লজ্জা (০৩) শীতটা তেমন জমিয়ে নামছে না

৩ক.

শীতটা কি তেমন জমিয়ে নামছে না? সুরঞ্জন গা থেকে লেপ সরিয়ে দেয়। সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ। বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। কাল রাতে সে সারা শহর ঘুরেছে। কারও বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করেনি, কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। একা একা হেঁটেছে। বাড়িতে বাবা মা দুশ্চিন্তা করছেন এরকম ভাবনাও তার হয়েছে। কিন্তু ইচ্ছে করেনি ফিরতে .। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা কিরণময়ীর মুখ দেখতে তার নিজেরই ভয় হয়। সুধাময়ও কেমন ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন। সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে কোথাও বসে মদ খেতে। খেতে খেতে যেন সে ভুলতে পারে মায়ার মায়াবতী চোখ, সেই চোখে থোকা থোকা নীলাভ ভয় নিয়ে সে ‘দাদা দাদা’ বলে ডেকেছিল সুরঞ্জনকে। তাঁর তরী করে বড় হয়ে গেল মেয়েটি। সেদিনের মেয়েটি, দাদার আঙুল ধরে নদী দেখতে যেত। শ্যামলা সুন্দর মেয়ে, পুজো এলে আবদার করবেই, জামা কিনে দাও। সুরঞ্জন বলত পুজো-ফুজো বাদ দে তো। মাটির মূর্তি গড়ে অসভ্যগুলো নাচবে আর তুই নতুন জামা পরবি, ছিঃ! তোকে আর মানুষ করা গেল না।

মায়া আদুরে গলায় বলত—দাদা, পুজো দেখতে যাব, নেবে? সুরঞ্জন ধমক লাগাত। বলত-মানুষ হা। মানুষ হ। হিন্দু হোস নে।

মায়া খিলখিল করে হাসত। বলত-কেন হিন্দুরা কি মানুষ নয়!

মায়াকে ফরিদা বলে ডাকা হত একাত্তরে। বাহাত্তরেও হঠাৎ হঠাৎ মুখ ফসকে ‘ফরিদা’ নাম বেরিয়ে যেত সুরঞ্জনের। মায়া গাল ফুলিয়ে রাগ করত। ওর রাগ ভাঙাতে সুরঞ্জন মোড়ের দোকান থেকে চকলেট কিনে দিত। চকলেট পেয়ে ও কী যে খুশি হত, ফোলা গলে চকলেট পুরলে মায়ার মায়াবতী চোখ দুটো খুশিতে হাসত। মুসলমান বান্ধবীদের দেখে ঈদ এলেই রঙিন বেলুনের আবদার করত ছোটবেলায়, পটকা ফাটাবে, তারাবাতি জ্বলবে, কিরণময়ীর শাড়ির আঁচল ধরে ঘুর ঘুর করত ‘আজ নাদিরাদের বাড়িতে পোলাও মাংস রান্না হবে, আমিও পোলাও খাব।‘ কিরণময়ী পোলাও রাঁধতেন।

মায়া পরশু সকালে গেছে, আজও তার কোনও খবর নেই। ওকে নিয়ে বাবা মার দুশ্চিন্তাও নেই। মুসলমানের বাড়িতে অন্তত বেঁচে তো থাকতে পারবে। এই বয়সে দুটাে টিউশনি করে সে। ইডেন কলেজে পড়ে, পড়ালেখার খরচ বাড়ি থেকে নেয় না বলতে গেলে। সুরঞ্জনেরই কেবল হাত পাততে হয়। চাকরি-বাকরি করা হল না কিছুই। ফিজিক্সে মাস্টার ডিগ্রি নিয়ে বসে আছে। প্রথম প্রথম চাকরি করবার ইচ্ছে কিছু ছিল। ইন্টারভিউও দিয়েছিল। কোথাও কোথাও। ইউনিভার্সিটির তুখোড় ছাত্র সে, অথচ যে ছাত্ররা তার কাছে পড়া বুঝতে আসত, ওরাই ফাইনালে গিয়ে তার চেয়ে নম্বর বেশি। পেল। আর চাকরির বেলায়ও ঘটনা একই। শিক্ষকের চাকরি তার চেয়ে নম্বর কম। পাওয়া ছেলেদের ভাগ্যে জুটল। এদিক ওদিক ইন্টারভিউ দিয়েছে সে, ইন্টারভিউয়াররা কাত করতে পারেনি তাকে এতটুকু। অথচ বোর্ড থেকে বেরিয়ে যে ছেলেরা চুক চুক দুঃখ করত যে তেমন ভাল হয়নি ভাইবা, সুরঞ্জন আশ্চর্য হত যে ওরাই কী করে ফেন এপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে যেত, সুরঞ্জন পেত না। দু-একটি বোর্ডে কথা উঠেছে, সুরঞ্জন আদিবাকায়দা জানে না, এগজামিনারদের সে সালাম দেয় না। আসলে আসসালামু আলায়কুম, আদাব বা নমস্কারই যে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের একমাত্র পদ্ধতি, এ কথাই সে মানে না। আসসালামু আলায়কুম বলে যে ছেলে গদগদ ভঙ্গিতে কথা বলে সে বোর্ড থেকে বেরিয়ে পরীক্ষকদের ‘শুয়োরের বাচ্চা” বলে গাল দেয়, সেই ছেলেকেই লোকে ভদ্র বলে জানে, সে-ই হয়ত টিকে যায় ইন্টারভিউয়ে। আর যে সুরঞ্জন আসসালামু আলায়কুম বলে না, সে কিন্তু কোনও দিন গাল দেয়নি শিক্ষকদের। অথচ লোকের কাছে সুরঞ্জন বেয়াদব ছেলে হিসেবে নাম কমিয়েছে, নাম না বলে দুনামও বলা যায়। কী জানি সে কারণেই কিনা নাকি সে হিন্দু বলেই কিনা কোনও সরকারি চাকরি তার হয়নি। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়েছিল, তিন মাস করবার পর ভাল লাগেনি। ছেড়ে দিয়েছে। সেইদিক থেকে মায়া বেশ মানিয়ে নিয়েছে, দিব্যি টিউশনি করে। চাকরিও নাকি কোন এক এন জি ও-তে করবে। ঠিক হয়েছে। সুরঞ্জনের সন্দেহ হয়। এইসব সুবিধেগুলো তাকে জাহাঙ্গীর নামের ছেলেটিই করে দিচ্ছে। মায়া কি কৃতজ্ঞতা দেখাতে গিয়ে ছেলেটিকে বিয়েই করে ফেলবে শেষ পর্যন্ত? আশঙ্কার খড়কুটাে তার বুকের মধ্যে বাবুই পাখির বাসার মত বাসা বাঁধতে চায়। এককাপ চা নিয়ে সামনে দাঁড়ােন কিরণময়ী। চোখের কোল ফোলা, সুরঞ্জন বোঝে রাতে ঘুম হয়নি তাঁর। তারও যে ঘুম হয়নি এ কথা সে বুঝতে দিতে চায় না। হাই তুলে বলে-“এত বেলা হয়ে গেল টেরও পাইনি।” যেন ভাল ঘুম হওয়ার কারণে সে টের পায়নি। টের পেলে অন্যদিনের মত খুব ভোরে উঠে সে হাঁটতে যেত। জগিং করত। কিরণময়ী চা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। টেবিলে রেখে যে চলে যাবেন, তাও করেন না। সুরঞ্জন অনুমান করে কিছু বলবেন কিরণময়ী। কিন্তু কোনও শব্দ তিনি উচ্চারণ করেন না, যেন ছেলে তার হাত বাড়িয়ে কাপটি নেবে। এরই অপেক্ষা করছেন। তিনি। দুজনের মধ্যে কত যোজন দূরত্ব নির্মাণ হলে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়, নির্বাক, সুরঞ্জন বোঝে; সে নিজেই কথা পাড়ে–মায়া কি আজও ফেরেনি?

—না। যেন একটি প্রশ্নের অপেক্ষাই তিনি করছিলেন। যেন সুরঞ্জন উচ্চারিত যে কোনও শব্দ নিয়ে তিনি দুকথা বলতে পারুেন। এমন দ্রুত উত্তর করে তিনি বিছানায় বসলেন। ছেলের নাগালের কাছেই। সুরঞ্জন অনুমান করে এত কাছে বসবার কারণ আসলে নিরাপত্তাহীনতার অস্থিরতা। কিরণময়ীর না ঘুমোনো চোখ, না আঁচড়ানো চুল, মলিন শাড়ি থেকে চোখ সরিয়ে নেয় সে। আধখানা পিঠ তুলে কাপটি হাতে নিয়ে চুমুক দেয়। ‘ও কেন ফিরছে না? মুসলমানরা তাকে বাঁচাচ্ছে বুঝি? আমাদের ওপর বিশ্বাস নেই? একবার খবরও নিচ্ছে না। এখানে আমরা কেমন আছি। শুধু নিজে বাঁচলেই চলবে।

কিরণময়ী চুপ হয়ে থাকেন। সুরঞ্জন চায়ের সঙ্গে একটি সিগারেট ধরায়। বাবা মা’র সামনে সে কখনও সিগারেট খায়নি, আজ যখন ফস করে ম্যাচের কাঠি জ্বালাল, সিগারেট ধরিয়ে মুখ ভরে ধোঁয়াও ছাড়ল, তার মনেও পড়ে না। সে কিরণময়ীর সামনে সিগারেট ফোঁকে না। যেন অন্য দিনগুলোর মত স্বাভাবিক দিন নয় এখন। এখন মা ছেলের যে দূরত্বটি রচিত ছিল তা ঘুচে গেছে। সূক্ষ্ম যে একটি দেওয়াল ছিল, তা ভেঙে যাচ্ছে। কতদিন সে একটি স্নেহকাঙািল হাত মায়ের কোলে রাখেনি। ছেলেরা বড় হয়ে গেলে কি মায়ের স্পর্শ থেকে এরকম দূরে সরে যেতে থাকে! সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে অবোধ শিশুর মত কিরণময়ীর কোলে মাথা রেখে ছোটবেলার ঘুড়ি ওড়ানোর গল্প করুক, সেই যে সিলেট থেকে এক মামা আসত, নবীন মামা, নিজে হাতে ঘুড়ি তৈরি করত, আর ওড়ােতও চমৎকার। আকাশের আর সব ঘুড়িকে ভোকাট্টা করে দিয়ে দিব্যি সে উড়ে বেড়াত।

সুরঞ্জন মায়ের কোলটির দিকে তৃষ্ণাৰ্তা চোখে তাকায়। সিগারেটের শেষ ধোঁয়া ছেড়ে বলে–কাল কি কামাল, বেলাল বা অন্য কেউ এসেছিল?

কিরণময়ী স্নান কণ্ঠে বলেন–না।

কামাল একবার খোঁজও নিল না, অবাক লাগে বন্ধুরা কি ভাবছে। সুরঞ্জন মরে গেছে, নাকি ওকে বাঁচাবার আর ইচ্ছে নেই। কারও?

কিরণময়ী ধীরে, গলার স্বরটি বুজে আসে, বলেন–কাল তুই গেলি কোথায়? আমরা বাড়িতে দুজন মানুষ। কী হয় না হয় একটু কি ভাবিস না? আর তুই যে বাইরে চলে গেলি কিছু যদি হত? ও বাড়ির গীেতম দুপুরের দিকে পাড়ার দোকানো গিয়েছিল ডিম কিনতে, ওকে মুসলমান ছেলেরা মেরেছে। সামনের দুটো দাঁত ভেঙে গেছে। পায়ের হাঁড়ও নাকি ভেঙেছে।

–ও।

—মনে আছে। বছর দুই আগে শনির আখড়া থেকে গীতার মা আসত, ঘরবাড়ি ছিল না। পুড়িয়ে দিয়েছিল? গীতার মা এ বাড়ির কাজ ছেড়ে চলে গেল ভিটের ওপর নতুন করে ঘর তুলবে বলে। ঘর তুলেওছিল, এর ওর বাড়িতে কাজ করে টাকা জমিয়ে। সে এসেছিল ভোরে, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। এবারও তার নতুন তোলা ঘর ছাই করে দিয়েছে। ভিটেয় কিছু নেই। আজ ভোরে এসে বলল, ‘বোঁদি, বিষ পাওয়া যায় কোন দোকানে? পাগল হয়ে গেছে মনে হয়।

—ও। সুরঞ্জন চায়ের কাপটি বালিশের পাশে রাখে।

—মায়া যে এ বাড়িতে আসবে, ওকে নিয়ে তো আরও দুশ্চিন্তা হবে রে।

—তাই বলে মুসলমানের ছাতার তলে তার সারাজীবন বাস করতে হবে নাকি?

সুরঞ্জনের কণ্ঠ কঠিন হয়ে ওঠে। সে-ও একবার বাড়ির সবাইকে নিয়ে কামালের বাড়ি গিয়েছিল, তখন মুসলমানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে বলে এরকম গ্লানি হয়নি, মনে হয়েছে কিছু দুষ্ট লোক দুষ্টোমি করছে, কেটে যাবে, সব দেশেই তো এরকম দুষ্ট লোক থাকে। এখন ওরকম মনে হয় না। এখন কিছু দুষ্ট লোকের দুষ্টেমি মনে হয় না এসব। আরও বড় কোনও গভীর কোনও ষড়যন্ত্র বলে সন্দেহ হয়। হ্যাঁ সন্দেহই হয় বৈকি। সুরঞ্জনের এখন বিশ্বাস হতে চায় না কামাল বেলাল কায়সার লুৎফর এরা কেউ অসাম্প্রদায়িক লোক। আটাত্তরে জনগণ কি সংবিধানে বিসমিল্লাহ বসাবার আন্দোলন করেছিল যে জিয়াউর রহমানের সরকার বিসমিল্লাহ বসােল? অষ্টআশিতে জনগণ কি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করবার জন্য কেঁদেছিল যে এরশাদ সরকার ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করল? কেন করল? সেকুলারিজমে নাকি বাঙালি মুসলমানের অগাধ বিশ্বাস, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির! কই, তারা তো রাষ্ট্র কাঠামোয় সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ বপন করা দেখেও তেমন ক্ষুব্ধ হয়নি? ক্ষুব্ধ হলে কী না হয়! এত বড় একটি যুদ্ধ ঘটিয়ে দিতে পারে যে দেশের রক্ত-গরম মানুষ, সে দেশের মানুষ আজ সাপের মত শীতল কেন? কেন তারা সাম্প্রদায়িকতার চারাগাছকে সমুলে উৎপাটন করবার তাগিদ অনুভব করছে না? কেন তারা এমন একটি অসম্ভব ভাবনা ভাববার সাহস পায় যে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া দেশে গণতন্ত্র আসবে বা এসেছে? এ ভাবনা তো তারাই ভাবছে, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিই? প্রগতিশীল আন্দোলনে যুক্ত মানুষেরাই?

—কাল সোয়ারিঘাট মন্দির ভেঙে ফেলেছে শুনেছিস? শ্যামপুর মন্দিরও?

কিরণময়ী করুণ কণ্ঠে বলেন। সুরঞ্জন আড়মোড়া ভাঙে। বলে—তুমি কি মন্দিরে যেতে কখনও, যে মন্দির ভাঙলে কষ্ট হচ্ছে? ভাঙুক না, ক্ষতি কি? ওঁড়ো হয়ে যাক এইসব ধর্মের দালানকোঠা।

—মসজিদ ভাঙলে ওদের রাগ হয়, মন্দির ভাঙলে যে হিন্দুদের রাগ হয় এটা কি ওরা জানে না? নাকি বোঝে না? একটা মসজিদের জন্য ওরা শ’য়ে শ’য়ে মন্দির ভাঙছে। ইসলাম না শান্তির ধর্ম?

—এ দেশের হিন্দুরা যে রাগ করে কিছুই করতে পারবে না তা মুসলমানরা ভাল জানে। তাই তারা করছে। কেউ হাত দিতে পেরেছে একটি মসজিদে? নয়াবাজারের মন্দিরটা দু বছর থেকে ভেঙে পড়ে আছে। বাচ্চারা ওর ওপর উঠে নাচে, পেচ্ছাব করে। কোনও হিন্দুর শক্তি আছে মসজিদের ঝকঝকে দেওয়ালে দুটো কিল বসায়?

কিরণময়ী নিঃশব্দে উঠে চলে যান। সুরঞ্জন বোঝে যে মানুষটি নিজের ভেতর এক জগত তৈরি করে নিয়েছিলেন, সংসারের বাইরে তিনি হাত পা বড় একটা বাড়ান না, তিনি পারভিনকে যে চোখে দেখেন, অৰ্চনাকেও সে চোখে—তিনিও খানিক টালমাটাল হলেন, তাঁরও প্রশ্ন জেগেছে মনে—রোগ অভিমান ক্ৰোধ কি কেবল মুসলমানদেরই আছে?

 

৩খ.

বাবরি মসজিদ আক্রান্ত হওয়ার পরই যে নব্বই-এর অক্টোবরে শুরু হয়েছে। এ দেশে হিন্দু নিযতন এবং মন্দির হামলা, তা নয়। সুরঞ্জনের মনে পড়ে উনআশির একুশে এপ্রিল সকালে রাজশাহী জেলা সদরে সাহেব বাজারের ঐতিহাসিক কালী মন্দিরের কালী মূর্তি আয়ুব আলি নামের এক লোক নিজ হাতে ভেঙে ফেলেছিল। মন্দির ভাঙবার পর হিন্দু মালিকদের দোকানও ভাঙে ৷

ওই বছরের ষোলই এপ্রিল ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার রামগোপাল পাড়ায় রামগোপাল মন্দিরের ঐতিহ্যবাহী রামগোপাল বিগ্রহ চুরি হয়। পরে শৈলকূপা শ্মশানের পাশে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় মূর্তিটি পাওয়া যায়। তবে বিগ্রহের সোনা রূপার অলঙ্কার পাওয়া যায়নি।

সীতাকুণ্ডের পূর্ণ লালানগর গ্রামের জয়গোপালহাট কালী মন্দির ভস্মীভূত করা হয়েছে। উত্তর চান্দগাঁও-এর কুরাইশ চান্দগাঁও দুগাবাড়ির বিগ্রহও ভেঙে ফেলা হয়েছে।

রাষ্ট্রধর্ম বিল পাশ হবার দু মাস পর খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের পাশে পুরনো কালাচাঁদ মন্দিরের কষ্টিপাথরের মূর্তি আর তার গায়ের সোনার অলঙ্কার চুরি হয়। মন্দির কমিটির সম্পাদক ফুলতলা থানায় এজাহার করতে গেলে পুলিশ তাঁকেই গ্রেফতার করে, তাঁকেই শারীরিক নিযাতন করে। মন্দির কমিটির সকলের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। জেলার এ এস পি ওই এলাকার তদন্তে গিয়ে হিন্দুদের এই বলে হুমকি দেন যে হিন্দুরাই মন্দিরের বিগ্রহ চুরি করেছে।

টাঙাইল জেলার কালীহাতি উপজেলার দ্বিমুখা গ্রামের প্রাচীন মন্দির থেকে আটই ডিসেম্বর রাতে শ্বেতপাথরের শিব, রাধাগোবিন্দ, অন্নপূর্ণ মূর্তি ও শালগ্রাম শিলা চুরি হয়ে যায়। থানার লোক আসে, নূর মোহাম্মদ তালুকদার বিগ্রহ চুরি করেছে জানাবার পরও এটি উদ্ধারের কোনও ব্যবস্থা হয়নি।

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের হিন্দুদের উদ্দেশ্যে ‘বিশ্ব ইসলাম নামের একটি সংগঠন চিঠি দেয় যে হিন্দুরা যেন অবিলম্বে এ দেশ ছেড়ে চলে যায়। চিঠিতে হাঁশিয়ার করা হয় পুজো-আচ্চা বন্ধ না করলে দাঙ্গা হবে। চৌদ্দই এপ্রিল কালীবাড়ির মন্দিরের পাশের বটবৃক্ষে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আলী আহমদ নামের এক লোক ময়নামতি বাজারে প্রচার করে যে এলাকার হিন্দুদের দাঙ্গার মাধ্যমে উৎখাত করতে হবে।

এগারোই মার্চ ভোলার লালমোহন উপজেলার শ্ৰী শ্ৰী মদনমোহন আখড়ায় নাম সংকীর্তন চলাকালে শতাধিক লোক মণ্ডপে হামলা চালায়। তারা মন্দিরে ঢুকে প্রতিমা ভাঙচুর করে, উপস্থিত ভক্তদের মারধোর করে। দত্তপাড়ার বিভিন্ন মন্দিরে ঢুকে প্রতিমা ভাঙচুর, লুটপাট, আর আগুন ধরানো খেলা খেলে।

মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার বড়টিয়া গ্রামে প্রায় একশ বছরের পুরনো শ্ৰী শ্ৰী কালীমাতার মন্দিরের পাশের জমিতে এডভোকেট জিলুর আহমদ কবরস্থান ও মসজিদ নিমাণের উদ্যোগ নেওয়ায় পুজো করার অন্তরায় হবে বলে আশঙ্কা করছে হিন্দুরা।, নোয়াখালি জেলার চাটখিল উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নে কালীরহাটে হিন্দুরা একটি মন্দিরে দীর্ঘদিন যাবৎ পূজাৰ্চনা করে আসছে। স্থানীয় মুসলমানেরা চক্রান্ত করে জোর করে মন্দিরটি উঠিয়ে দিয়ে সেখানে ব্যবসা শুরু করেছে।

গাজিপুর পৌরসভার ফাউকাল গ্রামের লক্ষ্মী মন্দিরের বিগ্রহ ছাবিবশে মে তারিখে গভীর রাতে ভেঙে ফেলে, বিগ্রহের মাথাটি নিয়েও যায়।

ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার কষ্টসাগর গ্রামের মঠবাড়িতে চৈত্র সংক্রান্তির রাতে চড়ক পূজো চলাকালে একদল লোক হামলা চালায়, পূজারীকে বেদম পেটায়, পূজার নৈবেদ্য তছনছ করে, ঢাক কেড়ে নেয়। মামলা দায়ের করবার পরও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার নিজড় পূর্বপাড়ার কালীমন্দিরে উনআশির চৌদ্দই মার্চ রাত ন’টায় মুসলমানেরা হামলা করে মন্দিরের ক্ষতি করে। উলপুরের শিবমন্দিরের তালা ভেঙে শিবলিঙ্গ সহ মূল্যবান জিনিসপত্র চুরিও করে।

কুষ্টিয়া জেলা সদরে থানাপাড়ায় অষ্টআশির সতেরো অক্টোবর তারিখে দুৰ্গ প্রতিমা  ভেঙে ফেলে।

খুলনা জেলা সদর পালের বাজারে পুজো শুরু হওয়ার আগে মুর্তিগুলো ভেঙে ফেলে ঝাজারের কজুন মুসলুমান লোক।

যশোর জেলার গোবরায় দুর্গ প্রতিমা ভেঙে ফেলা হয়।

অষ্টআশির পয়লা অক্টোবর খুলনা জেলার ঐতিহ্যবাহী শ্ৰী শ্ৰী প্রণবানন্দজী মহারাজের আশ্রমের দুর্গা প্রতিমা ভেঙে ফেলা হয়।

তিরিশে সেপ্টেম্বর তারিখে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের পুজোমন্দিরের দুর্গ প্রতিমা ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়।

খুলনা ভুমুরিয়া উপজেলার মধুগ্রাম জামে মসজিদের ইমাম শারদীয় দুগোঁহাসকের আগে এলাকার সকল পুজো মণ্ডপে চিঠি লিখে জানিয়ে দেয় প্রতিবার আজান ও নামাজের জন্য পুজোর সব কিছু বন্ধ রাখতে হবে। চিঠিটি পেঁৗছয় সতেরো অক্টোবর তারিখে।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে খুলনা জেলা শহরে সাম্প্রদায়িক শক্তির এক মিছিলে শ্লোগান ওঠে-মুর্তিপূজা চলবে না, ভেঙে দাও, ওঁড়িয়ে দাও।’

কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার মহিষকোলা গ্রামে তেইশ অক্টোবর কালী মন্দিরের কালী মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়।

গাজিপুরে কালীগঞ্জ উপজেলার কালীগঞ্জ বাজারের কালী মন্দিরে পুজোর আগে যে মূর্তিটি তৈরি হচ্ছিল, ভেঙে ফেলা হয়। –

তিরিশে সেপ্টেম্বর তারিখে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নকীপুর গ্রামে হরিতলা মন্দিরে পুজোর আগে তৈরি করা মুর্তি ভেঙে দেয়।

পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় কালী মন্দিরের দেওয়াল ভেঙে ড্রেন করা হয়েছে।

বরগুনা জেলার ফুলঝুরি বাজারের দুর্গ প্রতিমা বিজয়া দশমীর দিন মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। বামনা উপজেলার বুকাবুনিয়া ইউনিয়নের দুর্গ প্রতিমা পূজার কয়েকদিন আগে ভেঙে ফেলে। এসবের কোনও স্ট্রিচার হয়নি।

বাংলাদেশ নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। সুরঞ্জন হঠাৎ হেসে ওঠে। এক ঘরে, ঘরে কিরণময়ী নেই, একটি বেড়াল শুয়েছিল। দরজার পাশে, বেড়ালটি চমকে তাকায় সুরঞ্জনের হাসির শব্দে। বেড়ালটি কি আজ ঢাকেশ্বরী মন্দির যায়নি? আচ্ছ এই বেড়ালের জাত কি? সে কি হিন্দু? হিন্দুর বাড়িতে যখন থাকে, হিন্দুই হবে বোধহয়। সাদা কালোয় মেশানো রঙ, নীল চোখদুটোয় মায়া, বেড়ালের চোখ থেকেও কি করুণা ঝরছে। তবে তো এটিও মুসলমান! নিশ্চয়ই মুক্তচিন্তার বিবেকবান মুসলমান, আজকাল ওরা আবার হিন্দুদের দিকে করুণ চোখে তাকায়। বেড়ালটি উঠে যায়। এ বাড়িতে চুলো জ্বলছে না খুব একটা, এরকম হতে পারে, বেড়ালটি পাশের মুসলমান বাড়ির রান্নাঘরে গিয়ে বসিল, বেড়ালটির তা হলে জাত নেই। জাত কেবল মানুষের আছে। মানুষেরই মন্দির মসজিদ আছে। সুরঞ্জন দেখে সিঁড়িতে রোদ এসে পড়েছে, বেলা অনেক হল, আজ ডিসেম্বরের না তারিখ, তার খুব বেড়াল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। সারাজীবন সে পুজো করল না, মন্দিরে গেল না, দেশে সমাজতন্ত্র আনবে বলে পণ্য করুল, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল, মিছিল করল, মিটিং-এ ভাল ভাল কথা বলল, কৃষকের কথা ভাবল, শ্রমিকের কথা ভাবল, দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নতির কথা ভেবে ভেবে নিজের দিকে, সংসারের দিকে তাকাবার অবসরও পায়নি। আর এই সুরঞ্জনকে সবাই আঙুল তুলে বলছে সে হিন্দু : পাড়ার ছেলেরা তাকে ‘ধর ধর বলে ধ্বনি দেয়। আজ হয়ত ওরা ধরে মার দিচ্ছে না, কাল দেবে। গৌতম ডিম কিনতে গিয়ে মার খায়, সে মোড়ের মতির দোকানে সিগারেট কিনতে যাবে, পিঠে হঠাৎ পড়বে এসে প্রবল ঘুষি, ঠোঁট থেকে সিগারেটটি পড়ে যাবে তার, ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখবে কুদ্দুস, রহমান, বেলায়েত, সোবহান এরা সব দাঁড়িয়ে আছে। হাতে শক্ত লাঠি, ধারালো ছোরা। দৃশ্যটি ভাবতেই সুরঞ্জন চোখ বন্ধ করে ফেলে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। তবে সুরঞ্জনও কি ভয় পায়? সে তো ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। বিছানা ছেড়ে সে উঠোনে বেড়ালটিকে খোঁজে। কী নিস্তব্ধ বাড়ি। মনে হয় কতকাল এই বাড়িতে কেউ থাকে না। একাত্তরে গ্রাম থেকে যখন ফিরে এসেছিল, ব্ৰাহ্মাপল্লীর বাড়িতে বড় বড় ঘাস গজিয়ে গিয়েছিল, থমথমে, গোটা বাড়িটায় একটি জিনিস নেই, তার লাটিম মার্বেল ঘুড়ি নাটাই ক্যারমবোর্ড দাবা বইপত্র কিছু নেই। খাঁ খাঁ করা বাড়িটিতে ঢুকে যেমন বুক কেঁপেছিল, সুরঞ্জনের তেমন বুক কাঁপে। সুধাময় কি সারাদিন শুয়ে থাকেন? প্রেসার যদি বাড়েই, ডাক্তার ডাকবে কে? বাজার করা, ওষুধ কেনা, মিস্ত্ৰি ভাকা, পত্রিকা রাখা এ ধরনের কোনও কাজই সুরঞ্জন কখনও করেনি। সে বাড়িতে তিনাবেল নয়ত দুবেলা খায়, রাত হলে বাড়ি ফেরে, বেশি রাতে হলো নিজের ঘরের দরজা বাইরে থেকে খুলে ঢোকা যায়, ঢোকে। টাকা পয়সার দরকার হলে কিরণময়ী নয় সুধাময়ের কাছে চেয়ে নেয়। টাকা চাইতে তার লজ্জাই হয়। তেত্রিশ বছর বয়স, এখনও কোনও উপার্জন নেই। সুধাময় বলেছিলেন–রিটায়ার করছি, তুই কিছু কর সুরঞ্জন।’ ‘আমার দ্বারা চাকরি-বাকরি করা হবে না।’ বলে সে কুটক্যামেলা এড়িয়ে গেছে। বাইরের ঘরে রোগী দেখে সংসার চালাচ্ছেন সুধাময়। রাত করে ঘরে ফিরেছে, পার্টি অফিসে, মধুর কেন্টিনে, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অফিসে, প্রেস ক্লাবে, বত্ৰিশ নম্বরে সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত সুরঞ্জন ঘরে ফিরেছে। ভাত ঢাকা থাকত টেবিলে, কোনও দিন খেয়ে, কোনও দিন না খেয়ে শুয়ে পড়েছে। দূরত্ব এভাবেই তৈরি হচ্ছিল সংসারের সঙ্গে তার, কিন্তু আজ যখন কিরণময়ী সকালের চা দিতে গিয়ে বসলেন তার বিছানায়, সুরঞ্জন অনুভব করেছে। তার মত উড়নচন্তীি উদাসীন দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলের ওপর এখনও বাবা মায়ের পরম নির্ভরতা। কি দিয়েছে। সে এই সংসারকে? এক সময়ের বিত্তবান সুধাময় ডাল-ভাত খেয়ে এখন তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। সুরঞ্জনও তোলে, তার মনে আছে ছোটবেলায় তাকে নাক চেপে ধরে দুধ গেলানো হত, মাখন না খেলে পিঠে মাির পড়ত, আর এখন যদি সে কিরুণাময়ীর কাছে আবদার করে আমার সেই খাঁটি দুধ চাই, ননী চাই, মাখন চাই; দুপুরে মাছ চাই মাংস চাই, ঘিয়ে ভাজা পরোটা চাই; সুধাময়ের ক্ষমতা হবে খাওয়াবার? অবশ্য প্রাচুর্য বা বিলাসিতার প্রতি সুরঞ্জনের কোনও আকর্ষণ জন্মায়নি। না জন্মাবার কারণ সুধাময়। সমান বয়সের বন্ধুরা যখন নতুন ডিজাইনের প্যাস্ট শার্ট বানাতো, সুধাময় তখন ছেলের জন্য কিনে আনতেন আইনস্টাইন, নিউটন, গ্যালিলিওর জীবনী, ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনী, গোর্কি টলস্টয়ের গল্প। সুধাময় চাইতেন ছেলে তাঁর মানুষ হবে। আজ সকালে বেজাত বেড়ালটিকে খুঁজতে খুঁজতে তার নিজের কাছেই জানতে ইচ্ছে হল সে কি আন্দীে মানুষ হয়েছে? তার কোনও লোভ নেই, সম্পদ বা সম্পঞ্জির প্রতি মোহ নেই, নিজের স্বার্থের চেয়ে দশজুনের স্বার্থকেই বড় করে দেখে। এসবোকই কি মানুষ হওয়া বলে! সুরঞ্জন এলোমেলো হাঁটতে থাকে বারান্দায়। সুধাময় পত্রিকা পড়ছিলেন। ছেলের দিকে চোখ পড়তেই ডাকেন—সুরঞ্জন, শোন।

-কল। খাটের রেলিং ধরে দাঁড়ায় সে।

—যোশী আর আদভানি সহ আটজন গ্রেফতার হয়েছে শুনেছিস? ওদিকে চারশ’রও বেশি মারা গেছে। ইউ পি-র কল্যাণ সিং-এরও বিচার হবে। আমেরিকা এমনকি সারা বিশ্ব বাবরি মসজিদ ভাঙার নিন্দা করেছে, ভোলায় কার্ফু দিয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি রক্ষণ করার জন্য বি এন পি আওয়ামি লিগ এমনকি অনেক দলই পথে নোমছে। বিবৃতি দিচ্ছে। সুধাময়ের চোখের তারা বেড়ালের চোখের তারার মত মায়া মায়া।

—আসলে কি জানিস, যারা দাঙ্গা বাঁধাচ্ছে, তারা কি আর ধর্ম মেনে করছে? আসল কথা লুটপাট। মিষ্টির দোকানগুলো লুট হয় কেন বুঝিাস না? মিষ্টির লোভে। সোনার দোকানও ওই সোনাদানার লোভে।। গুণ্ডা বদমাশরা এই লুটপাটগুলো করছে, এখানে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে আসলে কোনও বিরোধ নেই। আর যে হারে শান্তি মিছিল বেরোচ্ছে, কিছু একটা হবেই। নব্বই-এ এরশাদের পতন তো এই ইসুতেই হল। আচ্ছা সুরে, এরশাদ যে বলেছিল হিন্দুদের ক্ষতিপূরণ দেবে, দেওয়া হয়েছিল?

—তুমি কি পাগল হয়ে গেছ বাবা?

–কী জানি আজকাল মনেও থাকে না? নিদারাবাদ হত্যাকাণ্ডের আসামীদের ফাঁসি হবে জানিস তো?

সুরঞ্জন বোঝে সুধাময় বোঝাতে চান হিন্দুরা এ দেশে বিচার পায়। ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ার নিদারাবাদ গ্রামের বিরজাবালা দেবনাথ আর তার পাঁচ সন্তান নিয়তিবালা, সুভাষ দেবনাথ, মিনতিবালা, সুমন দেবনাথ ও সুজন দেকনাথকে ধোপাজুড়ি বিলে নিয়ে রামদা দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলে, মেরে দুটো ড্রামে পুরে ড্রামের মুখ চুন ও নুন দিয়ে বন্ধ করে ধোপাজুড়ি বিলে ডুবিয়ে রাখে, পরে পানির নীচ থেকে ড্রাম ভেসে ওঠে। মেরেছিল বিরজার স্বামী শশাঙ্ক দেবনাথের তিন একর চৌত্ৰিশ শতক সম্পত্তি জীবর দখল করা এবং শশাঙ্ক হত্যামামলা থেকে বাঁচবার জন্য। হত্যামামলার আসামী তাজুল ইসলাম আর চোরা বাদশাহর ফাঁসির রায় হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে, সেও আজ চার মাস হয়ে গেল, নতুন করে সুধাময়ের এই কথা বলবার কারণ কি তবে এই যে তিনি কোনও একটি ঘটনা থেকে সাত্মনা পেতে চাইছেন। ভাবতে চাইছেন হিন্দুরা এই দেশে খুব সুবিচার পায়। এই দেশে হিন্দু মুসলমান একই মযাদা পায়! হিন্দুরা এই দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক নয়।

—কাল কি সম্প্রীতির মিছিলে গিয়েছিলি? কত লোক হয়েছিল রে সুরঞ্জন?

—জানি না।

–জামাতিরা ছাড়া সব দল তো রাস্তায় নেমেছিল, তাই না?

–জানি না।

—পুলিশ প্রোটেকশান তো দিচ্ছেই সরকার

—জানি না।

–শাঁখারি বাজার এলাকার এমাথা ওমাথায় ট্রাক ভর্তি পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, দেখেছিস?

–জানি না।

—হিন্দুরা তো দোকানপাটও খুলছে।

–জনি না।

–ভোলায় নাকি খুব খারাপ অবস্থা? খুব কি খারাপ অবস্থা সুরঞ্জন? নাকি প্রচারটা বেশি হচ্ছে?

–জানি না।

-গৌতমকে বোধহয় ব্যক্তিগত শক্রতার কারণেই মেরেছে। ছেলেটি নাকি গাঁজ-টাজা খেত?

–জানি না।

সুরঞ্জনের নিষ্পৃহ ভঙ্গি সুধাময়ের উচ্ছাস দমিয়ে ফেলে। তিনি পত্রিকার পাতা মেলে ধরেন চোখের সামনে। আহত কণ্ঠে বলেন–তুই বোধহয় পত্রিকা-টত্রিকা পড়িস না!

—পত্রিকা পড়ে কী হবে?

–চারদিকে কিরকম প্রতিরোধ হচ্ছে, প্রতিবাদ হচ্ছে, জামাতিদের কি আর এত শক্তি হবে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মন্দিরে ঢুকতে?

—মন্দির দিয়ে কী করবে তুমি, পুজো করবার ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি শেষ বয়সে? মন্দির ওঁড়ো করে ফেললে তোমার কোনও অসুবিধে? যত মন্দির আছে ভেঙে ফেলুক না! আমি তো খুশি হই।

সুধাময় অপ্রস্তুত হন। সুরঞ্জন ইচ্ছে করেই তার ভালমানুষ বাবাকে আহত করে। এত ভাবনার কি আছে, দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে, নিজেকে প্রথম শ্রেণীর কাতারে দাঁড় করাবার ইচ্ছেটাই তো বোকামি। এতকাল পুজো-আচ্চা না করে, এতকাল মুসলমানদের ভাই বন্ধু ভেবে কী লাভ হল সুধাময়ের, কী লাভ হল সুরঞ্জনের! সেই তো সকলে তাদের হিন্দু বলেই জানে। সারাজীবন মনুষ্যত্ব আর মানবতার চাচা করে, সারাজীবন নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাস করে কী লাভ হল। এই পরিবারের! সেই তো ঢ়িল পড়ে বাড়িতে, সেই তো তটস্থ থাকতে হয় ভয়ে। সেই তো কুঁকড়ে থাকতে হয় আশঙ্কায় কখন সাম্প্রদায়িকতার অন্ধ আগুন এসে গায়ে লাগে। সুরঞ্জনের মনে আছে সে যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে, টিফিন পিরিয়ডে তারই ক্লাশমেট ফারুক তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিল-’আমি খুব ভাল একটি খাবার এনেছি বাড়ি থেকে, কাউকে দেব না, তুই আর আমি ছাদের সিঁড়িতে বসে খাব, কেমন?’ সুরঞ্জন যে খুব ক্ষুধার্ত ছিল তা কিন্তু নয়। তার কাছে ফারুকের প্রস্তাবটি মন্দ লাগেনি। টিফিনবক্স নিয়ে ফারুক উঠে এল স্কুলের ছাদে, পেছনে সুরঞ্জন। ফারুক তার টিফিনবক্স খুলে একটি কাবাব দিল সুরঞ্জনের হাতে। দুজনে গল্প করতে করতে কাবাব খেল। সুরঞ্জন ভােবল তার মা-ও চমৎকার নারকেলের নাডু বানাতে পারেন, একদিন এনে সে ফারুককে খাওয়াবে। ফারুককে সে বললও, ‘এটি কে বানিয়েছে, তোমার মা বুঝি? আমার মায়ের রান্নাও তোমাকে একদিন খাওয়াব ৷ ‘ এদিকে খাওয়া শেষ হবার পর ফারুক সজোরে আনন্দধবনি দিলে—’হুররে ৷ ‘ সে কিছু বুঝে উঠবার আগেই ফারুক দৌড়ে নেমে গেল সিঁড়ি ভেঙে। নীচে নেমে ক্লাসের সবাইকে সে জানিয়ে দিল সুরঞ্জন গরু খেয়েছে। সকলে সুরঞ্জনকে ঘিরে হৈ হৈ করে নাচতে লাগল। কেউ চিমটি কাটে, কেউ তার মাথায় চাটি মারে, কেউ জামা ধরে টান দেয়, কেউ প্যান্টখানা

নামিয়ে ফেলতে চায়, কেউ জিভ বের করে নাড়ায়, কেউ খুশিতে মরা তেলাপোকা ঢুকিয়ে দেয় শার্টের পকেটে। সুরঞ্জন লজ্জায় মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল, তার চোখ উপচে জল নামছিল, গরুর মাংস খেয়ে তার এতটুকু গ্লানি হচ্ছিল না, গ্লানি হচ্ছিল তাকে ঘিরে জান্তব উচ্ছ্বাস দেখে। সে খুব বিচ্ছিন্ন বোধ করছিল। তার মনে হচ্ছিল যেন সে এদের বাইরে, এই বন্ধুরা একরকম মানুষ, আর সে আরেকরকম। বাড়ি ফিরে সে কী কান্না সুরঞ্জনের। সুধাময়কে বলল–ওরা আমাকে ষড়যন্ত্র করে গরুর মাংস খাইয়েছে।

শুনে সুধাময় হেসে বলেছিলেন-এর জন্য কাঁদতে হয় নাকি? গরুর মাংস তো ভাল খাবর। কালই আমি বাজার থেকে কিনে আনিব, সবাই মিলে খাব, দেখিস।

পরদিন সত্যি সত্যি গরুর মাংস কিনে এনেছিলেন সুধাময়। কিরুণাময়ী রেঁধেছিলেন সেই মাংস ৷ সহজে কি রাঁধতে চান। অর্ধেক রাত পর্যন্ত সুধাময় বুঝিয়েছিলেন এসব কুসংস্কারের কোনও অর্থ নেই, অনেক বড় বড় মনীষী এইসব সংস্কার মানতেন না, আর যাই বল মাংসটা তো টেস্টি। ঝাল ফ্রাইও করতে পারো। সুরঞ্জনের ধীরে ধীরে কেটেছিল ছোটবেলার লজ্জা, ভয়, ক্ষোভ, সংস্কার। পরিবারের শিক্ষক ছিলেন সুধাময়। সুরঞ্জনের মনে হয় তার বাবা অতিমানব গোছের কিছু হবেন। এত সততা, এত সারল্য, এত সুস্থ চিন্তা, গভীর বোধ ও ভালবাসা, এত অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আজকাল কেউ বাঁচে না।

সুরঞ্জন পত্রিকাটি ছুঁয়েও দেখে না। আলগোছে সরে যায় সুধাময়ের ঘর থেকে। তার ইচ্ছে করে না পত্রিকার ওপর ঝুঁকে থাকতে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিপক্ষে বুদ্ধিজীবীদের গীতি পড়বে, শক্তি মিছিলের ছবি দেখবে, আর প্রাণে তার আস্থার সুবাতাস বইবে এ স্পর্কবারেই অপছন্দ সুরঞ্জনের। সে বরং বেড়ালটিকে খুঁজতে থাকে। জাতছাড়া একটি বেড়াল! বেড়ালের তো জাত নেই, সম্প্রদায় নেই। সেও যদি একটি বেড়াল হতে পারত।

 

৩গ.

ক্যাম্প থেকে কদিন পর ফিরেছিলেন সুধাময়, সাতদিন? ছ’দিন? তাঁর খুব পিপাসা পেয়েছিল। এত পিপাসা যে সে হাত পা বাঁধা, চোখও বাঁধা, তবু তিনি গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিলেন যদি কোনও মাটির কলসের দিকে যাওয়া যায়। ক্যাম্পে কলস কোথায় পাবেন, দূরে ব্ৰহ্মপুত্রের জল ছলাৎ ছলাৎ করে, ঘড়ায় কোনও জল তোলা নেই। সুধাময়ের বুক, জিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকত। জল জল বলে যখন কাতরাতেন সুধাময়, মিলিটারিগুলো ইতি শব্দ করে হাসত। একদিন অবশ্য জল দিয়েছিল ওরা, সুধাময়ের চোখের পট্টি খুলে দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে একটি ঘটিতে পেচ্ছাব করেছিল দুটো মিলিটারি, সেই ঘটির পেচ্ছাব সুধাময়ের মুখে ঢালতে নিলে তিনি সরিয়ে ফেলেছিলেন মুখ ঘূণায়, কিন্তু মুখটিকে হাঁ করিয়ে রাখলো শক্ত দুটো হাত দিয়ে একজন, আর আরেকজন ঢালল, হো হো করে হেসে উঠেছিল ক্যাম্পের বাকি মিলিটারি। নোনা গরম জল তাঁর গলা বেয়ে নামছিল, মনে মনে তিনি তাঁর প্রকৃতির কাছে বিষ চাইছিলেন। ওরা কড়িকাঠে ঝুলিয়ে পিটিয়েছিল তাঁকে। পেটাতে পেটতে বারবারই বলছিল মুসলমান হতে। কলমা পড়ে মুসলমান হতে। অ্যালেক্স হ্যালির রুটস-এ কালো ছেলে কুণ্টা কিন্টেকে যেমন তার নাম টোবি বলবার জন্য যারা চাবুক মারছিল পিঠে, তাদের সে বারবারই বলছিল তার নাম কুন্টা কিন্টে। সুধাময় যখন কিছুতেই মুসলমান হতে চাইলেন না, মুসলমান যখন হাবই ন এই নে তোর মুসলমানি করে দিলাম বলে ওরা একদিন লুঙ্গি তুলে খচ করে কেটে ফেলল তাঁর পুরুষাঙ্গ। ওটি ধরে পেচ্ছাব খাওয়াবার দিন যেমন হেসেছিল, তেমন অদ্ভুত কণ্ঠে হেসে উঠল। সুধাময় সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছিলেন সে মুহুর্তে। বেঁচে ফিরবেন এরকম আশা তিনি করেননি, যে হিন্দুরা চোখের সামনে বাঁধা ছিল, তারা কলমা পড়ে মুসলমান হতে চাইল, তবুও তারা প্ৰাণে বাঁচল না, সুখময়কে আমূল মুসলমানি করুবার করুণায় হয়ত বাঁচিয়ে দিল ওরা। ওরকম বেঁচে এসে তাঁর নালিতবাড়ি যাবার প্রোগ্রাম গেল ধসে।

ডাকবাংলোর ড্রেনের কাছে পড়ে থাকা দেহটি সজাগ হয়ে দেখেছিল গা থেকে রক্ত গড়াচ্ছে, কিন্তু মরেনি। সেই পা পাঁজর ভাঙা শরীর নিয়ে কী করে ব্ৰাহ্মাপল্লী অবধি এসেছিলেন ভাবলে এখনও তিনি অবাক হন, ওই ভেতরের শক্তিই সম্ভবত তাঁকে এখনও অনড় রেখেছে। বাড়ি ফিরে কিরুণাময়ীর সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন সেদিন। দেখে থর/থার কেঁপেছিলেন কিরণময়ী। কিরণময়ীই তাঁকে পার করে নিয়ে এসেছিলেন, রাড়িঘর ফেলে ব্ৰহ্মপুত্রের ফেরি পার হলেন তিনি, সঙ্গে অবাধ দুটো শিশু ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছিল, কিরণময়ী কাঁদতে পারেননি, সব কান্না তাঁর জমা ছিল বুকের ভেতর। ফয়জুলের মা প্রায়ই তাঁকে বলতেন—’মৌলভি ডাকি, কলমা পড়ে মুসলমান হয়ে যান, সওয়াব হবে। মায়ার বাবাকে বোঝান।’ কিরণময়ী তখনও কাঁদেননি। আটকে রেখেছিলেন। গভীর গোপন বেদনাগুলো, বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে শাড়ির আঁচল কেটে সুধাময়ের ক্ষতে ব্যান্ডেজ করে দিতেন, তখনও কর্মীদেননি; কেঁদেছিলেন তখন যখন সারা গ্রাম জুড়ে উৎসব শুরু হল আনন্দের, জয় বাংলার, তখন গ্রামের লোকে কী বলবে কিছু না ভেবেই কিরণময়ী সুধাময়ের বুকে পড়ে বুকের সব জমানো কান্না কেঁদেছিলেন। শিশুর মত গলা ছেড়ে কেঁদেছিলেন।

এখন কিরণময়ীর দিকে চোখ পড়তেই সুধাময়ের মনে হয় সে ভেতরে ভেতরে একাত্তরের ন’ মাসের মত কাল্লা জমাচ্ছে। হঠাৎ একদিন সব কান্না সে কাঁদবে, হঠাৎ একদিন তাঁর দুঃসহ স্তব্ধতা কাটবে। ভেতরে কালো মেঘের মত দুঃখ জমছে। একদিন জল হযে বৃষ্টি হয়ে ঝরবে সব, কবে জয় বাংলার মত স্বাধীনতার সংবাদ তাদের কানে আসবে। কবে খবর আসবে শাঁখা সিঁদুর পরুবার, ধুতি পরুবার অবাধ স্বাধীনতার। কবে কািটৰে একাত্তরের মত দম বন্ধ করা দুৰ্য্যেগের দীর্ঘ রাত? সুধাময় লক্ষ করছেন কোনও রোগীও আর আসছে না। তাঁর কাছে; দিনে ছ সাতটি রোগী তো ঝড়-বৃটির দিনেও হত। সারাদিন ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগে না সুধাময়ের, খানিক পর পর মিছিল যায় ‘নারীয়ে তকবির আল্লাহু আকবার, হিন্দু যদি বাঁচতে চাণ্ড, এ দেশ ছেড়ে চলে যাও।’ যে কোনও সময় বোমা পড়তে পারে বাড়িতে, যে কোনও সময় আগুন লাগিয়ে দেবে মীেলাবাদীরা, যে কোনও সময় লুট হয়ে যাবে বাড়ি, খুন হয়ে যাবে বাড়ির যে কেউ। হিন্দুরা কি চলে যাচ্ছে, নব্বই-এর পর সুধাময় জানেন অনেকে দেশ ছেড়েছে, নতুন সেনসাসে হিন্দু মুসলমান আলাদা আলাদা করে গোনা হয়নি, হলে দেশ ছেড়ে গেছে কত হিন্দু তা স্পষ্ট হত। বইয়ের তাকে ধুলো জমে গেছে। সুধাময় কুঁ দিয়ে ধুলো পরিষ্কার করেন। স্কুলো কি যায়! পাঞ্জাবির খুঁট দিয়ে ধুলো মুছতে মুছতে চোখে পড়ে। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ঝুরোর পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থটি। উনিশ’শ ছিয়াশির পরিসংখ্যান। চুয়াত্তর এবং একাশি সনের হিসেবে। চুয়াত্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষ আট হাজার, একাশিতে দাঁড়াল পাঁচ লক্ষ আশি হাজার। চুয়াত্তিরে সেখানে মুসলমান ছিল ছিয়ানব্বই হাজার, একাশিতে হল এক লক্ষ অষ্টআশি হাজার। চুয়াত্তিরে ছিন্দু ছিল তোপ্পান্ন হাজার, একাশিতে হল ছেষট্রি হাজার। মুসলমান বৃদ্ধির হার ৯৫.৮৩%, হিন্দু বৃদ্ধির হার ২৪.৫৩%,। কুমিল্লায় চুয়াত্তিরে মুসলমানের সংখ্যা ছিল বাহান্ন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার, একাশিতে দাঁড়াল ছেষট্টি লক্ষ, হিন্দু ছিল পাঁচ লক্ষ চৌষট্টি হাজার, একাশিতে ছিল পাঁচ লক্ষ পয়ষট্টি হাজার। মুসলমান বৃদ্ধির হার ২০.১৩%। হিন্দু বৃদ্ধির হার ০-১৮% ৷ ফরিদপুরে জনসংখ্যা চুয়াত্তর থেকে একাশিতে বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭.৩৪%। মুসলমান সংখ্যা ছিল একত্ৰিশ লক্ষ, একাশিতে এসে হল আটত্রিশ লক্ষ বাহান্ন হাজার। বৃদ্ধির হার ২৪.২৬%। নয় লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার ছিল চুয়াত্তিরের হিন্দু সংখ্যা, একাশিতে দাঁড়াল আট লক্ষ চুরানব্বই হাজার। বৃদ্ধির হার (-)৫.৩৫%,। পাবনার জনসংখ্যা চুয়াত্তর থেকে একাশিতে বেড়েছে ২১.১৩%। পঁচিশ লক্ষ ছেচল্লিশ হাজার মুসলমান ছিল চুয়াত্তরে, একাশিতে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল একত্রিশ লক্ষ সাতষট্টি হাজার। বৃদ্ধির হার ২৪-৩৯% ৷ এদিকে হিন্দু ছিল দুই লক্ষ ষাট হাজার, একাশিতে হল দুই লক্ষ একান্ন হাজার। বৃদ্ধির হার (-)৩-৪৬%,। রাজশাহী জেলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২৩.৭৮ % ৷ মুসলমান বেড়েছে। ২৭।২০%। হিন্দু ছিল চুয়াত্তিরে পাঁচ লক্ষ আটান্ন হাজার। একাশিতে হল পাঁচ লক্ষ তিন হাজার। হিন্দু বৃদ্ধির হার (-)৯.৬৮%,। পরিসংখ্যান গ্রন্থটির ১১২ নম্বর পৃষ্ঠায় সুখময় দেখলেন একটি হিসেব লেখা : ১৯৭৪ সনে হিন্দু জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা সাড়ে তের ভাগ ছিল। ১৯৮১ সনে হিন্দুরা মোট জনসংখ্যার ১২.১ ভাগ। বাকি হিন্দু যাচ্ছে কোথায়? সুধাময় চশমার কাচ পরিষ্কার করেন জামার হাতায়। তরে কি ওরা চলে যাচ্ছে? কেন চলে যাচ্ছে? চলে যাওয়াতেই কি আসল মুক্তি? দেশে থেকে লড়াই করা কি উচিত ছিল না? সুধাময়ের আবার ইচ্ছে করে পালিয়ে যাওয়া হিন্দুদের কাওয়ার্ড বলে গাল দিতে।

তাঁর শরীরটা ভাল লাগছে না। পরিসংখ্যানের বই হাতে নেওয়ার পর থেকে তিনি লক্ষ করছেন ডান হাতটি দুর্বল লাগছে। বইটি তাকে উঠিয়ে রাখতে গিয়েও দেখেন আগের মত জোর পাচ্ছেন না হাতে। কিরণময়ীকে ডাকেন। তিনি, ডাকতে গিয়ে লক্ষ করেন জিভখানাও ভরি লাগছে। নীল নেকড়ের মত একটি আশঙ্কা তাঁর দরজায় দাঁড়ায়। নাছোড়বান্দা নেকড়ে। হাঁটতে গিয়েও লক্ষ করেন তাঁর ডান পায়ে আগের জোর নেই। ডাকেন—কিরণ! ও কিরণ!

কিরণময়ী ডাল বসিয়েছেন চুলোয়। নিঃশব্দে দাঁড়ান এসে সামনে। সুধাময় ডান হাত বাড়তে চান কিরণাময়ীর দিকে। হাতটি ঢলে পড়ে যায়। —কিরুণ, আমাকে বিছানায় শুইয়ে দাও তো।

কিরুণাময়ীও ঠিক বুঝতে পারেন না হয়েছে কী। মানুষটি এভাবে কাঁপছেন কেন। কথাই বা জড়িয়ে যাচ্ছে কেন। তিনি শোবার ঘরের বিছানায় শুইয়ে দেন সুধাময়কে। –হয়েছে কি তোমার?

—সুরঞ্জন কোথায়?

—এই তো বেরিয়ে গেল। কথা শুনল না।

–আমার ভাল লাগছে না কিরণ। কিছু একটা কর।

—তোমার কথা জড়াচ্ছে কেন? কি হয়েছে?

—ডান হাতে জোর পাচ্ছি না। ডান পায়েও না। তবে কি কিরণময়ী প্যারালাইসিস হয়ে যাচ্ছে?

কিরণময়ী দুহাতে জাপটে ধরেন সুধাময়ের দুটো বাহু। বলেন—বালাই ষাট। দুর্বলতা থেকে হচ্ছে গো, ঘুম হচ্ছে না রাতে। তাই বোধহয়। খাওয়া-দাওয়াও করছ না।

সুধাময় ছটফট করেন। অস্থিরতা তাঁর সারা শরীরে। তিনি বলেন–দেখ তো কিরণ, আমি মরে যাচ্ছি কি না। আমার এমন লাগছে কি না।

—কাকে ডাকব? হরিপদবাবুকে ডাকব একবার?

সুধাময় বাঁ হাতে খামচে ধরেন কিরণময়ীর হাত। —যেও না, আমার কাছ থেকে নড়ো না কিরণ। মায়া কোথায়?

—ও তো সেই যে গেছে। পারুলের বাড়ি। ফেরেনি।

—আমার ছেলে কোথায় কিরণ? আমার ছেলে?

—কি পাগলের মত কথা বলছি।

—কিরণ দরজা জানালাগুলো খুলে দাও।

—দরজা জানালা কেন খুলব?

—আমার একটু আলো চাই। বাতাস চাই।

—হরিপদবাবুকে ডেকে আনি। তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকো।

—ওই হিন্দুগুলো পালিয়েছে বাড়ি ছেড়ে, ওদের পাবে না। মায়াকে ডাকো।

—খবর পাঠাবো কাকে দিয়ে বল। কেউ তো নেই।

—তুমি একচুল নড়ো না কিরণ। সুরঞ্জনকে ডাকো।

সুধাময়। এরপর বিড়বিড় করে কী বলেন কিছু বোঝা যায় না। কিরণময়ী কেঁপে ওঠেন। তিনি কি চিৎকার করে পাড়ার লোক ডাকবেন? দীর্ঘ বছর ধরে পাশাপাশি থাকা পড়শি কাউকে? হঠাৎ দমে গেলেন তিনি পড়শি কে আছে যে আসবেন? হায়দার, গৌতম বা শফিক সাহেবদের বাড়ির কাউকে? বড় অসহায় বোধ করেন কিরণময়ী। ডাল পুড়ে পোড়া গন্ধে আর ধোঁয়ায় ঘর ভেসে যায়।

 

৩ঘ.

সুরঞ্জন আজও কোথায় যাবে কোনও ঠিক নেই। একবার ভাবে বেলালের বাড়ি যাবে। কাকরাইল পার হয়ে ডানেই দেখে জলখাবার নামের দোকানটি ভাঙা। রাস্তায় দোকানের টেবিল চেয়ার এনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, পোড়া কাঠকয়লা আর ছাই জমে আছে। সুরঞ্জন দেখে, যতক্ষণ দেখা যায়। চামেলিবাগে পুলকের বাড়িও। সুরঞ্জন হঠাৎই তার ইচ্ছে পাল্টায়। পুলকের বাড়িতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। রিক্সাকে বাঁয়ের গলিতে যেতে বলে। পুলক একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। এন জি ও-তে চাকরি করে। অনেকদিন দেখা হয় না। ওর সঙ্গে। পাশেই বেলালের বাড়ি আডিডা দিতে সে প্রায়ই আসে। অথচ কলেজ জীবনের বন্ধু পুলকের খোঁজ নেওয়ার সময়ই তার হয় না।

কলিং বেল বাজে। ভেতর থেকে কোনও শব্দ আসে না। একটানা কলিং বেল বাজিয়েই চলে সুরঞ্জন। ভেতর থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে শব্দ হয়—কে?

–আমি সুরঞ্জন।

—কোন সুরঞ্জন?

–সুরঞ্জন দত্ত। ভেতর থেকে তালা খুলবার শব্দ হয়। পুলক নিজেই দরজা খুলে দেয়। চাপা কণ্ঠে বলে-ঢুকে পড়।

—কি ব্যাপার এত প্রোটেকশনের ব্যবস্থা কেন? ডোর ভিউ লাগালেই পারো।

পুলক আবার তালাটি লাগায় দরজায়। টেনে দেখেও নেয় ঠিকমত লাগল কিনা ৷ সুরঞ্জন বেশ চমকিত হয়। পুলক চাপা স্বরে আবার জিজ্ঞেস করে—তুমি বাইরে বেরিয়েছ যে?

—ইচ্ছে করেছে।

—মানে? ভয়ডর নেই নাকি? সাহস দেখিয়ে প্রাণটা খোয়াতে চাও? নাকি এডভেঞ্চারে বেরিয়েছ?

সুরঞ্জন সোফায় শরীর ছেড়ে দিয়ে বলে—যা ভাবো তাই।

পুলকের চোখের মণিতে আশঙ্কা কাঁপে। সেও পাশের সোফায় এসে বসে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বলে-খবর রাখছ তো সব?

—নাহ।

—ভোলায় তো খুব খারাপ অবস্থা। তাজমুদ্দিন, বোরহানউদ্দিন থানার গোলকপুর, ছোট ডাউরি, শম্ভুপুর, দাসের হাট, খাসের হাট, দরিরামপুর, পদ্মামন আর মনিরাম গ্রামের দশ হাজার পরিবারের প্রায় পঞ্চাশ হাজার হিন্দু সর্বস্বাস্ত হয়েছে। লুটেপুটে আগুন লাগিয়ে ভেঙেচুরে সব শেষ করে দিয়েছে রে। পঞ্চাশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মরেছে দুজন, আহত দুশ। লোকের পরনে কাপড় নেই, পেটে ভাত নেই। একটি ঘরাও আর বাকি নেই। আগুন ধরাতে। শত শত দোকান লুট হয়েছে। দাসের হাট বাজারের একটি হিন্দুর দোকানও নেই। আর। ঘরবাড়িহারা মানুষগুলো এই প্রচণ্ড শীতে খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছে। শহরের মদনমোহন ঠাকুরবাড়ি, মন্দির, লক্ষ্মীগোবিন্দ ঠাকুরবাড়ি, তার মন্দির, মহাপ্রভুর আখড়া লুট করে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। বোরহানউদ্দিন, দৌলতখান, চরফ্যাশন, তাজমুদ্দিন, লালমোহন থানার কোনও মন্দির, কোনও আখড়ার অক্তিত্ব নেই। সব ঘরবাড়িতে লুট হয়, আগুন ধরানো হয়। ঘুইন্যার হাট বলে এক এলাকায় প্রায় দু মাইল জুড়ে হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। দৌলতখান থানার বড় আখড়াটি সাত তারিখ রাতে জ্বলিয়ে দিয়েছে। বোরহানউদ্দিন বাজারের আখড়া ভেঙে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কুতুবা গ্রামের পঞ্চাশটি বাড়ি ছাই করে দিয়েছে। চরফ্যাশন থানায় হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করেছে। অরবিন্দ দে নামের একজনকে ছুরিও মেরেছে।

–নীলা কোথায়?

—ও তো ভয়ে কাঁপছে। তোমার অবস্থা কি?

সুরঞ্জন সোফায় আরাম করে বসে চোখ বন্ধ করে। সে ভাবে পাশেই বেলালের বাড়ি না গিয়ে আজ সে পুলকের বাড়ি এল কেন। সে কি ভেতরে ভেতরে কম্যুনাল হয়ে উঠছে, নাকি পরিস্থিতি তাকে কম্যুনাল করছে।

—বেঁচে আছি, এইটুকুই বলতে পারি।

মেঝোয় শুয়ে পুলকের ছ’বছরের ছেলে কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পুলক বলে ও কাঁদছে কেমন জানো? পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চারা, যাদের সঙ্গে খেলত ও, আজ থেকে অলককে খেলায় নিচ্ছে না। বলছে তোমাকে খেলায় নেব না, হুজুর বলেছেন হিন্দুদের সঙ্গে না মিশতে।

—হজুর মানে? সুরঞ্জন প্রশ্ন করে।

—হুজুর হচ্ছে সকলে মৌলভি আসে আরবি পড়াতে সেই লোক।

—পাশের ফ্ল্যাটে আনিস আহমেদ থাকে না? সে তো কমিউনিস্ট পার্টি করে, সে তার বাচ্চাদের হুজুর দিয়ে আরবি পড়ায়?

—হ্যাঁ। পুলক বলে।

সুরঞ্জন আবার চোখ বোজে। সে অলক হয়ে নিজেকে অনুভব করে। অলকের গ কেঁপে কেঁপে ওঠা কান্না তার বুকেও নিঃশব্দে বাজে। তাকেও যেন কেউ খেলায় নিচ্ছে না। এতকাল যাদের সঙ্গে সে খেলেছিল, যাদের সঙ্গে খেলবে বলে ভেবেছিল, তারা তাকে খেলায় নিচ্ছে না। হুজুরেরা বলেছে হিন্দুদের খেলায় নিতে নেই। সুরঞ্জনের মনে পড়ে মায়া একবার স্কুল থেকে কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফিরেছিল। বলেছিল—আমাকে ক্লাস থেকে বার করে দেয় টিচার।

আসলে ক্লাসের পাঠ্য বিষয়গুলোয় ধর্ম একটি বাধ্যতামূলক বিষয় ছিল। ইসলামিয়াত ক্লাসে তাকে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া হত। সে একা একটি হিন্দু মেয়ে, তার বইও ছিল না, তার জন্য আলাদা হিন্দু মাস্টােরও ছিল না। স্কুলে, সে একা একটি হিন্দু মেয়ে বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকত, বড় এক বড় নিঃসঙ্গ, বড় বিচ্ছিন্ন মনে হত নিজেকে তার।

সুধাময় জিজ্ঞেস করেছিলেন-কেন, কেন তোমাকে ক্লাস থেকে বার করে দেয়?

—সবাই ক্লাস করে। আমাকে নেয় মা, আমি হিন্দু তো, তই।

সুধাময় বুকের মধ্যে জাপটে ধরেছিলেন মায়াকে। অপমানে, বেদনায় তিনি অনেকক্ষণ কোনও কথা বলতে পারেননি। সেদিনই তিনি স্কুলের ধর্ম টিচারের বাড়ি গিয়ে বলেন–’আমার মেয়েকে ক্লাসের বাইরে পাঠাবেন না, ওকে কখনও বুঝতে দেবেন না ও আলাদা কেউ। * মায়ার মানসিক সমস্যা ঘুচল, কিন্তু ওকে আবার আলিফ বে তে সোর মোহে পেয়ে বসল। বাড়িতে খেলা করতে করতে আনমনে সে বলতে থাকে—’আলহামদুলিল্লাহ হি, রাব্বিল আল আমিন, আঁর রাহমানির রহিম। * শুনে কিরণময়ী সুধাময়কে ধরতেন—‘এসব করছে কি ও? নিজের জাত ধর্ম বিলিয়ে এখন স্কুলে লেখাপড়া করতে হবে নাকি? সুধাময়ও চিন্তিত হলেন। মেয়ের মানসিক অবস্থা সুস্থ রাখতে গিয়ে মেয়ে যদি ইসলাম ধর্মে আসক্ত হয়ে পড়ে তবে তো অসুবিধে আরও নতুন করে বাঁধিল। ওই ঘটনার সপ্তাহ খানিকের মধ্যে স্কুলের হেড মাস্টারের কাছে একটি দরখাস্ত লিখলেন যে ধর্ম হচ্ছে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার, এটি স্কুলের পাঠ্য হওয়া জরুরি নয়। তা ছাড়া আমি যদি আমার সন্তানকে কোনও ধর্মে শিক্ষিত করবার প্রয়োজন মনে না করি। তবে তাকে স্কুল কর্তৃপক্ষ কখনও জোর করে ধর্ম শেখাবার দায়িত্ব নিতে পারেন না। আর ধর্ম নামক বিষয়টির পরিবর্তে মনীষীদের বাণী, মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী ইত্যাদি সম্পর্কে সকল সম্প্রদায়ের পাঠ্য একটি বিষয় রচনা করা যায়, তাতে সংখ্যালঘুদের হীনমন্য ভাবটি দূর হয়। সুধাময়ের এই আবেদনে স্কুল কর্তৃপক্ষ সাড়া দেননি। যেভাবে চলছিল; সেভাবেই চলছে।

নীলা আসে। ছিপছিপে শরীর তার, সুন্দরী। সেজেগুজে থাকে। আজ তার আলুথালু বেশ। চোখের নীচে কালি, উদ্বিগ্ন চোখ, সে এসেই জিজ্ঞেস করে-সুরঞ্জনদা, কতদিন আসেন না, খবর নেন না, বেঁচে আছি কি মরে গেছি জানতেও আসেন না। খবর পাই পাশের বাড়িতেই আসেন। বলতে বলতে নীলা হঠাৎ কেঁদে ওঠে।

সুরঞ্জন আসে না বলে কেঁদে উঠবে কেন নীলা? সে কি তার সম্প্রদায়ের অসহায়ত্বের জন্মই কেঁদে উঠল, যেহেতু কষ্ট যা ধারণ করে এখন নীলা, একই বেদনা বা নিরাপত্তাহীনতা সুরঞ্জনকেও ধারণ করতে হয়? সে তা বোঝে বলে নিজের অসহায়বোধের সঙ্গে পুলক, অলক এবং সুরঞ্জনের বোধকেও সে নিদ্বিধায় মিলিয়েছে। এই পরিবারটিকে বড় আপন মনে হচ্ছে সুরঞ্জনের। বেলালের বাড়িতে চার-পাঁচ দিন আগেও আড্ডা দিয়েছে সুরঞ্জন, এ বাড়িতে আসবার প্রয়োজনই বোধ করেনি। এই বোধ তার নতুন করে জন্ম নিচ্ছে।

—ভূমি এত ন্যাভাস হচ্ছে কেন? ঢাকায় বেশি কিছু করতে পারবে না। পুলিশ পাহারা আছে শাঁখারি বাজারে, ইসলামপুরে, তাঁতিবাজারে।

-পুলিশ তো গতবারও দাঁড়িয়ে ছিল, তারা ঢাকেশ্বরী মন্দির লুট করুল, আগুন ধরাল পুলিশের সামনে, পুলিশ কিছু করল?

一হুঁ।

—আপনি রাস্তায় বেরোলেন কেন? কোনও বিশ্বাস নেই মুসলমানদের। ভাবছেন বন্ধু, দেখবেন সেই আপনার গলা কেটে ফেলে রাখিল।

সুরঞ্জন আবার চোখ বন্ধ করে। দু চোখ বন্ধ করে রাখলে কি অন্তৰ্জােলা কিছু কমে! বাইরে কোথায় যেন হইচই হচ্ছে, বোধহয় কোনও হিন্দুর দোকান ভাঙছে, পুড়ছে। চোখ বন্ধ করলেই পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে লাগে। চোখ বন্ধ করলেই দা কুড়োল রামদা হাতে ধেয়ে আসা মৌলবাদীর দল মনে হয় চোখের সামনে নাচছে। গত রাতে গৌতমকে দেখতে গিয়েছিল সে, শুয়ে আছে, চোখের নীচে, বুকে পিঠে কালশিরে দাগ। ওর বুকে হাত রেখে বসেছিল সুরঞ্জন। কিছু জিজ্ঞেস করেনি, যে স্পর্শ সে রেখেছিল, এসে স্পর্শের পর কথা বলবার দরকার পড়ে না। গৌতমই বলেছিল–‘দাদা, আমি কিছুই করিনি। ওরা মসজিদ থেকে দুপুরের নামাজ সেরে বাড়ি ফিরছিল, বাড়িতে বাজার নেই। কিছু, মা বললেন ডিম কিনে আনতে। পাড়ার দোকান ভয় কী, আমি তো আর দূরে কোথাও যাচ্ছি। না। ডিম হাতে নিয়ে টাকা ফেরত নিচ্ছি, হঠাৎ পিঠের পেছনে দুম করে লখি এসে পড়ে। ওরা ছসৈাতজন ছেলে, আমি একা কী করে পারি! দোকানঅলা, রাস্তার লোকেরা দূর থেকে মজা দেখল, কিছু বলল না। আমাকে কোনও কারণ ছাড়াই মারল ওরা, নীচে ফেলে মারল। বিশ্বাস কর কিছু বলিনি আমি ওদের। ওরা বলছিল—’হিন্দু শালা, মালাউনের বাচ্চা, শালাকে মেরে শেষ করে দেব। আমাদের মসজিদ ভেঙে পার পেতে চাস তোরা। তোদের দেশ থেকে তাড়াবই।’ সুরঞ্জন শোনে শুধু কিছু যে বলবে, খুঁজে পায় না। গৌতমের বুকের টিপচিপ শব্দ অনুভূত হয় তার হাতে। এই শব্দ সে কি তার বুকেও বাজতে শুনেছে? বোধহয় শুনেছে। দু-একবার।

নীলা চা আনে। চা খেতে খেতে মায়ার কথা ওঠে।

—মায়াকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা হয়। সে আবার হুট করে জাহাঙ্গীরকে বিয়েই করে বসে কি না।

—সে কী সুরঞ্জনদা? এখনও ফেরান ওকে। দুঃসময়ে মানুষ ঝটি করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।

—দেখি যাবার পথে পারুলের বাড়ি থেকে ওকে নিয়ে যাব। মায়াটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বেঁচে থাকবার প্রচণ্ড লোভে ও বোধহয় ফরিদা বেগম জাতীয় কিছু একটা হয়ে যাবে। সেলফিস।

নীলার চোখে নীল দুশ্চিন্তা খেলা করে। অলক কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে, গালে তার চোখের জলের দাগ। পুলক পায়চারি করে, ওর অস্থিরতা সুরঞ্জনকেও স্পর্শ করে। চায়ের মত চা পড়ে থাকে, জুড়িয়ে জল হয়ে যায়। সুরঞ্জনের চায়ের পিপাসা ছিল, কোথায় যে উবে যায় সব পিপাসা। সে চোখ বুজে ভাবতে চায় দেশটি তার, তার বাবার, তার ঠাকুরদার, ঠাকুরদারও ঠাকুরদার দেশ। এটি। সে কেন তবু বিচ্ছিন্ন বোধ করছে! কোন মনে হয় এই দেশে তার কোনও অধিকার নেই!

তার চলবার, বলবার, যা কিছু পরবার, ভাববার অধিকার নেই। তাকে সিঁটিয়ে থাকতে হবে, লুকিয়ে থাকতে হবে, তার যখন ইচ্ছে বেরোনো চলবে না, যা কিছু করা চলবে না। গলায় ফাঁস পরালে যেমন লাগে মানুষের, সুরঞ্জনের তেমন লাগে। সে নিজেই নিজের দুহাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে কণ্ঠদেশ। শ্বাস তার কিছু রোধ হয় কী হয় না। সে হঠাৎ চেচিয়ে ওঠে—আমার কিছু ভাল লাগছে না পুলক ৷

পুলকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এই শীতেও ঘাম জমে কেন? সুরঞ্জনের হাত নিজের কপালেও ওঠে। সে অবাক হয় তার কপালেও ঘাম জমেছে। ভয়ে? কেউ তো তাদের ধরে পেটাচ্ছে না। মেরে ফেলছে না। তবু কোন ভয় হয়, বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ হয়?

সুরঞ্জন ফোনের ডায়াল ঘোরায়। দিলীপ দে, এক সময়ের তুখোড় ছাত্র নেতা, ওর নম্বরটি মনে পড়ে হঠাৎ। বাড়িতেই ছিলেন দিলীপ দে।

—কেমন আছেন দাদা? কোনও অসুবিধে নেই তো? কিছু ঘটেনি তো?

—অসুবিধে নেই, কিন্তু মনে স্বস্তি পাচ্ছি না। আর আমারই ঘটতে হবে কেন? সারা দেশেই তো ঘটছে।

—তা ঠিক।

—তুমি কেমন আছ? চট্টগ্রামের অবস্থা তো শুনেছ নিশ্চয়ই?

—কি রকম?

—সন্দ্বীপ থানায় বাউরিয়ায় তিনটে, কালাপানিয়ায় দুটো, মগধরায় তিনটে, টেউরিয়ায় দুটো, হরিশপুরে একটি, রহমতপুরে একটি, পশ্চিম সারিকাইতে একটি, মাইটভাঙায় একটি মন্দির ধ্বংস করেছে। পশ্চিম সারকাইতে সুচারু দাস নামের এক লোককে মারধাের করে পনেরো হাজার টাকা নিয়ে যায়। টোকাতলিতে দুটো বাড়ি লুট করে দুজনকে ছুরি মেরেও গেছে। পটিয়া থানার কচুয়ায় একটি বাড়ি, ভাটিকাইনে একটি মন্দির…

—আপনি এমন একটি দুটির হিসেব পেলেন কোথায়?

—আরে আমি চিটাগাঙের ছেলে না? ওসব এলাকায় কি হচ্ছে খবর না নিলেও খবর চলে আসে। শোন, বাঁশখালি থানার বইলছড়িতে তিনটে, পূর্ব চাম্বলে তিনটে বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে। রাঙ্গুনিয়া থানায় সরফভাটা ইউনিয়নে পাঁচটি ঘর, পায়রা ইউনিয়নে সাতটি ঘর, শিলক ইউনিয়নে একটি মন্দির, চন্দনাইশ থানায় বাদামতলিতে একটি মন্দির, জোয়ারার একটি মন্দিরে লুটপাট করা হয়, ভাঙা হয়। আনোয়ারা থানার বোয়ালগাঁও-এ। চারটে মন্দির, একটি ঘর, তেগোটায় ষোলোটি বাড়িতে হামলা, লুট, ভাঙচুর সবই হয়। বোয়ালখালি থানার মেধস মুনির আশ্রমে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

—আমি কৈবল্যধাম, তুলসীধাম আশ্রম, অভয় মিত্র শ্মশান, শ্মশান কালীবাড়ি, পঞ্চাননধাম নিয়ে দশটি কালীবাড়ি যে পুরো জ্বলিয়ে দেওয়া হয়েছে শুনেছি। সুরঞ্জন বলে।

–সদরঘাট কালীবাড়ি, গোলপাহাড় শ্মশান মন্দিরেও হামলা হয়েছে। জামালখান রোড আর সিরাজউদ্দৌলা রোড়ে দোকান ভাঙচুর করা হয়। এনায়েত বাজার, কে সি দে রোড, ব্ৰিকফিল্ড রোডের হিন্দুদের দোকান ও বাড়ি লুট করে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কৈবল্যধাম মালী পাড়ায় আটত্রিশটি বাড়ি, সদরঘাট জেলেপাড়ায় একশর ওপর বাড়ি লুট হয়েছে, আগুন ধরানো হয়েছে। ঈদগাঁও আগ্রাবাদ জেলেপাড়া আর বহদ্দারহাটে ম্যানেজার কলোনিতে লুটপাট করে, ভেঙেও ফেলে। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে মীরেরসরাই আর সীতাকুণ্ডে। মীরেরসরাই-এর সাতবাড়িয়া গ্রামে পঁচাত্তরটি পরিবার, মসদিয়া ইউনিয়নে দশটি পরিবার, হাদিনগরে চারটি পরিবার, বেশরতে ষোলটি পরিবার, তিনটি মন্দির, ওদেয়পুরে বিশটি পরিবার, খাজুরিয়ায় বারোটি পরিবার, জাফরাবাদে সােতাশিটি পরিবারে হামলা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর লুটপাট, ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নে একটি পরিবার, বারুইয়ার ঢালা ইউনিয়নের মহালঙ্কা গ্রামে তেইশটি পরিবার, বহরপুরে আশিটি পরিবার, বারইপাড়ায় তিনশ চল্লিশটি পরিবার, নারায়ণ মন্দির, বাঁশবাড়িয়ায় বারোটি পরিবার, বাড়বকুণ্ডে সতেরোটি পরিবার, দুটো মন্দির, ফরহাদপুরে চৌদ্দটি পরিবারে হামলা হয়েছে, লুট করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

–আর কত শুনব দিলীপদা, ভাল লাগছে না।

–তুমি কি অসুস্থ সুরঞ্জন? কণ্ঠস্বর কেমন যেন লাগছে।

–ঠিক বুঝতে পারছিনা।

ফোন ছাড়তেই পুলক বলে দেবব্রতর খবর নাও তো। সুরঞ্জন দেবব্রত, মহাদেব ভট্টাচাৰ্য, অসিত পাল, সজল ধর, মাধবী ঘোষ, কুন্তলা চৌধুরী, সরল দে, রবীন্দ্র গুপ্ত, নিখিল সানাল, নির্মল সেনগুপ্ত-কে এক এক করে ফোন করে। জানতে চায় ‘ভাল আছেন কি না।‘ অনেকদিন পর পরিচিত অনেকের সঙ্গে কথা হয়। এক ধরনের আত্মীয়তাও অনুভূত হয়।

ক্রিং ক্রিং বেজে ওঠে ফোনটি। সুরঞ্জনের কানের কাছে ক্রিংক্রিং শব্দটি দ্রিম দ্রিম হয়ে বাজে। তার অস্বস্তি হয়। পুলকের ফোন। কক্সবাজার থেকে। ফোনে কথা সেরে পুলক বলে–কক্সবাজারে জামাত শিবিরের লোকেরা জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দিয়েছে।

সুরঞ্জন শোনে এবং নিজের নিলিপ্তি দেখে সে নিজেই অবাক হয়। এই খবর শুনে তার ক্ষোভে ফেটে পড়বার কথা। আজ মনে হচ্ছে এই পতাকা পুড়ে গেলে তার কিছু যায় আসে না। এই পতাকা তার নয়। সুরঞ্জনের এমন হচ্ছে কেন? এমন হচ্ছে বলে সে নিজেকে ধিক্কার দেয়, নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হয়, বড় নীচ, বড় স্বার্থপর, তবু তার নির্লিপ্তি কাটে না। পতাকা পুড়েছে বলে তার ভেতর যে ক্রোধ হওয়া উচিত ছিল, তার কিছুই হয় না।

পুলক সুরঞ্জনের কাছে এসে বসে। বলে—আজ আর যেও না। এখানেই থেকে যাও। বাইরে বেরোলে কখন কী বিপদ ঘটে বলা যায় না। এ সময় আমাদের কারও রাস্তায় বেরোনোটা ঠিক নয়।

গতকাল লুৎফর তাকে এ ধরনের একটি উপদেশ দিয়েছিল। সুরঞ্জন অনুভব করে পুলকের কণ্ঠের আন্তরিকতা আর লুৎফরের কণ্ঠের সূক্ষ্ম অহঙ্কার বা ঔদ্ধত্য।

নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—দেশে বোধহয় আর থাকতে পারব না। আজ হয়ত কিছু হচ্ছে না, কাল হবে, পরশু হবে। কী ভীষণ অনিশ্চিত জীবন আমাদের। এর চেয়ে নিশ্চিত নিরাপদ দরিদ্র জীবন অনেক ভাল।

পুলকের প্রস্তাবে সুরঞ্জন রাজি প্রায় হয়েই যেত, কিন্তু সুধাময় এবং কিরণময়ীর কথা মনে পড়ায়, ওঁরা দুশ্চিন্তা করবেন ভেবে সুরঞ্জন উঠে যায়। বলে—যা হয় হবে। মুসলমানের হাতে না হয় শহীদ হলাম। কেওয়ারিশ লাশ পড়ে থাকবে জাতীয় ফুল শাপলার নীচে। লোকে বলবে ও কিছু না অ্যাকসিডেন্ট। কী বল? সুরঞ্জন হোসে ওঠে। পুলক আর নীলার মুখে হাসি খেলে না।

রাস্তায় নেমে একটি ক্লিক্সা পেয়ে যায় সুরঞ্জন, মাত্র আটটা বাজে, তার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। পুলক তার কলেজ জীবনের বন্ধু। বিয়ে করে চমৎকার সংসার সাজিয়েছে, তারই হল না কিছু বয়স তো অনেক হল, রত্না নামের এক মেয়ের সঙ্গে মাস দুই হল পরিচয় হয়েছে। সুরঞ্জনের হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে হয় বিয়ে করে সংসারী হতে। পারভিনের বিয়ে হয়ে যাবার পর সে তো ভেবেইছিল সন্ন্যাসব্যাপনের কথা। তবু রত্না কেমন যেন এলোমেলো করে দিল তার ছন্নছাড়া জীবন। এখন বড় গুছিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে, এখন স্থির হতে ইচ্ছে করে কোথাও। রত্নাকে অবশ্য এখনও বলা হয়নি ‘তোমাকে এই যে এত ভাল লাগছে আমার, তুমি বোঝা সে কথা?’

রত্নার সঙ্গে প্রথম আলাপের কয়েকদিন পর রত্না বলেছিল–এখন করছেন কি?

—কিছু না। সুরঞ্জন ঠোঁট উল্টে বলেছিল।

—চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্য কিছু না?

–না।

–রাজনীতি করতেন, সেটা?

–ছেড়েছি।

—খুব ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন জানতাম।

–ওসব আর ভাল লাগে না।

–কি ভাল লাগে?

–ঘুরে বেড়াতে। মানুষ দেখতে।

–গাছপালা, নদী উদী দেখতে ভাল লাগে না?

—লাগে। তবে সবচেয়ে ভাল লাগে মানুষ। মানুষের ভেতর যে রহস্যময়তা আছে তার জট খুলতে আমার ভাল লাগে।

–কবিতা-টবিতা লেখেন নাকি?

—আরে না। তবে প্রচুর কবি বন্ধু আছে।

—মদ-টদ খান?

–মাঝে মধ্যে।

—সিগারেট তো বেশ ফোঁকেন।

–হ্যাঁ, তা ফুঁকি। পয়সা-টয়সা তেমন পাই না।

—সিগারেট ইজ ইনজুরিয়াস টু হেলথ, তা জানেন তো?

—জানি। করার কিছু নেই।

—বিয়ে করেননি কেন?

—কেউ পছন্দ করেনি তাই।

–কেউ না?

—একজন করেছিল। সে রিস্ক নেয়নি আলটিমেটালি।

–কেন?

—সে মুসলমান ছিল, আর আমাকে তো বলা হয় হিন্দু। হিন্দুর সঙ্গে বিয়ে, ওকে তো আর হিন্দু হতে হত না। আমাকেই আবদুস সাকের নাম-টাম রাখতে হত।

রত্না হেসেছিল শুনে। বলেছিল–বিয়ে না করাই ভাল, ক’দিনের মাত্র জীবন। বন্ধনহীন কাটিয়ে দেওয়াই তো ভাল।

—তাই বুঝি আপনিও ওপথ মাড়াচ্ছেন না।

—ঠিক তাই।

—ঐ অবশ্য একদিক থেকে ভালই।

—ঐকই সিদ্ধান্ত হলে আপনার আমার বন্ধুত্ব জামবে ভাল।

—বন্ধুত্বের খুব বড় অর্থকরি আমি। দু-একটা সিদ্ধান্ত মিললেই বন্ধু হওয়া যায় নাকি!

—আপনার বন্ধু হতে গেলে বুঝি খুব সাধনা করতে হবে?

সূরঞ্জন জোরে হেসে উঠে বলেছিল—আমার কি এত সৌভাগ্য হবে নাকি?

–আত্মবিশ্বাস খুব কম বুঝি আপনার?

–না সে কথা না। নিজেকে বিশ্বাস আছে। অন্যকে বিশ্বাস নেই।

—আমাকে বিশ্বাস করে দেখুন তো।

সূরঞ্জনের সেদিন সারাদিন মন ভাল ছিল। আজ আবার রত্নার কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে তার, সম্ভবত মন ভাল করবার জন্য। ইদানীং সে তাই করে, কিছুতে মন খারাপ হলে রত্নাকে স্মরণ করে। রত্না আছে কেমন? একবার যাবে নাকি আজিমপুরে। গিয়ে জিজ্ঞেস করবে–কেমন আছেন রত্না মিত্ৰ?’ প্রত্না কি সামান্য অপ্রস্তুত হবে তাকে দেখে? সুরঞ্জন স্থির করতে পারে না তার কি করা উচিত। সাম্প্রদায়িক সম্রাসের কারণে এক ধরনের হিন্দু পুনর্মিলনী হচ্ছে, তা সে অনুমান করে। আর রত্না নিশ্চয় অবাক হবে না, ভাববে। এ সময় হিন্দুরা হিন্দুদের খোঁজ নিচ্ছে, দুঃসময়ে যখন পাশেই দাঁড়াচ্ছে সবাই, তখন, হঠাৎ, কোনও নিমন্ত্রণ ছাড়াই সুরঞ্জন নিশ্চয়ই দাঁড়াতে পারে রত্নার সামনে।

রিক্সাকে আজিমপুরের দিকে ঘুরতে বলে সে। রত্না তেমন লম্বা নয়, সুরঞ্জনের কাঁধের নীচে পড়ে, ফসর্ণ গোল মুখ, কিন্তু ওর চোখে কী যে অতল বিষন্নতা, সুরঞ্জন থাই পায় না। সে বুক পকেট থেকে টেলিফোন ইনডেক্সে লিখে রাখা ঠিকানাটি বের করে বাড়িটি খোঁজে। চাইলে খুঁজে পাবে না এমন কী হয়!

রত্না বাড়িতে নেই। দরজা সামান্য ফাঁক করে বুড়োমত এক লোক বললেন–আপনার নাম কি?

—সুরঞ্জন।

—ও তো ঢাকার বাইরে গেছে।

—কবে? কোথায়? সুরঞ্জন নিজেই তার কণ্ঠস্বরে আবেগ বা আকুলতা টের পেয়ে সামান্য লজা পায়।

—সিলেট।

–কবে ফিরবে জানেন কিছু?

—না।

সিলেটে কি অফিসের কাজে গেছে রত্না নাকি বেড়াতে, নাকি পালিয়েছে? নাকি আদৌ সিলেট যায়নি, বলা হচ্ছে সিলেট। কিন্তু সুরঞ্জন নাম শুনে, যেহেতু এটি ‘হিন্দু নাম’, লুকোবার তো কিছু নেই—এরকম ভাবতে ভাবতে সুরঞ্জন আজিমপুরের রাস্তায় হাঁটতে থাকে। এখানে কেউ তাকে হিন্দু বলে চিনতে পারছে না। টুপি মাথার পথচারী, গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তপ্ত যুবকেরা, রাস্তার টোকাই কিশোরেরা কেউ যে তাকে চিনতে পারছে না। এ বেশ মজার ব্যাপার বটে। যদি ওরা চিনতে পারে, যদি ওদের ইচ্ছে করে চ্যাংদোলা করে কবরস্থানে ফেলে আসবে তাকে, সুরঞ্জনের কি একার শক্তি হবে নিজেকে বাঁচায়! তার বুকের ভেতর ঢিপিটিপ শব্দটি আবার শুরু হয়। হাঁটতে হাঁটতে দেখে সে ঘািমছে। পরনে কোনও গরম জামা নেই তার, পাতলা একটি শার্ট, শার্টের ভেতর সূচের মত হাওয়া ঢুকছে, অথচ তার কপালে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাঁটতে হাঁটতে পলাশি পৌঁছে যায় সুরঞ্জন। পলাশি যখন এসেছেই, একবার নির্মলেন্দু গুণের খবর নেওয়া যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির ফোর্থ ক্লাস এমপ্লয়িদের জন্য কলোনি আছে পলাশিতে। কলোনির মালির ঘরটি ভাড়া নিয়ে থাকেন নির্মলেন্দু গুণ। সত্যভাষী এই মানুষটির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা সুরঞ্জনের। দরজায় টোকা পড়লেই পাল্লা হাট করে খুলে দেয় দশ-বারো বছরের একটি মেয়ে। নির্মলেন্দু গুণ বিছানায় পা তুলে বসে মন দিয়ে টেলিভিশন দেখছিলেন। সুরঞ্জনকে দেখেই সুর করে বলে উঠলেন—‘এস এস এস আমার ঘরে এস, আমার ঘরে…।‘

—টিভিতে দেখার কি আছে?

—বিজ্ঞাপন দেখি। সানলাইট ব্যাটারি, জিয়া সিল্ক শাড়ি, পেপসি জেল টুথপেস্ট-এর বিজ্ঞাপন। হামদ নাত দেখি। কোরানের বাণী দেখি।

সুরঞ্জন হেসে ওঠে। বলে—সারাদিন এই করেই কাটে আপনার? বাইরে বের-টের হননি নিশ্চয়?

—আমার বাড়িতে চার বছরের এক মুসলমান ছেলে থাকে। ওর ভরসায় তো বেঁচে আছি। কাল অসীমের বাড়ি গেলাম, ও আগে আগে গেল, আমি পেছন পেছন।

সুরঞ্জন হেসে ওঠে আবার। বলে—এই যে না দেখে দরজা খুলে দিলেন। যদি অন্য কেউ হত?

গুণ হেসে বলেন–কাল রাত দুটোর সময় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কিছু ছেলে মিছিল করবার প্ল্যান করছিল, হিন্দুদের গাল দিয়ে কী কী শ্লোগান দেওয়া যায়, আলোচনা চলছিল। হঠাৎ হাঁক দিলাম, ‘কে ওখানে, গেলি?’ ওরা সরে গেল। আর আমার চুল দাড়ি দেখে অনেকে তো ভাবে আমি মুসলমান, মৌলভি।

—কবিতা লেখেন না?

—না। ওসব লিখে কি হবে। ছেড়ে দিয়েছি।

–রাতে নাকি আজিমপুর বাজারে জুয়ো খেলেন?

–হ্যাঁ। সময় কাটাই। তবে ক’দিন তো যাচ্ছি না।

–কেন?

–বিছানা থেকেই নামি না, ভয়ে। মনে হয় নামলেই বুঝি ওরা ধরে ফেলবে।

—টিভিতে কিছু বলছে, মন্দির ভাঙা-টাঙা কিছু দেখাচ্ছে?

—আরে না। টিভি দেখলে মনে হবে এ দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ দেশে দাঙ্গা-টাঙ্গা কিছু ঘটছে না। যা কিছু ঘটছে ভারতে।

—সেদিন একজন বলল, ভারতে এ পর্যন্ত চার হাজার দাঙ্গা হয়েছে। তবু তো ভারতের মুসলমান দেশ ত্যাগ করছে না। কিন্তু এখানকার হিন্দুদের এক পা থাকে বাংলাদেশে, আরেক পা ভারতে। অৰ্থাৎ ভারতের মুসলমানরা লড়াই করছে, আর বাংলাদেশের হিন্দুরা পালাচ্ছে।

গুণ গভীর হয়ে বলেন-ওখানকার মুসলমানরা লড়াই করতেই পারে। ভারত সেকুলার রাষ্ট্র। আর এখানে ফান্ডামেন্টালিস্টরা ক্ষমতায়। এখানে আবার লড়াই কিসের। এখানে হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের কি লড়াই করবার জোর থাকে?

—এসব নিয়ে কিছু লেখেন না কেন?

—লিখতে তো ইচ্ছে করেই। লিখলে আবার ভারতের দালাল বলে গাল দেবে। কত কিছু লিখতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করেই লিখি না। কী হবে লিখে!

গুণ বোধহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন টেলিভিশন নামের খেলনা বাক্সটির দিকে। গীতা চা রেখে যায় টেবিলে। সুরঞ্জনের খেতে ইচ্ছে করে না। গুণদার ভেতরের যন্ত্রণা তাকেও স্পর্শ করে।

হঠাৎ হেসে ওঠেন গুণ, বলেন—তুমি যে অন্যের খোঁজ-খবর নিচ্ছ, তোমার নিজের নিরাপত্তা আছে তো?

—আচ্ছা গুণদা, জুয়ো খেলে কি জেতেন কখনও?

  • না।
  • –তাহলে খেলেন কেন?

—না খেললে ওরা মা বাপ তুলে গাল দেয়, তাই খেলতে হয়।

শুনে হো হো করে হেসে ওঠে সুরঞ্জন। গুণও হাসেন। চমৎকার রসিকতা জানেন মানুষটি। আমেরিকার লাস ভেগাসের ক্যাসিনোয় বসে তিনি জুয়ো খেলতে পারেন, আবার পলাশির বস্তিতে বসে মশার কামড়ও খেতে পারেন। কিছুতে আপত্তি নেই, বিরক্তি নেই তাঁর। বারো বাই বারো ফুটের একটি ঘরে দিব্যি তিনি তুচ্ছ আমোদ আহ্রদে কাটিয়ে দিচ্ছেন। এত অমল আনন্দে তিনি ভেসে থাকেন কী করে, সুরঞ্জন ভাবে। আসলেই কি আনন্দ নাকি বুকের ভেতরে তিনিও গোপনে গোপনে দুঃখ পোষেন। কিছুই করবার নেই বলে হেসে পার করেন দুঃসহ সময়।

সুরঞ্জন উঠে পড়ে। তার নিজের ভেতরেও দুঃখবোধটা বেড়ে উঠছে। দুঃখ কি সংক্রামক কিছু? সে হেঁটে হেঁটে টিকাটুলির দিকে যেতে থাকে। রিক্সা নেবে না। পাঁচটি টাকা আছে পকেটে। পলাশির মোড় থেকে সিগারেট কেনে। বাংলা ফাইভ চাইলে দোকানিটি সুরঞ্জনের মুখের দিকে অবাক তাকায়। ওর তোকানো দেখে বুকের মধ্যে সেই টিপচিপ শব্দটি হয়। লোকটি কি টের পাচ্ছে সে হিন্দু ছেলে, লোকটি কি জানে ব্যবরি মসজিদ ভেঙেছে বলে ঐখন যে কোনও হিন্দুকেই ইচ্ছে করলে পেটানো যায়? সিগারেট কিনে দ্রুত্ব সরে যায় সুরঞ্জন। তার এমন হচ্ছে কেন? সে সিগারেটটি দোকানে না ধরিয়েই চলে এসেছে। আগুন চাইতে গেলে যদি বুঝে ফেলে সে হিন্দু? হিন্দু মুসলমান পরিচয় তো আর গায়ে লেখা থাকে না। তবু তার সন্দেহ হয় তার হাঁটায়, ভাষায়, চোখের চাহনিতেও বোধহয় ধরে ফেলবার কিছু আছে। টিকাটুলির মোড়ে আসতেই একটি কুকুর ঘেউ করে ওঠে। চমকে ওঠে। সে। হঠাৎ পেছনে শোনো একপাল ছেলের ‘ধর ধর’ আওয়াজ। শুনে সে আর পেছন ফেরে না। উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োয়। গা ঘামতে থাকে  তার। শার্টের বোতাম খুলে যায়, তবু  দৌড় দৌড়। অনেকদূর দৌড়ে এসে সে পেছনে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। তবে কি সে মিছিমিছি দৌড়োলো। শব্দটি তার উদ্দেশ্যে ছিল না? নাকি এ তার অডিটরি হ্যালুশিনেশন!

রাত বেশি হয়ে গেলে, সুরঞ্জন সদর দরজায় ডাকাডাকি না করে বাইরে থেকে অলা দিয়ে যাওয়া নিজের ঘরটিতে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই পাশের ঘর থেকে ভগবান ভগবান বলে করুণ একটি ক্ৰন্দন শোনে সুরঞ্জন। বাড়িতে কোনও হিন্দু অতিথি বা আল্পীয় এসেছে কিনা একবার ভাবে সে। হতেও পারে। এরকম ভেবেই সে যখন সুধাময়ের ঘরে ঢুকতে যাবে, দেখে সে অবাক হয়, কিরণময়ী ঘরের কোণে একটি জলচৌকিতে মাটির এক মূর্তি নিয়ে বসেছেন। মূর্তিটির ব্ল্যামনে গলায় আঁচল পেঁচিয়ে উবু হয়ে ‘ভগবান ভগৱােন বলে ৰুদ্রিছেন। এরকম দৃশ্য এই বাড়িতে দেখা যায় না। অদ্ভুত অচেনা একটি দৃশ্য সুরঞ্জনকে এত স্তম্ভিত করে, সে কিছুক্ষণ বুঝে পায় না তার কী করা উচিত। সে কি মুর্তিটিকে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলবে, নাকি কিরণময়ীকে নতমস্তক সে নিজে হাতে টেনে সরিয়ে আনবে। নতমস্তক দেখিলে তার গা ঘিনঘিন করে।

কাছে এসে কিরুণাময়ীর দু বাহু ধরে দাঁড় করায়। বলে–হয়েছে কি তোমার। মূর্তি নিয়ে বসেছ কেন? মূর্তি তোমাকে বাঁচাবে?

কিরুণাময়ী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। বলেন—তোর বাবার হাত পা অবশ হয়ে গেছে। কথা জড়িয়ে আসছে।

সঙ্গে সঙ্গে সুধাময়ের দিকে চোখ পড়ে তার। শুয়ে আছেন। বিড়বিড় করে কথা বলছেন। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না। কী বলছেন। বাবার গা ঘেঁষে বসে সে ডান হাতটি নগ্নড়ে, হাতে কোনও চেতন নেই, শক্তি নেই। বুকের ঝোপে কুড়োলের কোপ পড়ে সুরঞ্জনের। তার ঠাকুরুদ্রার ঠিক এরকম শরীরের একদিক অবশ হয়ে গিয়েছিল, ডাক্তার বলেছিলেন-ষ্ট্রেক! মুড়ির মত ওষুধ খেতে হত শুয়ে শুয়ে। আর ফ্রিািজওথেরাপিস্ট এসে হাত পায়ের এক্সক্লসাইজ কন্নতেন। বোঝা চোখে একবার কিরণময়ীর দিকে একবার সূরঞ্জনের দিকে তাকান সুধাময়।

আত্মীয়স্বজনও ধারে কাছে কেউ নেই। কার কাছে যাবে সে? ঘনিষ্ঠ কোনও আত্মীয়াই অবশ্য নেই তাদের। এক এক করে সবাই দেশ ছেড়েছে। খুব একা, অসচ্ছল, অসহায় বোধ করে সুরঞ্জন। ছেলে হিসেবে এখন সব দায়িত্ব তার কাঁধেই বর্তাবে। সংসারের অপদাৰ্থ ছেলে সে। আজও তার ঘুরে ঘুরে জীবন কাটে। কোনও চাকরিতে সে স্থায়ী হয়নি। ব্যবসাও করতে চেয়েছিল, সম্ভব হয়নি। সুধাময় অসুস্থ পড়ে থাকলে বাড়ির চুলো বন্ধ হবে, বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হরে সবাইকে।

—কামাল-টামাল কেউ আসেনি? সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে।

—না। কিরণময়ী মাথা নাড়েন।

কেউ একবার খোঁজ নিতে আসেনি। সুরঞ্জন কেমন আছে। অথচ শহরে ঘুরে কতজনের খবৰ নিয়ে এল সে ৷ সকলে ভাল আছে, কেবল সে ছাড়া। এত দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা আর কোনও সংসারে বোধহয় নেই। সুধাময়ের অচেতন হাতটি চেপে ধরে সুরঞ্জনের বড় মায় হয়। এই বিরুদ্ধ-জগতে তিনি কি ইচ্ছে করেই অচল হয়ে গেলেন কিনা কে জানে।

–মায়া ফেরেনি? হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সুরঞ্জন।

–না।

—কোন ফেরেনি সে? আচমকা চিৎকার করে ওঠে সুরঞ্জন। কিরণময়ীও অবাক হন নম্র স্বভাবের ছেলেটি কখনও এমন মাথা গরম করে কথা বলে না। আজ হঠাৎ চেঁসিয়ে কথা বলছে কোন! মায়া যে পাক্রিলের ব্রাড়ি গিয়েছে। এ এমন কোনও অন্যায় ঘটনা নয়, বরং এ অনেকটা নিশ্চিম্ভের। হিন্দু বাড়ি লুট করতে এলে মায়া ছাড়া আর কোনও সম্পদ নেই তো ঘরে। মেয়েদের তো মানুষ সোনাদোনর মত সম্পদই মনে করে।

সুরঞ্জন সারাঘর জুড়ে অস্থির হাঁটে আর বলে–মুসলমানদের এত বিশ্বাস কেন ওর? ক’দিন বাঁচাবে ওরা?

কিরণময়ী বুঝে পান না। সুধাময় অসুস্থ, এখন ডাক্তার ডাকতে হবে। এই মুহুর্তে মায়া কেন মুসলমানের বাড়ি গেল, এ নিয়ে রাগারগি করছে কেন ছেলে?

সুরঞ্জন বিভূবিভু করে-ডাক্তার ডাকতে হবে, চিকিৎসার খরচাটা কোথায় পাবে, শুনি? পাড়ার দুটো-পিচ্চি ছেলে ভয় দেখিয়েছিল, সেই ভয়ে দশ লাখ টাকার বাড়ি দু লাখ টাকায় বিক্রি করে এলে, এখন ভিক্ষুকের মত বাঁচতে লজ্জা করে না।

–কেবল কি ছেলে-ছোকরাদের ভয়ে, বাড়ি নিয়ে মামলার ঝামেলাও তো কম ছিল না। কিরণময়ী উত্তর দেন।

বারান্দায় একটি চেয়ার ছিল, সুরঞ্জন সেটিকে লাথি মেরে সরিয়ে দেয়।

—আর মেয়ে গেছে মুসলমানকে রিয়ে করতে। ভেবেছে মুসলমানরা তাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে। মেয়ে বড়লোক হতে চায়।

বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় সে। পাড়ায় দুজন ডাক্তার আছেন। হরিপদ সরকার টিকাটুলির মোড়ে, আর দু বাড়ি পরে আছেন। আমজাদ হোসেন। কাকে ডাকবে সে? সুরঞ্জিল এলোমেলো হাঁটতে থাকে। মায়া বাড়ি ফেরেনি বলে এই যে কেঁচালো সে, সেকি মায়া ফেরেনি বলে, নাকি মুসলমানদের ওপর মায়ার নির্ভরতা দেখে? সুরঞ্জন কি অল্প অল্প কমুনীল হয়ে উঠছে? নিজেকে সন্দেহ হয় তার। সে হেঁটে টিকাটুলির মোড়ের দিকে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *