লবঙ্গীর জঙ্গলে – ৪

বলদগুলোকে ওরা এই জঙ্গলে নিয়ে আসে পাহাড় থেকে কাটা কাঠ টেনে নামাবার জন্যে। পম্পাশরের বড় রাস্তা থেকে লবঙ্গীর জঙ্গলের এতখানি ভিতরে ওদের হাঁটিয়ে আনা যায় না। প্রথমত, সময় লাগে অনেক। দ্বিতীয়ত, পথে বাঘের ভয়। ক্যাম্পে লোকজন থাকে। সারারাত আগুন জ্বলে। ক্যাম্পের আশে-পাশেও কুলীদের ঝুপড়ি থাকে। বাঘ সহজে সাহস করে না ক্যাম্পে আসতে। তাছাড়া মোষ ও বলদগুলো একসঙ্গেই থাকে। তবে মাঝে মাঝে যে বাঘ কাছাকাছি না আসে, তা নয়। তখন বলদ ও মোষগুলো একসঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে ভঁস্ ভঁস্ করে নিশ্বাস ফেলে, জোরে জোরে শিং নাড়ায়। ওদের গলার ঘণ্টাগুলো জোরে বেজে ওঠে। লোকজনের ঘুম ভেঙে যায়। ওরা হল্লা করে, টিন বাজায়, মশাল জ্বালায়। বাঘ সরে যায়।

হাঁটিয়ে যেহেতু আনতে পারেনি, তাই কাঠ বয়ে নিয়ে যাওয়ার ট্রাকের জন্যে যেই রাস্তা হয়ে গেছিল, অমনি ট্রাকে করে বলদগুলোকে নিয়ে আসা হচ্ছিল। এই বলদটা, চুলের কাঁটার মতো এক বাঁকে যে, কখন ট্রাক থেকে নীচের খাদে পড়ে গেছিল তা কেউ খেয়াল করেনি। ক্যাম্পে এসে খেয়াল হয়েছিল। পরদিন খোঁজ করতে করতে দেখা গেল বেচারী পা-ভেঙ্গে, পড়ে আছে খাদে। খাদ বেশি গভীর না থাকায় প্রাণে বেঁচে গেছিল বেচারা।

এখন সেই ভাঙা পা সারাচ্ছে কম্ফু। একটা লাল রঙা ওষুধ তৈরি করেছে ও। কচি শিমুলের গোড়ার শিকড়, হাড়কঙ্কালির ছাল, পুাসিয়া লাতার গোড়া, বুড়ো শ্যাওড়ার ছাল বেটে জড়া তেল দিয়ে ঔষুধটা বানিয়েছিল ও। তারপর সেই ওষুধ লাগিয়ে ডবা বাঁশ কেটে স্প্রিন্টার তৈরি করে তা দিয়ে বেঁধে দিয়েছিল পা।

একটা শলাই কাঠের মশাল মাটিতে পুতে, জায়গাটা আলোকিত করে হাঁটু গেড়ে উবু হয়ে বসে ওষুধ লাগাচ্ছিল কম্ফু বলদাটার পায়ে। বলদটার দুটো বড় বড় উজ্জ্বল চোখে ওর শরীরে ব্যথা প্রতিফলিত হচ্ছিল।

আমি পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।

কম্ফু নিজের মনে বিড় বিড় করে কি সব বলছিল। ওষুধ লাগানো হয়ে গেলে বাঁশের স্প্রিন্টার দুটো নতুন লতা দিয়ে আবার ভালো করে বেঁধে দিল ও বলদটার পায়ের সঙ্গে।

আমি শুধোলাম, সেরে উঠছে?

কম্ফু বলল, তা তো বটেই। তবে পুরো ভালো হতে আরো সময় লাগবে। গত সপ্তাহে উঠে দাঁড়িয়েছিল! এ সপ্তাহে রোজ অনেকক্ষণ সময় দাঁড় করিয়ে রাখছি। শিগগিরই কাজে লাগতে পারবে। তারপর, যেন একটু বিষণ্ণ হয়েই বলল, এর কাজ শুরু হলেই, আমার কাজ শেষ।

এখানে একটা বলদের দাম আজকাল অনেক। একজন মানুষের জীবনের চেয়ে বেশি। চিকিৎসার জন্যে বহুদূর জঙ্গলের বস্তি থেকে কম্ফুকে খবর পাঠিয়ে আনিয়েছে রত্নাকর, ক্যাম্পের ম্যানেজার। বলদ এবং মানুষেরও চিকিৎসার জন্যে। তখনকার মতো চিকিৎসা শেষ হলে কম্ফু বলল, চলো বাবু, কি বলবে আমাকে শুনি।

আমরা দুজনে ক্যাম্পে সামনের উঁচু পথটাতে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে দুটো পাথরে বসলাম।

কম্ফুকে বললাম, তুমি চন্দ্রকান্তকে দেখেছো?

কম্ফু কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে চেয়ে রইল, তারপর চোখ চেয়েই বলল, হ্যাঁ। দেখা তো হয়। মাঝে-মাঝে। তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তেমন তো জংলী জানোয়ারের সঙ্গেও দেখা হয়।

-থাকেন কোথায়? আমি শুধোলাম।

-তা জানি না, তবে দেখা হয়ে যায় মাঝে-মাঝে। জঙ্গলের মধ্যে। দিনে বিশেষ বেরোয় না। রাতে বেরোয়। বাঘের জাত তো!

তারপর আবার অনেকক্ষণ থেমে স্বগতোক্তির মতো বলল, মরবে কোনদিন সাপের কামড়ে। গরম তো পড়ছে আস্তে আস্তে।

–এই দিকে কোন সাপ বেশি?

—সব সাপই আছে। তবে ভয় বেশি শঙ্খচূড়কে। তেড়ে এসে ধাওয়া করে ছোবলায়।

আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, তোমার সঙ্গে চন্দ্রকান্তর কথা হয়?

—কি কথা? বলেই, কম্ফু আমার চোখের দিকে তাকাল।

—আমি বললাম, কোনো কথা।

কম্ফু বলল, হয়; কিছু কিছু।

বুঝলাম কম্ফু আমার কাছে সহজ হতে পারছে না।

কম্ফু আমাকে শুধোল, তুমি এতদূরে এসেছো কেন চন্দ্রকান্তর খোঁজে? চন্দনীর সঙ্গে আবার বিয়ে দেবে?

আমি বললাম, চন্দ্ৰকান্ত আমার বন্ধু হন। তা ছাড়া চন্দনীর জন্যেও এসেছি, ওদের যখন বিয়ে হয় তখন আমি ছিলাম বিড়িগড়ে

কম্ফু গম্ভীর মুখে বলল, বিয়েটা তোমাদের না দেওয়াই উচিত ছিল। যে মরদ বউয়ের দেখাশোনা করতে পারে না তার বিয়ে করা কেন? চন্দ্রকান্তর আর যে গুণই থাক না কেন, বউ-এর সঙ্গে ব্যবহারটা ভালো করেনি সে।

তারপর হঠাৎ কম্ফুর চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শুধোল, তুমি কখনও বিড়িগড়ের দুর্গে গেছ?

—হ্যাঁ। আমি বললাম।

কম্ফু বলল, ঐ দুর্গের কাছে একটা লতাঝোপ আছে, সেই লতার রস থেকে একটা ওষুধ বানিয়ে তা দিয়ে আমি কর্কট রোগ সারাতে পারি।

—ক্যানসার?

আমি অবাক হয়ে বললাম!

কম্ফু বলল, ক্যানসার কি জিনিস? কোনো জানোয়ার? আমাদের জঙ্গলে- পাহাড়ে ও জানোয়ার নেই। আমি রোগের কথা বলছি।

তারপর বলল, তুমি আমাকে ঐ দুর্গে কখনও নিয়ে যেতে পারবে?

আমি বললাম, পারি। তুমি চন্দ্রকান্তর সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দাও।

কম্ফু আমার চোখের দিকে আবার তাকাল অনেকক্ষণ। তারপর বলল, তুমি জাতে ব্যবসাদার?

আমি হাসলাম। বললাম, না। কিন্তু চন্দ্রকান্তর সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার।

কম্ফু আবার নিজেকে গুটিয়ে নিল। বলল, সে তোমার বরাত।

বলেই, হাতের লাঠিটা নিয়ে মাটিতে ঠুকতে লাগল। লাঠির মুখটা একেবারে সাপের ফণার মতো।

আমি লাঠিটা একটু চাইলাম ওর কাছে, দেখব বলে।

কফু লাঠিটা এগিয়ে দিল।

লাঠিটা আশ্চর্য! এরকম লাঠি আগে কখনও দেখিনি।

কম্ফু বলল, এটা জাদু করা লাঠি। জামো পেনু, থ্রিভি পেনু, কাটি পেনু, সকলের আশীর্বাদ আছে এতে।

-ওরা তো খন্দদের দেবতা। তুমি কি খন্দ না কি?

আমি শুধোলাম।

কম্ফু বলল, ভগবান কি কারো কেনা নাকি? যে যাকে মানে, সেই-ই তার ভগবান।

আমি বললাম, তা ঠিক।

তারপর বললাম, তুমি কাল যখন জঙ্গলে যাবে আমাকে নিয়ে যাবে?

কম্ফু বলল, আমি সারাদিন কত ক্রোশ ঘুরি লাতা-পাতা জোগাড় করতে, তুমি পারবে অত কষ্ট করতে? শহুরে বাবু।

আমি বললাম, নিয়েই চলো না। পারি কি না পরখ করো।

কম্ফু বলল, সে বড় অসুবিধে। আমার সঙ্গে গিয়ে কাজ নেই তোমার।

তারপর বলল, ধরো যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায় চন্দ্রকান্তর সঙ্গে, তোমার কথা কি বলব?

আমি বললাম, বোলো, বিড়িগড়ের শালাবাবু এসেছে তার খোঁজে। আরও বোলো, চন্দনীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। আমরা দুজনেই তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

—বলব। কম্ফু নৈর্ব্যক্তিক গলায় বলল।

আমি চমকে উঠলাম। বললাম, তাহলে নিশ্চয়ই কাল দেখা হবে তোমার সঙ্গে চন্দ্রকান্তর।

কম্ফু এবার চমকে উঠল।

এড়িয়ে গিয়ে বলল, না, কখনও কখনও দেখা হয়ে যায়।

আমার মনে হল কম্ফু আমাকে মিথ্যা বলছে। ওর সঙ্গে হয়তো রোজই দেখা হয় চন্দ্রকান্তর।

কম্ফুকে বললাম, তুমি আমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও।। ভালো বকশিস্ দেব। কম্ফু অদ্ভুত এক হাসি হাসল।

বলল, টাকা দিয়ে কি করব আমি? চলে যাচ্ছে তো বেশ! তাছাড়া এই জঙ্গলে টাকাও যা, কাগজও তাই।

আমি অবাক হলাম। বললাম, তোমার টাকার দরকার নেই?

কম্ফু সগর্বে বলল, দরকার হয়নি।

—তোমার বউ ছেলে? আমি শুধোলাম, ওদেরও দরকার নেই?

—কিসের দরকার? আমার বউ অন্য দশজনের বউ-এর মতো নয়, সে কম্ফু বদ্যির বউ। তার কাছে টাকার চেয়ে ইজ্জতের দাম বেশি আর আমার ছেলেকে আমি আমার মতো বদ্যি করতে চাই। ও গ্রামে গঞ্জে গেলে চাকরি খুঁজবে, বড় হলে ঠিকাদারের মুহুরী হবে, কারখানায় কাজ করবে, কি রাস্তা বানাবে। আমার নাম কম্ফু আমি মরা মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে পারি। জঙ্গল ছেড়ে গেলে আমার মধ্যের শক্তি নষ্ট হয়ে যাবে। আমি খুব ভালো আছি। আমাকে টাকার লোভ দেখিও না।

আমি বললাম, আমার সঙ্গে জিপ গাড়ি আছে। তোমাকে নিয়ে মহানদী পেরিয়ে বড়সিলিঙা হয়ে বড়মূল হয়ে, টাক্রা হয়ে, বিড়িগড়ে নিয়ে যাবো তাহলে লতার জন্যে। যাবে?

—যাবো। খুশি হয়ে কম্ফু বলল।

তারপর বলল, থাক্। আমাকে লোভ দেখিও না। লোভ জাগলে আর আমার ওষুধ ধরবে না। দেখছ না, পা-ভাঙ্গা বলদটা কেমন সেরে উঠছে। তোমাদের শহরের ডাক্তাররা পারতো?

আমি বললাম, না।

—তবে? কম্ফু বলল।

তারপর বলল, বকশিসের দরকার নেই। আমি দেখব তোমার জন্যে কি করতে পারি।

বেশ বিপদে পড়লাম। কোনো একটা হদিস না পেয়ে এই নিশ্ছিদ্র জঙ্গলে চন্দ্রকান্তকে খুঁজে বের করা সামান্য কথা নয়। কম্ফুর সাহায্য ছাড়া তা প্রায় অসম্ভব। অথচ্ কম্ফুর কতদিনে দয়া হবে বোঝা যাচ্ছে না।

খাওয়া-দাওয়ার পর চন্দনী গিয়ে ওর ঘরে শুয়েছে এখন। আমি ঘরের বাইরে কাটা গাছের গুঁড়িতে বসে পাইপ খাচ্ছি। নালার পিছনের জঙ্গল থেকে একটা নাইটজার একটানা ডেকে চলেছে টাকু-টাকু-টাকু-টাকু-টাকু। জ্যোৎস্নাটা অনেক জোর হয়েছে। আর ক-দিন বাদেই দোল পূর্ণিমা। পাহাড় থেকে হনুমান ডাকাডাকি করছে হুপ-হুপ-হুপ-হুপ করে। সেই আওয়াজ ছড়িয়ে যাচ্ছে দূরের পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে নীচের উপত্যকায়! বাঘ বা চিতা দেখে থাকবে ওরা। রাস্তার পাশে কতগুলো গেণ্ডুলি গাছ। সাদা নরম তাদের গা। এখন পাতা নেই—জ্যোৎস্নায় ওদের গুঁড়ি ও শাখা-প্রশাখাগুলো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। পত্রশূন্য ফলভরা আমলকী গাছের ডালে ডালে জ্যোৎস্না চুঁইয়ে পড়ছে।

নারাণ গান ধরেছে—

দয়া করো দীনবন্ধু শুভে যাউ আজ দিন
কড়জোড়ি তুম পাদে করুছি এ নিবেদন।
সত্য শান্তি প্রদায়ক, দুষ্ট দণ্ড বিধায়ক
রুক্‌মিনী প্রাণনায়েক প্ৰভু পতিত পাবন ॥

রত্নাকর ধমক দিয়ে নারাণের ভজন থামিয়ে দিয়ে, নিজেও যে গান গাইতে পারে তা শোনাবার জন্যে চটুল গান ধরল।

ফুলরসিয়ারে মন মোর ছুঁয়ি ছুঁয়ি যা
তো লাগি বিকশী চাহিছি একুঞ্জে
গুঞ্জন দেই যা যা।
যা না’রে ফেরি, আসি পাশে যা না
গা মন ভরি, করো না তুমনা
ঝুরিলে কি আউ আসিব এ দিন
হসি লেটি গাই যা-যা —
সাজি কেতে কুঞ্জে, কেতে ফুল সেজে
মহক্ ছটাই মরে নিতি লাজে
লাজ ত্যজি আজি করুছি আরতি
থরে ধীরে চাহি যা যা ॥

রত্নাকরের সংগীত প্রতিভা চন্দনীকে না জানালেই নয়।

বউ-ছেলে গ্রামে ফেলে বছরের মধ্যে আট-ন-মাস জোয়ান ছেলেগুলো জঙ্গলে পাহাড়ে পড়ে থাকে। এর মধ্যে চন্দনীর মতো একজন অতিসুন্দরী যুবতীর আগমনে অনেকেরই সংগীতপ্রতিভা এবং আরও যাবতীয় প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছে। সকলেই চন্দনীকে ইম্পেস করবার জন্যে নিজের নিজের বিভিন্ন মাধ্যমে উন্মুখ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে চন্দনী যে পয়সার বিনিময়ে করুণা বিতরণ করেছিল নদীপারে, এ তো এদের সকলেরই জানা। এও জানা যে দোর্দণ্ড-প্রতাপ চন্দ্ৰকান্ত আর এ-নারীর উপর কোনো দাবি রাখে না। রত্নাকর প্রথমে কর্তৃত্ব দেখিয়ে চন্দনীকে আবিষ্ট করতে চেয়েছিল। আমার জন্যে সেপথে সুবিধা না হওয়ায় এখন মধুর পথে এগোতে চেষ্টা করছে।

রত্নাকরের গানের রেশ তখনো মিলিয়ে যায়নি, এমন সময় দূর থেকে জঙ্গলের মধ্যে একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ শোনা গেল। যারাই জঙ্গলে থাকে, জঙ্গলে আসা- যাওয়া করে, এ-শব্দের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত। জিপের এঞ্জিনের আওয়াজ এ।

যারা ঘুমিয়ে পড়েছিল তাদের ঘুম ভেঙে গেল। যারা ঘুমোবে ভাবছিল, তারা উঠে বসল। আওয়াজটা ক্রমশ জোর হতে লাগল। আলোর আভাস দেখা যেতে লাগল খাদের পাশের উঁচু ঘোরালো রাস্তাটাতে।

আমি তাড়াতাড়ি একবার চন্দনীর ঘরের সামনে গেলাম। উঁকি দিয়ে দেখি ও জড়োসড়ো হয়ে দু-হাঁটু জড়ো করে দু-হাত দিয়ে হাঁটু জড়িয়ে বসে আছে।

আমি বললাম, তুমি ঘরেই থেকো। কোনো ভয় নেই।

হঠাৎ দেখি কম্ফু লাফাতে লাফাতে নিজের ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আমার পাশে বসল। ওর হাতে সেই লাঠিটা। তারপর আমার সঙ্গে অর্গুনগাছের ফলের টক্ রাঁধলে কেমন খেতে হয় তা নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরু করে দিল।

জিপটা ক্যাম্পের আনাচ কানাচ আলোয় আলোকিত করে এসে দাঁড়াল।

তিন-চারজন লোক নামল জিপ থেকে। পুলিশের লোক নয়।

রত্নাকর ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এসে যে বেঁটে মতো লোকটি ড্রাইভারের পাশে বসেছিল, তাকে খুব ভক্তিভরে প্রণাম করল।

লোকটি বলল, দারিয়ানী চন্দনী এখানে এসেছে?

দারিয়ানী কথাটার উপর খুব জোর দিল লোকটা।

তারপর রত্নাকরকে জবাব দেওয়ার সুযোগ দেবার আগেই বলল, ওকে আমার চাই। ডাক্ ওকে। কাল সকালে ফেরৎ দিয়ে যাব সত্যি! ছবি কথা রাখবে।

লোকটা জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছিল।

রত্নাকর ব্যাপার বেগতিক দেখে, আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ঐ বাবু নিয়ে এসেছেন চন্দনীকে। ওঁকে জিগ্‌গেস করুন।

আমি উঠে গিয়ে লোকটার সামনে দাঁড়ালাম। লোকটার মুখ দিয়ে ভক্‌ভক্ করে দিশি মদের গন্ধ বেরুচ্ছিল। চোখ দুটো রাতের জানোয়ারের চোখের মতো চক্‌চক্‌ করছিল।

আমি কিছু বলার আগেই লোকটা নিজের বুকে তর্জনী ঠেকিয়ে বলল, আমার নাম ছবি নায়েক–আমি চন্দনীকে চাই। পয়সা দেবো। আমার এক্ষুনি চাই ওকে। ওকি আপনার রাখন্তি?

লোকটার আস্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, চন্দনী আমার সঙ্গে এসেছে। এবং থাকবে। এক্ষুনি এখান থেকে চলে না গেলে বিপদ হবে, আপনি যেই হন না কেন?

লোকটার পরনে ধুতি, বাফতার পাঞ্জাবি, গালের একটা দিক পোড়া—বেঁটে, গাঁট্টা-গোট্টা চেহারা। লোকটা অনেকক্ষণ ঢুলু ঢুল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তাপর হঠাৎ আমার পা জড়িয়ে ধরে বলল, কিছু মনে করবেন না। অপরাধ নেবেন না।

বলেই জিপে গিয়ে উঠল।

কফু বলল, পালান্ পালান্ ঠিকাদারবাবু নইলে ঝামেলা হবে।

ছবি ঠিকাদার বলল, যাচ্ছি ভাই; এখুনি যাচ্ছি।

বড় বিনয়ের সঙ্গে বলল কথাটা।

তারপর আমাকে বলল, চলি বাবু! রাগ করবেন না আমার উপর। অপরাধ হয়ে থাকলে মাপ করবেন।

হঠাৎ, রোগা-পটকা নারাণ দৌড়ে এসে আমাকে নিচু গলায় বলল, বাবু সাবধান।

জিপটা চলে যেতেই কম্ফুও যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ চলে গেল, একটাও কথা না বলে।

যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বলল, এ সাপ শঙ্খচূড়ের চেয়েও সাংঘাতিক। এর জাত জানেন? তারপর আমি কিছু বলার আগেই বলল, এর নাম বেনে-সাপ!

অপসৃয়মাণ জিপের লাল টেইল-লাইটটা মিলিয়ে যেতেই নারাণ মাথা নেড়ে নেড়ে গাইতে লাগল :

দোয়াপর যুগরে হরি গুপ্তে বরি গুপপুরী
দুষ্টু কংসুক নিবারি রজা কল উগ্রসেন,
ভারতভূমি মধ্যরে সুদর্শন ধরি করে
পাণ্ডবংক ছলে হরি, কৌরবে কল দহন।
দয়া করো দীনবন্ধু মতে যাউ শুভদিন ॥

রত্নাকর ওকে ঠেলে ঘরে পাঠিয়ে দিল। বলল, আফিং জোর চড়ে গেছে। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, বাবু এরপর খুব গোলমাল হবে।

আমি বললাম, বুঝতে পারছি।

রত্নাকর বলল, ছবি নায়েক একবার এমনি করে কম্ফুর বউকেও জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে সারারাত আটকে রেখেছিল। লোকটা ভালো না, ওর কাছে কুলির চেয়ে কামীন বেশি। সব কামীনের ডিউটি পড়ে ওর ঘরে রাতের বেলা ঘুরে ঘুরে। লোকটা ঐরকমই। ননসেন্স।

শেষ কথাটায় একটা ইংরেজি বলল, একাদশ-ফেল রত্নাকর।

আমি বললাম, কি হবে তা দেখা যাবে। এসব লোকের মেরুদণ্ড থাকে না।

রত্নাকর নারাণ ওরা সব চলে যেতেই চন্দনী আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে আমার পিঠে হাত ছোঁয়াল।

আমি চমকে উঠে তাকাতেই দেখি ভয়ে ওর মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।

আমি বললাম, চলো তুমি আমার ঘরেই শোবে। কোনো ভয় নেই তোমার।

আমার হোলডল্ বিছানো বিছানা পাতা ছিল। চন্দনী ওর কাঁথা নিয়ে এসে মাটিতে শুলো এক কোণায়। পা দুটো গুটিয়ে বুকের কাছে নিয়ে ভীরু শিশুর মতো শুয়ে পড়ল লজ্জায় মুখ ঢেকে।

আমি বললাম, আমার বিছানায় উঠে শোও। মাটিতে শুলে বিছে কামড়াবে।

ও অন্ধকারে উঠে বসল। যেন আমার কথা ওর বিশ্বাস হল না। আমার নিজেরও বিশ্বাস হল না আমার নিজের গলার স্বরকে।

চন্দনী হামাগুড়ি দিয়ে এসে আমার পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে আশ্রিত কোনো ভীরু জীবের মতো শুয়ে পড়ল।

একটু পরে দেখি ওর চোখের জলে আমার বিছানা ভিজে গেছে।

আমি বাঁ-হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে আমার বুকের কাছে টেনে আনলাম। চন্দনী আরামে, আশ্রয়ে পরম নিশ্চিন্তিতে আমার বুকের মধ্যে একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ল।

আমার ঘুম এল না। পাতার ফাঁক-ফোঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরটার মধ্যে। চন্দনীর মুখে। ওর ঘুমন্ত চোখে। মাথায় ও কি তেল মাখে জানি না। কেমন একটা ফুল-ফুল গন্ধ ওর চুলে।

বাইরে কাক-জ্যোৎস্না। নাইটজার পাখিটা ডেকেই চলেছে টাকু—টাকু——টাকু- টাকু—টাকু। উপত্যকার উপরে জ্যোৎস্নায় ভেসে ভেসে একটা পিউ-কাঁহা পাখি ডাকছে পিউ-কাঁহা পিউ-কাঁহা। কোথায় যেন ওর প্রিয়া হারিয়ে গেছে, চন্দনীর স্বামীর মতো।

কোনো যুবতী নারীকে এত কাছে নিয়ে কখনও আমি শুইনি এর আগে। অবকাশ ঘটেনি। সারা বুকের, সারা অঙ্গের এত কাছে আগুন নিয়ে কি কেউ ঘুমাতে পারে? চন্দনী অভ্যস্ত। ও ঘুমুলো কিন্তু সারারাত আমি শুয়ে শুয়ে বাইরে বসন্তবনের ফিফিসানি শুনলাম। পিউ-কাঁহাটা সারারাত তার প্রিয়াকে ডেকেই গেল। তবু সাড়া দিলো না প্রিয়া।

বিছের কামড়ের হাত থেকে চন্দনী বাঁচল নিশ্চয়ই।

কিন্তু একটা অন্য বিছে আমাকে সারারাত কামড়ে মারল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *