লণ্ডনের ভূতের রাজ্যে
ইলিয়ট ও’ডনেল একজন গোস্ট হান্টার। ভুতুড়ে বাড়ি বা জায়গার খোঁজে ইংল্যাণ্ডের অনেক এলাকায়ই অভিযান চালিয়েছেন। তাঁর কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি আজ।
সাধারণত ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা বললে আমাদের মনে হয় অভিজাত বাড়ি, ম্যানশন বা পুরানো কোন প্রাসাদের কথা। কিন্তু লণ্ডনের দরিদ্র এলাকাগুলোতেও নানা ধরনের অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে। যেমন প্যাকহ্যাম রের এক দোকানের কথা বলব এখন।
আগস্টের এক সন্ধ্যা। একটু একটু করে আঁধার হতে শুরু করেছে চারপাশ। দোকানে ঢুকেই চমকে গেলাম। এক মহিলাকে ব্র্যাণ্ডি পান করাচ্ছে দোকান মালিক। মহিলাটি মেঝেতে আধবসা আধশোয়া অবস্থায় আছেন। পুরোপুরি জ্ঞান আছে এটাও বলতে পারব না।
‘হ্যালো, মি. ডি., ঘটনাটা কী?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘মহিলাটি একটু বেশি রকম চমকে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।’
বিষয়টা কী জানতে চাইলাম। দোকান মালিক আমার পূর্ব পরিচিত হওয়ায় অমত করল না খুলে বলতে। জানাল যখন বেকন কাটছিল এসময়ই মহিলাটি দোকান থেকে বের হচ্ছিলেন। তারপরই মহিলাটি চিৎকার করে উঠে মূর্ছা যান। তিনি ভেবেছেন দোকান মালিক তার হাতের আঙুল কেটে ফেলেছে।
‘অবশ্য,’ বলল সে, ‘তুমি বলতেই পার এটা একটা হ্যালুসিনেশন কিংবা দৃষ্টিবিভ্রম টাইপের কিছু। তবে এই জায়গার মধ্যে আসলেই অস্বাভাবিক একটা কিছু আছে। সন্ধ্যার একই সময় একই ধরনের ঘটনা দেখার কথা বলেন ক্রেতারা। তাঁরা দেখেন আমার একটা আঙুল কাটা পড়ছে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো এটা সবসময় বেকন কাটার সময়ই হয়, চিজ, বিফ কিংবা অন্য কিছু কাটার সময় নয়। বিষয়টা আমার মনের মধ্যে এতটাই চাপ ফেলে যে কখনও মনে হয় সত্যি বুঝি একটা আঙুল কেটে ফেলছি। চিৎকার করে গিন্নিকে ডাকতে শুরু করি।’
‘তাহলে, তোমার স্ত্রী বা অন্য কাউকে বেকনের ব্যাপারটা দেখতে দাও না কেন?’ পরামর্শ দিলাম, ‘তাহলে হয়তো এটা ঘটবে না আর।’
তবে ওটা ঘটল, আরও ভয়ঙ্করভাবে। পরের বার যখন গেলাম তখন ঘটনাটা খুলে বলল সে।
‘জায়গাটা ছাড়ছি আমি। এটা অনেকটাই তোমার কারণে। মনে আছে অন্য কাউকে বেকনের দায়িত্ব দিতে বলেছিলে?’
মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম।
‘তো কাজটা করতে দিই আমার শালীকে,’ বলতে লাগল সে, ‘আমাদের সঙ্গে এসে বাস করার আগে ব্রিক্সটনে একটা রেস্তোরাঁর ব্যবসা ছিল তার। প্রথম রাতে যখন কাজটা করল কিছুই ঘটল না। তবে দ্বিতীয় রাতে তার আতঙ্কিত চিৎকারে দোকানে দৌড়ে যায় আমার স্ত্রী। আমার শালী চিৎকার করে বলছিল, ‘ওহ! আমি আমার আঙুল কেটে ফেলেছি।’ চিৎকারটা আমিও শুনেছি। তবে সেই পুরনো ঘটনা মনে করে পাত্তা দিইনি মোটেই। বরং হাসছিলাম মুচকি মুচকি। কিন্তু তারপরই শালী সিসির ওখান থেকে দৌড়ে কাউন্টারে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে আমার স্ত্রী বলল, ‘এখনই একজন ডাক্তারের খোঁজে যাও। ওর আঙুলটা পুরোপুরি কাটা পড়েছে।’’
ক্যানিংটন পার্কের এক বাড়িতেও বেশ অদ্ভুত রকম ভুতুড়ে ঘটনা ঘটে। পুরানো ধাঁচের বাড়িটার থেকে কিছুটা দূরে রাস্তা শুরু হয়েছে।
আমার এক সাংবাদিক বন্ধু, যার রাতের অর্ধেকটা লিখতে লিখতে পার হয়ে যেত প্রায়ই, সেখানে একটা কামরা ভাড়া নিল। তো যে রাতে কামরাটায় উঠল, খুব ক্লান্ত ছিল। হাতে জরুরি কোন অ্যাসাইনমেন্টও ছিল না, তাই একটু তাড়াতাড়িই ঘুমাতে গেল। অন্তত তার হিসাবে। এই কামরাটায় গ্যাস নেই, মোমই ভরসা। একটা মোমকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে অপরটা নেভাতে যাবে এমন সময় কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগল। বিছানার নিচে তাকাল, ওখানে গিজগিজ করছে তেলাপোকা। এটা তাকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল। পৃথিবীতে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে সে তা হলো এই তেলাপোকা। এক লাফে টেবিলের ওপর উঠে এক পায়ের ওপর আরেক পা আড়াআড়িভাবে রেখে বসে পড়ল। সকাল পর্যন্ত এভাবেই বসে থাকবে স্থির করল।
বেশ কিছুটা সময় বিছানার দিকে তাকালই না। তবে অজানা কোন একটা আকর্ষণে সেদিকে তাকাতে বাধ্য হলো। তখনই বালিশটার দিকে দৃষ্টি গেল। কেমন যেন লাগছে। ভাবল নিশ্চয়ই চোখের কোন সমস্যার কারণে এমনটা হয়েছে। অতএব ঠিক করল, ওদিকে আর তাকাবেই না। কিন্তু আবারও কী এক আকর্ষণে তাকাল ওদিকে। না, কোন ভুল নেই। বালিশটা আর বালিশ নেই, একটা মুখ হয়ে গিয়েছে। ওই তো নাকটা দেখা যাচ্ছে, পুরু আর একটু বাঁকা। কানদুটো বড়, মাথার পেছনের দিকে লেপ্টে আছে। চোখ, মুখ সবই আছে। আর শেষের ওই অঙ্গটাই আমার বন্ধুকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে। ঠোঁটটা পুরু, মুখটা হাঁ হয়ে আছে। মোটের ওপর বেশ সাধারণ একটা চেহারা। তবে ওটা এখানে কেন?
মোমটা জ্বলতে জ্বলতে ছোট হয়ে এসেছে। পুরোপুরি নিভে যাওয়ার আগেই অপর মোমবাতিটা জ্বেলে ফেলল। আবার মুখটার দিকে তাকাল। বাইরের যান চলাচলের শব্দ একেবারেই থেমে গিয়েছে। ঘোড়ার গাড়ির ঝুনঝুন, ঘোড়ার খুরের আওয়াজ, ট্রামের শব্দ—সব কিছু থেমে গিয়ে আশ্চর্য নীরবতা বিরাজ করছে এখন। তবে এসবে আমার বন্ধুর আগ্রহ নেই। তার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু যেখানে বালিশটা থাকার কথা এবং এর বদলে ভুতুড়ে মুখটা আছে সেখানটায়।
ধারণা করল, বেশিরভাগ সময়ে বারে কাটানো মদ্যপ এক মোটাসোটা মানুষের মুখ ওটা। ধারণাটা সত্যি করে দিতেই যেন হঠাৎ বিয়ারের গন্ধ নাকে এসে লাগল।
সন্দেহ নেই বাসি বিয়ারের গন্ধ ওটা। আমার বন্ধু যে কিনা এ জিনিস থেকে দূরে রয়েছে সবসময়, তার জন্য গন্ধটা রীতিমত অসহনীয়। এসময়েই কিছু একটা তাকে নিচের দিকে তাকাতে বাধ্য করল। দেখল বিশাল, কালো একটা শুঁড়অলা বস্তু বিছানার চাদর বেয়ে ওপরে উঠছে। ওটার পেছনে আরেকটা, এভাবে একটা একটা করে গোটা চাদরটাই এই বিদঘুটে জীবগুলোয় ভরে গেল। তাদের হাঁটার শব্দও যেন শুনতে পাচ্ছে সে। ওপরে ওঠা জিনিসগুলো গোটা শয্যায়, এমনকী ওই মুখটায় ছড়িয়ে পড়ল। সবার লক্ষ্য ছিল আসলে ওই মুখটাই। বিছানা থেকে জোর করে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল আমার বন্ধুটি। তার এবং দরজার মাঝখানের মেঝের দিকে, দৃষ্টি গেল তার। এখানে-সেখানে কিছু নড়াচড়ার আভাস পেল।
টেবিলে এক হপ্তার ভাড়া রেখে এবং একটা কাগজে বাড়ি ছাড়ার কারণ বর্ণনা করে, আসন থেকে সাবধানে নেমে এল। তারপর ছুটল সামনের দরজার দিকে।
কয়েক হপ্তা পর অন্য একজন পরিচিত সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করল, নদীর দক্ষিণ-পুব অংশে একটা কামরার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে কিনা, তবে অবশ্যই ক্যানিংটন পার্ক রোডে নয়।
‘কেন নয় সেখানে?’ আমার বন্ধুটি জানতে চাইল।
‘কারণ ওখানে আমার একটা অভিজ্ঞতা। কখনও ভুলব না ওই স্মৃতি। তুমি কি ভূতে বিশ্বাস করো? আর তেলাপোকা নিয়ে কি তোমার কোন দুর্বলতা আছে?
‘কী!’ আমার বন্ধু বিস্ময় প্রকাশ করল, ‘তাহলে ওই বাড়িতেই ছিলে তুমিও!’
তারপর তথ্য চালাচালি হতেই জানা গেল ওই সাংবাদিক যে শুধু ওখানে থেকেছে তা-ই নয় তার অভিজ্ঞতাও অবিকল এক।
‘বাড়ির মালকিনও প্রায়শই ওই কামরার বাসিন্দাদের এই অভিজ্ঞতার ব্যাপারটি জানতেন। সবাই নিশ্চয়ই তোমার মত এতটা উদার ছিল না যে ভাড়াটা পর্যন্ত রেখে আসবে। আর ওই বালিশমুখের ব্যাপারে তুমি কিছু জানো কিনা জানি না। ওই সময় ডাকা এক চিকিৎসকের কাছ থেকে এর বৃত্তান্ত শুনেছি। ওই বাড়ির মালকিন মহিলাটি আসলেই আস্ত এক পিশাচী। কয়েক বছর আগের এক রাতে ওই মহিলার স্বামী এতটাই মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফেরে যে বিছানায় যাওয়ার অবস্থা পর্যন্ত তার ছিল না। বদ মহিলাটি তাকে বিছানায় তুলে শোয়ানোর বদলে রাতভর বিছানার পাশেই ফেলে রাখে। তেলাপোকারা বিয়ার কী পরিমাণ পছন্দ করে তা তো জানো। ওই গন্ধে রীতিমত পাগল হয়ে যায় ওই কামরায় আশ্রয় নেয়া হাজারো তেলাপোকা। সকালে মহিলা এসে দেখে স্বামী দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছে।
বলা হয় সহো নানা ধরনের প্রেতাত্মার জন্য বিখ্যাত। ডিন স্ট্রিটের এক বাড়িতে বহু বছর ধরে আস্তানা গাড়া একটি বিশাল ভুতুড়ে কালোপাখির কাহিনী বেশিরভাগেরই জানা। তবে গ্রিক স্ট্রিটের এক দোকানের ওপরের ফ্ল্যাটের ঘটনাটা আশা করি পাঠকদের পরিচিত মনে হবে না।
বিশ্বযুদ্ধের পর এক মেডিকেল পড়ুয়া ছাত্র আশ্রয় নেয় গ্রিক স্ট্রিটের ওই বাড়িতে। মোটামুটি হপ্তাখানেক কাটানোর পর একদিন গিয়ে বাড়ির মালকিনকে অভিযোগ করল প্রতিদিন রাতে বিছানাটা শোবার সময় ভেজা পায় সে। মহিলা বলল এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। খেপা ছাত্রটি তখন হুমকি দিল আজ রাতেও একই ঘটনা ঘটলে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেবে।
ওই দিন সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে ফিরতেই মহিলা তাকে বলল তার সঙ্গে কামরায় এসে দেখতে সব কিছু ঠিক আছে কিনা।
‘গোটা বিকালটা রান্নাঘরের আগুনের কাছে রেখেছি তোমার বিছানাটা।’ বলল মহিলা।
মেডিকেল কলেজের ছাত্রটি তার সঙ্গে ভেতরে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করল মহিলা, ‘এবার ঠিক আছে তো?’
‘হ্যাঁ, এখন এটা একেবারেই শুকনো। তবে এটা নিশ্চিত গত রাতে ওটা ভেজাই ছিল।’
বেশ রাত করে পড়ালেখা শেষ করে বিছানায় গেল ছেলেটি। কিন্তু যখনই শরীরটা এলিয়ে দিল আবিষ্কার করল ওটা ভেজা। কিন্তু সকালে যখন মহিলাকে দেখাতে নিয়ে যাওয়ার আগে স্পর্শ করে দেখল, অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, ওটা একেবারেই শুকনো।
বেশ চমকিত মেডিকেল ছাত্র এবার বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিল। মহিলা তখন তাকে অপর একটা কামরা দিতে চাইল। ছেলেটা এতে কী লাভ হবে বারবার জানতে চাইলে মহিলা অনিচ্ছাসত্ত্বেও জানাল, এই কামরায় আগে যারাই থেকেছে দারি করেছে ওই বিছানাটা ভুতুড়ে।
‘আমি এতদিন একে তাদের কল্পনা ভেবেছিলাম,’ বলল মহিলা; ‘তবে তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আসলেই কোন সমস্যা আছে। ওই কামরাটার ওপরেই একটা রুম খালি হয়েছে। চাইলে আজই ওটায় উঠে যেতে পার।’ তবে এই ঘটনার পর ছাত্রটির আর ওই বাড়িতে থাকার কোন আগ্রহ ছিল না। সন্ধ্যায়ই সে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদায় নেয়।
এই মেডিকেল ছাত্রের কথা বলতে গিয়ে উইমপোল স্ট্রিটের কথা মনে পড়ে গেল। ওখানে একটা বাড়িতে প্রায় সময়ই চিকিৎসকরা বাস করেন। ওই বাড়িটারও ভুতুড়ে বলে বদনাম আছে। তবে ওখানকার রহস্যময় অতিথি সাধারণত দেখা দেয় না, বরং শব্দ করে নানা ধরনের। একটা কামরা থেকে চাবুকের শপাং শপাং বাড়ির শব্দ শোনা যেত প্রায়ই। মনে হত যেন কোন মানুষকে কেউ চাবুক দিয়ে ইচ্ছামত পেটাচ্ছে। আবার এক ল্যাণ্ডিঙে বাস করা লোকেরা প্রায়ই প্রচণ্ড হাতাহাতির শব্দ শুনতে পেতেন। শেষ হত কোন একটা কিছু ধপ করে পড়ার শব্দের মাধ্যমে। ধারণা করা হয় ওই বাড়িতে বাস করা কোন ভৃত্য অমানুষিক নির্যাতনের কারণে মারা যায়। তার অতৃপ্ত আত্মাই এই শব্দগুলো ফিরিয়ে আনছে।
যুদ্ধের সময় একেবারেই অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হয় আমার। উইগমোর স্ট্রিটে এক ভূতের খোঁজে গিয়ে এটা হয়। একটা ফ্ল্যাটে নীল একটা আলো দেখা যায়, এক কামরা থেকে আরেক কামরা চষে বেড়ায় ওটা। আবার প্রতি রাতে একই সময়ে, যখনই আলোটা দেখা যায় একটা ছায়ামূর্তি হাজির হয়। একটা সিঁড়ির নিচে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ওটা।
তো এক রাতে আরও কয়েকজন বন্ধুসহ ঠিক করলাম ওই বাড়িটায় ভূতের খোঁজে যাব। রিজেন্ট স্ট্রিটে একটা ক্লাব থেকে কেবল বেরিয়েছি তখনই রাস্তার লাল বাতিগুলো নিভে গেল। তার পর পরই গুলির শব্দের মত দুটো আওয়াজ।
সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে সরে পড়ল। কিন্তু আমি ওই বাড়িটায় হাজির হওয়ার জন্য লাফ দিয়ে একটা বাসে উঠে পড়লাম। অক্সফোর্ড সার্কাসে আমাকে ছাড়ল বাসটা। উইগমোর স্ট্রিটে যখন এলাম তখন দেখলাম রাস্তায় আমিই একমাত্র পথচারী। তারপরই রীতিমত বিশৃঙ্খল আর ভয়ানক একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো। রাস্তা ও ফুটপাতের ওপর গোলার টুকরো পড়তে লাগল। বেশ বিচলিত হয়ে পড়লাম। মাথায় কেবল নরম ফেল্ট টুপি আমার। চারপাশে ঘন অন্ধকার, কেবল একটা ল্যাম্প পোস্ট থেকে লাল একটা আলো আসছে। এসময় কটা নীল আলো চোখে পড়ল। ওই আলোয় ফুটে উঠল অশুভ কটা শব্দ, ‘তাড়াতাড়ি নিরাপদ কোথাও গা ঢাকা দাও।’
সত্যি ভয় পেলাম। এক ছুটে ভুতুড়ে বাড়িটাতে গিয়ে উঠলাম। বাড়ির মালিক মহিলা আর তার সঙ্গী ছাড়া আর কেউ নেই। আমার যে বন্ধুদের জন্য ঝুঁকি নিলাম তারা একজনও আসেনি। রাতভর সেখানে থেকেও কোন ধরনের অস্বাভাবিক আলামত পেলাম না। ‘সম্ভবত গোলাগুলির শব্দ ওটাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ। অন্যান্য সাবধানী নাগরিকদের মত গা ঢাকা দিয়েছে সে-ও।’ ঠাট্টা করে বললেন ভদ্রমহিলা।
হারলে স্ট্রিটের দুটো বাড়ির কথা জানি সেগুলো ভুতুড়ে। এই এলাকায় একসময় চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীদের গবেষণার প্রয়োজনে অনেক কুকুরকেই যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে বলে শুনেছি। একটা বাড়িতে যেমন একটা স্প্যানিয়েল কুকুরের অশরীরীকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। ওটার প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করার শব্দ শুনলে শরীরের রোম দাঁড়িয়ে যাবে আপনার। এদিকে অপর একটা বাড়িতে, অর্ধ শতাব্দী আগে যেখানে ভয়ানক একটা অপরাধ সংঘটিত হয়, সেখানে অশরীরী হাজির হয় একটা পিপের বেশে, থপ থপ শব্দ করতে করতে কিচেনের সিঁড়ি বেয়ে ওটা নেমে যায় পাতালঘরের দিকে।
ডোভার স্ট্রিটের কাছে একটা দোকানের ওপরে একটা ফ্ল্যাট নিয়েও নানা ধরনের কিচ্ছা প্রচলিত। বেশ কয়েক বছর আগে এক ব্যারিস্টার বন্ধুসহ সেখানে হাজির হলাম। তবে ফ্ল্যাটটায় রাত কাটানোর অনুমতি পেলাম না। খুব নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানতে পারলাম, এক নারী রাতে কেউ শুয়ে থাকলেই ওই বিছানায় গিয়ে বসে। ওই সময় শুয়ে থাকা ব্যক্তিটি গলায় প্রচণ্ড চাপ অনুভব করতে থাকে। কখনও কখনও মূর্ছাও যায়। এর নির্ভরযোগ্য কোন ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও একটা তত্ত্ব বেশ ডালপালা মেলেছে। একসময় ফ্ল্যাটটায় অর্ধ-উন্মাদ এক নারী বাস করত। সে নিজের বোনকে এবং তারপর নিজেকেই গলা টিপে মেরে ফেলে। অবশ্য আমার গবেষণায় বহু আগেই বেরিয়ে এসেছে, যেসব বাড়িতে এ ধরনের উন্মাদরা বাস করেছে এবং এভাবে গলা টিপে কাউকে মেরেছে, সে বাড়িগুলোতে এ ধরনের গলা চেপে ধরার অভিজ্ঞতা হয় লোকেদের মাঝে মাঝেই।
এতক্ষণ ভুতুড়ে বাড়ি নিয়ে পড়ে থাকলেও এবার ব্রিজের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন কয়েকটা ভুতুড়ে ঘটনা দিয়ে এই অধ্যায়টি শেষ করতে চাই। টেমস নদীর সঙ্গে এত বেশি খুন, আত্মহত্যা এবং দুর্ঘটনার সম্পর্ক আছে যে এর দু’তীরে ভুতুড়ে ঘটনা ঘটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
বাঁধ আর কোন কোন সেতুতে দেখা যাওয়া ভূতেদের কথা বলছি। রাতে এখান দিয়ে চলাফেরা করা পথচারী, ভবঘুরে আর রিভার পুলিসদের এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়। এদের কাছ থেকেই ওখানকার অশরীরীদের সম্পর্কে জানতে পারি আমি
জীবন সম্পর্কে হতাশ এক ভবঘুরে আমাকে বলল এক রাতে ওয়াটার লু সেতুর ওপর দিয়ে নদীর দিকে ঝুঁকে ছিল, লাফ দেয়ার সাহস সঞ্চয় করার জন্য। এসময় টলতে টলতে এক সুবেশী যুবক তাকে পাশ কাটাল। মনে হচ্ছে আকণ্ঠ মদ খেয়েছে। যুবকের সঙ্গের সোনার ঘড়ি আর হারটা ওই ভবঘুরেকে লোভী করে তুলল। আত্মহত্যার চিন্তা বাদ দিয়ে তাকে অনুসরণ শুরু করল সে। একপর্যায়ে সেতুর পাশে পাঁচিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে ভারসাম্য রক্ষা করতে দেখে খুশি হয়ে উঠল ভবঘুরে। চমৎকার একটা সুযোগ চলে এসেছে। চুপিসারে তার পেছনে এসে হাত বাড়াল ঘড়িটা টান দেয়ার জন্য। কিন্তু হাত কিছুই পেল না। পরমুহূর্তে ভারসাম্য হারিয়ে জোরে বাড়ি খেল দেয়ালের সঙ্গে। কিন্তু তার শিকারের কোন দেখা নেই। যেন বা সেতুটা হঠাৎ ফাঁক হয়ে তাকে অতলে টেনে নিয়েছে।
ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজে ভুতুড়ে এক অভিজ্ঞতার কথা আমাকে বলে এক পুলিস সদস্য। অ্যাবির দিক থেকে রাত দুটোর দিকে সেতু পেরোচ্ছিল সে। এসময়ই মনে হলো তার পেছনে কেউ দৌড়চ্ছে। ঘুরতেই সুন্দরী, দামি পোশাক পরা এক মেয়ের মুখোমুখি হয়ে গেল।
‘দয়া করে আমার সঙ্গে এসো। এই মাত্র এমন একজনকে রেখে এসেছি, যে খুব বিপদে আছে।’ আর্তি জানাল মেয়েটা।
সার্জেন্টকে তখনই রিপোর্ট করার কথা থাকায় পুলিসটা দ্বিধা করছিল। তবে মেয়েটা এমন করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল যে সে তাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হলো। বাঁধের কোনায় আসতেই দেখল একটা মেয়ে নদীতে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। বেশ জোর-জবরদস্তি করে মেয়েটাকে নিচে নামাতে পারল। তার মুখের দিকে তাকাতেই ধাক্কা খেল। যে মেয়েটা তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে সে দেখতে অবিকল তারই মত। একটা ব্যাখ্যা পাওয়ার আশায় পেছনে তাকাতেই দেখল পথ প্রদর্শক মেয়েটি গায়ের হয়েছে।
‘তোমার বোন, আরও পরিষ্কারভাবে বললে যমজ বোনটি ‘গেল কই?’ আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর দিকে চেয়ে চিৎকার করে
বলল পুলিসটি। চারপাশে খুঁজছে সে ওই মেয়েটিকে।
‘কার কথা বলছ?’ প্রাণ দিতে যাওয়া মেয়েটা বলল।
‘কেন, তোমার যমজ বোন। যে আমাকে ডেকে এনেছে তোমার আত্মহত্যা ঠেকাতে।’
‘কী বলছ এসব,’ এবার অবাক হবার পালা মেয়েটির, ‘পাগল নাকি? আমার যমজ বোন তো দূরে থাক কোন বোনই নেই। আমার কোন বন্ধু নেই, স্বজন নেই, আমি একেবারেই একা। এখানে আসার পর কোন মেয়েকে দেখিনি, এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারি।’