লঙ্গরখানা
বড়মামা খেতে খেতে বললেন, ‘আমি একটা গাধা।’
মেজোমামার বাঁ হাতে একটা বই, ডান হাতে ঝোলে ডোবান রুটির টুকরো। এইটাই তাঁর অভ্যাস। সামান্য সময়ও নষ্ট করা চলবে না। অগাধ জ্ঞান-সমুদ্র, আয়ু অল্প বহু বিঘ্ন। সব সময় পড়ে যাও। সকালের কাগজ বাথরুমে বসে বসেই পড়েন। এখন যে বইটা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে পড়ছেন, সেটা কাক সম্বন্ধে। কাকের স্বভাব, কাকের সমাজ, কাকের নিয়মনিষ্ঠা। পড়তে পড়তেই বললেন।
‘কি করে বুঝলে? তোমার কান দুটো অবশ্য একটু বড়ই ঝোলা ঝোলা, সাধারণ মানুষের কান অত বড় হয় না। প্রকৃতির ব্যাপার। বোঝা শক্ত। কে যে কি ভাবে জন্মায়। চীনে মেয়েদের শিং বেরোচ্ছে। কলকাতায় ছেলেদের ন্যাজ বেরোচ্ছে।’
রুটির টুকরোটা মুখে ঢোকালেন। কোলের ওপর এক ফোঁটা ঝোল পড়ল। আগেও দু-এক ফোঁটা পড়েছে। দৃকপাত নেই। জ্ঞান-তপস্বী।
বড়মামা বললেন, ‘স্কুলে অনেকবার আমাকে গাধা প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল। মানতে রাজী হইনি। তখন বোকা ছিলুম, গাধা ছিলুম না। এখন বোকাগাধা। ও সব কানটান নয়, এ আমার স্বীকারোক্তি। আত্মসমীক্ষার ফল।’
মেজোমামা বই থেকে চোখ না তুলেই বললেন, ‘আমি দর্শনের ছাত্র, তর্কশাস্ত্র পড়েছি, অত সহজে মানতে পারব না। তুমি প্রমাণ কর। ডেকে দেখাও। গাধা চেনা যায় ডাক দেখে।’
‘আমি চিনেছি গরু দেখে।’
‘গরু দেখে গাধা চেনা! অবশ্য দুটো জন্তুরই চারটে পা। চতুষ্পদ। তা হলেও মুখে মেলে না স্বভাবেও মেলে না। তোমার সিদ্ধান্ত ধোপে টিকল না। ধোপে টিকলে তুমি এতক্ষণে এই খাবার টেবিলে না থেকে ধোপার আস্তাবলে বাঁধা থাকতে। খাচ্ছ খেয়ে যাও। তর্কে এস না, হেরে যাবে।’
বড়মামা মাংসর হাড় চুষতে চুষতে বললেন, ‘তুই একটা গাধা। দার্শনিক গাধা।’
মেজোমামা বইটা কোলের ওপর উপুড় করে রেখে বললেন, ‘তুমি একটা ডাক্তার গাধা।’ মাসিমা ফ্রিজ থেকে পুডিং বের করতে করতে বললেন, ‘হ্যাঁ, এইবার গাধা গাধা করতে করতে হাতাহাতি হোক। খাওয়া মাথায় উঠুক।’
বড়মামা বললেন, ‘তুই দেখ কুসি, কি রকম আনসিভিলাইজড। আমি যখন বলছি, আমি গাধা, তখন নিশ্চয় কারণ আছে। সেটুকু মেনে নেবার উদারতা পর্যন্ত নেই। উনি দার্শনিক। ঘোড়ার ডিমের দার্শনিক।’
মাসিমা টেবিলে পুডিং-এর ডিশ সাজাতে সাজাতে বললেন, ‘মেজদা, তোমারও ভীষণ একগুঁয়ে স্বভাব। তোমার এই সামান্য কথাটা মানতে কি হয়? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়?’
‘কি করে মানব তুই বল কুসি। আমার তো স্মৃতিশক্তি এখনও তেমন দুর্বল হয়ে যায়নি। এই তিন দিন আগে, এই টেবিলে বসেই উনি বললেন, আমি ভগবান। লজিক কি বলে? গাধাই ভগবান, ভগবানই গাধা। আমি ভগবান না মানলেও হিন্দুর ছেলে। আমার একটা সংস্কার আছে। গর্দভকে আমি ভগবান বলতে পারব না।’
মাসিমা খুব রেগে গেলেন। ‘ওই লজিকেই তোমাকে মেরেছে মেজদা, যেমন ডাক্তারি মেরেছে বড়দাকে। দু’জনকেই আর বিয়ে করতে হল না।’
বড়মামা বললেন, ‘একেই বলে মেয়েছেলে! গাধা থেকে বিয়েতে চলে গেলি?’
মেজোমামা সঙ্গে সঙ্গে বড়মামার সঙ্গে একমত হয়ে গেলেন, ‘ঠিক বলেছ বড়দা, ওটা একটা রিয়েল গাধা।’
মাসিমা বললেন, ‘হ্যাঁ রিয়েল গাধা না হলে তোমাদের ভার বহন করবে কে? সকালে কাপের পর কাপ চা, কারুর নরম টোস্ট, কারুর কড়া, কারুর ডিমের ওমলেট, কারুর পোচ, জল গরম, ত্রিফলা, পাঁচন, ইসবগুল, কারুর স্টু। যত রকমের ফ্যাচাং, কে সহ্য করবে। হাড়ে দুব্বো গজিয়ে গেল। কে গাধা, কে গাধা নয়, এ তর্ক এখন থাক। দয়া করে খাওয়া সেরে উঠে পড়। অনেক রাত হল। পাড়া নিশুতি হয়ে এসেছে।’
মেজোমামা বললেন, ‘আমি এখুনি উঠে পড়ছি, যারা ভগবানকে গাধা বলে, গাধাকে ভগবান, তাদের আমি ঘৃণা করি। আই হেট দেম।’
বড়মামা চামচে দিয়ে পুডিং-এর মাথা থেকে লাল চেরিটা খসিয়ে নিয়ে বললেন, ‘একে বলে গায়ে পড়ে ঝগড়া। অবশ্য ছেলে ঠেঙিয়ে প্রফেসারদের স্বভাবটাই মিনমিনে হয়ে যায়। পাঁচিলের ওপর হুলো বেড়ালের মতো। মিঁআও মিঁআও। চলাও চলাও, ঝগড়া করি চাঁদের আলোয়।’
মেজোমামা তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। কোলের বইটা পায়ের কাছে পড়ে গেল। মাসিমা মেজোমামার হাতটা চেপে ধরলেন, ‘কি ছেলেমানুষী হচ্ছে মেজদা?’
‘ছেলেমানুষি! আমাকে হুলো বলবে, আমি বসে বসে সহ্য করব! ডাক্তারদের মারার লাইসেনস আছে জানি, যা তা বলার পারমিট আছে কি?’
‘মেজদা, তুমি দয়া করে বড়দাকে গাধা বলে মেনে নিলেই তো লেঠা চুকে যায়। সেদিন ভগবান বলে মানতে পারলে, আর আজ গাধা বলে মেনে নিলে তোমার মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। যাঁহা রাম তাঁহা কৃষ্ণ।’
‘সেদিনও মানিনি আজও মানব না।’
বড়মামা খুব শান্ত গলায় বললেন, ‘বোস, বোস। অশান্তি করিসনি। স্বভাবটা পালটা। পুডিংটা খেয়ে দেখ। কুসিটা দারুণ বানিয়েছে। তোর ওই ভুঁড়ি আরও এক বিঘত বেড়ে যাবে।’
মেজোমামা আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। আমি তো জানি, পুডিং মেজোমামার ভীষণ প্রিয় জিনিস। রাগ করে ছেড়ে চলে গেলে রাতে নানারকম দর্শনেই বই পড়ায় মন বসবে না। আমাকে একদিন বলেছিলেন, খাব না তো খাব না, খেতে বসে আধাখ্যাঁচড়া খাওয়া হলে মেজাজটা খিঁচড়ে যায়। জানবি মুড়ি আর ভুঁড়ে কানেকটেড। দুটোর মধ্যে ভীষণ যোগ।
বড়মামা বেশি আদর মাখানো গলায় বললেন, ‘এবার প্লেটটা কোলের কাছে লক্ষ্মীছেলের মতো টেনে নাও। লজ্জা কোরো না। জানই তো আর একবার সাধিলেই খাইব।’
মেজোমামা আবার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন, ‘ইমপসিবল। ইনসালট। ব্রুট্যাল অ্যাসলট।’
মাসিমা বললেন, ‘এবার থেকে তোমরা দুজনে একসঙ্গে খেতে বসবে না। নেভার।’
বড়মামা বললেন, ‘তুই অত সহজে খেপে যাস কেন? তর্কে রেগে গেলেই হার। পরাজয়। বোস, বোস। অবশ্য এটাও তোর একটা টেকনিক। ওঠ বোস করে খিদে বাড়ানো।’
মেজোমামা বসতে গিয়েও আবার উঠে পড়লেন। বড়মামার পায়ের কাছে যেন একটা স্প্রিং আছে। এক একবার একটু করে চাপ দিচ্ছেন আর মেজোমামা উঠে পড়ছেন।
মাসিমা খুব রেগেমেগে বললেন, ‘কি হচ্ছে কি বড়দা? তোমার রসিকতা থামাবে, না আমরা উঠে যাব? মেজদা তুমি না দার্শনিক? কোনও কথায় কান না দিয়ে খেয়ে উঠে যেতে পারছ না?’
বড়মামা বললেন, ‘শুরুতেই বলেছি, আমি একটা গাধা। গাধা না হলে প্রফেসারের সঙ্গে কেউ এক টেবিলে খেতে বসে?’
‘আবার শুরু করলে। তখন থেকে কেন গাধা গাধা করছ। আচ্ছা গাধায় পেয়েছে তো।’ মেজোমামা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বাঁ হাতটা একবার করে মুঠো করছেন আবার খুলছেন। চেয়ারে বসতে সম্মানে লাগছে। মাসিমা মেজোমামাকেও এক ধমক লাগালেন—
‘তোমার ছেলেমানুষী দেখলে রাগ ধরে মেজদা। জানই তো বড়দার পেছনে লাগা স্বভাব! তুমি যতই লাফাচ্ছ উনি ততই তোমাকে উসকে দিয়ে মজা পাচ্ছেন।’
মেজোমামা মুখ গোঁজ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। চামচে দিয়ে রাগমাগ করে ইয়া বড় এক খাবলা পুডিং তুলে মুখে পুরলেন।
বড়মামা বললেন, ‘আমি গাধা, তার প্রমাণ আমার গরু। আমার মতো গাধা না হলে কেউ ওরকম তিনটে গরু পোষে না। তোরাই বল, ওই গরু তিনটে আজ পর্যন্ত ক’ছটাক দুধ দিয়েছে!’
মাসিমা যেন বেশ খুশিই হলেন, ‘ঠিক বলেছ বড়দা। গরু দিয়েই প্রমাণ করা যায় তুমি একটা গাধা।’
মেজোমামা সব সময় বাঁকা পথ ধরেন। প্রতিবাদ করার জন্যে মুখিয়ে আছেন। বড়মামা বলেন, ‘প্রোটেসটান্ট। মেজোমামার উচিত ছিল চুপ করে শুনে যাওয়া। তা আর হল কই। হঠাৎ বলে বসলেন, ‘কেন? ওয়ানস আপন এ টাইম তোমার কালো গরুটা হঠাৎ দিন তিনেক দুধ দিয়ে ফেলেছিল। তুমি সেই দুধ দেখে কলতলায় রবারের জুতো পায়ে দিয়ে নাচতে নাচতে পিছলে পড়ে গিয়েছিলে। একদিন গরুর আনারে সত্যনারায়ণ পুজো হয়েছিল। তুমি বলেছিলে সিন্নি খেয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, দুধে এতই নাকি ফ্যাট। একদিন মেজারিং গ্লাসে করে প্রত্যেককে এক আউনস করে দুধ খাইয়েছিলে। সেই খাঁটি দুধ খেয়ে আমাদের সব পেট খারাপ হয়ে গেল। গরুর ভাষা নেই। প্রতিবাদ করতে জানে না বলে যা খুশি তাই বলে যাবে?’
‘হ্যাঁ দিয়েছিল ঠিকই। তারপর আর দিয়েছে কি?’
‘কেন দেয়নি?’
‘তোর মতো একগুঁয়ে স্বভাব বলে দেয়নি। দিতে পারি তবু দোব না। কি করতে পার কর।’ মেজোমামা এবার সশব্দে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লেন।
‘আমি আর তোমার ভুঁসো কালো গরু এক শ্রেণীতে পড়ল। অসম্ভব! আর সহ্য করা যায় না।’ মেজোমামা বিদ্যাসাগরী চটির ফটাস ফটাস শব্দ তুলে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। খুব রেগে গেছেন। যাক বাবা, পুডিংটা শেষ করে গেছেন।
মাসিমা বললেন, ‘তোমার বড়দা ভীষণ পেছনে লাগা স্বভাব!’
বড়মামা হি হি করে হেসে বললেন, ‘ফায়ার হয়ে গেছে। ভেতরে গড়ড় গড়ড় শব্দ হচ্ছে।’
‘গরুর সঙ্গে তুলনা না করলেই পারতে।’
‘গাধার ভাই গরুই হয়। আমাদের ভায়ে ভায়ে হচ্ছে তুই এর মধ্যে নাক গলাতে আসিসনি। থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার।’
‘ও, আমি হলুম থার্ড পার্সন? ঠিক আছে।’ মাসিমাও রাগ করে উঠে গেলেন।
বড়মামা আমাকে বললেন, ‘এদের আজ কি হয়েছে বল তো। কথায় কথায় রেগে যাচ্ছে। সব কটা ব্লাডপ্রেসারের রুগী। আমার যেমন বরাত। গরু তিনটেরও প্রেসার। তোর জানা আছে গরুর প্রেসার কোন পায়ে মাপে? মানুষের প্রেসার মাপি বাঁ হাতে। গরুর তো চারটেই পা। হাতের বালাই নেই।’
বড়মামা ভীষণ ভাবনায় পড়লেন। ব্যাপারটা ডাক্তারির দিকে চলে গেল। আমি বললুম, ‘বোধহয় নেজে মাপে।’
কথাটা পছন্দ হল না, ‘ধুর, নেজ আবার একটা জিনিস! দড়ির মতো ঝোলে। নেজে কিস্যু নেই। ওটা একটা আব্রু। ওই যেখান দিয়ে গোবর বেরোয় সেটাকে ঢেকে রাখে। নেজ নয়, বুঝলি! দেখি, পশু-চিকিৎসার বই ঘেঁটে দেখতে হবে।’
বড়মামা হঠাৎ চিৎকার শুরু করলেন, ‘কুসি, কুসি।’
মাসিমা ঘরের বাইরে খুটুস খুটুস করেছিলেন।
‘কি হল? চেঁচাচ্ছ কেন।’
‘বাঃ চেঁচাব না। আর কিছু দিবি না?’
‘আবার কি দোব? পুডিং-এর পর আর বাকি থাকে কি? দি এণ্ড।’
‘সে কি রে! ফ্রুটস-ট্রুটস দিবি না।’
‘না, দয়া করে উঠে পড় টেবিলটা পরিষ্কার করে নিক।’
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আমার চোখ ঘুমে জুড়ে আসে। ধপাস করে শুয়ে পড়তে পারলে আর কিছুই চাই না। আজও সেই তালেই ছিলুম। পরিষ্কার বিছানা। নরম মাথার বালিস, কোল বালিস। মৃদু পাখার বাতাস। জানালার বাইরে সাদা ফুলে ফুটফুটে কামিনী গাছ। থমথম করছে মিষ্টি গন্ধ। কোণের দিকে বড়মামার আরাম-কেদারার কাছে তে-ঠ্যাঙা বড় টেবিলে ল্যাম্পের মাথার ওপর হালকা সবুজ রঙের শেড স্বপ্নের মতো আলো ছড়িয়ে রেখেছে। ঘুম আয়, ঘুম আয় বলতে হয় না, ঘুম যেন ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
বিছানায় পা দুটো তুলে সব শুতে যাচ্ছি, বড়মামা ‘হাঁ হাঁ’ করে উঠলেন।
‘খেয়েই সোয়া কি? ভেরি ব্যাড হ্যাবিট। হজম হবে না, ডিসপেপসিয়া ধরবে। চাঁদ উঠেছে। চলো ছাদে যাই। ঘণ্টাখানেক পায়চারি করে, পেট কমিয়ে, এক গেলাস জল খেয়ে, জল বিয়োগ করে তারপর বিছানা। নট নাও, নট নাও। উঠে এসো।’
ব্যস ঘুমের বারোটা বেজে গেল। বড়মামার যখন স্বাস্থ্যের দিকে আজ নজর পড়েছে তখন আর বিছানা না ছেড়ে উপায় নেই।
আজ অবশ্য ছাতটা বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। হু হু আকাশ। চাঁদের আলো যেন গানের মতো ছড়িয়ে আছে। ছোট ছোট তারারা আজ আর ফোটেনি। বড় বড় গ্রহরা এখানে ওখানে পড়তে বসে আমার ঘুম-রাঙা চোখের মতো ড্যাবড্যাব করছে।
ছাদের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় যেতে যেতে বড়মামা বললেন, ‘একটা ডেয়ারী হয়ে যেত।’
‘সে আবার কি?’
‘যত টাকা ওই বাঁদর গরু তিনটের পেছনে ঢেলেছি সেই টাকায় একটা ছোটখাটো ডেয়ারী হয়ে যেত।’
‘আজ বুঝি হিসেবে বসেছিলেন?’
‘হিসেবে কি রে? এরপর নগেন আমার গলায় গামছা দেবে। হাজার টাকা পাওনা। গত পাঁচ মাসে বাবুরা হাজার টাকার খড় খেয়েছেন। এর উপর ভুসি আছে, ছোলার চুনি আছে, ভেলিগুড় আছে, গোষুধ আছে, দুটো লোকের মাইনে আছে।’
‘গোষুধ কি বড়মামা!’
‘গরুর ওষুধ।’
ছাতের ও-মাথায় তুলসীগাছের টব ছুঁয়ে আমরা এ-মাথার রজনীগন্ধার টবের কাছাকাছি এসে গেছি। বিশাল ছাত, তিরিশ পাকে এক মাইল তো হবেই।
‘ইয়ারকি পেয়ে গেছে। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। ”দুর্জনং গরুনাং তথা শূন্য গোয়ালং শ্রেয়ঃ, পঞ্চতন্ত্রে আছে। কুঁক করে হাসছিস কেন?’
‘মানে সংস্কৃতটা কি রকম বায়োকেমিক বায়োকেমিক লাগছে।’
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, তুই আমার চেয়ে সংস্কৃত বেশি জানিস। ম্যাট্রিকে লেটার পাওয়া ছেলে আমি। ভাটপাড়ায় টোল না করে ডাক্তার হয়ে লাল জল, নীল জল করছি।’
সংস্কৃত নিয়ে বেশি খোঁচাখুঁচি করার সাহস হল না। হঠাৎ যদি জিগ্যেস করে বসেন, ঠিকটা কি হবে তুই তা হলে বল। সংস্কৃত ছেড়ে গরুর দিকেই থাকা ভালো।
‘আপনি গরুগুলোকে তা হলে কী করবেন? ছেড়ে দেবেন?’
‘ছেড়ে দোব না, তবে গরু-গরু করে গাধার মতো আর নাচানাচি করব না। দুধের আশায়ও থাকব না। তোমরা থাক তোমাদের গোয়ালে, আমি থাকি আমার ঘরে। দুধ দিতে হয় দেবে, না দিতে হয় না দেবে। পয়সা থাকে কিনে খাব, না থাকে চা খাব। আমি কি ডরাই কভু ভিখারি গারবে।’
বাবা! আজ একেবারে সংস্কৃতের ফোয়ারা ছুটছে। পটাস পটাস করতে করতে আবার তুলসী-গাছের টবের কাছে এসে পড়েছি। এবার তো শুয়ে পড়লেই হয়।
‘বড়মামা, সব তো হজম হয়ে গেল, এবার একটু বিশ্রাম করলে হয় না।’
‘খেপেছিস। এর মধ্যে শুবি কি-রে। একটা ফিউচার প্ল্যান তৈরি করতে হবে না?’
‘কিসের প্ল্যান?’
‘গরু ছেড়ে দিলুম। আর একটা কিছু ধরতে হবে তো।’
‘কেন। কুকুর রয়েছে গোটাছয়েক, পাখি রয়েছে খাঁচায় খাঁচায়, দুটো বেড়াল।’
‘ধ্যার। ওদের কি ধরব? বড় একটা কিছু ধরতে হবে। মহান, মহৎ, অসীম, অনন্ত।’
‘সে আবার কি?’
‘আমি একটা লঙ্গরখানা খুলব।’
‘লঙ্গরখানা?’
‘কিছুই জানিস না? রোজ হাঁড়ি হাঁড়ি খিচুড়ি তৈরি করে দুপুরবেলা দরিদ্র মানুষদের খাওয়াব। রাজা রাজেন মল্লিকের মতো। দাতব্য চিকিৎসালয় খুলে ফ্রী চিকিৎসা চালাব। একটু একটু করে আমার এই সমাজসেবা এমন চেহারা নেবে হেঁ হেঁ!’
‘হেঁ হেঁ মানে?’
‘হেঁ হেঁ মানে মাদার টেরেসা! তোর মেজোকে বলে আয় মনের জোর, ইচ্ছাশক্তি, তেজ আর ত্যাগ থাকলে নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা এমন কিছু শক্ত কাজ নয়। শুধু পুডিং খেলেই হয় না, পুডিং খাওয়াতে হয়। আমি-আমি করলে নিজের ভুঁড়ি বাড়ে। তুমি-তুমি করলে আমিটা পেল্লায় বড় হয়ে বিশ্ব-আমি হয়। বিশ্বামি ভবেৎ।’
‘বিশ্বামি?’
‘হ্যাঁ, স্বরসন্ধি। অকারের পর অকার থাকিলে উভয় মিলিয়া দীর্ঘাকার হয়। এখুনি জিগ্যেস করবি দীর্ঘাকার কি? দীর্ঘ প্লাস আকার। এও স্বরসন্ধি।’
‘মেজোমামাকে এখুনি বলে আসব?’
‘শিওর! নাকের ডগায় রাসেল নিয়ে বসে আছে বার্ট্রান্ড বানান জানে না।’
যাক বাবা! বড়মামার হাত থেকে ছাড়া পাওয়া গেছে। মেজোমামার ঘরে গিয়ে ঘুম লাগাই।
সকালবেলা বড়মামাকে ঘরে পেলুম না। অথচ এই সময়ে ঘরে থাকারই কথা। লাল টকটকে সিল্কের লুঙ্গি? খোলা গা। পিঠের ওপর ইয়া মোটা সাদা পইতে। তাতে আবার একটা আঙটি বাঁধা। হাতের আঙুলে জায়গা নেই। আঙটি কোমরের কাছে ঝুলছে। চেয়ারে বাবু হয়ে বসা। ছটা কুকুর ঘরময় হ্যা হ্যা করছে। এক একটা পালা করে লাফিয়ে উঠে বড়মামার হাত থেকে বিস্কুট ছিনিয়ে নিচ্ছে। মনে মনে হিসেব করে এক একটা বদমাইশকে ধরে ফেলছেন, ‘উঁহু উঁহু, তোর দুটো হয়ে গেছে, এইবার ওইটার পালা।’ কে কার কথা শোনে। সব কটা এ ওর ঘাড়ে লাফাচ্ছে। মাঝে-মাঝে পইতেতে পা আটকে যাচ্ছে। বড়মামা ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলছেন, ‘এইবার সব কটাকে দূর করে দেব। ইনডিসিপ্লিনড জানোয়ার।’ বলেই পইতের ঝোলা অংশ তুলে কপালে ঠেকাচ্ছেন। কোথায় সেই পরিচিত দৃশ্য! ঘরময় কুকুরের ছড়াছড়ি। প্রভু বেপাত্তা।
দক্ষিণের জানালায় উঁকি মেরে দেখি বড়মামা আছেন। মুখের চেহারায় ভীষণ ভাবনা। কি হল কে জানে? হঠাৎ চোখাচোখি হতেই ইশারায় ডাকলেন। বাগানে নামতেই আমাকে বললেন—
‘বুঝলি, এইখানেই হবে।’
‘কি হবে বড়মামা? নারকোল গাছ?’
‘আরে না রে না। তোর কেবল খাবার চিন্তা।’
‘তবে?’
‘এইখানে হবে সেই লঙ্গরখানা। একপাশে বিশাল উনুন। আর একপাশে সারি সারি টেবিল আর ফোলডিং চেয়ার। এই কোণে কল আর জল। এইখানটায় একটা পেটা ঘড়ি। ঢ্যাং করে যেই একটা বাজবে, খাওয়া স্টার্ট। দুটোর মধ্যে যারা আসবে তারাই খেতে পারে। একটা থেকে দুটো। কড়া নিয়ম।’
‘টেবিল, চেয়ার?’
‘তবে না তো কি? দরিদ্রনারায়ণ সেবা। ভেজিটেবিল খিচুড়ি আর যে কোনও একটা ভাজা। সপ্তাহে একদিন চাটনি। চল, এইবার চট করে হিসেবটা করে ফেলি।’
বড়মামা ঘরে ঢুকতেই কুকুরগুলো মুখিয়েছিল, সকালের বিস্কুট পায়নি। চারপাশ থেকে ছেঁকে ধরল। একটা পায়ের কাছে। একটা পেছনের দিকে লাফাচ্ছে। বড়মামা বললেন, ‘উঁ পাওনাদারদের জ্বালায় জীবন গেল।’
বিস্কুট পর্ব শেষ হতে না হতেই মাসিমা চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। সব কটা কুকুরকে এক জায়গায় দেখে বললেন, ‘পয়সার কি জ্বালা! কত মানুষ না খেয়ে জীবন কাটাচ্ছে আর কারুর আধডজন কুকুর রোজ এক কেজি হরলিকস বিস্কুট দিয়ে ব্রেকফাস্ট করছে। উৎপাতের ধন এইভাবেই চিৎপাতে যায়!’
‘ঠিক বলেছিস কুসি।’
বড়মামার সমর্থন শুনে মাসিমা ভীষণ অবাক হলেন, ‘অ্যাঁ ভূতের মুখে রামনাম!’
বড়মামা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘একেবারে অন্য রাস্তায় যাত্রা। কমপ্লিট বিবেকানন্দ। জীবে দয়া করে যেই জন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর! প্রথমে পঁচিশজন দিয়ে শুরু, ধীরে ধীরে একশো, দুশো, তিনশো, পাঁচশো, হাজার।’
মাসিমা চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘হাজার কুকুর। অত কুকুর পাবে কোথায়?’
‘গবেট! কুকুর নয়, কুকুর নয়, মানুষ। দরিদ্রনারায়ণ সেবা।’
‘সে আবার কি। বারোয়ারী পূজো প্যাণ্ডেলে ফি বছর একদিন নারায়ণ সেবা হয়। তুমি তার প্রেসিডেন্ট হলে নাকি?’
‘আজ্ঞে না স্যার। এ হবে সুধাংশু মুখোপাধ্যায়ের ফ্রী কিচেন, জাস্ট লাইক রাজা রাজেন মল্লিক অফ মার্বেল প্যালেস। আজই নগেনকে ডেকে বাগানে একটা আটচালা তৈরির হুকুম দিচ্ছি। কালই খগেন এসে উনুন করে দেবে। পরশু আসবে চাল, ডাল, আলু, নুন, তেল, মশলা, তেজপাতা, তরশু বেলা একটা। দেখবি সে কি কাণ্ড। গরমাগরম খিচুড়ি খেয়ে লোক দু হাত তুলে আর্শীবাদ করতে করতে চলেছে—লং লিভ রাজা, সরি, ডাক্তার সুধাংশু মুকুজ্যে!’
‘সর্বনাশ!’
‘সর্বনাশ কি রে! বিবেকানন্দ বলে গেছেন, জন্মেছিস যখন দেয়ালের গায়ে একটা আঁচড় রেখে যা। তুই হবি এই নারায়ণ-যজ্ঞের সুপারভাইজার। এক সেকেন্ড বস তো। তোর পরামর্শে হিসেবটা সেরে নি। ধর পঁচিশ জন।’
মাসিমা ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন।
‘তুমি দেউলে হয়ে যাবে বড়দা? তুমি নিজে মরবে আমাদেরও মারবে।’
‘আমি মরি মরব। জন্মিলে মরিতে হবে। তোরা মরবি কেন, বালাই ষাট। নে বল, পঁচিশজনে ডেলি কত চাল খেতে পারে? পেট ভরে খাবে, হাফভরা নয় ফুলভরা!’
মাসিমা বললেন, ‘পঁচিশ কেজি।’
বড়মামা অবাক হয়ে বললেন, ‘নার্ভাস করে দিচ্ছিস। বল পঁচিশ পো, মিনস ওই ছ’সের। মিনস ব্ল্যাকে কিনলে আঠারো টাকা। এইবার ডাল। ছ’সের চালে কত ডাল লাগে রে? ফর্মুলাটা কি।’
‘চালের ডবল ডাল।’
‘ভাগ, ভাঙচি দিচ্ছিস, হাফ ডাল হাফ মিনস তিন কেজি, পনেরো টাকা। আঠারো প্লাস পনেরো ইজিকলুট তেত্রিশ। ইত্যাদি আরও সাত, মানে চল্লিশ। কয়লা, রান্না ইত্যাদি দশ। রোজ পঞ্চাশ টাকা, নাথিং, নাথিং। চল ভাগনে লেগে পড়ি।’
বড়মামা সে কী উৎসাহ! তড়াৎ করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন।
মাসিমা বললেন, ‘ভাগনে কি ভাবে লেগে পড়বে?’
‘যে ভাবে লাগাবে সেই ভাবে লাগবে। ওর মতো ছেলে লাখে একটা মেলে কিনা সন্দেহ।’
‘সে তো বুঝলুম, কিন্তু তোমার এই রাজসূয় যজ্ঞে একি ঘোড়া ধরতে বেরোবে!’
‘আমাদের এখন কত কাজ জানিস! আটচালা তৈরি, রাঁধবার লোক ঠিক করা। উনুন বসান। চাল ডাল কেনা। তারপর প্রচার।’
‘প্রচার মানে?’
‘প্রচার মানে?’ বড়মামা রেগে গেলেন। ‘প্রচার মানে প্রচার। লোকে জানবে কি করে? না জানতে পারলে লোক আসবে কি করে।’
‘অ। তা সেটা কি ভাবে হবে? কাগজে বিজ্ঞাপন, বিবিধ ভারতী, দেয়ালে পোস্টার, মাইক নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরা, সিনেমায় স্লাইড। কোনটা।’
‘ভ্যাক। ওর কোনওটাতেই কাজ হবে না। দুঃস্থ মানুষ যারা পড়তে জানে না, যাদের পয়সা নেই সিনেমা দেখে না, তারে অন্যভাবে জানাতে হবে। ভোটার লিস্ট তৈরির মতো পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে প্রকৃত গরিব মানুষ খুঁজে বের করে হাত জোড় করে সবিনয়ে বৈষ্ণবদের মতো বলতে হবে—দয়া করে এই অধমের গরীবখানায় প্রসাদ গ্রহণ করিবেন।’
মাসিমা বললেন, ‘ডাক্তারি তা হলে মাথায় উঠল!’
‘যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না, ইডিয়েট। যা, আর এক কাপ চা করে আন। বেরিয়ে পড়ি। তোমাদের মতো আলস্য যোগে জীবন ম্যাসাকার হতে দোব না। কর্মযোগ, কর্মযোগ। যোগ কর্মসু কৌশলম। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন। গীতা পড়েছিস গবেট!’ মাসিমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
বড়মামা প্যান্ট জামা পরে তৈরি হবার জন্যে পর্দার আড়ালে অদৃশ্য হলেন।
মাসিমা ঠক করে চায়ের কাপ টেবিলে রাখলেন। বড়মামা চমকে মুখ তুলে তাকালেন। কাগজে দক্ষিণ পাড়ার ম্যাপ আঁকছিলেন। যে যে রাস্তা ধরে আমরা যাব তারই পরিকল্পনা। ‘খুব রেগে গেছিস মনে হচ্ছে।’
‘রাগলে তোমার আর কি? তুমি কার পরোয়া কর? তবে তোমার এই সব ব্যাপার মেজদা জানে?’
‘হু ইজ মেজদা! তার দর্শনে জীবে দয়া নেই জিভে দয়া আছে। ভগবান একটা না দুটো, না শূন্য, ভগবান আমি না আমিই ভগবান, তিনি সাকার না নিরাকার, এই গোলকধাঁধাতেই বেচারা সারা জীবন বোকার মতো ঘুরতে ঘুরতে ম্যাড হয়ে গেল। তুই যা, তুই যা, আমাদের এখন অনেক কাজ। মেয়েদের সঙ্গে বকবক করার সময় নেই।’
মাসিমা বেশ বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন। আমি বললুম, ‘বড়মামা হাওয়া খুব সুবিধের মনে হচ্ছে না।’
‘রাখ রাখ, ঝোড়ো হাওয়াতেই আমাদের নিশান উড়বে পত পত করে।’
মোটরসাইকেলে উঠতে উঠতে বড়মামা বললেন, ‘প্রথমে একবার চক্কর মেরে যাই। তুই শুধু চোখ-কান সজাগ রেখে দেখে যাবি। যেই মনে হবে এই লোক সেই লোক, সঙ্গে সঙ্গে আমার পিঠে খোঁচা দিবি। গাড়ি থামিয়ে তাকে যা বলার আমি বলব।’
বড়মামার মোটরসাইকেল, তার যেমন রঙ তেমন আওয়াজ। কানে তালা লেগে যাবার মতো অবস্থা। শক্ত করে ধরে বসে আছি। পকেটে সেই ম্যাপ। বীরেন শাসমল রোড দিয়ে ঢুকে, রাম চ্যাটার্জী রোডে পড়ে, শরৎচন্দ্র স্ট্রীট হয়ে, কালু শেখ রোড ধরে বিরাট একটা চক্কর মারা হবে। জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই বড়মামার অন্যসূত্রে আসতে পারবে। বড় বড় হরফে দরমার গায়ে লেখা থাকবে, শক, হূণ, দল মোগল পাঠান এক দেহে হল লীন।
সবে সকাল হয়েছে। রাস্তায় বেশ লোক চলাচল। সকলেই যে যার কাজে চলেছেন। কেউ বাজারে। কেউ স্কুলে ছেড়ে মেয়ে পৌঁছতে। কেউ অফিসে। চারপাশের দোকানপাট খুলে গেছে। জমজমাট ব্যাপার। সাইকেলের সামনে কাগজ ডাঁই করে হকার চলেছেন বাড়ি বাড়ি কাগজ দিতে। চোখে এমন একজনও পড়ছে না যাকে মনে ধরে। বড়মামা বলে দিয়েছিলেন, দেখবি মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। জটপাকান চুল, তোবড়ান গাল, গর্তে বসা চোখ, শির বের করা হাত, সামনে কুঁজো হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে, কিংবা উদাস হয়ে রকে কি গাছতলায় বসে আছে, বিড় বিড় করে আপন মনে বকছে, দখলে বুঝবি এই সেই লোক, দি ম্যান।
অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর বড়মামা একটা বটগাছতলায় গাড়ি থামিয়ে বললেন।—
‘দেশের কি রকম উন্নতি হয়েছে দেখছিস! গরিবী হাটাও তো সত্যিই গরিব হাটাও, সবাই ওয়েল-টু-ডু ম্যান। একটা লোকও চোখে পড়ল না!’
‘বুধবার তা হলে পাল পাল ভিখিরি আসে কোথা থেকে?’
‘আরে দূর। বুধবার এ তল্লাটের মিল-ফিল বন্ধ থাকে, পালে পালে সব বেরিয়ে পড়ে উপরি রোজগারের ধান্দায়। ওরা কেউ রিয়েল ভিখিরি নয়।’
‘আমার কি মনে হয় জানেন?’
‘কি?’
‘আমরা যাদের খুঁজছি তারা কেউ উঠে হেঁটে আর বেড়াতে পারছে না। কোথাও না কোথাও ফ্ল্যাট হয়ে শুয়ে আছে।’
‘হতে পারে। কিন্তু কোথায় শুয়ে আছে?’
‘মনে হয় গঙ্গার ঘাটে, মোচ্ছবতলায়, শ্মশানে পাকুড়তলায় বাঁধান চাতালে।’
বড়মামা খুব তারিফ করলেন, ‘মন্দ বলিস নি। উঠতেই যদি পারবে তাহলে তো খেটে খাবে। না খেতে পেয়ে সব লটকে পড়ে আছে। ঠিক বলেছিস। বড় হয়ে তুই ব্যারিস্টার হবি। চল, তা হলে মোচ্ছবতলাতেই আগে যাই।’
বড়মামা নেচে নেচে মোটরসাইকেল স্টার্ট করলেন। ভুল, ভট-ভট শব্দে আকাশ ফেটে গেল। গাছের ডালপালা থেকে পাখি উড়ে পালাল ভয়ে। গঙ্গার দিকে রাস্তাটা যতই এগোচ্ছে ততই ঢালু হচ্ছে। ইঁটের গোলা, বাঁশের গোলা। খড়কাটা কল চলছে ঘস-ঘস করে।
মোচ্ছবতলাতেই আমাদের প্রথম বউনি হল। একটি লোক উদাস মুখে বসে আছে। যেন জীবনের সব কাজ শেষ। হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। মুখে অল্প অল্প কাঁচাপাকা দাড়ি। কোটরে বসে ঘোলাটে চোখ শীর্ণ-শীর্ণ হাত পা। ভাঙা গাল। বকের মতো গলা।
‘বড়মামা-আ!’
‘দেখছি।’
‘সব মিলছে। তবে নাকে তিলক-সেবা করেছে।’
‘তা করুক। বৈষ্ণব, বুঝেছিস!’ বড়মামা গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে নেমে পড়লেন। এইবার কথাটা পাড়বেন। লোকটির কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। কে তো কে। জগতে কোনও কিছুর পরোয়া করে না। এই রকম একটা ভাব। বড়মামা প্রথমে গঙ্গাদর্শন করলেন। তারপর মোচ্ছবতলায় মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। এইবার কী করেন দেখি।
লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘নমস্কার হই।’
লোকটি বললে, ‘জয় নিতাই।’
বড়মামা বললেন, ‘জয় নিতাই।’
লোকটি বললে, ‘দেশলাই আছে?’
‘দেশলাই তো নেই।’
‘সিগারেট আছে?’
‘সিগারেট তো খাই না।’ বড়মামা যেন খুব লজ্জা পেলেন।
‘জয় নেতাই। পঞ্চাশটা পয়সা হবে?’
বড়মামার মুখের দিকে চেয়ে মনে হল আশায় আলো ফুটেছে। এতক্ষণে লোকটি এমন একটা জিনিস চেয়েছে যা বড়মামার কাছে আছে। পকেট থেকে একটা গোল টাকা বের করে লোকটির হাতে হাসি হাসি মুখে দিলেন।
‘জয় নেতাই। পঞ্চাশটা পয়সা আবার ফেরত দিতে হবে না কি?’
‘না না, পুরোটাই আপনার। এইবার একটা কথা বলব?’
‘কি কথা? কেউ মরেচে নাকি?’
বড়মামা চমকে উঠলেন, ‘কেউ মরবে কেন?’
আমার সঙ্গে লোকের কথা মানে তো কেউ মরেচে,—দুখী বোস্টুম চল হে কেত্তন গাইতে হবে।’
‘না না ওসব নয়, ওসব নয়, অন্য কথা। আপনি খেতে পারবেন!’
‘খেতে? কি খেতে? শ্রাদ্ধ?’
‘না না শ্রাদ্ধট্রাদ্ধ নয়। এমনি খাওয়া। রোজের খাওয়া। ভোগ আর কি!’
‘কোন আশ্রম? আমি চরণদাস বাবাজীর চেলা অন্য ঘরে নাম লেখাতে পারব না। ধম্মে সইবে না।’
‘আশ্রম নয়। আমার বাড়িতে।’
‘কার পাচিত্তির? কি অসুখ!’
‘পাচিত্তির মানে? ও বুঝেছি। প্রায়শ্চিত্ত। না না প্রায়শ্চিত্ত নয়। জাস্ট এমনি খাওয়া।’
‘বদলে কি করে দিতে হবে? বেড়া বাঁধা, ঘুঁটে দেওয়া, চেলা কাঠ কাটা, খড় কাটা!’
‘কিচ্ছু না, কিচ্ছু না, ও সব কিচ্ছু না। রোজ একটা নাগাদ যাবেন, খাবেন-দাবেন, চলে আসবেন।’
‘কি খাওয়া!’
‘খিচুড়ি, ভাজাটাজা এই আর কি।’
‘কি ডাল? মুসুল ডাল চলবে না। মুগ হওয়া চাই।’
‘তাই হবে।’
‘কি চাল? আলো না সেদ্ধ?’
‘ধরুন সেদ্ধ।’
‘হ্যাঁ, সেদ্ধই ভালো। আলোতে পেট ছেড়ে দেবে। ও বেধবাদেরই চলে। রেশানের কাঁই বিচি চাল, না বাজারের চাল?’
‘বাজারের, খোলা বাজারের ভালো চাল।’
‘ঘি পড়বে, না খসখসে খেসকুটে? খিচুড়িতে ঘি না পড়লে টেস্ট হয় না।’
‘হ্যাঁ, তা পড়বে।’
‘শালপাতায়, না কলাপাতায়, না চটা ওঠা এনামেলের থালায়?’
‘না না, ধরুন শালপাতায়।’
‘হ্যাঁ, এনামেল হলে খাব না। তা শেষ পাতে একটু মিষ্টি না থাকলে জল খাব কি করে? বোষ্টম মানুষ। একটু পায়েস হলেই ভালো হয়।’
‘সপ্তাহে তিন দিন।’
‘রোজ হলেই ভালো হয়। যাক মন্দের ভালো। হ্যাঁ, একটা কথা, বোস্টমীকে নিয়ে আমরা সাতটি প্রাণী। সপরিবারে, না আমি একলা?’
বড়মামার মুখ দেখে মনে হল আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছেন, ‘সাত জন? বলেন কি? এ যে দেখছি মেঘ না চাইতেই জল। না না, একা নয় একা নয়। সপরিবারে।’
‘জয় নেতাই। তা হলে কবে থেকে?’
‘আজ হল গিয়ে রোববার। সোম, মঙ্গল, বুধ। হ্যাঁ বুধবার থেকে। বুধ ভালো বার।’
‘প্রভুর নিবাস?’
বাব্বা! বড়মামা প্রভু হয়ে গেলেন! মেজোমামা একবার শুনলে হয়, জ্বলে যাবেন। বড়মামা বাড়ির নির্দেশ দিতেই লোকটি বললে, ‘অ আমাদের কেদারবাবুর বড় ছেলে। সেই ছিটেল ডাক্তার।’ বড়মামার মুখটা কেমন হয়ে গেল,—’ছিটেল বললেন!’
‘ছিটেল বলব না? সবাই জানে ডাক্তারটা খেয়ালী।’
‘আমিই সেই ডাক্তার।’
‘সে আগেই বুঝেচি। হক কথা বলব, ভয়টা কিসের! উকিল আর ডাক্তার শেষ জীবনে পারের কড়ি কুড়োতে চায় ধম্মকম্ম করে। সারা জীবনের অধর্মের পয়সা। একজন মারে মক্কেল, আর একজন মারে রুগি। দেখেন না, আজকাল মন্দিরে আশ্রমে কত ভিড়! সব ওই ভেজালদার, কালোবাজারী, ডাক্তার, উকিল, এম.এল.এ. মন্ত্রী।’
ভট-ভট করে মোটরবাইকে আসতে আসতে বড়মামা বললেন—
‘কি রকম ট্যাঁকট্যাঁকে কথা শুনেছিস! ওই জন্যে লোকের ভালো করতে নেই। নেহাত সেদিন বইয়ে পড়লুম, লিভ, লাভ অ্যাণ্ড লাফ তা না হলে অ্যায়সা রাগ ধরছিল। যাক বরাতটা খুব ভালো। এই বাজারে সাত সাতটা লোক পাওয়া! বাকি রইল আঠারোটা।’
‘ভাববেন না বড়মামা। ঠিক যোগাড় হয়ে যাবে। একবার খবরটা ছড়াতে দিন।’
আরও টহল মারা হল। এবার আর চারে মাছ পড়ল না, যাক সাতটা পড়েছে। ভালো ক্যাচ। বড়মামার বৃদ্ধ কমপাউন্ডারের নাম সতুবাবু। সতুবাবুকে ভার দেওয়া হল আরও আঠারোজন সংগ্রহ করার। পারবেন তো?’
‘হ্যাঃ’ সতুবাবু অবজ্ঞার হাসি হাসলেন, ‘আঠারো কেন, আঠারোশো ধরে এনে দিতে পারি।’
বেলা বারোটা নাগাদ লোক লস্কর নিয়ে বড়মামা নেপোলিয়ানের মতো মার্চ করে বাড়ি ঢুকলেন। একজন বাগানের আগাছা পরিষ্কার করবে। একজন বাঁশ বাঁধবে। একজন উনুন পাতবে। একজন দরজা ঘিরবে। মাসিমা সেই পল্টন দেখে হাঁ হয়ে গেলেন। এখনি হুকুম হবে, ‘চা দে কুসি, চাল নে, সব ভাত খাবে।’ হই-হই ব্যাপার।
মেজোমামা এক ফাঁকে খুব গম্ভীর মুখে আমাকে ডাকলেন।
‘কি সব হচ্ছে হে! ভূতের নৃত্য!’
‘খুব মজা মেজোমামা। কত লোক আসবে। খাবে। দু’হাত তুলে যাবার সময় চিৎকার করে বলবে, জয় রাজা রাজেন মল্লিক।’
‘রাজা রাজেন মল্লিক? তোমার বড়মামা নাম পালটে ফেললে না কি? নাম ভাঁড়িয়ে শেষে এই অসৎ কাজে নেমে পড়ল?’
‘আমি কি বলতে কি বলে ফেলেছি। আসলে বলবে, জয় রাজা সুধাংশু মুকুজ্যে।’
‘রাজা! কোথাকার রাজা? কামপুচিয়ার? ওই টাইম-টেবলটা আন তো।’
ড্রয়ারের ওপর থেকে টাইম-টেবলটা এনে মেজোমামার হাতে দিলুম। একটা পাতা খুলে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম, রাত নটা চল্লিশ।’
‘কোথায় যাবেন মেজোমামা?’
‘যেদিকে দুচোখ যায়।’
‘সে কি?’
‘হ্যাঁ তাই। পাগলামি অনেক সহ্য করেছি। আর নয়।’
‘দরিদ্রসেবা পাগলামি? অসৎ কাজ?’
‘পরে বুঝবে। এখন যেমন নাচ্ছ নেচে যাও। সবুরে মেওয়া ফলবে। তখন মেও সামলাতে পুলিশ ডাকতে হবে।’
বড়মামা জিগ্যেস করলেন, ‘প্রফেসার কি বলছিল রে?’
‘বলছিলেন, অসৎ কাজের ঠেলা পরে বুঝবে কামপুচিয়ার রাজা।’
‘অসৎ কাজ!’ বড়মামা হই-হই করে হেসে উঠলেন, ‘হিংসে, বুঝলি, হিংসে। সারা জীবন ছেলে ঠেঙিয়ে কিছুই করতে পারল না। আমি এক কথায় ফেমাস হয়ে গেলুম। এখন পরিচয় দিতে গেলে বলতে হবে, সুধাংশু মুকুজ্যের ভাই। কোন সুধাংশু? আরে সেই ডাক্তার সুধাংশু, গরিবের মা-বাপ।’
‘মেজোমামা তো রাত নটা চল্লিশের ট্রেনে যেদিকে দু’চোখ যায় সেই দিকে চলে যাচ্ছেন।’
‘তাই না কি? হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী। ভজা, ভজা।’
বড়মামা পার্শ্বচর ভজা। ‘যাই বড়বাবু।’
‘চাল?’
‘আ গিয়া।’
‘ডাল?’
‘ও ভি আ গিয়া।’
‘বহত আচ্ছা। চা বানাও।’
ভজা গান গাইতে গাইতে চলে গেল। গোয়ালে গরু তিনটে ফ্যাল-ফ্যাল করে প্রায় খালি ডাবরের দিকে তাকিয়ে আছে। কালোটা হাম্বা করে উঠল। মানে, এবার দুধ দেবার চেষ্টা কর, নয়ত মালিক খুব খেপে গেছে। ন্যাজ মলে বিদায় করে দেবে।
মঙ্গলের ঊষা বুধে পা। সানাইটাই যা বাজল না। তা ছাড়া সবই হল। সকালে মন্ত্র পড়ে উনুন পুজো হল। বাঁশ থেকে ফুলের মালা ঝুলল ঝুলুর-ঝুলুর করে। কাগজের রঙীন শিকলি চলে গেল এপাশ থেকে ওপাশে। শ্যামজেঠা বেলতলায় বসে সকাল থেকে চণ্ডীপাঠ করলেন। বড়মামা মাসিমাকে ডেকে বললেন, ‘কুসি, সকালে আমি আর তোদের বাড়িতে খাব না। সকলের সাথে ভাগ করে নিতে হবে অন্নপান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। আমি হর্ষবর্ধন। সঙ্গমে স্নান করে নিজের পরনের কাপড়টা পর্যন্ত দান করে দোব…।’
‘তারপর নেংটি পরে কুয়োতলায় ধেই-ধেই করে নাচব।’ মাসিমা রেগে চলে গেলেন।
মেজোমামা দোতলার বারান্দা থেকে মাসিমাকে চিৎকার করে বললেন, ‘ভুলে যাসনি, আমার ট্রেন রাত নটা চল্লিশে।’
ওদিকে বেলতলায় শ্যামজেঠার উদাত্ত গলা, ‘রূপং দেহি, যশো দেহি।’
জোড়া উনুনে আগুনে পড়েছে। গল-ল করে ধোঁয়া উঠেছে আকাশের দিকে গাছের ডালপালা ভেদ করে।
মেজোমামা খুব উত্তেজিত হয়ে বারান্দায় পায়চারি করতে করতে বললেন, ‘সেই সাতসকাল থেকে দেহি দেহি শুরু হয়েছে। যার অত দেহি দেহি সে হবে দাতা কর্ণ?’
ছটা কুকুর বাড়ি একেবারে মাথায় করে রেখেছে। যত অচেনা অচেনা লোক দেখছে ততই ঘেউ-ঘেউ করছে। মাসিমা গ্লিসারিন তুলো ভিজিয়ে কানে গুঁজে রেখেছেন। কোনও কথাই শুনতে পাচ্ছেন না।
সে এক জ্বালা! জল চাইলে তেল এনে দিচ্ছেন।
পেয়ারা গাছের ডালে কাঁসার ঘড়ি বাঁধা হয়েছে। সাবেক কালের জিনিস। বেলা একটার সময় ঠ্যাং করে বাজিয়ে ঘোষণা করা হবে—শুরু হল। সবাই বসে পড়।
দেখতে দেখতে একটা বেজে গেল। ভজুয়া দাঁত মুখ খিঁচিয়ে, চোখ বন্ধ করে, দু’হাতে একটা লোহার রড ধরে ঘড়িতে ঘা মারল। সারা এলাকা কেঁপে উঠল ঠ্যাং শব্দে। আওয়াজ বটে। কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়।
সবার আগে এল জয় নিতাইয়ের দল। সপরিবারে, হই-হই করে। সকলেরই নাকে নিখুঁত রসকলি।
বোষ্টম, বোষ্টমী, গেঁড়ি গেঁড়ে ছেলে মেয়ে। এটা লাফায়, ওটা ছোটে। বড়টা ছোটটার মাথায় গাঁট্টা মারে। ছোটটা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। মা সবকটাকে ধরে পাইকারি পিটিয়ে দেয়। ‘ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি’, শ্যামজেঠার আর্তনাদ।
‘বসে পড় সব, বসে পড় সব।’
ফোলডিং চেয়ার উলটে চার বছরের ছেলেটা মাটিতে চিৎপাত হল। বুকের ওপর চেয়ার। পায়ায় ঠ্যাং জড়িয়ে গেছে।
‘জয় নেতাই, পড়ে গেছে রে বাপ। খেঁচকে তোল আপদটাকে।’
‘তুলসী গাছ কোন দিকে?’
‘তুলসী গাছ কি হবে গো?’ ভজুয়া জিগ্যেস করল।
‘দূর বেটা খোঁট্টা। তুলসীপাতা ছাড়া ভোগ হয়!’ বড়মামার তুলসীঝাড় ফাঁক।
‘পঁচিশ কোথায়? পিল-পিল করে লোক আসছে।
বড়মামা আঁতকে উঠলেন, ‘মরেছে, এ যে রাজসূয় যজ্ঞ রে! হাঁড়ি নয়, ড্রাম ড্রাম খিচুড়ি লাগবে। স্টপ দেব? অ্যানাউনস করে দে, পঁচিশ জনের বেশি নয়। গেটটা বন্ধ করে দে রাশকেল ভজুয়া।’
‘গেট বন্ধ করে আটকান যাবে না ডাগদারবাবু। গেট টপকে চলে আসবে।’
‘ধাক্কা মেরে বের করে দে।’
‘মেরে শেষ করে দেবে বাবু!’
বড়মামা গলা চড়িয়ে বললেন, ‘শুনুন, শুনুন, আমাদের এই আয়োজন মাত্র পঁচিশ জনের জন্য।’
প্রত্যেকেই চিৎকার করে উঠল, ‘আমি সেই পঁচিশজনের একজন।’
‘তা কি করে হয়! এখানে অনেককেই দেখছি যাঁরা টেরিকটনের প্যান্ট শার্ট পরে এসেছেন। বড় বড় চুল। দে আর নট গরিব।’
চিৎকার উঠল, ‘আমরা মডার্ন গরিব। বেকার বসে আছি বছরের পর বছর।’
‘আমি মডেল গরিব বেছে নেব।’
‘বেছে নেব মানে? এটা কি স্টেট লটারি? কে বেছে নেবে?’
বড়মামা খুব অসহায়ের মতো বললেন, ‘সে কি রে বাবা। এরা যে দেখছি তেরিয়া হয়ে উঠছে। বেশ, জোর যার মুলুক তার। আপনারা পঁচিশ জন বাকি সকলকে ঠেকিয়ে রাখুন। তাজিয়া কাজিয়া যা হয় নিজেরাই ফয়সালা করুন।’
মার, মার, হই হই, রই রই। হে রে রে রে করে লোক ঢুকছে। যেন দশ আনার টিকিটের সিনেমার কাউন্টার খোলা হয়েছে। ভজুয়া পালাতে পালাতে বলল, ‘আরও আসছে বাবু। নারায়ণকা জলুস নিকলেছে আজ।’
শ্যামজেঠা পালাতে পালাতে বললেন, ‘সুধাংশু, প্রাণে যদি বাঁচতে চাও, পেছনের দরজা দিয়ে পালাও।’
বড়মামা ভয়ে পেছনে পেছনে বললেন, ‘য পলায়তি স জীবতি। ব্যাপারটা বুফে-লাঞ্চের মতো হয়ে গেল। যে পারে সে নিয়ে খাক।’
চেয়ার ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হয়ে গেছে। বাঁশের খুঁটি উপড়ে ফেলেছে। একপাশের সামিয়ানা কেতরে গেছে। পেছনের দরজা দিয়ে রাস্তায় পড়ে বড়মামার লাল মোটরবাইক তীরবেগে পশ্চিমে ছুটছে। মেজোমামা কাঁপতে কাঁপতে টেলিফোন ডায়াল করছেন—
‘হ্যালো থানা। নরনারায়ণে বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছে। বড় বড় থান ইট ছুঁড়ছে। ও সেভ আস, সেভ আস।’
ছটা কুকুর বাগানে নেমে পড়েছে খেপে গিয়ে। মাসিমার কানে অ্যায়সা তুলো ঢুকেছে কিছুতেই বের করতে পারছেন না। মাথার কাঁটা, দেশলাই কাঠি, যতই খোঁচাখুঁচি করছেন গ্লিসারিন-তুলো ততই ভেতরে চলে যাচ্ছে। কেবল বলছেন, ‘এখনও চণ্ডীপাঠ হচ্ছে! শিলাবৃষ্টি হচ্ছে না কি রে।’
মেজোমামা রিসিভার চেপে বলছেন, ‘আর দাঁড়াতে পারছি না। আমার পা কাঁপছে। প্যাণ্ডিমোনিয়াম! আরে দূর মশাই হারমোনিয়াম নয়, প্যাণ্ডিমোনিয়াম।’