লগ্নজিতা – ১০

১০

প্রথম মাসের বেতন পেয়েই লগ্ন সান ফ্রান্সিসকোর টিকিট কাটল। গিয়ে কোনো লাভ নেই, এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত তবুও যেতে ইচ্ছে করছে। পার্শ্ববর্তী স্টেট তাই যাতায়াত খরচ কম, যদিও এই কমটাও এই মুহূর্তে তার জন্য অনেক। টাকা জমিয়ে সেমিস্টার ব্রেকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সময়টাও কাজে লাগানো যেত আবার ঘুরতেও পারত। কিন্তু সে তো লগ্নজিতা, এখনই সে যাবে। এই যাওয়া আটকানোর সাধ্য তার নেই।

যেদিন ক্লাস নেই সেদিন বেকারি থেকে ছুটি নিয়ে রওনা হলো সান ফ্রান্সিসকো। আজকের রাতেই ফিরতি টিকিট কাটা। সকালের ফ্লাইট ছিল, এগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেল। এয়ারপোর্টে নেমে সোজা চলে গেল মাইক্রোসফটের অফিসে। সেখানে গিয়ে রিসিপশনে ইফতেখার মাহমুদের সাথে দেখা করতে চাইল। রিসিপশনিস্ট ইফতেখার মাহমুদকে ফোন দেওয়ার আগে লগ্নর পরিচয় জানতে চাইলে লগ্ন বলল, ‘বলুন সিয়াটল থেকে একজন বাংলাদেশি দেখা করতে এসেছেন।’

রিসিপশনিস্ট তাকে ওয়েটিং রুমে বসতে বলল।

কিছুক্ষণের মধ্যে ইফতেখার মাহমুদ ওয়েটিং রুমে এলেন। লগ্নকে দেখে তিনি চিনতে পারলেন না। বললেন, ‘হাই, আমি ইফতেখার মাহমুদ। কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’

লগ্ন বলল, ‘আমি লগ্নজিতা। আপনাকে একেবারেই অযাচিতভাবে একটু বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত।’

ইফতেখার মাহমুদ শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চেনে না জানে না মেয়েটা কী যে বলছে তার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।

সে বলল, ‘কী বিষয়?’

লগ্ন খানিক ইতস্তত করে তারপর বলল, ‘কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে আমার বিয়ে হয়। একটা প্রতারক চক্র আপনার নাম পরিচয় দিয়ে, আপনার ঠাকুরগাঁওয়ের বাসা ভাড়া করে খুবই সুনিপুণভাবে ঘটনাটা ঘটায়। বিয়ের পরদিন ৩০ ভরি সোনার গয়না ও টাকাপয়সা যা পারে নিয়ে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে পুলিশের কাছে আমরা জানতে পারি ওরা একটা প্রতারক চক্র।’

ইফতেখার মাহমুদ অবাক হয়ে বলল, ‘বলেন কী! বাসা ভাড়া নিয়ে একটা পুলিশি ঝামেলা হয়েছিল শুনেছিলাম। আমাদের কেয়ারটেকারের জেলও হয়েছে। ওসব আমার বাবা হ্যান্ডেল করেছেন। কিন্তু আমার নাম পরিচয় ব্যবহার করা হয়েছে এমন কিছু শুনিনি।’

‘আপনি ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান থেকে পড়াশোনা করেছেন না?’

‘হ্যাঁ।’

এবার আরেক দফা অবাক ইফতেখার। লগ্ন বলল, ‘আপনার পড়াশোনা, চাকরি, পরিচয়, সবকিছুই প্রতারক ছেলেটি ব্যবহার করেছে। আর একারণেই বিয়ের আগে যখন আমার পরিবার পাত্র সম্পর্কে খোঁজখবর করেছে তখন সব ভালোই জানতে পেরেছে। কারণ সবাই তো আপনার ব্যাপারে বলেছে। আমার পরিবার কাউকে ছবি দেখিয়ে খোঁজ নেয়নি, এটা অবশ্য তাদের ভুল ছিল। যাই হোক এবার আসল কথায় আসি, প্রতারক ছেলেটি সান ফ্রান্সিসকো মাইক্রোসফটে কাজ করে বলেছিল বলেই আপনাকে পাওয়ার একটা ক্লু পাই আমি। তাই এখানে আসা। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে যে মানুষ আপনার সম্পর্কে এত কিছু জানে সে কোনো না কোনোভাবে আপনার পরিচিত হতে পারে। পুলিশ মারফত জানতে পারি ছেলেটির আসল নাম নাদভি আহমেদ

ইফতেখার এবার বললেন, ‘এই নামে তো কাউকেই মনে করতে পারছি না। আপনার কাছে ওর কোনো ছবি আছে?’

‘জি।’

লগ্ন মোবাইল বের করে ছবি দেখাল। ছবি দেখে ইফতেখার ভ্রু কুঁচকে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘লগ্নজিতা, আমি ওনাকে ঠিক চিনতে পারছি না। আবার খুব পরিচিতও লাগছে। এই পরিচিত লাগাটাই অস্বস্তি দিচ্ছে।’

লগ্ন বলল, ‘আপনি একটা ছবি রাখুন। ওর আসল ন্যাশনাল আইডি কার্ডের একটা কপি আছে আমার কাছে। পুলিশ বের করেছে। সেটাও এক কপি এনেছি। সেখানে ওর বাবা-মায়ের নাম, ঠিকানা এসব আছে। যদি কখনো কিছু মনে পড়ে। যেহেতু আপনার পরিচিত লাগছে তাই বলছি।’

‘হ্যাঁ, প্লিজ। আপনি আপনার ফোন নম্বর দিয়ে যান। কখনো কিছু যদি মনে পড়ে বা বের করতে পারি আপনাকে আমি জানাব।’

লগ্ন নাদভির ছবি, ন্যাশনাল আইডি কার্ডের কপি এবং নিজের ফোন নম্বর দিয়ে বিদায় নিল। ততক্ষণে দুপুর হয়ে গেছে। লাঞ্চ করে চলে গেল বেকার বিচে। এই বিচের কথা সে নকল ইফতেখার অর্থাৎ নাদভির মুখে অনেকবার শুনেছে। বিচে গিয়ে তার মনে হলো নাদভি কখনো একবার হলেও এই বিচে এসেছে। নাহলে ওইভাবে বর্ণনা করা সম্ভব না। তার মানে কি সান ফ্রান্সিসকোর সাথে ওর কোনো যোগাযোগ আছে?

১১

নাদভির ছবি হাতে বসে আছে ইফতেখার মাহমুদ। চেনা মুখ অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছে না। আসলে কি সে ছেলেটিকে চেনে নাকি অযথাই চেনা চেনা লাগছে? অনেক মানুষ তো আছে যাদের চেহারাটাই চেনা চেনা ধরনের। যদি না চিনে তাহলে তো হলোই, কিন্তু যদি চিনে থাকে তাহলে মনে পড়ছে না কেন? তার নাম পরিচয় দিয়ে এতবড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে গেল। নিসঃন্দেহে খুবই ধূর্ত লোক। এত ধূর্ত লোককে সে কীভবে চেনে? আর এই লোকটাই বা তার সম্পর্কে এতকিছু কীভাবে জানে?

.

লগ্ন এক সপ্তাহান্তে আবার গেল লেক ওয়াশিংটনে। ফেরার পথে সেই কফিশপে গেল। সেখানে সঙ্গীতার খোঁজ করতেই কিছুক্ষণের মধ্যে সে বেরিয়ে এলো।

‘হাই লগ্নজিতা।’

‘হাই সঙ্গীতা কেমন আছ?’

‘খুব ভালো। তা তুমি কেমন আছ?’

‘আমিও ভালো আছি। তোমার শিফট শেষ হবার সময় হয়ে এসেছে না?’

‘হ্যাঁ। আর দশ মিনিট।’

‘দশ মিনিট পর আমার সাথে বসে এক কাপ কফি খাওয়ার সময় কি হবে তোমার?’

সঙ্গীতা হেসে বলল, ‘নিশ্চয়ই, কেন নয়? তুমি একটু বসো। আমি কাজ শেষ করি।’

দশ মিনিট নিল না সঙ্গীতা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইউনিফর্ম বদলে ফিরে এলো। লগ্ন দুটো কফি অর্ডার করল।

তারপর সঙ্গীতাকে ধন্যবাদ দিতেই সঙ্গীতা অবাক হয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ কীসের জন্য?’

লগ্ন হেসে বলল, ‘সেদিন তুমি ওয়েবসাইট অ্যাড্রেসটা দিলে আর বারিস্তা কোর্সের আইডিয়াটা দিলে সেইজন্য। আমি বারিস্তা কোর্স করিনি অবশ্য বেকিং কোর্স করেছি। একটা চাকরিও পেয়েছি। একটা ধন্যবাদ তো তোমার প্রাপ্যই।’

সঙ্গীতা হেসে বলল, ‘ধুর তুমি পাগল। নিউকামারদের তথ্য দেওয়াটা তো পুরোনোদের দায়িত্ব। আমিও তো নতুন যখন এসেছিলাম তখন অন্য কারো থেকেই জেনেছিলাম।’

কথায় কথায় অনেক গল্প হলো। আরো কয়েকবার দেখা হলো। অচেনা দেশে একদম অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে লগ্নর প্রথম ও পরম বন্ধু হয়ে উঠল সঙ্গীতা

দেখতে দেখতে একটা সেমিস্টার শেষ হয়ে গেল। সেমিস্টার ব্রেকে সঙ্গীতার সাথে লগ্ন ঘুরে বেড়াল পাহাড়, লেক ও সমুদ্রে ঘেরা পুরো সিয়াটল শহর। দারুণ সময় কাটল। প্রথম সেমিস্টারের রেজাল্ট দেওয়ার পর লগ্ন নিজেই অবাক হয়ে গেল। হাইয়েস্ট স্কোর করেছে সে। জেদ থেকেই প্রচুর পরিশ্রম দিয়ে পড়াশোনা করেছে। একটা ভালো স্কোর তার চাই-ই চাই। কিন্তু তাই বলে এতটা ভালো করবে বুঝতে পারেনি। চুপচাপ থাকে বলেই তাকে কেউ অতটা খেয়াল করেনি। কিন্তু রেজাল্ট বের হওয়ার পর প্রফেসর থেকে শুরু করে ক্লাসমেট সবার নজরে পড়ে গেল।

লগ্নর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। যে মেয়ে সারাজীবন অ্যাভারেজ স্টুডেন্ট ছিল সে বিদেশ বিভুইয়ে পড়তে এসে এত দেশের স্টুডেন্টদের মধ্যে টপার হবে ভেবেছিল? এবার তার জেদ আরো বেড়ে গেল। একবার টপ রেজাল্ট করে এরপর পেছনে পড়লে মান ইজ্জত থাকবে না। তাই নতুন উদ্যোমে পড়াশোনা শুরু করল। ফলশ্রুতিতে পরের সেমিস্টারেও সে টপার হলো। এখন থেকে সে স্কলারশিপ পাবে। তার পার্ট টাইম চাকরির বেতন থেকে থাকা খাওয়া হয়ে যাবে। পড়াশোনায় যেহেতু টাকা লাগছে না তাই বাবার থেকে আর টাকা আনতে হবে না। কী যে আনন্দ হচ্ছে। নিজের সফলতায় যে এত আনন্দ আগে বোঝেনি সে। মনে পড়ে গেল মৌরি মরিয়মের জনপ্রিয় উপন্যাস মহাযাত্রার কথা। এ উপন্যাসে লেখক বুঝিয়েছেন সফলতা অর্জনের মাধ্যমে সকল দুঃখকষ্টকে ভুলে যাওয়া যায়। বিষয়টা এবার লগ্ন নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করল। তারপর মনে হলো এখন আর তার এসব ছোটখাটো সফলতায় পোষাবে না। এবার তার বড় বড় সফলতা অর্জনের ক্ষুধা তৈরি হলো।

১২

সামনেই ক্রিসমাসের ছুটি। ইফতেখার মাহমুদের স্কুলের রিইউনিয়নের আয়োজন চলছে। শুধু এই রিইউনিয়নের জন্য দেশে গিয়ে ছুটিটা নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না। দেশে তার তেমন কেউই নেই। বাবা-মা বড় ভাইয়ের সাথে নিউ ইয়র্কে থাকে। এই ছুটিতে সেখানে যাওয়া উচিৎ।

এদিকে স্কুলের ফেসবুক গ্রুপটা রিইউনিয়ন নিয়ে মেতে আছে। এত আয়োজন দেখে যেতেও ইচ্ছে করছে। এরইমাঝে এক বন্ধু তাদের ব্যাচের পুরোনো এক ছবি দিয়েছে। ছবিটা দেখে একপ্রকার আতকে উঠলো ইফতেখার। কারণ ওই ছবিতে একজনকে নাদভি আহমেদ নামক সেই প্রতারকের মতো লাগছে। সঙ্গে সঙ্গে লগ্নর দেওয়া বিয়ের ছবি ও ন্যাশনাল আইডি কার্ড বের করল। বিয়ের ছবির সাথে খুব একটা মিল না থাকলেও ন্যাশনাল আইডির ছবির সাথে অনেকটাই মিল পাওয়া গেল। তার মানে এই নাদভিই তার স্কুলের ক্লাসমেট নাদভি! বয়সের সাথে চেহারার পরিবর্তনের কারণে সে চিনতে পারেনি। এজন্যই চেনা চেনা লাগছিল! ইফতেখার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল লগ্নকে।

ইফতেখারের ফোন পেয়ে লগ্ন চমকে উঠল। কারণ প্রায় বছরখানেক পার হয়ে গেছে। সে ইফতেখারের কাছ থেকে কোনো খবর পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিল।

‘হ্যালো।’

‘হ্যালো লগ্নজিতা, আমি ইফতেখার বলছি।’

‘জি, নম্বরটা এখনো সেভ করাই আছে। কেমন আছেন?’

ইফতেখার উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছিল না। তাই হয়তো কুশল বিনিময়ের সৌজন্যতায়ও সে গেল না।

সরাসরি বলল, ‘লগ্ন নাদভির খোঁজ পেয়েছি।’

এক সেকেন্ডের জন্য লগ্নর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল।

পরক্ষণেই ইফতেখার বলল, ‘সরি সরি খোঁজ পেয়েছি বললে ভুল হবে। বর্তমানে কোথায় আছে আমি জানি না কিন্তু আমি ওকে চিনতে পেরেছি।’

‘নাদভি আপনার পরিচিত?’

‘হ্যাঁ। স্কুলের বন্ধু। অনেকদিন আগের ব্যাপার তাই ভুলে গিয়েছিলাম। আজ আমাদের স্কুলের গ্রুপে এক বন্ধু পুরো ব্যাচের একটা ছবি দিল, সেখানে দেখে চিনতে পারলাম।’

‘ছবিটা আমাকে পাঠাবেন?’

‘নিশ্চয়ই, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

‘কোন স্কুলে পড়তেন আপনি?’

‘ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ। সেভেন থেকে টুয়েলভথ পর্যন্ত আমরা একসাথেই পড়েছি।’

‘ক্যাডেট কলেজ!’

লগ্নর গলায় বিস্ময়!

ইফতেখার বলল, ‘জি।’

লগ্ন বিস্ময় কাটিয়ে একসময় বলল, ‘আর কিছু জানেন?’

‘হ্যাঁ। নাদভি খুবই ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল। ওর বাবা ডাক্তার ছিল। মা হাউজওয়াইফ। ফ্যামিলি স্ট্যাটাস ভালো। কলেজের পর ও কারো সাথে যোগাযোগ রাখেনি। কোথায় ছিল কোথায় পড়েছে কিছুই জানি না। যোগাযোগ না থাকায় আমি তো ওকে ভুলেই গিয়েছিলাম। তাই প্রথমদিন নাম শুনে চিনতেও পারিনি। ও হয়তো কোনোভাবে আমার সব খবর পেয়েছিল, সেটাকেই কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু ওর মতো ছেলে এরকম নোংরা কাজের সাথে কীভাবে জড়াল আমার মাথাতেই আসছে না।’

‘বুঝতেই পারছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’

‘মাই প্লেজার। ব্যাপারটার সাথে আমার নাম এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে এখন এ বিষয়ে আপনাকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য মনে করছি। আমার বন্ধুদের থেকে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করব, এখন ওর ব্যাপারে কেউ কিছু জানে কি না। যদি আর কিছু জানতে পারি আপনাকে অবশ্যই জানাব।’

ইফতেখার বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দিলো। লগ্ন ভাবতে লাগল ক্যাডেট কলেজে পড়া কোনো ছাত্রের যার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস ভালো তার কেন এমন জালিয়াতি করতে হবে? তবে উত্তর মিলল না।

লগ্ন ইফতেখারের পাঠানো ছবি দেখছিল। নাদভির চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু মুখটা তখনো নিষ্পাপ দেখতে ছিল, এখনো তেমনই আছে। কে বলবে এই ছেলেটি পরিকল্পিতভাবে এতবড় প্রতারণা করেছে!

ইফতেখার নাদভির ব্যাপারে আর কোনো তথ্যই দিতে পারলেন না। লগ্ন অবশ্য আশাও করেনি আর। যে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায় তাকে খুঁজে পাওয়া কি এতই সহজ?

লগ্ন নাদভির চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে নিজের পড়াশোনা নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে চায়। কিন্তু এমন একটি দিন নেই যে সে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নাদভিকে খোঁজে না বা তাকে নিয়ে ভাবে না। সকল ধরনের সোস্যাল মিডিয়াতেও খোঁজ করতে ভুল হয় না তার। কিন্তু নেই, কোথাও নেই সে। বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ায় ইফতেখার মাহমুদ সাজা ফেইক আইডিগুলোও সে পালিয়ে যাবার পর থেকে বন্ধ। কত সহজেই না একটা মানুষ এসে জীবনটাকে তছনছ করে দিয়ে যায়! কীভাবে পারে? ধর্মীয় সব রীতিনীতি মেনেই তো তাদের বিয়ে হয়েছিল। কোনো অনুভূতিই কি হয়না ওর? অবশ্য প্রতারকদের এত অনুভূতি থাকলে তো প্রতারণাই করতে পারত না।

দিন কেটে যেতে থাকে লগ্নর। মাস্টার্সের শেষ বছরে তার জীবনে একটা দারুণ ঘটনা ঘটে। তার ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যায়। এতে করে তার বেকারির চাকরিটি আর করতে হয় না, উপরন্তু আয়ও বেড়ে যায়। নতুন অভিজ্ঞতার সাথে দারুণ কাটে বছরটি।

১৩

মাস্টার্স শেষে লগ্ন একইসাথে অনেকগুলো বড় বড় কোম্পানিতে চাকরির আবেদন করে রাখল। যেহেতু সে আউটস্ট্যান্ডিং রেজাল্ট করেছে তাই আত্মবিশ্বাসও বেড়েছে। ইচ্ছে করেই প্রথমে বড় বড় সব কোম্পানিতে আবেদন করেছে। স্বপ্ন বড় হলে সফলতাও বড় হবে। স্বপ্ন ছোট হলে সফলতাও তো ছোটই রয়ে যাবে। যদি এসব কোম্পানিতে চাকরি না হয় তারপর নাহয় ছোটখাটো কোম্পানিতেও চেষ্টা করা যাবে।

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই লগ্নর চাকরি হলো ওয়ালমার্ট কর্পোরেট অফিসে। পোস্টিং হলো টেক্সাসে। চলে গেল সেখানে। নতুন শহরে নতুন জীবন। আগে নতুন জায়গায় গিয়ে মানিয়ে নেওয়ার ভয় হতো। এখন বরং ভালো লাগে এই বৈচিত্র্য।

টেক্সাসে নিজের মনের মতো একটা এক কামরার অ্যাপার্টমেন্ট নিল লগ্ন। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে পছন্দমতো ফার্নিচার কিনল। বারান্দায় গাছ লাগাল। একদম গুছিয়ে নেওয়া যাকে বলে।

আতিকুর রহমান ও বিলকিস বেগমও ভীষণ খুশি। তারা মেয়েকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তাতেই ছিলেন। যে অবস্থায় মেয়ে দেশ ছেড়েছে এরপর একা বিদেশ বিভুঁইয়ে নিজেকে সামলে নিতে পারবে কি না এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা। মেয়ে শুধু নিজেকে সামলেই নেয়নি বরং ভালোমতো পড়াশোনা করে ভালো একটা চাকরিও পেয়ে গেছে। এখন দেখেশুনে একটা ভালো বিয়ে দিতে পারলেই সব দুশ্চিন্তা শেষ হবে। কিন্তু বিয়ে নিয়ে লগ্নর সাথে কথা বলতেও ভয় লাগে তাদের। লগ্ন নিজেই যদি কাউকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চাইতো তাহলে সবচেয়ে ভালো হতো। একবার ভুলভাল বিয়ে দিয়ে এমন অপরাধবোধে ভুগছে যে সারাক্ষণ মনে হয় নিজের হাতে মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছেন!

একদিন লগ্ন অফিস থেকে ফেরার পথে গেল বাজার করতে। বাজার করে এসে অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলতে পারছিল না। লকটা কদিন ধরেই একটু সমস্যা করছিল। তবে এত বেহাল দশা ছিল না। তাই অতটা আমলে নেয়নি। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও যখন পারল না তখন ভাবল কৰ্তৃপক্ষকে ফোন করবে। ঠিক তখনই পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটা এগিয়ে এসে স্পষ্ট বাংলায় বলল, ‘আমি হেল্প করব?’

ছেলেটিকে আসতে যেতে প্রায়ই দেখা যায়। সম্ভবত তাদের অফিস টাইম একই। প্রায়ই লিফটে দেখা হয়। তবে এর আগে কখনো কথা হয়নি। লগ্ন অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি বাঙালি?’

ছেলেটি হেসে বলল, ‘শুধু বাঙালি না বাংলাদেশি বাঙালি।’

দরজা খুলতে ছেলেটিরও একটু কসরত করতে হলো। তবে সে খুলে দিতে পারল। লগ্ন ধন্যবাদ জানাল। ছেলেটি বলল, ‘লকটা নষ্ট হয়ে গেছে। আপনার ওনারকে বলুন ঠিক করে দিতে।’

‘হ্যাঁ বলব। আসলে কদিন ধরেই সমস্যা করছিল, আমিই গুরুত্ব দিইনি।’

ছেলেটি আবারও হেসে বলল, ‘আবার ভেতরে আটকে যেয়েন না যেন।’

লগ্ন হাসল।

‘ভালো থাকবেন। আমি এলাম।’

ছেলেটি এ কথা বলে চলে যেতেই লগ্ন তার বাজার নিয়ে ভেতরে ঢুকল।

এরপর আরেকদিন দেখা হলো কফিশপে। লগ্ন কফি নিয়ে বসার জায়গা খুঁজছিল তখনই ছেলেটি ডাক দিলো। বলল, ‘আমার টেবিলে জায়গা আছে। চাইলে বসতে পারেন।’

লগ্ন গিয়ে তার টেবিলে বসে বলল, ‘আপনার অফিস এদিকেই?’ হ্যাঁ। এই ডান পাশের বিল্ডিংয়েই। আপনার?’

লগ্ন লোকেশন বলতেই ছেলেটি বলল,

‘বাহ! ওয়ালমার্ট?’

‘জি।’

লগ্ন কফিতে চুমুক দিতেই ছেলেটি বলল, ‘আমি তাহসিন।’

‘আমি লগ্নজিতা।’

‘বাহ! খুব সুন্দর নাম।’

তাহসিন স্যান্ডউইচ আর কফি নিয়েছিল। লগ্ন শুধু কফি। তাহসিন স্যান্ডউইচের প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘প্লিজ।’

লগ্ন বলল, ‘থ্যাংকস। আমি নাস্তা করেই বেরিয়েছি।’

‘ওকে।’

তাহসিন খেতে খেতে বলল, ‘আমার আবার রান্নাবান্নায় খুব আলসেমি। বাসায় কিছু করতে ইচ্ছে করে না। তিনবেলা বাইরের খাবার দিয়ে চালিয়ে দিই।’

‘কতদিন আছেন এখানে?’

‘বছরখানেক হবে। নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম। পড়া শেষে ওখানে কিছুদিন জব করলাম, তারপর বেটার জব পেয়ে এখানে শিফট হই। আপনি এর আগে কোথায় ছিলেন?’

‘সিয়াটল।’

‘ইউনিভার্সিটি অব সিয়াটল?’

‘উঁহু। ওয়াশিংটন।’

লগ্নর কফি শেষ হতেই সে বলল, ‘আচ্ছা আমার অফিসের সময় হয়ে গেছে। আজ উঠি।

তাহসিন হেসে বলল,

‘শিওর।’

লগ্ন চলে গেল। তাহসিন চেয়ে রইল তার চলে যাওয়া পথের দিকে।

১৪

তাহসিন কিছু স্ন্যাকস কিনতে বাংলাদেশি গ্রোসারি শপে এসেছে। এসে দেখে লগ্ন বাজার করছে। কার্টে চাল ডাল দেখে জিজ্ঞেস করল, খিচুড়ি হবে নাকি?’

লগ্ন বলল, ‘আরে আপনি। হ্যাঁ, একটু খিচুড়ি করব ভাবছি।’

‘দাওয়াত দেবেন? নর্থ ডাকোটা থেকে আসার পর একবারও খিচুড়ি খাইনি।’

লগ্ন হেসে বলল, ‘যদি না দিই?’

তাহসিন হেসে বলল, ‘দিবেন দিবেন জানি। খিচুড়ির সাথে আর কী হবে?’

‘বিফ ভুনা।’

‘আহ্ এক্ষুনি জিভে জল এসে যাচ্ছে।’

লগ্ন অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো নিচ্ছিল। হঠাৎ তাহসিন বলল, ‘যদি কিছু মনে না করেন আমি একটা ইলিশ মাছ নিই? আমি তো ভাজতে পারি না। আপনাকেই ভাজতে হবে। দুজন মিলে খেলাম। খিচুড়ির সাথে জমবে খুব।’

‘আপনি শিওর আমি আপনাকে দাওয়াত করব?’

তাহসিন আবার হেসে বলল, ‘আরে দাওয়াত তো করেই ফেলেছেন। বাঙালি বলে কথা। প্লিজ ইলিশটা নিতে মানা করবেন না।’

লগ্ন হেসে বলল, ‘আচ্ছা নিন। একটু মোটা পিস করতে বলবেন। ওরা বেশি চিকন করে ফেলে। ভাজলে শক্ত হয়ে যায়।’

সমর্থন পেয়ে তাহসিন দৌড়ে গেল মাছ কিনতে। এখন ইলিশের মৌসুম। গতদিন এসেই বড় বড় ইলিশ মাছ দেখেছিল। তখন থেকেই খাওয়ার জন্য অস্থির লাগছিল।

লগ্ন খিচুড়ি মাংস রান্না করে ইলিশ ভাজার আগমুহূর্তে তাহসিনকে ডাকল। তাহসিন আসার পর বলল, ‘দেখুন ইলিশ মাছ এতটা তো লাগবেনা। আজকে আমাদের দুজনের জন্য দুপিস করে রেখেছি। বাকিটা আপনি নিয়ে যাবেন।’

‘আরে না না। থাকুক এটা এখানেই।’

লগ্ন কড়া চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমার কথা শেষ করতে দিন। ‘আচ্ছা বলুন।’

‘আমি এখন মাছ ভাজব। কীভাবে ভাজব আপনি দেখবেন শিখবেন। মাছ ভাজা খুব সহজ। এরপর বাকিটা আপনি নিজে ভেজে খাবেন। যাতে ইচ্ছে হলে খেতে পারেন।’

তাহসিনের মাছ ভাজা শেখার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কিন্তু না করতে পারল না। লগ্ন মসলা মেখে মাছ ভাজল। তাহসিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরোটা দেখল। ততক্ষণে দুজনের মাঝে টুকটাক অনেক গল্পই হলো।

অনেকদিন বাদে তাহসিন কবজি ডুবিয়ে বাঙালি খাবার খেলো। যাওয়ার সময় লগ্ন বক্সে করে আরেক বেলা খাওয়ার মতো খাবার দিয়ে দিলো। তাহসিন প্রথমে নিতে চাইল না।

তখন লগ্ন বলল, ‘নিন নিন। বেশি করেই করেছিলাম। আমার আরেকবার খাওয়ার মতো খাবার আছে। তাই আপনি এটা না নিলে নষ্ট হবে।’

এবার তাহসিন খাবারটা নিল। তারপর ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

.

লগ্ন টেক্সাসে এত সুন্দর করে সব গুছিয়ে নিয়েছিল, মাঝে জল ঢেলে দিলো তার অফিস। ভালো পারফরমেন্সের কারণে তাকে প্রোমোশন দেয়া হয়েছে কিন্তু পোস্টিং হবে কানাডায়, মিসিসাগাতে। সিয়াটল এত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর তবুও সেখান থেকে আসার সময় মন খারাপ হয়নি। কিন্তু টেক্সাস ছাড়তে মন খারাপ হচ্ছে। তার পছন্দের বাসা, শখের ফার্নিচারগুলো কী করবে এখন? পরক্ষণেই আবার নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করল আসলে মন খারাপটা কেন হচ্ছে? গোছানো সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে নাকি আমেরিকা ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে? আমেরিকা ছেড়ে চলে গেলে কি নাদভিকে পাওয়ার আশাও ছেড়ে যেতে হবে? এমন কেন মনে হচ্ছে তার? নাদভি তো সব ভুল তথ্যই দিয়েছিল। নাদভি যে আমেরিকায় আছে এমনটা না হওয়ার সম্ভাবনাই তো বেশি। হ্যাঁ, চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরি নেওয়া যায় কিন্তু আমেরিকার সবচেয়ে বড় তিনটি কোম্পানির মধ্যে ওয়ালমার্ট একটি। ওয়ালমার্টে এত ভালো পজিশনের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। নিজের ক্যারিয়ার সবকিছুর আগে। এসব আলতুফালতু ছেলেকে খোঁজার আশায় তা নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। তার ওপর খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ১%।

লগ্ন তার সব ফার্নিচার বিক্রি করে দিলো। ফার্নিচার মুভ করার সময় তাহসিন দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার লগ্নজিতা, ফার্নিচার বিক্রি করে দিচ্ছেন নাকি?’

‘হ্যাঁ। আসলে আমার কানাডায় পোস্টিং হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে মুভ করব। তাই সব বিক্রি করে দিচ্ছি।’

তাহসিন অবাক হয়ে বলল, ‘মানে আপনি কানাডায় চলে যাচ্ছেন!’

‘জি।’

তাহসিন আর কিছু বলল না। লগ্ন বাকি ফার্নিচারগুলো বের করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

রাতে তাহসিন একটা পিৎজা নিয়ে হাজির হলো। দরজা খুলে লগ্ন অবাক হলো।

তাহসিন বলল, ‘আপনি চলে যাচ্ছেন তাই ভাবলাম আপনাকে কিছু বানিয়ে খাওয়াই। আমি আসলে পিৎজা, পাস্তা ছাড়া তেমন কিছু পারি না। পিৎজাটাই একটু ভালো হয় তাই এটাই করলাম। লগ্ন হেসে বলল, ‘থ্যাংক ইউ! আসুন।’

পিৎজা খেয়ে লগ্ন বলল, ‘আপনি কিন্তু দারুণ পিৎজা বানান।’

‘তাই নাকি?’

‘সত্যি।’

‘থ্যাংকস।’

খেতে খেতে অনেক গল্প হলো। একটা সময় তাহসিন বলল, ‘লগ্ন একটা কথা বলার ছিল।’

লগ্ন পিৎজায় কামড় দিতে দিতে বলল, ‘বলুন না।’

তাহসিন কিছুটা ইতস্তত করে বলল, ‘আমি আসলে আরেকটু সময় নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি সময় নেই।’

লগ্ন এইমাত্র বুঝতে পারল তাহসিন কী বলতে চায়। কিন্তু এখন তো আর পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। তাহসিন এবার বলল, ‘প্রতিদিন আসতে যেতে লিফটে দেখতাম আপনাকে। তখন থেকেই ভালো লাগত। কবে ভালোবাসতে শুরু করেছি জানি না।’

তাহসিন আর কিছু বলার আগেই লগ্ন বলল, ‘তাহসিন আমি বিবাহিত।’

চমকে উঠল তাহসিন। অবিশ্বাস্য গলায় বলল, ‘আপনি আমাকে অ্যাভয়েড করার জন্য বলছেন না তো?’

‘না। সত্যিই আমি বিবাহিত। আমাদের তো আসলে কখনো ফ্যামিলি নিয়ে কথা হয়নি তাই বলা হয়নি।’

লগ্ন মোবাইল থেকে তার বিয়ের ছবি বের করে দেখাল।

তাহসিন বলল, ‘সরি।’

‘ইটস ওকে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *