৫
যথাসময়ে মহাসমারোহে বিবাহ সম্পন্ন হলো লগ্ন-ইফতির। লগ্ন খানিক দুশ্চিন্তায় ছিল, বিদায়ের সময় যদি কাঁদতে না পারে, তাহলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে? দুশ্চিন্তারও যথেষ্ট কারণ আছে। কান্নার কোনো সম্ভাবনা তো দেখা যাচ্ছেই না, উলটো আনন্দ হচ্ছে। কথায় কথায় সে কেবল হাসছে। ভীড়ের ভেতর থেকে মুরব্বি ধরণের এক ভদ্রমহিলা তো বলেই ফেললেন, ‘ওমা বিয়ের কনের এত হাসি কীসের? বলছে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। তলে তলে দেখো গিয়ে প্রেমের বিয়ে।’
কিন্তু বাস্তবে ঘটনা ঘটল অন্যরকম। বিদায়ের সময় কোত্থেকে এত মন খারাপ ভর করল লগ্নর ওপর। বাবা-মায়ের দিকে তাকাতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
বিদায় পর্ব শেষে যখন গাড়ি ছাড়ল লগ্ন তখনো কাঁদছে। ইফতি এক পর্যায়ে বলল, ‘তুমি চাইলে আমরা কালও যেতে পারি।’
লগ্ন ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ইফতি বলল, ‘না মানে যেভাবে কাঁদছো, খারাপ লাগছে। তাই ভাবলাম একটা অপশন দিই।’
এ কথায় লগ্ন হেসে দিলো। এরপর ধীরে ধীরে খারাপ লাগা কিছুটা কমে গেল। মজার ব্যাপার হচ্ছে ঠাকুরগাঁও যেতে যেতেই মন খারাপ অনুভূতিটা ভালোলাগায় রূপান্তরিত হলো। একটা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। একটু ভয়, একটু উৎকণ্ঠা আর অনেকখানি ভালোলাগা, সব মিলিয়ে বারবার শিহরিত হচ্ছে।
ঠাকুরগাঁও পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। সেই রাতেও ইফতিদের বাড়িতে নতুন বউ দেখার ঢল নামল। ভারী কাপড়চোপড় পরে থাকতে লগ্নর একটু কষ্ট হচ্ছিল। তবুও কাপড় বদলালো না সে, নতুন বউয়ের তো নতুন বউয়ের মতোই থাকা চাই।
রাত বাড়লে ভিড় কিছুটা কমে এলো। ঘর একেবারে খালি হয়ে গেলে ইফতি এসে বলল, ‘আমার বউ আমিই ভাগে পাচ্ছি না। কী আজব সোসাইটি!’
লগ্ন মুখ টিপে হাসল। ঠিক তখনই আবার ইফতির বাবার গলা পাওয়া গেল। তিনি ইফতিকে ডাকছেন।
ইফতি বিরক্তমুখে ঘর থেকে বের হবে তখন লগ্ন বলল, ‘শোনো।’
ইফতি দাঁড়াল। পেছন ফিরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই লগ্ন বলল, তোমার কি নতুন বউয়ের সাজপোশাক নিয়ে কোনো ফ্যান্টাসি আছে?’
ইফতি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘মানে?’
‘না মানে… থাকলে অপেক্ষা করব। না থাকলে গোসল করে বাসার জামা পরব।’
এবার লগ্নর কথার অর্থ বুঝতে পারল ইফতি। অবাক হয়ে কাছে এসে বসল। তারপর বলল, ‘তুমি ভাই দুষ্টু আছ। দেখলে বোঝা যায় না।’
লগ্ন চোখ নামিয়ে হাসল। তারপর বলল, ‘যাও তো, বাবা ডাকছেন।’
‘হুম। আচ্ছা আমার ওরকম কোনো ফ্যান্টাসি নেই। তোমার স্বাচ্ছন্দ্যই সবচেয়ে বড় কথা। নিশ্চিন্তে গোসলে যেতে পারো।’
ইফতি দরজার কাছে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘরে একটা টিকর্ণার আছে তার। সেখানকার ইলেকট্রিক কেটলিটা দেখিয়ে বলল, ‘কেটলিতে পানি গরম করে নিয়ো। এই শীতের রাতে ঠান্ডা পানিতে গোসল করলে নির্ঘাত ঠান্ডা লাগবে।’
লগ্ন অনেক সময় নিয়ে কুসুম গরম পানিতে আরাম করে গোসল করল। সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে গেল। গোসল করে বেরিয়ে দেখে ইফতি এরমধ্যেই জামাকাপড় পালটে ফেলেছে। ঘরে পরার সাধারণ ট্রাউজার আর টিশার্টে তাকে আরো বেশি সুন্দর আর নিজের মানুষ বলে মনে হচ্ছে। সোফায় আধশোয়া দেখে লগ্ন জিজ্ঞেস করল, ‘ক্লান্ত লাগছে?’
‘তেমন না। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’
ইফতি উঠে বসল। লগ্ন চুল শুকাতে শুকাতে বলল, ‘আমার কেবল আফসোস হচ্ছে।’
‘কেন?’
‘এইযে কদিন পরই তুমি চলে যাচ্ছ।’
ইফতি হেসে বলল, ‘এসব ভাবলে খারাপ লাগবেই। তাই এসব ভেবে বর্তমানটা নষ্ট কোরো না। যে কদিন আছি একদম মন খারাপ করা যাবে না।’
লগ্ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চুল শুকানো হয়ে গেলে চুলগুলো আঁচড়ে নিচ্ছিল।
তখনই ঘরের দরজায় টোকা দিলেন শাশুড়ি। ইফতি দরজা খুলতেই তিনি বললেন, ‘লগ্নর হলো?’
ইফতি কিছু বলার আগেই লগ্ন বলল, ‘জি মা, হয়ে গেছে।’
শাশুড়ি বললেন, ‘খেতে এসো মা। রাত বারোটা বেজে গেছে। এত মানুষজন এলো, এদের বিদেয় করে সব রেডি করতে করতে দেরি হয়ে গেল।’
লগ্ন হেসে বলল, ‘কোনো অসুবিধা নেই মা।’
.
খাওয়াদাওয়া শেষ করে টুকটাক গল্পগুজব করতে করতেই রাত একটা বেজে গেল। তারপর সবাই যার যার ঘরে গেলে লগ্ন ইফতি তাদের ঘরে এলো। লগ্ন এবাড়িতে এসেই বিছানাটা ফুল দিয়ে সাজানো দেখেছে। কিন্তু তখন স্বাভাবিক লাগলেও এখন লজ্জা লাগছে। কী করবে বুঝতে পারছিল না সে। ইফতিই সব সহজ করে দিলো।
বলল, ‘বিছানাটার করেছে কী!’
তারপর সে একটা শলার ঝাড়ু বের করে বিছানার ওপর থেকে ফুলের পাপড়িগুলো ঝেড়ে ফেলল।
বিছানা ঝেড়ে কাছে এসে লগ্নর হাত ধরে বলল, ‘তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। একটা বিয়েতে মেয়েদের কত ধকল যায় এটুকু বুঝি। সেই হিসেবে ছেলেদের তো কোনো কষ্টই নেই। ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়ো। বাসররাত নিয়েও আমার তেমন কোনো ফ্যান্টাসি নেই। ভালোবাসতে জানলে সব রাতই বাসররাত। বউ তো আমারই, অত তাড়া নেই।’
এ কথা শুনে এই মুহূর্তে লগ্নর খুব ইচ্ছে করছে ইফতিকে জড়িয়ে ধরতে। স্ত্রীরা আগে জড়িয়ে ধরলে কি স্বামীরা কিছু মনে করে? এসব মনে করাকরির যুগ কি আছে আর? নাকি এসব বিষয়ে এখনো পুরুষেরাই এগিয়ে থাকতে পছন্দ করে?
লগ্নকে চুপ করে থাকতে দেখে ইফতি জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভাবছ এত বলো তো?’
লগ্ন হেসে বলল, ‘কিছু না।’
তারপর বিছানায় গেল। তার সত্যিই খুব ঘুম পাচ্ছে। ইফতিও শুয়ে পড়ল। একসময় লগ্ন পাশ থেকে বলল, ‘জানো ইফতি, তোমাকে না আমার খুব আপন আপন লাগে?’
ঘুমে গলা জড়িয়ে যাচ্ছে লগ্নর। ইফতির মায়া হলো। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কতটা আপন লাগে?’
লগ্ন ইফতির বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এতটা।’
ইফতিও লগ্নকে জড়িয়ে ধরল। ওই অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়ল মেয়েটা। ইফতি তাকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল। তবে সহজে ঘুম এলো না তার।
লগ্নর যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে বেলা বারোটা। নতুন বউ এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে, লোকে কী ভাববে! লজ্জায় মাথা কাটা যাবে আজ তার। তড়িঘড়ি করে উঠে বেরিয়ে দেখে বাড়িতে কেউ নেই। সব ঘর ফাঁকা বিয়েবাড়ি ভর্তি এত মানুষজন ছিল অথচ এখন পুরো বাড়ি ফাঁকা! অদ্ভুত লাগল তার। তার সঙ্গে দাদি আর দুজন চাচাতো ভাই এসেছে। তাদের যে ঘরে ঘুমোতে দেওয়া হয়েছে সেখানে গিয়ে দেখে তারা সবাই এখনো ঘুমাচ্ছে।
এবার ঘরে গিয়ে ফোন খুঁজে ইফতিকে ফোন করতে গিয়ে দেখে লাবণ্য ও বাবা অনেকবার ফোন করেছে। কী আশ্চর্য! কী ঘুম ঘুমিয়েছে যে এতগুলো কল সে টের পেল না? ভাবল, বাবাকে নাহয় একটু পর কলব্যাক করবে। তার আগে ইফতিকে কল করা দরকার। কল করে দেখে ইফতির ফোন বন্ধ। হলোটা কী? মাথা কাজ করছে না! তখনই চোখ পড়ল তার ফোনের নিচে একটা কাগজ চাপা দেওয়া ছিল। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
Sorry.
-Iftekhar
৬
সকালবেলা নাস্তা শেষে চা খেতে খেতে আতিকুর রহমান স্ত্রীর সাথে লগ্নর বউভাতে যাওয়ার প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন। আগামীকালই বউভাত, হাতে সময় বেশি নেই। এমন সময় লাবণ্য এলো ছুটতে ছুটতে। আতিকুর রহমান তাকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হলো তোর?’
লাবণ্য কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘বাবা, লগ্ন ফোন ধরছে না।’
বিলকিস বেগম বললেন, তাতে হয়েছে কী? কাল যে ধকল গেল। হয়তো এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। উঠলে কলব্যাক করবে।’
‘না মা, অনেকবার কল করেছি ধরছে না। তারপর একটু চিন্তা হচ্ছিল বলেই ইফতিকে ফোন করি। ওর ফোন বন্ধ। এরপর দাদিকে ফোন দিই, সেও ধরে না।’
এবার সকলেই চিন্তায় পড়ে গেল। আতিকুর রহমান প্রথমে লগ্নকে ফোন করল। সেও ফোন না ধরায় মা, ভাইপো সবাইকেই কল করল। কেউই ফোন ধরল না। এরপর ফোন করল ইফতি ও তার পরিবারের লোকদের। তাদের সবার ফোন বন্ধ। তৎক্ষণাৎ আতিকুর রহমান ভাইদের সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরগাঁও রওনা হলেন। লাবণ্য ও তার স্বামীও সঙ্গে চলল। ঘটককে ফোন করে ডেকে পথে তাকেও গাড়িতে তুলে নিল।
.
লগ্নর যা ধারণা হচ্ছে তা সে বিশ্বাস করতে চাইছে না। মনে অনেক জোর নিয়ে সে বাবাকে ফোন করল। ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে উঠল। ফোন হাতেই সে দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলে দেখে বাবা এসেছেন।
আতিকুর রহমান ধরা গলায় বললেন, ‘মা, তুই ঠিক আছিস?’
লগ্ন বলল, ‘হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। কিন্তু এবাড়িতে কিছু একটা ঠিক নেই বাবা।’
সারাবাড়িতে কাউকে খুঁজে না পেয়ে নিকটস্থ থানায় খবর দিলো আতিকুর রহমান। লাবণ্য দাদি ও চাচাতো ভাইদের ডেকে তুলল। তারা এখনো ঘুমে কাতর।
পুলিশ এসে সারাবাড়ি তল্লাশি করে উদ্ধার করল ইফতি ও তার পরিবার লগ্নর সোনার গয়না চুরি করে পালিয়েছে। ৩০ ভরি গয়না দিয়েছিল লগ্নর বাবা। তারা যা দিয়েছিল, সেসবও নিয়ে গেছে। এমনকি গত রাতে পরিশোধ করা দেনমোহরের পাঁচ লাখ টাকাও নিয়ে গেছে। এই বাড়িও তাদের নয়। তারা ভাড়া নিয়েছিল। বাড়ির মালিক বিদেশে থাকে, তাকে পাওয়া গেল না। তবে কেয়ারটেকার ও ঘটককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে গেল। বিয়েতে তোলা তাদের ছবি, কাবিনের সময় দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি-সবকিছু পরবর্তী তদন্তের জন্য পুলিশ নিয়ে গেল।
পুলিশ চলে যাওয়ার পর সবাই লগ্নকে স্বান্তনা দিচ্ছিল।’ শুধু আতিকুর রহমান বাদে। তিনি বললেন, ‘মাগো, আমাকে তুই মাফ করে দে। তুই বিয়ে করতে না চাওয়া সত্ত্বেও তোকে জোর করেছি।’
লগ্ন কিছু বলতে পারল না। পুলিশের কথা শোনার পর থেকে আর কারো কোনো কথাই তার কর্ণপাত হচ্ছে না। রাতের খাবারের সাথে মিশিয়ে সবাইকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিল ওরা। সেই ঘুমের ঘোর কাটতে না কাটতেই এতবড় ধাক্কা। মাথা ঝিমঝিম করছে, সমস্ত শরীর কাঁপছে। অন্যকিছুই ভাবছে না সে, শুধু একটা কথাই ভাবছে; মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলেছিল সে। যদি ধোঁকা দেওয়াই ইফতির উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে ভালোবাসার জাল ফেলার কী দরকার ছিল? বিয়ে তো ঠিক হয়েই গিয়েছিল। যেটা ভালোবাসা ছাড়াও হতে পারত!
৭
বাড়ি ফিরে লগ্ন যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল, যেন কিছুই হয়নি। অন্য সবাই অপরাধবোধে গুমরে গুমরে মরছে। এত খোঁজখবর করার পরেও কীভাবে এত বড় ভুল হয়ে গেল বুঝতে পারছে না আতিকুর রহমান। পুরো বাড়ি থমথমে।
সারাদিন স্বাভাবিক থাকলেও সারারাত বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদল লগ্ন। এতবছরের প্রেমের পর হিমেলের প্রতারণায় যে কষ্ট পেয়েছিল তারচেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছে সামান্য কিছুদিনের পরিচয়ের ইফতির প্রতারণায়। কিন্তু কেন? ইফতির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে? তাই হবে। মনে হচ্ছে এক জীবন সংসার করা স্বামীকে সে হারিয়ে ফেলেছে। অদ্ভুত অসহায় এক অনুভূতি হচ্ছে!
কেন বারবার সে প্রতারিত হয়? সে কি কারো সত্যিকারের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না? না হলে নাই, ভালোবাসা তো সে চায়নি। না চাইতেও কেন ওরা এসে ভালোবাসার জালে জড়ায় তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়?
কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই লগ্নর। সকালবেলা ঘুম ভাঙার পরেও উঠল না। চুপচাপ শুয়ে রইল। লগ্নর ঘুম ভেঙেছে টের
পেয়ে লাবণ্য এলো ঘরে।
এসে নিচু গলায় বলল, ‘তোর সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।’
লগ্ন নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘বল।’
লাবণ্য এবার আরও নিচুগলায় বলল, ‘অসভ্যটা কি সেদিন রাতে প্রটেকশন নিয়েছিল?’
লগ্ন এবার উঠে বসল। তার কপালে বিরক্তির রেখা। লাবণ্য বলল, ‘আমাকে বল। না নিলে তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এখনো সময় আছে।’
এবার লগ্ন বলল, ‘আপা তুই যা এখান থেকে।’
‘আরে তুই রাগ করছিস কেন? আমি তো তোর ভালোর জন্যই বলছি। একটা বাচ্চাকাচ্চা এসে গেলে আরেক বিপদ হবে।’
লগ্ন আঙুল দিয়ে দরজা দেখিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘এক্ষুনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা।’
লাবণ্য মুখ কালো করে বেরিয়ে গেল। চিৎকার শুনে বিলকিস বেগম ছুটে এলো। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই লগ্ন বলল, ‘সেটা তোমার বড় মেয়েকে জিজ্ঞেস করো।’
লগ্নকে এত রাগ করতে কখনো দেখেননি তিনি। অবশ্য এতবড় একটা ঘটনা ঘটে যাবার পর মাথা ঠান্ডা রাখা মুশকিল। তিনি লগ্নকে আর না চটিয়ে চলে গেলেন।
বিলকিস বেগম লাবণ্যর মুখে সব শুনে আবার এলেন লগ্নর কাছে। মেয়ের পাশে বসে বললেন, ‘রাগ করিস না মা। তুই ছোট মানুষ, ওর একটু চিন্তা হচ্ছিল তাই ওসব বলেছে।
লগ্ন ফোঁস করে উঠল, ‘ছোট মানুষ হলে বিয়ে দিয়েছ কেন?’
এই প্রশ্নের জবাবে বিলকিস বেগম কিছু বলতে পারলেন না। চুপচাপ চলে গেলেন।
লগ্ন দরজা বন্ধ করে বসে রইল সারাদিন। এতক্ষণ তার খেয়াল ছিল না। লাবণ্য জিজ্ঞেস করাতেই খেয়াল হলো সেদিন রাতে ইফতি সুযোগ পেয়েও তার সঙ্গে কোনো শারীরিক সম্পর্কে আগায়নি। তার মানে ওরা শুধুই চোর। অন্যকোনো কিছুর প্রতি ওদের লোভ নেই। সবই বুঝতে পারছে, শুধু এটুকু বুঝতে পারছে না ইফতি ভালোবাসার অভিনয়টা কেন করল।
পুলিশ জানিয়েছে ইফতি ও তার পরিবারের সবার পরিচয়পত্র নকল। ছবির মাধ্যমে ইফতির আসল পরিচয়পত্র জোগাড় করা গেছে। তার আসল নাম নাদভি আহমেদ। স্থায়ী ঠিকানা নোয়াখালী। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা যায় তার পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। নাদভি কোথায় আছে কেউ জানে না। তাকে ট্রেস করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত দেশ ছেড়েছে সে।
পুলিশের যে তথ্যে লগ্ন সহ পুরো পরিবার অবাক হয়েছে তা হলো, প্রতারকচক্র যে বাড়িভাড়া করে নিজের বাড়ি বলে জানিয়েছিল সেই বাড়ির ছেলের নাম ইফতেখার মাহমুদ। তার পুরো প্রোফাইল ব্যবহার করেই জাল পাতা হয়েছিল। তারা দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি। এই কারণে আতিকুর রহমান বিয়ের আগে খোঁজখবর করে সব ভালো তথ্যই পেয়েছিলেন।
৮
লগ্নর ঘুমের রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। রাতে একদমই ঘুম হয় না, দিনে কখনো হয়, কখনো হয় না। চোখের নিচে কালি তো তার আগেই ছিল। সেটা এখন বেড়েছে। মুখে প্রচুর পরিমাণে ব্রণ উঠতে শুরু করেছে।
সারারাত না ঘুমিয়ে প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছিল। ক্লান্তি কাটাতেই চা বানিয়ে নিজের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল। এমন সময় বিলকিস বেগম এসে বললেন, ‘খালি পেটে চা খাচ্ছিস, নাস্তা তৈরি হয়ে গেছে। কিছু একটা খেয়ে নে।
লগ্ন বলল, ‘মাত্র উঠেছি। ক্ষুধা নেই। কিন্তু চা জরুরি। নাস্তা একটু পরে করছি।’
বিলকিস বেগম আর কিছু বললেন না। চলে গেলেন স্বামীকে নাস্তা দিতে। ছুটা বুয়া ঘর মুছছিলেন।
সে হঠাৎ বলে বসল, ‘ভোক কেমন করি লাগিবি বুবু! যা হইল তোমাঘরের সাথত! পুরুষ মানুষ আসেই জীবনডা তছনছ করিবার তনে। আহারে কী সুন্দর মেয়ে! কাঁয় বুঝা পাইছিলো এমন হবি।’
লগ্ন চিৎকার করে মাকে ডাকল। বিলকিস বেগম এসে বললেন, ‘কী হলো?’
‘আজ থেকে আমার ঘরে বাইরের কেউ যেন না আসে। আমার ঘর আমি নিজেই পরিষ্কার করতে পারব।’
বিলকিস বেগম অবাক হয়ে বুয়ার দিকে তাকাল। বুয়ার ঘর মোছা প্ৰায় শেষ। সে ঝড়ের বেগে বাকিটা মুছে বের হয়ে গেল। বিলকিস বেগম বললেন, ‘কী করেছে ও?
‘আমার স্বামী আমার গয়নাগাটি নিয়ে পালিয়েছে এই ঘটনাটা ছাড়া জন্মের পর তো আমার জীবনে আর কিছু ঘটেইনি মা। সেটা নিয়েই হাহুতাশ করছিল।’
বিলকিস বেগম করুণ মুখে চেয়ে রইলেন। লগ্ন আবার তার চায়ে মনোযোগ দিলো।
লগ্নর সাথে যা ঘটেছে তারপর তার জন্য সামলে ওঠা খুবই কঠিন, তবে সে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু মূল সমস্যাটা শুরু হলো বন্ধ ঘর থেকে বের হওয়া শুরু করতেই। যার সাথেই দেখা হয় সেই তার দুঃখে আহা উঁহু করে। যতই সে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চায়, ততই তার আশেপাশের মানুষ বিষয়টিকে উন্মোচিত করতে পছন্দ করে। বাড়িতেও যে খুব শান্তি আছে তা নয়। যেই আসবে সেই আফসোস করবে। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে দুধওয়ালা কিংবা কাজের লোক-প্রত্যেকে ওই একটি ঘটনা নিয়ে পড়ে রয়েছে। যেন ওই দুর্ঘটনা ছাড়া লগ্নর জীবনে আর কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। দমবন্ধ করা অনুভূতি হতে লাগল তার। একদিন সহ্য করতে না পেরে বাবার কাছে গেল। তিনি বাজারের লিস্ট তৈরি করছিলেন। লগ্ন বলল, ‘বাবা, তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।’
আতিকুর রহমান লিস্ট থেকে চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ মা, বল কী বলবি।’
‘আমি যত দ্রুত সম্ভব বাইরে পড়তে যেতে চাই। তুমি ব্যবস্থা করে দাও।’
এবার আর আতিকুর রহমান মানা করতে পারলেন না। কীভাবে করবেন! মেয়ের সাথে সবার অমানবিক আচরণ তো নিজ চোখেই দেখছেন। বিলকিসের মুখেও শুনেছেন। মেয়ের সুখের জন্যই তো সব করেছেন। কিন্তু হলো উলটোটা!
লগ্ন পুরোদমে আইইএলটিএসের প্রস্তুতি নিতে লাগলো। তাকে ভালো একটা স্কোর করতেই হবে। নিজে নিজেই প্রতিদিনের পড়াশোনার একটা পরিকল্পনা তৈরি করে নিল। একটু আগে আগেই রেজিস্ট্রেশন করে নেবে ভেবে রেজিস্ট্রেশন করতে চলে গেল। যেদিন রেজিস্ট্রেশন করতে গেল সেদিন ঘটল আরেকটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। পে করার সময় পার্স খুলে তার ক্রেডিট কার্ডটা আর খুঁজে পেল না। ব্যাংকে গিয়েও পোহাতে হলো নানান ঝামেলা। তারপর একসময় সে বুঝতে পারল ইফতি অর্থাৎ নাদভি যাওয়ার সময় তার ক্রেডিট কার্ডটিও নিয়ে গেছে। তার ক্রেডিট কার্ডের লিমিট এক লাখ। সেই টাকাটাও তুলে নিতে ভুল করেনি। মেসেজ চেক করে দেখল, যে রাতে ওরা পালিয়েছিল সেই রাতে তার কাছে মেসেজও এসেছিল কিন্তু ঘুমের ওষুধের ইফেক্টে মরার মতো ঘুমাচ্ছিল। পরদিন সকালে এতবড় ধাক্কা সামলাতে গিয়ে মেসেজ খেয়াল করা হয়নি। কিন্তু পিন কীভাবে জানল? তারপর মনে পড়ল বিয়ের শপিংয়ের সময় অসংখ্যবার লগ্ন নাদভির সামনেই পিন ব্যবহার করেছে। হয়তো কখনো আড়চোখে দেখে নিয়েছে। নিজের মনেই হাসল লগ্ন।
৯
লগ্নর মাস্টার্সের অ্যাডমিশন হলো ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে। এই ইউনিভার্সিটি আমেরিকার ওয়াশিংটন স্টেটের সিয়াটল শহরে অবস্থিত। দেশ ছেড়ে যাবার সময় যখন প্লেনে চেপে বসে সবারই হয়তো মন খারাপ হয়, কিন্তু লগ্নর মনে হলো এতদিনে সে শ্বাস নিতে পারছে। তার প্রিয় শহর আর সেই শহরের মানুষগুলো তাকে শ্বাস নিতে দিচ্ছিল না।
>
কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি নয়, লগ্ন সরাসরি সিয়াটলে নেমে আগে থেকে বুক করে রাখা এক কামরার একটি এয়ারবিএনবিতে উঠল। আত্মীয় বন্ধুদের আহা উহু শোনার মতো কোনো ইচ্ছে তার নেই।
প্রথম দুটো দিন ঘুমিয়েই কেটে গেল। এরপর বের হলো বাসা খুঁজতে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে একটা এক কামড়ার স্টুডিও এপার্টমেন্ট পেয়ে গেল। অ্যাপার্টমেন্টটা একটু পুরোনো। এই ভাড়াতেই সে ঝকঝকে তকতকে বাসায় উঠতে পারত তবে সেক্ষেত্রে নিজস্ব কামরা হয়তো থাকত, কিন্তু ফ্ল্যাট শেয়ার করতে হতো। সেটা চায় না সে। আজকাল মানুষজন ভালো লাগে না তার। একা থাকতেই সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
নতুন বাসায় উঠে ফার্নিচার বলতে একটা ম্যাট্রেস আর বালিশ ছাড়া কিছুই কিনল না লগ্ন। রান্নাঘরের টুকিটাকি জিনিসপত্র দেশ থেকেই নিয়ে এসেছিল। প্রয়োজনের সব জিনিসই তার কাছে আছে। আরাম আয়েশ, বিলাসিতা আর শখের জিনিস নিজের উপার্জনে কিনবে। এমনিতেই বাবার ওপর অনেক চাপ পড়ে গেছে। এখন পার্ট টাইম চাকরি খুঁজছে সে। সিয়াটলের মতো ব্যস্ত শহরে কাজের অভাব হবে না বলেই তার বিশ্বাস।
লগ্নর ক্লাস শুরু হতে আরো সপ্তাহখানেক বাকি। বাসা খোঁজা ও গোছানো হয়ে গেছে। এখন ক্লাস শুরু হওয়ার আগ অবধি অফুরন্ত সময় তার। তাই গুগল ম্যাপে দেখতে লাগল আশেপাশে কী আছে। তখন দেখে লেক ওয়াশিংটন তার বাসার খুবই কাছে। ১৫ মিনিটের হাঁটা পথ। ব্যস বেরিয়ে পড়ল। ম্যাপ ধরে যখন লেকের পাড়ে পৌঁছল তখন নিজেই অবাক হয়ে গেল। নীল জলরাশির ওপাড়ে ছোটবড় কত পাহাড়। আর সে যে তীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে অযত্নে ফুটে রয়েছে অজস্র ডেইজি ফুল। এই সৌন্দর্য নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা দায়। হঠাৎ করে লগ্নর মনে হলো জীবনে হিমেল, ইফতি কিংবা নাদভি সব মিথ্যে। এই মুহূর্তটাই কেবল সত্যি!
ফেরার পথে একটা কফিশপে বারিস্তা লাগবে এমন একটা বিজ্ঞাপন দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো এক্সপেরিয়েন্স না থাকলেও চলবে, কিন্তু বারিস্তা কোর্সের সার্টিফিকেট থাকা লাগবে। যেহেতু এধরনের কিছু তার নেই তাই সে বেরিয়ে গেল। সে বের হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই একটা মেয়েও বের হলো কফিশপ থেকে।
মেয়েটা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি ইন্ডিয়ান?’
লগ্ন জানাল সে বাংলাদেশি। মেয়েটি এবার হেসে পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘আমি কলকাতার’
তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, ‘সঙ্গীতা।’
লগ্ন মেয়েটির সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আমি লগ্নজিতা।’
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল। সঙ্গীতা বলল, ‘তুমি নতুন এসেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘এখানে সরকার থেকে নিউকামারদের জন্য ফ্রিতে বিভিন্নরকম কোর্সের ব্যবস্থা রয়েছে। সেখান থেকে বারিস্তা কোর্স করে নিতে পারো। আমি এই কফিশপে কাজ করি। সার্টিফিকেট ছাড়া নেবে না ঠিক আবার শুরুতে সবটা নিজেরাই শিখিয়ে নেবে। তাই কোনোরকম একটা কোর্স করা থাকলেই হবে। কিংবা অন্যকিছুতে ইন্টারেস্টেড থাকলে সেসবও করে নিতে পারো। জব পেতে সুবিধে হবে।’
‘তাই নাকি? তাহলে তো খুবই ভালো হয়।’
সঙ্গীতা ওয়েবসাইট অ্যাড্রেসটা লিখে দিয়ে দ্রুত পা চালাল, তার বাসের
সময় হয়ে এসেছে।
লগ্ন বাড়ি ফিরে ওয়েবসাইট চেক করে দেখে নানান পদের কোর্স। কোনটা রেখে কোনটা করবে! যেহেতু ফ্রি তাই সে দুটো কোর্স নিল। একটা বেকিং আরেকটা ফ্রেঞ্চ ভাষা। বেকিংয়ের কোর্সটা স্বল্পমেয়াদি ফ্রেঞ্চের আবার অনেকগুলো ধাপ। ৩ মাস থেকে শুরু করে ২ বছর পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ আছে। যার যতটা ইচ্ছে শিখতে পারে। একটা বাড়তি ভাষা শেখার ইচ্ছে তার অনেকদিনের। এবার সুযোগ পেয়ে সেই ইচ্ছেটাকেই জাগ্রত করল আবার। পড়াশোনা ও কাজের চাপ বুঝে নাহয় কোর্সগুলো করা যাবে। ক্লাস শুরু হওয়ার পর লগ্ন বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বেকিংয়ের কোর্সটা শেষ হওয়ার তিন দিনের মাথাতেই সে একটা বেকারিতে পার্ট টাইম জব পেয়ে যায়। এরপর থেকে তার সময় যে কোনদিক দিয়ে যায় নিজেও টের পায় না।