লগ্নজিতা – ১৫

১৫

লগ্ন কানাডা শিফট হবার পর অফিসে জয়েন করতে আর তিন দিন বাকি রইল। এবার আর ফার্নিচার কেনার ভুল করেনি সে। ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছে। সে যখন মিসিসাগা শহরে নামল তখন রাত। তাই শহরটাকে বিশেষ কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু সকালবেলা প্রথমবার যখন বাসার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল, তখন মিসিসাগা শহরের অনেকটাই তার চোখের সামনে। একদিকে উঁচু উঁচু দালান, আরেকদিকে আবাসিক এলাকা, এখানে দোতলার ওপরে কোনো বাসা নেই। আর সামনে নীল জলরাশির প্রশস্ত অন্টারিও লেক। এক পলকেই শহরটার প্রেমে পড়ে গেল।

লগ্ন নাস্তা সেড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে একটা কফি নিল। কফি হাতে হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে গেল লেকের দিকে। লেকটা তার বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। এই লেকের পাড় টা একদম সী বিচের মতো। কী অপূর্ব! পুরোটা সকাল সে লেকের পাড়ে হেঁটে বেড়াল। লেকসংলগ্ন পার্কে ঘুরল। দুপুরবেলা প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগায় বাইরেই খেয়ে নিল, এখন আর বাসায় ফিরে রান্না করার মতো সময় নেই। খেয়ে আবার ঘুরতে লাগল। এবার অন্যদিকে। সারাদিন ঘুরে রাতেও বাইরেই খেয়ে নিল। তারপর বাসায় ফিরে এক ঘুমে সকাল করে দিলো।

আজ লগ্নর মিসিসাগা অফিসের প্রথম দিন। একটু আগেভাগেই বের হলো, প্রথমদিন যেন দেরি না হয়ে যায়। অফিসে তাকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হলো। তারপর যখন তার টিমমেটদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো তখন লগ্ন অবাক হয়ে চেয়ে রইল নাদভির দিকে। অথচ সেই প্রতারক খুব স্বাভাবিক রইল। যাকে এতদিন আমেরিকায় নানাভাবে খুঁজেছে তাকে পেয়ে গেল কানাডায় তারই অফিসে তারই টিমমেট হিসেবে। দুনিয়াটা কী অদ্ভুত!

নাদভি যেমন স্বাভাবিক, লগ্নও নিজেকে ততটাই স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছে সারাদিন। নাদভিকে পেলে সে কী কী বলবে কী কী করবে-সব ঠিক করে রেখেছিল। এখন ওকে এখানে দেখে সব গুলিয়ে গেছে। ভাবতে হবে আরও অনেক ভাবতে হবে। অফিস শেষ করে লগ্ন যখন বের হলো তখনই পেছন পেছন নাদভি বের হলো। দূর থেকেই ডাক দিলো। লগ্ন দাঁড়াল। নাদভি কাছাকাছি এসে বলল, ‘আমরা কি কোথাও বসে কথা বলতে পারি?’

‘না।’

লগ্ন এ কথা বলে আবার হাঁটা শুরু করল।

নাদভি পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘প্লিজ লগ্ন। প্লিজ তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।’

লগ্ন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কথা থাকলে নিজেই যোগাযোগ করতে। আমার সাথে যোগাযোগ করার সব রাস্তা তোমার খোলাই ছিল।’

‘মানছি। কিন্তু তোমার সাথে যোগাযোগ করার মতো সাহস আমার ছিল না। এখন যখন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন, এই সুযোগটা হারাতে চাই না।’

নাদভি ও লগ্ন একটা কফিশপে বসল। মুখোমুখি দুজন, যে লগ্ন ভেবেছিল নাদভিকে পেলে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাবে সে নাদভির দিকে তাকাতেও পারছে না এখন। শরীর ভেঙে কান্না পাচ্ছে। কিন্তু এখন তো কাঁদা যাবে না। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে এখন তার কান্না আটকে রাখতে হবে।

নাদভি বলল, ‘লগ্ন, আমি তোমার সাথে এমনটা করতে চাইনি। লগ্ন বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, ‘তাহলে কি আমি বাধ্য করেছি তোমাকে?’

নাদভি মাথা নিচু করে বলল, ‘না। কেউই বাধ্য করেনি। কিন্তু ওই সময়টা…’

লগ্ন চুপ। নাদভি আবার বলতে শুরু করল, ‘লগ্ন, তুমি যাদের আমার বাবা-মা বলে চিনেছ তারা আমার কেউ না। জাস্ট টিমমেট ছিল। আমার বাবা ডাক্তার ছিল। আমি যখন ভার্সিটিতে অ্যাডমিশনের জন্য কোচিং করি তখন তিনি মারা যান। বাবার রেখে যাওয়া জমানো টাকাপয়সা দিয়ে মা কোনোভাবে আমার পড়াশোনা চালিয়ে নেয়। পাবলিকে চান্স পেয়ে যাই তাই খুব একটা অসুবিধা হয়নি। অসুবিধা হলো মা অসুস্থ হবার পর। তখন সবে আমার গ্রাজুয়েশন শেষ হয়েছে। মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ল।

ক্যান্সারের কথা শুনেই লগ্নর মনে হলো আরেকটা ঢপ মারছে নাদভি আর সে গিলছে। তবে কিছু বলল না। চুপচাপ শুনতে লাগলো। নাদভি বলল, ‘মায়ের ট্রিটমেন্টের জন্য প্রচুর টাকা দরকার। তাই মাস্টার্স না করেই চাকরির চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু আমাদের দেশের চাকরির বাজার তো জানো। এদিকে মায়ের ট্রিটমেন্ট তো থামিয়ে রাখা যায় না। বাবার রেখে যাওয়া টাকা শেষ হবার পর জমি-জমা, বাড়ি-ঘর যা কিছু ছিল সব একে একে বিক্রি করে দিয়েছি। তখন আসলে মাকে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আমার জীবনে আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। টাকা-পয়সা, সম্পত্তি সব যখন শেষ হয়ে যায় তখনো চাকরি পাইনি। এরপর টাকার জন্য এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যা আমি করিনি। ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত ভাবার মতো বোধ ছিল না। একটাই বোধ ছিল মাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’

এবার লগ্ন জিজ্ঞেস করল, ‘সবই বুঝলাম। তোমার টাকার দরকার ছিল। কিন্তু নাদভি, তুমি আমাকে প্রেমের জালে কেন ফেলেছিলে? বিয়ে তো ঠিক হয়েই গিয়েছিল। ওটা হতোই। তোমার পরিকল্পনাও সফল হতো। তাহলে ওই প্রেম প্রেম খেলার কী দরকার ছিল?

নাদভি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘জানি তুমি আমার কোনো কথা বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করার মতো কাজ আমি করিনি। কিন্তু আজ আমি একটি বর্ণও মিথ্যে বলছি না। আমি তোমাকে প্রেমের জালে ফেলিনি লগ্ন। উলটো নিজেই প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়েছিলাম। বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর তোমার সাথে যত সময় কাটাতাম ততই ভালো লাগত। তোমার সাথে থাকাকালে আমি নিজের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে পারতাম না। এই কাজ আমরা আগেও কয়েকবার করেছি। কিন্তু কখনো কারো প্রেমে পড়িনি। যেহেতু আমি জানিই আমি ধোঁকা দিতে যাচ্ছি সেখানে প্রেমে পড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু কীভাবে যেন তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম। অন্যসময় হলে আমি ওই মুহূর্তে সরে যেতাম। কিন্তু আমার মা তখন হাসপাতালে। টাকা লাগবে আমার। মেহেদির দিন আমি যখন তোমাকে দেখতে দিনাজপুর গিয়েছিলাম সেদিন এতটা ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম যে ভেবেছিলাম, যা হওয়ার হবে সব বলে দিই তোমাকে। কিন্তু আমার তখনকার পরিস্থিতি আমাকে বলতে দেয়নি।’

‘তোমার মা হাসপাতালে থাকলে তুমি তখন দেশ ছাড়লে কীভাবে?’

‘দেশ ছাড়িনি তো। গা ঢাকা দিয়ে ছিলাম। কয়েক মাস পর মা মারা যান। ততদিনে সব টাকাপয়সাও শেষ। টিমমেটরা নতুন কাজের কথা বললে ওদের ফিরিয়ে দিই। যে মানুষটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এসব করতাম সেই তো নেই। ডিপ্রেশনে পড়ে যাই। একটা সময় ভাবলাম পড়াশোনাটা আবার শুরু করা দরকার। স্কলারশিপের জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম। আমেরিকায় একটা ইউনিভার্সিটিতে হয়ে গেল। তখন দেশ ছাড়লাম।’

‘কোন ইউনিভার্সিটি?’

‘মিসৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটি।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কী! চাকরিবাকরি শুরু করলাম। ওয়ালমার্টই আমাকে কানাডায় ট্রান্সফার করল।’

‘আশা করি তোমার সব কথা শেষ হয়েছে। এখন আমি উঠি।’

‘আমাকে কি ক্ষমা করা যায় লগ্ন? আমি জানি আমি যা করেছি তা ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না। কিন্তু তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমিও শান্তি পাইনি। যতটা কষ্ট তোমাকে দিয়েছি তার অনেকগুণ বেশি কষ্ট আমি পেয়েছি।’

লগ্ন এবার হেসে বলল, ‘সারারাত একসাথে কাটিয়ে বিয়ের পরদিন যখন স্বামী গয়নাগাটি নিয়ে পালিয়ে যায় তখন বাংলাদেশের একটা মেয়ে আশেপাশের মানুষদের থেকে কী পরিমাণ গঞ্জনা সহ্য করে তার বিন্দুমাত্র ধারণা যদি তোমার থাকত তাহলে আমার চেয়ে বেশি কষ্ট তুমি পেয়েছ এ কথা ভুলেও বলতে না।’

নাদভি মাথা নিচু করে ফেলল। লগ্ন এবার উঠে দাঁড়াল। চলে যাচ্ছিল। আবার ফিরে এসে বলল, ‘আর হ্যাঁ, তোমাকে আমি কখনোই ক্ষমা করব না নাদভি আহমেদ।

তারপর চলে গেল লগ্ন। নাদভি দুহাতে মুখ ঢেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল!

১৬

বাসায় গিয়ে লগ্ন পাগলের মতো কাঁদলো। নাদভির দ্বারা প্রতারিত হবার পরেও সে এতটা কাঁদেনি, যতটা আজ কাঁদল। এতদিনের সব জমানো কষ্টের যেন বাঁধ ভেঙে গেছে আজ। কেন একটা প্রতারককে এতটা ভালোবেসে ফেলল যে ওর সব কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে! যখন প্রতারিত হলো সেই মুহূর্তেই তো সব ভালোবাসা উধাও হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ গেল না! এমনভাবেই রয়ে গেল যে, মন বলে ও আজ সব সত্যি বলছে। কিন্তু মস্তিষ্ক বলে ও মিথ্যা বলছে। নিজের ওপর এত রাগ আগে কখনো লাগেনি তার।

পরদিন সকালে লগ্ন ইফতেখার মাহমুদকে ফোন করল। ইফতেখার বললেন, ‘অনেকদিন পর আপনার ফোন। তা কেমন চলছে?’

‘চলছে ভালোই। আপনার কী খবর?’

‘ভালো।’

‘ইফতেখার আমার একটি ব্যাপারে আপনার সাহায্য দরকার।’

‘জি বলুন।’

‘নাদভির বাবা-মা কীভাবে মারা গেল সেটা আমার জানা দরকার। আপনি কি একটু খোঁজ লাগিয়ে দেখবেন?’

‘নিশ্চয়ই। ও এখন কোথায় সেটা জানা না গেলেও আশা করি এটা জানা যাবে। তবে কথা দিতে পারছি না যে আসলেই কোনো তথ্য দিতে পারব কি না। চেষ্টা করব।’

‘ওতেই হবে।’

ইফতেখার কলব্যাক করল দুদিন পর। জানাল, সে এক বন্ধুর মাধ্যমে জেনেছে নাদভির বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন আর মা দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে মারা গেছেন।

.

এই অফিসে সবচেয়ে অসহ্যকর বিষয় হচ্ছে লগ্নকে নাদভির সাথে একই টিমে কাজ করতে হচ্ছে। কাজের কারণেই প্রতিদিন তাদের কথা হচ্ছে। এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। একদিন লগ্ন পায়ে ব্যথা পেল। তাদের টিম লিডার বলল, নাদভি যেন লগ্নকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। লগ্ন প্ৰথমে মানা করলেও পরে রাজি হলো।

লগ্ন গাড়ি থেকে নেমে একাই পা টেনে টেনে হাঁটছিল। নাদভি বলল, ‘আমি ধরব?’

লগ্ন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘খবরদার। আমাকে ধরতে এলে হাত ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দেব।’

‘আচ্ছা তোমার ব্যাগগুলো আমাকে দাও।’

আজ অফিসে লগ্নর পার্সেল এসেছিল তাই বাড়তি ব্যাগ রয়েছে। সেগুলো নাদভির হাতে দিয়ে সে নিজেই হেঁটে গিয়ে লিফটে উঠল। বাসায় ঢুকে চেয়ার টেনে বসে জুতো খুলতে খুলতে বলল, ‘এবার বিদেয় হও।’

নাদভি ব্যাগগুলো রেখে হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে বসল, ‘কিছু মনে না করলে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি, বাসা দেখে মনে হচ্ছে তুমি এখানে একা থাকো। তোমার হাজবেন্ড কোথায় থাকেন?’

লগ্ন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলতে চাও তুমি?’

‘স্পষ্টই তো বললাম।’

লগ্ন বিরক্তমুখে বলল, ‘বিয়ে করিনি। একবার করে সাধ মিটে গেছে।’

নাদভি এবার চমকে উঠে বলল, ‘তাহলে দরজার নেমপ্লেটে মিসেস লেখা দেখলাম যে! তুমি কি এখনো নিজেকে আমার স্ত্রী ভাবো?’

আসলে এখানে যেন ভুলেও তাহসিনের মতো কেউ জুটে না যায় তাই লগ্ন নেমপ্লেটে নামের আগে মিসেস যুক্ত করেছে। মেজাজ ধরে রাখতে না পেরে লগ্ন এবার চিৎকার করে বলল, ‘এক্ষুনি বেরিয়ে যাও তুমি আমার বাসা থেকে।’

নাদভি লগ্নর সামনে মেঝেতে বসে পড়ল। তারপর অনুনয় করে বলল, ‘যাচ্ছি। তুমি শুধু এই একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।’

লগ্ন এবার রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল, ‘আমার ভাবা না ভাবাতে কিছু যায় আসে না। বিয়ের পর তিন বছর পর্যন্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলে কেউ আর স্বামী-স্ত্রী থাকে না।’

‘ঠিক। কিন্তু অনুভূতিরা রয়ে যায়।’

নাদভি সঙ্গে সঙ্গে নিজের ওয়ালেট বের করে দেখাল সেখানে তাদের বিয়ের একটি ছবি রাখা। তারপর বলল, ‘আমারও রয়ে গেছে, তোমারই মতন।’

লগ্ন হেসে বলল, ‘এটা তুমি আমাকে দেখানোর জন্য রিসেন্টলি প্রিন্ট করে রেখেছ।’

নাদভি এবার ছবিটা বের করে উল্টোপাশে প্রিন্ট করা তারিখটা দেখাল। তাদের বিয়ের ঠিক একবছর পরের তারিখ। নাদভি বলল, ‘ফার্স্ট অ্যানিভার্সারিতে এটা প্রিন্ট করেছিলাম ওয়ালেটে রাখার জন্য। সেই থেকে আছে।’

লগ্ন এবার উঠে গিয়ে দরজা খুলল। তারপর নাদভির হাত ধরে টেনে দরজার সামনে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিল।

.

সামনে উইকেন্ড আছে। তার আগে দুদিন অফিস। এই দুদিন লগ্নকে হোম অফিস দেয়া হয়েছে। লগ্ন অভিভূত হয়ে গেল এই ঘটনায়। এইটুকু পা ব্যথার কারণে কোনো অফিস সেধে হোম অফিস দেয়? বাংলাদেশিদের জন্য এটা স্বপ্ন।

সপ্তাহের শেষ দিন অল্প অল্প বরফ পড়তে শুরু করেছে। বরফ দেখেই লগ্নর মনটা বিরিয়ানি বিরিয়ানি করতে লাগল। কিন্তু শরীরের যে অবস্থা রান্না করার কোনো এনার্জি নেই। তার পছন্দের বিরিয়ানি আছে পাশের শহর টরোন্টোতে। কে যায় পা ব্যথা নিয়ে এখন অতদূরে! কানাডায় এসেই টরোন্টো গিয়ে বিরিয়ানি খেয়েছিল। সেই ছবিটা ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করে লিখল, স্নোফল দেখে সবার আগে এই বিরিয়ানিটার কথা মনে পড়ল।

রাতে নাদভি এলো।

লগ্ন ইন্টারকমে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী চাই? এখানে কেন এসেছ?’

‘তোমার বিরিয়ানি ক্রেভিংয়ের পোস্ট দেখে আমারও বিরিয়ানি ক্রেভিং হচ্ছিল। তাই নিয়ে এলাম। ভাবলাম ডিনারটা একসাথে করি।’

লগ্নর মেজাজ খারাপ হলো।

বলল, ‘তুমি আমাকে ইন্সটায় ফলো করো?’

‘সবকিছুতেই করি।’

‘তোমার যে কত ফেইক পরিচয় আছে আল্লাহ জানে! তোমার বিরিয়ানি তুমি নিয়ে বিদেয় হও।’

নাদভি অনুরোধ করে বলল, ‘আচ্ছা ঠিকাছে আমার সাথে খেতে হবে না। কিন্তু প্লিজ বিরিয়ানিটা তো রাখো। এই স্লোফলের মধ্যে টরোন্টো গিয়ে এনেছি।’

‘কেন এনেছ? তোমাকে তো আনতে বলিনি।’

‘আচ্ছা ভুল হয়ে গেছে। আজকে তো রাখো।

এরপর লগ্ন কী মনে করে যেন নাদভিকে আসতে দিলো। লগ্ন খাবার গরম করতে গেলে নাদভি বলল, ‘আমি করে দিই।’

লগ্ন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘এটা তোমার বাসা না। আমার বাসা। চুপচাপ লিভিংরুমে গিয়ে বসো।’

নাদভি লিভিংরুমে বসে মুগ্ধ চোখে দেখছিল লগ্ন খাবারগুলো গরম দিয়ে শসা, টমেটো কুচি কুচি করে একটা সালাদ তৈরি করছে। আটপৌরে একটা ট্রাউজার আর সোয়েটারেও কি সুন্দর লাগছে ওকে!

খাবার টেবিলে দিয়ে লগ্ন নাদভিকে ডাকলো।

খেতে খেতে নাদভি বলল, ‘তোমার বাবা শেষ অবধি তোমাকে বিদেশে পড়তে পাঠাল?’

লগ্ন ব্যঙ্গ করে বলল, ‘অবশ্য সেক্ষেত্রে তোমার সামান্য অবদান আছে। তুমি আমার জীবনটা জাহান্নাম না বানালে বাবা কখনোই আসতে দিত না।’

‘ভেবনা তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি সুখে ছিলাম। মা মারা যাবার পর আমার জীবনটাও জাহান্নামই হয়ে গিয়েছিল।’

লগ্ন প্রসঙ্গ পালটে বলল, ‘তুমি কিন্তু ভালো রকমের বেহায়া। সেদিন ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার পরেও আজ আবার এসেছ! আমাকে কেউ এভাবে বের করে দিলে আর কোনোদিন তার ত্রিসীমানায় যেতাম না।’

নাদভি হেসে বলল, ‘আমি যা করেছি তাতে ওইটুকু কিছুই না। তুমি জুতো খুলে পেটালেও আবার আসব।’

এবার লগ্ন হাসল।

জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? এবার কেন পটাতে চাইছ? এবার তোমার উদ্দেশ্য কী?’

নাদভি গম্ভীর গলায় বলল, ‘কোনো উদ্দেশ্য নেই। যে নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের দোষে হারায়, কোনোদিন আর সামনে পাওয়ার সুযোগ নেই জেনেও ভালোবাসতে থাকে। সে যদি হঠাৎ করে তার ভালোবাসার মানুষটাকে সামনে পায়, কী করবে সে? আবার পাওয়ার চেষ্টা কী করবে না? আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’

লগ্ন বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল, ‘তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি।’ নাদভি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওটা তো আজন্মকাল বেশিই ছিল। নাহলে অত ভয়ংকর সব কাজ কীভাবে করতাম?’

লগ্নর নিজের ওপর ভয়ংকর রাগ হচ্ছিল। একবার মনে হয় মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদুক, আরেকবার মনে হয় মানুষটাকে খুন করে ফেলুক। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না।

১৭

লগ্ন আজ থেকে আবার অফিসে যাবে। অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নিচে নামতেই দেখে নাদভির গাড়ি। লগ্নকে দেখেই সে গাড়ি থেকে নেমে এলো।

লগ্ন ধমকে বলল, ‘এখানে কী চাই?’

নাদভি বলল, ‘না মানে, খবর পেলাম আজ থেকে তুমি অফিস করবে। এত স্নো পড়ছে। বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে যেতে তো তুমি জমে যাবে। তাই ভাবলাম আমি তো যাচ্ছিই, আমি নিয়ে যাই।’

লগ্ন চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার ব্যাপারে এত ভাবতে বলেছে কে তোমাকে? আমি বাসেই যাব। দেখি স্নো আমার কী করতে পারে!’

লগ্ন হনহন করে হেঁটে চলে গেল। নাদভি পেছন পেছন এলো কিছুক্ষণ।

একসময় লগ্ন পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘আমার পেছন পেছন এলে আজকেই চাকরি ছেড়ে দেব। দুনিয়ায় চাকরির অভাব নেই।’

এবার আর সাথে সাথে গেল না নাদভি। লগ্নকে সে ভয় পায়!

.

অফিস শেষ করে লগ্ন একটা শপিং মলে গেল। এটা তার খুবই পছন্দের জায়গা। মন ভালো না থাকলে মাঝেমাঝে এখানে এসে বসে থাকে। মানুষ দেখে।

লগ্ন যখন একা একা বসে মানুষের কাজকর্ম দেখছিল তখনই পাশে এসে দাঁড়াল নাদভি। তাকে দেখেই লগ্নর মাথা গরম হয়ে গেল। কিন্তু সে এখন শান্ত থাকতে চায়। তাই কিছু বলল না।

নাদভি বলল, ‘তোমার সাথে কিছুক্ষণ বসতে পারি?’

লগ্ন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ফলো করতে করতে তো এসেই পড়েছ। এখন যে বড় অনুমতির ধার ধারছো? ফলো করার আগে অনুমতি নিয়েছিলে?’

নাদভি কিছু বলল না। বসলোও না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। গা জ্বলে গেল লগ্নর।

সে বলল, ‘ঢঙে মরে যাচ্ছে! বসো।’

নাদভি এবার বসলো। কিন্তু তেমন কিছু বলল না।

লগ্নই জিজ্ঞেস করল, ‘কেন এসেছো? কী বলতে?’

নাদভি মাথা নেড়ে বলল, ‘তেমন কিছু না। শুধু তোমার সাথে কিছুক্ষণ বসব বলে এলাম।

লগ্ন এবার নাদভির দিকে ফিরে বসলো।

তারপর বলল, ‘এই তোমার মত এতবড় একটা ক্রিমিনাল দেশ ছাড়লো কীভাবে আমাকে বলো তো? কোথাও আটকালে না?’

নাদভি মাথা নিচু করে বলল, ‘যা করেছি সব ফেক আইডেন্টিটি দিয়ে করেছি। তাই সমস্যা হয়নি।’

‘নকল বিয়ে ছাড়া আর কী কী করেছো একটু শুনি তো। অনেক শখ জেগেছে আজ সবকিছু জানার।

নাদভির মন প্রচণ্ড খারাপ। শুরু থেকেই সে অপরাধবোধে ভুগছে। এখন আরো খারাপ লাগছে।

সে বলল, ‘মানুষের বাড়িঘরে চুরি করেছি কয়েকবার। একবার এটিএম বুথের টাকাও চুরি করেছি। সেবার এত ইফোর্ট দিয়েছি, এত রিস্ক নিয়েছি, কিন্তু মেশিনে টাকা ছিল খুবই কম।’

লগ্ন বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, ‘আল্লাহর বিচার আল্লাহ করে।’

নাদভি বলল, ‘সেতো অবশ্যই। তা না হলে আমার মা হয়তো বাঁচতেন। সব অবৈধ টাকা ঢেলেছি বলেই হয়তো দ্রুত আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন।’

এ কথায় লগ্নর হঠাৎ খারাপ লাগলো। কথাটা হয়তো মিথ্যে নয়, তবে সে এভাবে বলতে চায়নি। এবার গলা নরম করে বলল, ‘অন্যভাবে চেষ্টা করলে না কেন?’

নাদভি এবার লগ্নর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার কি মনে হয় আমি অন্য কোন ভাবে চেষ্টা করিনি? যখন চাকরি পাইনি, এমন কোন কাজ নেই যা করিনি। কিন্তু এত পরিশ্রম করেও মাসে যে টাকা আমি পেতাম তাতে মায়ের এক সপ্তাহ চিকিৎসা হতো না। আমার চোখের সামনে দিন দিন তার অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। অসহায় চোখে চেয়ে দেখা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। তখনই ওই অন্ধকার জগত আমাকে পথ দেখায়। অন্ধকার জগতে অন্ধকার কাজ করেই আমি সেই পরিমাণ টাকা পেতাম, যে পরিমাণ টাকা মায়ের চিকিৎসার জন্য দরকার হতো।’

লগ্ন কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো, ‘ভয় হতো না?’

নাদভি অবলীলায় বলল, ‘নাহ। ডেসপারেট হয়ে গিয়েছিলাম। ছোটবেলা থেকে মায়ের খুব পাগল ছিলাম। একমাত্র সন্তান ছিলাম বলে মাও আমাকে ছাড়া দু’চোখে কিছু দেখতেন না।’

লগ্ন প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য বলল, ‘চলো হাঁটি। বসতে আর ভালো লাগছে না।’

প্রায় সব দোকানে ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল চলছে। লগ্ন ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো কোথায় কতটা সেল দিচ্ছে। তার একটা উইন্টার জ্যাকেট কেনা দরকার।

নাদভি বলল, ‘রাতের খাবার একসঙ্গে খাই?’

‘বাঙালি বসতে দিলে খেতে চায় এই কথা প্রমাণ করতে চাইছো?’

নাদভি হাসলো। লগ্ন আরো কয়েকটা দোকান ঘুরতেই ৫০% সেলে ভালো একটা উইন্টার জ্যাকেট পেয়ে গেলো। সেটা কিনে নিলো। এরপর চোখে পড়লো চকোলেটের দোকানে বিশাল সেল চলছে। সেখান থেকে কিছু চকোলেট কিনে নিল। নাদভিকে খেতে সাধলে সে চকোলেটটা হাতে নিয়ে বলল, ‘তুমি দিলে বলে খাচ্ছি, কিন্তু আমি আসলে চকোলেট খাই না।’

লগ্ন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার এতশত খারাপ কাজের মধ্যে কি মানুষ খুন ছিল একটাও?’

‘না।’

‘কিন্তু পারবে নিশ্চয়ই। যে মানুষ চকোলেট খায় না, সে মানুষও খুন করতে পারবে অবলীলায়।’

নাদভি হেসে বলল, ‘চকোলেট একটা অস্বাস্থ্যকর খাবার। অনেকেই খায় না। আর অস্বাস্থ্যকর খাবার না খাওয়াটাই ভালো।’

এরমধ্যেই একটা বাঙালি খাবারের দোকান চোখে পড়ল যেখানে ফুচকা পাওয়া যায়। লগ্ন বলল, ‘চলো আরেকটা অস্বাস্থ্যকর খাবার খাই।’

নাদভি হেসে দিল। লগ্ন দোকানের সামনে গিয়ে অর্ডার দিয়ে বলল, ‘এই অস্বাস্থ্যকর কিন্তু সেরা খাবারটা খাও তো?’

নাদভি গম্ভীর গলায় বলল, ‘খাই না। কিন্তু তুমি বললে বিষও খেয়ে নেব।’

লগ্ন নাদভির চোখে চেয়ে বলল, ‘এভাবে বলো না, সত্যি সত্যি বিষ খাইয়ে দিতে পারি।’

নাদভি ঘাড় নেড়ে বলল, ‘সত্যি সত্যিই দিতে পারো। আপত্তি নেই।’

এরমধ্যে ফুচকা এসে গেল। লগ্নর ফুচকা খাওয়া দেখে নাদভি অবাক হয়ে গেল। এতবড় ফুচকা পুরোটা একসাথে মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে খাচ্ছে। কেউ এত উপভোগ করে একটা খাবার খায় কীভাবে? নাদভি যদি আগেই লগ্নর প্রেমে না পড়ে যেত তাহলে আজ ওর ফুচকা খাওয়া দেখে নির্ঘাৎ প্রেমে পড়ত!

১৮

মাসখানেক পর একদিন রাতে লগ্ন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময়ে আতিকুর রহমানের কলটা এলো। তিনি সরাসরি ফোনে কল দিয়েছে বলে একটু অবাক হলো লগ্ন। সাধারণত অনলাইনেই কথা হয়। লগ্ন কলব্যাক করতেই তিনি বললেন, ‘মা, একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে।’

‘কী ঘটনা বাবা?’

‘ইফতেখার না মানে ওই নাদভি আহমেদ একটা চিঠি পাঠিয়েছে। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া গয়নাগুলো। এমনকি তোর ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে তোলা এক লাখ টাকাও।’

লগ্ন অবাক হয়ে বলল, ‘কী বলছ তুমি?’

আতিকুর রহমান বললেন, ‘হ্যাঁ, চিঠিতে লিখেছে ওর মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিল। তার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা দরকার ছিল বলে ওই কাজ করেছিল। তবে ওর মাকে বাঁচাতে পারেনি। গয়নাগুলো ফেরত দেওয়ার জন্য নাকি চাকরিতে ঢুকে টাকা জমাচ্ছিল। সব গয়না একদম হুবহু একই ডিজাইনে বানিয়ে পাঠিয়েছে। আমি স্যাঁকড়ার দোকানে গিয়ে সব পরীক্ষা করিয়ে এনেছি। সব আসল। যেটা যতটুকু ওজনের ছিল ঠিক তাই আছে।’

‘তো? মাফ করে দিয়েছ?’

‘মাফ করব কোথা থেকে? ও তো যোগাযোগের কোনো মাধ্যম রাখেনি। একটা লোক এসে এসব দিয়েই চলে গেল।’

‘ধরো যোগাযোগের মাধ্যম পেলে। তখন কি মাফ করবে?’

‘আমার কাছে মাফ চাইলে তো হবে না। মাফ চাইতে হবে তোর কাছে। অন্যায় করেছে তোর সাথে।’

‘থ্যাংক ইউ বাবা। এটুকুই জানতে চাচ্ছিলাম। আমি তাহলে এখন রাখি। শুয়ে পড়েছিলাম। কাল আবার কথা হবে।’

‘আচ্ছা মা।’

পরদিন সকালে লগ্ন ঘুম থেকে উঠেই নাদভিকে দেখা করতে বলল। নাদভি জানে কেন তাকে ডাকা হয়েছে। নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবে না। কী আর করা যাবে! সময়টাই তো প্রতিশোধ নিল! জিনিসগুলো ফেরত দেওয়া হয়ে গেলে যদি দেখা হতো!

সকাল ৮টা বাজে। সূর্য উঠতে শুরু করেছে কেবল। এখনো চারপাশ আবছা অন্ধকার। নাদভি বাসার নিচে এসে ফোন করতেই লগ্ন নিচে নামল। বাইরে বরফ পড়ছে। লগ্ন দ্রুত নাদভির গাড়িতে উঠল। নাদভি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, ‘কোনদিকে যাব?’

লগ্ন চিৎকার করে বলল, ‘জাহান্নামে যাবে।’

নাদভি অফিসের দিকে চালাতে শুরু করল। কাছাকাছি কোথাও গিয়ে নাহয় পার্ক করবে। লগ্ন জানতে চাইল, ‘গয়না টাকাপয়সা ফেরত দিয়ে কি ভাবছো তুমি তোমার সব পাপ মুছে ফেলতে পারবে?’

নাদভি নির্বিকার গলায় বলল, ‘না। কিন্তু যার জন্য এতকিছু করেছি তাকে তো রাখতে পারিনি। ভাগ্যের ফেরে এখন ভালো ইনকাম করছি। এত টাকাপয়সা দিয়ে কী করব? আমার তো কেউ নেই। তাই জিনিসগুলো ফেরত দিচ্ছি।’

লগ্ন ক্ষুব্ধ গলায় বলল, ‘তুমি আসলে আমাকে ইম্প্রেস করার জন্য জিনিসগুলো ফেরত দিয়েছ।’

নাদভি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িটা পার্ক করল। তারপর লগ্নর দিকে ফিরে বলল, ‘আমি জানতাম তুমি বিশ্বাস করবে না। আফসোসও হচ্ছিল, কেন এসব ফেরত দেওয়ার আগেই আমাদের আবার দেখা হলো!’

লগ্নও এবার নাদভির দিকে ফিরে বসল।

তারপর আগের মতোই ক্ষুব্ধ গলায় জানতে চাইল, ‘তা এত দরদ শুধু আমার জন্যই কেন হচ্ছে? বাকি যে মেয়েগুলোকে ঠকিয়েছ, তাদেরগুলো ফেরত দিচ্ছ না কেন?’

‘সবারগুলোই ফেরত দিচ্ছি লগ্ন। আর একজনেরটা বাকি।’

লগ্ন এবার বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল, ‘বাহ! আগে থেকেই জানতে যে তোমার একদিন অনেক টাকা হবে আর সবার গয়নাগাটি ফেরত দিতে পারবে তাই সবগুলোর ছবি, মাপ ডিটেইলস রেখেছিলে?’

‘না। বিক্রির জন্যই ছবি তোলা হতো, মাপ লিখে রাখা হতো। সেসব আমার ড্রাইভে রয়ে গিয়েছিল।’

‘বিশ্বাস করি না।’

নাদভি তার ল্যাপটপ থেকে ড্রাইভ খুলে গয়নাগুলোর ছবি, মাপ সেভ করার তারিখ দেখাল। তারপর বলল, ‘আমার বাসায় চলো। গয়নাগুলো বানাতে দেওয়ার রিসিট দেখাই। রিসিটের তারিখ দেখলেই বুঝবে তোমার সাথে দেখা হওয়ার আগে বানাতে দিয়েছি নাকি পরে।’

‘দেখাও।’

নাদভি গাড়ি ঘুরিয়ে তার বাসার দিকে গেল। বাসার সামনে গিয়ে বলল, ‘ভেতরে যাবে নাকি এখানে নিয়ে আসব?’

লগ্নর অনেক কিছু পরখ করার আছে। তাই সে ভেতরে গেল। নাদভি একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। বাসাটা ছবির মতো গোছানো না। আবার ছেলেদের ঘরের মতো এলোমেলো না, নোংরাও না। লগ্ন চেয়ার টেনে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখতে লাগলো। সন্দেহজনক কিছু পেল না অবশ্য। নাদভি সব কাগজপত্র বের করে দেখাল। একেকটা গয়নার রিসিটে একেক তারিখ তবে সবগুলো তারিখই তার সাথে দেখা হবার আগের। এবার কিছুটা শান্ত হলো লগ্ন। নাদভি আবার সব গুছিয়ে রাখল। লগ্ন এবার বলল, ‘ভালো সবার সবকিছু ফিরিয়ে দিচ্ছ। কিন্তু আমার দেনা তো শোধ হয়নি এখনো। আমার সতীত্ব ফিরিয়ে দাও।’

নাদভি চমকে উঠে বলল, ‘কী বলছ? সেদিন তো আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি।’

‘সেটা সারা পৃথিবীর লোক জানে না। সবাই জানে স্বামী এক রাত কাটিয়েই ভেগে গেছে। কেউ কেউ আমাকে কন্ট্রাসেপটিভ পিল এনে দিয়েছে, যদি বাচ্চা হয়ে যায়? আমার সবকিছু আগের মতো করে দাও। আমার হারিয়ে যাওয়া সম্মান ফিরিয়ে দাও। যেন নিজের শহরে নিজের বাড়িতে কারো আহা উহুর শিকার না হয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারি।’

নাদভি মাথা নিচু করে ফেলল। লগ্নর চোখে জল এসে গেছে। সে বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসল।

নাদভি পেছন পেছন এসে গাড়িতে উঠলো। বলল, ‘অফিসের সময় হয়ে আসছে। অফিসের দিকে যাই?’

লগ্ন চোখ মুছে বলল, ‘আমি বাসায় যাব।’

নাদভি লগ্নকে বাসায় নামিয়ে দিলো। লগ্ন অফিসে ফোন করে ইমার্জেন্সি ছুটি নিল। তারপর সারাদিন বিছানায় গড়াগড়ি খেলো। কখনো হাঁসফাঁস লাগল, কখনো চিৎকার করল, কখনো কাঁদল। কী অসহ্য যন্ত্রণা!

নাদভি অবশ্য অফিসে গেল। সারাটাদিন তার অস্থিরতায় কাটল। অফিস শেষ করেই লগ্নর বাসার সামনে গিয়ে ফোন করল। কিন্তু সে ফোন ধরল না। দু-তিনবার ফোন করার পর একটা ই-মেইল পাঠিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কোনো রিপ্লাই এলো না। রাত বাড়তেই নাদভি বাড়ি ফিরে গেল।

লগ্ন নাদভির ফোন দেখেই ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিল। রাতে ফোন হাতে নিতেই দেখল কয়েকবার কলের পর একটা ই-মেইল এসেছে। লগ্ন ই- মেইলটা পড়ল।

লগ্ন,

তোমাকে আমি হুট করেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কী তীব্র সে ভালোবাসা! তোমাকে বোঝাতে পারব না। আর ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিয়ে দূরে সরে যাওয়া আরো বেদনাদায়ক। সেই বেদনাও আমার পক্ষে বোঝানো সম্ভব না। সৃষ্টিকর্তা যখন অদ্ভুতভাবে আমাদের আবার দেখা করিয়ে দিলো তখন কেমন যেন একটা আশার আলো জ্বলে উঠল মনে। আমি জানি আমি তোমাকে পাওয়ার যোগ্য নই। তবুও বেহায়ার মতো চাইছি। একটাবার ক্ষমা করে নতুন করে সবকিছু শুরু করার সুযোগ দাও। কথা দিচ্ছি আমার দ্বারা আর কোনো কষ্ট তুমি কখনো পাবে না। আমি তোমাকে একদমই জোর করছি না। সিদ্ধান্ত অবশ্যই তোমার। সিদ্ধান্ত যাই হোক আমি চুপচাপ মেনে নেব, এরপর থেকে তোমাকে আর জ্বালাব না।

-নাদভি

১৯

দিন গড়িয়ে রাত হয়, মাস গড়িয়ে ক্যালেন্ডারের পাতা বদলায়। কিন্তু লগ্নর রাগ কমে না। একইভাবে ভালোবাসাও কমে না একবিন্দু। সে জীবনের এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে আজকাল শান্তি ছাড়া কিছুই চায় না। অথচ এই অফিসে ট্রান্সফার হওয়ার পর তার জীবনের শান্তিটাই উধাও হয়ে গেল। একদিন সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল। জীবন তো একটাই।

সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে খুব সকালবেলা লগ্ন মেট্রো ধরল। সূর্য ওঠেনি তখনো। নাদভির বাসার খুব কাছেই মেট্রো স্টেশন। স্টেশন থেকে হেঁটেই চলে গেল লগ্ন। বরফ পড়ছে, হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। নাহ একটা গাড়ি কিনেই ফেলতে হবে মনে হচ্ছে। দু মাস স্যালারি থেকে কিছু টাকা জমালেই একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি হয়ে যাবে।

লগ্নকে দেখেই সিকিউরিটি গেট খুলে দিলো। লগ্ন বলল, ‘নাদভিকে ফোন করুন।’

সিকিউরিটি বলল, ‘উনি বলেছেন আপনি আসলে যেতে দিতে, ফোন করার দরকার নেই।

লগ্ন নাদভির অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে বেল বাজাল। নাদভি চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে লগ্নকে দেখেই চমকে উঠল।

‘এত সকালে তুমি? এই বরফে কীভাবে এলে? আমাকে একটা কল দিলেই তো আমি চলে যেতে পারতাম।

লগ্নর জ্যাকেটের জায়গায় জায়গায় বরফ পড়ে সাদা হয়ে আছে।

নাদভি সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ভেতরে এসো।’

লগ্ন ভেতরে ঢুকে জ্যাকেটটা খুলে রাখল। নাদভি হিটারের টেম্পারেচার বাড়িয়ে দিলো। তারপর অবাক চোখে চেয়ে রইল। লগ্ন শীতে কাঁপতে কাঁপতে এসে নাদভিকে জড়িয়ে ধরল। নাদভির বুকের সাথে মিশে যেতে যেতে বলল, ‘ক্ষমা করে দিয়েছি।’

এবার নাদভিও লগ্নকে জড়িয়ে ধরল। তারপর ভেজা গলায় বলল, ‘থ্যাংক ইউ লগ্ন। থ্যাংক ইউ সো মাচ।’

তারপর লগ্নকে জ্যাকেট দেওয়ার জন্য সরে যেতে চাইলে লগ্ন ছাড়ল না। নাদভি বলল, ‘তুমি জমে যাচ্ছ। একটা জ্যাকেট দিই।’

লগ্ন এবার নাদভিকে ছেড়ে বলল, ‘না। নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে সারারাত ঘুমাতে পারিনি। এখন ঘুমাব।’

এরপর লগ্ন নিজেই নাদভির বিছানায় গিয়ে কম্বলের মধ্যে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। নাদভি চেয়ার টেনে পাশে বসল। লগ্নর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। কতক্ষণ সে জানে না। আজ তার বিশ্বজয় করার দিন। লগ্ন তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে!

লগ্ন ঘুম থেকে ওঠার আগেই নাদভি কিছু নাস্তা তৈরি করল। তারপর আবার সেই চেয়ারে গিয়ে বসে তাকিয়ে রইল লগ্নর মুখের দিকে।

লগ্ন প্রায় দুই ঘণ্টা ঘুমাল। ঘুম ভেঙে এই দৃশ্য দেখেই হেসে দিলো। নাদভিও হাসল। লগ্ন উঠে আড়মোড়া ভাঙতেই নাদভি বলল, ‘চলো,

‘চলো, নাস্তা করি। আমি আসলে বাইরেই নাস্তা করি বেশি, তাই বাসায় খুব বেশি কিছু ছিল না। তোমাকে একা রেখে বাইরে যেতেও ইচ্ছে করছিল না। তাই যা ছিল তাই রেডি করেছি।’

লগ্ন বিছানা ছেড়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে দেখে অরেঞ্জ জুস, অমলেট, বেকন, পিনাট বাটার টোস্ট, ফ্রুটস দিয়ে টেবিল ভরা। বলল, ‘এতকিছুর পর আবার বলছো কিছু নেই। বাপরে কিছু থাকলে কী বানাতে!’

নাদভি হাসল। লগ্ন হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে বসলো। নাদভিও খেতে বসল কিন্তু তার চোখ সরে না লগ্নর উপর থেকে। খেতে খেতে লগ্ন জানতে চাইল, ‘কী দেখছ তখন থেকে?’

‘তোমাকে দেখছি। এতদিন লুকিয়ে দেখেছি। এখন তো আর লুকানোর প্রয়োজন নেই।’

লগ্ন হেসে বলল, ‘তুমি জানো, কেন আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি? তোমার ভালোবাসা দেখে নাকি তোমার অনুশোচনা দেখে নাকি অন্যকিছু?’

নাদভি একটু ভেবে বলল, ‘সম্ভবত এসবের কোনোটিই না। ক্ষমা করেছ, তুমি আমাকে ভালোবাসো বলে।’

লগ্ন মাথা নেড়ে বলল, ‘ভালোই চিনেছ দেখছি।’

নাদভি হাসল। তারপর বলল, ‘তোমার রাগ কমেছে? ‘না।’

‘তাহলে রাগ মিটিয়ে নাও। ভালো লাগবে।’

‘কীভাবে?’

তুমি যেভাবে চাও। খামচে, কামড়ে কিংবা চাবুক মেরে।’

লগ্ন এবার হো হো করে হেসে দিলো। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে ভেবে দেখি কী করা যায়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *