত হল। ওর দু-চোখ ভরে জল এল। বড় বড় আইল্যাশ্ ভিজে ভারি হয়ে গেল।
অনেকক্ষণ পর ও আস্তে আস্তে বলল, তোমাকে তো সব বলেইছিলাম তবুও টিকড়পাড়া থেকে আনলে কেন আমাকে? কি দরকার ছিল তোমার?
আমি বললাম, তুমি চিঠি লিখলে; লিখলে, তোমার বড় বিপদ! তাই-ই তো দৌড়ে এলাম। এসে কি অন্যায় করেছি?
চন্দনী বলল, না! ন্যায় করতেই এসেছিলে হয়তো, কিন্তু যেটা করলে সেটা অন্যায়। তুমি এসে আমাকে অনেক বেশি অপমান করলে। এর চেয়ে যেখানে ছিলাম, সেখানে কম অপমানে ছিলাম।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তাহলে যা করেছিলে তা বেশ খুশি মনেই করছিলে বলো? তাহলে আর স্বামীর উপরে রাগ করা কেন?
চন্দনী জল-ভেজা চোখের চাবুক মেরে আমাকে ধমকে বলল, চুপ করো তুমি যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বোলো না। তুমি আমাকে বোঝনি একটুও।
আমি বললাম, না-বোঝার কি আছে? এই তো সীতা কেমন চলে গেল। তোমরা মেয়েরা তো ঐ রকমই। নিমকহারাম তোমরা। তোমরা বিশ্বাসঘাতক!
চন্দনী কাঁদতে কাঁদতে হেসে উঠল। বলল, তুমি যে কিছুই বোঝোনি, সীতাকে অথবা আমাকে, এ-সব কথা তারই প্রমাণ।
আমি শুধোলাম, সীতা তাহলে গেল কেন? শক্ত শরীরের লোভে যায়নি কি?
চন্দনী দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, না!
-তবে কেল কেন?
-অন্য কারণে।
-তা তো বুঝলাম, কিন্তু কারণটা কি?
চন্দনী ঝাঁঝালো গলায় বলল, কারণটা কম্ফু ভাই সীতাকে কোনোদিনও একটি মেয়ে বলেই মনে করেনি। তার কাছে তার জড়ি-বুটি,তার যশ, তার জগৎ অনেক বড় ছিল। সীতাকে কম্ফুভাই রান্না করবার, কাঠকুড়োবার ছেলে-বিয়ানো ও ছেলে- পালার একটি যন্ত্র হিসেবেই দেখেছিল। ও বেচারীও যে একটা মানুষ, ও-ও যে একটু আদর চায়, সহানুভূতি চায়, ওদের ঐ ঝুড়ির মধ্যে সীতারও যে একটা বড় ভূমিকা ছিল সেটা তার স্বামী কখনও স্বীকার করেনি। এই অপমানেই সীতা চলে গেল। আমিও ঠিক সে কারণেই ফিরে যাবো না চন্দ্রকান্তর কাছে
এত কথা এই ভাষায় বলেনি চন্দনী। বলেছিল ওর স্বভাবসিদ্ধ, নরম, সংক্ষিপ্ত কাটা-কাটা কথায়। কিন্তু মূল কথাটা এই।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি বলছো, তাহলে ঐ জোয়ান ছেলেটার সঙ্গে ওর শক্ত শরীরের জন্য যায়নি সীতা?
চন্দনী আমার দিকে চেয়ে বলল, শোনো, তুমি যে শক্ত শরীরের কথা বার বার বলছ তার চেয়ে ভুল আর কিছুই নেই। তোমরা এই বিশ্ব সংসারের পুরুষরা শুধু একটা জিনিসই বোঝো। ঐ গাল-পোড়া বেঁটে-বাঁটকুল বেনেটার মতো। তোমরা ভাবো যে, আমরা শুয়োরী। আমরা ঐ একটি জিনিস পেলেই বুঝি সুখী থাকি; খুশি হই। তোমরা পুরুষরাই এসব গল্প বানিয়েছ, প্রচার করেছ যে, ঐ একটি জিনিসের জন্যে আমরা তোমাদের খোঁটায় বাঁধা অথবা তোমরা আমাদের। এর চেয়ে বড় ভুল আর নেই।
চন্দনীর কাছ থেকে আমি এসব কথা এমনভাবে শুনবো বলে ভাবিনি। ওর কথা শুনে, ওকে উত্তেজিত দেখে, (উত্তেজিত অবস্থায় বোধহয় সবচেয়ে সুন্দর দেখাল ওকে) আমার বিরক্তি উধাও হয়ে গিয়ে বড় কৌতূহল হল।
আমি বললাম, বেশ! মানছি যে, আমি ভুল বুঝেছি, এবং আমরা পুরুষরা পাজী, বোকা, সব। কিন্তু তুমি এও তো বলবে যে, কী তাহলে চাও তোমরা পুরুষদের কাছ থেকে? ঠিক কোন জিনিসটা চাও?
চন্দনী বলল, বলব না, বলব না; বলব না।
তারপর একটু থেমে বলল, আস্তে আস্তে স্বগতোক্তির মতো অনেক কথা যা বলল, ওর ভাষায় তার সারার্থ হল, আমরা তোমাদের মতো স্থূল নই। কোনোদিনও আমরা মুখ ফুটে বলব না কি চাই আমরা তোমাদের কাছ থেকে। যদি বুঝতে পারো, তো পারলে। না পারলে তো আমরা একদিন তোমাদের আত্মমগ্নতায়, উচ্চম্মন্যতায়, তোমার স্বার্থপরতায় থুথু ফেলে তোমাদের আশ্চর্য করে দিয়ে সীতার মতো হঠাৎ হঠাৎ চলে যাই। তোমরা ভেবে ভেবে কূল পাওনা কেন গেলাম। তোমাদের অজ্ঞাতে আমরা অন্যর দেওয়া ছেলেকে বুকে করে মানুষ করি। কম্ফু ভাই যখন কুশকে আদর করতো, তখন সীতার মুখে একটা প্রচ্ছন্ন কৌতুক দেখতাম, একটা চাপা ঘৃণা। আজকে বুঝলাম, কেন?
একটু থেমে দম নিয়ে বলল, শুনে রাখো। আমরা এও পারি। আমরা সব পারি। ভালোবাসতে পারি, ঘেন্না করতে পারি, প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে পারি। আমাদের অবলা বলে কখনও ভেবো না।
আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম। চন্দনীর এই বক্তৃতায় রীতিমতো অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।
আবহাওয়ার মোড় ঘুরাবার জন্য বলাম, এমন সুন্দর চাঁদনী রাতে এমন সব ঝগড়া-ঝগড়ি কি ভালো? তার চেয়ে বরং কি করে তোমাদের আদর করতে হয়, কেমন করে আদর করলে তোমরা সবচেয়ে খুশি হও, তাই একটু বালো। আমার অবস্থাও যেন কখনও চন্দ্রকান্ত বা কম্ফুর মতো না হয়, তার জন্যে একটু সাবধান হয়ে থাকা তো দরকার।
চন্দনী হেসে ফেলল।
তারপর বলল, বলব না। আমি কেন? কোনো মেয়েই তোমাকে বলবে না কখনও। তার চোখ চেয়ে তার মন বুঝে নিতে হবে তোমার। দু-একজনই তা পারে; সবাই পারে না।।
আমি বললাম, তাই-ই যদি হয়, তাহলে লক্ষ-লক্ষ স্বামী-স্ত্রী সুখে ঘর করছে কি করে?
চন্দনী হাসল। বলল, সুখে ঘর করছে তা তোমাকে কে বলল; ঘর করাটা একটা অভ্যাস—সময়ে চান করার মতো, নিমের ডাল ভেঙে দাঁতন করার মতো—অভ্যাসের মধ্যে সুখটা কখন মরে যায় তা কেউ জানতেও পায় না। হয়তো জানতে চায়ও না ভয়ে। তাছাড়া সীতার উপায় ছিল না, আমাদের অনেকেরই উপায় থাকে না।
বললাম, কেন উপায় ছিল না কেন? থাকে না কেন?
চন্দনী রেগে বলল, তোমাদের মতো শরীর দেয়নি যে ভগবান আমাদের—আমাদের রোজগারের সোজা ও সুস্থ উপায় দেয়নি। আমরা যদি একবেলা দুমুঠো ভাতের জন্যে তোমাদের উপর নির্ভর না করতাম, তাহলে কবে কত শত মেয়েরা ছেড়ে চলে যেত তাদের স্বামীদের। গলায় মালা পরালেই কি স্বামী হওয়া যায়? এক ঝুপড়িতে শুলেই, ছেলেমেয়ের বাবা হলেই কি একজন নারীকে একজন পুরুষ সম্পূর্ণভাবে পায়? আমরাও তো মানুষ। আমাদের মনের উপর যাদের দখল নেই, তারা শরীরের দখল নিয়ে একটু খেতে দিয়ে, একটু পরতে দিয়েই বড়াই করে। তোমরা ঐটুকুই বোঝো—বাকিটা কখনও বোঝোনি, বুঝবেও না।
বলেই দুমদুম করে পা ফেলে চন্দনী ঝুপড়িতে ঢুকে গেল।
অনেকখানি হাঁটাহাঁটি করায় সেদিন বেশ ক্লান্ত লাগছিল। কিন্তু কিছু খাইনি বলে শোওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম আসেনি। ঘুম যখন এল, তার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নও এল। স্বপ্নই আগে এল, না ঘুম বলতে পারি না। অবচেতন থেকে চেতনাহীনতায় গড়িয়েই তারা আসে। তাই দুজনে একসঙ্গেও এসে থাকতে পারে।
আমি দেখলাম, সেই বধ্যভূমি বারিরি মালভূমিতে আমি আর চন্দ্রকান্ত বসে আছি। চন্দ্রকান্তর পরনে একটা মোটা ধুতি। গায়ে একটা নীলরঙা কাঁধ ছেঁড়া শার্ট।
চন্দ্রকান্ত একটা পাথরের উপরে বসে সামনের উন্মুক্ত বন-জ্যোৎস্নায় ভিজে সুপসুপ করা প্রান্তরে চেয়ে আছেন। চতুর্দিকের সেগুন বনে চাঁদ পড়ে পিছলে যাচ্ছে। সেগুনের পাতার ভিতর দিকটা সাদাটে। ভিতরের দিকে যেখানে যেখানে আলো পড়ছে সেখানে কেউ যেন রুপো গলিয়ে ঢেলে দিয়েছে মনে হচ্ছে।
চন্দ্রকান্ত বললেন, ওসব কথা শুনবেন না, ওসব মেয়েদের কথা। ওরা, ওরা; আমরা, আমরা। মানুষের ইতিহাসের প্রথম দিন থেকে পুরুষকে হাতছানি দিয়েছে দিগন্ত। পুরুষই ডাইনোসরের সঙ্গে পাথরের হাতিয়ার নিয়ে যুদ্ধ করেছে। এক জায়গা ছেড়ে গিয়ে অন্য জায়গায় ঘর বেঁধেছে। এক নারী ছেড়ে অন্য নারীতে। পুরুষের রক্তে স্থিতি নেই; ঘর নেই। নারীই ঘর বেঁধে পুরুষকে ঘরের চার দেওয়ালে বন্দী করে রেখেছে তার মোহন ললিতলীলায়, তার চোখের বিলোল চাউনিতে, তার মিষ্টি গলার স্বরে, তার গ্রীবা হেলনের মনোরম ভঙ্গীতে, তার বেশবাসে, তার কেশ পরিপাট্যে, তার নরম সুরেলা শারীরিক বিশেষত্বে পুরুষকে চিরদিন কাছে রেখেছে।
পাছে পুরুষ তাকে ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যায়, তাই তার মধ্যে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য সমস্ত সুরের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছেন বিধাতা। মানুষ বাঁধা পড়েছে। নারীর মধ্যে দিয়ে নিজেকে নিরন্তর পুনরুজ্জীবিত করেছে, পুরুষের রক্ত ছিনিয়ে নিয়ে নারী তার নিজের জরায়ুতে তাকে শুদ্ধ করে, তাতে মন্ত্র পড়ে, তার রক্তের শরিক সৃষ্টি করেছে। সে যখন জরাগ্রস্ত যৌবনহীনা হয়েছে, নারী নিজে যখন তার নিজের কারণে নিজের লোভনরূপে পুরুষকে বাঁধতে পারেনি—যখন প্রেমে পারেনি—তখন অপত্য স্নেহের অমোঘ রজ্জু জড়িয়ে দিয়েছে পুরুষের পায়ে, যেমন করে পুরুষ বুনো ঘোড়া ধরেছে, তেমন করে লাস্য দিয়ে পুরুষকে ধরেছে নারী।
একটু চুপ করে থেকে চন্দ্রকান্ত আবার বললেন, এ এক গভীর ষড়যন্ত্র।
আমি স্বপ্নের মধ্যে হাসলাম, সে হাসি আমিই শুধু শুনতে পেলাম, আর কেউ নয়। বললাম, নারী কি পুরুষের পরিপূরক নয়? কী এমন ক্ষতি করল নারী আপনার? মানে, পুরুষদের?
—করেছে, করেছে, বিলক্ষণ ক্ষতি করেছে। নারী বাঁধন, পুরুষ মুক্তি। একজনের জীবনের মূলমন্ত্র পরাধীন হয়ে থাকার ছলে পুরুষকে পরাধীন করা আর পুরুষের জীবনের মূলমন্ত্র সব পরাধীনতার বাঁধন ছিঁড়ে স্বাধীন হওয়া।
আমি বললাম, ব্যাপারটা বড্ড বেশি অ্যাকাডেমিক। বুঝতে পর্যন্ত পারছি না আমি।
স্বপ্নের চন্দ্রকান্ত হাসলেন। বললেন, পারবেন না।
আমি বললাম, আপনি এমন বাঁধনছেঁড়া, ঘরবিদ্বেষী, বুনো হয়ে উঠলেন কি করে? বিড়িগড়েও তো ঠিক এমনটি দেখিনি আপনাকে। তখনও সাধারণ গৃহী- জীবনের প্রতি, চন্দনীর প্রতি, আপনার একটা আকর্ষণ ছিল, যতই তা ক্ষীণ হোক না কেন?
সে কথা এখন থাক্। তারপর বললেন, পুরোনো দিনে তো ঘোড়াই ছিল শক্তির মান। সেযুগে নিউক্লিয়ার পাওয়ার ছিল না, অন্য অনেক কিছুই ছিল না। তাই সমস্ত শক্তির মূল্যায়ন করতো মানুষ তখন অশ্বশক্তি দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের একটা দারুণ গল্প পড়েছিলাম, ঘোড়ার সৃষ্টির উপরে। পড়েছেন?
—না তো! আমি বললাম।
চন্দ্রকান্ত হাসলেন। বললেন, অথচ আপনি বাঙালি। রবীন্দ্রনাথের গর্বে আপনারা ফুলে ফেঁপে থাকেন, অন্যদের হেয় করেন, অথচ তাঁর লেখা পড়ার অবকাশ পর্যন্ত হয় না আপনাদের।
আমি লজ্জিত হলাম।
চন্দ্রকান্ত কথা ঘুরিয়ে বললেন, সৃষ্টি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে যখন, তখন সৃষ্টিকর্তা দেখলেন প্রচুর মালমশলা বেঁচে গেছে। ক্ষিতি, মরুৎ, ব্যোম, অপ্ ইত্যাদি বহু উপাদানের মধ্যে ব্যোম্ রয়ে গেছে বেশি। তাই দিয়েই তলানী-টলানী ঢেলে-ঢুলে সৃষ্টি করলেন ঘোড়াকে। তার মধ্যে ব্যোম্ই সবচেয়ে প্রবল ছিল বলে কারণে- অকারণে সে মাথা উঁচু করে ঘাড় বেঁকিয়ে প্রান্তরের পর প্রান্তর দৌড়ে যায়। তার কেশর ওড়ে হাওয়ায়, তার বুকে মুখে হাওয়া লাগে, তার নাকে শোঁ শোঁ করে উদার বাতাস ঢোকে, সূর্যকিরণে তার চিকণ চামড়া ঝক্ক করে ওঠে, তার পেশীতে ঢেউ জাগে ছলাৎ ছলাৎ করে—সে তবু দৌড়োয়। কোনো গন্তব্যের জন্যে নয়, বাঁধা থাকতে যে সে ভালোবাসে না সেই জানাটা পৃথিবীময় জানান দেওয়ার জন্যে সে দৌড়ে বেড়ায়।
আমি বললাম, খামোখা দৌড়ে লাভ কি? গন্তব্যহীনতা তো মৃত্যুরই সমকামী।
চন্দ্রকান্ত বললেন, আপনি বুঝবেন না। যারা দৌড়োয়, যারা বাঁধন ভাঙে, স্বাধীনতার স্বাদে যাদের মন ভরেছে, তারাই শুধু এ দৌড়ের মজা জানে। পরাধীন গৃহপালিত দয়ানির্ভর জন্তু যেমন জানায় মুখ ডুবিয়ে দ্রুত-ধাবমান স্বাধীন ঘোড়ার খুরের শব্দে তাদের নির্বোধ ভাবালু চোখ তুলে বোকার মতো তাকায়, তেমন অনেক মানুষও তাকায় ঐ স্বল্প সংখ্যক দৌড়ে-বিশ্বাসী মানুষগুলোর দিকে। ওরা ওদের বড় ভালোবাসে। ওদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, ওদের ঘৃণাভরা স্বাচ্ছল্য, ওদের গলার দড়িকে ওরা বড় ভালোবাসে। ওরা যেন-তেন-প্রকারেণ একটু খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে চায়। ইজ্জৎ বা স্বাধীনতার বোধ ওদের কখনও ভাবায় না। ওরা মন্থর, লজ্জার, গ্লানির, ওদের বড় সুখের জীবনে, চোখ রাঙানির ভয়ে, লাঠির ভয়ে চুপ করে থাকে। ঐ পুরুষগুলো গৃহপালিত বা রাষ্ট্রপালিত বলদ। এবং আমি আর আমার মতো কতিপয় নষ্ট লোক বুনো ঘোড়া।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, ওরা যা কিছু পেয়েছে জীবনে, নিজেদের গায়ে আঁচড়মাত্র না লাগিয়ে, নিজেদের স্বার্থপর ভীরুতার দুর্গন্ধি বালাপোষে মুড়ে রেখে, তা এই মুষ্টিমেয় লোকদেরই জন্যে। আমার মতো লোকদের আপনারা মূর্খ বলেছেন,বলেছেন বিকৃতমস্তিষ্ক, বলেছেন দায়িত্বজ্ঞানহীন, কিন্তু আমাদের জন্যেই, আমাদের কষ্টের ও পাগলামির মূল্যেই আপনাদের মতো ক্ষুদ্র গৃহী, আত্মসম্মানজ্ঞানহীন, সুখ-সন্ধানী লোকেরা দিনে দিন পুষ্ট হয়েছেন। আমরা যখন হিমেল বাতাসে উত্তুঙ্গ গিরিশৃঙ্গে আপনাদের সুখ ও শান্তির সীমানা পাহারা দিয়েছি সভ্যতার ইতিহাসের প্রথম থেকে—আপনারা স্ত্রী বা প্রেমিকার বুকে ঘন হয়ে, রুদ্ধ ঘরের আরামে রাত কাটিয়েছেন। আপনারা আমাদের কথা বুঝবেন না। বোঝার চেষ্টাও করবেন না কখনও। কারণ বোঝার চেষ্টাটুকুতেও আপনাদের শান্তি বিঘ্নিত হবে। আপনারা যে পোষা পাখি। ঝড়ের বাতাসকে আপনাদের যে বড় ভয়। কিন্তু আমরা যে ঝড়েই বার বার ডানা ভেঙে পড়েছি, আমরা গুলিবিদ্ধ হয়েছি, ধরে ধরে আমাদের ডানা কেটে দেওয়া হয়েছে কতবার, বিচার বা ন্যায়ের প্রহসনে প্রহসনে হাসতে হাসতে এমন পর্যায় এসেছি যে, তাকিয়ে দেখুন আমাদের চোয়াল ফাঁক হয়ে আছে। চোয়াল-ফাঁক জীবন আমাদের; আমাদের শবের। প্রচণ্ড প্রাণসত্তায় আমরা তবু দৌড়ে গেছি, অন্যায়ের, অবিচারের, গ্লানির, পরাধীনতার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছি। আমরা যুগে যুগে মরেছি; কিন্তু আমাদের রক্তবীজ এই ধরিত্রীর বুকে ছড়িয়ে গেছে। লক্ষ মধ্যে এক। একজন মাথা তুলেছে লক্ষর মধ্যে। তার শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। আবার অন্য কেউ তার স্থান পূরণ করেছে। আমরা কচুরীপানার জাত। আমাদের শেষ নেই, জরা নেই, মৃত্যু নেই। আমরা আত্মার মতো অবিনশ্বর, আগুন আমাদের পোড়াতে পারে না, বন্দুকের গুলি আমাদের রক্তাক্ত করে, মৃত করে, কিন্তু কখনও বিদ্ধ করে না। আমরা ধ্বংস হই, কিন্তু হারি না কখনও। কারণ আমরা মানুষের প্রকৃত স্বরূপ। আমরাই সবচেয়ে আগে আগে যাই যে কোনো শোভাযাত্রায়। আমরা লড়াই করি, যুদ্ধ জিতি, প্রতিবাদ করি, স্বাধীন গ্রীবা তুলে, শির উঁচিয়ে দাঁড়াই। আপনারা ভয়ে, মুখ ঢাকেন, দুয়ার বন্ধ করেন, তারপর আমরা যা চেয়েছিলাম তা অর্জন করলে আপনারাই এগিয়ে বসে তার সিংহভাগ নেন। ভালো জামাকাপড় পরে আপনারা আপনাদের কাপুরুষের হৃদয় ঢেকে গাছেরটাও খান, তলারটাও কুড়োন। আপনারা চিরিদিনই তাই করে এসেছেন। ঘেন্না, ঘেন্না, আপনাদের ঘেন্না, বড় ঘেন্না আমার।
এতকথা একসঙ্গে শুনে আমি বোধহয় আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বললাম, কিন্তু কি আপনি করতে চান? গাছের টঙে বসে নিজের স্ত্রীকে অপমানের মধ্যে অসম্মানের মধ্যে নিক্ষেপ করে কিসের সাধনা করছেন আপনি?
চন্দ্রকান্ত হাসলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। বললেন, কিছুই করছি না। ভাবছি! কি করব, কি করা উচিত তাই ভাবছি।
–কাদের জন্যে কি করা উচিত?
-সকলের জন্যে। এই নারাণ, কম্ফু, কালিন্দী, যুধিষ্ঠির, এই রত্নাকর, চন্দনী, এমনকি আপনারও জন্যে। আপনার এবং ওদের সকলের দৃষ্টি আচ্ছন্ন, ঘোলা। আপনাদের দৃষ্টি শুধু দিগন্ত অবধিই বিস্তৃত। আমার দৃষ্টি দিগন্তকে ছাড়িয়ে যায়। আমার সোনার ভারতবর্ষকে সোনার মানুষে ভরে দিতে চাই আমি। মানুষের মতো মানুষে। যারা শ্রমবিমুখ নয়, যারা শৃঙ্খলাবদ্ধ, যারা সাহসী, যারা স্বাধীন, যারা সৎ, যারা পৃথিবীর সব জাতের সেরা জাত সেই ভারতীয়দের জন্যে। আমার কোনো দল নেই, ইজম্ নেই, গদী নেই, তার জন্যে কাঙালপনা নেই, আমি শুধু চাই যে, আমাদের নেতারা সত্য হোক, সুন্দর হোক, তারা যেন শুধু ভঙ্গী নিয়ে না ভোলায় চোখ। সব নেতারা। সব দলের নেতারা।
আসলে এরা কেউ কম্ফু নারাণ চন্দনীদের নেতা নয়। এরা আপনাদের নেতা। আপনারা এবং আপনাদের নেতারা আমাদের কেউ নন। আমাদের কথা আপনারা কেউই ভাবেন না। ভাবেননি কোনোদিনও। আপনারা বড় ইতর, নীচ, বড় ভণ্ড।
আমি বললাম, এই বাঘ-ভাল্লুকের জঙ্গলে বসে এসব কথা ভাবলেই কি আপনি কিছু করতে পারবেন? আপনার দল কই? প্রচারক কই? কে আপনার কথা শুনবে? কে চেনে আপনাকে?
কেউ শুনবে না, কেউই চেনে না আমাকে। কিন্তু আমার ভাবনা অন্যদের ভাবতে শেখাবে। কম্ফুকে, নারাণকে, চন্দনীকে এমনকি আপনাকেও। আমার ভাবনার রেশ অন্যের মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যাবে। আপনাদের মধ্যে যদি সকলেই ভাবেন, নিজের নিজের স্বার্থ একটু মাত্র ক্ষুণ্ণ করে নারাণ কম্ফুদের কথা একবারও ভাবেন, তাহলেই আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। আপনাদের ঘুম-পাড়ানো বিবেক ঘুম ভেঙে উঠবে, চোখ মেলে চাইবে, এই-ই আমার একমাত্র কামনা, বাসনা, যাই-ই বলেন সব।
আমি বললাম, আপাতত আপনি কি করতে চান?
—আরেকটা হাতী মারতে চাই। চন্দ্রকান্ত হেসে বললেন।
আমি বললাম, এ জঙ্গলে তো হাতী নেই।
—না, হাতী নেই। কিন্তু ভয় আছে। ঐ গুণ্ডা হাতীটারই সে সমগোত্রীয়। ছবি নায়েক। লোকটা আমার এই আপনজনদের বুকের মধ্যে ভয় সেঁধিয়ে দিয়েছে। বুঝলেন মশায়। যে বুকের মধ্যে ভয় নিয়ে বাঁচে সে মরে গেছে। নিশ্বাস ফেলা আর প্রশ্বাস নেওয়ার মানেই বেঁচে থাকা নয়! আমি ওদের বাঁচতে শেখাবো। চীনা দার্শনিক কনফ্যুসিয়াস বলেছিলেন :
If you pay evil with good, what do you pay good with?
আমি সে কথায় বিশ্বাসী। ঐ গাল-পোড়া বেনেটাকে ওদের চোখের সামনে মেরে আমি ওদের জানিয়ে দেবো যে, পৃথিবীতে ভয় পাওয়ানোর মতো কিছু নেই মানুষকে। কোনো রক্ত-চোখ, কোনো বন্দুকের নল, কোনো শারীরিক বা অর্থনৈতিক অত্যাচারই শেষ কথা নয়। ওদের নিজেদের জন্যে, ওদের উত্তরসূরীদের জন্যে, মাথা তুলে ওদের দাঁড়াতেই হবে। তা নইলে, ওদের চিরদিনই আজকের মতো আফিং গোলা জল খেয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
আমি বললাম, কিন্তু আপনার যে জেল হবে, ফাঁসি হবে।
হোক না। চন্দ্ৰকান্ত বললেন।
তারপর বললেন, আমার জীবনে আছেটা কি? আমি ফাঁসিতে ঝুলে কি জেলে গিয়েও যদি ওদের এই দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারি, যদি ওদের সামনের দিকে কিছুটাও এগিয়ে দিতে পারি, তাহলেও তো জানব, জীবনে কিছু একটা করে গেলাম। শুধুই টাই পরে অফিস গেলাম না আপনাদের মতো, শুধুই নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, নিজের চাকরির উন্নতি, নিজের আরাম নিয়ে নরকের কীটের মতো সব মান-সম্মান স্বাধীনতার বোধ বিসর্জন দিয়ে তবুও শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যেই বেঁচে থাকলাম না। আপনারা যে বাঁচা বাঁচছেন তাকে কি বেঁচে থাকা বলে? এই আপনারা, চাকরি বা ব্যবসা করছেন, টাকা কামাচ্ছেন, বিয়ে করছেন, ছেলে মেয়ের বাবা হচ্ছেন, বুড়ো হচ্ছেন, বাতে কোঁকাচ্ছেন, তারপর একদিন পৃথিবী থেকে নিশ্চুপে মাথা নীচু করে চলে যাচ্ছেন। এই দেশটাকে শুধু আপনার উত্তরসূরীই নয়, সকলের উত্তরসূরীর জন্যেই কি আরো একটু ভালো দেখে যাওয়া, কিছুমাত্র অবদান রেখে যাওয়া আপনার কর্তব্য নয়? কেন এত লেখাপড়া শিখলেন? দৈনিক কাগজে লেটারস টু দ্য এডিটরস্ কলামে বাংলার বা ইংরিজির তুবড়ি ছুটোবার জন্যেই শুধু? আপনাদের শিক্ষার কি আর কোনোও উদ্দেশ্যই ছিল না? শিক্ষা মানে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছাপ মারা কাগজ শুধু?
তারপর একটু থেমে বললেন, শুনেছি, ঐ গাল-পোড়া বেনেরও তেমন একটা কাগজ আছে।
আমি চুপ করে থাকলাম। কি বলব ভেবে পেলাম না।
স্বপ্ন অথবা ভাবনা ভেঙে গেল শেষ রাতে অনেকগুলো কুকুরের চিৎকারে। কুকুরগুলো ক্যাম্পের চারপাশে ঘেউ ঘেউ করে ডাকছিল। কয়েকজন লোক কথাবার্তা বলছিল।
বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে এলাম।
ক্যম্পের সামনে বড় আগুনটা নিভু নিভু হয়ে এসেছে। চাঁদনী রাতেও একটা আগুন থাকেই জঙ্গলে—পাছে জন্তু-জানোয়ারেরা চলে আসে ভুল করে। দেখি, ক্যাম্পের সকলেই প্রায় উঠে পড়েছে, উঠে বারিরির দিকে যে পাকদণ্ডী পথটা চলে গেছে সেদিকে আঙুল দেখিয়ে কি যেন বলেছ।
বুনো কুকুরের দল ক্যাম্পের চারদিকে নেমে আসেছে বারিরি বেয়ে। ভয়- পাওয়ানো গলায় অদ্ভুত কুঁই কুঁই আওয়াজ করছে। এমন সময় একটা একলা মাদী চিতল হরিণ অর্গুন ঝোপের আড়াল থেকে সোজা নেমে এলো হড়হড় খর্খর আওয়াজ করে পাথরে পাথরে একেবারে ক্যাম্পের সামনে। ক্যুপ্-কাটা কুলীরা হৈ- হৈ করে ওঠায় হরিণীটা একবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কি যেন ভাবল হরিণীটা। তারপর কুকুরগুলোর চেয়ে মানুষগুলো কম বেপরোয়া ভেবে মানুষগুলোর দিকেই এগিয়ে এল।
বুনো কুকুরগুলো চতুর্দিকে লাফালাফি করতে লাগল। মুখের খাবার পালিয়ে যাওয়ায় ক্ষুধার্ত হিংস্র স্বরে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল। তাদের সম্মিলিত ডাক পাহাড়ে-পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে সারা বনে ছড়িয়ে যেতে লাগল প্রতিধ্বনি তুলে।
রত্নাকর হঠাৎ বলল, মার্ এটাকে। সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে না। মাংস ভাল—কচি আছে।
নারাণ হঠাৎ চটে উঠে বলল, রক্ষক হয়ে ভক্ষক হতে নেই। দীনবন্ধু পাপ দেবেন তাহলে।
রত্নাকর হাসল। যার হাসি কুকুরগুলোর চিৎকারের সঙ্গে মিশে গেল। বলল, ছাড় তোর দীনবন্ধু।
মনে হল, দীনবন্ধুর ভরসাতে রত্নাকরের আর দরকার নেই। ওর জমি-জমা আছে, টাকা আছে, সাইকেল আছে, পাকা ভবিষ্যৎ আছে; ও কেন এই হতভাগাগুলোর মতো দীনবন্ধুর ভরসায় থাকবে। ও বলল; আন; টাঙ্গী আন।
কুলীরা সকলেই লোভাতুর মাংসলোলুপ চোখে হরিণীটির দিকে তাকাল, তারপর কি হল, কে জানে, সকলে মিলে রত্নাকরকে বলল, না এটা অন্যায় কাজ হবে। ওকে মারা ঠিক হবে না।
হরিণীটা এতক্ষণ তার বড় বড় ভয়াতুর চোখ মেলে মানুষগুলোর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল। সোজা বারিরি বেয়ে পাকদণ্ডীতে নেমে এসেছে বোধহয় ও। তখনও ওর সামনে পা দুটো, বুকের সামনেটা থরথর করে কাঁপছিল! বুনো কুকুরগুলো বধ্যভূমিতে ধাওয়া করে ওকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে চেয়েছিল।
হরিণীটা এবারে বসে পড়ল। কুকুরগুলো অনেকক্ষণ চারিদিকে বসে ডাকল, লাফালাফি করল তারপর হরিণী আমাদের আশ্রয় পেয়েছে দেখে চলে গেল। কুকুর তো কুকুরই। মানুষ না হলেও মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসম্পন্ন জীবকে ওরা মানুষ বলেই মনে করে, ভুল করে ভয়ও পায়। কুকুররা সব সময়ই ভয় পায়।
আমি গিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।