লটারি
যাত্রি
“এতো চিপা সিটে বসা যায় নাকি!” বুড়ো লোকটা বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে নিজের সিটে বসে পড়ল। অনেক দিন পর নিজ গ্রামে যাচ্ছে। আগামীকাল বুধবার হরতাল। দেরি করে আসার কারণে একেবারে পেছনের সিটে বসতে হয়েছে। ভালো করেই জানে ঝাঁকি খেতে খেতে অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে।
বৃহস্পতিবার বাদ দিলে পরদিন শুক্র-শনিবারসহ টানা তিনদিনের ছুটি। তবে বাসের অনেক যাত্রির মতো বুড়ো সেই সুযোগ নিচ্ছে না। কর্মহীন একজন মানুষ সে। তার যাত্রার করণ বাকি সবার চেয়ে ভিন্ন। গতরাতে হঠাৎ করেই স্বপ্ন দেখে তার বাবাকে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাবার পরই নিয়ত করে বাবার কবর জিয়ারত করবে। প্রায় পঁচিশ বছর পর নিজের বাবাকে স্বপ্নে দেখার কারণে কি না কে জানে, তার ভেতরে একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠেছিল, অনেক বছর হয়ে গেছে! তোমারও সময় হয়ে গেছে তাহলে? এরপরই মৃত্যু নামক কুৎসিত দানবটার চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এখন আবার সেই একই দৃশ্য আর কণ্ঠস্বর সক্রিয় হয়ে উঠলে মৃত্যুভাবনা দূর করার জন্য হাতে থাকা রোল করা পুরনো একটি সংবাদপত্র পড়তে শুরু করার কথা ভাবলো সে।
*
ওদিকে আঠাশ বছরের যুবক সালেক খুব তাড়ায় আছে, তবে তার বন্ধু সহযাত্রি আতাবর একেবারেই ভাবলেশহীন। বাস ছাড়ার সময় পেরিয়ে গেছে আরও আধঘণ্টা আগে। রাগে গজগজ করছে সালেক। হাঁটার গতি আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে পিছিয়ে পড়া বন্ধুর দিকে ফিরলো। “আরে, তোমার অবস্থা দেইখা মনে হইতাছে বাস তোমার লেইগা সারাদিন দাঁড়ায়া থাকবো।”
“তুমি মিয়া খামাখা টেনশন করতাছো। ঐ হালার বাস আরও এক ঘণ্টা খাড়ায়া থাকবো, দেইহো। জীবনে দ্যাখছো বাঙ্গালি টাইমমতো কিছু করছে!” তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকে আঁটকে রাখা সিগারেটে জোরে একটা টান দিলো আতাবর।
ইস্যুরেন্স কোম্পানির রিপ্রেজেন্টিভ সালেক আর সবার মতো হরতালের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে না, তার পরিবারের লোকজন তার বিয়ে ঠিক করেছে। অসুস্থ বাপ আবদার করেছে বড় ছেলের বউ দেখে তিনি কবরে যাবেন, তার আগে নয়। আগামী শুক্রবার তার কাবিন, তাই সাথে করে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আতাবরকে নিয়ে রওনা দিয়েছে। ঢাকায় আসার পর আতাবরদের মহল্লারই একটা মেসে ওঠে সালেক। সেই থেকে এই ছেলেটার সাথে তার পরিচয়, বন্ধুত্ব। রাজনীতি ছাড়া আতাবর কিছুই করে, তারপরও দিনরাত খেটে আধমরা হওয়া সালেকের চেয়ে ভালো আছে সে। আতাবরকে নিজ গ্রামটা ঘুরিয়ে আনার ইচ্ছে ছিল অনেক দিনের কিন্তু সময় আর সুযোগ আসেনি। এখন তার কাবিন আর হরতালের সুবাদে সেই সুযোগ এসে গেছে। পাক্কা তিন দিন তারা গ্রামে থেকে ঢাকায় চলে আসবে।
*
বাসের ভেতরে পঁচিশ বছরের যুবক মুক্তার খুব টেনশনে আছে। অনেক আগেই বাসস্টেশনে এসেছে কিন্তু বাস এখনও ছাড়ছে না, ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছে সে। অনেক ভেবেচিন্তে বড়সড় জানালার পাশে বাসের একটি সিট বেছে নিয়েছে। সেই জানালা দিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে বার বার। আজ ভোরের দিকে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে যে, তাকে এখন ঢাকা থেকে অনেক দূরে, এক বন্ধুর বাড়িতে যেতে হচ্ছে। বিপদে পড়লেই মুক্তার সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
*
আরেক যাত্রি বৃষ্টির ভালো লাগছে না, ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর। তার পাশে বসা লোকটি নিষ্পলক চেয়ে আছে তার দিকে। এমন না যে, পুরুষ মানুষের লোলুপ দৃষ্টির কারণে তার এমন অনুভূতি হচ্ছে। আজ এতোদিন পর নিজের গ্রামের বাড়িতে যাবার জন্যে বাসে উঠতেই কি না এই উটকো লোকটা এসে জুটেছে। প্রথমে পাশের এই যাত্রিকে সে খেয়ালই করেনি। লোকটা একটু আগে যখন তাকে বলল, “কেমন আছো, বৃষ্টি?” তখনই তার বুক ছ্যাৎ করে ওঠে। “আমি বৃষ্টি না, আমার নাম আকলিমা।” বেশ রুক্ষ্ম গলায় কথাটা বলার পর থেকেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। তার পাশে বসা ইতরটা চোখের পলক ফেলছে না, সেই থেকে ঠোঁটের কোণে বদমাশের হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।
.
যাত্রা ১
বাসের ভেতরে ঢুকেই সালেকের মেজাজ বিগড়ে গেল। সব সিট দখল হয়ে গেছে, একেবারে পেছনে বসতে হবে এখন। পেছনের বাম দিকের তিনটা সিটের মধ্যে জানালার পাশের সিটে বসে আছে সত্তর কি আশি বছরের এক বুড়ো। ডান দিকের দুটো সিট কোন হারামজাদা যেন গাট্টি-বোঁচকা রেখে দখল করে রেখেছে। সেই গাড়ি থেকে বের হচ্ছে শুঁটকি মাছের বমি উদ্রেক করা কটু গন্ধ। একটু কাছে এগোতেই সালেকের পেট গুলিয়ে উঠল।
আতাবরকে বুড়োর পাশে বসতে বলল সে।
“নানাজান, একটু চাপেন তো,” বুড়োকে বলল আতাবর কিন্তু বয়স্ক যাত্রির কোনো সাড়াশব্দ নেই। “কানে কম হুনে নাকি!” বিড়বিড় করে বলল
সে। “নানাজান, একটু সরেন, এবার বেশ জোরে বলল।
“কই সরুম? জায়গা থাকলে তো!” ঝাঁঝালো কণ্ঠে জবাব দিলো বুড়ো। নানা বলায় ক্ষেপে গেছে সে।
“বুইড়ার তেজ আছে দেহি,” কণ্ঠটা নিচে নামিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সালেককে বলল আতাবর। “এইটা তো তিনজনের সিট…”।
বুড়ো জবাব না দিয়ে সমস্ত মনোযোগ ঢেলে জানালার বাইরের দৃশ্য উপভোগ করছে। আতাবর কিছু বলল না বটে কিন্তু এমনভাবে বসলো যে, বুড়ো ধাক্কা খেয়ে নিজ থেকেই কিছুটা সরে গেল। “বাপের বয়সি কারো। সাথে এমন করতে লজ্জা করে না?” ক্ষেপে গিয়ে বলল সে।
“আমার বাপ এহনও অনেক জোয়ান…আপনে আমার নানার চায়াও বড় অইবেন।”
বুড়ো লোকটা বুঝতে পারলো এই ছোকরা দ্রগোছের কেউ না। রাগে সারা শরীরে আগুন ধরে গেলেও কিছু বলল না, জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলো কেবল।
“হালায়, এইটা কুনো বাস অইলো!” সালেকের কাছে অভিযোগের সুরে বলল আতাবর। “লোকাল বাসের চায়াও খারাপ…তোমাগো দ্যাশে যাওনের কি এরচায়া ভালা বাস নাই?”
“আছে, কিন্তু টিকেট পাই নাই।”
পাশের সিটে রাখা গাট্টিবোঁচকা থেকে যে শুঁটকির দুর্গন্ধ বের হচ্ছে সেটা এখন আতাবরও টের পাচ্ছে। নাক-মুখ কুঁচকে বস্তার দিকে ইঙ্গিত করলে সালেক তাকে বলল, “শুঁটকির গাট্টি।”
“বালের সুটকি থেইকা তো পুটকির গন্ধ আইতাছে।” চারপাশে তাকিয়ে হেল্পারকে খুঁজতে লাগলো আতাবর। “হালায়, কুন খাটাসের বাচ্চা এই মাল এইহানে রাখছে!”
সালেক কিছু বলল না। বাসে ওঠার আগে একটাই চিন্তা ছিল-বাস চলে গেছে কিনা। এখন আবার অন্য একটা চিন্তা ভর করেছে। বাবা-মা যে মেয়ের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে তার শুধু একটা ছবি দেখেছে। ঐ ছবি দেখে যতোটুকু বুঝেছে তাতে মনে হয়েছে মেয়েটার চেহারা-সুরত খারাপ না, তবে লেখাপড়া খুব কম। নিতান্তই সাধারণ একটি মেয়ে। অনেক আশা ছিল ঢাকা শহরের মেয়ে বিয়ে করবে কিন্তু সেটা আর হলো না।
তার সঙ্গী আতাবরের মেজাজ খুব দ্রুত খারাপ হয় আবার ফুরফুরে হতেও সময় লাগে না। এই ছেলেটা সব সময় ঠাট্টা-তামাশা করতে পছন্দ করে। “দোস্ত, কেমন লাগতাছে?”
“মানে?” সালেক বুঝতে না পেরে বলল।
“এই যে, বিয়া করতে যাইতাছো…?”
একটু লজ্জা পেলো সালেক। “না…কেমন আর লাগবো…এই তো…”
সালেকের ঊরুতে সজোরে একটা চাপড় মারলো আতাবর। “দোস্ত, তোমার চেহারা দেইখা মনে অইতাছে বিয়ার রঙ এহনও লাগে নাই, তয় লাইগা যাইবো…” কথাটা বলেই হা-হা করে হেসে ফেললো সে।
বুড়ো লোকটা ভুরু কুঁচকে আতাবরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “রঙ তো লাগছে অন্য জনের!”
কথাটা আতাবর শুনতে পেয়ে বুড়োর দিকে ফিরলো। “চাচামিয়া, কিছু কইলেন নাকি?”
“একবার কন নানাজান, আরেকবার কন চাচা…ফাইজলামি করেন?”
“আরে, নানাজান কইয়া তো দেখলাম আপনার মুখটা একেবারে গরুর পুটকির মতো অয়া গেছে…তাই ভাবলাম চাচা কইলে বুঝি ঈদের মতো খুশি অইবেন।”
“বেয়াদ্দপ পোলাপান,” নীচু কণ্ঠে বলেই মুখটা আবার জানালার দিকে সরিয়ে নিলো বুড়ো।
আতাবর আর সালেক একে অন্যের দিকে তাকিয়ে নীরব হাসি হাসলো। বুড়োর আচরণে তারা খুব মজা পাচ্ছে।
.
যাত্রা ২
বাসের বাইরে হ্যাংলা টাইপের এক ছেলের সাথে মুক্তারের চোখাচোখি হতেই তার গলা শুকিয়ে গেল। এখনও দূর থেকে ক্ষণে ক্ষণে তাকে আড়চোখে দেখে যাচ্ছে ছেলেটা। এক অজানা আশংকা মুক্তারের মধ্যে জেঁকে বসলো। “ওঠেন, ওঠেন…বাস ছাড়বো।” হেল্পারের কথাটা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।
অবশেষে তাদের বাসটা গন্তব্যের দিকে চলতে শুরু করলো।
বৃষ্টির পাশে বসা লোকটা একটু আগে আবারও তাকে বৃষ্টি বলে সম্বোধন করেছে। ভাবছে এই লোকটার কাছ থেকে কিভাবে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে লোকটা বলল : “দেশে যাচ্ছো?”
কটমট চোখে তাকালেও কিছু বলল না বৃষ্টি। এই লোকটা, যে কি না সব জায়গায় নিজেকে কবি বলে পরিচয় দেয়, তাকে যদি সে বাসে না পেয়ে অন্য কোথাও পেতো তাহলে আচ্ছা করে একটা শিক্ষা দিয়ে দিতো। আস্ত একটা খাটাশ। তাকে কী ঠকানটাই না ঠকিয়েছিল। তিনশ’ টাকার জায়গায় যখন পাঁচশ’ টাকার একটি নতুন নোট তার হাতে গুঁজে দিলো তখন মনে হয়েছিল বাকি টাকাটা বখশিস হিসেবে দিচ্ছে। আধো-আলো-অন্ধকারে বৃষ্টি ধরতে পারেনি, কিন্তু তার ভুল ভেঙেছিল পরদিন সকালে। বাড়ির সামনে মুদিদোকানিকে পাওনা টাকা মেটাতে গেলে বুঝতে পারে পাঁচশ’ টাকার নোটটা জাল।
এখন হাতের কাছে সেই লোককে পেয়েও বৃষ্টি কিছু করতে পারছে না, উল্টো সেই জোচ্চোরটা তাকে পীড়ন করে যাচ্ছে। খচ্চর কবি একটা কবিতা আওড়াচ্ছে তার কানের কাছে মুখ এনে :
“দস্যুর মতো লুটে নিলাম আমি…ছিল তোমার যা সবই…ওহ্। প্রিয়তম…ক্ষমা করে দিও…যদি কিছু ফিরিয়ে দিতে না পারি!”
অসহ্য, মনে মনে বলল বৃষ্টি।
.
যাত্রা ৩
তা না আবারও লো
“কাবিনের পর কি বাসরঘর হইবো নাকি, দোস্ত?” সালেকের উদ্দেশে বলা আতাবরের কথায় আদিরসের গন্ধ পেয়ে বুড়ো কান খাড়া করে রাখলো।
“আস্তে কও,” সালেক আড়চোখে বুড়োর দিকে ইশারা করে নীচু কণ্ঠে বলল।
“ফোকনা লইয়া ঢুইকো কিন্তু…তা না অইলে দেহা যাইবো পয়লা চান্সেই তুমি ভাবিসাবের প্যাট ফুলায়া দিছো।” আবারও সালেকের ঊরুতে একটা চাপড় মারলো সে। “আমার স্টকে কয়েকটা আছে…লাগবোনি?”
“তুমি কি সব সময় এইসব জিনিস নিয়া ঘোরো?” সালেক মুচকি হেসে বলল।
“মানিব্যাগে রাখি…কক্ষন কামে লাইগ্যা যাইবো ক্যাঠায় জানে!” কথাটা বলেই চোখ টিপলো আতাবর।
“এজন্যেই বিয়াশাদির চিন্তা তোমার মাথায় ঢোকে না!”
এ কথা শুনে আতাবর শুধু হেসে গেল। আত্মপক্ষ সমর্থন কিংবা সাফাই গাইবার স্বভাব তার মধ্যে খুবই কম।
.
যাত্রা ৪
“আস্তে!” হেল্পারের জোরালো কণ্ঠটা শোনা গেল গেটের সামনে থেকে। “ওস্তাদ, একটু ডাইনে।”
কিন্তু বৃষ্টির পাশে বসে থাকা কবি আরেকটু বাঁয়ে সরে এলো, একেবারে গা ঘেষে। “তুমি আরও বেশি সুন্দর হয়ে গেছো।” বদমাশটা আস্তে করে বৃষ্টির উরুতে হাত রাখলে কটমট করে তাকালো সে। লোকটার কোনো বিকার নেই। ময়লা দাঁত বের করে হাসছে। বৃষ্টি নিশ্চিত এই কবি কয়েক দিন ধরে গোসল করেনি।
*
“দোস্ত, বিয়া করবার লাগছো মাগার তোমারে দেইহা মনে অইতাছে দোনোমোনো…”
আতাবরের কথাটা প্রথমে বুঝতে পারলো না সালেক। “দোনোমোনো মানে?”
“মানে পুরাপুরি খুশি অইতে পারতাছো না।”
“খুশি হওয়ার কী আছে…মা-বাবার মুখের দিকে চায়া বিয়া করতাছি, আমি তো রাজি ছিলাম না, তুমি জানোই। বাপে যদি বিছানায় না পড়তো তাইলে তো এইখানে বিয়া করতাম না।”
“কই করতা তাইলে?” আতাবরের কথার মধ্যে যে ইঙ্গিতটা আছে। সেটা ধরতে পারলো সালেক। হয়তো নিঃশব্দে তার বুকের ভেতর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসও বের হয়ে এলো কিন্তু সেটা চলমান বাসের কোলাহলে কেউ টের পেলো না। “ঐ মাইয়ার কথা ভুইলা যাও। মাইয়াটা কিন্তু ভালা না।”
একটু উদাস হয়ে গেল সালেক। হ্যাপির প্রসঙ্গ উঠলেই আতাবর তাকে এ কথা বলে। সালেক কখনও সেটা গায়ে মাখে না। হ্যাপি তাদের মেসের উল্টোদিকের এক বাড়িতে থাকে। সালেকের সাথে বেশ খাতিরও আছে তার, কিন্তু মেয়েটার ঠাটবাট একটু বেশিই। সব সময় সেজেগুজে থাকে, কথাও বলে শুদ্ধ ভাষায়। সালেকের এটা বেশ ভালো লাগে। সত্যি বলতে, হ্যাপির সবকিছুই তার ভালো লাগে। মেয়েটা যখন ঠোঁট বেঁকিয়ে কোনো ব্যক্তি বা বিষয়কে তাচ্ছিল্য করতে থাকে সেটাও তার কেমনজানি লাগে। কিন্তু নিজের এই ভালো লাগার কথা কখনও বলার সাহস হয়নি। মেয়েটাও বোঝে সালেক তাকে পছন্দ করে কিন্তু ভুলেও প্রশ্রয় দেয়নি কখনও।
নিজের উরুতে আতাবরের থাবা বসতেই সালেক সম্বিত ফিরে পেলো। “কী?” সামনের একটা সিটের দিকে ইঙ্গিত করলো আতাবর।
“ঐ যে, সবুজ কামিজ পরা মাইয়াটারে দেখতাছো না…” আতাবরের কথা শুনে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো সালেক। “দেহ না, খচ্চরটা ওর লগে কী করতাছে।”
সালেক দেখলো তাদের সামনের সিটে একটা মেয়ে বসে আছে, তার পাশে বসে আছে এক লোক। বাসে ওঠার সময় মেয়েটাকে খেয়াল করেনি। এইমাত্র দেখতে পেলো। গা ঘেষে বসে থাকা লোকটি উত্যক্ত করে যাচ্ছে। তাকে। মেয়েটার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার কাঁধে হাত রেখেছে। অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে মেয়েটা কিন্তু প্রতিরোধ করতে পারছে না।
শূয়োরের বাচ্চা। মনে মনে বলে উঠল সালেক। কিন্তু তারপর হুট করে সে যেটা করলো সেটা তার চারিত্রিক বৈশিষ্টের বাইরে। এই জীবনে সে নিজে কখনও এরকম কাজ করেনি। এরকম কাজ তার সঙ্গি আতাবরকে করতে দেখেছে বার কয়েক আর প্রতিবারই সে বন্ধুর সাহসে মুগ্ধ হয়েছে।
“এই যে ভাই?”
বৃষ্টির পাশে বসা লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, তবে বৃষ্টি একটুও বিস্মিত হলো না। বিরক্তি ছাপিয়ে তার ঠোঁটে হঠাৎ করেই দুর্বোধ্য হাসি দেখা যাচ্ছে। খচ্চরটা মুখ তুলে চেয়ে রইলো সালেকের দিকে। বাসের মধ্যে থাকা সব যাত্রির চোখও এখন সালেকের দিকে নিবদ্ধ। নিজের সিট থেকে উঠে চলে এসেছে এখানে।
“আপনার সমস্যাটা কি?” বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল সালেক।
“স্-স্-সমস্যা মানে…?” তোতলাতে শুরু করলো খচ্চরটা।
“উনারে ডিস্টার্ব করতাছেন কেন?”
“ডিস্টার্ব করছি!?” লোকটা কৃত্রিম বিস্ময়ে বলল।
“দ্যাখেন না ভাই, একলা মেয়েমানুষ পাইয়া কী রকম ইতরামি করতাছে,” সুযোগ বুঝে বৃষ্টি বলল তার সদ্য আবির্ভূত ত্রাণকর্তাকে।
সালেক আর কোনো কথা না বলে লোকটার জামার কলার ধরে সিট থেকে ওঠালো, তারপর কী যেন মনে করে বাসের ভেতর বসে থাকা যাত্রিদের নিরীক্ষণ করে গেল কিছুটা সময়। এসব দেখে আতাবর যারপরনাই বিস্মিত, তবে সালেকের এমন কাণ্ডে মজাও পাচ্ছে বেশ।
মাঝখানের সিটে এক অশীতিপর বৃদ্ধ বসে আছে, তার পাশে এক দম্পতি।
“চাচা, আপনি কি একলা যাইতাছেন?” সালেক সেই বুড়োকে বললে মাথা নেড়ে সায় দিলো বৃদ্ধ। এবার আরও বেশি কর্তৃত্বের সুরে বলল সে, “আপনি এইখানে আসেন।”
হয় সালেকের আগ্রাসী আচরণের কারণে নয়তো বৃষ্টির মতো তরুণীর সান্নিধ্য পাবার লোভে বুড়ো তার নাতির বয়সি এক ছেলের আদেশ পালন করে সিট ছেড়ে সুরসুর করে উঠে এলো।
“আপনি ঐ সিটে গিয়া বসেন,” কলারটা ছেড়ে দিয়ে খচ্চরটাকে বলল সালেক।
“আপনি কে, আমাকে ঐ সিটে যাবার অর্ডার দিচ্ছেন?” বাসের সব যাত্রির কাছে নিজের সম্ভ্রম ফিরে পাবার আশায় একটু সাহস করে বলল কবি। তবে তার প্রতিবাদি কণ্ঠ যেমন দুর্বল তেমনি ভয়ার্ত।
চলন্ত বাসের বিকট শব্দের মধ্যেও আলোড়ন তুললো শব্দটা। এমনকি ড্রাইভার লোকটাও কয়েক মুহূর্তের জন্য পেছনে ফিরে দেখে নিলো শব্দটার উৎপত্তিস্থল। কন্ডাক্টর ছেলেটা তাদের দিকে এগিয়ে এসেও থেমে গেল।
নিজের বাম গালে হাত বোলাতে বোলাতে ভড়কে যাওয়া কবি চুপচাপ সিটের অদলবদল সেরে নিতেই বাসযাত্রিদের চোখেমুখে তৃপ্তি ফুটে উঠল। কারো কারো চোখেমুখে সালেকের বীরত্বের জন্যে বাহবা দেবার অভিব্যক্তি।
“হাসতাছো কেন?” আতাবরের পাশে এসে বসার পর সালেক জানতে চাইলো। নিঃশব্দে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে যাচ্ছে সে।
“তালি বাজামু?” আতাবর বলল।
“ক্যান্…তালি বাজাইবা ক্যান?”
হাসি থামিয়ে এবার আতাবর স্বাভাবিক হলো। “আচ্ছা, আখা খেইপা গেলা ক্যান, দোস্ত?”
সালেক কিছু বলল না। তার নিজের কাছেও এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। এখন মনে হচ্ছে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলছে।
এই দুই বেয়াদপ ছেলে সব যাত্রির কাছে সম্ভম পাচ্ছে এটা বুড়ো মেনে নিতে পারছে না। একটা সিগারেট বের করে ধরালো সে।
“বুইড়ার কামটা দ্যাখছো?” কনুই দিয়ে তো মেরে চাপা কণ্ঠে বন্ধুকে বলল আতাবর। সালেক পাশ ফিরে বুড়োকে দেখলেও কিছু বলল না। “হালার বিজাতটাইপের বুইড়া।” কথাটা বুড়োর কানে যেতেই সিগারেটে জোরে জোরে টান দিয়ে ভকভক করে ধোয়া ছাড়লো সে।
“চাচামিয়া, বাসের মইদ্যে সিগ্রেট খাইতাছেন ক্যান?” বুড়ো ফিরেও তাকালো না। আয়েশ করে সিগারেটে টান দিয়ে যাচ্ছে। “বাসে সিগারেট খাওন তো মানা…এইটা আপনেও জানেন…জানেন না?” আতাবর এ কথা বলার পর বুড়ো বিরক্ত হয়ে তাকালো তার দিকে। “ওইটা জানালা দিয়া বাইরে ফালায়া দ্যান।”
আতাবরের আদেশ অগ্রাহ্য করে বুড়ো জানালা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে শুরু করলো এবার।
“আমি হালায় জোয়ানপোলা হইয়া আইন মানতাছি আর আপনে…” বুড়ো কিছুই বলল না। “দ্যাখছো, হালার বুইড়ার ঘাড়ের রগ কতো ত্যাড়া!”
“বাদ দাও তো…” সালেক আতাবরকে এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করে দিলো।
ওদিকে সামনের দিকে সিটে বসা বৃষ্টি ভাবছে তার কপালটাই খারাপ। দাদা-নানা বয়সি লোকটা তার পাশে এসে প্রথম কয়েক মিনিট একটুও নড়াচড়া করেনি, কিন্তু এখন বার বার দু-হাত সামনের সিটের উপর রাখছে আর নামিয়ে আনছে। নামিয়ে আনার সময় বুড়োর বাম কনুই বৃষ্টির হাত তলপেট স্পর্শ করছে।
শেষ সিটে আতাবরের পাশের যাত্রি বুড়ো সিগারেট শেষ করে সিদ্ধান্ত নিলো এবার সে পত্রিকা পড়বে। পুরো পত্রিকাটা দুদিকে মেলে একমনে পড়তে লাগলো। বুড়োর বাম হাত পাশে বসা আতাবরের মুখের সামনে চলে এলে কটমট করে সে তাকালো তার দিকে।
“এই যে নানা, হাতটা সরান।” বুড়ো তার হাতটা এক ইঞ্চির মতো সরিয়ে নিলো। আতাবর আর বাক্যব্যয় করলো না, বুড়োর হাতটা ধরে নিজেই সরিয়ে দিলো। তার এমন আচরণে বুড়ো কিছু না বলে অন্যভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালো। জোরে জোরে পত্রিকার খবর পড়তে শুরু করলো সে।
“দ্যাখছো, বুইড়ার কামটা দ্যাখছো।”
সালেক একটু বিরক্ত হয়ে বুড়োর দিকে তাকিয়ে আতাবরকে বলল, “আরে বাদ দাও না।”
কিন্তু আতাবর ঠিক করলো, সে বাদ দেবে না, বুড়োর সাথে একটু মজা করবে। “নানা তো দেহি ভালাই খবর পড়েন…কুনো চ্যানেলে-ট্যানেলে খবর পড়বার ইন্টারভিউ আছেনি?”
“মশকরা করেন?” বুড়ো পত্রিকা থেকে চোখ তুলে বলল।
“মশকরা করুম ক্যান…যেমনে পড়তাছেন মনে অইতাছে খবর পড়বার চাকরি করবেন।”
“বেয়াদ্দপ!” বিড়বিড় করে বলেই পত্রিকায় মনোযোগ দিলো বুড়ো।
আরেক যাত্রি মুক্তার হোসেন বুঝতে পারলো তাকে একটা ফোন করতে হবে। কল করে কানে ঠেকালো মোবাইলফোনটা। একটু পরই শুরু হলো নীচুকণ্ঠে কথাবার্তা : “আমি…” আড়চোখে এদিক-ওদিক তাকালো সে। “…বাড়িতে আইছিল?…কহন?…আর কিছু কইছে?…তোমরা সব ঠিক আছো তো?…আচ্ছা…না…আমি ঠিক আছি।”
পত্রিকা পড়তে থাকা বুডোের মনোযোগ আকর্ষণ করলো আতাবর। “নানাজান, ঠিক কইরা পড়েন।” কটমট চোখে তার দিকে তাকিয়ে আবার পড়ায় ফিরে গেল বুড়ো। “আহ্, নানাজান…কানে লাগতাছে তো!”
“আপনার সমস্যা কী?” রেগেমেগে বলল বুড়ো।
“স্বাইস্থ্য না…বলেন স্বাস্থ্য।”
“আমি কি আপনারে পইড়া শুনাইতাছি…?” বুড়ো রেগেমেগে বলল।
সালেক আতাবরকে নিবৃত্ত করার জন্যে উরুতে আলতো করে চাপড় দিলো কিন্তু আতাবর সেটা গায়ে মাখলো না। “কন কী…তাইলে এতো জোরে জোরে পড়তাছেন ক্যান?”
“আমি জোরে জোরেই পড়ি!” ধমকের সুরে বলল বুড়ো।”এইটা আমার অভ্যাস।”
“তাইলে শুদ্ধ কইরা পড়েন…’স্বাইস্থ্য’ না…বলেন ‘স্বাস্থ্য’…’বেরাশি’ না … ‘বিরাশি’…বুঝলেন?”
“আপনার চায়া আমার উচ্চারণ অনেক ভালো। আগে নিজেরটা ঠিক করেন।”
“কীরম ভালা তাতো দ্যাখতাছিই।”
বুড়ো কিছু বলতে গিয়েও নিজের সমস্ত রাগ দমিয়ে নিঃশব্দে পড়তে লাগলো। রাগে গজ গজ করছে সে। আজকালকার ছেলেপেলেদের বেয়াদবি যে সীমা ছাড়িয়ে গেছে সে ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ নেই তার।
“নানাজান?” আতাবরের এ কথায় বুড়ো শুধু কটমট চোখে চেয়ে রইলো। “পত্রিকাটা তো আইজকার না…বাসি পত্রিকা পইড়া কী মজা পান আল্লাই জানে!”
“আমি বাসি পত্রিকা পড়ম না টাটকা পড়ুম তাতে আপনার কী?”
“আরে, রাগ করেন ক্যান্…পত্রিকা পুরানা অয়া গেলে ওইটা দিয়া ঠোঙ্গা বানায়…এইসব ঠোঙ্গা পইড়া কী লাভ!” সালেক আবারও আতাবরকে থামানোর চেষ্টা করলো। এমন না যে সে বিরক্ত হচ্ছে, সে-ও মজা পাচ্ছে তবে চাচ্ছে ব্যাপারটা যেন সীমার মধ্যেই থাকে।
বুড়ো আর পাল্টা জবাব না দিয়ে জানালার দিকে মুখ করে নিজের রাগ দমনের চেষ্টা করলে আতাবর হতাশ হয়ে বন্ধুর দিকে ফিরলো। সামনের সিটের সবুজ রঙের কামিজ পরা মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল, “দোস্ত, ঐ মাইয়াটারে দেইখা মনে অইতাছে দুই নাম্বার…”
পাশ ফিরে অবাক হয়ে তাকালো সালেক। “কেমনে বুঝলা?”
“বোঝা যায়, বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল আতাবর। “তুমি তো এইসব মাইয়ার কাছে কোনো দিন যাও নাই তাই বুঝবার পারতাছো না।”
সালেক কিছু বলল না, চুপ মেরে রইলো।
পাশে বসে থাকা সত্তরোর্ধ বুড়ো লোকটার দিকে ঝট করে তাকালো বৃষ্টি। “আর কোন কোন জায়গায় হাত দিতে ইচ্ছা করতাছে, দাদাজান?” কথাটা শুনে ভিরমি খেলো বুড়ো। “এইখানে হাত দিতে ইচ্ছা করতাছে?” নিজের বুকের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। মুহূর্তে কাচুমাচু খেয়ে দু-হাত গুটিয়ে নিলো বুড়ো লোকটা।
হঠাৎ করে নাক-মুখ-চোখ কুঁচকে ফেললো আতাবর। সালেকও নাক চেপে ধরে বন্ধুর দিকে তাকালো। “হালায় সাইলেন্সর মারছে,” বলল আতাবর। চোখ কুঁচকে নাকে হাত চাপা দিয়ে বুড়োকে বলল সে, “নানাজান, কী খায়া বাড়ি থেইকা বাইর অইছেন, অ্যাঁ?”
“মানে?”
“এহনও বুঝতাছেন না?”
“আরে, কী বলতে চাচ্ছেন?” বুড়ো এবার চটে গেল।
বন্ধু সালেকের দিকে তাকিয়ে আবার বুড়োর দিকে ফিরলো সে। “আপনি তো হালায় সুটকিরেও হার মানায়া দিছেন।”
“আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?”
“চুরি চুরি আবার সিনা জুড়ি!” আতাবর কথাটা বলল সালের দিকে ফিরে। “জায়গায় বে-জায়গায় গ্যাস ছাইড়া কয়, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন!”
“বাদ দাও তো,” সালেক আতাবরকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলো আবারও।
“আরে কী বাদ দিমু!…বাঁয়ে সুটকি, ডাইনে এই হালার বুইড়া…এক্কেবারে নাক জ্বালায়া দিছে, ওর মায়রে বাপ!”
তাদের বাসটা ফেরিতে ওঠার পর আগমন ঘটলো পত্রিকার হকার আর ফেরিওয়ালাদের। বুড়ো লোকটা হকারের কাছ থেকে একটা পত্রিকা কিনে নিলো।
ফেরি থেকে নেমে বাসটা আবারও চলতে শুরুে করেছে।
পাশে বসে থাকা আতাবর মুচকি হাসছে দেখে রেগেমেগে পত্রিকা খুলে পড়তে শুরু করে দিয়েছে বুড়ো।
কিছু যাত্রি এখন ঘুমাচ্ছে। কিছু নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। কেউ কেউ উদাস হয়ে অতিক্রান্ত হওয়া দৃশ্য দেখছে জানালা দিয়ে। কেউবা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কেনা আমড়া-বাদাম-ঝালমুড়ি মজা করে সাবাড় করছে। কিন্তু আতাবর মজা করার উপলক্ষ্য পাচ্ছে না। বুড়ো তাকে সেই সুযোগও দিচ্ছে না এখন। একমনে পত্রিকা পড়ে যাচ্ছে সে। আর আতাবরের বন্ধু সালেক উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে।
উসখুস করতে লাগলো আতাবর। এক বুড়ো ছাড়া লাগবার মতো কেউ নেই ধারেকাছে। অতঃপর বুড়োর দিকেই নজর দিলো আবার। বেশ মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছে। আতাবর সেদিকে নজর দিতেই পত্রিকাটা সরিয়ে ফেললো যেন ফাও চান্সে পত্রিকা পড়তে না পারে। বুড়োর এমন কাণ্ড দেখে মুচকি হাসলো সে।
“এইবার ঠিক আছে…পত্রিকা আসলে টাটকা পড়াই ভালা…কি কন, নানাজান?”
বুড়ো কোনো জবাব দিলো না। টিটকারিটা গায়ে না মেখে নিবিষ্টমনে পত্রিকা পড়ে যাচ্ছে। তাই নিরুপায় হয়ে সালেকের দিকেই ফিরলো আতাবর। “কী ভাবতাছো?”
“কিছু না,” তার দিকে না তাকিয়েই বলল সালেক।
আতাবরের ধারণা সালেক এখন ঐ হ্যাপি নামের মেয়েটার কথা ভাবছে। প্রত্যেক নারী-পুরুষের জীবনে অনেক আক্ষেপ থাকে। আতাবর জানে সালেকের একটা আক্ষেপের নাম হলো হ্যাপি।
“তুমি কেমনে বুঝলা মেয়েটা দুই নাম্বার?”
হঠাৎ করে বলা সালেকের এ কথায় আতাবর একটু অবাকই হলো। “কইলাম তো, বুঝা যায়।”
“কিন্তু কেমনে এইসব বোঝো?”
চিন্তায় পড়ে গেল আতাবর। সে বুঝতে পারে ঠিকই কিন্তু কীভাবে বুঝতে পারে সেটা নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি, ভেবেও দেখেনি। অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এরকমই হয়। “তাতো কইবার পারুম না…তয় আছে…ওগো মইদ্যে কিছু একটা আছে…তুমি দোস্ত বুঝবা না।”
“আমি কেন বুঝবো না?”
“কারণ তুমি ওগো কাছে কহনও যাও নাই।”
সালেক কিছুক্ষণের জন্যে উদাস হয়ে গেল। “তুমি কেমনে বুঝলা আমি কখনও যাইনি?”
সালেকের এই কথায় আতাবর হেসে ফেললো। “আরে, তুমি হইলা ভালা মানুষ…তুমি কি আমার মতোন নাকি!”
“তুমি অনেক যাও, তাই না?” আশ্চর্য হয়ে সালেক দেখতে পেলো আতাবর একটু লজ্জা পাচ্ছে।
“যাই। মাঝেমইদ্যে যাইতে অয়। বহুত পুরানা অভ্যাস।”
“ওরা সবাই কি এরকমই হয়?”
ঠোঁট উল্টালো আতাবর। “সবার কথা কইবার পারুম না, তয় ক্যাটাগরি আছে।” সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো সালেক। “লোয়ার ক্যাটাগরি, আপার ক্যাটাগরি…এইরকম আর কি।”
“ঐ মেয়েটা কোন ক্যাটাগরির?”
একটু ভাবলো আতাবর। যেন হিসেব করে নিচ্ছে। “মিডিয়াম অইবার পারে আবার লোয়ারও অইবার পারে।”
“লোয়ার ক্যাটাগরির কারা?”
“যারা রাস্তায় খাড়ায়া খাড়ায়া কাস্টমার ধরে,” একটু থেমে আবার বলল সে, “তয় মার্কেট খারাপ অয়া গেলে মিডিয়াম ক্যাটাগরিরগুলানও রাস্তায় নাইমা যায়।”
সালেক আপন মনে মাথা দোলাতে লাগালো। “আর আপার। ক্যাটাগরিরগুলা?”
আবারও একটু ভেবে নিলো আতাবর। “উমমম…ওগো দেইহা তুমি ভাবতেই পারবা না ওরা এই লাইনের। প্রেমে পইড়া যাইবা…বিয়া করবার চাইবা। বুঝছো? একদম বুঝবার পারবা না।”
সালেকের মনে হলো আতাবরের শেষ কথাগুলো একটু ইঙ্গিতপূর্ণ। আর সেটা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা।
“তোমার অনেক এক্সপিরিয়েন্স…না?” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল সে।
“এক্সপিরিয়েন্সের কথা যদি কও তো মনে করো এইসব নিয়া বিশাল একটা বই লেখা যাইবো।”
“ওগো কাছে তুমি কেন যাও?” সালেকের দার্শনিক মার্কা প্রশ্নটা আতাবরকে ভড়কে দিলো নাকি বিস্মিত করলো বোঝা গেল না।
“দ্যাহো, আমি শিক্ষিত-জ্ঞানীগুনী মানুষের লাহান প্যাঁচ দিয়া, সুন্দর কইরা কইবার পারুম না।”
“তুমি যে ওদের কাছে যাও এইটা নিয়া তোমার কোনো অনুশোচনা হয় না?”
“প্রথম প্রথম অইতো…মনে হইতো নষ্ট অয়া গেছি। বরবাদ অয়া গেছি। মাগার এহন আর হয় না।”
আবারও আলতো করে মনের অজান্তে মাথা দোলালো সালেক। ঠিক তখনই তার মোবাইলফোনটা বেজে উঠল। বাড়ির কোনো মুরুব্বির সাথে বিয়ের কেনাকাটা আর আয়োজন নিয়ে আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।
ঘোৎ করে একটা শব্দ হতেই আতাবর আবার নজর দিলো ডান দিকে। বুড়ো লোকটা দু-হাতে পত্রিকা ধরে চোখ-মুখ খিচে আছে। ভালো করে বুড়োর দিকে তাকালো সে। দাঁতে দাঁত চেপে বৃদ্ধ ঢলে পড়ল তার উপরে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আতাবর তার বন্ধুকে বলল, “সালেক, বুইড়া কিমুন জানি করতাছে!”
সালেক ফোন রেখে বুড়োর দিকে তাকালো। আতাবর বুড়োকে দু-হাতে ধরে বলল, “কী অইছে…? আপনি এমন করতাছেন ক্যান?” বন্ধু সালেক তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে বুড়োর দিকে। সে কিছু বলছে না। আবার বন্ধুর দিকে ফিরলো। “বুড়ার মনে হয় ইসটোক করছে…ডাক্তার লাগবো…হাসপাতালে নিতে হইবো…গাড়ি থামাইতে কও!”
এমন সময় সালেক আতাবরের মুখে হাত চাপা দিলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিস্ফারিত চোখে বন্ধুর দিকে চেয়ে রইলো সে।
.
যাত্রা ৫
বাস চলছে দ্রুতগতিতে। বিকেল পেরিয়ে গাঢ় হতে শুরু করেছে সন্ধ্যার অন্ধকার। যাত্রিদের বেশিরভাগই নিস্তেজ হয়ে শুয়ে-বসে ঝিমুচ্ছে। অন্য সব যাত্রির তুলনায় আতাবর আর সালেকের অবস্থা একেবারেই ভিন্ন। একটু আগে যে ঘটনা ঘটে গেছে সেটা এখনও হজম করতে পারছে না তারা। তাদের পাশে বুড়ো লোকটা নিথরভাবে বসে আছে। দেখলে মনে হবে যাত্রাপথের ক্লান্তিতে ঘুমাচ্ছে সে।
আতাবরের এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করা। “এহন কী করমু?” আস্তে করে বন্ধুকে বলল সে।
“মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হইবো। বুড়া যে মরছে এইটা যেন কেউ না বোঝে।”
উদাস হয়ে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আতাবর বলল, “আচ্ছা, এই টিকিটটা দেহাইলেই পুরস্কার দিয়া দিবো?” সালেক মাথা দোলালো। “টিকিটের গায়ে তো মালিকের নাম লেখা থাকে না,” বিড়বিড় করে বলল আতাবর। “সারা জীবন কুনো লটারির টিকিট বাদ দেই নাই…এহনও পকেটে একটা আছে…আর দ্যাহো, এই বুইড়া কিনা…!”
“পুরা চল্লিশ লাখ!” নিষ্পলক চোখে বলল সালেক। কিছুক্ষণ ধরেই তার ভাবভঙ্গি বদলে গেছে। তার কারণেই আজ তাদের হাতে চল্লিশ লাখ টাকার একটি লটারির টিকেট। আতাবর যখন সালেককে বলল বাস থামাতে তখন তার মুখে হাত চাপা দিয়ে তাকে চুপ করতে বলেছিল। প্রথমে আতাবর বুঝতে পারেনি তার বন্ধু এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন। পরক্ষণেই সালেক যখন মেলে ধরা পত্রিকার একটি খবরের দিকে ইঙ্গিত করলো, আতাবর তখনও ধরতে পারেনি। তারপর বুড়োর এক হাতে একটা লটারির টিকেটের দিকে তার মনোযোগ আকর্ষণ করলে মুহূর্তে আতাবর বুঝে যায়। কোনো বাক্য ব্যয় না করেই তারা একটা সিদ্ধান্তে চলে আসে : বুড়ো লোকটা মরুক।
এখন মৃত বৃদ্ধলোকটার সৌভাগ্যের চল্লিশ লাখ টাকা তাদের হাতে!
আচমকা এই সৌভাগ্যের আগমনে ধন্দে পড়ে গেল সালেক। চল্লিশ লাখ টাকা! একটা জীবন কতো দ্রুতই না বদলে যেতে পারে এই পরিমাণ টাকায়! এই জীবনে দু’লাখ টাকাও নিজের হাতে কখনও ধরে দেখেনি। চাকরিতে ঢোকার পর পাঁচ-পাঁচটা বছর কেটে গেছে, বহু কষ্টে, অনেক শখ জলাঞ্জলী দিয়ে গোপনে কিছু টাকা জমিয়েছে সে। সর্বসাকুল্যে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার হবে। আর এখন…পুরো চল্লিশ লাখ টাকা!
সঙ্গে সঙ্গেই তার ভুলটা ভাঙলো। লটারির টিকেটটা তো তার কাছে নেই! সেটা প্রথম থেকেই আতাবরের হাতে। শুধু পত্রিকার ফলাফল দেখে লটারির নাম্বারটা মিলিয়ে নেবার সময় তার হাতে এসেছিল কিছুক্ষণের জন্য। আতাবরের দিকে ফিরে তাকালো, ছেলেটা কী যেন ভাবছে। সালেকের চল্লিশ লাখ টাকার স্বপ্ন এক নিমেষে বিশ লাখে নেমে এলো।
“কী ভাবতাছো?”
“ভাবতাছি এই টিকিট নিয়া তোমাগো গ্রামে যাওন ঠিক অইবো না,” আতাবর বলল।
“মানে?”
“আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আইছে, দোস্ত।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো সালেক।
কণ্ঠটা একেবারে নিচে নামিয়ে বলল আতাবর, “তুমি তোমার বাড়িতে যাও, আমি ঢাকায় ফিরা যাই। দেরি করা ঠিক অইবো না। আমি যতো তাড়াতাড়ি পারি লটারির ট্যাকা তুইলা রাখুম। তুমি গ্রামে গিয়া নিশ্চিন্তে কাবিন কইরা ঢাকায় ফিরা আহো। তার বাদে দুইজনে মিলা ট্যাকা ভাগ কইরা লমুনে।”
দ্বিধায় পড়ে গেল সালেক। “আমি…মানে, কইতাছিলাম কি…চলো দুইজনেই ঢাকায় ফিরা যাই?”
“পাগল অইছোনি?…শুক্কুরবার না তোমার কাবিন?”
সালেক মাথা দোলালো। “হ…কিন্তু—”
“আরে, তুমি কি আমারে বিশ্বাস করতে পারতাছো না?”
“না…বিশ্বাস করুম না কেন…এইটা তুমি কী কইলা!”
“হুনো, এই চল্লিশ লাখ টাকার জিনিস লইয়া রিস্ক লওন যাইবো না। বুইড়া যে মইরা গেছে এইটা তো বেশিক্ষণ চাপা দিয়া রাখা যাইবো না। কিছুক্ষণ পরই জাইনা যাইবো সবাই। তহন যদি আমাগো ধরে…সন্দেহ করে?” সজোরে মাথা দোলালো আতাবর। “তার চায়া ভালা, আমি সামনের স্টপেজেই নাইমা একটা গাড়ি নিয়া ঢাকায় ফিরা যাই।”
আতাবরের এই পরিকল্পনার সাথে সালেক মোটেও একমত হতে পারছে না, তবে এটা মুখে বলতেও পারছে না বন্ধুকে। একান্ত অনিচ্ছায় মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
চল্লিশ লাখ এক ধাক্কায় নেমে গেছে বিশ লাখে। এখন আতাবর যদি কোনোভাবে ঢাকা শহরে চলে যায় তাহলে হয়তো পুরো টাকাটাই বেহাত হয়ে যাবে। স্থানীয় ছেলে সে, তাকে কোনোভাবে চাপও দিতে পারবে না। উল্টো সালেককে এলাকা ছাড়া করতে পারবে। এসব ভেবে ভেবে তার মাথাটা ভনভন করতে লাগলো।
এমন সময় কন্ডাক্টর ছেলেটা সালেকের কাছে এসে দাঁড়ালে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল তারা দুজন। ছোকরাটা নিথরভাবে বসে থাকা বুড়োর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। “এই যে মুরুব্বি?”
সালেক আর আতাবর ভেবে পেলো না কী করবে। ছেলেটা আবারও বুড়োকে ডাকলে আতাবর তাকে বাধা দিয়ে বলল, “দেখতাছো না চাচামিয়া ঘুমাইতাছে…হেরে ডাকতাছো ক্যান?”
“হে বাসে উঠার সময় কইছিল ফুলতলায় আইলে হেরে যে কই।”
এবার সালেক জবাব দিলো। “সামনের স্টপেজ কি ফুলতলা?” কন্ডাক্টর ছেলেটা মাথা নাড়লো। “আচ্ছা, তুমি যাও…আমরা ডাইকা দিমুনে।”
কন্ডাক্টর ছেলেটা এ কথা শুনে চলে গেল।
সালেক পাশ ফিরে দেখলো আতাবর তার দিকে চেয়ে আছে। “কইছিলাম না…এই বাসে থাকাটা রিস্কি হয়া যাইবো। যেকোনো সময় জানাজানি হয়া যাইবো এই বুইড়া মইরা গেছে।”
“বুড়া মরলে তার জন্যে কি সবাই আমাদের ধরবো?” সালেক জানতে চাইলো।
“বুইড়া কখন মরলো, কেমনে মরলো, আমরা কেন ড্রাইভারে বাস থামাইতে কইলাম না, এইসব জানতে চাইবো না?”
সালেক চুপ মেরে গেল। “পাশের সিটে একজন স্টো করলো আর আমরা কিছুই জানলাম …এইটা কেউ বিশ্বাস করবো মনে করছো?” আতাবর পাল্টা যুক্তি দেখালো এবার। “নানান ধরণের প্রশ্ন করবো…কী কইতে কী কমু…একটু এদিক ওদিক হইলেই তো ধরা খায়া যামু আমরা!”
চুপ মেরে থাকলো সালেক।
ফুলতলা স্টপেজে বাস থামলে কিছু যাত্রি নেমে গেল। কন্ডাক্টর ছেলেটা বাসের দরজার পাদানি থেকে বার কয়েক তাকালো তাদের দিকে। সালেকের সাথে তার চোখাচোখি হতেই সে বুড়োর দিকে ইঙ্গিত করলে সালেক ডান হাত তুলে তাকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু কী বোঝাতে চাইছে সেটা সে নিজেই জানে না। কন্ডাক্টর ছেলেটাকে নিয়ে তারা দু’জনেই বেশ চিন্তায় আছে।
বাস ছাড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে এমন একটা ঘটনা ঘটলো যে ভয়ে সালেক আর আতাবরের রক্ত হিম হয়ে গেল। গেটের সামনে থেকে কন্ডাক্টরকে ধাক্কা মেরে হুরমুর করে ঢুকে পড়ল বেশ কয়েকজন পুলিশ। তাদের ভাবভঙ্গি খুবই আগ্রাসী।
.
যাত্রা ৬
গেটের সামনে দু’জন পুলিশ পথরোধ করে আছে, বাকি তিনজন বাসে উঠে প্রত্যেক যাত্রিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো এক এক করে। পুলিশ দলের নেতাগোছের লোকটি বাসের শেষ সিটের দিকে চোখ স্থির করলো। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে দুই যুবক। তাদের কাছে যে তথ্য আছে এ দু’জনের সাথে তা বেশ মিলে যায়। একেবারে নার্ভাস হয়ে আছে তারা। পুলিশের লোকটি এগিয়ে গেল সেদিকে।
আতাবর আর সালেকের বুক ধপধপ করতে শুরু করলো। জীবনে এরকম পরিস্থিতিতে কখনও তারা পড়েনি। হাতে চল্লিশ লাখ টাকা পাবার সমস্ত আনন্দ এখন সুকঠিন ভীতিতে পরিণত হয়েছে। তাদের পাশে আছে মৃত এক বুড়ো। পুলিশের লোকটা আস্তে আস্তে নাটকীয় ভঙ্গিতে আসছে তাদের দিকে। আতাবর আর সালেক বুঝতে পারছে না কী করবে।
“নাম কি?” পুলিশের লোকটা সালেকের সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো।
“সা-সা-সালেক।”
“আপনার?” পাশে বসা আতাবরেকে বলল অফিসার এবার।
“আতাবর।” অনেক কষ্টে সমস্ত ভীতি আড়াল করে বলতে পারলো সে।
“আতাউর?”
“না, আতাবর,” শুধরে দিয়ে বলল এবার।
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“এইতো গ্রামে…”
“কোন গ্রামে? নাম কি?”
“আমি তো ঠিক কইবার পারুম না…”
“কী?” অফিসার কাছে এগিয়ে এলো। “কইতে পারবেন না মানে?”
আতাবর সালেককে দেখিয়ে বলল, “হের লগে হেগো গ্রামে যাইতাছি।”
পুলিশ সালেকের দিকে তাকালে সে বলল, “দিনাজপুরের আরবপুর…আমার বিয়ে…মানে, কাবিন…ও আমার বন্ধু।”
অফিসার মাথা নেড়ে এবার আতাবরের পাশে থাকা বুড়োকে দেখিয়ে বলল, “এই লোকও কি আপনাদের সাথে…?”
“হ…না…মানে…”
সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো পুলিশ। “হ-না মানে কী?”
“না,” আতাবর বলল।
“ঘুমায়া আছে নাকি?”
“হ।” আতাবর কথাটা বলেই প্রমাদ গুনলো। তার হাতে থাকা চল্লিশ লাখ টাকার লটারির টিকেট-সব শেষ হয়ে গেল বুঝি।
“আপনার হাতে কী?” আতাবরের হাতের মুঠোয় থাকা টিকেটের দিকে ইঙ্গিত করলো অফিসার।
“ল্-ল্-লটারির টিকিট।” এবার আতাবরও তোতলাতে শুরু করলো।
মাথা দোলালো অফিসার। “বুড়োকে একটু ডাকেন,” আতাবরকেনির্দেৰ্ম দিলো।
কয়েক মুহূর্তের জন্যে আতাবরের মনে হলো তার শরীরের সমস্ত রক্ত বুঝি শুষে নেয়া হয়েছে। নিজের হৃদস্পন্দনটা স্পষ্ট কানে আসছে এখন।
“কী হলো-”
অফিসারের কথাটা শেষ হবার আগেই বাসের মধ্যে একটা হট্টগোল শুরু হয়ে গেল।
.
অগ্যস্ত যাত্রা
হট্টগোলের কারণ জানালা দিয়ে মুক্তার হোসেন নামের যাত্রিটি লাফিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছে।
পুলিশ তৎপর হয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। আতাবর আর সালেককে বাদ দিয়ে বাস থামাতে বলল, হুরমুর করে এগিয়ে গেল বাসের গেটের দিকে।
কিন্তু বাস থামতেই পুলিশদের আর কিছু করতে হলো না। মুক্তার জানালা দিয়ে লাফ দিতেই মর্মান্তিক একটি ঘটনা ঘটে গেল। বাস থেকে নেমে দৌড়ে রাস্তা পার হবার সময় একটা ট্রাকের নিচে চাপা পড়ল সে।
পুলিশ বাস থেকে নেমে দুর্ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত হলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো আতাবর আর সালেক। এ ঘটনার কারণে প্রায় আধঘণ্টা দেরি হয়ে গেল তাদের।
বাস চলতে শুরু করলো আবার। বাসের বাকি যাত্রিরা এখন জানে কুখ্যাত বোমমুক্তার গতকাল ভোরে নিজের বাড়ির ছাদের উপর বোমা বানাতে গিয়ে দুর্ঘটনা বাধায়, এতে করে ঘটনাস্থলেই তার দুই সহযোগীর মৃত্যু হয়। অক্ষত আর প্রাণে বেঁচে যাওয়া মুক্তার ঢাকা ছেড়ে দিনাজপুরের এক গ্রামে গা ঢাকা দিতে চেয়েছিল কিন্তু বাস ছাড়ার আগে পুলিশের এক ইনফর্মার তাকে দেখে ফেলে। বাসকাউন্টার থেকে গন্তব্য জেনে যাত্রাপথের সবগুলো থানায় জানিয়ে দেয়া হয়েছিল।
“কী বাঁচনটাই না বাঁচছি,” বন্ধু সালেকের দিকে ফিরে বলল আতাবর। “এই মুরদার লগে বেশিক্ষণ থাকন যাইবো না। আমি সামনের স্টপেজেই নাইমা যামু।”
সালেক চুপ মেরে থাকলো। এখন রাতের গাঢ় অন্ধকারে চলছে তাদের বাস। সালেকের মাথা কাজ করছে না।
“এহন তো বাসে অনেক সিট খালি…আমি নাইমা যাওয়ার পর তুমি অন্য একটা সিটে গিয়া বইসো।”
“…এই লাশটার কি হইবো?” অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বলল সালেক।
“এইটা নিয়া ভাইবো না…লাস্ট স্টপেজের আগে নাইমা যাইও…বাকি পথ একটু কষ্ট কইরা ম্যানেজ কইরো, দোস্ত।” কণ্ঠটা আরও নিচে নামিয়ে বলল সে, “রিস্ক লওনটা ঠিক হইবো না।”
সামনের এক সিটে বোরখা পরা এক মহিলা আর তার স্বামী বসে আছে স্বামী ভদ্রলোক কন্ডাক্টরের কানে কানে অতি গোপনীয় কিছু একটা বলার পর ছোকরা ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে হাঁক দিলো, “ওস্তাদ, বাস থামান…লেডিস মোতবে!”
বোরখা পরা মহিলা কাণ্ডজ্ঞানহীন ছোকরার কারণে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল।
চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। মাঝে মধ্যে সড়ক দিয়ে একটা দুটা বাস ট্রাক যাচ্ছে। সড়কের দু’পাশে ডোবা-নালা আর ঝোঁপঝাঁড়। আশেপাশে কোথাও জনমানবের কোনো চিহ্ন নেই। আস্তে করে গতি কমিয়ে বাসটা সড়কের একপাশে গিয়ে থামলে বাস থেকে নেমে গেল বোরখা পরা মহিলা আর তার স্বামী। ড্রাইভার এই অর্নিধারিত বিরতির সুযোগ নিয়ে একটা সিগারেট ধরালো।
“আমিও একটু ছাইড়া আহি,” বলেই আতাবর বাস থেকে নেমে যেতে উদ্যত হলো।
“কই যাও?” সালেক বিস্ফারিত চোখে জানতে চাইলো।
ডান হাতের কড়ে আঙুলটা উঁচিয়ে দেখালো সে।
আতাবর বাস থেকে নামার পর এক মিনিটও যায়নি অস্থির হয়ে উঠল সালেক। মাথাটা কাজ করছে না। কোনো কিছু না ভেবে হুট করেই সে-ও বাস থেকে নেমে পড়ল।
“হাগা-মুতার সিরিয়াল লাইগ্যা গেছে দেহি,” সিগারেটে টান মেরে আপন মনে বলল ড্রাইভার। সালেক যখন গেট দিয়ে নেমে যাবে তখন পেছন থেকে তাকে লক্ষ্য করে আরও বলল সে, “বেশি দেরি কইরেন না।”
মহাসড়কের কোথাও একফোঁটা আলো নেই। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখলো আতাবরের টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। তার বুকটা ধক করে উঠল। কালো বোরখা পরা মহিলা আর তার স্বামী গেছে ডান দিকে, সালেক সেটা বাস থেকেই দেখেছে কিন্তু আতাবর কোন দিকে গেছে? একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বাম দিকেই পা বাড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে কয়েক গজ দূরে এসে আবার থেমে গেল সিদ্ধান্তহীনতায়। তার হাত-পা কাঁপছে। এদিক ওদিক উদভ্রান্তের মতো তাকালো। কোথাও নেই।
ঠিক তখনই একটা জিনিস চোখে পড়ল। কিছুটা দূরে, সড়ক থেকে একটু নিচে, ঝোঁপের কাছে ছোট্ট আলোর বিন্দু নড়ছে। দ্রুত এগিয়ে গেল সেখানে। আবছায়া মূর্তিটা থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই মহাসড়ক দিয়ে ছুটে যাওয়া বাসের হেডলাইটের আলোয় বুঝতে পারলো আতাবর ঝোঁপের সামনে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছে। তার মুখে জ্বলন্ত সিগারেট।
সন্তর্পনে তার পেছনে এসে দাঁড়ালো সালেক। ছলছল করে শব্দ হচ্ছে। আতাবরের প্রস্রাব গিয়ে পড়ছে নিচের ডোবায়। পেছনে যে সালেক এসে দাঁড়িয়েছে সেটা টের পায়নি।
আশেপাশে তাকালো সালেক। কেউ নেই। চারপাশ ঘন অন্ধকারে ঢাকা। আস্তে করে আরেকটু এগিয়ে গেল সে।
*
“আর কেউ বাকি আছে?”
বাস ড্রাইভারের এ কথায় ছ্যাৎ করে উঠল সালেকের বুকটা। এখন সে বসে বুড়োর লাশের পাশে। তাদের দু’জনের মধ্যে এখন বেশ ফাঁকা একটি জায়গা।
“ওই, দ্যাখ তো আর কেউ বাকি আছে কিনা, কন্ডাক্টরকে বলল ড্রাইভার।
কন্ডাক্টর ছেলেটা বাসের ভেতর এক নজর চোখ বুলিয়ে থমকে গেল সালেকের দিকে চেয়ে। হাত তুলে তাকে ইশারা করে বলল, “আপনার লোক কই?”
“নাইমা গেছে।” ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড নাভাস। “ওর বাড়ি এইখানেই।” অবাক হয়ে গেল এতোটা স্বাভাবিকভাবে মিথ্যে বলতে পারছে। বলে।
“ওস্তাদ…ছাড়েন,” জোরে বলল ছেলেটা।
বাস আবারও চলতে শুরু করলো। যাত্রিদের বেশিরভাগই যার যার গন্তব্যে নেমে যাচ্ছে। শেষ স্টপেজে পৌঁছাতে এক ঘণ্টারও কম সময় বাকি।
পকেট থেকে লটারির টিকেটটা বের করে দেখলো সালেক। চল্লিশ লাখ টাকা এখন তার হাতে। ভাগাভাগির কোনো ব্যাপার নেই। তার জীবনটাই পাল্টে যাবে। কোনো কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। একটু আগে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাকে। না নিয়ে উপায়ও ছিল না। তার বন্ধু আতাবর একবার ঢাকায় চলে গেলে সব শেষ হয়ে যেতো। রাজনীতি করা ছেলে, তাকে ঘাটানো যেতো না। অসহায়ের মতো সালেক চেয়ে চেয়ে দেখতো আতাবর চল্লিশ লাখ টাকা বাগিয়ে নিয়ে মওজ-ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে।
কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাকে। তবে ঘটনাটা এতো সহজে ঘটাতে পারবে সেটা সে ভাবতে পারেনি। আরেকটা কাজ করতে হবে তাকে। বাড়িতে একটা ফোন করতে হবে। এই কাজটা অবশ্য তার জন্যে একটু বেশি কঠিন। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করতে যাবে এমন সময় চেয়ে দেখলো সামনের সিট থেকে মেয়েটা উঠে তার দিকে আসছে।
“কিমুন আছো?” মেয়েটা তার সামনে এসে বললে সালেক মলিন একটা হাসি দিলো। “অনেক দিন পর দেখা হইলো…তাও আবার বাসে…”
“তুমি কেমন আছো?” সালেক বলল।
“আছি আর কি…তোমার খবর কী?”
“ভালো।”
মেয়েটা এবার সালেকের পাশে তাকালো।
“তোমার বন্ধু কই?”
“নাইমা গেছে।”
“তাইলে তোমার লগে বসি?” মেয়েটার এ কথায় সালেক কিছু বলল না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো। “কী?…সমস্যা আছে?”
“না…বসো,” বলেই একটু সরে গেল সালেক।
তার পাশে মেয়েটা গা ঘেষে বসতেই অনেক দিন পর সুবর্ণার চুলের গন্ধ টের পেলো সে। প্রথম দিনেই এই গন্ধটা তার খুব ভালো লেগেছিল। যেদিন এই মেয়েটার কাছে গিয়েছিল সেদিনের কথা তার স্পষ্ট মনে আছে। সুখকর কোনো স্মৃতি নয় সেটা, তারপরও ঘটনাটা মনে করলে তার ভালো লাগে। প্যান্ট খোলার আগেই তার পতন হয়েছিল, লজ্জায় একেবারে কুঁকড়ে গেছিল সে। কিন্তু সুবর্ণা পরম মমতায় তাকে আদর করতে করতে বলেছিল এটা কোনো ব্যাপার না। প্রথম প্রথম নাকি এরকম হয়। তারপরও সালেক নিজেকে ফিরে পায়নি। মেয়েটার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে এসেছিল, বলেছিল পরে আবার আসবে।
“অনেক দিন হয়া গেল, তুমি তো আর আসলা না…তোমারে খুব মনে পড়তো।”
সুবর্ণার দিকে নিস্পলক চেয়ে রইলো সালেক। আগের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর হয়ে গেছে মেয়েটা।
“কি দ্যাখতাছো?” চোখেমুখে এক ধরণের ইশারা করে জানতে চাইলো সুবর্ণা।
“তুমি অনেক সুন্দর হয়া গেছে।”
মুখ টিপে হাসলো সে। “আমার কথা তোমার মনে পড়ে নাই?”
“পড়ছে।”
“তাইলে আর আসলা না যে?”
চুপ মেরে রইলো সালেক।
“কই যাইতাছো?” অনেকক্ষণ পর জানতে চাইলে সুবর্ণা।
“বাড়ি…” তখনই সালেকের মনে পড়ে গেল আগামী শুক্রবার তার কাবিন।
“আমিও।” কথাটা বলেই সালেকের পাশে থাকা বুড়োর দিকে তাকালো সুবর্ণা। “এই বুড়ার কী হইছে?”
আৎকে উঠল সালেক। “কী হইছে, মানে…?”
“সেই কখন থেইকা দেখতাছি মরার মতো ঘুমাইতাছে।”
ভেবে পেলো না কী বলবে।
সালেকের কাঁধে হাত রাখলো সুবর্ণা। “ঐ খচ্চরটার হাত থেইকা যখন বাঁচাইলা আমার যে কী ভালা লাগছিল তোমারে কইবার পারুম না।” কথাটা বলেই হৃদয় উথাল-পাথাল করা একটা হাসি দিলো সে। “মনে হইতাছিল ফিল্ম দেখতাছি…তুমি নায়কের মতো আমারে…”
সুবর্ণা কথা শেষ করার আগেই তাদের বাস আচমকা বাম দিকে মোড় নিলে বুড়োর নিথর দেহটা হেলে সালেকের উপর হামলে পড়ল। মুখটা উপুড় হয়ে পড়ল সুবর্ণার কোলে।
“হায় আল্লা!” সুবর্ণা ভড়কে গিয়ে বুড়োর মাথাটার দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিতে যাবে এমন সময় সালেকের বলিষ্ঠ হাত তার মুখ চেপে ধরলো।
.
যাত্রা বিরতি ৮
“বুড়া মইরা গেছে!” সুবর্ণার কানের কাছে মুখ এনে বলল সালেক।
“কেমনে মরলো?” মুখ থেকে সালেকের হাতটা সরতেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে জানতে চাইলো সুবর্ণা।
“হার্ট ফেইল করছে মনে হয়।”
“কখন?”
“অনেকক্ষণ আগে।”
“তাইলে ব্যাপারটা গোপন রাখছো কেন…?”
“আছে…একটা কারণ আছে।”
ভুরু কুঁচকে তাকালো সুবর্ণা। “তোমরা মারো নাই তো?”
“আরে না! আমরা ক্যান মারুম?”
“তাইলে কাউরে কইলা না ক্যান?”
“কইলাম না কারণ আছে…” সালেক বুঝতে পারছে না মেয়েটাকে কীভাবে বোঝাবে।
“কী কারণ যে কইতে পারতাছো না?” সুবর্ণার সন্দেহ দূর হচ্ছে না।
“কমু…কিন্তু তার আগে কও তুমি কাউরে বলবা না?”
অবাক চোখে তাকালো সুবর্ণা। “কমু না…কাউরে কমু না।”
সালেক পুরো ঘটনাটা সংক্ষেপে খুলে বললে সুবর্ণা চুপ মেরে রইলো।
“কী হইলো…চুপ মাইরা আছো কেন?”
“চল্লিশ লাখ টাকা?” বিড়বিড় করে বলল সে। “প্রথম পুরস্কার?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। সুবর্ণার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, “কাউরে কইও না…তুমিও ভাগ পাইবা।”
অবিশ্বাসে তার দিকে তাকালো সুবর্ণা। “আমারে ভাগ দিবা?”
মাথা দোলালো সালেক। “এক লাখ?”
“এক লাখ!” আপন মনে বলল মেয়েটি।
“দু-দুই…দুই লাখ?” নার্ভাস হয়ে বলল সালেক।
ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে রইলো সুবর্ণা।
“তুমি তোমার সিটে গিয়া বসো, কন্ডাক্টর সন্দেহ করতে পারে।”
কিছুক্ষণ ভেবে সুবর্ণা চুপচাপ নিজের সিটে ফিরে গেল।
বাড়িতে ফোন করার কথাটা মনে পড়তেই মনে মনে জিভ কাটলো সালেক। কঠিন একটা কাজ করলো সে। মাকে জানিয়ে দিলো তার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব নয়। কথা বলা শেষ করে ফোনটা পকেটে না রেখে আরেকটা নাম্বারে ডায়াল করলো।
“কী ব্যাপার, হঠাৎ আমাকে মনে পড়ল!” ওপাশ থেকে কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে বলল একটি নারীকণ্ঠ।
“তুমি কেমন আছো?”
“ভালো…তোমার কী খবর?”
“ভালো-”
“ভালো তো লাগবেই। হাজার হোক বিয়ে করতে যাচ্ছো,” কথাটা বলেই হেসে ফেললো মেয়েটি।
সালেক রীতিমতো ভিরমি খেলো। তার বিয়ের খবর আতাবর ছাড়া আর কেউ জানে না। এমনকি অফিস থেকে যে একদিনের ছুটি নিয়েছে সেখানেও কারণ হিসেবে বলেছে বাবার অসুস্থতার কথা।
“আমার বিয়ের কথা তুমি কীভাবে জানলে?!”
ওপাশ থেকে নীরবতা নেমে এলো।
“হ্যালো?” তাড়া দিলো সালেক।
“তোমার সাথে যে আছে তাকে বলো আমি কেমনে জানলাম!” রহস্য করে বলল হ্যাপি।
সালেকের গায়ের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে গেল। “কী বলছো?”
“তোমার সাথে আতাবর আছে না?”
আতাবরের কথা বলছে হ্যাপি? অনেকটা বজ্রাহত হলো সালেক। আতাবরের সাথে যে হ্যাপির পরিচয় আছে সেটা সে জানতো না। হ্যাপিও কখনও এটা বলেনি।
“চুপ করে আছো কেন?”
“আতাবরের সাথে তোমার পরিচয় আছে সেটা তো জানতাম না!” আস্তে করে বলল সে।
“কেন…আতাবরের সাথে আমার পরিচয় থাকতে পারে না?”
“তোমরা তো কখনও আমাকে বলোনি।”
“তুমি আমাকে মনে মনে পছন্দ করো তাই আতাবর এ কথা বলতে বারণ করেছিল আমাকে।”
আরেকবার বিস্মিত হলো সালেক। তার বন্ধু আতাবরের সাথে হ্যাপির সম্পর্ক আছে! অথচ হ্যাপির প্রসঙ্গ এলেই আতাবর বলতো মেয়েটা ভালো না। “তোমাদের সম্পর্ক কতোদিনের?”
“সম্পর্ক!” করুণ হাসি দিলো মেয়েটি। “কী যে বলো! আমি কি বলেছি আমাদের মধ্যে সম্পর্ক আছে?” আরও রহস্য করে বলল এবার।
“তাহলে?”
“তোমার বন্ধুকে বলল…আমাকে বলছো কেন?”
“হ্যাপি, আমাকে ঠিক ঠিক বলো, তোমার সাথে আতাবরের কী সম্পর্ক? ব্যাপারটা জানা আমার জন্যে খুব জরুরি।”
“জরুরি? আজব! কী বলছো এসব!”
“প্লিজ!”
“শোনো, আমার সাথে আতাবরের একটা সম্পর্ক আছে সত্যি, তবে সেটা প্রেমের নয়।” একটু চুপ থেকে আবার বলল হ্যাপি, “আমাদের মতো মেয়ের সাথে কেউ সম্পর্ক করে না।”
“মানে?” একেবারে রহস্যের প্রহেলিকায় তলিয়ে যাচ্ছে সে।
“তোমার সাথে আতাবর আছে না? তাকে জিজ্ঞেস করো।”
চুপ মেরে রইলো সালেক। আতাবরের একটা কথা কানে বাজতে লাগলো : লোয়ার ক্যাটাগরি…আপার ক্যাটাগরি । আস্তে করে কল কেটে দিয়ে মোবাইল ফোনটা আনমনে পকেটে ঢুকিয়ে রাখতেই দেখতে পেলো কন্ডাক্টর ছেলেটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। প্রমাদ গুনলো সে।
“কী ভাই, আপনার বন্ধু কই নাইমা গেল?”
“ওর একটা জরুরি ফোন আইছিল…ঢাকায় ফিরা গেছে।”
“কেমনে ফিরা গেল? গাড়িঘোড়া কিছু পাইবোনি?”
সালেক কিছু বলল না।
কন্ডাক্টর ছেলেটা এবার বুড়োর দিকে তাকালো। “হের কি অবস্থা?”
“ঘুমাইতাছে,” ছোট্ট করে বলল সালেক।
“এতোক্ষণ ধইরা ঘুমাইতে আছে?” ছেলেটা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো বুড়োর দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো এবার।
“ওই চাচা মিয়া, ছেলেটা বুড়োকে উদ্দেশ্য করে ডাকলে সালেকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো। তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কী করবে সে? কিছু একটা করতে হবে দ্রুত।
সালেক কিছু একটা করতে যাবার আগেই হঠাৎ করে ফোনের রিং বাজতে শুরু করলো, একে অন্যের দিকে তাকালো কন্ডাক্টর আর সালেক। শব্দটা আসছে বুড়োর পকেট থেকে! হায় আল্লাহ, বুড়ার কাছে একটা ফোন আছে!
“কি ভাই, বুড়া ফোন ধরে না ক্যান?” বিস্ময় আর সন্দেহভরা কণ্ঠে বলল কন্ডাক্টর। একটু সামনে এসে বুড়োকে ধরতে যাবে অমনি সালেক খপ করে ছেলেটার হাত ধরে ফেললো। কী বলবে কিছুই তার মাথায় আসছে না। হঠাৎ করে তার মুখ দিয়ে ফিসফিসিয়ে একটা বাক্য বেরিয়ে গেল। “ভাই, আপনেরে আমি অনেক টাকা দিমু…চুপ কইরা খালি আমার কথা শোনেন!”
ভুত দেখার মতো বিস্ময় নিয়ে কন্ডাক্টর ছেলেটা তাকালো তার দিকে।
সুবর্ণার কাছে যে গল্পটা বলেছিল সেটাই আবার পুণরাবৃত্তি করলো, এবারের শ্রোতা বাসের অল্পবয়সি কন্ডাক্টর।
সব শুনে ছেলেটার চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বের হয়ে যেতে চাইছে। “কতো ট্যাহার কথা কইলেন?”
“চল্লিশ।”
“তাইলে এহন কন, আমারে কতো দেবেন?”
“দুই? তিন?” সালেক নিশ্চিত হতে পারছে না কতো বলবে।
ছেলেটা চুপ মেরে কী যেন ভেবে বলল, “লটারির টিকিটটা একটু দ্যাহান দিহি?”।
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো সালেক। “টিকিটটা একটু দ্যাহান মোরে,” আবারও তাড়া দিলো সে।
অগত্যা পকেট টিকেটটা বের করে নিজের হাতে রেখেই মেলে ধরলো। ছেলেটা নিষ্পলক চেয়ে রইলো সেটার দিকে। তারপর আচমকা টিকেটটা লক্ষ্য করে ছোঁ মেরে বসলো, কিন্তু সালেকও প্রস্তত ছিল, সঙ্গে সঙ্গে হাতটা সরিয়ে নিতে পারলো সে।
ছেলেটা দ্রুত নিঃশ্বাস নিচ্ছে। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে সালেকের দিকে। সালেকের দৃষ্টিতেও এমন কিছু আছে যে ছেলেটা ধস্তাধস্তি করার চেষ্টা করলো না। কয়েক মুহূর্ত দুজনের কেউই সিদ্ধান্তে আসতে পারলো না কী করবে। অবশেষে ছেলেটা গেটের সামনে গিয়ে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রইলো, যেন এই বাস থেকে সালেক কোনোভাবেই নামতে না পারে।
কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম বাঁ-হাতে মুছে নিলো সালেক। বুঝতে পারছে কিছু একটা করতেই হবে, তা না হলে চল্লিশ লাখ টাকা বেহাত হয়ে যাবে। কন্ডাক্টরকে লটারির টিকেটের কথা বলাটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। তবে ঐ মুহূর্তে তার মাথায় অন্য কিছুও আসেনি।
গাঢ় অন্ধকার মহাসড়ক ধরে বাস চলছে। একটু আগে একটা স্টপেজে কিছুক্ষণের জন্যে বাস থেমেছিল কয়েকজন যাত্রিকে নামিয়ে দেবার জন্যে, সালেকও চেয়েছিল নেমে যেতে কিন্তু পারেনি। কন্ডাক্টর ছেলেটা তাকে কড়া নজরে রেখেছে।
এখন বাসে ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর ছাড়া সুবর্ণা, সালেক, মৃত বুড়ো, বোরখা পরা মহিলা আর তার স্বামী রয়েছে। এক অজানা আশংকায় সালেকের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। কন্ডাক্টর ছেলেটার ভাবগতি দেখে সুবর্ণাও কিছুটা আঁচ করতে পেরে মাঝেমধ্যে পেছন ফিরে সালেকের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু সে কোনো রকম সাড়া দিতে পারছে না।
কন্ডাক্টর গেট থেকে ড্রাইভারের কাছে এসে নীচু কণ্ঠে কী যেন বলল। সালেক বুঝতে পারছে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি করে ফেলছে। কন্ডাক্টর কথা শেষ করার আগেই ড্রাইভার আচমকা ব্রেক কষে রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে একেবারে পেছনের সিটের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকালো। লোকটার চোখমুখ এখন ডাকাত দলের সর্দারের মতো দেখাচ্ছে। যেন এক্ষুণি কারোর কল্লা নামিয়ে দেবে ঘাড় থেকে!
সালেক ঠিক করলো সামনের বাম দিকের একটি সিটের জানালা দিয়ে লাফ দেবে। রাস্তার পাশে ডোবা নয়তো নীচু জলাভূমি কিংবা কপাল ভালো থাকলে ঘাসের উপর গিয়ে পড়বে, তারপর প্রাণপনে দৌড়াবে সে।
যেমন আচম্বিত বাসটা থেমেছিল তেমনি হুট করে আবার চলতে শুরু করলে বাসের হাতেগোনা কিছু যাত্রির সাথে সাথে তার এই ভাবনাটাও মারাত্মকভাবে ঝাঁকি খেলো। কপালে আবার ঘাম জমতে শুরু করেছে। কন্ডাক্টর ছেলেটার চোখমুখে হিংস্র হায়েনার ছাপ। চলন্ত বাস থেকেই লাফ দেবে? এভাবে লাফ দিলে মারাত্মকভাবে আহত হবে। দৌড়াতে পারবে না। ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর ছেলেটা খুব সহজে তাকে ধরে ফেলবে।
বাস খুব দ্রুতগতিতে ছুটছে। তাকে অবাক করে দিয়ে কন্ডাক্টর ছেলেটা গেটের কাছ থেকে এগিয়ে আসতে থাকলো। ছেলেটা চোখের পলক ফেলছে না। তার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো প্রহরী কুকুরের মতো। যেন সালেককে একচুলও নড়তে দেবে না। এমন সময় বাসের গতি কমে আস্তে আস্তে সেটা রাস্তার একপাশে সরে গিয়ে থেমে গেল। সালেক জানালার বাইরে কিছুই দেখতে পেলো না। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল তার। কন্ডাক্টরের ঠোঁটের কোণে বদমাশের হাসি।
“কী হইলো…বাস থামলো ক্যান?” বোরখা পরা মহিলার স্বামী দূর্বল কণ্ঠে জানতে চাইলো ড্রাইভারের কাছে।
“ইঞ্জিনে টেরাবল হইছে…বাস আর যাইবো না,” নিজের সিট থেকে উঠতে উঠতে বলল ড্রাইভার।
“জামতলী তো এহনও এক মাইল দূরে।”
ড্রাইভারের চোখ লাল টকটকে। লোকটার দিকে কটমট করে তাকিয়ে কোমর থেকে ছোট্ট একটা বোতল বের করে কিছুটা পান করে নিলো, তারপর বোতলের ছিপি লাগাতে লাগাতে বোরখা পরা মহিলার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “না যাইতে চাইলে বইসা থাকেন…বাস আর যাইবো না!”
লোকটা আর কিছু বলল না, বউকে তাড়া দিয়ে সুর সুর করে বাস থেকে নেমে পড়ল। ভয় দেখানোতে কাজ হয়েছে বলে তৃপ্তির হাসি দেখা গেল ড্রাইভারের ঠোঁটে। এবার একটু এগিয়ে এসে সুবর্ণার সামনে দাঁড়ালো সে। “কই যাইবা?”
“জামতলী।”
“হুনলা না, জামতলীতে বাস যাইবো না। বাকি রাস্তা পায়ে হাইটা যাও!” শেষ কথাটা ধমকের সুরে বলল ড্রাইভার। পেছন ফিরে সালেকের দিকে তাকালো সুবর্ণা। “ঐ ব্যাটার দিকে তাকাইতাছো ক্যান?”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো সুবর্ণা। ঢোক গিলে অবশেষে বলল, “আমি উনার লগে যামু।”
সুবর্ণার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ড্রাইভার। “বাসের মইদ্যেই কাস্টমার বাগায়া ফালাইছোস!” খপ করে সুবর্ণার চুলের মুঠি ধরে তাকে সিট থেকে তুলে ফেললো। “খানকি মাগি কুনহানকার!”
“ওরে ছাইড়া দেন!” সালেক নিজের সিট থেকে উঠে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললে ড্রাইভার লোকটা অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে।
“খানকির লাইগা এতো দরদ!” কথাটা বলেই সালেকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কন্ডাক্টরের দিকে ইশারা করলে ছেলেটা সালেকের কাঁধ ধরে তাকে বসিয়ে দিলো। “কোনো কথা কইবি না…চুপচাপ বয়া থাক!”
সুবর্ণার চুলের মুঠি ধরে তাকে গেটের সামনে নিয়ে এলো ড্রাইভার। মেয়েটা সালেকের কাছে সাহায্যের জন্য আকুতি জানিয়ে বলল, “তুমি কিছু কও না ক্যান?”
সুবর্ণার এই কথা শুনে ড্রাইভার যারপরনাই বিস্মিত হলো। “কিরে…’তুমি কইরা কইতাছে দেহি!” চুলের মুঠিটা আরও শক্ত করে ধরে ঝাঁকি মারলো। “আগে থেইকা চিনোস নাকি?”
“ওস্তাদ, আমার মনে হইতাছে এই ব্যাটার লগে মাগিটার আগে থেইকা জানাশোনা আছে।”
ড্রাইভার সুবর্ণার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালে সে মাথা নেড়ে সায় দিলো। “খানকিমাগি!” বলেই চুলের মুঠি ধরে সুবর্ণাকে টানতে টানতে সালেকের কাছে নিয়ে এলো। “ওই, লটারির টিকিটটা বের কর,” সালেককে বলল ড্রাইভার। তার চোখেমুখে খুনির প্রতিচ্ছবি।
হঠাৎ করে পরিস্থিতি এতোটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় সালেক বরফের মতো জমে আছে। কন্ডাক্টর ছেলেটা তার শার্টের কলার ধরে ঝাঁকুনি দিলো। “ওই খানকিরপোলা…কথা কানে যায় না?”
সালেক পকেট থেকে টিকেটটা বের করে বাড়িয়ে দিলো ড্রাইভারের দিকে। সুবর্ণাকে ছেড়ে দিয়ে টিকেটটা হাতে নিয়ে দেখলো ড্রাইভার। তার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। কন্ডাক্টর ছেলেটার পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, “ব্যাটা, তুই একটা কামই করছোস।” এবার সুবর্ণার দিকে ফিরলো সে। “ঐ মাগি…ওইখানে বয় চুপচাপ।”
সালেকের সামনের সিটে বসলো সুবর্ণা।
“ওস্তাদ, এই দুইটারে কী করবেন?”
সালেকের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। কিছু একটা করতেই হবে। এভাবে বেঘোরে প্রাণ দেয়ার কোনো মানে হয় না। “আমাগো দুইজনরে ছাইড়া দেন…আমরা কাউরে কিছু কমু না। যা লওয়ার তাতে লইছেনই।”
“চুপ, খানকিরপোলা,” বলল ড্রাইভার। “চুপচাপ বইয়া থাক। উল্টাপাল্টা কিছু করলে এক্কেবারে জানে মাইরা ফালামু।”
ড্রাইভারকে তার সাগরেদ কন্ডাক্টর একেবারে সামনের একটা সিটে নিয়ে গিয়ে কী যেন শলাপরামর্শ করতে শুরু করে দিলো।
“ওগো ভাবসাব ভালা ঠেকতাছে না!” ভয়ার্ত চাপা কণ্ঠে বলল সুবর্ণা।
ড্রাইভার লোকটা লম্বা-চওড়া আর বেশ বলশালী; কন্ডাক্টর ছেলেটাও শারিরীকভাবে সালেকের চেয়ে এগিয়ে আছে। এ দু’জনের সাথে কোনোভাবেই সে পেরে উঠবে না।
ঠিক তক্ষুণি সালেকের পাশ থেকে একটা ঘোৎঘোৎ শব্দ হলে ড্রাইভার, কন্ডাক্টর আর সুবর্ণা ফিরে তাকালো সেদিকে। পাশ ফিরে সালেক যা দেখতে পেলো সেটা একেবারেই ভৌতিক দৃশ্য। তার মুখ দিয়ে অস্ফুটভাবে একটা শব্দ বেরিয়ে গেল : “হায় আল্লা।”
ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, সুবর্ণা আর সালেক বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখছে এখন বুড়ো লোকটা জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। যেন লম্বা একটা ঘুম দিয়ে এইমাত্র জেগে উঠেছে সে। তবে বুড়োর শরীর খুব খারাপ। হাসফাস করছে। নিঃশ্বাস এখনও স্বাভাবিক হয়নি। কিছুক্ষণ পর বুড়ো সম্বিত ফিরে পেলো।
“ওই…ফুলতলায় আইছে নাকি?”
কন্ডাক্টর আর ড্রাইভার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। “বাস খালি কেন?” বুড়ো এখন বাসের ভেতর চোখ বুলাচ্ছে। ড্রাইভারের হাতের দিকে তাকাতেই বুড়োর চোখ চকচক করে উঠল। “আমার টিকিট কই? অ্যাই…তোমার কাছেনি?”
ড্রাইভার কিছু বলল না।
“দাও! আমার টিকিট দাও।” আশেপাশে তাকিয়ে দুর্বলকণ্ঠে চিৎকার দেবার চেষ্টা করলো, “পুলিশ! পুলিশ!”
ড্রাইভার লোকটা তার ফুলপ্যান্টের ডান পকেটে টিকেটটা ঢুকিয়ে আচমকা বুড়োর গলা ধরে তাকে এক হ্যাঁচকায় টেনে সিটের উপর ফেলে উপুড় হয়ে চেপে ধরলো। তার দেখাদেখি কন্ডাক্টর ছেলেটাও সামনের সিট ডিঙিয়ে বুড়োর বুকের উপর চেপে বসলো। ড্রাইভার লোকটা শক্ত করে বুড়োর গলা টিপে ধরে আছে।
ড্রাইভার ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়ই সালেক সরে গিয়েছিল। অবিশ্বাসে সে চেয়ে চেয়ে দেখছে। বুড়োকে যে দু’জন লোক শ্বাসরোধ করে মারছে সেটা নয়, অন্য একটা জায়গায় আটকে আছে তার চোখ।
তাড়াহুড়োয় পকেটে রাখতে গিয়ে ড্রাইভারের ডান পকেট থেকে লটারির টিকেটটার কিছু অংশ বের হয়ে আছে। এমন সময় টের পেলো পেছন থেকে সুবর্ণা তার শার্ট খামচে ধরে তাকে টানছে। তার দিকে তাকাতেই চাপা কণ্ঠে বলল, “চলো, পলাই!”
বুড়োর মুখ দিয়ে চাপা গোঙানি বের হচ্ছে। ধারণার চেয়েও অনেক বেশি সময় নিলো বুড়ো। অবশেষে নিস্তেজ হবার পর ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর তাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
“ওস্তাদ, মরছে?” কন্ডাক্টর ছেলেটা বুড়োকে ভালো করে দেখে বলল।
ড্রাইভার আবারও উপুড় হয়ে পরখ করে দেখলে বুড়ো মারা গেছে। কিনা। “হ…এইবার মরছে।”
“ওস্তাদ, এই বুড়ার লাশ এহন কী করবেন?”
“সামনে গিয়া কোনো এক জায়গায় ফালায়া দিমু।”
“ওস্তাদ!”
ড্রাইভার তার সাগরেদের দিকে তাকালো। “কী হইছে?”
“ওরা তো পলাইছে!”
ড্রাইভার এতোক্ষণে বুঝতে পারলো সালেক আর মেয়েটা সুযোগ পেয়ে সটকে পড়েছে। “জাহান্নামে যাওক, টিকিট তো আমার কাছেই!”
“কিন্তু টিকিটটা কই?” জানতে চাইলো কন্ডাক্টর ছেলেটা।
“কই আবার, এইখানে,” পকেটে হাত দিয়েই থমকে গেল ড্রাইভার। উদভ্রান্তের মতো দুই পকেটে খুঁজতে লাগলো সে। “আরে, আমি তো এই পকেটেই রাখছিলাম!”
“কন্ কি, ওস্তাদ!”
মুহূর্তে বোধোদয় ঘটলো ড্রাইভারের। “হায় হায়! ঐ খানকিরপোলায় নিয়া ভাগছেরে!”
“অ্যাঁ!”
সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর বাস থেকে নেমে রাস্তার দু’দিকে তাকালো। ঘন অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বেশি দূর যাইতে পারে নাই!” বিড়বিড় করে বলল ড্রাইভার। “বড় টর্চটা লইয়া আয়।” ড্রাইভার হাঁক দিলে তার সাগরেদ দ্রুত বাসে উঠে গেল আবার। “একটা রড আর রেঞ্জও লইয়া আয়!”
শক্তিশালী টর্চটা দিয়ে রাস্তার সামনের দিকে আলো ফেলা হলো। সামনের একশ গজ দেখা যায় এই টর্চের আলোয়। রাস্তার উপর কোনো জনমানুষের চিহ্ন নেই। তারা এমন একটা জায়গায় আছে যেখানে রাস্তার দু’পাশে শুধু খালবিল। বহু দূরে কিছু বাড়িঘর আর লোকালয় আছে।
এবার তাদের পেছনে আলো ফেললো। দূরে, দুটো আবছায়া অবয়ব দেখতে পেলো সে। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে চোখ কুঁচকে ভালো করে দেখলো ড্রাইভার।
“ঐ তো! ঐদিকে!”
ড্রাইভার দৌড় দিতে উদ্যত হলে পেছন থেকে কন্ডাক্টর তাকে ধরে বলল, “ওস্তাদ…!” বলেই পেছনের দিকে ইঙ্গিত করলো সে।
.
অযাত্রা ৯
চারদিকে ঘন অন্ধকার। দূর থেকে দুটো উজ্জ্বল আলোর বিন্দু দেখে সুবর্ণা বুঝতে পারলো বাসটা তাদের দিকেই আসছে। পথের বাম পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে। বাসটা কাছে আসতেই গতি কমে এলো। তার কাছে এসে সজোরে ব্রেক কষলে তীক্ষ্ণ একটা শব্দ বিদীর্ণ করলো রাতের নিস্তব্ধতা। সুবর্ণা একটুও নড়লো না। সে দেখতে পাচ্ছে ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে হুরমুর করে নেমে এলো তারা।
ড্রাইভার কাছে এসেই সুবর্ণার চুল খামচে ধরলো। “ঐ মাগি! তর নাগর কই?”
কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে সুবর্ণা বলল, “হে আমারে ফালায়া চইলা গেছে।”
“কই গেছে?”
সড়কের বাম দিকে গাঢ় অন্ধকারের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, “এই তো…এই দিক দিয়া দৌড়ায়া চইলা গেছে।”
ড্রাইভার টর্চ দিয়ে জায়গাটা দেখলো। যতোদূর চোখ যায় শুধু ধানক্ষেত। মাত্র চাড়া বোনা হয়েছে, গোড়ালী পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে সেইসব চাড়া।
“তুই এই মাগিটারে ছাড়বি না…আমি আইতাছি,” ড্রাইভার বলেই সড়ক থেকে নেমে গেল হনহন করে।
কন্ডাক্টর ছেলেটা এবার তার ওস্তাদের মতো সুবর্ণার চুল খপ করে ধরে ফেললো। “একদম চিল্লাফাল্লা করবি না!”
“আহ্ লাগতাছে তো!” সুবর্ণা ব্যথা পেয়ে বলল।
“লাগতাছে…অ্যাঁ?” অন্যহাতে সুবর্ণার গলা চেপে ধরে ছেলেটা বলল, “হেইয়ার লগে পলাইয়া যাইতে আছেলে, না? এহন বুঝবা হেইডার মজা!”
কন্ডাক্টর ছেলেটা বেশ অবাক হলো। সুবর্ণা তার দিকে চেয়ে হাসছে। “কিরে…হাসতাছোস ক্যান?”
.
অযাত্রা ১০
হাঁটু পর্যন্ত কাদাপানি মেখে ড্রাইভার লোকটা উঠে এলো রাস্তার উপর। অনেক দূর যাবার পরও সে সালেকের টিকিটা দেখতে পায়নি। রাগে সমস্ত শরীর কাঁপছে। বেশ্যাটা তাকে ধোঁকা দিয়েছে!
কিন্তু রাস্তার উপর আসতেই রাগ আরও বেড়ে গেল। তার সাগরেদ নেই! ছেলেটাকে বলে গিয়েছিল মাগিটাকে যেন এখানে আটকে রাখে। চারপাশে তাকিয়ে তার গা ছমছম করে উঠল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, কোনো গাড়িঘোড়া চলছে না সড়ক দিয়ে। আশেপাশে জনমানবের কোনো চিহ্নও নেই।
“ওই…তুই কই গেলি?” চেষ্টা করেও নিজের গলা দিয়ে জোরালো আওয়াজ তুলতে পারলো না। অজ্ঞাত এক ভীতি জেঁকে বসেছে তার মধ্যে। অদূরে বাসটা দেখা গেলেও বাসের ভেতরে কোনো বাতি জ্বলছে না।
ডান হাতে থাকা লোহার রডটা আরও শক্ত করে ধরে টর্চের আলো ফেললো বাসের দিকে। কোনো সাড়াশব্দ নেই।
তার সাগরেদের চরিত্রে অনেক সমস্যা আছে। মেয়েটাকে নিয়ে আবার ফুর্তি করতে শুরু করে দেয়নি তো!
হনহন করে বাসের দিকে এগিয়ে গেল সে। গেটের কাছে আসতেই জান্তব একটা শব্দ কানে গেল, সঙ্গে সঙ্গে মাথায় খুন চেপে গেল তার। এরকম পরিস্থিতেও হারামজাদা মওজ করতে শুরু করে দিয়েছে!
“কালাম! কী করতাছোস তুই?”।
কোনো সাড়া শব্দ নেই। বাসের ভেতর ঢুকে বুঝতে পারলো মাঝখানের একটা সিট থেকে শব্দটা আসছে। কিন্তু আরেকটু এগিয়ে যেতেই শক্ত কিছু দিয়ে তার মাথায় সজোরে আঘাত করা হলো, হুমড়ি খেয়ে একটা সিটের উপর পড়ে গেল সে। মাথা ঘুরিয়ে নিজের হামলাকারির মুখটা দেখার চেষ্টা করলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা আঘাত করা হলো। এবার ঠিক কপাল বরাবর। নিস্তেজ হয়ে গেল ড্রাইভার।
.
দ্বিতীয় যাত্রা ১১
সালেক হাটছে, তার পাশে সুবর্ণা। তাদের গন্তব্য ঢাকা। আতাবরের বাড়ির লোকজন জানে সালেকের সাথে তাদের গ্রামের বাড়িতে গেছে সে। তবে সালেক এ নিয়ে খুব একটা ভাবছে না। তার কাছে চল্লিশ লাখ টাকার লটারির টিকেট আছে আর আছে একটি গল্প।
সুবর্ণা মেয়েটার বুদ্ধিতে বেশ ভালোই কাজ হয়েছে। এই সড়ক ধরে তারা ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরের হাত থেকে পালাতে পারতো না। চারদিকে ঘন অন্ধকার আর কাদাপানির ধানক্ষেত। সুবর্ণার কথামতো সালেক রাস্তার ওপর পাশে ঘাপটি মেরে থাকে, আর মেয়েটা ড্রাইভারকে বিপরীত দিকে, ভুলপথে পাঠিয়ে দেবার পর আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে সালেক। সেই সময় তার হাতে ছিল একটা ইট।
কন্ডাক্টর সুবর্ণার চুল ধরে রেখেছিল। বন্ধু আতাবরকে পেছন থেকে যেভাবে মেরেছিল ঠিক একই কায়দায় কন্ডাক্টরকে ঘায়েল করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। একটা অস্ফুট শব্দ করেই ছেলেটা ঢলে পড়ে মাটিতে। তারপর বাসের ভেতরে হাত-পা বেঁধে মাঝখানের একটা সিটে ফেলে রাখে তাকে। ছেলেটার জ্ঞান ফিরে এসেছিল কয়েক মিনিটের মধ্যেই। তারপর থেকেই ঘোৎঘোৎ শব্দ করতে শুরু করে।
কিছু দূর যাবার পর পেছন ফিরে তাকালো সালেক। রাতের অন্ধকারে এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে বাসটা। মনে মনে গল্পটা আবারও সাজিয়ে নিলো : হরতাল আহ্বানকারিরা বাসে আগুন ধরিয়ে দিলে সে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছে। আতাবরের খবর তার জানা নাই।
.
গন্তব্য ১২
হরতালের তিন দিন পর সালেক বসে আছে একটা পার্কের বেঞ্চে। একটু আগে তার সমস্ত জগন্টা টলে গেছে। ঝিমঝিম করছে মাথা। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরটা একেবারে খালি হয়ে গেছে।
লটারির টিকেটটা যখন কর্তৃপক্ষকে দেখালো তখন জানতে পারলো এটা প্রথম পুরস্কার পাওয়া টিকেট নয়!
এখনও তার কাছে পুরো ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য ঠেকছে। সে নিজে পত্রিকার ফলাফলের সাথে মিলিয়ে দেখেছে। একবার নয় দু’বার নয়, বেশ কয়েকবার। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। পুরো ব্যাপারটাই তার কাছে রহস্য বলে মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্যে এ-ও মনে হয়েছে, ঐ দিনের রাতের ঘটনাটা একটি দুঃস্বপ্ন ছিল, বাস্তবে এরকম কিছু ঘটেনি। অন্য কোনো জগতে সবটা ঘটেছে।
বন্ধু আতাবরের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল এবার। কীভাবে সে পারলো একটা ভারি ইট দিয়ে তার মাথাটা থেতলে দিতে! পুরো ব্যাপারটা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্যে আতাবরের মোবাইল ফোন আর মানিব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে পাশের এক ডোবায়। একেবারে নিখুঁত দক্ষতায় কাজটা করেছে, যেন এ জীবনে বহুবার এরকম কাজ করেছে সে।
নিজের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলে অন্যমনস্কভাব কাটিয়ে ফোনটা পকেট থেকে বের করলো। “হ্যালো?”
“কি ব্যাপার…খবর কী?” সুবর্ণা ওপাশ থেকে বলল।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সালেকের বুক থেকে। সে জানে এখন যে কথাটা তাকে বলবে সেটা সত্যি হলেও মেয়েটা বিশ্বাস করবে না।
“তারা কইলো এই টিকিটটা নাকি সেই টিকিট না!” আড়ষ্ট গলায় বলতে পারলো কথাটা।
“মানে?” ওপাশে সুবর্ণার অবিশ্বাস্য কণ্ঠ।
একটা ঢোক গিলে নিলো সালেক। “প্রথম পুরস্কার যে টিকিটটা পাইছে… এইটা নাকি সেই টিকিট না।”
কয়েক মুহূর্ত চুপ। “আমি জানতাম…” আস্তে করে বলল সুবর্ণা। ভারি একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তারপর। “হায়রে দুনিয়া!…এই জীবনে একটা ভালা পুরুষমানুষের দেহাও পাইলাম না!”
লাইনটা কেটে গেলেও ফোনটা কানে চেপে রেখেই দূরে, পার্কের একটা বিশাল গাছের দিকে চেয়ে রইলো সালেক। ভাবতে লাগলো কার মধ্যে আগে অবিশ্বাসের বীজ রোপিত হয়েছিল : আতাবর? নাকি তার মধ্যে! সে জানে না। হয়তো কখনও জানতে পারবে না।
.
গন্তব্যহীন যাত্রা ১৩
জামতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কপ্লেক্সে ভয়ানকভাবে মাথায় আঘাত পাওয়া এক রোগির জ্ঞান ফিরে এলো উদ্ধার করার তিনদিন পর। হরতালের আগের দিন মাঝরাতে তাকে উদ্ধার করে এক পথচারী, তাই ঢাকায় নিয়ে যাবার কোনো উপায় ছিল না। সম্ভবত লোকটার সব ছিনিয়ে নেবার জন্যে তাকে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। ডাক্তাররা তার বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিল তবে জ্ঞান ফিরে পাবার পর সে আশংকা দূর হয়েছে। রোগি প্রাণে বেঁচে গেলেও দেখা দিয়েছে নতুন একটি সমস্যা : স্মৃতিশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার। কোনো কিছুই মনে করতে পারছে না। এমন কি নিজের নামটা পর্যন্ত বলতে পারছে না। ডাক্তার বলেছে ধীরে ধীরে সেরে উঠলে কিছুটা স্মৃতি ফিরে পেতেও পারে, পুরো স্মৃতি হয়তো কোনোদিনও ফিরে পাবে না। তবে ডাক্তার যা জানে না তা হলো এই রোগির শুধু স্মৃতিই নষ্ট হয়নি, তার মস্তিষ্কেরও বিকৃতি ঘটেছে।
একটু আগে নার্স এসে বলে গেছে তার প্যান্টের পকেট থেকে লটারির একটি টিকেট ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। স্মৃতিহীন লোকটা লটারির সেই টিকেট চোখের সামনে মেলে অনেকক্ষণ ধরে দেখে গেল।
হাফপ্যান্ট পরা এক অল্পবয়সি ছেলে গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি এক শনপাপড়িওয়ালার দিকে। ছেলেটা জিভ চাটলো। শনপাপড়িওয়ালা লোকটা ঠিক তার সামনে এসে বাক্স থেকে একটা শনপাপড়ি ছেলেটার হাতে দিয়ে প্রসন্নভাবে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে চলে গেল। অবাক চোখে ছেলেটা চেয়ে রইলো শনপাপড়ির দিকে। আর আয়েশ করে শনপাপড়ি খেতে শুরু করলো। জীবনে এতো মজার আর সুস্বাদু শনপাপড়ি খায়নি সে।
কেউ খেয়াল করলো না, স্মৃতিহীন রোগি লটারির একটি টিকেট কামড় দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।