লবঙ্গীর জঙ্গলে – ৬

অনেক বেলা অবধি ঘুমিয়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙল, দেখি চন্দনী নেই। মেঘ সরে গেছে। বৃষ্টি-ধোওয়া গাছ-পালায় সকালের রোদ ঝক্‌ক্‌ করছে। বাইরে নানা লোকের গলা শোনা যাচ্ছে। ক্যুপ্-কাটা কুলীদের আজ হাজ্রীর দিন। রত্নাকর কখন এসেছে জানি না। এখন একটা পাথরে বসে টিপ সই দিয়ে সকলকে হপ্তা দিচ্ছে। আজ হাট আছে তিন ক্রোশ দূরে। রোজ পেয়ে সকলে হাটে যাবে। নুন কিনবে। তেল কিনবে, সামান্য কেরোসিন এবং সর্ষে, আফিং-এর গুঁড়ো, একটু শাকসবজি। মেয়েরা নিম করৌঞ্জের তেল, লাল-নীল ফিতে। শাড়ি ছিঁড়ে গিয়ে থাকলে শাড়ি। ছেলের গামছা। শাড়ি গামছা বছরে একবারের বেশি কিনতে পারে না ওরা।

দেখি, চন্দনী কাচের গ্লাসে করে চা এনে দাঁড়িয়েছে। চন্দনীকে সবসময়ই সুন্দর দেখায়। ঘুম ভেঙে, ঘুমন্ত অবস্থায়, দুপুর, সন্ধে সবসময়।

বলল, কাল রাতে আসতে ভিজেছো বৃষ্টিতে, আদা দিয়ে চা বানিয়েছি। ওঠো, চা খাও।

চা নিয়ে, গায়ে চাদর জড়িয়ে বাইরে এলাম।

বললাম, চল, আমিও আজ হাটে যাব। হাট পর্যন্ত জিপ যাবে?

ওরা সকলে খুব খুশি হল। বলল, জিপ রেখে হাঁটতে হবে কিছুটা।

বললাম, ঠিক আছে।

রত্নাকর তাচ্ছিল্যর গলায় বলল, আপনি আবার এ-হাটে কি কিনতে যাবেন? এ হাটে ভদ্রলোকরা যায় না।

ও যে ভদ্রলোক, তা একাদশ-ফেল রত্নাকর বিশেষভাবে জানে।

আমি বললাম, আমি যে ভদ্রলোক তা জানলি কি করে তুই?

রত্নাকর বলল, কি যে বলেন, তার ঠিক নেই।

রত্নাকর এসব হাটে যায় না। ওখানে বন-জঙ্গলের ঠিকাদারদের ক্যুপ্‌-কাটা কুলীদের ভিড়। ওখানে শ্রেণী-সচেতন মহুরীরা যায় না। নারাণ কালিন্দীদের মতো কাউকে পাঠায়।

চন্দনী বলল, নারাণদা তাড়াতাড়ি ভাত চাপাও। খেয়ে-দেয়ে যাবে তো?

-হ্যাঁ! হ্যাঁ! নারাণ বলল। তাড়া কিসের? নারাণ যতক্ষণ না খাবে, হাট উঠবে না ততক্ষণ। বসবেও না।

বেলা দশটা বাজে। এবার নালার উপরে গিয়ে প্রাতঃকৃত্য ও চানটান সারতে হয়। এমন সময় হঠাৎ একটা জিপ আসতে দেখা গেল। এত লোকের গণ্ডগোলে এতক্ষণ শব্দটা কানে আসেনি কারো।

জিপ থেকে একজন দারোগা ও ফরেস্টার নামলেন। দারোগার চোহারাটা কচ্ছপের মতো। খাদ্য-পানীয় ও বিনা আয়াসের রোজগারে লোকটা তামসিকতার এক স্থূল দৃষ্টান্ত হয়ে গেছে। ফরেস্টারের চেহারা সাত্ত্বিক-সাত্ত্বিক; ফর্সা, রোগা, ছিপছিপে ভালোমানুষ মুখ।

ফরেস্টার বললেন, এখানে কাল শম্বর মারা হয়েছে?

রত্নাকর অবাক হওয়ার স্বরে বলল, তাই নাকি? আমি জানি না তো? কাল আমি ছিলাম না সারাদিন।

কম্ফু মাটিতে বসে ওর সাপমুখো লাঠিটাতে কি যেন মালিশ করছিল। হঠাৎ দারোগা ওকে ডেকে বললেন, তোর নাম কি? কি করিস তুই?

কম্ফু ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমার নাম কম্ফু। জড়ি-বুটির বদ্যি আমি। বলদের চিকিৎসা করছি।

দারোগা বললেন, তুই কিছু জানিস?

—কি জানি? বলে, অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল কম্ফু।

—শম্বর মারা হয়েছে কিনা?

–তা কে না জানে? সকলেই তো জানে। সকলেই মাংস খেয়েছে। আমরা সকলে মিলেই মাংস ভাগ করে খেয়েছি।

—সে কথা বলছি না। কে মারল শম্বরটাকে? সেই কথা জানতে চাইছি। দারোগা বললেন।

কম্ফু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বোকার মতো মুখ করে বলল, ভগবানে মেরেছে বোধহয় আমাদের খাওয়ার জন্যে। কতদিন আমরা মাংসের মুখ দেখিনি। দেড়-দু-বছর।

—ভগবানে মেরেছে মানে? দারোগা চটে উঠে বললেন।

কম্ফু আবারও বোকা বোকা মুখ করে বলল, বাজ পড়ার আওয়াজ হল পাহাড়ের ওপর। দৌড়ে গিয়ে দেখি শম্বরটা মরে পড়ে আছে।

—ইয়ার্কি পেয়েছিস? দারোগা বললেন। গুলির শব্দ পাওয়া গেছে ছবিবাবুর ক্যাম্পেও। তুই বলছিস ভগবানে মেরেছে?

কম্ফু আবারও বলল, গুলি কি বাবু? আফিং-এর গুলি? সে তো নারাণ সকাল- সন্ধ্যা খায়। শব্দ তো শুনিনি কখনও।  

দারোগা বললেন, চল্, তোকে এক্ষুনি বেঁধে নিয়ে যাব। দারোগার সঙ্গে ফাজলামি! কার সঙ্গে কি করে কথা বলতে হয় জানিস না?

কম্ফু বলল, তা যা বলেছেন। ঐ জন্যেই সকলের সঙ্গে ঝগড়া হয় আমার সবসময়। আমার বউকে জিজ্ঞেস করুন। বলেই, হেই সীতা, বলে বউকে ডাক দিল।

নারাণ বলল, তোর বউ কি ঘরে আছে? জঙ্গলে গেছে।

—ওঃ। বলল কম্ফু। যেন নিরাশ হল সাক্ষীর অভাবে।

দারোগা বলল, কে মেরেছে না বললে এখানে যত লোক আছে সবাইকে বেঁধে নিয়ে যাব।

কম্ফু বলল, এক জিপে কি অত জায়গা হবে? তারপরই আমার দিকে ফিরে বলল, বাবুর জিপ নিলেও হবে না। দু-জিপেও না।

একটু থেমে বলল, বাবুকেও বেঁধে নিয়ে যাবেন না কি?

দারোগা বলল, বাবু-টাবু বুঝি না, সকলকেই বেঁধে নিয়ে যাব

এতগুলো লোকের সামনে আমাকেও বিনা কারণে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার কথায় আমার একটু অবাক লাগল। রাগও হল। গ্রামগঞ্জের লোকেরা এইরকম দারোগাকেই সরকার বা সরকারের প্রতিভূ বলে জানে। এই বাঁশবনে শেয়াল রাজা দারোগার এত আস্ফালন সহ্য হল না আমার।

আমি বললাম, আপনি অবান্তর কথা বলছেন।

দারোগা তখন আমাকেও চোখ রাঙিয়ে বলল, পুলিশের লোকে এমনি করেই কথা কয়, আমাকে সহবৎ শেখাবেন না, ধরে তাহলে সত্যিই নিয়ে যাব থানায় আপনাকে সহবৎ শেখাবার জন্যে।

আমি বললাম, তাহলে যদি বলি আমিই মেরেছি। আপনি কি আমাকে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন?

চোখের কোণে দেখলাম, কম্ফু নারদের মতো নড়ে-চড়ে বসল।

দারোগা এক হাঁক ছাড়লেন। দুজন হাফ-প্যান্ট পরা লাঠি হাতে পুলিশ এসে আমার সামনে দাঁড়াল।

দারোগা বললেন, অবশ্যই রাখি।

চন্দনী খুব ভয় পেয়ে গেল। ও দৌড়ে কম্ফুর পিছনে গিয়ে দাঁড়াল জড়সড় হয়ে।

দারোগা চন্দনীর দিকে তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টে।

আমি বললাম, এটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে। আপনার লোকদের এখান থেকে এক্ষুনি সরে যেতে বলুন। আপনি ভেবেছেন কি? কি ঠাউরেছেন নিজেকে?

আমার কথাতে পুলিশগুলো সরে গেল বটে কিন্তু দারোগা কোমরে হাত দিয়ে রিভলবার বের করতে গেলেন।

আমি মুখে আর কিছু না বলে কোমর থেকে পিস্তল খুললাম।

দারোগা হাত নামিয়ে নিলেন।

ফরেস্টার দারোগাকে কানে কানে কিসব বললেন।

আমি বললাম, ফের রিভলবারের ভয় দেখিয়েছেন তো খারাপ হবে।

দারোগা বললেন, আপনি দারোগাকে ধমকান। সাহস তো কম নয় আপনার।

আমি বললাম, দারোগা নিজে যদি আসামীর মতো ব্যবহার করে তাহলে আর কি করা যায়?

এমন সময় পথের উপর থেকে কে যেন বলে উঠল, ঝগড়াটা কিসের? কার সঙ্গে কার ঝগড়া?

চোখ তুলতেই দেখলাম, চন্দ্রকান্ত। একটা পাথরের উপর বসে আছেন। দুটো গাছের ফাঁকে।

দারোগা বললেন কনস্টেবলদের, এই ধর, ধর, পালিয়ে না যায়; ঐ সেই হাতী- মারা ফেরারী।

কনস্টেবলদের খুব একটা উৎসাহ দেখা গেল না চন্দ্রকান্তকে ধরতে যাওয়ার।

চন্দ্রকান্ত বললেন, আমিই আসছি দারোগাবাবু। অত বড় ভুঁড়ি নিয়ে এতখানি চড়াই উঠতে আপনার কষ্ট হবে। আপনার কনস্টেবলদেরও।

বলেই তর তর করে চন্দ্রকান্ত নেমে এলেন। পাথরে পাথরে পা রেখে পাকদণ্ডী দিয়ে। যে পাকদণ্ডী দিয়ে প্রথম দিন আমি কম্ফুকে নামতে দেখেছিলাম।

দারোগা কোমরের কাছে একবার হাত এনে, আমার দিকে চোখ পড়তেই নামিয়ে নিলেন।

চন্দ্রকান্ত বললেন, ছবি নায়েক কি বলেনি যে, কে মেরেছে শম্বরটা? আপনারা জানেন না? কি ফরেস্টারবাবু?

ফরেস্টারবাবু বললেন, জানি।

—দারোগাবাবু কি জানেন? চন্দ্রকান্ত বললেন।

—জানি, দারোগাবাবু বললেন।

-তবে? আপনারা আমার কাছে না এসে এদের উত্ত্যক্ত করছেন কেন?

দারোগাবাবু রেগে বললেন, আপনার ঠিকানা কি আপনি থানায় দিয়ে এসেছিলেন?

—না। তা দিইনি। তবে আপনার বন্ধু ছবি নায়কের কাছে ছিল! ইচ্ছে করলেই আসতে পারতেন।

তারপই চন্দ্রকান্ত ফরেস্টারকে বললেন, নমস্কার ফরেস্টারবাবু, আপনার মেয়ের অসুখ করেছিল, কেমন আছে এখন?

ফরেস্টারবাবু এই অভাবনীয় ব্যবহারে অভিভূত হয়ে পড়লেন।

বললেন, আপনি কেমন করে জানলেন? হ্যাঁ! ভাল আছে।

—ভালো লোকদের সব খবর রাখতে হয় আমার। খারাপ লোকেরও।

বলেই, দারোগাবাবুকে বললেন, সদরের সেই আফিং-এর চোরাকারবারীর সঙ্গে দোস্তি চালিয়ে যাচ্ছেন এখনও? কামাই জোর হচ্ছে বলুন!

দারোগাবাবুর মুখ বেগ্‌নে হয়ে গেল।

চন্দ্রকান্ত আমার দিকে ফিরে বললেন, আমি নাম-ঠিকানা সব দেবো, একটা ভালো করে লিখে দেবেন তো আই-জিকে। আমি একটা শম্বর মেরে যারা দেড় বছর মাংস খায় না তাদের খাইয়ে মহাপাতকের কাজ করেছি। আমাকে ধরতে এসেছেন ইনি!

দারোগাবাবু বললেন, ঠিক আছে। আমি দেখে নেবো।

—দেখে নেবো কেন? এখুনি দেখুন। আসুন আমাকে বেঁধে নিয়ে যান পারেন তো? এমন দিন-দুপুরে না পারলে পরে কি আর পারবেন? চন্দ্ৰকান্ত বললেন।

তারপর বললেন, আমার অপরাধটা কি? একটা শিঙাল শম্বর মেরেছি এই-ই তো। আপনি আপনার শালাকে নিয়ে গত মাসে রাতের বেলা তিনটে মাদী শম্বর মেরে নিয়ে যাননি? এই জঙ্গল থেকে? বলুন আপনি? তারিখ বলব, কবে? জিপের নাম্বার বলব?

দারোদাবাবু আঁৎকে উঠলেন।

চন্দ্ৰকান্ত বললেন, আইন যাঁরা খাটান, দয়া করে তাঁরাও আইনটা মানবেন। যান। এবার বাড়ি যান। ওঃ হোঃ ভুলেই গেছিলাম। এখন তো ছবি নায়েকের কাছে যাবেন। আজ রাতটা নিশ্চয়ই কাটাবেন ওখানে। ফুর্তি-টুর্তি হবে। তাই-ই না?

দারোগাবাবু ফরেস্টারবাবুকে প্রায় টেনে নিয়ে জিপে উঠলেন।

জিপটা স্টার্ট করতেই চন্দ্রকান্ত একেবারে দারোগার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন বললেন, আবারও হয়তো এখানে আপনাকে আসতে হবে। তখন এদের কাছে না এসে সোজা আমার কাছেই আসবেন। নইলে, অন্য কাউকে পাঠাবেন – যে পরিষ্কার, যার নিজের লুকোনোর মতো কিছু নেই। যার সাহস আছে, যার সঙ্গে লড়ে মজা, এমন লোককে। আপনি মশাই একটা ছুঁচো। আপনার গাল-পোড়া বেঁটে বন্ধুর মতো।

দারোগাবাবু কনস্টেবলগুলোর সামনে চুপ করে বসে রইলেন।

জিপটা চলে গেল ধুলো উড়িয়ে।

নারাণ বলল, বাবু চা খাবেন?

—চা? খাওয়া। বহুদিন খাইনি।

তারপরই চন্দনীকে দেখতে পেয়ে বললেন, কি রে? কেমন আছিস? সুখেই তো আছিস মনে হচ্ছে।

চন্দনীও ঠেস দিয়ে বলল, তা আছি! তোমার সঙ্গে থাকতে সুখ কাকে বলে জানতে পারলাম কই?

চন্দ্রকান্ত হাসলেন। বললেন, তোর সুখ আর আমার সুখ আলাদা রে চন্দনী! রাগ করিস্ কেন? সবাই কি সবাইকে সুখী করতে পারে?

রত্নাকর এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়েছিল।

চন্দ্রকান্ত বললেন, রত্নাকর, কাছে আয়।

রত্নাকর কাছে আসতেই হঠাৎ এক প্রচণ্ড চড় লাগালেন চন্দ্রকান্ত রত্নাকরকে।

চড় খেয়ে রত্নাকর ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে। ওর কর্তৃত্ব, ওর হাতঘড়িশুদ্ধ হাত, ওর অথরিটি সব ধুলোয় ধুলো হল।

সকলে এ ব্যাপারে স্তম্ভিত হয়ে গেল। আমিও।

রত্নাকর উঠে বসল মাটিতে, গালে হাত দিয়ে।

চন্দ্ৰকান্ত বললেন, কাল দারোগাকে খবর দিয়েছিলি তুই? তুই নিজে কুটরা মেরে খাস্ না? শম্বর তো মেরেছি আমি, কিন্তু আমি কি খেয়েছি? তোদের জন্যেই মেরেছিলাম।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, শোন রত্নাকর। আর কখনও যদি জানতে পাই যে, তুই গোয়েন্দাগিরি করেছিস, তোকে গুলি করে মেরে ঝুলিয়ে রাখব এই গাছটায়।

আবার বললেন, দেখে নে ভালো করে; এই গাছটায়।

রত্নাকর মুখ নীচু করে, অত লোকের সামনে, ওর সমস্ত মাতব্বরী ধুলোর সঙ্গে লুটিয়ে ক্যুপ্-কাটা কুলিদের চোখের সামনে আস্তে আস্তে ঢুকে গেল ঝুপড়ির মধ্যে।

চা খেতে খেতে চন্দ্রকান্ত বললেন, সৌমেনবাবু কবে আসবে রে?

নারাণের মালিক চন্দ্রকান্তর হাতে মার খাওয়াতে নারাণ চন্দ্রকান্তর সঙ্গে ঠিক কি রকম ব্যবহার করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। চাকরি গেলে সর্বনাশ। আফিং-এর গুলি না হলে ও মরে যাবে। একদিনও বাঁচবে না। এ ভব সংসারে আফিং আর দীনবন্ধু ছাড়া ওর আর কেউ নেই।

নারাণ ঝুঁকি না নিয়ে বলল, আমি জানি না।

চন্দ্রকান্ত আর কোনো কথা না বলে চায়ের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে পাকদণ্ডী দিয়ে উঠে জঙ্গলে মিলিয়ে গেলেন।

অপসৃয়মান চন্দ্রকান্তর দিকে চেয়ে দেখলাম, ওঁর হাত খালি। বন্দুক রাইফেল কিছুই নেই সঙ্গে। ভাবলাম, দারোগা তবুও ছেড়ে দিয়ে গেল কেন ওঁকে?

তারপরই মনে হল, ভয়ের জন্যে। দারোগার বুকে ভয় আছে। অনেক কিছুর ভয়। অনেক অন্যায়ের ভয়ের পোকা দারোগার বুকে থিক থিক করছে। অন্য দিকে চন্দ্রকান্তর বুক ভয়শূন্য। চন্দ্রকান্তর পায়ের শব্দ জঙ্গলের শুকনো পাতার মধ্যে মিলিয়ে গেল।

আমার বয়স হল অনেক কিন্তু জীবনে এই প্রথমবার উপলব্ধি করলাম যে, কার হাতে কোন হাতিয়ার থাকে সেটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। কার বুকে কি থাকে সেইটেই সবচেয়ে বড় কথা। হাতে হাতিয়ার না থাকলেও যায় আসে না, হাতটা পরিষ্কার থাকা চাই। এমন কটা লোক সংসারে আছে যে, দু-হাত উপরে তুলে বলতে পারে যে, ‘দ্যাখো! আমার হাতে ময়লা নেই কোনো, লুকোবার নেই কিছুমাত্র। আমি পরিষ্কার।’

কম্ফু বলল, আমি যাই একটু ঘুরে আসি।

বললাম, কোথায় যাবে?

চন্দনী, চন্দ্রকান্ত চলে যাওয়া অবধি চুপ করেই ছিল। ও হঠাৎ বলল, আমিও যাব।

–কোথায়? আমি শুধোলাম।

—তোমার সঙ্গে। আমারও বেড়ানো হবে।

বুঝলাম, যদিও চন্দ্ৰকান্তকে ও আর স্বীকার করে না, চন্দ্রকান্তও স্বীকার করে না ওকে। কিন্তু যেখানে চন্দনী আছে, যাদের আশ্রয়ে, সেই তাদেরই মাতব্বর রত্নাকরকে চড় মেরে গেলেন চন্দ্রকান্ত। এইটা বড় অস্বস্তির কারণ হয়েছিল ওর কাছে।

আমি ওর চোখের দিকে চেয়ে সেকথা বুঝলাম।

বললাম, এসো। চলো আমাদের সঙ্গে।

বসন্তবনের দুপুরে পাহাড়-জঙ্গলে হেঁটে বেড়ালে নেশা ধরে। এ নেশা আফিং- এর নেশার চেয়েও অনেক গাঢ়। ঝুরু ঝুরু করে হাওয়া বইছে পাহাড়ে পাহাড়ে। আমের বোলের গন্ধের সঙ্গে মিশে গেছে প্রথম মহুয়ার গন্ধ। এখন প্রজাপতির দিন। রঙ বেরঙের প্রজাপতির সুতো দিয়ে সবুজ বনের জমিতে কোন অদৃশ্য নিপুণ রসিক তাঁতী যেন তাঁত বুনে চলেছেন। রঙে-রঙে কাটাকুটি, মেশামেশি হয়ে রঙ-বেরঙে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কাঁচপোকা উড়ছে। তার ডানায় চেনাই উড়ছে। নেপালী ইঁদুর তাদের গাঢ় বাদামী শরীরে রোদ প্রতিফলিত করে বড় বড় গাছের ডালপালা পাতা ঝাকাঝাকি করে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। ধূসর-কালো কাঠবেড়ালী তার ছোট ছোট দুই হাতের মধ্যে জংলী ফল ধরে গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে লাজুক চোখে উঁকি মারছে। পাখিগুলোর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মাটিতে কে হেঁটে গেল না গেল। রোদভরা বাসন্তী আকাশ ওদের ডাক দিয়েছে। নীচের পত্রপুষ্পশোভিত বিচিত্ৰ বর্ণের বসন্তবন আর উপরের অশেষ আকাশ এই নিয়েই ওরা খুশি আছে। মাঝে মাঝে কোনো বোকা পাখি, বাজের মতো, চিলের মতো, পাহাড়ী স্বয়নার মতো, আকাশের ওপারে কিছু আছে কি না দেখার জন্যে উড়ে উড়ে সোজা উপরে রোদ- চকচক ছোট্ট বিন্দুতে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। তারপর আকাশের বুকে আরও আকাশ, তার পরেও আরও আকাশের খোঁজ নিয়ে ফিরে আবার তাদের ভালোবাসার, গন্ধের, শব্দের, ফুলফলের পৃথিবীতে নেমে আসছে। গলা তুলে এ ওকে ডাকছে, গদগদ হয়ে কত কথা বলছে।

একটা অর্জুনের ডালে রোদ এসে পড়েছে। তার পাতায় একটি ছোট্ট মৌসুমী পাখি বসে শীষ দিচ্ছে। আমার পা থমকে গেল। চন্দনীর হাত ধরে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম সেখানে। কতটুকু পাখি! কিন্তু ঐটুকু পাখিকে ভগবান কী দেননি! চোখ, নাক, কান, ঠোট, মুখ। শুধু ঠোটই যে দিয়েছেন, তাই-ই নয়, সেই ঠোঁটে কী সুর দিয়েছেন, কী গায়কী! ওকেও খেতে শিখিয়েছেন, ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। যা দেননি তা আমাদের মতো সর্বগ্রাসী ক্ষিদে, লোভ, ঈর্ষা, ক্ষমতার কামনা, পরশ্রীকাতরতা। ঐ সামান্যতার মধ্যেও ওকে আমার মতো দত্তভরা মরণশীল মানুষের চেয়ে কত বড় করে দিয়েছেন। ভাবলে অবাক লাগে।

একটা পাখি যখন ডানা মেলে উড়ে যায়, একটা পাতা যখন হাওয়ায় বৃন্তচ্যুত হয়ে ঘুরে ঘুরে আরতি করে ধরিত্রীর পায়ে পড়ে, এক গুচ্ছ ফুল থেকে, আমের বোল থেকে যখন গন্ধ ওড়ে, যখন হরিণীর তার কাজলকালো চোখে চকিতে চেয়ে বনের গভীরে শুকনো পাতায় মচমচানি তুলে দৌড়ে যায়, চিতাবাঘ যখন তার চিত্র- বিচিত্র শরীরে জঙ্গলের কিনারায় চিত্রার্পিতের মতো নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায়, তখন বারবারই আমার মনে হয় মিছিমিছি মানুষ হয়ে জন্মালাম। শুধু দত্ত নিয়ে, গর্ব নিয়ে, সংস্কার নিয়ে নীচ ঘৃণিত এক সম্মানের ও ক্ষমতার লোভ নিয়ে মিছিমিছিই এই জীবনটাকে নষ্ট করে গেলাম। ওদের মতো হলে কত সহজে তাঁর সঙ্গে একাত্ম হতে পারতাম। না জেনেও তাঁকে ভালোবাসতে পারতাম! নিজের অজ্ঞাতসারে, আত্মশ্লাঘা আর উচ্চম্মন্যতায় কুব্জদেহ আঁতেলসভার সমর্থন ও শিরোপা ছাড়াই সর্বোত্তম উত্তরণের শরিক হতে পারতাম। কিছুই হল না। বনের জন্তু না হয়ে শহরের জন্তু হয়ে সমস্ত জীবনটাই বরবাদ হয়ে গেল।

চন্দনী আমার হাতে টান দিল। চমক ভাঙল আমার। দেখি, কম্ফু অনেক দূরে চলে গেছে।

একটা মৌটুসী পাখি উড়ল। অর্গুনের ডালটা কাঁপতে লাগল। কাপতে লাগল পাতাগুলো। কম্পমান সবুজ পাতাগুলো হলুদ রোদটাকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে লাগল।

হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, একটা আমলকী গাছের নীচে একজোড়া রাজ ঘুঘু, ফল্সা রঙা। সুডৌল পুরুষ ঘুঘুটা বড় আদরে, বড় সোহাগে বড় সযত্নে স্ত্রী ঘুঘুটাকে আদর করছে।

আমার কী হল জানি না আমি। চন্দনীকে আমি দু-হাত দিয়ে কাছে টানলাম। আমার ঠোঁট ওর ঠোটে আমার বুক ওর বুকে! তারপর বড় আদরে, বড় সোহাগে, বড় যতনে, ঘুঘুটার কাছ থেকে শিখে চন্দনীর ভিজে নরম কমলা-কোয়া ঠোঁট, নিঃশেষে আমার ঠোঁট দিয়ে চুষে নিলাম। শুধুমাত্র চন্দনীর ঠোটই নয়, তার সঙ্গে এই বসন্তবনের মধ্য দিনে যত রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ ছিল তার সবটুকু আর্দ্রতা এবং জ্বালাও আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে আমি নিংড়ে শুষে নিলাম, নিতে থাকলাম; চন্দনীর ঠোটের মধ্যে দিয়ে।

আমার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো ভালোবাসায়, ভালোলাগায়। শরীর, এই ডিজেলের ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়া এই কয়লার ধোঁয়ায় কালো শরীরে যে এত কোষ আছে তা’ আমি এর আগের মুহূর্তেও জানিনি। বুকের মধ্যে রক্ত ছলাৎ ছলাৎ করে সে কথা এই প্রথম আমায় জানান দিল।

বয়সের হিসাবে যুবক হয়েছিলাম আগে আজ আমি এই দুপুরে এই বনের আলোছায়ায়, এই পাখির ডাকে ফুলের গন্ধে, চন্দনীকে বুকে করে প্রথম জানলাম যে, যৌবনের মানে কি। যৌবনের পরিপূর্ণতা, পরিপ্লুতী কোথায়?

মনে মনে বললাম, চন্দী, আমার চন্দনীরে! ভাগ্যিস তুই ডাক পাঠিয়েছিলি আমার। নাহলে বালকত্ব আমার কখনও ঘুচতো না। একদিন যৌবনকে টপকে গিয়ে বার্ধক্যের দরজায় কড়া নাড়তাম। এই যৌবন, এই বন, এই চন্দনী; আমি কি করব। কি করব আমি এত আনন্দ নিয়ে? আমি আজ রাজাধিরাজ। এইই প্রথম, আমার প্রথম কৈশোরের প্রেমিকা এই প্রকৃতিরই বুকে দাঁড়িয়ে, তারই এক স্নেহধন্যা বন্যা মেয়েকে নিয়ে আমি আমার যৌবনের পুরুষসত্তাকে নিবেদিত করলাম অনাদিকালের স্নিগ্ধ অথচ ঝাঁঝালো প্রকৃতিসত্তার কাছে।

চন্দ্ৰকান্ত! তুমি অনেক বড়। তুমি সাধারণ নও। আমাদের আশীর্বাদ করো যেন আমরা সাধারণ মানুষ ও মানুষী হিসেবে এই বনভূমিতে বাকী জীবন বড় সুখে বড় ভালোবাসায় কাটাতে পারি। বেশি লোভ নেই আমার। সামর্থ্যও নেই। তুমি আগে যেও, আমরা পেছনে থাকব। তোমার মতো ত্যাগ আমার জন্যে নয়। আমি আমাকে ভালোবাসি, এই পৃথিবীকে ভালোবাসি, এই নরম লতানো শরীরের পাখির মতো ওম-ধরা মসৃণ বুকের চন্দনীকে ভালোবাসি। আমাকে এই ভোগের মধ্যে ডুবে থাকতে দাও। চন্দনীকে আমার মতো করে পূজো করতে দাও আমায়।

হঠাৎ উপর থেকে কম্ফু হাঁক দিল।

বলল, কি হল? কাঠের মতো দাঁড়িয়ে কেন? সাপ?

চন্দনী খিল্‌ খিল করে হেসে উঠল। বলল, কম্ফু ভাইরে। শঙ্খচূড়। পায়ে দাঁড়িয়ে মুখে ছোবল মারে।

কম্ফু প্রথমে বুঝল না। না বুঝেই, তরতর করে কিছুটা নেমে এলো উৎরাই বেয়ে। তারপরই বুঝতে পেরে, হেসে ফেলল।

বলল, দারোগা ব্যাটা যাওয়ার পর তবু একটু হাসা গেল।

আমি বললাম, কম্ফু, কাম-জ্বরের কোনো ওষুধ আছে?

কম্ফু হাসল। বলল, আছে আছে! সব ব্যারামেরই অসুধ আছে। ওষুধ তো সামনেই আছে। কিন্তু অনুপান নেই। অনুপান তৈরি করে দেবো যদি চাও।

আমার বড় খুশি খুশি লাগছিল নিজেকে। অর্গলমুক্ত।

বললাম, দিও দিও; শিখিয়ে পড়িয়ে দিও। আমি বড় আনাড়ী।

কম্ফু হেসে উঠল। চন্দনী লজ্জা পেল।

তারপর আমরা তিনজনেই আবার উঠতে লাগলাম উপরে।

উপরে যখন উঠে এলাম, তখন চোখ জুড়িয়ে গেল। আধ স্কোয়ার কিলোমিটার মতো একটা মালভূমি—চতুর্দিকে ঘন সেগুনের বন। পাতাগুলো হাতীর কানের মতো বড় বড়। তারপর একটু ঝোপ-ঝাপ অর্গুন শিয়ারি, গিলিরি, কিছু কিছু বাইগবা, তারপরই ফাঁকা মালভূমি। নীচে ঝোপ-ঝাড় লতাপাতা কিছু নেই। সমস্ত জায়গাটায় কয়েকশ আমলকী গাছ। শুধু ফলে ভরা। সব পাতা ঝরে গেছে, শুকনো ডালে ডালে লক্ষ লক্ষ আমলকী। গাছতলায় কত যে আমলকী পড়ে আছে তা কি বলব। আমলকী আরও দেরীতে ফলে অন্যান্য জঙ্গলে, এখানে কিসের তাড়া বুঝলাম না।

কয়েকশ পাখি এসে জমেছে জায়গাটায়। ময়না, টিয়া, বুলবুলি, বসন্তবৌরি, পাহাড়ী ময়না; কুম্ভাটুয়া, দোয়েল, কোকিল আরো কত শত নাম না-জানা পাখি।

আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়েছিলাম।

কম্ফু বলল, একটা বারিরি!

চন্দনী চমকে উঠল। বলল, যাঃ!

–যাঃ না। সত্যি এটা বারিরি।

শব্দটা উচ্চারণ করতে করতে কম্ফুর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।

আমার প্রথমে মনে পড়ছিল না। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেল। খন্দ্রা মেরিয়া বলি দিত যে সময়, জীবন্ত মানুষের মাংস খুবলে নিত, তখন আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে যে বধ্যভূমিতে নিয়ে যেত খন্দ্রা, তারই নাম বারিরি। ‘বারিরি’ মানে বধ্যভূমি।

মেরিয়া-প্রথা বহুদিন হল উঠে গেছে, কিন্তু বারিরি নামটি এখনও রয়ে গেছে ওদের মনে, অবচেতনে। বারিরি শব্দটার মধ্যেই কেমন একটা গা-শিরশির ভয়ের ভাব আছে।

কম্ফু বলল, একদিন রাতের বেলা এখানে এসো। দেখবে পালে পালে চিতল হরিণ চরে বেড়াচ্ছে, আমলকী খাচ্ছে, আর তাদের মাথার উপর ঘুরে ঘুরে টী-টী পাখি ডেকে বেড়াচ্ছে চমকে চমকে হাট্টিটি—হাট্টিটি—হাট্টিটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *