লগ্নজিতা – ২০

২০

শীত শেষে বসন্ত এসে গেছে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজিয়েছে। টানা কয়েকমাস বরফ দেখার পর এত সবুজ দেখে মন-প্রাণ চঞ্চল হয়। এখন প্রতিদিন অফিস শেষে লগ্নকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে নাদভি বাসায় ফেরে। আজ লগ্ন নাদভিকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানাল। নাদভি বলল, দুজন মিলে রাঁধবে। কিন্তু লগ্নর বাসায় বাজার প্রায় শেষ। অতঃপর বাজার করতে গেল গ্রোসারি শপে। বাজার করতে করতে একটা পর্যায়ে নাদভি লগ্নকে অন্য সেকশনে টেনে নিয়ে একটা চাবুক দেখিয়ে বলল, ‘নেবে নাকি?’

লগ্ন হেসে বলল, ‘এত চাবুক খাওয়ার শখ তোমার?’

নাদভি হেসে বলল, ‘একদম না। কিন্তু তোমার ভেতরের রাগ কমানো দরকার না?’

‘ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। ঠিক করে ফেলেছি। বাসায় গিয়ে বলব।’

‘ওরে বাপরে! এখন কিন্তু টেনশন লাগছে।’

‘একটু লাগুক।’

লগ্ন আবার তার বাজারে মনোযোগ দিল।

.

নাদভি সব কাটাকুটির দায়িত্ব নিল। লগ্ন রান্নার। রান্নাটা একটু গুছিয়ে নিয়ে লগ্ন বলল, ‘এবার শোনো কী শাস্তি দেবো।’

নাদভি হাসিমুখে বলল, ‘বলো।’

লগ্ন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নাদভির গলা জড়িয়ে বলল, ‘ব্যানফ যেতে চাই বাই রোডে। ক্যাম্পিং করব। আমি এদেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে গেছি। কিন্তু ড্রাইভ করতে পারব না। ড্রাইভ অবশ্যই তুমি করবে।’

নাদভি চমকে উঠে বলল, ‘ওরে সর্বনাশ! তুমি তো সাংঘাতিক মেয়ে! সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার রাস্তা ড্রাইভ করে যাওয়া কীভাবে সম্ভব! আমার কি টেসলা আছে?’

লগ্ন সরে গিয়ে ভাত ফুটেছে কি না দেখতে দেখতে বলল, ‘আমি কী জানি?’

নাদভি লগ্নর কাছে এসে বলল, ‘তারচেয়ে ফ্লাইটে চলে যাই।’

লগ্ন কঠিন গলায় বলল, ‘না। ফ্লাইটে গেলে রকি মাউন্টেইন দেখতে দেখতে যাব কী করে? শাস্তি কি কখনো সহজ হয়?

এবার নাদভি হেসে বলল, ‘কাজটা কঠিন, অ্যাডভেঞ্চারাস। কিন্তু শাস্তি হিসেবে খুবই সামান্য।’

‘তাহলে? শোনো রেস্ট নিয়ে নিয়ে যাবে। সারাদিন ড্রাইভ করবে। যেখানে রাত হবে সেখানে হোটেলে থাকব। আর সেই জায়গায় হোটেল না পাওয়া গেলে গাড়িতেই থাকব। তোমার গাড়ির পেছনের সিটে অনায়াসে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা যাবে। কারসিটের ওপর সেট করার মতো বিছানা আমি অ্যামাজনে দেখেছি। আর ক্যাম্পিংয়ের জন্য অবশ্যই দুটো তাঁবু নেবে। আমি তোমার বউ না যে তোমার সাথে ঘুমাব।’

নাদভি এবার সজোরে হেসে দিলো। লগ্ন দুষ্টু হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘তো রাজি?’

‘রাজি তো প্রথম কথাতেই। কিন্তু কীভাবে কি ম্যানেজ করব তাই ভাবছিলাম!’

সবকিছু ম্যানেজ হয়ে গেলেও ছুটি ম্যানেজ হতে দেরি হয়ে গেল। একই টিমের দুজনের ১০ দিনের ছুটি মঞ্জুর করতে অফিস নারাজ। যাই হোক, ছুটি মিলল পরের মাসে। দুজন মিলে ক্যাম্পিংয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা শুরু করল। যেসব জিনিস ভাড়া নেওয়া সম্ভব সেগুলো ভাড়া নিল } যেমন তাঁবু, ক্যাম্পিং বেড, ক্যাম্পিং চেয়ার, পোর্টেবল ক্যাম্পিং ফ্রিজ, ইত্যাদি। তারপর সত্যি সত্যিই একদিন ভোরে গাড়িতে করে রওনা হয়ে গেল সাড়ে তিন হাজার দূরত্বে।

২১

মিসিসাগা টু ব্যানফ জার্নিতে ছোটখাটো কফি বিরতির পর প্রথম বড়সড়ো স্টপেজ ছিল অন্টারিও প্রভিন্সের থানডার বেতে। থানডার বে শহরটি মিসিসাগা থেকে ১৩৮৪ কিলোমিটার দূরে। ভোর ছটায় রওনা হয়েছিল তারা। থানডার বে পৌঁছাল রাত ৮টায়। টানা ১৫ ঘণ্টা ড্রাইভ করে নাদভি প্রচণ্ড ক্লান্ত। রাতটা এখানে থাকার জন্য একটা হোটেলে দুটো রুম বুক করে রেখেছিল। রাতের খাবার খেয়েই তারা যার যার রুমে ঘুমিয়ে পড়ল। রাতে খুব ভালো ঘুম হলো।

ভোরবেলা আবার বেরিয়ে পড়ল। আজকের গন্তব্য সাসকাচোয়ান প্রভিন্সের গাল লেক। সেখানেও হোটেলে দুটি রুম বুক করা আছে। অন্টারিও প্রভিন্সের পর ম্যানিটোবা প্রভিন্স পার হয়ে তারপর সাসকাচোয়ান প্রভিন্স। ম্যানিটোবা প্রভিন্সের উইনিপেগ শহরে লাঞ্চ করে যখন আবার রওনা হচ্ছিল তখন লগ্ন আগেই গিয়ে স্টিয়ারিংয়ে বসল। নাদভি অবাক হলো।

লগ্ন বলল, ‘আমি এতটাও অমানবিক না যে একটানা এত ড্রাইভ করাব তোমাকে দিয়ে। যতক্ষণ পারি আমি চালাই। এরপর আবার তুমি চালিয়ো।’

নাদভি আপত্তি করলেও লগ্ন তা টিকতে দিলো না। সে রেজাইনা পর্যন্ত টানা ৬ ঘণ্টা গাড়ি চালাল। রেজাইনাতে কফি ও হালকা স্ন্যাকস খেয়ে আবার রওনা হলো। এবার আর নাদভি লগ্নকে সুযোগ দিলো না। লগ্নরও কষ্ট হচ্ছিল তাই ছেড়ে দিলো। আরও তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করার পর তারা পৌঁছল গাল লেক। রাতটা গাল লেকে কাটিয়ে পরদিন ভোরবেলা আবার যাত্রা শুরু করল। এবার আর কোনো বড় স্টপেজ নেই। আজ দুপুরের আগেই মাত্র ৫ ঘণ্টা ড্রাইভ করেই তারা পৌঁছবে তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্য আলবার্টা প্রভিন্সের ব্যানফে।

তারা যাচ্ছে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে। যত পশ্চিমে যাচ্ছে তত প্রকৃতি তার সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। গাল লেকের কিছুদূর পর থেকেই আলবার্টা প্রভিন্সের শুরু। আলবার্টা প্রভিন্সে ঢোকার পর থেকেই কানাডিয়ান মাউন্টেইন তাদের আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করল। বিশাল বড় হাইওয়ের দুপাশে অসীম জঙ্গল। রাস্তার ওপর প্রায়ই বড় বড় ব্রিজ পড়ছে। এই ব্রিজগুলো বানানো হয়েছে জঙ্গলের এপাশ থেকে ওপাশে হাতি, ভালুকসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের অবাধ চলাচলের জন্য। কি চমৎকার ব্যবস্থা! যতদূর চোখ যায় কেবল সারি সারি পাইন গাছ দেখা যায়। আর তারই মাঝে কখনো দূরে দেখা যায় বিশাল বিশাল ত্রিভুজাকৃতির পাহাড়। পাহাড়গুলোর শুরু দেখা যায়, শেষ দেখা যায় না। কখনোবা আবার বিশাল পাহাড়ের সামনে রাস্তার সাথে লাগোয়া লেক পড়ছে, কখনোবা আবার নদী। কী অপূর্ব দৃশ্য! লগ্ন পাহাড় ভালোবাসে। বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক পাহাড় তার ঘোরা হয়েছে। কিন্তু এমন বিশালত্ব সে খুব কমই দেখেছে। মনপ্রাণ ভরে যাচ্ছে তার। হঠাৎ সে একটা হাত বাড়িয়ে নাদভির হাত ধরল।

নাদভি তাকাতেই সে বলল, ‘থ্যাংক ইউ সো মাচ। শুধু এই সৌন্দর্যটা দেখার জন্যই গাড়িতে আসতে চেয়েছিলাম। নাদভি হেসে আবার ড্রাইভিংয়ে নজর দিলো।

বলল, ‘তোমার এই খুশি দেখার জন্য আমি দুদিন কেন টানা দুমাস গাড়ি চালাতে পারব।’

লগ্ন অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘মাত্র দুমাস?’

নাদভি হেসে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে লগ্নও হেসে দিলো।

বেলা এগারোটা নাগাদ তারা পৌঁছল ব্যানফ শহরে। এখন শহর ঘুরলে দেরি হয়ে যাবে। পরে শহর ঘুরবে বলে এখন সরাসরি ক্যাম্প গ্রাউন্ডের দিকে চলে গেল।

তারা বুকিং দিয়েছিল লেক লুইস ক্যাম্পগ্রাউন্ডে। সেখানে পৌঁছে দুজনেরই চোখ কপালে উঠে গেল। তাদের ক্যাম্পসাইটের পাসে দিয়েই বয়ে চলেছে খরস্রোতা পাথুরে নদী। নাম তার বো। নদীর ওপারে পাইন গাছের জঙ্গল আর ডান পাশে পাইন গাছের আড়ালে মপ্ত সব পাহাড়ের লুকোচুরি খেলা। লগ্ন নদীর পাড়ে গিয়ে পা ভেজাল। কনকনে ঠান্ডা পানি! দ্রুত পাড়ে উঠে এলো সে। নাদভি প্রকৃতির চেয়ে বেশি উপভোগ করছে লগ্নর উচ্ছ্বাস।

লগ্ন বলল, ‘কী কেমন লাগছে? মনে হচ্ছে না শাস্তিটা পেয়ে বরং জিতে গেছ?

নাদভি হো হো করে হেসে উঠল।

ক্যাম্পগ্রাউন্ডে টয়লেট, গোসল, খাবার পানি সবকিছুর সুব্যবস্থা আছে। প্রতিটি ক্যাম্পসাইটে ডাইনিং এরিয়া হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঠের টেবিল ও তার দুপাশে দুটি বেঞ্চ তৈরি করা আছে, এছাড়াও আছে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা। আছে ইলেকট্রিক সাপ্লাইও। তাই ফোন ল্যাপটপ চার্জ দেওয়া নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। এমনকি চাইলে লাইটের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।

ক্যাম্পগ্রাউন্ডে আগুন জ্বালানোর জন্য কাঠ কেটে রেখে দেয়। যদিও টুকরোগুলো অনেক বড় বড় থাকে। সেগুলো এনে ছোট ছোট টুকরো করে নেয়। নাদভি সদ্য কেনা কুড়াল দিয়ে জীবনে প্রথম কাঠ কাটল প্রথমদিকে একটু অসুবিধা হলেও পরে অভ্যস্ত হয়ে গেল। ক্যাম্পসাইটে আগুন জ্বালানোর জন্য একটা হাফ ড্রামের মতো বস্তু দেওয়া থাকে। যার ভেতরে কাঠের টুকরো দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। ওপরে একটা রডের ঢাকনার মত থাকে। আগুন পোহানো ছাড়াও চাইলে এর ওপর রান্না করা যায়। অনেকে আবার চুলা নিয়ে আসে। তবে ওরা এই আগুনেই রান্না করবে। নাদভি আগুন জ্বালিয়ে দিলো। তারপর গেল খাওয়ার পানি আনতে। পানি এনে তাঁবু টানাতে শুরু করল। এরমধ্যে লগ্ন রান্নাবান্নার জিনিসপত্র বের করল। যাতে দ্রুত রান্না হয় তাই সে চট করে একটা পাত্রে খিচুড়ি বসিয়ে দিলো। কষানোর ঝামেলায় যায়নি, মসলা মেখে পানি দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। তারপর নাদভিকে তাঁবু টানানোতে সাহায্য করল। তাঁবু টানানো হয়ে যেতেই নাদভি লগ্নকে সাহায্য করতে এলো। খিচুড়ি প্রায় হয়ে এসেছে। লগ্ন বেগুন ভাজার জন্য বেগুন কাটছিল। এরমধ্যে নাদভি ডিম ভাজার জন্য পেঁয়াজ মরিচ কেটে দিলো। ভাজাভুজি হতে হতে খিচুড়ি পুরোপুরি হয়ে গেল। এরপর দুজনে খেতে বসল।

নাদভি খিচুড়ি মুখে দিয়েই বলল, ‘আহ এটা তোমার সেরা রান্না।’

লগ্ন হেসে বলল, ‘বলেছে তোমাকে। আসলে যে এত কাজ করে খিদেয় মরে যাচ্ছিলে এটা বলছ না।’

নাদভি হেসে বলল, ‘এত কাজ করে খিদে পেয়েছে এটা সত্যি। কিন্তু রান্নাটাও ভালো হয়েছে। সঙ্গে আছে এমন অবিশ্বাস্য সুন্দর প্রকৃতি। খাবার মজা না লেগে উপায় কী?’

‘এটা ঠিক। এত সুন্দর জায়গায় বসে যা খাব তাই বোধহয় ভালো লাগবে।’

বিকেলটা কফি হাতে নদীর পাড়ে বসে কাটিয়ে দিলো দুজনে। কতশত গল্প হলো! সূর্য ডোবার পরে এখানে আর করার তেমন কিছু নেই। শরীরও ক্লান্ত তাই যার যার তাঁবুতে ঢুকে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর লগ্ন ফোন করল।

নাদভি ধরল, ‘হ্যালো।’

লগ্ন আমতা আমতা করে বলল, ‘একবার আমার তাঁবুতে আসবে?’

‘আসছি।’

নাদভি লগ্নর তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিতেই লগ্ন তাবুর চেইন খুলে দিলো। নাদভি ভেতরে আসতেই লগ্ন তাকে বসতে বলল। বাইরে যে ক্যাম্পিনিং চেয়ারে তারা বসেছিল সেই চেয়ারই এখন ঘরে এনে রেখেছে।

নাদভি সেখানে বসে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার?’

লগ্ন মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘তোমার বেডটা এই তাঁবুতে নিয়ে এসো।’ নাদভি অবাক হয়ে বলল, ‘কেন, তোমার ভয় লাগছে?’

লগ্ন এবার ধমকে উঠল, ‘কেন, এই জঙ্গলের মধ্যে ভয় লাগাটা কি অস্বাভাবিক?’

‘না, তা না। কিন্তু তাহলে দুটো তাঁবু আনার মানেটা কী হলো?’

এবার লগ্ন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আরে তখন কি জানতাম নাকি সন্ধ্যার পর এমন গা ছমছমে অনুভূতি হবে?

নাদভি মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা নিয়ে আসছি।’

‘এই, এই তুমি হাসলে কেন? এতবড় সাহস তোমার?’

‘কই না তো, হাসিনি।’

নাদভি তাঁবু থেকে বেরিয়ে একা একাই হাসল। তারপর তার বেড ভাঁজ করে লগ্নর তাঁবুতে নিয়ে এলো। সঙ্গে প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র। বিছানা গুছিয়েই কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল সে। কিছুক্ষণ পর লগ্ন ডাকলো, ‘নাদভি ঘুমিয়ে পড়েছ?’

‘না।’

‘তোমার মনে আছে একটি রাত কি অবলীলায় তোমার বুকে মাথা গুঁজে ঘুমিয়েছিলাম।

নাদভি বলল, ‘মনে থাকবে না কেন? আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন আর কষ্টের রাত ছিল যে সেটা।’

‘আর আমার জীবনের স্বপ্নের। রাত পেরোতেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।’

‘আম সরি লগ্ন।’

লগ্ন আর কথা বলে না। চোখের জলে ভিজে যেতে থাকে তার বালিশ নাদভি উশখুশ করতে থাকে। আর কোনো কথা বলার সাহস পায় না।

২২

খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল নাদভির। সে উঠে ফ্রেশ হয়ে এলো। তারপর কিছুক্ষণ নদীর পাড়ে হাঁটল। এর মাঝেই লগ্ন উঠে পড়ল।

তাকে দেখে নাদভি আগুন ধরাতে ধরাতে জানতে চাইল, ‘আজকের নাস্তায় কী খাবে? তুমি ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে আমি বানিয়ে ফেলি।’

লগ্ন বলল, ‘তুমি যা খাওয়াবে।’

লগ্ন চলে গেলে নাদভি চিন্তায় পড়ে গেল। এতকিছু এনেছে তারা, কী যে বানাবে বুঝতেই পারছে না। অনেক চিন্তাভাবনা করে শেষে স্যান্ডউইচ বানাল। কিছু ফল কেটে নিল। লগ্ন ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে নাদভির নাস্তা বানানো শেষ। দুজন নদীর পাড়ে বসে নাস্তা করল। নাস্তা খেতে খেতে লগ্ন বলল, ‘শোনো আমরা যদি কোনোদিন অভাবে পড়ি তাহলে তোমার এই স্যান্ডউইচ দিয়ে দোকান দিয়ে ফেলব। এত ভালো স্যান্ডউইচ তুমি বানাও! এর আগে খাওয়াওনি কেন?’

নাদভি হো হো করে হেসে ফেলল। লগ্নর প্রথমদিকের সেইসব দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। ওর হাসি দেখেই তো মজেছিল! বলল, ‘তুমি হাসলে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে। এত কম হাসো কেন ইদানীং?’

নাদভি নদীর দিকে তাকানো ছিল। সেদিকে তাকানো অবস্থাতেই বলল, ‘ভয় হয় তাই।’

লগ্ন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কীসের ভয়?’

নাদভি এবার লগ্নর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুধু হাসি না, সবকিছুতেই ভয় লাগে। হারিয়ে ফেলার ভয়। যদি ভাবো পটানোর জন্য করছি? ভাবতেই পারো, একসময় তো পটানোর জন্যই করতাম।’

লগ্ন কিছুক্ষণ নাদভির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। নাদভিও। তারপর নাদভির কাছে এসে গা ঘেঁষে বসল। হাত ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল, ‘তোমার যখন যা ইচ্ছে করবে তাই করবে। ভয় নেই। পটেই গেছি। আর পটানোর কিছু নেই।’

নাদভির বুকের ভেতর উথালপাথাল ঢেউ উঠেছে। সে আর কিছু বলতে পারল না।

নাস্তা শেষ করে ওরা গাড়ি নিয়ে ছুটল ব্যানফ শহরের উদ্দেশে। বিশাল রকি মাউন্টেনের পাদদেশে ছবির মতো সুন্দর একটা শহর ব্যানফ। রাস্তার দু ধারে দোকানপাট আর ট্যুরিস্টদের জনসমাগমে জমজমাট পুরো শহর। কিছুক্ষণ এদিকওদিক ঘুরে বেড়াল। টুকটাক কেনাকাটা করল। তারপর গেল বহুল প্রতীক্ষিত ব্যানফ হট স্প্রিংয়ে। এটি পাহাড়ের চূড়ায় একটি প্রাকৃতিক উষ্ণ পানির পুল। পাশেই পাহাড়চূড়ায় সারাবছর বরফ জমে থাকে। আশেপাশের প্রতিটি লেকের পানি ভয়ংকর ঠান্ডা। অথচ এই পুলে এসে পড়ছে গরম পানি! বিধাতার কী চমৎকার আশ্চর্য সৃষ্টি! প্রথমদিকে পুলটিও প্রাকৃতিক ছিল, পাথর দিয়ে বাঁধানো। পরবর্তীতে ট্যুরিস্টদের ব্যবহারের সুবিধার্থে সুইমিং পুলের মতো করে তৈরি করা হয়েছে। এটি যেহেতু পাহাড়ের চূড়ায় তাই ব্যানফ শহর নিচে। মেঘেরাও খুব কাছে। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।

লগ্ন ও নাদভি পুলে নেমে কখনো সাঁতার কাটল। কখনো চুপচাপ পাহাড় চূড়ায় ভেসে বেড়ানো মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি খেলা দেখল। কখনো বা আবার দেখল নিজেদের, পরস্পরকে। এখন এখানে বসন্তকাল, তাপমাত্রা অনেক কম, বেশ ঠান্ডা। তারমাঝে এই গরম পানি শরীরে এত আরাম এনে দিলো যে উঠতেই ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু খিদেয় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছিল তাই উঠতে হলো। কাপড় পালটে বেরিয়ে এলো। রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে বিকেলে ফিরে এলো ক্যাম্পগ্রাউন্ডে।

কাঠ শেষ হয়ে গেছে, নাদভি আবার কিছু কাঠ নিয়ে এলো। সূর্য ডুবলে সব অন্ধকার। তাই বেলা ফুরানোর আগেই রাতের রান্নাটা শেষ করে ফেলতে হবে। নাদভি কাঠ কাটতে শুরু করতেই লগ্ন বলল, ‘রাতের রান্নাটা আমি করি। কী খাবে বলো তো?’

নাদভি কাঠ কাটতে কাটতে বলল, ‘তোমার ইচ্ছা।’

‘আচ্ছা এটা বলো যে ভাত খেতে চাও নাকি অন্যকিছু।’

নাদভি হেসে বলল, ‘বাঙালির মন তো একটু ভাত ভাত করবেই। মিসিসাগা ছেড়ে আসার পর থেকে তো ভাত খাওয়া হয়নি।’

‘তাহলে ভাতই করি। রান্না করা গরুর মাংস যে এনেছিলাম ওটা গরম করি। সাথে দু’টুকরো মাছ ভাজা।’

নাদভি হেসে বলল, ‘ফার্স্ট ক্লাস খানা।’

লগ্ন সব প্রস্তুত করতে করতে নাদভি আগুন জ্বালিয়ে দিলো। লগ্ন রান্না বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কফি খাবে?’

নাদভি বলল, ‘আমি বানাই।’

নাদভি কফি বানিয়ে লগ্নর পাশে এসে চেয়ার পেতে বসল। কফি খেতে খেতে বলল, ‘জানো, মা আমার হাতের কফি খুব ভালোবাসত।’

লগ্ন নাদভির দিকে তাকিয়ে দেখে ভাবনায় ডুবে গেছে সে। হয়তো পুরোনো দিনের ভাবনা। বলল, ‘মাকে দেখাবে? ছবি আছে?’

নাদভি তার ফোন থেকে ছবি দেখাতে দেখাতে বলল, ‘শেষদিকে মায়ের অনেক ছবি তুলে রাখতাম। বুঝতে পারছিলাম হারাতে চলেছি।’

লগ্ন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে অসুস্থ একজন মহিলা। নাদভির চেহারার সাথে মিল আছে।

বলল, ‘সুস্থ সময়ের ছবি নেই?’

‘আছে। দাঁড়াও দেখাচ্ছি।’

নাদভি ফোন ঘেটে সুস্থ অবস্থার ছবি দেখাল। অসম্ভব সুন্দর ছিলেন দেখতে! ক্যান্সার কতটা বদলে দিয়েছিল! নাদভি বলল, ‘আমার স্মৃতিতে অসুস্থ চেহারাটাই ভাসতে থাকে সবসময়। তাই হয়তো ওই ছবিগুলো প্রথমে দেখিয়ে ফেলেছি। কিছু মনে কোরো না।’

লগ্ন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কী মনে করব?’

নাদভি আমতা আমতা করে বলল, ‘না মানে, যদি ভাবো মা আসলেই অসুস্থ ছিল এটা প্রমাণ করার জন্য ওই ছবিগুলো দেখিয়েছি। আসলে ব্যাপারটা তা নয়।

‘উফ ধুর! আমি এমন কিছুই ভাবিনি। তুমি তোমার গিল্টনেসের কারণে এতকিছু ভাবছ। এসব ভাবা বন্ধ করো তো। যা গেছে তা গেছে।’

ইতোমধ্যে রান্না হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার হয়ে আসবে, তাই খাবার দাবার সব তাঁবুর ভেতর নিয়ে গেল।

তাঁবুতে ঢুকে নাদভি জিজ্ঞেস করল, ‘আজ একা ঘুমাতে পারবে নাকি আজও ভয় করবে?’

লগ্ন নাদভির মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। গলার পেছনে দু’হাত বেঁধে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন আমার সাথে এক তাঁবুতে ঘুমাতে ভয় পাচ্ছ?’

নাদভির যে কী হলো! সে লগ্নর কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে বলল, ‘তা একটু পাচ্ছি বইকি।’

লগ্ন মিটিমিটি হেসে বলল, ‘তোমার স্পর্শ তো বলে না কোনো ভয় পাচ্ছ।’

‘হাতে হয়তো ভয় নেই, মনে আছে।’

‘তাহলে মন না হলেও হাত অবাধ্য হতে পারে বলছ?’

নাদভি হো হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল, ‘তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার কোনোকিছুই অবাধ্য হবে না কখনো।’

‘আর যদি আমার ইচ্ছে করতে বাধ্য করো?’

‘এমনটা কখনোই করব না।’

লগ্ন এবার ঘোরলাগা গলায় বলল, ‘একটু করলে কী হয়? নাদভি হেসে বলল, ‘উসকাচ্ছ কেন আমাকে?

লগ্ন এবার নাদভিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘জানিনা।’

নাদভিও জড়িয়ে ধরল। সত্যিই উসকে গেছে সে। অবাধ্য হতে ইচ্ছে করছে এখন। কিন্তু এই ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেবে না। কিছুতেই না।

নাদভি সরে গিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, খাওয়ার পানি শেষের দিকে। পানি নিয়ে আসি।’

লগ্ন বলল, ‘আমি একা থাকতে পারব না এখানে।

‘তাহলে তুমিও চলো।’

দুজন মিলে পানি আনতে গেল। পানি এনে রাতের খাবার সেড়ে দুজনে কিছুক্ষণ ক্যাম্পগ্রাউন্ডে হেঁটে এলো। তারপর যার যার বিছানায় শুয়ে পড়ল। লগ্ন কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল কিন্তু উসকে যাওয়া নাদভির সহজে ঘুম এলো না।

২৩

আসার সময় লগ্ন-নাদভি ব্যানফ হাইকিং ম্যাপ এবং গাইডবুক কিনে এনেছিল। পরদিন সকালে সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল তারা। আজকের গন্তব্য বো ফলস। ম্যাপ ও গাইডবুক দেখে সারাদিনের পরিকল্পনা সাজিয়ে নেয়া হয়ে গেলে দুজন মিলে বার্গার তৈরি করতে বসলো। যেহেতু সারাদিনের পরিকল্পনা তাই দুপুরের খাবারটা সাথে করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সঙ্গে কিছু ফল নিল ছোট ক্ষুধার জন্য।

ব্যানফ থেকে হাইকিং করে বো ফলসে পৌঁছতে হবে। বো নদীর পাশে ট্রেইল তৈরি করা আছে, সেটা ধরেই তারা হাঁটছিল। দুজনের কাঁধেই ব্যাগ। ব্যাগে খাবার, পানিসহ সারাদিনের জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। নদীর ওপাড়ে তাকালে প্রথমে সবচেয়ে উঁচুতে দেখা যায় ঝকঝকে নীল আঁকাশ। তার নিচে ছোট-বড় পাহাড়, সামনে সবুজ পাইন গাছ, তার নিচে নীলচে সবুজ পানির স্রোতসিনী বো নদী। আঁকাশ থেকে শুরু করে নদী পর্যন্ত কী অপূর্ব রঙের খেলা। হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় দাঁড়িয়ে পড়ি, চুপচাপ উপভোগ করি। কিন্তু তাদের গন্তব্য যে আরো সুন্দর জায়গা!

হাঁটতে হাঁটতে নাদভি একসময় বলল, ‘বো নদীর ট্রেইল এত সুন্দর, ফলস পর্যন্ত না যেতে পারলেও আক্ষেপ থাকবে না।’

লগ্ন বলল, ‘আমার থাকবে। বো ফলস দেখার জন্যই এত কষ্ট করে এতটা পথ হাঁটছি।’

নাদভি হাসতে হাসতে বলল, ‘একটু হাঁটাহাঁটির অভ্যাস রেখো। তাহলে এত অল্প হেঁটেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে না।’

লগ্ন বলল, ‘ওমা প্রতিদিন মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত কে হাঁটতো? এখন তুমিই তো আমাকে গাড়ি করে অফিস নিয়ে এসে অলস বানিয়েছো। আমি নিশ্চিত যখন আমি মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত হাঁটতাম তখন এলে আমার হাঁটতে এতো কষ্ট হতো না।’

নাদভি হেসে বলল, ‘অফিস টাইমে আর অফিস শেষে হেঁটে কষ্ট করার দরকার কী? অন্য সময়ে হাঁটবে। আমি যেমনটা করি।’

লগ্ন ভেংচি কেটে বলল, ‘তোমার মতো অত আলগা তেল নেই আমার গায়ে।’

লগ্ন এক জায়গায় বসে পড়ে বলল, ‘দাঁড়াও একটু বসে যাই।’

নাদভি দাঁড়ালো। লগ্ন পানি খেল। তারপর একটা এনার্জি বার খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করলো।

দূরে বো ফলস দৃশ্যমান হতে না হতেই পানির শব্দ শোনা গেল। কি অদ্ভুত প্রকৃতির সঙ্গীত! ঝর্নার এই সঙ্গীতের নেশায় যে একবার পড়েছে সে কখনও এই নেশা ছাড়াতে পারে না। লগ্নরও হয়েছে সেই দশা!

বো ফলসের পানি মাত্র ৩০ ফিট উপর থেকে পড়ে। প্রস্থ ১০০ ফিট। কিন্তু এর সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। ফলসের একপাশে বড় পাহাড় আরেক পাশে ট্রেইলের পাশেই খাঁজকাটা ছোট পাহাড়।

এখানে অনেক রকম অ্যাক্টিভিটি আছে। লগ্ন-নাদভি বেছে নিল রাফটিং। রাফটিংয়ে দুজনেই নতুন। কিন্তু দারুণ অভিজ্ঞতা হলো। কী ভয়ংকর সব স্রোত পেরিয়ে গেল! প্রথমদিকে মনে হচ্ছিল রাফটিং বোট উলটে পড়ে যাবে। কিন্তু পড়লো না। এরপর খুব দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে গেল। তখনই আসল মজাটা শুরু হলো।

রাফটিং শেষে দুজনে জামাকাপড় পালটে লাঞ্চ করতে বসলো। খেতে খেতে নাদভি বলল, ‘আমার জীবনের বেস্ট একটা এক্সপেরিয়েন্স ছিল এটা।’

লগ্ন বলল, ‘আমারও। থ্যাংক ইউ সো মাচ। তুমি না থাকলে এটা সম্ভব হতো না।’

নাদভি হেসে বলল, ‘আমার ক্ষেত্রেও তাই। তুমি না থাকলে তো এখানে আসাই হতো না।’

লগ্ন এবার দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি না থাকলে আর কী কী হতো না বলো তো?’

নাদভি হেসে বলল, ‘সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার ড্রাইভ করে আসা হতো না। ব্যানফ দেখা হতো না। হট স্প্রিংয়ে সাঁতার কাটা হতো না। কাঠ কাটা হতো না। আর…’

‘আর?’

‘আর মুগ্ধ চোখে ঘুমন্ত পরি দেখা হতো না!

চমকে তাকালো লগ্ন। নাদভি চোখ সরিয়ে নিল।

২৪

লেক লুইসকে পাখির চোখে দেখার লোভে লগ্ন ও নাদভি পরদিন হাইকিং করা শুরু করল। বিশাল জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। গাছপালার ফাঁক দিয়ে রকি মাউন্টেইন দেখা যায়। ৪৫ মিনিটের সহজ হাইকিং। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে দেখা গেল কিছু কিছু জায়গায় রাস্তা খুবই উঁচু। হুট করেই কোনো পরিকল্পনা ছাড়া বিকেলবেলা তারা রওনা হলো। সূর্য ডোবার আগে ফিরে আসতে পারলেই হয়। এই সময়ে মানুষজন নেমে আসছে। শুধু তারাই ওপরে উঠছে। লগ্ন একটা জায়গায় গাছের গুঁড়ির ওপর বসে পড়ল।

বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, ‘দাঁড়াও, একটু বসে যাই। পা ব্যথা করছে।’

নাদভিও এসে পাশে বসল। লগ্ন পানি খেয়ে বলল, ‘কী অদ্ভুত সুন্দর জায়গা তাই না! কত বড় বড় গাছ!’

নাদভি বলল, ‘হ্যাঁ। আমার তো এখন মনে হচ্ছে ৪৫ মিনিট কেন ৯০ ঘণ্টা লাগলেও আপত্তি নেই।’

‘না না। তখন আবার বেশি পা ব্যথা করবে।’

নাদভি হাসল। লগ্নর থেকে নিয়ে পানি খেয়ে তারপর বলল, ‘আর কোথাও যেতে চাইলে আজকেই যেতে হবে কিন্তু। কাল সকালে আমরা রওনা হচ্ছি, মনে আছে তো?’

‘আরে না। এবার আর কোথাও যাব না। অত ছোটাছুটি করতে চাই না। রিল্যাক্সে ক্যাম্পিং করতেই তো আসা। তারমধ্যে যতটুকু যা ঘুরেছি তা যথেষ্ট।’

‘ঠিক আছে।’

আরো কিছুক্ষণ বসে তারা রওনা হলো। আরো দুবার মিনিট পাঁচেকের বিশ্রামের পর তাদের হাইকিং শেষ হলো। ওপরে উঠে সামনের সৌন্দর্য দেখে দুজন কথা বলতে ভুলে গেল। অনেক নিচে নীল পানির সম্পূর্ণ লেক লুইস একসাথে দেখা যাচ্ছে। নীল বললেও ভুল হবে, অনেকটা প্যাস্টেল রঙের মতো। ওপর থেকে লেকটাকে ছোট লাগছে। লেকের ওপারে পাইনের জঙ্গল।

লগ্ন একটা বেঞ্চে বসে ছিল। নাদভি হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতে সে কিছু বুনোফুল দেখতে পেল। কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন রঙের ফুল ডাঁটাসহ ছিঁড়ে একটা তোড়ার মতো বানালো। তারপর সেটা নিয়ে লগ্নর কাছে গেল। লগ্ন খেয়াল করেনি। সে লেক লুইসের সৌন্দর্যে ডুবে আছে তখনো। নাদভি আচমকা হাঁটু গেড়ে বসে ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘উইল ইউ বি মাই ওয়াইফ? রিয়েল ওয়াইফ?’

লগ্ন অবাক হলো। সঙ্গে ভীষণ ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হলো মন। সে ফুলের তোড়াটা নিয়ে নাদভির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। লগ্ন মাথা নেড়ে বলল, ‘ইয়েস। আই উইল।’

এবার নাদভিও উঠে দাঁড়াল। তারপর অবাক হলো লগ্নর চোখে জল দেখে। বলল, ‘তুমি কাঁদছ?’

লগ্ন আচমকা নাদভিকে জড়িয়ে ধরলো। নাদভি জড়িয়ে ধরে জানতে চাইল, ‘কাঁদছ কেন?’

লগ্ন কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘জানি না। আই লাভ ইউ।’

নাদভির বুঝতে বাকি রইল না এ কান্না সুখের কান্না। সে লগ্নর মুখটা দুহাতে ধরে চোখের পানি মুছে দিলো। বলল, ‘আই লাভ ইউ টু।’

কিছু বুঝে ওঠার আগেই নাদভি লগ্নর ঠোঁটে চুমু খেলো। এক মুহূর্ত পর সরে যেতেই লগ্ন তাকে ধাক্কা দিয়ে বেঞ্চে ফেলে তার কোলে বসে চুমু খাওয়া শুরু করল। এই ভালোবাসার ক্ষণের সাক্ষী হয়ে রইল রকি মাউন্টেইন, লেক লুইস, পাইন গাছ, মেঘেরা আর পাখিরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *