লঙ্কাদহন পালা
ফটিক অবশ্য কালোয়াতি গান নিয়ে থাকে। তিন বছর ধরে মাত্র তিনখানা গান নিয়েই এন্তার বমি করে চলেছে। বলে-রাগ রাগিণীর ব্যাপার, সাধনার দরকার।
ইদানীং পটলার নাটকে সে সুর সংযোজনা করেছে। সুতরাং ফটিক বলে—থাম দিকি হোঁৎকা ! নাটক দিয়েই এবার পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব সমাজসেবার কাজ করবে।
পটলাও বলে –সিওর!
এর মধ্যে ম্যারাপ বেঁধে পটলার নতুন নাটক ‘আমরা কারা’ মঞ্চস্থ হয়েছে। পটলার ছোটকাকা আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক । পাড়ায় গাছে-দেওয়ালে পটলার নাটকের পোস্টার পড়েছিল। হোঁৎকাও কোনো অরিজিন্যাল বাস্তুহারার রোল করেছে খাঁটি বাঙাল ভাষায় ৷ ওটা ছাড়া অন্য ভাষায় ওর বোল ফোটে না। দারুণ করেছিল।
আমার অভিনয়ের জন্য একটা রৌপ্যপদক ঘোষণা করা হল, পটলার নামে ঘোষণা করা হল তিনখানা, অবশ্য তার একখানাও এতাবৎ হস্তগত হয়নি। ওরা কবুল করেই চুপ করে গেছে।
তবুও আরা এবার জোর কদমে নাট্য আন্দোলনে ভিড়ে পড়েছি।
পটলা সেদিন খবরটা আনল। ওর পিসতুতো ভাই এসেছে হাড়ভাঙা বসন্তপুর থেকে, ওদের অজগ্রামেও এখন নাকি রীতিমত সাংস্কৃতিক চেতনার মশাল জ্বলে উঠেছে। গ্রামের বাৎসরিক ধর্মরাজ পুজো উপলক্ষে তারা কলকাতা থেকে আমাদের নাটকের দলকে নিয়ে যেতে চায়।
পটলার ‘আমরা কারা’ নাটকের সুখ্যাতি তারাও শুনেছে। তাই ধেয়ে এসেছে।
হোঁৎকা বলে— হালায় অজ পাড়াগাঁয়ে যাবি পটলা ?
হোঁৎকা কলকাতাতেই মানুষ হয়েছে। পাড়াগ্রাম সম্বন্ধে তার একটা এলার্জি রয়ে গেছে। পটলা নাটকের জন্য ডাক পেয়ে বোধহয় সুমেরু কুমেরুতেও চলে যাবে। সে বলে— কেন যাবি না? পল্লীর অন্ধকার ত-তমশার মাঝেও ন্-নাটকই পথ প্রদর্শন করতে প্––
আমি পাদপূরণ করি— পথ দেখাতে পারে।
পটলা এবার ইংরেজিতে মন্তব্য করে—করেকট। তাই এ আমন্ত্রণ আমরা নেবই ।
ফটিক বলে— নিশ্চয়ই। এ আমাদের পুণ্যব্রত। যেতেই হবে সেখানে।
হোঁৎকা বলে— কুনো ঝামেলা হইব না তো?
পটলার পিসতুতো ভাই-এর চেহারাটা শীর্ণ, মাথাটা বেশ বড়সড়। তাতে বাবরি চুলও রয়েছে। দেখতে অনেকটা খ্যাংরা-কাঠির মাথায় আলুর দমের মতই। নামটাও বেশ জবরদস্ত। চঞ্চলকুমার।
চঞ্চলকুমার বলে ওঠে— তাদের দেশজ বীরভূমী ভাষায়, কুন শালো কি করবেক হে? খেঁটে লাদনার বাড়িতে উদের পিন্ডি চটকাই দিব না? রং চালাকি! তবে পটলা, একটো ডাংসার লিয়ে যেতে হবেক। পালার আগে দু’একটা লাচ লাগাই দিবি।
আমি বলি—নাচ! আমাদের নাটকে ওসব তো নেই। ইঙ্গিতধর্মী নাটক তো।
চঞ্চল বলে— লাচ কিন্তুক চাই হে! বোতল নিত্য, জিপসি লাচ, না হয় ডিকো লাচ চাই কিন্তুক !
পটলা বলে— হবে। ডিসকো নাচও হবে ।
চঞ্চল খুশি হয়ে বলে—তাহলে তো আর কথাই নাই। ব্যস। ওই কথাই রইল। সামনের মাসে তেরো তারিখ সকালের বাসে ইখান থেকে যেয়ে দুর্বরাজপুরের আগে হাড়ভাঙা বসন্তপুরের মোড়ে নেমে পড়বি। উখান থেকে আমরা লিয়ে যাবো । হুঁ!
যাবার গাড়িভাড়া আর ড্রেস-মেআপ বাবদ শ দুয়েক টাকাও দিয়ে গেল। চঞ্চল বলে— লাইট-ফাইট সিউড়ি থেকে আসবেক। ফকাস্ যা দিবেক দেখে লিবি বটে পটলা। লাল, লীল, বাসন্তী রং যা চাইবি সব পাবি ।
হোঁৎকা চুপ করে আছে।
চঞ্চল বলে চলেছে—আর খাওয়ন-দাওয়নও হবেক জোর-
এবার আহারের নাম শুনে হোঁৎকা একটু চঞ্চল হয়। শুধোয় সে—মাছ-মাংস থাকবো নিশ্চয়?
চঞ্চল বলে— হেঁই দ্যাখো? দশ বারো সেরি ঘেঁটো রুই খাওয়াবো হে। আর মাংস? একটো ইয়া খাসি রেখেছি, গাদাড়ে দিব। আর হাড়ভাঙার দইও দেখবা, হাঁড়ি ফাঁটাই দাও, দই টুকিবেনও পড়বেক নাই। ত্যামন দই দিব হে।
ঘনঘন রিহার্সেল হচ্ছে। আর টেপরেকর্ডারে ডিসকো মিউজিকের তালে তালে কানা বিশেও এবার নাচের মহড়া জোরদার করে তুলেছে।
পটলা তখন টিম নিয়ে এবার দূরপাল্লার বাসে যাবার আয়োজন করছে।
এর আগে এত দূরে অভিনয় করতে আসিনি। শালবন-অজয় নদী পার হয়ে বাসটা চলেছে, বেলা তখন প্রায় এগারোটা। কনডাকটার একটা মাঠের মধ্যে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলে হাড়ভাঙা বসন্তপুর মোড়। নেমে পড়ুন।
আমরা স্যুটকেস, ব্যাগ, ওদিকে সাজের বাক্স-টাক্স নিয়ে হড়বড়িয়ে নামলাম, বাসও আমাদের বাতিল মালপত্রের মত এই ধাপধাড়া গোবিন্দপুরের মাঠে ফেলে দিয়ে চলে গেল। একটা পুরোনো বটগাছ-এর নীচে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান মত। বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি দুটো মাচা, ও-দুটোই বেঞ্চের কাজে লাগায় দোকানদার।
হোঁৎকা বিবর্ণ মুখে বিড়বিড় করে— ক্ষুধা পাইছে—কইল মাছ মাংস, ভরপেট দইও দিবে। হালায় ওগোর পাত্তাই দেহি না রে পটলা !
রোদও বেড়ে উঠেছে। দেখছি এদিক ওদিকে। পটলাও বিপদে পড়েছে। হঠাৎ তিন চারজন ছেলেকে সাইকেল নিয়ে আমাদের দিকে আসতে দেখে চাইলাম। ওদেরই একজন এগিয়ে এসে শুধোয়—কলকাতা থেকে আসা হচ্ছে? এ্যাঁ!
ছেলেটার গোঁফজোড়াটা বেশ জমজমাট। গলাটাও একটু কর্কশ। পটলা আশাভরে বলে—হ্যাঁ। আপনারা হাড়ভাঙা বসন্তপুর থেকে আসছেন? চঞ্চলদা পাঠিয়েছে?
অন্যজন বলে—উসব চলবেক নাই হে। হাড়ভাঙা বসন্তপুরে ঢুকবা নাই তুমরা। ইখান থেকেই পরের বাসে পানাগড় চলে যেতে হবেক।
অবাক হই—–সেকি? এতদূর এলাম নাটক করতে, শেষকালে ফিরে যেতে হবে? কেন? ছেলেটা এবার গোঁফে চাড়া দিয়ে বলে, কেনে-মেনে বুঝি না। গাঁয়ে ঢুকলে হাড় গুঁড়ো করে দোব। গাঁয়ের নামটা জানো তো?
এবার চমকে উঠি। হাড়ভাঙা নামটা শুনে তখনও ঠিক বুঝিনি।
এবার মনে হয় সত্যিকার ওইসব কাজ এরা করে তাই ওই নামটাই বহাল হয়েছে এ গ্রামের।
হোঁৎকা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। এই সব শাসানি শুনে এবার হোঁৎকা এগিয়ে আসে। খিদের চোটে জ্বলছিল আগেই, এবার ওদের কথায় জ্বলে উঠে হোঁৎকা ওদের একজনকে ধরে ফেলেছে। বলে হোঁৎকা—কি কইলা? হালায় কলকাতার কুলেপাড়ার জিনিস, আমাগোর ওই একখ্যান গাঁয়ের নাম কইরা ভয় দেখাবো? আমাগোর হাড় ভাঙার আগে তোমার গোঁফখানই খুইলা লমু !
ছেলেটা চমকে উঠেছে। ফটিক নির্বিরোধী টাইপের ছেলে। বিদেশে এসে এসব ঝামেলা সে পছন্দ করে না। তাই ওকে হোঁৎকার হাত ছাড়িয়ে বলে— থাম্ হোঁৎকা। যাও ভাই তোমরা । ছেলেটা ছাড়া পেয়ে তার সহচর দুজনকে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে বলে—ঠিক আছে। বললাম যাবেন না, তারপরও যদি যান তখন দেখা যাবে।
আমরাও ভাবনায় পড়েছি। গলা শুকিয়ে আসছে। কানা বিশের নাচের পোজ থেমে গেছে। সে বলে— কাজ নাই গাঁয়ে গিয়ে, ফিরে চল।
সেই চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি। দোকানদারই জানায় ফেরার বাস সেই বেলা তিনটেয় ।
অর্থাৎ সারা দুপুর শুধুমাত্র লেড়ো বিস্কুট চিবিয়ে বসে থাকতে হবে এখানে। ওদিকে সেই ছেলেরাও দেখছে আমাদের।
গতিক ভালো বুঝছি না। তাই বলি—ফিরেই চল পটলা। চঞ্চলদারাও কেউ এল না, গ্রামের ছেলেরা এসে শাসাচ্ছে, ওখানে নাটক করতে যাওয়া ঠিক হবে না ।
হোঁৎকা গর্জায়—ওগোর শাসানি ছুটাই দিমু !
এমন সময় দেখা যায় দূরের গ্রাম থেকে শ’খানেক লোকজন ছেলেপুলে লাঠি উঁচিয়ে মত্ত কলরবে বড় রাস্তার দিকে ধেয়ে আসছে। ভয় পেয়ে যাই। মনে হয় এবার ওই ছেলেগুলোর কথা না শোনার জন্যই বোধহয় মারধরই করতে আসছে তারা।
নাটক করতে এসে পটলার জন্যে প্রাণটা বেঘোরে দিতে হবে তা ভাবিনি। বলি—পটলা ! এবার মেরে ফেলবে রে!
হঠাৎ দেখি ওই দলবলকে ছুটে আসতে দেখে ওদিকের তিনটি ছেলে উঠি কি পড়ি ভাবে সাইকেলে চেপে বড় রাস্তা দিয়ে দৌড় মারল, ওই মাঠ থেকে আগত দলেরও কিছু ছেলে ওদের তাড়া করেও ধরতে পারল না৷
ভিড় থেকে চঞ্চলদা এবার বের হয়ে এসে বলে, আইচ হে তুমরা। বুঝলা ভায়া—গাঁয়ে শালোরা কিষ্ট যাত্রা করাবেক; তাই লিয়ে তক্কো, কিষ্ট যাত্রা হবেক লাই, কলকাতার নাটক হবেক। শালোদের হঠাই দিলম্। চলো—
বিবাদের নমুনা কিছুটা বুঝেছি। ওরা তাই আগে এসে আমাদের তাড়াতেই চাইছিল। ফটিক বলে—ওখানে আর নাটক করে কাজ নাই পটলা। টেপরেকর্ডার, লাইট-ফাইট যদি ভেঙে দেয় ?
ভাববার কথা। তাই বলি, ঠিক বলেছিস ফটিক। পটলা, তিনটের বাসে ফিরে চল। আর নাটক করে কাজ নাই !
গোবরাও সায় দেয়। কানা বিশে তো আগেই তার মতামত জানিয়েছে। আমাদের অন্যতম অভিনেতা নিতুও তাই বলে—সেই ভালো। ওদের গোলমালের মধ্যে আমরা কেন যাব? ভোটের জোরে পটলাও এবার মত বদলায়। তাহলে ফিরেই চল।
ভরপেট মাছ-মাংস ফস্কাবার দুঃখে হোঁৎকা ম্রিয়মান। কিন্তু ও পক্ষ এবার অন্য মূর্তি ধরে। সিঁটকে মত একজন লাঠি উঁচিয়ে বলে—ফিরে যাবে? এ্যা-রং চালাকি পেয়েছ? এ গাঁয়ের নামটা জানো? হাড়ভাঙা বসন্তপুর। হাড় ভেঙে পাউডার বানিয়ে দোব। মানে মানে গাঁয়ে চলো—‘পেলে’ করো, ব্যস্। বাপের সুপুত্তুরের মত ফিরে যাবে।
অন্যজন গর্জে ওঠে— না হলে কলকাতার মুখ আর দেখতে হবেক লাই, লাশগুলান দিঘির পাঁকের লীচে পুঁইতে দিব।
পটলা এবার আর্তনাদ করে ওঠে—চঞ্চলদা?
চঞ্চল এখন গদিচ্যুত। সেই বীরপুঙ্গবই শোনায়—চঞ্চলে কি করবেক হে? গাঁয়ের মাথাটি হেঁট করে চলে যাবে, তা সইব লাই। চলো-
অজ পাড়াগ্রাম। আমাদের নিয়ে গিয়ে ওদের ক্লাবঘরে তুলেছে। উঁচু পুকুরের পাড়—সেখানে খড়ের লম্বা ঘরটাই ওদের লাইব্রেরি-কাম-ক্লাবঘর, গ্রামের বাইরেই।
ওদের দলপতির নাম ভূষণ। সে-ই বলে— আজ গোলমালে মাছটাছ ধরানো হয়নি, ছাগল কাটাও হল না। এদের মহেশবাবুর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে আন। কাল দেখা যাবে।
ক্লাবের নীচে পুকুরে স্নান করে গ্রামের মধ্যে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে খেতে গেলাম। হোঁৎকা খেতে বসেই গুম হয়ে গেছে। লাল বোগড়া চালের ভাত, হড়হড়ে বিরিকলাই-এর ডাল, ডিংলার তরকারি, তৎসহ আলুপোস্ত আর টম্যাটোর উগ্র টক।
“হোঁৎকা বলে—পটলা, হেই চঞ্চলদা কনে গ্যাল র্যা, ঘেঁটো রুই, মাংস—হালায় গুল দিবার জায়গা পায় নাই ।
চঞ্চলদাকে ওরা পাত্তাই দেয়নি, এখন আমরা এদের ডিরেক্ট চার্জে এসে গেছি। হাঁড়িতে জিইয়ে রাখা কইমাছের মত। হোঁৎকা কোনোরকমে খাওয়া সেরে উঠল।
সন্ধ্যার পর থেকেই আটচালায় লোকের ভিড় শুরু হয়েছে। ফাঁকা মাঠে চট, তালাই পেতে ওরা সপরিবারে বসেছে, কেউ দিনভোর মাঠে ধান কেটে এসেছে গান শুনতে। ভটভট শব্দে জেনারেটার চলেছে। তার লাল নীল বেগুনি আলোয় কানা বিশে গো গো চশমা পরে মাইকে বাজানো ডিসকো বাজনার তালে বেতালে বিকটভাবে লম্ফ-ঝম্ফ করে চলেছে।
চড় চড় শব্দে দর্শকবৃন্দের হাততালি পড়ে। কারা আবার চিৎকার করে—এঙ্কোর এঙ্কোর-অর্থাৎ আবার লাগাও ।
আমি নজর রেখেছি সেই আগেকার দল যেন কোনো গোলমাল না করে। অবশ্য সে ব্যাপারে ভূষণ-চঞ্চলদারাও সজাগ। তাদের দেখাও যায় না।
এবার পটলার অমর অবদান ‘আমরা কারা’ নাটক শুরু হল। ইঙ্গিত-ধর্মী নাটক, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্রেফ পা-হাত ছুঁড়ে গতিময়তা, নাটকীয় মূহূর্ত আনতে চেষ্টা করছি,আর নাটকের চরিত্রগুলোও দুর্বোধ্য, পটলাই তার মানে জানে। (অবশ্য মানে টানে শুধোলে পটলাও চটে যায়) তবু ওই চট-তালাই-এর শ্রোতারা কেবল হাততালি দিয়ে চলেছে। কলকাতার নাটক না বুঝতে পারলে নাকি তাদের গেঁইয়া বলবে। তাই ঘনঘন মাথা নেড়ে হাততালি দিচ্ছে।
পটলার সরল পুঁটির মত জীর্ণ বুকের খাঁচাটা ফুলে ওঠে। বলে সে—দেখছিস কেমন নাটক বোঝে এরা?
অবশ্য এ নাটক বিশেষ কোথাও পুরোপুরি ভাবে শেষ করতে পারিনি। কোথাও ইট্, কোথাও আধলা, কোথাও টম্যাটো, কোথাও পচা ডিম, আবার কোথাও স্রেফ চিৎকার করে পিনিক দিয়ে আমাদের ড্রপ ফেলতে বাধ্য করিয়েছে। এখানে সেটা হল না। নাটক শেষ হল। পটলা আর গোবরা দুজনে কুস্তির পোজে দাঁড়াল-লাল আলো পড়ল, আর হাততালি-সিটি সমানে চলেছে।
পটলা খুব খুশি, পুরো নাটক হয়েছে। বলে সে- রিয়েল নাট্যপ্রেমীদের জায়গা। কাল ভাবছি আর একটা নাটক ‘আধখানা রুটি’ করব।
হোঁৎকা রাতেও খেতে বসে দেখে কুমড়োর ঘ্যাঁট উইথ সজনে ডাঁটা, আর চিংড়িমাছের টক ।
হোঁৎকা গর্জে ওঠে—তুই একাই নাটক করোস। আমরা কাল ভোরেই চইলা যামু। এই হালায় ঘেঁটো রুই, এই তগোর মাংস।
রাত হয়েছে। একটু ঝিমুনি এসেছে। হঠাৎ দরজাটা কাদের বাইরে থেকে বন্ধ করতে দেখে চাইলাম। সারা গ্রাম নাটক দেখে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। নিশুতি গ্রাম। হঠাৎ বাইরে থেকে কাদের দরজা বন্ধ করতে দেখে চমকে উঠি।
এ্যাই! কে―কে?
সাড়া নেই। দরজাটা বাইরে থেকে শিকল তোলা। খোলার উপায় নেই। হঠাৎ দেখা যায় খোলা জানালা দুটোর সামনে দুটো আংরা ভর্তি মালসা, আগুনের তাপ গনগন করছে, আর সেই জ্বলন্ত আংরার উপর কি ফেলে ফুঁ দিয়ে সমস্ত ধোঁয়া দুটো জানলা দিয়ে এই বদ্ধ ঘরে ঠেলে দিচ্ছে।
পরক্ষণেই বুঝতে পারি ব্যাপারটা। পটলা বিকট শব্দে হাঁচছে— গোবরাও। উৎকৃষ্ট পাটনাই সুপক্ক লঙ্কার গুঁড়ো দিচ্ছে ওই মালসায় আর লঙ্কাপোড়ার ঝাঁঝালো সব ধোঁয়াটা এসে ঢুকছে এই বদ্ধ ঘরে।
নাক জ্বালা করছে, চোখমুখ দিয়ে জল ঝরছে আর হাঁচি। ঘরসুদ্ধ সবাই হাঁচছি, চিৎকার করার মত দমও নেই। মনে হয় এই বদ্ধ ঘরে হাঁচতে হাঁচতেই শেষ হয়ে যাবে। পটলার নাটকের জন্য শহিদ হতেই হবে বোধ হয়।
ধোঁয়ায় ঘরটা ভরে উঠেছে। ভিতরে একটা চাপা আর্তনাদ, হাঁচির শব্দ ওঠে। হোঁৎকা প্রাকৃতিক ব্যাপারে বাইরে এসেছিল, হঠাৎ ওই লঙ্কাপোড়ার ব্যাপার দেখে সে হকচকিয়ে গেছে। তারার আলোয় দেখা যায় রাস্তায় প্রথম দেখা সেই গোঁফওয়ালা ছেলেটাই তার দলবল নিয়ে এসেছে এবার এদের সযুত করতে।
ওরা তাক বুঝে ধোঁয়া দিচ্ছে, হোঁৎকাও অতর্কিতে লাফ দিয়ে পড়ে ওর পুরুষ্টু গোঁফজোড়াটা হাতে পাক দিয়ে দড়ির মত ধরেছে, অন্যটার মাথার লম্বা চুল ধরে দুটোকে মালসার আগুনে মাথাগুলো এনে ফেলতেই ওরাও লঙ্কার ঝাঁঝে বিকট শব্দে হেঁচে ওঠে। অন্য দুজন বেগতিক দেখে মালসা ফেলে হাওয়া।
এ দুটো বন্দি ইঁদুরছানার মত চিঁ চিঁ করছে আর হাঁচছে বিকট শব্দে। ঘরের ভিতর থেকে পটলা-গোবরারা চিৎকার করছে।
সারা গ্রামের লোকজন জেগে গেছে, আবার লাঠি সড়কি নিয়ে তারা চিৎকার করে এসে হাজির হয় ৷
লম্বা চুলওয়ালা তখন প্রাণের দায়ে হোঁৎকার হাতে একগোছা চুল রেখে পালাবার জন্য লম্ফ দিতে টাল খেয়ে উঁচু পাড় গড়িয়ে শীতের রাতে ভাদুরে পাকা তালের মত বহু নীচে পুকুরের কাদাজলে পড়েছে।
গ্রামের জনগণ তখন পুকুর ঘিরে তার সন্ধান করছে আর গোঁফওয়ালা ওই বাহারি গোঁফের জন্যই বমাল ধরা পড়ে গেল লঙ্কাগুঁড়ো আংরার মালসা সমেত ।
এবার মুক্ত হয়ে আমরাও ঘোষণা করি—এখানে কোনো ভদ্রলোকের বাস নাই। ডেকে এনে নাটক করিয়ে প্রাণে মারতে চায় এরা।
এবার গ্রামের মহেশবাবু আরও দুচারজন মাতব্বর এগিয়ে এসে ভূষণদেরই কড়া স্বরে বলেন—এভাবে গ্রামের বদনাম হতে দেবো কেন ?
ভোরবেলাতেই জাল নেমেছে পুকুরে। ক্লাবঘর থেকে মহেশবাবুর চকমিলানো বাড়ির বৈঠকখানার ফরাসে এসেছি। আর আট দশ কেজি নধর মাছ, তাজা খাসি, আর সেই হাঁড়িভাঙা, জমাট দুই— সব কিছুর আয়োজনই করেছেন মহেশবাবু।
পটলা বলে—তাহলে আর একপালা হোক ‘আধখানা রুটি।’ আমি ভয়ে ভয়ে শুধোই-আর ‘লঙ্কা দহন’ হবে না তো ?
মহেশবাবু বলেন—সে হনুমানদের মেরে হাড় ভেঙে ফেলে রেখেছি। শুনে চুপ করে যাই। হাড়ভাঙা বসন্তপুর থেকে অক্ষত অবস্থায় বেরুতে পারলে বাঁচি।