লন্ডন

লন্ডন

উঠুন মশিয়েঁ ভ্যান গক, কত ঘুমোবেন? বেলা হল যে!

ঘুমের মধ্যেই যেন ভ্যান গক উরসুলার এই ডাকের প্রতীক্ষায় ছিল। চোখ না খুলেই বললে—বাঃ, ঘুমিয়ে কই? জেগেই তো আছি।

হেসে উঠল মেয়েটি খিলখিলিয়ে—তাই বই কী? না ডাকলে বুঝি ঘুম ভাঙত?

সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল রান্নাঘরে। ভ্যান গক শুনল তার পায়ের শব্দ। না, আর শুয়ে থাকা চলে না। দুই কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে উঠে ভ্যান গক লাফিয়ে নামল বিছানা থেকে। খুব চওড়া তার কাঁধ আর বুক, শক্ত পেশিবহুল দুই বাহু। তাড়াতাড়ি পোশাকের মধ্যে ঢুকে সোরাই থেকে খানিকটা ঠান্ডা জল ঢেলে নিয়ে সে ক্ষুরে শান দিতে বসল।

দাড়ি কামানোর এই প্রাত্যহিক ব্রত-উদ্‌যাপন ভিনসেন্ট ভ্যান গকের ভালোই লাগে। ডানদিকের জুলপির ঠিক তলা থেকে প্রশস্ত গাল বেয়ে ক্ষুরটা নামে মুর্খের কিনারা পর্যন্ত, তারপর নাকের তলা দিয়ে ওপরকার ঠোটের ডানদিকের আধখানা অংশের ওপর দিয়ে চলে যায়। আবার একই প্রক্রিয়ায় মুখের বাঁ-দিকটা মসৃণ করার পালা। তারপর চিবুক বেয়ে ক্ষুর নামে গলা পর্যন্ত। চিবুক যেন গোল একটা শক্ত পাথর।

মুখটা পরিষ্কার করে নিয়েই সে ঝুঁকে পড়ল নীচু শেফটার ওপর+ব্রাবান্টের ঘাস আর ওক পাতার একটা তোড়ার মধ্যে নাক ডুবিয়ে জোরে নিশ্বাস নিল ক-বার। জুন্ডেয়ার্টের প্রান্তর থেকে সংগ্রহ করে তার ভাই থিয়ো তাকে তোড়াটা লন্ডনে পাঠিয়েছে। আজকের এই সকাল বেলাটিতে সবকিছুর আগে তাকে এসে সমাদর করল হল্যান্ডের গন্ধ। দিনের আরম্ভটি চমৎকার।

বাইরের থেকে দরজায় ধাক্কা। আবার উরসুলার গলা—মশিয়েঁ ভ্যান গক, চিঠি। খামের ওপরকার হাতের লেখা দেখেই বোঝা গেল চিঠিটা এসেছে মার কাছ থেকে। থাক এখন পকেটে, পড়া যাবে অবসরমতো। ঘন লম্বা লালচে চুলের রাশ পিছন দিকে ঠেলে আঁচড়ে ভ্যান গক জামাটা বদলাল। কড়া-ইস্ত্রি করা নীচু কলারের একটা শার্ট পরে গলায় সে বাঁধল খুব চওড়া একটা কালো টাই। এবার গটমট করে নামতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। নীচে তার জন্যে অপেক্ষা করছে গরম প্রাতরাশ আর উরসুলার প্রভাতী হাসি।

বাড়ির পিছনে বাগানের ও-ধারে শিশুদের একটি পাঠশালা। এটি চালান উরসুলার মা, মেয়েও সাহায্য করে। উরসুলার বয়েস উনিশ। ছিমছাম তন্বী মেয়েটি বড়ো বড়ো চোখ, গোলগাল মুখে সর্বদা খুশির গোলাপি আভা। সে–রঙের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভ্যান গকের নেশা ধরেছে।

খেতে বসল। উরসুলার পরিবেশনের হাতে ত্বরিত স্বচ্ছন্দ গতি। ভ্যান গকের বয়েস একুশ, প্রথম প্রেম। ভাবে, বাকি জীবনের প্রতিটি সকালে উরসুলার পরিবেশিত প্রাতরাশ যদি সে খেতে পায়, তবেই-না জীবন তার ধন্য হবে!

রাঙা–ঠোটে হাসি ফুটিয়ে উরসুলা বললে—মনে আছে সেই যে বিচি পুঁতেছিলেন বাগানে? তার অঙ্কুর বেরিয়েছে।

—তাই নাকি? দেখাবে চলো তো?

—কী বুদ্ধি! নিজের হাতে পুঁতেছেন, আর এখন দেখিয়ে দেব আমি? ঢোক গিলল ভিনসেন্ট। যেমন চেহারাটা তার লম্বা-চওড়া, তেমনি কথাবার্তাও তার আড়ষ্ট। ঠিক কোন কথাটি কখন উরসুলাকে বলতে হবে তা চট করে তার মাথায় আসে না।

দুজনে গেল বাগানে। এপ্রিল মাস আপেল গাছে মঞ্জরি ধরেছে। ক-দিন আগে ভিনসেন্ট বীজ পুঁতেছিল সুইট-পি আর পপির। মাটি ফুঁড়ে উঠেছে সবুজ কিশলয়। দুই পাশে উবু হয়ে বসে দেখতে লাগল দুজনে। ভিনসেন্টের নাকে উরসুলার কেশসুরভি।

-উরসুলা! অস্ফুট গলায় বললে ভিনসেন্ট।

মাথাটি হেলিয়ে হাসিমুখে মেয়ে বললে—বলুন।

-আমি—আমি…মানে, আমি বলছিলাম কি—

-কী হল? অত আমতা আমতা কীসের?

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পেছনের পাঠশালাবাড়ির দিকে পা বাড়ালে উরসুলা। ঠিক সময়ের কথাটি জোগায় না ভিনসেন্টের মুখে। সে শুধু চলল সঙ্গে সঙ্গে।

উরসুলা আবার বললে—এখুনি আমার ছাত্ররা এসে পড়বে। আপনার ও গ্যালারিতে যেতে দেরি হচ্ছে না?

– না, দেরি কীসের? স্ট্র্যান্ডে পৌঁছোতে কতক্ষণ? বড়োজোর পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আর কথা নেই কারও মুখে। একটু অস্বাভাবিক স্তব্ধতা। দু-হাত তুলে ঘাড়ের পেছনের একটি অবাধ্য কেশগুচ্ছকে উরসুলা সংযত করতে লাগল। পেলব দেহতটে ফুটে উঠল সুপুষ্ট বঙ্কিম রেখা। তারপর বললে—আমার পাঠশালার জন্যে ব্রাবান্টের যে-ছবি দেবেন বলেছিলেন, তার কী হল?

কৃতার্থ ভিনসেন্ট বললে—সিজার দ্য ককের একটা ছবির প্রিন্ট শিল্পীর কাছেই পাঠিয়েছি। নিজের হাতে তিনি সেটাতে সই করে দেবেন তোমার জন্যে।

কী চমৎকার! এই জন্যেই তো মাঝে মাঝে আপনাকে ভারি ভালো লাগে! সর্বশরীরে একটা মধুর হিল্লোল তুলে সে ফিরে দাঁড়াল যাবার জন্যে। ভ্যান গক তাড়াতাড়ি তার হাত চেপে ধরে তাকে থামাল। অনেক সাহস করে বললে—জানো! কাল রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ার আগে তোমার একটা নতুন নাম আমি আবিষ্কার করেছি। নামটা হচ্ছে

খিলখিল করে হেসে উঠল উরসুলা। বললে—বটে? ইয়ার্কি? দাঁড়ান, মাকে ঠিক বলে দেব!

হাসির লহর তুলে ভ্যান গকের হাত ছাড়িয়ে সে দৌড় দিল, অদৃশ্য হয়ে গেল পাঠশালার দরজায়।

মাথায় টপ-হ্যাট, হাতে দস্তানা—ভিনসেন্ট বার হল ক্ল্যাপহ্যামের রাস্তায়। লন্ডনের দূর পাড়া এটা, ফাঁকা ফাঁকা বাড়ি। বাগানে বাগানে লাইলাক হথর্ন আর লাবানাম ফুলের মেলা।

সোয়া আটটা মাত্র বেজেছে, নটার আগে গুপিলে পৌঁছোতে হবে না। তবু জোরে হাঁটাই তার অভ্যাস। বাড়ি-ঘরের ভিড় ক্রমে বাড়ছে, পথে জুটছে তারই মতো অনেক অফিসযাত্রী। সবাই যেন তার বন্ধু, সবাই যেন মনে মনে জানে কী মধুর তার এই নতুন প্রেমে পড়া।

স্ট্র্যান্ডের ওপর ১৭ নম্বর সাউদাম্পটন এই ঠিকানায় গুপিল অ্যান্ড কোম্পানির লন্ডন শাখার অফিস। সারা ইয়োরোপ জুড়ে এ-কোম্পানির আর্টের বেসাতি।

অফিসে ঢুকেই সামনের ঘরটা মহামূল্য ঘন কার্পেট আর ভারী পর্দা দিয়ে মোড়া। ঘরভরতি বুটন, টার্নার, মিলে প্রভৃতি শিল্পীদের ছবি। একজন কেরানি ডেকে বললে—লিথোগ্রাফ টেবিলে আপনার জন্যে একটা প্যাকেট রয়েছে, নিয়ে নেবেন। দ্বিতীয় ঘরটিতে এচিং আর লিথোগ্রাফের সমাবেশ। তৃতীয় ঘরটি ভিনসেন্টের এলাকা। সবচেয়ে বেশি বিক্রি এই ঘরেই। এ-ঘরে মেলে ছবির প্রিন্ট ছাপা ছবি—ভিনসেন্ট বোঝে, সবচেয়ে সস্তা আর বাজে মাল বিক্রির কাজ নিয়েই সে আছে। ভিড় অবশ্য এ-ঘরেই সবচেয়ে বেশি, সবচেয়ে নির্বোধ ক্রেতার ভিড়। তবে তাতে তার বয়েই গেছে। বিক্রি নিয়ে কথা। যত প্রিন্ট সে বিক্রি করতে পারবে তত না অফিসে তার খাতির বাড়বে!

নিজের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্যাকেটটা সে খুলল। সিজার দ্য কক ছবিটা ফেরত পাঠিয়েছেন। শুধু নাম সই করেই দেননি, নিজের হাতে লিখে দিয়েছেন–ভিনসেন্ট আর উরসুলাকে।

আজ রাত্রে ছবিটা যখন উরসুলাকে দেব, ভিনসেন্ট ভাবতে লাগল—তখন বলব তাকে। কীসের দেরি আর? বাইশ বছরে তো দু-দিন পরেই পড়ব, আর মাসে পাঁচ পাউন্ড তো বাঁধাই!

কোথা দিয়ে হু-হু করে সময় কেটে যায়। তার হাত দিয়ে দৈনিক বিক্রি হয় অন্তত পঞ্চাশটি ছবির ফোটোগ্রাফ। কত পয়সা সে কোম্পানির জন্যে কামাচ্ছে। অফিসের অন্যান্য কেরানিদের সঙ্গে তার খুব ভাব। বেশ কিছুটা সময় যায় তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করেও। আগে কিন্তু এমন ছিল না। লোকজনকে সে তখন এড়িয়ে চলত, মিশতে পারত না সহজভাবে। সহকর্মীরাও ভাবত, কেমন পাগলাটে যেন লোকটা। উরসুলাই তার স্বভাবটা একেবারে বদলে দিয়েছে। তাকে চেনার পর থেকেই আসক্তি এসেছে সহজ হবার স্বাভাবিক হবার, সকলের পরিচিত ও প্রিয় হবার।

ছ-টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হল দিনের কাজ। পথে বার হবার মুখে দরজার সামনে মি. ওবাক ভিনসেন্টকে দাঁড় করালেন। বললেন, তোমার কাকা চিঠি লিখেছেন তোমার খোঁজখবর নিয়ে। আমি তাঁকে লিখলাম তুমি চমৎকার কাজ করছ, এখানকার শ্রেষ্ঠ কর্মীদের তুমি একজন।

-অনেক ধন্যবাদ আপনাকে স্যার!

-আর শোনো, আমি ঠিক করেছি গরমের ছুটির পর তোমাকে মাঝের ঘরে নিয়ে আসব, এচিং আর লিথোগ্রাফ বিক্রির ভার তোমাকে দেব।

-আমার মস্ত সৌভাগ্য সেটা হবে স্যার। কেননা, মানে—মানে কিনা—আমি ভাবছি আমি বিয়ে করব।

-তাই নাকি? বাঃ! এ তো খুব ভালো খবর! কবে হে? বেশ বেশ, খুব ভালো। বিয়ে-থাওয়া করে ছুটি থেকে ফিরে এসে তোমার মাইনের কথাটা মনে করিয়ে দিয়ো আমাকে, দেখব একটা ভালো ব্যবস্থা তখন করতে পারা যায় কি না। কেমন?

রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর ভিনসেন্ট বললে—তোমার ছবি এসে গেছে উরসুলা।

-তাই নাকি? উঃ কী মজা!

-একটা আলো নিয়ে চলো, ছবিটা একেবারে পাঠশালার দেয়ালে টাঙিয়ে দিয়ে আসি।

আড়চোখে উরসুলা তাকাল ভিনসেন্টের দিকে, ঠোঁট দুটি এমন করে ফোলাল, ঠিক যেন তারা একটি চুমুরই প্রত্যাশী। বললে—এক্ষুনি কী করে! মাকে এখন সাহায্য করতে হবে না? ঠিক আধ ঘণ্টা পরে যাব, কেমন?

নিজের ঘরে পৌঁছেই ভিনসেন্ট দাঁড়াল আরশিটার সামনে। নিজের চেহারা সম্বন্ধে এতদিন সে সচেতন ছিল না, এ নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকারই হয়নি হল্যান্ডে থাকতে। সে জানতই যে ইংরেজদের তুলনায় তার মুখ আর মাথা অনেকটা ভারী ভারী দেখতে। আরশিতে যে-মুখটা ফুটে উঠল তার পাহাড়ে কপালের নীচে গভীর খোদলে ঢোকা দুটি চোখ, খাঁড়ার মতো উঁচু আর সামনের দিকে ঝুঁকে-পড়া নাক, মোটা কালো ঘন ভ্রূ, সুপুষ্ট কামুক দুটি ঠোট, চওড়া চোয়াল আর মস্ত কড়া চিবুক, খাঁটি হল্যান্ডবাসীর চরিত্র এই চিবুকেই প্রকাশ।

আরশির কাছ থেকে সরে সে অলসভাবে এসে বসল বিছানার ধারে। হল্যান্ডে নিজের পরিবারের খুব কড়া বিধানের মধ্যে সে মানুষ হয়েছে। এর আগে কোনো মেয়েকে সে ভালোবাসেনি। চোখ তুলে তাকাতেই শেখেনি কোনো মেয়ের দিকে, হালকা আলাপের সুযোগ পাওয়া তো দূরের কথা। উরসুলার প্রতি তার এই যে প্রেম এতে লালসার মালিন্য নেই। সবে তার যৌবন, নব যৌবনের আদর্শধৌত এই তার প্রথম প্ৰেম।

ঘড়িতে দেখল পাঁচটা মিনিট মোটে কেটেছে। আরও পঁচিশ মিনিট বাকি, দুস্তর কাল! মার চিঠির খামের মধ্যে থেকে আর-একটি চিঠি বার করে সে আর–একবার পড়তে শুরু করল। ভাই থিয়ো লিখেছে। ভিনসেন্টের থেকে থিয়ো চার বছরের ছোটো। ব্রুসেলসে গুপিলের দোকানে ভিনসেন্টের জায়গায় সে এখন লেগেছে। বাবা থিয়োডোরাস আর কাকা ভিনসেন্টের মতো ভিনসেন্ট আর থিয়ো এই দুই ভাইয়ের অন্তরঙ্গতা ছেলেবেলা থেকেই।

টেবিল থেকে কাগজ টেনে নিয়ে ভাইকে চিঠি লিখতে বসল সে। চিঠি লেখা শেষ হতে ড্রয়ার থেকে টেনে বার করল কয়েকটি পেনসিলস্কেচ। টেমসের বাঁধে এগুলি তার আঁকা। স্কেচগুলি সে আলাদা একটা খামে ভরল, সঙ্গে জাক-এর আঁকা ‘তলোয়ার হাতে যুবতী’ ছবিখানির একটি ফোটোগ্রাফ। চিঠি আর ছবি সব যাবে থিয়োর কাছে।

হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠল। আরে, ভুলেই গিয়েছিলাম উরসুলার কথা যে! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে, দেরি হয়ে গেছে পনেরো মিনিটেরও বেশি। তাড়াতাড়ি ঢেউ-খেলানো লাল চুলের রাশের ওপর একবার চিরুনি বুলিয়ে সে টেবিল থেকে সিজার দ্য ককের ছবিটা হাতে নিয়ে দৌড়ে বার হল ঘর থেকে।

নীচে বসবার ঘরে উরসুলা তখন তার খুদে ছাত্রদের জন্যে কয়েকটা কাগজের পুতুল বানাচ্ছিল। ভিনসেন্ট ঘরে পা দিতেই সে বলে উঠল—বাঃ, আমি তো ভাবলাম ভুলেই বুঝি গেলেন আপনি। কই, আমার ছবি এনেছেন? দেখি, দেখি—

-না, এখন না। আগে টাঙিয়ে দিই, তারপর দেখো। আলো কই?

-মার কাছ থেকে নিয়েই আসুন না!

রান্নাঘর থেকে আলো নিয়ে আসতেই উরসুলা ভিনসেন্টের হাতে দিল আশমানি রঙের সিল্কের একটা স্কার্ফ তার কাঁধে জড়িয়ে নেবার জন্যে। ভালো লাগল সেই স্পর্শটুকু। বাগানে আপেলমঞ্জরির সুরভি। অন্ধকার পথে উরসুলা নরম আঙুলগুলি রেখেছে তার কালো মোটা কোটের হাতায়। একবার হোঁচট খেতেই সে শক্ত করে চেপে ধরল তার বাহু, নিজেরই অসাবধানতায় হেসে উঠল খিলখিল করে। নিজে নিজে হোঁচট খেলে তাতে আবার হাসবার কী আছে বুঝতে পারে না ভিনসেন্ট, তবে সেই হাসি উরসুলার আবছা দেহবল্লরীতে যে-হিল্লোল তোলে তা দেখতে ভালোই লাগে। পাঠশালার ছোটো দরজাটা সে খুলে দাঁড়াল, উরসুলা আগে ঢুকল। যাবার সময়ে উরসুলার মুখটা যেন বড়ো কাছাকাছি এল তার মুখের, কেমন রহস্যভরা চোখে তাকাল উরসুলা তার চোখে।

টেবিলের ওপর আলোটা নামিয়ে রাখল ভিনসেন্ট।

-কোনখানে ছবিটা টাঙাব বলো?

-ঠিক আমার ডেস্কের ওপরের দেয়ালে। তাই ভালো হবে না?

সারা ঘর জুড়ে গোটা পনেরো ছোটো ছোটো টেবিল আর বেঞ্চি। এক ধারে একটি উঁচু প্ল্যাটফর্ম, তার ওপর উরসুলার ডেস্ক আর চেয়ার। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবিটাকে তুলে ধরল দেয়ালে। হাত ঠিক রাখতে পারছে না ভিনসেন্ট, যতবারই পেরেকটি বসতে যায় ঠিক জায়গায়, হাত থেকে খসে পড়ে মাটিতে। হেসে ওঠে উরসুলা, বড়ো নিবিড় আর নিকট সেই হাসি।

বলে, দুর বোকা, পারে না! সরুন, আমাকে দিন।

মাথার ওপর যুগল বাহু উঁচু করে তুলে নিপুণভাবে সে কাজ শুরু করল, সারা দেহের স্পষ্ট পরিচ্ছন্ন রেখায় চঞ্চল যৌবনের সাড়া। সহসা ভিনসেন্টের মনে হল, স্বল্প আলোর এই প্রায়ান্ধকারে দু-হাতে সে জড়িয়ে ধরুক উরসুলাকে, আশা–নিরাশার সমস্ত যন্ত্রণার অবসান হোক একটি দ্বিধাবিহীন আলিঙ্গনে। উরসুলার সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি হচ্ছে বারে বারে, কিন্তু ঠিক সুযোগটি মিলছে না একবারও। আলোটা সে উঁচু করে ধরল, ছবির নীচের লেখাগুলি পড়ে খুশিতে হেসে উঠল আবার। তার পুলকিত দেহের আঁকুবাকুকে আলিঙ্গনে কি ধরা যায়?

উরসুলা বললে—আপনার বন্ধু তাহলে তো আমারও বন্ধু হয়ে গেলেন, তাই না? একজন খাঁটি শিল্পীর সঙ্গে ভাব হবে, এ আমার কতদিনের স্বপ্ন!

ভিনসেন্ট চাইল এমন একটি কথা বলতে যাতে মুহূর্তটি মধুর হয়, আসল প্রস্তাব করাটা তারপরে সহজ হয়ে ওঠে। উরসুলা মুখ ফিরিয়েছে তার দিকে। লন্ঠনের আলো উরসুলার চোখে ছোটো ছোটো ফুলকি ফুটিয়েছে। মুখখানি তার আবছায়ায় ঢাকা, সে-মুখের মসৃণ শুভ্রতার মাঝে লাল দুটি ঠোটের ইঙ্গিতে হঠাৎ দোলা লাগে রক্তে।

একটু স্তব্ধতা। এবার কথা বলুক ভিনসেন্ট, যাহোক অর্থহীন কথা; ভালোবাসার কথা। সেই কথার প্রতীক্ষাই তো উরসুলা করছে এই মুহূর্তের অর্থপূর্ণ স্তব্ধতায়। জিভ দিয়ে ঠোটটা সে ভিজিয়ে নিল মাত্র কয়েক বার। দেরি হয়ে গেল, মুখ ঘুরিয়ে নিল উরসুলা, মৃদু একটু কাঁধ-ঝাঁকুনি দিয়ে পেছন ফিরে ছুটে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে।

সুযোগ বুঝি হারিয়ে যায়! আতঙ্কচকিত ক্ষিপ্রতায় সে দৌড়োল উরসুলার পেছনে।

-দাঁড়াও, উরসুলা, থামো একটু দয়া করে!

মুহূর্তে থমকে দাঁড়াল তরুণী, তাকাল তার দিকে। অন্ধকার আকাশে তারাগুলি জ্বলজ্বলে। বাতিটা পাঠশালাতেই পড়ে রয়েছে, রান্নাঘরের জানলা দিয়ে একটুমাত্র আলোর আভা। কাছে পৌঁছোতেই নাকে লাগল উরসুলার কেশসুরভি। একটু কেঁপে উঠে উরসুলা স্কার্ফটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে বুকের সামনে দু-হাত জড়ো করে নিলে।

-এ কী উরসুলা, তোমার যে ঠান্ডা লাগছে!

-তা লাগছে। ঘরে চলুন।

রাস্তা আটকে দাঁড়াল ভিনসেন্ট। না উরসুলা, না!

স্কার্ফ দিয়ে থুতনি ঢেকে আশ্চর্য-হওয়া বড়ো বড়ো চোখ মেলে উরসুলা ভিনসেন্টের দিকে চাইল। বললে—কেন মশিয়েঁ ভ্যান গক, আপনার কথা আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!

–না না, কিছু না। তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাইছিলাম। মানে কী না, আমি—আমি বলছিলাম কী—

-কথা এখন থাক। বড্ড শীত করছে আমার–

-শোনো শোনো। খবরটা তোমাকে দিই। জানো, আজ কাজে আমার উন্নতি হয়েছে। লিথোগ্রাফরুমে কাল থেকে আমি যাচ্ছি। এই নিয়ে এ-বছরেই দু-বার আমার মাইনে বাড়ল।

এক পা পিছিয়ে গেল উরসুলা। গলা থেকে স্কার্ফটা সরিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে কঠিন ঠান্ডা গলায় বললে—আসলে আপনার কী বক্তব্য তা জানতে পারি?

নিজেকে ধিক্কার দিল ভিনসেন্ট। উরসুলার কণ্ঠে এ কী দূরত্বের আভাস! মূর্খ সে, কেন সে সংযত করতে পারে না নিজেকে! একটু থেমে মনের সমস্ত শক্তি সংহত করে আস্তে আস্তে স্পষ্ট ভাষায় সে বলতে লাগল—তোমাকে যা আমি বলতে চেষ্টা করছি উরসুলা, তা তুমিও নিশ্চয়ই জানো। আমি তোমাকে ভালোবাসি, সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। তুমি যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হও তাতে জীবন আমার সার্থক হবে।

লক্ষ করল ভিনসেন্ট, তার প্রস্তাবের এই স্পষ্টতায় উরসুলা যেন চমকে উঠল একটু। এইবার কি তাকে আলিঙ্গন করার ক্ষণটি এসেছে?

কিন্তু উত্তর দিতে দেরি করল না উরসুলা। গলাটা চড়িয়ে বললে—বিয়ে? আপনাকে? এ অসম্ভব!

–এবার কিন্তু তোমার কথা আমিই বুঝতে পারছি না উরসুলা!

-কী আশ্চর্য! আপনি জানতেন না যে এক বছরের ওপর হল আমি বাগদত্তা?

নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে গেল ভিনসেন্ট, কতক্ষণ পরে নিষ্প্রাণ প্রেতকণ্ঠে শুধু বললে—কে সে ভাগ্যবান?

-ওহো, ঠিকই তো। আমার ভাবী স্বামীর সঙ্গে আপনার আলাপ হয়নি। আপনি আসার আগে আপনার ওই ঘরেই সে থাকত। তবে আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো জানেন—

-কী করে জানব বলো?

না, মানে, আমি ভেবেছিলাম কী, উরসুলা একবার রান্নাঘরের জানলার দিকে তাকিয়ে বললে—আমার ধারণা ছিল কারুর কাছে আপনি হয়তো শুনেছেন।

ভিনসেন্টের গলায় আর কোনো দ্বিধা নেই। স্পষ্ট সে প্রশ্ন করলে—তুমি কেন আমাকে বলোনি? এই এক বছরের মধ্যে কেন কথাটা গোপন রেখেছিলে? বুঝতে পারোনি ‘দিনে দিনে তোমার ভালোবাসায় আমি পড়ছি?

-বাঃ! তাতে আমার কী দোষ? আমি তো আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই চেয়েছিলাম।

ভিনসেন্ট জিজ্ঞাসা করলে—আমি এ-বাড়িতে আসার পর থেকে সে কি কোনোদিনই আসেনি তোমার সঙ্গে দেখা করতে?

-না। এখন সে ওয়েলসে। গরমের ছুটিতে আসবে এখানে।

-এক বছর তাকে দেখনি? তাহলে এক বছরে তাকে তো ভুলেই গেছ! এখন যাকে তুমি ভালোবাস সে হচ্ছে আমি। আমি—আমি ছাড়া আর কেউ নয়। ছিঁড়ে ফেলল স্থৈর্যের বন্ধন। সবল হাতে উরসুলাকে জড়িয়ে ধরল ভিনসেন্ট, তার মুখ ভরে দিল অবাঞ্ছিত কঠিন চুম্বনে চুম্বনে। চুম্বন করল তার চুলের গুচ্ছ। বাঁধন-ছাড়া প্রেম মুহূর্তে যেন পাগল হয়ে গেল।

-উরসুলা, উরসুলা, লক্ষ্মীটি! কে বলেছে ও-লোকটাকে তুমি ভালোবাস? কিছুতেই না। তোমার ভালোবাসা আমার, তুমি আমার! আমাকে বিয়ে তোমায় করতেই হবে। ওকে ভুলে যদি না যাও, আমাকে বিয়ে যদি না কর, কিছুতেই তোমাকে আমি ছাড়ব না। বলো বলো, কথা দাও, উরসুলা!

-আপনাকে বিয়ে করব? বললেই হল! পাগল নাকি আমি আপনার মতো? ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি এক্ষুনি, নইলে ঠিক আমি চেঁচাব! ছেড়ে দিন!

একঝটকায় নিজেকে মুক্ত করে নিল উরসুলা। তারপর রুদ্ধশ্বাসে দৌড় দিল বাড়ির দিকে। রান্নাঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে একবার সে পেছন ফিরে তাকাল। তারপর দাঁতে-দাঁত-চাপা মৃদু কণ্ঠে হানল প্রচণ্ড আঘাত—

বোকা, লালচুলো বোকা কোথাকার!

পরদিন সকাল বেলা কেউ তাকে ঘুম থেকে ডাকল না। ক্লান্তি ভরা দেহে মনে নিজেই সে বিছানা ছেড়ে উঠল। কোনো রকমে ক্ষুরটা গালে মুখে বোলাল, ভালোভাবে দাড়ি কামানো হল না তাতে। খাবার সময় উরসুলা সামনে এসে দাঁড়াল না। নিঃশব্দে প্রাতরাশ সেরে সে পা বাড়াল গুপিলসের পথে। রাস্তায় গতকাল যেসব লোক চোখে পড়েছিল, আজও তারাই চোখে পড়ল। কিন্তু লোকগুলো সবাই বদলে গেছে নাকি? সবাই যেন আশাহারা নিঃসঙ্গ জীব, চলেছে নিরর্থক পরিশ্রমের দিনযাত্রায়। পথের ধারের চেস্টনাট গাছের সার আর লাবানাম ফুলের মেলা আজ আর ভিনসেন্টের চোখে পড়ল না। ব্যর্থ হল বসন্তসূর্যের উজ্জ্বলতর রশ্মিপাত।

সারাদিনে কাজ সে কম করল না। ইনগ্রেসের অনুকরণে ভিনাস অ্যানোডোমিনি ছবির রঙিন প্রিন্টই তো বেচল প্রায় কুড়িটা। এগুলোতে খুব লাভ, কিন্তু এতে তার আর উৎসাহ নেই। কোম্পানির লাভ কম বা বেশি হোক, কী এসে যায় তার! ক্রেতাদের সঙ্গে ধৈর্য ধরে ব্যবহার করে যাওয়া অসম্ভব মনে হতে লাগল বারে বারে। আশ্চর্য ওরা! আর্টের কী যে ভালো আর কী মন্দ; তা-ই যে শুধু ওরা বোঝে না তা নয়; যা নিতান্ত মেকি আর সাধারণ আর সস্তা; তা-ই পছন্দ করার ক্ষমতা ওরা পেল কোথা থেকে!

সহকর্মীরা ভিনসেন্টকে খুব একটা আমুদে লোক বলে কখনওই ভাবত না, তবে কিনা এতদিন সে চেষ্টা করছিল সহকর্মীদের সঙ্গে মোটামুটি ভদ্র আর মিশুক হয়ে থাকতে। আজ আর তার দরকার নেই।

একটি কেরানি জিজ্ঞাসা করল অপরকে—ভ্যান গক পরিবারের বিখ্যাত বংশধরটির আজ সারাদিন কী হয়েছে বলো তো? কী ভাবছে এত?

কাল রাত্রে বোধ হয় সুনিদ্রা হয়নি, আর কী?

ঠিক বলেছ। সত্যিই তো, ওর তো দুশ্চিন্তার অবধি নেই! ভিনসেন্ট ভ্যান গকের ভাইপো, যে কিনা প্যারিস বার্লিন আর ব্রুসেলসের সমস্ত গুপিল গ্যালারিগুলোর অর্ধেক মালিক। বুড়োর তো ছেলেপুলে নেই, রোগেও ভুগছে। সবাই জানে তার অংশের অন্তত আধাআধি ছোকরার কপালে নাচছে!

হুঁ, কপাল কি আর তোমার-আমার মতো?

আহা, বাকি অর্ধেকটা শোনো! আর-এক খুড়ো হেনড্রিক ভ্যান গক হচ্ছেন ব্রুসেলস প্যারিস আর আমস্টার্ডামের বড়ো বড়ো দোকানগুলোর মালিক, আর তৃতীয় খুড়ো কর্নেলিয়াস হচ্ছেন সারা হল্যান্ডের সবচেয়ে জাঁদরেল আর্ট কারবারি। সারা ইয়োরোপের ছবি বিক্রির ব্যাবসা এই ভ্যান গরু পরিবারের একচেটে। আর হয়তো আমাদের পাশের ঘরের লালচুলো বন্ধুটির হাতের মুঠোয় এর সবকিছু আসবে একদিন।

রাত্রে যখন লয়্যারদের খাবার ঘরে ভিনসেন্ট ঢুকল দেখল মেয়ে আর মা নীচু গলায় কী কথাবার্তা বলছে। তাকে দেখেই দুজনে চুপ করল। উরসুলা দৌড়ে অন্তর্ধান করল রান্নাঘরের মধ্যে। মাদাম লয়্যারের চোখে কঠিন দৃষ্টি। তিনি বললেন শুধু—গুড ইভনিং।

বড়ো টেবিলটার ধারে একলা বসে ভিনসেন্ট ডিনার সারল। উরসুলা কথায় তাকে আঘাত দিয়েছে, আঘাত দিচ্ছে ব্যবহারে। কিন্তু হার সে মানবে না। উরসুলার ‘না’-কে সে ‘হ্যাঁ’ করাবেই।

সাত দিন কেটে যাবার পর একদিন সে উরসুলার সঙ্গে আবার কথা বলার সুযোগ পেল। এতদিন সে ভালোভাবে খায়নি, ঘুমোয়নি। বিশ্রান্তি আর দুশ্চিন্তা দুর্বল করেছে তার নার্ভগুলোকে। চোখের সবুজ রং মিলিয়ে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠেছে বেদনাব্যথিত নীলাভা। আড়ষ্টতা আরও বেড়েছে।

সে-দিন রবিবার। সান্ধ্যভোজের পর বাগানে উরসুলাকে সে ধরল। বললে—মাদমোয়াজল উরসুলা, সে-দিনকার ব্যবহারের জন্যে আমি খুব লজ্জিত।

ওঃ, তাতে কী? কিছুই হয়নি সে-দিন। ভুলে যান সে-দিনকার কথাটা।

আমার সে-দিনের ব্যবহারটা যদি ভুলে যাও তাহলে অনুগৃহীতই হব। তবে সে-দিন যা বলেছিলাম, তা কিন্তু সত্যি।

এক পা এগোল ভিনসেন্ট। সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে গেল উরসুলা।

ও-কথা আবার কেন তুলছেন? ওসব আমি মন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। চলুন ভেতরে যাই। মার কাছে লোক আসবার কথা আছে।

আর কাউকে তুমি যে ভালোবাস তা আমি বিশ্বাস করি না উরসুলা।, তাহলে তোমার চোখ দেখে এতদিনে তা আমি বুঝতে পারতাম।

মাপ করবেন, আমার আর সময় নেই।—ভালো কথা, কবে যেন আপনি ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছেন?

ঢোক গিলে ভিনসেন্ট বললে, জুলাইতে।

ভালোই হল। আমি যাকে বিয়ে করছি সে জুলাই মাসেই ছুটি নিয়ে এখানে বেড়াতে আসছে। ঘরটা খালি থাকা চাই তার জন্যে।

বিয়ে করবে তোমাকে? আর কেউ? আমি কিছুতেই তা হতে দেব না উরসুলা। তুমি আমার।

দেখুন, এসব কথা আপনি বন্ধ করুন। নইলে, মা বলেছে আপনাকে অন্য বাসা খুঁজে নিতে হবে।

উরসুলা চলতে শুরু করল। ভিনসেন্ট তাড়াতাড়ি তার পাশে গিয়ে বললে–তবু আমাকে আবার বলতে হবেই উরসুলা। তুমি জান না কী ভয়ংকর আমি তোমাকে ভালোবাসি। কেন তুমি এমনি করে আমাকে এড়াতে চাও?

.

আরও দুটি সপ্তাহ কাটল। সে ব্যর্থ প্রেমিক, নির্বান্ধব নিঃসঙ্গ সে। উরসুলাকে পাওয়া যদি-বা অসম্ভব, উরসুলার ধ্যানে বাধা দেবে কে? সহকর্মীদের সঙ্গে সামান্য সহযোগিতাটুকুও তার ঘুচল। ঘুচল সবকিছুরই প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ। যে-আলো জ্বলেছিল প্রেমের ইন্ধনে, নিভে গেল তা একেবারে। যেমন নিঃসঙ্গ গম্ভীর একগুঁয়ে ছিল তার স্বভাব জুন্ডেয়ার্টে থাকতে, ফিরে এল আবার সেই চরিত্র।

জুলাই এল। মিলল দু-সপ্তাহের ছুটি। লন্ডন ছেড়ে যেতে তার ভয় করে। সে যতক্ষণ এ-বাড়িতে থাকবে ততক্ষণ উরসুলা আর কাউকে ভালোবাসতে পারবে না নিশ্চয়ই।

নীচে বসবার ঘরে সে নামল। মা মেয়ে বসে আছে। তাকে দেখেই দুজনে দুজনের দিকে অর্থবোধকভাবে একবার তাকাল।

সে বললে—আমি শুধু একটা সুটকেস সঙ্গে নিচ্ছি মাদাম লয়্যার। আমার জিনিসপত্র সবকিছু ঘরে রইল। আর যে দু-সপ্তাহ আমি থাকব না এই রাখুন তার ভাড়া।

মাদাম বললেন—আমি বলছিলাম কী, আপনার বাকি সব জিনিসপত্রও এইসঙ্গে আপনি নিয়ে যান।

কিন্তু কেন?

আসছে সোমবার সকাল থেকে আপনার ঘরে নতুন ভাড়াটে আসছে। আমাদের ইচ্ছে আপনি অন্যত্র কোথাও থাকুন।

আপনি বলছেন ‘আমাদের ইচ্ছে’? ফিরে সে তাকাল উরসুলার দিকে গর্তে-ঢোকা করুণ চোখ মেলে। সে-দৃষ্টিতে বক্তব্য কিছু নেই, একটু শুধু ব্যথিত প্রশ্ন।

হ্যাঁ, আমাদের ইচ্ছে। আমার মেয়ের বিয়ে, ঠিক হয়েছে। জামাই চান না যে আপনি এ-বাড়িতে থাকেন। সত্যি কথা বলতে, মিস্টার ভ্যান গক, আপনি যদি কখনও এখানে না আসতেন তাহলেই হতো সবচেয়ে ভালো।

ব্রেডা স্টেশনে ছেলের জন্যে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন থিয়োডোরাস ভ্যান গক। গায়ে তাঁর সাদা খড়মড়ে-ইস্ত্রি-করা শার্টের ওপর ভারী কালো পাদরি-কোট, সরু খাড়া কলারের ওপর বিরাট একটা কালো বো-টাই। ভিনসেন্টের সর্বাগ্রে চোখে পড়ল বাবার মুখের বৈশিষ্ট্যটা। চোখের ডানপাতাটা বাঁ-পাতার চাইতে বেশি ঝুলে পড়া। মুখের বাঁ-দিকটা ডানদিকের চেয়ে বেশি শীর্ণ ও রেখাঙ্কিত। স্থির গম্ভীর দৃষ্টি, ভাবটা এই—দেখো এই আমি।

জুন্ডেয়ার্টের লোকেরা প্রায় বলত যে ডমিনি থিয়োডোরাস সিল্কের উঁচু টুপি মাথায় দিয়ে পরোপকার করে বেড়ান।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভিনসেন্টের বাবার মনে এই প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল, প্রতিষ্ঠার উচ্চতর শিখরে পৌঁছোতে তিনি পারলেন না কেন? কেন এত দিনের মধ্যে কখনও আমস্টার্ডাম বা হেগ শহরের মতো জায়গার কোনো গির্জায় তিনি বদলি হলেন না? কেন সারাজীবন কাটল এইভাবে? চেহারায় তিনি সুপুরুষ, শিক্ষা তাঁর যথেষ্ট, স্নেহশীলতা ধৈর্য চরিত্রবল প্রভৃতি সর্বগুণের তিনি অধিকারী, ধর্মকর্মের প্রত্যক্ষ উৎসাহে তাঁর ক্লান্তি নেই কখনও। কিন্তু পঁচিশ বছর ধরে এই অজ্ঞাত জুন্ডেয়ার্ট গ্রামে তিনি পড়ে আছেন, নিতান্ত অবহেলিত হয়ে। তাঁরা ছ-ভাই। আর পাঁচ ভাইকে একডাকে সারা দেশের লোক চেনে, তিনিই শুধু ভাগ্যহীন।

বাজারের সামনেকার বড়ো রাস্তার প্রান্তে কাঠের একটি বাড়ি। এই হচ্ছে পাদরির বাসগৃহ। রান্নাঘরের পেছনে ছোট্ট একটি বাগান, সরু সরু পায়ে-চলা পথের এ-ধারে ও-ধারে রকমারি ফুলগাছের কেয়ারি করা বাগান। তার পেছনেই বড়ো বড়ো গাছের আড়ালে ছোট্ট কাঠের তৈরি গির্জাটি। গির্জার দুই পাশে দুই দেয়ালে ছোট্ট ছোট্ট প্লেন কাচের গথিক জানলা, মেঝেয় পাতা ডজন খানেক কাঠের শক্ত বেঞ্চি। পাদরির আসনের পেছনে কয়েক ধাপ সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি-কটি উঠলে পুরোনো অর্গ্যানটি যেখানে আছে সেখানে পৌঁছোনো যায়। আড়ম্বরবিহীন এই উপাসনাগৃহ ক্যালভিনের ধর্মবিপ্লবের সাক্ষী।

গাড়ি এসে দাঁড়াল বাড়ির দরজায়।

ভিনসেন্টের মা আনা কর্নেলিয়া প্রতীক্ষা করছিলেন জানলায় দাঁড়িয়ে, ছুটে এলেন তিনি। স্নেহকরুণ আগ্রহে ছেলেকে বুকে নিতেই হঠাৎ তাঁর মনে হল, কী যেন একটা হয়েছে ছেলের!

আনা কর্নেলিয়ার নীলাভ সবুজ চোখে সর্বদা যেন মৃদু কৌতূহলের আভাস। সে-চোখ মানুষের মর্মস্থল পর্যন্ত পৌঁছোয় সহজ ঔৎসুক্যে, কিন্তু কখনও বিচারের দাবিতে কঠিন হয়ে ওঠে না। মানুষ পাথর নয়, তার বেদনা আছে, কামনা আছে, যেমন প্রলোভন আছে তেমনি আছে ব্যর্থতা—তা তিনি বোঝেন; সে-উপলব্ধি ক্ষমা আর সহানুভূতিতে মেদুর। তাঁর স্বামী যেখানে আদর্শের বিচারে কঠোর, তিনি সেখানে সংবেদনকরুণ।

বাবার ঘরেই সকলের আড্ডা। রাত্রের খাওয়াদাওয়ার পর ঘরোয়া কথাবার্তা এই খাবার টেবিলেই জমে। আনা কর্নেলিয়ার মনে কেমন একটা দুশ্চিন্তা, ছেলে রোগা হয়ে গেল কেন এতটা! আচারে ব্যবহারেও কেমন যেন ছটফটে অশান্ত ভাব।

সাপার শেষ হবার পর তিনি ভিনসেন্টকে শুধোলেন—হ্যাঁ রে, কী হয়েছে বল তো? তোর শরীরটা তো বড়ো কাহিল দেখছি।

কিছু না। কিছুই হয়নি মা।

বাবা জিজ্ঞাসা করলেন—লন্ডন লাগছে কেমন তোমার? ওখানে ভালো না, লাগে তো তোমার ভিনসেন্ট কাকার সঙ্গে কথা বলি, প্যারিসের কোনো দোকানে তোমাকে বদলি করুক।

হঠাৎ যেন চমকে উঠল ভিনসেন্ট। উত্তেজিত গলায় বললে–না না, খুব ভালো; লন্ডন আমার খুব ভালো লাগছে, আপনি আবার ও নিয়ে কাকাকে কিছু বলবেন কেন?

একটু সামলে নিয়ে সে কথাটা শেষ করল—মানে, আমি বলছিলাম কী, কাকা যদি আমাকে কোথাও বদলি করতে চান, তা তিনি নিজেই করবেন, তা-ই না?

থিয়োডোরাস বললেন——বেশ তো, তোমার যা ইচ্ছে।

আনা কর্নেলিয়া মনে মনে ভাবলেন, নিশ্চয়ই সেই মেয়েটা। ওর চিঠিপত্রের ধরন কেন বদলেছিল এইবার ঠিক ধরেছি।

গ্রামের প্রান্তে মস্ত জলাভূমি। মাঝে মাঝে পাইন আর ওক গাছের মেলা। সারাদিন ভিনসেন্ট এই প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় একলা। একমাত্র আনন্দের খোরাক ছবি আঁকায়। বাগানের স্কেচ কয়েকটি আঁকে, কয়েকটি বাড়ির জানলা থেকে দেখা শনিবারের বিকেল বেলাকার হাটের বিভিন্ন দৃশ্যের। হাতে যে-সময়টুকু কাগজ পেন্সিল থাকে, সেটুকু সময় ভুলে থাকে উরসুলাকে।

বড়ো ছেলে তাঁর বৃত্তি গ্রহণ করল না, দুঃখ ছিল থিয়োডোরাসের। একদিন ছেলেকে নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন এক অসুস্থ চাষিকে দেখতে, সন্ধে বেলা ফেরবার পথে কথাটা তিনি পাড়লেন।

আমার বাবাও পাদরি ছিলেন ভিনসেন্ট। আমার ইচ্ছা ছিল তুমিও এই বৃত্তিই নাও।

কিন্তু আমি তো কাজ বদল করতে চাইনে বাবা!

না, আমি জোর করছি না, তবে যদি তুমি ইচ্ছে কর, তাহলে আমস্টার্ডামে কাকা জ্যানের কাছে থেকে ইউনিভার্সিটিতে ভরতি হতে পারো। আর তোমার পড়াশুনোর ব্যাপারে রেভারেন্ড স্ট্রিকারও সাহায্য করতে রাজি।

আপনি কি উপদেশ দেন আমি গুপিলদের কাজ ছেড়ে দিই?

না না, তা নয়। তবে ওখানে মনে হয় তুমি খুব সুখী নও। তা ছাড়া লোকে তো কাজও বদলায়, আর এই তো তার বয়স—

তা ঠিক বাবা, কিন্তু গুপিল ছাড়বার আমার ইচ্ছে নেই।

ছুটি শেষ হল। আবার ফিরে যেতে হবে লন্ডনে। আনা কর্নেলিয়া জিজ্ঞাসা করলেন—হ্যাঁ রে, লন্ডনে ওই ঠিকানাতেই চিঠি দেব তো?

ভিনসেন্ট বললে—না, আমি অন্য বাসায় যাব। গিয়ে ঠিকানা জানাব। বাবা বললে—লয়্যারদের বাসা যে তুমি ছাড়বে স্থির করেছ, এতে আমি খুশিই হলাম। পরিবারটাকে আমার মোটেই ভালো লাগেনি।

কথাটা শুনে শক্ত হয়ে উঠল ভিনসেন্ট। থিয়োডোরাসের আড়ালে ছেলের বাহুতে হাত রেখে আনা বললেন—মন খারাপ করিসনে বাছা। কাজকর্মে উন্নতি কর, আমাদের নিজেদের দেশের খুব ভালো মেয়ের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব। সুখী হবি তাতে। এই উরসুলা মেয়েটাকে নিয়ে কিছুতেই সুখী হতে তুই পারতিসনে। ও-মেয়ে আমাদের ধাতেরই নয়।

ভিনসেন্ট ভাবল—মা কেমন করে জানল?

লন্ডনে ফিরে ভিনসেন্ট কেনসিংটন নিউ রোডে বাসা নিল। বাড়িওয়ালি এক নিরীহ প্রকৃতির বুড়ি, রাত আটটা বাজতেই তার ঘরের আলো নেবে। ভিনসেন্ট বিনিদ্র চোখে লড়াই করে নিজের সঙ্গে রাতের পর রাত। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করার পর কখন আবার দরজা খুলে বাড়ি থেকে বার হয়ে ছুটে চলে যায় লয়্যারদের বাড়ির উদ্দেশে।

একলা অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায় উরসুলার গৃহের চারপাশে। এত কাছে, তবু এত দূরে—দুস্তর, অপার দূর! নির্বাক নিঃসঙ্গ অসহ্য যন্ত্রণা। যুক্তিবিহীন আত্মপীড়ন!

এই যন্ত্রণা দিনে দিনে তাকে অপরের বেদনা সম্বন্ধে সচেতন করে তোলে। সঙ্গে সঙ্গে সহজ আর সুলভ চরিতার্থতার প্রতি জাগিয়ে তোলে তীব্র বিতৃষ্ণা। গ্যালারির কাজে তার মন বসে না। কোনো ক্রেতা যদি কোনো সস্তা ছবি সম্বন্ধে তাঁর মত জিজ্ঞাসা করে, সে আর রেখেঢেকে উত্তর দেয় না, বিক্রি হোক আর না হোক। যেসব ছবির মধ্যে শিল্পীর অন্তর্বেদনা পরিস্ফুট, কেবল সেইসব ছবিই তাকে কিছুটা তৃপ্তি দেয়।

–অক্টোবর মাসে একদিন দোকানে এক মহিলার পদক্ষেপ হল। ভদ্রমহিলার বিরাট বপু, গলায় উঁচু লেসের কলার, গায়ে ঝকমকে পোশাক, মাথায় রঙিন পালক-গোঁজা ভেলভেটের টুপি। শহরে তাঁর নতুন বাড়ি উঠছে। ঘর সাজাবার জন্যে ছবি সওদা করতে এসেছেন। তাঁর ভার পড়ল ভিনসেন্টের ওপর।

মহিলাটি বললেন—দামের জন্যে ভেবো না। তোমার দোকানে সবচেয়ে সেরা যে-মাল আছে দেখাও আমাকে। এই ধরো আমার বসবার ঘরের প্ল্যান; পঞ্চাশ ফুট লম্বা, দু-দিকে দুই দেয়াল; একটা দেয়ালের মাঝখানে এই দেখো জানলা….

সমস্ত বিকেলটা ভিনসেন্ট অপব্যয় করল ভদ্রমহিলাটিকে কয়েকটি ভালো ছবির প্রিন্ট বিক্রি করবার চেষ্টায়; রেমব্রাঁ, টার্নার, করো ও ডবিনির ছবি এসব। যা সত্যিকারের ভালো শিল্প তাকে চোখের পলকে বর্জন করার আর যা শিল্প হিসেবে নিতান্ত সস্তা আর নোংরা তা পছন্দ করবার অদ্ভুত ক্ষমতা মহিলাটির। যত সময় কাটে, তাঁর আচার-ব্যবহারে রুচিতে হঠাৎ-উঠতি মধ্যবিত্তের স্থূল বিকৃতি বিষাক্ত করে ভিনসেন্টের মন।

শেষপর্যন্ত পছন্দ শেষ হল। গর্বিত আত্মপ্রসাদে মহিলা বললেন—আঃ, চমৎকার ছবিগুলো কিন্তু বেছেছি, কী বলো?

ভিনসেন্ট বললে—নিশ্চয়ই, তবে কিনা, এত কষ্ট না করে চোখ বুজে যদি কখানা ছবি তুলে নিতেন এর চেয়ে তা মন্দ হতো না।

সাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন মহিলা। সযত্ন-উন্নীত বুক থেকে কপাল পর্যন্ত টকটকে লাল হয়ে উঠল।

কী বললে? কথা বলতে জান না ভদ্রমহিলার সঙ্গে? গেঁয়োভূত কোথাকার!

সক্রোধে তিনি ঘর থেকে বার হয়ে গেলেন। প্রচণ্ড মাথা নাড়ার সঙ্গে টুপির নীল পালক কাঁপতে লাগল।

মি. ওবাক ফেটে পড়লেন বিস্মিত বিরক্তিতে।—মাই ডিয়ার ভিনসেন্ট, তোমার হয়েছে কী? এত বড়ো খদ্দেরকে তুমি অপমান করে তাড়িয়ে দিলে? সারা সপ্তাহের সবচেয়ে মোটা বিক্রিটাই মাটি! এর জবাবদিহি করবে কে?

আমিই করব, ভিনসেন্ট বললে—তার আগে আমার একটি কথার শুধু জবাব দিন। মূর্খ লোককে যাচ্ছেতাই ছবি গছিয়েই কি আমার সারাটা জীবন কাটবে? ছবির একবিন্দু জ্ঞান যাদের নেই, তাদের খোশামোদ করতে হবে দিনের পর দিন, কেননা তারা পয়সার মালিক? আর যারা সত্যি ছবি বোঝে, ভালোবাসে শিল্পকলাকে, তারা শুধু মুখ শুকিয়ে দূর থেকে ফিরে ফিরে যায়, কেননা তারা গরিব। একটা প্রিন্ট কেনবার ক্ষমতাও তাদের নেই। দোকানদার হতে পারি, কিন্তু মানুষও তো আমি? সহ্যের সীমাও তো আছে!

একটু চুপ করে থেকে মি. ওবাক বললেন—সোস্যালিজম আওড়াচ্ছ তুমি! এমনি করলে আমার পোষাবে না। আমি বরং খোলাখুলি তোমার কাকাকে লিখি।

.

বড়োদিন সপ্তাহ খানেক বাকি। লয়্যারদের বাড়ির সামনে জানলার ধারে মস্ত একটা ক্রিসমাস গাছ সাজানো হয়েছে। দিন দুই পরে রাত্রি বেলা ভিনসেন্ট দূর থেকে দেখলে বাড়িভরতি আলো, দরজা দিয়ে লোকজনের আসা-যাওয়া। কানে এল হাসির কলোচ্ছ্বাস। লয়্যাররা বড়োদিনের পার্টি দিচ্ছে। ভিনসেন্ট দৌড়োল।

যাব আজ ওদের বাড়ি। আজ তো শুভদিন, এ-দিনটা আমার বিস্মরণের। ক্ষতি কী আজ ওখানে গেলে!

পরিচিত সিঁড়ি বেয়ে আবার সে উঠল। ধাক্কা দিল দরজায়। কান পেতে শুনল পরিচিত পদশব্দ, পরিচিত কণ্ঠ। এইবার দরজা খুলবে।

খুলল দরজা। ঘরের আলো এসে পড়ল তার মুখে। সামনে উরসুলা, সবুজ রঙের অস্পষ্ট একটি পোশাক তার পরনে। অনাবৃত দুটি বাহু। রূপের আঘাতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল ভিনসেন্টের।

অস্ফুট গলায় সে উচ্চারণ করল—উরসুলা!

উরসুলার মুখে এ কী ভাবোদ্রেক! সেই সে-দিন বাগানে তার মুখে যে রূঢ় ঘৃণাভরা ভাব ফুটে উঠেছিল, এ কি তারই প্রতিচ্ছবি?

চলে যান, চলে যান বলছি!

দরজা বন্ধ হয়ে গেল মুখের ওপর।

.

পরদিন আবার জাহাজে চাপল ভিনসেন্ট। হল্যান্ডেই সে ফিরে যাবে।

ক্রিসমাসের সময় গুপিলের গ্যালারিতে খরিদ্দারের সবচেয়ে ভিড়। মি. ওধা ভিনসেন্টের কাকাকে না লিখে পারলেন না যে তাঁর ভাইপো ছুটির অনুমতিটুকু পর্যন্ত চায়নি, না বলে-কয়ে কাজ ছেড়ে চলে গেছে।

খুড়ো ঠিক করলেন ওকে প্যারিসের গ্যালারিতে নিযুক্ত করবেন।

ভিনসেন্ট সরাসরি ঘোষণা করল, আর্টের ব্যাবসায় তার ইতি। খুবই আঘাত পেলেন কাকা, মর্মাহত হলেন, বললেন—তাঁর যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে, ভাইপোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আর মাথা তিনি ঘামাবেন না কখনও।

ডউরেকট-এ একটা ছোটো বইয়ের দোকানে সামান্য কেরানির কাজ জুটল। যান্ত্রিক কাজ, নিরবলম্ব জীবন। একদিন শনিবার রাত্রে ভিনসেন্ট ডউরেকট থেকে ট্রেনে উঠে উডেনবকে পৌঁছোল। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে জুন্ডেয়ার্ট। অন্ধকার রাত্রে দিগন্তবিস্তীর্ণ ঘুমন্ত মাঠ, বাতাসে শস্যসুরভি, হাঁটাপথের দূরে-অদূরে মধ্যে মধ্যে কালো কালো পাইন গাছ। বাবার পড়ার ঘরে ঝোলানো ঠিক যেন বড়মারের আঁকা ছবিটার মতো। সারা আকাশ জুড়ে পাতলা মেঘ, তার পেছনে তারার উঁকি। শেষ রাত্রে সে পৌঁছোল জুন্ডেয়ার্টের কাছাকাছি। পেছনে ফেলে-আসা শস্যক্ষেত্রে কোথায় লার্ক পাখিরা ডাক শুরু করেছে।

বাবা মা বুঝতে পেরেছেন ছেলের মনে কী বেদনার আক্ষেপ। কয়েক মাস পরে থিয়োডোরাস বদলি হলেন ইটেন বলে ছোটো একটা শহরে। আবার কথা বলার সময় এল।

থিয়োডোরাস বললেন—এসব দোকানদারির কাজ তোমার জন্যে নয় ভিনসেন্ট। নিজের মনকে তুমি বুঝে দেখো, ঈশ্বরের কাজই তোমার উপযুক্ত কি না।

আমি জানি বাবা।

তবে এসব ছেড়ে আমস্টার্ডামে গিয়ে পড়াশুনো আরম্ভ করো না!

তাই হয়তো যাব, তবে কিনা—

ভাবনা কীসের, মনস্থির করো ভিনসেন্ট—

বুঝিয়ে বলতে পারব না বাবা। আর ক-দিন আমাকে সময় দিন।

কাকা জ্যান একদিন ইটেন ঘুরে গেলেন। বললেন, আমস্টার্ডামে আমার বাড়িতে তোমার জন্যে ঘর কিন্তু ঠিক করে রেখেছি ভিনসেন্ট।

মা বললেন—রেভারেন্ড স্ট্রিকারও তো লিখেছেন ওর পড়াশুনোর সমস্ত ব্যবস্থাই তিনি সেরে রেখেছেন।

জানে, জানে সে। আমস্টার্ডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের শ্রেষ্ঠ সুযোগ সে পাবে। সেখানে ভ্যান গক আর স্ট্রিকার পরিবারে সে পাবে পূর্ণ সমাদর, সাহায্য আর সহানুভূতি। কিন্তু তা হবার নয়। বেদনার অঞ্জলি পূর্ণ হয়নি এখনও। উরসুলা এখনও অনূঢ়া।

ইংরেজি কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে দেখে দরখাস্ত পাঠিয়ে ভিনসেন্ট আবার সে-দেশে একটা চাকরি জোগাড় করল। সমুদ্রের ধারে নিউগেট শহর। লন্ডন থেকে ট্রেনে যেতে সাড়ে চার ঘণ্টা লাগে। সেই শহরের এক ইস্কুলে মাস্টারি।

লোহার রেলিং-ঘেরা মাঠ। তার গায়ে মি. স্টোকসের ইস্কুলবাড়ি। দশ থেকে চোদ্দো বছর বয়সের মধ্যে চব্বিশটি ছাত্র। ভিনসেন্টের কাজ তাদের ফরাসি জার্মান আর ডাচ ভাষা শেখানো আর সবসময়ে তাদের ওপর নজর রাখা। বিনিময়ে বিনামূল্যে আহার আর আশ্রয়। মাহিনা এক পয়সাও না।

জনবিরল মন-কেমন-করা জায়গা এই র‍্যামসগেট। ভিনসেন্টের মনোভাবের সঙ্গে মিলে গেল এর আবহাওয়া। নিঃসঙ্গতাই তার কাম্য, সে চায় নিমগ্ন থাকতে উরসুলার ধ্যানে, স্মৃতিবেদনার রোমন্থনে।

এখানে আসার পর প্রথম শনিবার দিন রাত থাকতে সে বেরিয়ে পড়ল হাঁটাপথে লন্ডনের উদ্দেশে। সারাদিন প্রচণ্ড গরম। পড়ন্ত বেলায় সে পৌঁছোল ক্যান্টারবেরিতে। গির্জার বাইরে বুড়ো গাছের ছায়ায় বসে কিছুটা বিশ্রাম করে আবার সে চলল। থামল গভীর রাতে একটা দিঘির ধারে। সেখানে গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে রাত চারটে পর্যন্ত ঘুমোল। পাখির ডাকের সঙ্গে আবার হাঁটা শুরু। লন্ডনে লয়্যারদের পাড়ায় শেষপর্যন্ত যখন পৌঁছোল তখন আবার সন্ধ্যা।

ওই লয়্যারদের বাড়ি, ওই উরসুলার গৃহদ্বার। এইজন্যেই তো ইংল্যান্ডে আসা। যে-দেশে উরসুলা আছে, আমিও আছি সেই দেশে—সান্নিধ্যের এই তো পাগল করা আকর্ষণ!

বুকের মধ্যে হাতুড়ির আঘাত থামেই না। বাড়ির অদূরে একটা গাছে ঠেস দিয়ে সে দাঁড়ায়, অন্তর মথিত হতে থাকে অবর্ণনীয় এক অদ্ভুত বেদনায়। বসে পড়ে গাছের ধারে। চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে।

কখন নিবে গেল সব আলো। উরসুলার ঘরের জানলাটা অন্ধকার, অন্ধকার সারা বাড়ি। জোর করে উঠে দাঁড়াল ভিনসেন্ট, ক্লান্ত স্খলিত পদে ফিরে চলল আবার। পথের বাঁকে হারিয়ে গেল উরসুলার বাড়ি, হারিয়ে গেল উরসুলা।

এমনি আশাহারা ব্যর্থ তীর্থযাত্রা তার শুরু হল প্রতি সপ্তাহ-শেষে। কখনও-বা শুক্রবার শনিবার দু-দিন সে হাঁটে শুধু রবিবার সকালে উরসুলার বাড়ির কাছে পৌঁছোবার জন্যে। উরসুলা যখন গির্জায় যায়, দূর থেকে কয়েক মুহূর্তের চোখের দেখার জন্যে। শীত এল, তবু বিরাম নেই। পাথেয় নেই, খাদ্য নেই, আশ্রয় নেই–

তবু বিরামও নেই। প্রতি সোমবার সকালে যখন র‍্যামসগেটে ফিরে আসে তখন প্রায় মুমূর্ষু অবস্থা।

কয়েক মাস পরে ভিনসেন্ট কাজ পেল আইলওয়ার্থে মি. জোনসের মেথডিস্ট স্কুলে। এ-কাজটা একটু ভালো। মি. জোনস মস্ত একটা এলাকার ধর্মযাজক। ভিনসেন্ট শিক্ষক হিসেবেই বহাল হল, কিন্তু তিনি তাকে গ্রাম্য পাদরিতে রূপান্তরিত করে ফেললেন।

উরসুলার বিয়ের দিন যে ঘনিয়ে আসছে, তা ভাবতেই পারে না ভিনসেন্ট। তার প্রণয়ের যে প্রতিদ্বন্দ্বী সত্যিই আছে, তা আর কল্পনার বাইরে। সে কল্পনা করে, উরসুলা যে তাকে বিমুখ করেছে তার কারণ তার নিজেরই কোনো অচরিতার্থতা। কিন্তু সামান্য দোকানদারি সে ছেড়েছে, বরণ করতে চলেছে জনসাধারণের সেবাব্রত। এবার কি উরসুলা বরণ করবে না তাকে? স্বপ্ন দেখে—দিন আসছে।

মি. জোনসের ছাত্ররা দরিদ্র। তারা অনেকে আসে লন্ডন থেকে। ধর্মযাজক তাকে ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি পাঠান ছাত্রদের অভিভাবকদের কাছ থেকে মাহিনা আদায় করবার জন্যে। ভিনসেন্ট তা-ই চায়—লন্ডন মানেই উরসুলার সান্নিধ্য।

ছাত্রেরা থাকে হোয়াইট চ্যাপেলের দরিদ্রতম বস্তিতে। রাস্তাভরা নোংরা আর দুর্গন্ধ, আসবাবহীন গৃহ—দারিদ্র্য ক্ষুধা আর ব্যাধির বীভৎস রূপ প্রতিটি অধিবাসীর চোখেমুখে। কত পরিবারের অঙ্গে শুধু চীর বসন, আহার্য তাদের রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া গলিত মাংস আর পচা রুটির টুকরো। দুঃখের কাহিনি শুনতে শুনতে রাত বাড়ে, একটি পয়সাও কোনোদিন সংগ্রহ হয় না, গভীর প্রহরে আইলওয়ার্থে ফিরে আসে খালি হাতে। উরসুলার কথাও মনে থাকে না—তার বাড়ির রাস্তায় পা পড়ে না কতদিন।

একদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা বেলা ধর্মযাজক তাকে পরীক্ষা করলেন। বললেন—আজ আমার বড়ো ক্লান্ত লাগছে ভিনসেন্ট। কতদিন তো তুমি আমার হয়ে ভাষণ লিখেছ, আজ তুমি নিজেই উপাসনাটা চালিয়ে নাও দেখি।

কম্পিত পদে ভিনসেন্ট পুলপিটে উঠল। মুখ লাল, গলা দিয়ে স্বর বার হতে চায় না, বুঝতে পারে না হাত দুটোকে নিয়ে করবে কী! কাগজে এতদিন যেসব সুন্দর সুন্দর কথা সাজিয়েছে, মুখে সেগুলি উচ্চারণ করা কী কষ্ট! আড়ষ্ট ভাষা আর অনভ্যস্ত ভঙ্গিকে সে জয় করল কেবলমাত্র মানসিক শক্তি দিয়ে।

মি. জোনস বললেন—বেশ হয়েছে ভিনসেন্ট, আসছে সপ্তাহে তোমাকে রিচমন্ডে পাঠাব।

রিচমন্ডের লোকেরা মি. জোনসকে জানাল, নতুন ওলন্দাজ পাদরিটিকে তাদের ভালোই লেগেছে। টার্নহাম গ্রিনের গির্জাটি খুব বড়ো, অধিবাসীরা সংখ্যায় যেমনি বড়ো রুচিও তেমনি তাদের কঠিন। মি. জোনস ভিনসেন্টকে সেখানে পাঠিয়ে পরখ করলেন। সেখানকার প্রার্থনাকারীদের যদি সে প্রীত করতে পারে, কোনো পুলপিটে সে আর আটকাবে না।

উপাসনার শেষে ধর্মযাজকের বাণী। ভিনসেন্ট ১১৯:১৯ শ্লোকটির ওপর ব্যাখ্যা শুরু করল। শ্লোকটির বাক্যগুলি এইরূপ:

পৃথিবীতে আমি অপরিচিত আগন্তুক। তোমার যা নির্দেশ তা তুমি গোপন রেখো না আমার কাছ থেকে।

সহজ সরল উদ্দীপনাভরা কণ্ঠে ভিনসেন্ট ভাষণ দিয়ে চলল। তার মস্তবড়ো মাথা আর তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি, তার অঙ্গের আড়ষ্টতা আর ভাষার সরল বলিষ্ঠ প্রকাশ মুগ্ধ করল ধর্মবিশ্বাসী শ্রোতাদের। উপাসনার শেষে কয়েক জন তার কাছে এসে হস্তমর্দন করল, ধন্যবাদ দিল সহৃদয়তার সঙ্গে। বাষ্পবিভোল দূরান্তবর্তী দৃষ্টি, মুখে মৃদু খাপছাড়া হাসি—ভিনসেন্ট বিদায় নিল এদের কাছ থেকে, হাঁটা শুরু করল লন্ডনের পথে।

ঝড় নামল পথে। ঘোলাটে হয়ে উঠল টেমস নদীর জল। আকাশভরা কালো মেঘ, চক্রবালে বিদ্যুৎরেখা। টুপি ওভারকোট সঙ্গে নিতে ভুলে গিয়েছিল ভিনসেন্ট। বৃষ্টিতে পায়ের চামড়া পর্যন্ত ভিজ়ে গেল তার, তবু চলল উদ্দাম বেগে।

বাধা সে মানবে না, বাধা সে জয় করেছে। অর্জন করেছে সাফল্য, উপলব্ধি করেছে জীবনের অর্থ। দ্বিধা নেই মনে, আজ সে জয়ী। এই নবলব্ধ জয়পুলককে সে সমর্পণ করবে উরসুলার পায়ে।

পথের সাদাটে ধুলো ধুয়ে যাচ্ছে বৃষ্টিতে, জলের ঝাপটায় কেঁপে কেঁপে উঠছে যেন হথর্ন ঝোপের দল। দূরে শহরের ঝাপসা দৃশ্য, যেন ডুবারের একটা চিত্র।

লন্ডনে লয়্যারদের বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতে গড়িয়ে এল আসন্ন সায়াহ্ন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সপসপে ভিজে, জলে ডোবানো ভারি বুটজুতো। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই কানে এল সংগীতের মূর্ছনা, দেখল ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। সামনের ঘরে নাচ চলেছে।

একটা বুড়ো গাড়োয়ানকে সে জিজ্ঞাসা করল—কী ব্যাপার ও-বাড়িতে?

উত্তর শুনল—বিয়ে।

গাড়িটার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল ভিনসেন্ট। মাথার লাল চুলের গুচ্ছ বেয়ে বৃষ্টির জল মুখ ভাসিয়ে দিতে লাগল তার। একটু পরে সামনের দরজাটা খুলল। উরসুলা আর তার পাশে দাঁড়িয়ে একটি ছিপছিপে চেহারার যুবক। লোকজনের আনন্দ-কোলাহল। দম্পতির গায়ে চাউলবৃষ্টি।

ভিনসেন্ট গাড়িটার পেছনে আত্মগোপন করল। গাড়িতে উঠল উরসুলা ও তার স্বামী। গাড়োয়ান চাবুক মারল ঘোড়ার পিঠে। গাড়িটা চলতে শুরু করল আস্তে আস্তে। গাড়ির পেছনে কয়েক পা দৌড়ে ভিনসেন্ট জানলা দিয়ে দেখল আলিঙ্গনে আবদ্ধ চুম্বনরত দম্পতি। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল সে। গাড়িটা মিলিয়ে গেল পথের বাঁকে, বর্ষণধূসর সায়াহ্ন-অন্ধকারে।

কী যেন একটা ছিঁড়ে গেল—ছিঁড়ে দু-টুকরো হয়ে গেল ভিনসেন্টের বুকের মধ্যে। ঘুচে গেল বন্ধন, মুহূর্তে হল চরম মোহমুক্তি, আচম্বিত পরিত্রাণ।

অক্লান্ত বর্ষণের মধ্যে ক্লান্ত পদক্ষেপে সে ফিরে গেল আইলওয়ার্থে। তারপর ইংল্যান্ড ছেড়ে গেল চিরদিনের মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *