লজ্জাস্থান
না দাদা, যাব না বললে তো হবে না। সকলেই যাচ্ছেন। আপনাকেও যেতে হবে।
আপনাদের মাথাটাথা খারাপ হয়েছে? গল্প শুনতে ডিসেম্বরের শীতের রাতে কে আসবে জলপাইগুড়ি শহরে? জলপাইগুড়িতে আজ থেকে যাচ্ছি না। প্রথমবার গেছি উনিশ-শো পঞ্চাশে যখন ক্লাস এইটে পড়ি।
তা যেতে পারেন। কিন্তু আমরা বলছি যে, আপনি অবাক হয়ে যাবেন দাদা দেখে যে, কত অনুরাগী আছেন আপনাদের সেখানে।
জানি না। তা ছাড়া সকলে যাচ্ছেন মানেটা কী? কে কে যাচ্ছেন? আমি তো সভাসমিতি কোথাওই যাই না। তার ওপরে দলে-বলে তো যাই-ই না।
দাদা, এ তো আর যাত্রাপার্টি নয়! আমরা জলপাইগুড়ি শহরকে একেবারে তাক লাগিয়ে দেব। সাহিত্যিকের মেলা বসবে সেখানে। মিলন-মেলা।
তার মানে? ‘কিশোরকুমার নাইট’ করার মতো?
তা না, তা না। সাহিত্যজগতের এতজন নামি নক্ষত্রকে একইসঙ্গে জলপাইগুড়িতে কখনো পাঠক-পাঠিকারা দেখেননি। তা ছাড়া আসল কথাটাই বলা হয়নি। এই গল্পপাঠের আসরের প্রধান উদ্যোক্তা এমন একজন নামি সাহিত্যিক যিনি জলপাইগুড়িরই মানুষ।
কে?
অবাক হয়ে বললাম আমি।
তাই যদি হবে তো তিনিই তো একটা ফোন করতে পারতেন আমাকে।
করবেন, তিনি করবেন। আমাদের কথাতে চিঁড়ে না ভিজলে উনি দই দিয়ে ভেজাবার বন্দোবস্ত করবেন। অবশ্যই করবেন ফোন।
দই মানে? টাকাপয়সা? টাকাপয়সা নিয়ে কোনো সভা-সমিতিতে যাইনি। আজপর্যন্ত যাইনি। ভবিষ্যতের কথা বলতে পারি না। প্রয়োজনে সবই করতে হয় মানুষকে। হয়তো আমাকেও হবে।
না, না দাদা, আমরা ওসব কথা জানি। কে কী দিলে যান। কার কত রেট। কিন্তু আগে আপনি একটু ধৈর্য ধরে সবটা শুনুন। আপনি বড়োই অধৈর্য।
আমি তো আর বড়ো খবরের কাগজের অফিসে কাজ করি না যে, কোনো কাজ করি আর নাই করি নাম-মাহাত্ম্যেই বসে বসে মাস গেলে মোটা খাম পাব একটা। আমাকে খেটে খেতে হয় ভাই। এখুনি বেরোতে হবে যে। আগে ফোন করে এলেন না কেন? আগে না জানিয়ে এলে যে সময় দেওয়া মুশকিল। সত্যিই মুশকিল।
জানি, আপনার সময় কম। তাই শর্টে বলছি। তা ছাড়া আরও দু-একজন খেটে-খাওয়া সাহিত্যিক যাচ্ছেন আপনি ছাড়াও। এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা হলেন সমরেশ মজুমদার। জলপাইগুড়ির গর্ব। তিনিও কাগুজে-সাহিত্যিক নন।
আরে মশাই কাগুজে-সাহিত্যিক বা কাগুজে-বাঘ বা কাগজের বউ এসব কথার মানে অন্য। অমন কারোকে বলবেন না।
সরি দাদা। মাফ করে দেবেন।
সমরেশ! তা সমরেশই তো ফোন করলে পারত।
করবেন দাদা, করবেন। পুরোটা শুনে নিন। কে কে ইতিমধ্যেই কনসেন্ট দিয়েছেন তাঁদের নামগুলো একবার শুনুন।
বলুন।
সমরেশদা, মানে সমরেশ বসু, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র, বিমল দেব আর সমরেশদা, মানে, ছোটো সমরেশদা অর্থাৎ, মজুমদার। তিনি তো যাচ্ছেনই! এখন সুনীলদা আর আপনি ‘হ্যাঁ’ করলেই ষোলোকলা পূর্ণ হয়। কোনো কষ্ট দেব না দাদা। প্লেনে করে নিয়ে যাব। প্লেনেই ফিরিয়ে দেব। জলপাইগুড়িতে ফার্স্টক্লাস গেস্টহাউসে রাখব। খাওয়া-দাওয়ার কোনোই অসুবিধে হবে না। প্রত্যেককেআলাদা আলাদা ঘর দেব। দোতলা গেস্ট হাউস। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। দেখার মতো। কেয়ারি করা ফুলের বাগান। সামনে-পেছনে। শুধু একটাই কষ্ট হতে পারে।
সেটা কী?
মশা। সেটার ওপরে সাহিত্যানুরাগীদের কোনো ডাইরেক্ট কন্ট্রোল তো নেই। মানে, সাহিত্যিকদেরও কোনো প্রভাব নেই মশার ওপরে। থাকলে, সে বন্দোবস্তও করা যেত। বিধানবাবু মশা নির্মূল করে গেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে। জ্যোতিবাবুরা রোশন-চৌকি বসিয়ে তাদের মহাসমারোহে ফিরিয়ে এনেছেন বরযাত্রীদের মতো। আমাদের কিছুই করণীয় নেই দাদা। মশাটা সহ্য করে নিতে হবে।
আর একজন বললেন, দমদম থেকে সকালের প্লেনে স্ট্রেইট বাগডোগরাতে গিয়ে নামবেন। সেখান থেকে প্রাইভেট কার-এ জলপাইগুড়ি। সেদিনই রাতে আপনাদের গল্পপাঠ, রবীন্দ্রভবনে। পরদিন সারাটা দিনই রেস্ট। ভক্ত পাঠক-পাঠিকারা হয়তো মাঝেমধ্যে আলাপ করতে বা সই নিতে গেস্ট হাউসে আসতে পারেন।
তার পর? তার পর সন্ধেবেলা আবারও গল্পপাঠের আসর। এত মানুষ আপনাদের দেখতে, নিজেদের গলাতে নিজেদের গল্পপাঠ শুনতে আগ্রহী যে তাদের সকলকে তো একদিনে অ্যাকোমোডেট করতে পারা যাবে না। দ্বিতীয় রাতের অনুষ্ঠানের পরেই সোজা নিয়ে যাব আপনাদের সকলকে চা-বাগানে। দু-দিন চা-বাগানে থেকে, রেস্ট করে বেড়িয়ে-টেড়িয়ে তার পরদিন ভোরে রওয়ানা হয়ে স্ট্রেইট আবার বাগডোগরাতে এসে প্লেন ধরে বিকেলেই কলকাতা।
সুনীলবাবু রাজি হয়েছেন যেতে?
হননি। তবে হয়ে যাবেন। হননি মানে, উনি কলকাতার বাইরে গেছেন। কোনো আত্মীয়র বিয়ে-টিয়ে উপলক্ষে। ফিরলেই ছোটো সমরেশদা ওঁকে গিয়ে ক্যাঁক করে ধরবেন। এবং রাজি করাবেন। সে ভার ওঁরই।
ভার নিয়ে থাকলে অবশ্যই পারবে সমরেশ। সে উদ্যোগী পুরুষ, অশেষ করিতকর্মা। মনোজ মিত্র, বিমল দেব ওঁরাও কি গল্পই পড়বেন?
না, না তা কেন? ওঁরা ‘স্ক্রিপ্ট’ পড়বেন। মানে, করবেন। নইলে এত জনের লাগাতার গল্পপাঠ। পাবলিক একটু বোরড হয়ে যেতে পারে। রিলিফ হবে একটু।
আমাদের এতজনকে ওখানে না নিয়ে গিয়ে জলপাইগুড়ির সকলকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে এলেই তো পারতেন।
হা:। কী যে বলেন বুদ্ধুদা!
আমার এক বন্ধুর মা আমাকে ‘বুদ্ধু’ বলে ডাকতেন। আর এই দ্বিতীয়জনকে দেখলাম বুদ্ধু বলে ডাকতে। বলা বাহুল্য, মোটেই খুশি হলাম না।
ওঁদের মধ্যে একজন বললেন, একটা কথা বলব দাদা?
কী? বলুন। তাড়াতাড়ি বলুন।
কোনো চিন্তা করবেন না। সন্ধেবেলাতে আপনাদের শরীর মেরামতির বন্দোবস্তও থাকবে। আমাদের আলাদা বাজেট থাকবে শরীর মেরামতি খাতে।
শরীর মেরামতি মানে? সেটা কী ব্যাপার?
সে কী দাদা? জানেন না? আগেকার দিনে যজ্ঞিবাড়ির ঠাকুরেরা যে লম্বা ফর্দ বানাত মশলাপাতির শেষ আইটেম থাকত—‘শরীর মেরামতি খাতে’—দুই টাকা। পাঁচটাকা, দশটাকা, দিন বুঝে, ঝক্কি বুঝে। অর্থাৎ কিনা ‘অহিফেন’। মানে বুঝলেন তো? আফিং।
আমাদের আফিং খাওয়াবেন নাকি?
তা কেন? যিনি যা-খাবেন অবারিত দ্বার স্যার আমাদের। মানে, যাঁদের শরীর আছে এবং সেই শরীরের মেরামতির দরকার আছে, তাঁদের জন্যে। জোর করে কি আর খাওয়াব? তবে সেটা সন্ধেবেলাতে নয়, হবে অনুষ্ঠানের পরেই। অনুষ্ঠানের আগে করাটা ঠিক হবে না। অধিকাংশই তো পাঠিকা। কেউ কিছু মনে করতে পারেন। আমাদের ওখানে প্রচুর গন্ধগোকুল আছে দাদা। হাওয়াতে গন্ধ পাবেন। এবং তা করলে আপনাদেরই বদনাম হবে। নামি লোকদের নিয়ে গিয়ে বদনাম করিয়ে দেব অমন কাজ আমাদের দ্বারা হবে না। শরীর মেরামত অবশ্যই হবে, তবে রাখ-ঢাক করে।
আমার শরীর এমনিতেই মজবুতই আছে। কোনোরকম মেরামতিরই দরকার নেই।
তবুও দাদা। আমাদের কর্তব্য সব কথা খুলে বলা, যাতে বুঝতে কোনো অসুবিধে না হয়।
আচ্ছা। আজকে আমাকে এখুনি বেরোতে হবে। সমরেশ মজুমদারকে বলবেন, দয়া করে যেন আমাকে একটা ফোন করেন।
কোথায় দাদা? অফিসে?
না, বাড়িতে। রাতে।
আপনার বাড়ির ফোন নাম্বার?
ওঁর কাছে আছে।
তাহলে আমরা আশা নিয়ে যাচ্ছি কিন্তু। কথা দিচ্ছেন তো?
কথা এখনও দিচ্ছি না। আমি কোথাওই যেতে পারি না। বহু বছর আগে একবার উত্তর আসামের ডিগবয়তে গেছিলাম। তাও তার আগের বছর আমার স্ত্রী গান গাইতে গেছিলেন সেখানে, তা, মানে, তাঁর কাছ থেকেই জায়গাটার সৌন্দর্য এবং উদ্যোক্তাদের আদর-আপ্যায়নের আন্তরিকতার কথা শুনে রাজি হয়ে গেছিলাম। নইলে—।
আমাদের ওখানেও আদর-আপ্যায়নের কোনোই ত্রুটি হবে না। তবে আপনি তো জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির অতিথি হন। জ্যোতিবাবুর দাদা-বউদিদের। অতখানি আদর-যত্নের প্রত্যাশা আমাদের কাছ থেকে করবেন না।
আপনাকে কে বলল?
আমরা কি জানি না নাকি? জলপাইগুড়ির নবাবকেও তো আপনি চেনেন।
নবাবকে চিনি না। কারা এসব রটান? ওঁদের পরিবারের দু-একজনকে চিনি। পরের প্রজন্মের। একজন নবাবদাদা একবার আমাদের সঙ্গে শিকারে গেছিলেন সুন্দরবনে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কী? আপনারা তো দেখছি গোয়েন্দা লাগিয়েছেন আমার পেছনে!
না মানে, খাতির-যত্নের আদর-আপ্যায়নের যদি কিছু সামান্য খামতি হয় আগে থাকতেই বলে রাখা ভালো দাদা। ক্ষমা-ঘেন্না করে নেবেন দাদা।
সমরেশ রাতে ফোন করল।
দাদা আমার ছেলেরা গেছিল?
হ্যাঁ।
কী বলল?
বলল, শরীর মেরামত করে দেবে।
মানে?
না। মানেটা খারাপ নয়। নতুন একটি শব্দ শেখা হল ওদের কল্যাণে। ভারি ভদ্র এবং বিনয়ী ছেলেরা তোমার।
যাচ্ছ তো? না ডোবাবে?
তোমাকে ডোবাতে পারি? দক্ষিণ বাংলার সুন্দরবনের বাঘ আর উত্তরবাংলার ডুয়ার্সের সমরেশ মজুমদারকে ডোবাবে এমন কে আছে? কার ঘাড়ে ক-টা মাথা?
চলো চলো। তোমার সঙ্গে তো কলকাতাতে দেখাই হয় না। দু-তিনটে দিন খুব আনন্দে কাটবে।
সাধুসঙ্গে?
সাধু না অসাধু জানি না।
আমরা যে দু-দিন জলপাইগুড়িতে থাকব তারই মধ্যে সমরেশদার জন্মদিনও পড়েছে, তোমাকে কিন্তু গল্পপাঠ ছাড়াও গান গাইবার জন্যে ধরতে পারেন ওঁরা। ‘না’ কোরো না যেন। উত্তরবঙ্গে তোমার যে কত ভক্ত আছে নিজে না গেলে বুঝবে না।
তোমার ভক্তদের চেয়েও বেশি? বাজে কথা বোলো না।
বলেই বললাম, আমাকে ছেড়ে, সঞ্জীবকে গাইতে বোলো।
সঞ্জীব গান গায় নাকি?
গায় না? সঞ্জীব বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন। ভালো ছবি আঁকে। ভালো আবৃত্তি করে। শ্রুতি নাটক। ভালো গান গায়। বিশেষ করে পুরাতনি গান। রীতিমতো প্রফেশনাল গায়কের মতো ভালো গায়। নিজেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গায়। আগে কিছু বোলো না। তাহলে ও বেঁকে বসবে। ওখানেই স্টেজে উঠিয়ে তার পরে ওকে পাকড়াও কোরো। হারমোনিয়াম-এর জোগাড় রেখো একটা ব্যাকস্টেজে। আমি বললে যদি নাও গায় তাহলে সুনীলবাবুকে দিয়ে বলিয়ো। সঞ্জীব তো তাঁরই ডিপার্টমেন্টের, মানে ‘দেশ’-এর। সুনীলবাবুর অনুরোধ ফেলতে পারবে না।
এটা ভালো বলেছ দাদা। সাগরদার পরে তো সুনীলই ‘দেশ’-এর সম্পাদক হবে। সুনীলের অনুরোধ সত্যিই ফেলতে পারবে না।
২
ফ্লাইট অনেকই ডিলেড ছিল। উদ্যোক্তরা সমরেশের পরামর্শে এয়ারপোর্টের দোতলার রেস্তরাঁতে আমাদের এবং ছোটো সমরেশেকেও নিয়ে গিয়ে নিজৌষধি সেবন করিয়ে ‘দুঃখু’ ভোলাবার চেষ্টা করলেন। তবে সঞ্জীব এবং শীর্ষেন্দু দুজনেই নিরামিশাষী। ছারপোকা-তেলাপোকা ইত্যাদি বেটে যেসব কালচে-লালচে জলীয় পদার্থ হয় সে-সবও আমিষের মধ্যেই গণ্য বলে ওরা মুখেও দেন না। তা ছাড়া ওসব তো মোটেই সুখাদ্য সুপানীয়র মধ্যে গণ্য নয়। দুজনেই ভোরে উঠে পুজো-আচ্চা করেন। শীর্ষেন্দু শ্রীশ্রী অনুকূল ঠাকুরের ভক্ত। সজীব সম্ভবত বৈষ্ণব। শীর্ষেন্দু নিরামিশাষী তো বটেই পেঁয়াজ পর্যন্ত খান না। সঞ্জীবের বোধ হয় অতটা বাছ-বিচার নেই।
ফ্লাইটটা সত্যি ভীষণ ডিলেড হল। এদিকে উদ্যোক্তাদেরও সকলের তো বটেই আমাদেরও প্রত্যেকের টেনশান হচ্ছিল। শুনলাম টিকিট বিক্রি করে অনুষ্ঠান হচ্ছে। যাত্রাপার্টি, অধিকারীসমেত, যথাসময়ে না পৌঁছোলে আমাদের পরিবর্তে উদ্যোক্তাদের নিজেদেরই শরীর-মেরামতিতে লাগতে হবে।
আমারও শেষ দেশ উত্তরবঙ্গেই। তবে তা বাংলাদেশে পড়ে গেছে। রংপুরে। হারাগাছার ফুটবল টিম-এর খেলার রকম আমি জানি। দুটি গোল খেয়ে গেলেই তাদের ক্যাপ্টেন লুঙ্গি কষে বেঁধে নিয়ে বলত: ‘বল ছাড়ি ম্যান ধরো বা হে।’ গোল ফুটবল, অপাঙক্তেয় হয়ে মাঠের এককোণে পড়ে থাকত আর হারাগাছার ফুটবল টিমের ষাঁড়ের ডালনা খাওয়া, মোটা মোটা বাঘের মতো পায়ের গোছওয়ালা প্লেয়ারেরা ‘চটা-ফট পটা-পট’ শব্দ করে রংপুরের ‘ধাপ’-এর প্লেয়ারদের পায়ের আর গোড়ালির হাড়ের চলটা ওঠাত। সেইসব বাঘ না থাকলেও আমি বিলক্ষণ জানি যে, ‘বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি।’ জার্মান জঙ্গলের মতো (চোতরা বিছুটি) অফুরন্ত প্রাণশক্তিসম্পন্ন বহু মানুষ উত্তরবঙ্গে আছেন। তাঁরা আমাদের হাড় নিয়ে দুন্দুভি বাজাতে ছাড়বেন না যদি সময়ে পৌঁছোনো না যায়। এমন একটা আশঙ্কা সমরেশের মুখে স্পষ্টই ফুটে উঠেছিল।
আমি ভাবলাম, আমাদের কী! আমরা তো অতিথি-শিল্পী। সমরেশ মজুমদার উদ্যোক্তাদের একজন। তবে সেও কিছু দুবলা-পাতলা নয়। হারাগাছার ষাঁড়ের ডালনা খাওয়া টিমের সঙ্গে টক্কর দিতে অবশ্যই পারবে প্রয়োজনে। ষাঁড়ের ডালনা না-খেয়েই, এটাই ভরসার কথা।
তার ওপরে টেনশান আরও বাড়ল যখন বাগডোগরাতে নেমে, ছোটো সমরেশের মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও সবিশেষ মাতৃ-পিতৃভক্ত শীর্ষেন্দু গোঁ ধরল যে, মা-বাবাকে না দেখে সে অকুস্থলের দিকে আদৌ রওনা হবে না। তাতে আমার ভালোই হল। শীর্ষেন্দুর মা ও বাবার সঙ্গে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হল, তাঁদের প্রণাম করার সৌভাগ্যও।
উত্তরবঙ্গে শিলিগুড়ি ভার্সাস জলপাইগুড়ির মধ্যে রীতিমতো মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলেরই মতো প্রতিযোগিতা আছে শীর্ষেন্দু ও সমরেশ মজুমদারকে নিয়ে। এঁরা দুজনেই আমারই মতো উদবাস্তু। সঞ্জীব খাঁটি ক্যালকেশিয়ান। বিমল দেবও তাই। মনোজের কেসটা ঠিক জানি না। যাইহোক, শিলিগুড়ি ন্যায্যত গর্বিত শীর্ষেন্দুকে নিয়ে। এবং জলপাইগুড়িও সমরেশ মজুমদারকে নিয়ে। শীর্ষেন্দু অবশ্য সাহিত্যক্ষেত্রে ছোটো সমরেশের চেয়ে অনেকদিন আগে এসেছে। আমার চেয়েও আগে। অবশ্য আমি এখনও ‘এসেছি’ যে একথা অনেকে স্বীকার করেন না এবং হয়তো ন্যায্যতই!
শিলিগুড়ি থেকে ছুটল গাড়ি জলপাইগুড়ি শহরের দিকে। একসময়ে প্রতিমাসে কাজে একাধিকবার শিলিগুড়ি যেতে হত। এবং গেলেই গাড়ি করেই পাহাড়ে এবং সমতলের নানা জায়গাতে ঘুরে বেড়াতাম। নানারকম গাড়ি এবং অন্যান্য স্থলযানে এবং বহুবিধ জলযানে খুব শিশুকাল থেকেই অভ্যস্ত ছিলাম। বিভিন্নরকম বায়ুযানেও নিয়মিত চড়ছি উনিশ-শো সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ থেকে। কিন্তু জাতে স্থলযান, অথচ আসলে বায়ুযানেরও অভিজ্ঞতা সেই প্রথম হল। অমন উড়ুক্কু গাড়ি এবং অমন ড্রাইভার এর আগে ভূ-ভারতে কোথাওই দেখিনি এবং দেখবার ইচ্ছেও আর নেই এ জীবনে।
অক্ষত অবস্থাতে যথাসময়ে, অর্থাৎ অনুষ্ঠান আরম্ভ হওয়ার আধঘণ্টাটাক আগেই দারুণ সরকারি দোতলা গেস্ট হাউস-এ আমরা তো দুটি গাড়িতে করে গিয়ে পৌঁছোলাম। সেই বিকেলে মোটর দুর্ঘটনা ঘটলে অনেকই সমসাময়িক এবং আমাদের পরের প্রজন্মের লেখকেরাও সত্যনারায়ণের শিন্নি খেতেন, দরগাতে মোমবাতি জ্বালাতেন, কালীবাড়িতে পাঁঠাবলি দিতেন। বায়োস্কোপ-থ্যাটারের কিছু লোকেরাও আনন্দে শরীর মেরামতিতে লেগে যেতেন। কারণ সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র, বিমল দেব, সমরেশ মজুমদার এবং এই তল্পিবাহক একইসঙ্গে বহুজনকে অপার আনন্দসাগরে ভাসিয়ে ফওত হয়ে যেতেন ও যেতাম। মনীষ ঘটক (যুবনাশ্ব) লিখেছিলেন, ‘একই অস্ত্রে হত হল মৃগী ও নিষাদ’। এ শুধু একনিষাদ নয় গন্ডা গন্ডা নিষাদ। একই আশ্চর্যযানে একলহমাতে খতম হয়ে যেতেন।
রাতে, যেখানে অনুষ্ঠান, সেই রবীন্দ্রভবনে ছুঁচ গলবার জায়গা ছিল না। ওই ঠাণ্ডাতে, অত মানুষে যে নি:শব্দে অত দীর্ঘ অনুষ্ঠান ওইরকম অখন্ড মনোযোগসহকারে এবং পরম শ্রদ্ধাসহকারে শুনবেন তা অন্তত আমার ভাবনায় ছিল না। আমার মনে হয়, সমস্ত মফসসল শহরের মানুষেরা কলকাতা এবং বৃহত্তর কলকাতার শ্রোতা এবং দর্শকদের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগী এবং শ্রদ্ধাশীল। তাঁদের অধিকাংশের মানসিক গভীরতাও হয়তো কলকাতার মানুষদের চেয়ে বেশি। তার কারণ, হয়তো প্রকৃতি-যুক্ততা। মানুষের অনেক গুণই সম্ভবত হ্রাস অথবা লোপ পেয়ে যায় প্রকৃতি-বিযুক্ত হলে। অবশ্য আমার মত যে অভ্রান্ত এমন মনে করার মতো পন্ডিতম্মন্যতা আমার নেই।
অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত সাড়ে দশটা। পরদিনও হবে আবার ওই একই সময়ে। জলপাইগুড়ি শহরে অত রাতে শ্রোতাদের ‘বাহন’ বলতে এক সাইকেল আর সাইকেল-রিকশা। সামান্য কয়েকটি গাড়ি দেখলাম। চা-বাগানের মালিক-টালিকেরই হবে। আর অধিকাংশ শ্রোতাকেই পায়ে হেঁটেই ওই শীতের অন্ধকার রাতে বাড়ি ফিরতে দেখলাম আমাদের গাড়ির হেডলাইটে। ভারি অপরাধী মনে হচ্ছিল নিজেদের। এবং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাতেও মাথা নুয়ে আসছিল।
জলপাইগুড়ি পশ্চিমবঙ্গের চা-বাগানগুলির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র অথচ এই শহরের তেমন কোনো উন্নতি কেন যে হল না যুগযুগান্ত ধরে তা ভাবলেও কষ্ট হয়। বহু বছর যাওয়া হয়নি। শুনেছি, সাম্প্রতিক অতীতে পথঘাট এবং শহরের অনেকই উন্নতি হয়েছে। শুনে খুব ভালো লাগল। বীরেন ঘোষ, খাঁদা রায় (চা-বাগানের মালিক এবং ফুটবলার) এবং আরও অনেক বাঙালির কত চা-বাগান ছিল। রাইকতরাজের ছিল দুটি বাগান শিকারপুর আর ভান্ডাগড়ি। রাজকুমারী প্রতিভা দেবী এবং বীরেনবাবু আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। এখন বিজন নাগ, রাজকুমারীর ছোটোজামাই, চা-বাগানগুলি নিয়ে নিয়েছেন। সম্ভবত অন্য বাগানও কিনেছেন। কিন্তু তা নইলে অধিকাংশ বাগানই হস্তান্তরিত হয়ে গেছে। যে ক-টি আছে তাও হয়তো যাবে। কারণ, মালিকেরা কলকাতাতে বসে ক্লাববাজি করেন আর রাজা-উজির মারেন, অধিকাংশ কর্মচারীরা চুরি করে শেষ করে দেন। সুযোগ বুঝে বিচক্ষণ মাড়োয়ারি ব্যাবসাদারেরা টাকা দাদন ও ধার দিতে থাকেন। তার পর একসময়ে বাগান কবজা করে নেন। দোষ তাঁদের নয়। তাঁরা ব্যাবসাদার। আমরা নিজেদের কাজ আর খাটনি ছাড়া আর সবকিছু করতে অত্যন্তই দড় হয়ে উঠেছি। নিজেদের কাজটি ছাড়া অন্য সব কিছুই ভালো বুঝি। এবং সেই কারণেই সমস্ত শিল্পবাণিজ্য, এমনকী চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রেই আজ এই অবস্থা আমাদের।
অবশ্য সব অন্য প্রদেশীয়রাই যে শুধু মেহনত আর সততার কারণেই সফল একথা আমি একবারও বলব না। কিন্তু একথা অবশ্যই বলব যে, তাঁরা প্রত্যেকেই আমাদের চেয়ে অনেকই বেশি পরিশ্রম করেন, সৎ-অসৎ, বোকা-চালাক নির্বিশেষে।
সমরেশ মজুমদারের ছেলেরা যে কী যত্ন-আত্তি করলেন আমাদের জন্যে তা বলার নয়! সরকারি গেস্ট হাউসে পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাত এগারোটা হল। সকলেরইধকল গেছে সকাল থেকে। একটু শরীর মেরামতি করতে চাইলেন অধিকাংশরাই। আমিও অরাজি ছিলাম না। কিন্তু খাবার-দাবার তো সবই ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল শীতের রাতে। তা গরম করার কোনো উপায়ও হল না, কারণ গেস্ট হাউসের কর্মচারীরা (কর্মীরা) কুক-বেয়ারা-দারোয়ান ইত্যাদিরা বললেন, আমাদের ডিউটি আওয়ার্স শেষ। ওভারটাইমের সিস্টেমও নেই। তাই আমরা কিছুই করতে পারব না।
সমরেশের ছেলেরা তাঁদের প্রায় হাতে-পায়ে ধরলেন। কলকাতা থেকে পশ্চিমবঙ্গের এত নামি-দামি সব লেখকেরা এসেছেন, জলপাইগুড়ির ইজ্জত-রক্ষার্থে অন্তত একটু কষ্ট স্বীকার করে খাবারগুলি আধঘণ্টা পরে একটু গরম করে দিতে। কিন্তু তাঁরা তা করতেও অস্বীকার করলেন। ওই একরাতই আমরা থাকব ওই সরকারি বাংলোতে। কারণ, পরদিন তো সোজাই চলে যাব চা-বাগানে, রবীন্দ্রভবন থেকে। কিন্তু ওই একটি রাতের জন্যেও তাঁরা তাঁদের ডিউটি আওয়ার্সের পরে আমাদের জন্যে অত কষ্ট করতে রাজি হলেন না। কেউ গিয়ে শুয়ে পড়লেন, কেউ অন্যত্র গেলেন। নিয়মনিষ্ঠা দেখে খুবই খুশি হলাম। নিয়মানুবর্তিতা ছাড়া কোনো জাতই কি বড়ো হতে পারে!
সমরেশ এবং তার ছেলেরা গাড়িতে করে খাবার নিয়ে গিয়ে কারো বাড়ি থেকে গরম করে নিয়ে এল। কিন্তু ওই শীতের রাতে গরম হয়ে আসতে আসতেই খাবার ঠাণ্ডা হিম হয়ে গেল। ওরা অত্যন্তই লজ্জিত হল। এবং আমরা দুঃখিত।
আমাদের শীতের রাতে ঠাণ্ডা খাবার খেতে হল। সমরেশ এবং উদ্যোক্তারা খুবই লজ্জিত এবং অপ্রতিভ হলেন কিন্তু সরকারি অতিথিশালার কর্মীদের (তিস্তা ব্যারাজের গেস্ট হাউস ছিল ওটি সম্ভবত) সে জ্ঞান নেই।
পরদিন সঞ্জীব বড়ো ভালো গান গেয়েছিল নিজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে। গানটির কথা আমার এখনও মনে আছে। ‘ব্যাভারেতে বোঝা গেল’—প্রথম কলি।
পরদিন যখন আমাদের মালপত্র সব গাড়িতে তুলে নিয়ে আমরা অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে বিকেলে বেরোলাম, অনুষ্ঠান শেষেই চা-বাগানে চলে যাব সোজা। দেখি, গেস্ট হাউসের স্টাফেরা গেটের দু-পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন।
না! আমাদের সম্মান বা শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে নয়। ভালোবাসাও নয়। সম্মান ও শ্রদ্ধা আমাদের প্রত্যাশারও ছিল না, কারণ সাহিত্যিক বা কবি বা নাট্যকারকে সম্মান তাঁরাই করেন যাঁদের সাহিত্য-নাটকের সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ আছে, যাঁরা বই পড়েন, গান শোনেন, বা নাটক দেখেন। শ্রদ্ধা বা সম্মান আমরা কেউই আশা করিনি ওঁদের কাছ থেকে কারণ গতরাতের অপমান গভীর ক্ষতর মতো লেগেছিল প্রত্যেকেরই মনে। তাঁদের কাছে আমাদের কারোরই আর কোনো প্রত্যাশা ছিল না। আশাপূরণের কারণে নয়, যা আমাদের প্রচন্ড ধাক্কা দিয়েছিল, বাঙালি হিসেবে, বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে তা হল যাঁরা একরাতের অতিথিদেরও খাবারটুকু একটু গরম করে দিতেও গররাজি ছিলেন অত জন স্থানীয় মানুষের এবং বেচারি সমরেশের সনির্বন্ধ অনুরোধ সত্ত্বেও, তাঁরাই বকশিশ-এর জন্যে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছিলেন গেটের দু-পাশে। বকশিশও যে অর্জনের বস্তু, সম্মানেরই মতো, ভিক্ষার ধন নয়। যে ন্যূনতম গুণ, মেধা নয়, সৌন্দর্য নয়, ডিগ্রি নয়, বৃত্তি নয়, যা নইলে কোনো মানুষই আর মানুষ থাকেন না সেই গুণটুকুও যে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি, সেই আত্মসম্মানবোধটুকুকেও, তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে বড়ো ঘেন্না হয়েছিল নিজেদেরই ওপরে।
আত্মসম্মানজ্ঞানই যাঁদের নেই তাঁরাও কি মানুষ? ভেবেছিলাম।
না, জলপাইগুড়ির ওই শহরের ওই সরকারি অতিথিশালার মুষ্টিমেয় কর্মচারীর বিরুদ্ধেই এই অনুযোগ নয়, আমরা জাত হিসেবে ওঁদের সমগোত্রীয়ই হয়ে উঠেছি। আলাদা করে ওঁদের দোষী করাটা বোধ হয় অন্যায়। ওঁরা আমাদেরই প্রতিভূ।
আমার হঠাৎই মনে হল, ধুতি-শাড়ি, পায়জামা, ট্রাউজার, ব্লাউজ, শার্ট পরলেই কিন্তু সব লজ্জাস্থান ঢাকা পড়ে না। প্রত্যেক মানুষেরই আরও কিছু লজ্জাস্থান থাকে। পরমদুঃখের বিষয় এই যে, আজ আমরা আর সেইসব লজ্জাস্থান সম্বন্ধে সচেতনও নই। চেহারাতেই মানুষ আমরা কিন্তু নিজেদের অজানতে মনুষ্যেতর জীবের পর্যায়েই নামিয়ে এনেছি নিজেদের।