‘লজ্জা’ বইটি লিখেছিলাম ২৩ বছর আগে। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কবে থেকে অত্যাচার হচ্ছে, কী করে হচ্ছে, কেন হচ্ছে— লিখেছিলাম। বইটি সরকার নিষিদ্ধ করেছিল, বলেছিল হিন্দুদের ওপর কোনো অত্যাচার হয় না, কিন্তু অত্যাচার হয় দাবি করে যা লিখেছি, তা সম্পূর্ণ মিথ্যে। খালেদা জিয়ার সরকার লজ্জা নিষিদ্ধ করেছিল, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সাধারণত খালেদা যা করেন, তার উল্টোটা করেন, কিন্তু লজ্জা থেকে নিষেধাজ্ঞা তিনি তোলেননি। লজ্জায় কি আমি ভুল কোনো তথ্য দিয়েছি? লজ্জা তথ্যভিত্তিক উপন্যাস। বইটির কোনো একটি তথ্য ভুল, তা আমার কোনো ঘোর শত্রুও কোনোদিন বলেনি।
লজ্জা আজো বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল, কোনো মানবাধিকার সংগঠন, কোনো লেখক সংস্থা, কোনো ব্যক্তি—কেউই এই বইটির ওপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য আদালতে যায়নি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে লেখা এই বইটি কেন একটি ‘নিষিদ্ধ বই’ হিসেবে চিহ্নিত হবে? যারা বইটি নিষিদ্ধ করেছিল ১৯৯৩ সালে, তারা এই সত্যটির সামনে দাঁড়াতে চায়নি যে তারা দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তারা এই সত্যটি শুনতে চায়নি যে তাদের পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল যখন সন্ত্রাসীরা হামলা করেছিল নিরীহ মানুষের ওপর।
‘লজ্জা’য় যেসব লজ্জাজনক ঘটনার কথা লিখেছি, সেসব আজো ঘটছে। আজো হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, মন্দির ভাঙা হয়, আজো হিন্দুরা নিরাপত্তাহীনতায় কুঁকড়ে থাকে নিজ-দেশে, আজো তারা দেশ ত্যাগ করে ভয়ে।
দু’দিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রায় তিনশ’ হিন্দু-বাড়িতে হামলা চালিয়েছে মুসলিম মৌলবাদীরা, শতাধিক হিন্দুকে আহত করেছে। নিরীহ অনেকের যা কিছু সম্বল ছিল নিয়ে গেছে। যে হিন্দুরা মার খেলো, আহত হলো, কী অপরাধ তারা করেছিল? শতাধিক হামলাকারী যখন হিন্দুদের বাড়িঘরের দিকে এগোচ্ছিল, হিন্দুরা আশঙ্কায় কুঁকড়ে ছিল। তারা কী অপরাধ করেছিল? কেন এদেশের মানুষকে তটস্থ থাকতে হবে এদেশেরই মানুষের ভয়ে? শুধু ধর্ম-বিশ্বাসটা ভিন্ন বলে কেন বছরের পর বছর তারা নির্যাতিত হবে? ভিন্ন তো মানুষের রাজনৈতিক বিশ্বাসও, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শৈল্পিক বিশ্বাসও। এই ভিন্নতার কারণে কাউকে তো এত ভুগতে হয় না যত ভুগতে হয় ধর্মের ভিন্নতার কারণে। ধর্ম মানুষকে ভালবাসা না শিখিয়ে তবে কি ঘৃণা শেখায়? এরকম কি কোনো ব্যবস্থা আছে যে ধর্ম যা কিছুই শেখাক, আমরা মানুষকে ভালবাসতে শেখাবো! জগতের সব মানুষের আদর্শ, আকাঙ্ক্ষা, রুচি, স্বপ্ন এক নয়। সমাজের বিভিন্ন মানুষের মনে বিভিন্ন বিশ্বাস। কিন্তু বছর যায়, যুগ যায়, শতাব্দী যায়— তারপরও কেন ধর্ম-বিশ্বাস ভিন্ন হলে মানুষ ঘৃণা করে, ক্ষতি করে, হত্যা করতেও দ্বিধা করে না? মানুষ কি চিরকালই এমন বর্বর? বর্বর হলেও বর্বরতার তো শেষ হয় একদিন। একদিন তো মানুষ সভ্য হয়। কেন সভ্য, শিক্ষিত, সচেতন হতে বাংলাদেশের মানুষের এত দীর্ঘ সময় লাগে!
শুনে খানিকটা আশ্বস্ত হয়েছি যে কিছু হামলাকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরকম আশা করতে ভালো লাগে যে তারা বিনা বিচারে ছাড়া পাবে না।
‘লজ্জা’ বইটি যদি নিষিদ্ধ না হতো, এটি পড়ে বাংলাদেশের অনেক মানুষই গত তেইশ বছরে অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে উঠতে পারতো। বইটি নিষিদ্ধ থাকায় সেই সম্ভাবনাটা নষ্ট হয়েছে। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে হিন্দু মৌলবাদীরা ভারতের বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার পর মুসলিম মৌলবাদীরা যে অত্যাচার চালিয়েছিল বাংলাদেশের নিরীহ হিন্দুদের ওপর, হিন্দুদের বাড়িঘরের ওপর, দোকানপাটের ওপর, সে চোখে-দেখা দৃশ্যই বর্ণনা করেছি ‘লজ্জা’য়। কত নিরপরাধ দরিদ্র মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে, কত সহস্র মানুষ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে- তাদের একটিই অপরাধ, তারা মুসলমান নয়। মানবতার মুখ থুবড়ে এমন পড়ে থাকা দেখে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বর্বর হওয়ার বদলে উদার হতে পারতো, হিন্দুদের শত্রু ভাবার বদলে বন্ধু ভাবতে পারতো, করতে পারতো ঘৃণার বদলে শ্রদ্ধা— যে শ্রদ্ধাটি মানুষের প্রতি মানুষের থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক হওয়া খুব সহজ নয়। বাংলা ওয়াজগুলোয় মোল্লা-মৌলানারা সারাদিন মুসলমানদের উপদেশ দেয় হিন্দুদের ঘৃণা করতে, তাদের মন্দিরের মূর্তি ভেঙে ফেলতে। উপদেশ শুনতে শুনতে খুব অজান্তেই মগজ ধোলাই হয়ে যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কী ঘটেছিল যে মানুষকে হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট করতে হয়েছে, মন্দির ভাঙতে হয়েছে? ঘটনাটি হলো, রসরাজ দাস নামে এক ছেলে তার ফেসবুক একাউন্ট থেকে একটা ফটো শেয়ার করেছে, যে ফটো দেখে মুসলমানের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে। আসলে ওই ফটো নেহাতই ফটোশপ করা ফটো। ফটোশপ করে কাবা শরীফের ছাদের ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে শিবের ছবি। রসরাজের দাবি, ফটোটি সে নিজে পোস্ট করেনি। তার অজান্তে কে বা কারা তার একাউন্ট থেকে পোস্ট করেছে সে জানে না। এজন্য সে সবার কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। রসরাজকে কেউ ক্ষমা করেনি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। রসরাজের ফেসবুক ভরে গেছে খুনের হুমকিতে।
কে রসরাজের আইডি হ্যাক করে ওই ছবি পোস্ট করেছিল তা সরকার চাইলে বের করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার চাইবে কি? রসরাজই বা কবে জেল থেকে মুক্তি পাবে? রসরাজের নিরাপত্তাই বা কে নিশ্চিত করবে? বাবরি মসজিদ ভেঙেছিল ভারতের হিন্দু মৌলবাদীরা। সেই মসজিদ ভাঙার দায়ে বাংলাদেশের নিরীহ হিন্দুদের অপরাধী বানানো হয়েছিল। রসরাজের একাউন্ট থেকে কোনও এক হ্যাকার একটি ফটোশপ করা ছবি পোস্ট করেছে। এ কারণে বাংলাদেশের সব হিন্দুকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হলো। মৌলবাদীরা এখন যে কোনও হিন্দুর ঘর ভেঙে দিতে পারে, যে কোনও মন্দির গুঁড়ো করে দিতে পারে, যে কোনও হিন্দুকে নির্যাতন করতে পারে। যে বা যারা অপরাধ করে, তারা শুধু নয়, তাদের ধর্মীয় গোষ্ঠীর সবাইকে শাস্তি পেতে হবে, এমনই যেন নিয়ম।
কয়েকজন মুসলমান সন্ত্রাসী সন্ত্রাস করলে সকল মুসলমানকে দোষ দেওয়া উচিত নয়— এ কথা বিশ্বের প্রায় সবাই বলে, এ কথা তারাও বলে যারা বলে একজন বা কয়েকজন হিন্দু দোষ করলে তার দায় সব হিন্দুকেই নিতে হবে।
ছাতকে, হবিগঞ্জে, গোপালগঞ্জের মন্দিরেও আক্রমণ হয়েছে। এই বৈষম্য দেখেই আমরা বড় হয়েছি, আমাদের নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে। বাংলাদেশের হিন্দুর সংখ্যা দ্রুত কমছে। কট্টরপন্থিরা এ সংখ্যাটি সম্ভবত শূন্য না বানিয়ে ছাড়বে না। দেশে হিন্দু থাকবে না, শিয়া থাকবে না, আহমদীয়া থাকবে না, বৌদ্ধ থাকবে না, খ্রিস্টান থাকবে না, শুধু সুন্নি মুসলমান থাকবে। সুন্নি মুসলমানদের মধ্যেও বাছাই করা হয়। যারা ধর্মান্ধ নয়, তারা থাকবে না। যারা কোনও প্রশ্ন করবে তাদের জেলে ভরা হবে, মেরে ফেলা হবে অথবা দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। গণতন্ত্র বলে কিছু থাকবে না, নারীর অধিকার থাকবে না, মানুষের মত প্রকাশের অধিকার থাকবে না। আমরা নিশ্চিতই এমন একটি ঘোর অন্ধকার সময়ের দিকে যাচ্ছি।
যেদেশে মুক্তচিন্তকের, যুক্তিবাদীদের স্থান নেই, যেদেশে নারীবাদীদের লাঞ্ছিত হতে হয়, যে দেশ নারী-বিদ্বেষী অজ্ঞ অশিক্ষিত লোকদের দখলে চলে গেছে, সেদেশে রসরাজ দাস ফটোশপের ছবি পোস্ট করলেও মার খাবে, না করলেও মার খাবে। কারণ সে রসরাজ দাস। রসরাজ দাসকে যদি মুক্তি না দেওয়া হয়, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা হয়, যদি হামলাকারীদের সবাইকে শাস্তি না দেয়া হয়, তবে আরও মানুষকে শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধে এভাবে নির্যাতিত হতে হবে। হামলাকারীরা উৎসাহ পেতে থাকবে, তাদের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকবে।
মানুষ মানুষকে মারছে। এসব দেখে এখন আর দুঃখ কষ্ট হয় না, এখন আর রাগও হয় না, এখন আশঙ্কা হয় এই বর্বর মানুষজাতিকে বোধ হয় একদিন বিলুপ্ত করবে ধর্মান্ধতা।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৩ নভেম্বর, ২০১৬