১
এই পৃথিবীতে সমস্যার কোনো শেষ নেই। একেকজনের সমস্যা একেক রকম। লগ্নর বাবা রিটায়ার করার পর থেকে তার সমস্যা ছিল, তার কোনো কাজ নেই। এরপর সে নানান সৌখিন কাজ করে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শুরু করল। কিন্তু হার্ট এটাকের পর থেকে তার সমস্যা পরিবর্তিত হলো মৃত্যুচিন্তায়। এখন তার সারাক্ষণ মনে হতে থাকে, যেকোনো মুহূর্তে তার মৃত্যু হবে। মৃত্যুর আগে তিনি তার জীবনের একমাত্র অপূর্ণ কাজটি সম্পূর্ণ করতে চান অর্থাৎ লগ্নর বিয়ে দিয়ে যেতে চান। কিন্তু লগ্নর ধারণা অন্যরকম। সে বিদেশে মাস্টার্স করতে যেতে চায়। সে বিদেশে গিয়ে কোনো বিদেশি ছেলে বিয়ে করে ফেলে কি না এই ভয়ে হয়তো আগেই বিয়ে দিতে চাইছেন।
এদিকে লগ্নর মায়ের সমস্যা সে কী রান্না করবে। প্রতিদিন সকাল হলেই সে এই এক চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়ে, বাড়ির সকলকে একে একে জিজ্ঞেস করতে থাকে কে কী খেতে চায়।
লগ্নর বড় বোন লাবণ্যর সমস্যা হচ্ছে, তার বাচ্চা কিছু খেতে চায় না। বাচ্চাকে খাওয়াতে গিয়ে তার যে পরিমাণ স্ট্রাগল করতে হয়, সারা জীবনেও সেই পরিমাণ স্ট্রাগল করেনি সে।
অন্যদিকে লগ্নর বেশিরভাগ বন্ধু-বান্ধবের সমস্যা বেকারত্ব। ব্যাচেলর শেষ করে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে সবাই। কারো কারো সংসারের হাল ধরতে হবে।
সবার সমস্যা সবার থেকে ভিন্ন। একজনের সমস্যা আরেকজনের কাছে হয়তো অর্থহীন। অথচ যার সমস্যা, তার কাছে সেটিই অসহনীয়। লগ্নর সমস্যাটাও অনেকের কাছে অর্থহীন তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে সে। দিনাজপুরের এক মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা মেয়েটি জীবনে প্রথম বাড়ির বাইরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতে শুরু করল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত সে। সেখানেই পরিচয় হিমেলের সাথে। পর্যায়ক্রমে গভীর প্রণয়। সারাক্ষণ দুজনকে একসাথে দেখা যেত। ক্যাম্পাসের সকলেই তাদের প্রেমের কথা জানত। বছরখানেক বাদেই হিমেল পাশ করে বেরিয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর থেকেই দূরে সরে যেতে লাগলো। সম্পর্কের অবনতি হতে লাগল। লগ্ন অনেক চেষ্টা করেছে, কোনোকিছুতেই হিমেলকে আগলে রাখতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যে চোখের সামনে দিয়ে বিয়েও করে নিল। কিছুই করতে পারেনি। আসলে যে যাওয়ার সে তো চলেই যায়। বিচ্ছেদের তিন বছর পেরিয়ে গেছে। শোকও পুরোনো হয়ে গেছে। হিমেলের প্রতি কোনো অনুভূতি লগ্নর এখন আর নেই। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে লগ্ন নতুন কাউকে গ্রহণ করতে পারছে না। বাবা নিত্যনতুন বিয়ের প্রস্তাব আনছেন, কাউকে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়ার কথা ভাবতেও পারছে না।
এই মুহূর্তে সে একদমই বিয়ে করতে চায় না। সম্প্রতি তার ব্যাচেলর শেষ হয়েছে। এখন বিদেশে মাস্টার্স করতে যেতে চায়। এদিকে বাবাকেও কষ্ট দিতে চায় না। তাই বিয়েতেও মানা করতে পারেনি। উলটো নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করছে। একদিন তো বিয়ে করতেই হবে। বাবা থাকতেই না হয় করুক। তাতে বাবা অন্তত শান্তি পাবে। তবে লগ্নর একটাই শর্ত তাকে মাস্টার্স এবং পরবর্তীসময়ে চাকরি করতে দিতে হবে। বাবা নিশ্চয়তা দিয়েছেন এমনটাই হবে।
এদিকে তার সমস্যাটা মা-বোন থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব কেউই বুঝতে পারছে না। সবাই বলছে বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কীভাবে ঠিক হবে? বিয়েই কীভাবে সর্বরোগের মহৌষধ তা বোঝে না লগ্ন
ঘটক ফয়েজ উদ্দিন একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আনছিলেন। লগ্নর বাবা আতিকুর রহমান সেখান থেকে বাছাই করে মেয়েকে ছবি দেখাতেন। কিন্তু এই প্রথম একজনকে আতিকুর রহমানের অসম্ভব মনে ধরেছে। এতই পছন্দ হয়েছে যে তিনি নিজে ছেলেটির সাথে দেখা করেছেন। দেখা করে ভালো লাগা আরো বেড়ে গেছে। এই ছেলেটির কথা তিনি বিশেষভাবে বললেন। ছেলেটি মিশিগান ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। এখন মাইক্রোসফটে জব করে। চাকরিসূত্রে সান ফ্রান্সিসকো, ক্যালিফোর্নিয়াতে আছে। এখন ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় আছে। গ্রিনকার্ড হতে আরও বছরখানেক লাগবে। কিন্তু লগ্ন যেহেতু বিদেশে পড়তে যেতে চায় তাই বিয়ের পর লগ্নকে স্টুডেন্ট ভিসায় পাঠিয়ে দিতে তিনি রাজি। একবার শুধু দেখা করানোর অনুমতি চাইলেন। পছন্দ না হলে তিনি জোর করবেন না। বাবা এমনভাবে বলায় লগ্ন মানা করতে পারেনি।
আজ ছেলেপক্ষ লগ্নকে দেখতে আসবে। বাবা অনেকদিন ধরে বিয়ের কথা বললেও কাউকে কখনো বাড়ি পর্যন্ত আনেনি। এই প্রথম। এদিকে লগ্নর মনের খুঁতখুঁতে অনুভূতিটা যায় না। সব মিলিয়ে খুব চাপ অনুভব করছে সে।
বিলকিস বেগম লগ্নর ঘরে ঢুকে বিস্মিত হলেন। পেছনে দাঁড়িয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, ‘একি লগ্ন? তুই এখনো তৈরি হোসনি কেন? ছেলেপক্ষ তো কাছাকাছি চলে এসেছে।’
লগ্ন আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিল। আয়নাতে মায়ের দিকে
তাকিয়ে বলল, ‘আমি তৈরি আম্মা।’
‘তুই সালোয়ার কামিজ পরে ওদের সামনে যাবি? শাড়ি পরবি না?’
শাড়ি পরে সঙ সাজতে পারব না। একটু স্বাভাবিক থাকলে ক্ষতি কী মা? আমি তো তাদের বউ হয়ে যাইনি যে শাড়ি পরতে হবে। আমি এখনো তোমাদের মেয়ে।’
বিলকিস বেগম যারপরনাই বিরক্ত, ‘উফ! তোর বাবা তোকে এত লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে। এখন সে বুঝবে। আমি কিছু জানি না।’
আতিকুর রহমান অবশ্য এ বিষয়টা বেশ স্বাভাবিকভাবেই নিলেন। মেয়ে যেভাবে চায় সেভাবেই থাকুক। ওর স্বস্তিটাই তার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
২
পাত্র-পাত্রীকে ছাদে আলাদা কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলো। তাদের চা নাস্তাও এখানেই এলো।
প্রথম কথা পাত্রই বলল, ‘আপনার অনুমতি আছে তো বিয়েতে?’
লগ্ন চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে বলল, ‘বিয়ে তো ঠিক হয়ে যায়নি। এখনই এই প্রশ্ন?’
ছেলেটি চা নিতে নিতে হেসে বলল, ‘আমি বলিনি এই বিয়েতে অনুমতি আছে কি না। আমি জানতে চাচ্ছি এই যে আপনার বিয়ের কথা চলছে, পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে এসব আপনার অনুমতিসাপেক্ষে হচ্ছে কি না।’
লগ্ন ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল, ‘এরকম মনে হওয়ার কারণ কী?’
‘কারণ শুরু থেকেই আপনি মুখ ভার করে আছেন। আমি শুনেছি বাংলাদেশে আজকালকার মেয়েরা এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে না। অন্তত মাস্টার্স শেষ করে নেয়, কেউ কেউ ক্যারিয়ার তৈরি করে এরপর বিয়ে করতে চায়। অনেকক্ষেত্রে এ ব্যাপারে পরিবারের মত থাকে না। তারা মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিতে চায়। আমি এমন জোরে পড়তে চাই না। তাই জিজ্ঞেস করা।’
আসার পর থেকেই ছেলেটিকে দূর থেকে লক্ষ করছিল লগ্ন। ছেলেটির আচার-আচরণ, কথা বলার ধরন, পোশাক, ভদ্রতাজ্ঞান সবকিছুই মাৰ্জিত সব মিলিয়ে ভালোই লাগছে লগ্নর। উপরি পাওনা হিসেবে আছে সৌন্দর্য। লম্বা, স্মার্ট, দেখতে ভালো। চোখ দুটি দিয়ে যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে! কিন্তু তবুও স্বামী ভাবতেই অস্বস্তি হচ্ছে। অথচ অসভ্য- কদাকার হিমেলকে বিয়ে করার জন্য কত পাগলই না হয়েছিল সে!
লগ্ন মৃদু হেসে বলল, ‘ওরকম কিছু না। আমি একটু ডিস্টার্বড ছিলাম তাই ভালো ঘুম হয়নি। এজন্য হয়তো এমন লাগছে। আমিও মাস্টার্সের পরেই বিয়ে করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু মাস্টার্স করতে বাইরে যেতে চাই। বাইরে গিয়ে বিদেশি কোনো ছেলেকে বিয়ে করে ফেলি কি না সেই ভয়ে সম্ভবত বাবা আমাকে এখনই বিয়ে দিতে চাইছেন।
একথা শুনে ছেলেটি হেসে ফেলল।
লগ্ন চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম কী?’
‘ইফতেখার মাহমুদ।’
‘এতবড় নাম? ডাকনাম কী?’
‘সেরকম কোনো ডাকনাম নেই। তবে বাবা-মা ইফতি বলে ডাকে। আপনিও তাই ডাকতে পারেন।’
‘আচ্ছা। আপনি কী করেন?
ইফতি চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘আমি বায়োডাটা পাঠিয়েছিলাম। আপনি পাননি?’
চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে দেখে লগ্ন পালটা প্রশ্ন করল, ‘চা ভালো হয়নি?’
‘না না ভালো। আমি আসলে এত গরম চা খেতে পারি না তাই।’
‘ও। যাই হোক, বাবা আমাকে আপনার বায়োডাটা দিয়েছিল। কিন্তু ওই যে বললাম আমি একটু ডিস্টার্বড ছিলাম। তাই দেখার সময় সুযোগ করে উঠতে পারিনি। বাবার আপনাকে অনেক পছন্দ হয়েছে, তাই আমি না দেখেই আসার অনুমতি দিয়েছি।’
‘আমি অবশ্য আপনার বায়োডাটা আর ছবি দেখতে দেখতে প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছি।’
লগ্ন এবার জোরে হেসে উঠল।
বলল, ‘দেখি কোন ছবি পাঠিয়েছে আপনাকে?’
ইফতি মোবাইল থেকে ছবিগুলো বের করে দেখাল। লগ্ন আবারও হেসে দিলো।
হাসতে হাসতে বলল, ‘সবগুলো আমার তিন-চার বছর আগের ছবি। দেশি বাবা-মায়েরা পাত্রপক্ষকে পাঠানোর জন্য মেয়ের সবচেয়ে সুন্দর ছবিগুলো খুঁজে বের করে। ২৪ বছর বয়সি মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছে ২০ বছর বয়সি ছবি দেখিয়ে। দেখেছেন কান্ড!’
ইফতি এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে লগ্নর হাসি দেখছিল।
এবার ঘোরলাগা গলায় বলল, ‘বাস্তবে আপনি ছবির চেয়ে বেশি সুন্দর।’
লগ্ন প্রতিবাদ করে বলল, ‘কখনোই না। ডার্ক সার্কেলগুলো চোখে পড়ছে না আপনার? তখন কিছুই ছিল না। আর এইযে কপালের ওপর ব্রণটা এটা তো বিভৎস!’
‘এমন করে বললে তো ডার্ক সার্কেল আর ব্রণগুলোকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে হবে। অথচ এরা খুব ন্যাচারাল। বিয়ের পর সুখী হলেই এসব চলে যাবে।’
‘আপনি কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন বিয়ের পরে আমি সুখীই হব?’
ইফতি মৃদু হেসে বলল, ‘আমার সর্বস্ব দিয়ে সুখী করার চেষ্টা করব। মন বলছে আমাদের বিয়েটা হবে। কারণ এখানে আসার পর থেকেই আল্লাহর কাছে দোয়া করছি এটাই যেন আমার শেষ মেয়ে দেখা হয়।’
লগ্ন দুষ্টু হেসে বলল, ‘আমার তো এই প্রথম। আমি নাহয় আরো কিছু ছেলে দেখি।’
‘নিশ্চয়ই। বাজার যাচাই করে নেওয়া ভালো।’
ইফতি শব্দ করে হেসে উঠলো।
লগ্ন জিজ্ঞেস করল, ‘হাসছেন কেন?’
ইফতি বলল, ‘মা বলে আমার হাসি সুন্দর। তাই হাসি দিয়ে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছি।’
লগ্ন বহু কষ্টে হাসি আটকে রেখে বলল, ‘আমাকে এত পছন্দ হওয়ার কারণ কী?
ইফতি কোনো ভনিতা না করে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে মানুষ যে কারণে পছন্দ করে। একটা সুন্দর পরিবার, একটা সুন্দর মুখ। আপনার ছবি দেখেই আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। এরপর আপনার বাবার সাথে দেখা করে খুব ভালো লাগে। তিনি অসম্ভব ভালো একজন মানুষ। তার মেয়ে নিশ্চয়ই তার মতোই হবে। আর আজ আপনাকে সামনাসামনি দেখে কথা বলে রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেছি। আমার মনে হয়েছে আপনি স্ত্রী ছাড়াও আমার খুব ভালো বন্ধুও হতে পারবেন। যার সাথে সব ধরনের বিষয়ে কথা বলে মজা পাওয়া যাবে।’
লগ্নই এবার মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সে প্রসঙ্গ পালটে জানতে চাইল, ‘আপনি দেশে আছেন কতদিন?’
‘দেড় মাস।’
‘ওমা তাহলে তো খুব কম সময়। এত কম সময়ে একটা বিয়ের আয়োজন কীভাবে সম্ভব?’
‘আসলে আমি একসাথে খুব বেশি ছুটি পাই না। দু মাসের ছুটিতে এসেছি। বাবা-মায়ের কিছু প্রস্তুতি নেওয়াই ছিল। আমাদের দিক থেকে সমস্যা হবে না। আপনার বাবা বললেন তারও কোনো অসুবিধা নেই।’
লগ্ন চিন্তিত মুখে বলল, ‘সেসব নয়, দুজনের চেনাজানার জন্য তো কিছু সময় প্রয়োজন।
‘নিশ্চয়ই। তবে সেটা বোধহয় অল্প দিনে সম্ভব, আবার অনেক দিনেও সম্ভব নয়। আপনি ভেবে দেখুন কী করবেন।’
৩
মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অনিশ্চিত। যে লগ্ন বিয়ের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, সে এখন অপেক্ষার প্রহর গুনছে। সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেয় বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে। প্রথম দেখার পর থেকে প্রতিদিন ইফতির সাথে ফোনে কথা হচ্ছে। ঘন ঘন দেখাও হচ্ছে। নতুন জীবন শুরুর আগে যতটা সম্ভব দুজন দুজনকে জেনে নেওয়া। ইফতিকে যত দেখছে মুগ্ধ হচ্ছে লগ্ন। মনে হয় যেন আল্লাহ তাকে ওরই জন্য ওর মনের মতো করে সৃষ্টি করেছেন।
আগামীকাল সকালে লগ্ন বন্ধুদের দাওয়াত দিতে রাজশাহী যাবে। তবে এর কোনো দরকার ছিল না, বন্ধুবান্ধবদের ফোনে দাওয়াত দিলেই যথেষ্ট। কিন্তু এই সাড়ে চার ঘণ্টার রাস্তায় ইফতিকে সঙ্গী করতে ইচ্ছে করছে। তাদের যতবার দেখা হয়েছে বড়জোর ঘণ্টাখানেকের জন্য দেখা হয়েছে। এই একটা সুযোগ দীর্ঘ সময় একসাথে কাটানোর। তার যদি লজ্জাশরম একটু কম থাকত, তাহলে অবশ্যই বাবা-মাকে বিয়ের দিন এগিয়ে আনার জন্য অনুরোধ করত। একটা মানুষ নতুন বউকে রেখে বিয়ের পনেরো দিন পরেই তেরো হাজার কিলোমিটার দূরে চলে যাবে, এ কেমন নিষ্ঠুরতা?
ফোনের ওপাশে রিং হচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইফতির গলা পাওয়া গেল, ‘হ্যালো।’
‘আগামীকাল সকালে ফ্রি আছ?’
ইফতি হেসে বলল, ‘তুমি বললে ফ্রি থাকব।’
লগ্ন ইতস্তত করে বলল, ‘না। ব্যস্ততা থাকলে দরকার নেই। বিয়ের আয়োজন করছো, ব্যস্ততা থাকতেই পারে।’
‘আগে বলবে তো কী বিষয়? দেখা করতে চাও?’
লগ্নর লজ্জা লাগছিল এভাবে বলতে। তবু সময় চলে গেলে আর ফিরে আসবে না। লজ্জাশরম বিসর্জন দিয়ে সে স্পষ্ট গলায় বলার চেষ্টা করল, ‘আমি কাল রাজশাহী যাব। তোমার সময় থাকলে আমার সাথে যেতে পারো। একা যাচ্ছি।’
ইফতি উত্তেজিত হয়ে বলল, আরে বাপরে! এমন লোভনীয় প্রস্তাব কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়?’
লগ্ন ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল, ‘লোভনীয় মনে হলো কেন?’
ইফতি হেসে বলল, ‘দেখো প্রেম এক জিনিস, আর বিয়ে আরেক জিনিস, বিশেষ করে এরকম অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। প্রেমে এখনই পাওয়া সম্ভব। বিয়েতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষা করতে করতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। এমন অপেক্ষার খরাময় দিনে তোমার সাথে এত দূরের যাত্রার প্রস্তাব অবশ্যই লোভনীয়।’
লগ্ন লজ্জা পেয়ে মুখ টিপে হাসল। তবে ধরা দিলো না।
স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘তাহলে কাল ভোরে চলে এসো। ভোরে রওনা না হলে সব কাজ শেষ করে কালই ফিরতে পারব না।’
‘ছ’টায় রওনা দিলে হবে?’
‘হবে। এক ঘণ্টায় ঠাকুরগাঁও থেকে অনায়াসে চলে আসতে পারবে। আমি আগে থেকে তৈরি থাকব। তুমি এলেই রওনা হব।’
রাজশাহীর সব বন্ধুদের বিয়ের দাওয়াত দেওয়া শেষ করে লগ্ন ও ইফতি দুপুরের খাবার খেতে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল। খাওয়াদাওয়া শেষ করে বের হওয়ার পর রেস্টুরেন্টের সামনেই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল। ইফতির কথায় লগ্ন হো হো করে হাসছিল। ঠিক সেই সময়েই হিমেলের সাথে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। হিমেল অবাক চোখে তাকাল ইফতির দিকে।
তারপর লগ্নর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাহ ভালোই আছ দেখছি।’
লগ্নর প্রচণ্ড রাগ লাগল। সে বলল, ‘তুমি ভালো থাকতে পারলে আমি কেন পারব না?’
হিমেল তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘তোমার বান্ধবীদের কাছে শুনেছিলাম আমাকে হারিয়ে অনেক শোকে আছ। এই তোমার শোকের নমুনা!’
ইফতি জানে না এই লোক কে, কী চায়। তবে আন্দাজ করতে পারছে। এর কথাবার্তার ধরন ভালো লাগেনি। লগ্নর বিরক্তিও তার চোখ এড়ায়নি।
তাই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিজে নেওয়ার জন্য ইফতি বলল, ‘এক্সকিউজ মি। কী সমস্যা আপনার?’
হিমেল বলল, ‘আমি আপনার সাথে কথা বলছি না।’
ইফতি দৃঢ় গলায় বলল, ‘কিন্তু আমি আপনার সাথে কথা বলছি। কারণ আপনি আমার হবু স্ত্রীর সাথে উঁচু গলায় কথা বলছেন।’
হিমেল কড়া গলায় বলল, ‘আপনার হবু স্ত্রী আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল। আমি তাকে যা খুশি বলতে পারি।’
ইফতি মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘যখন ছিল তখন বলেছেন। এখন নেই। এখন তার সাথে উঁচু গলায় কথা তো দূরে থাক, নিচু গলায় কথা বলতেও আমার অনুমতি নিতে হবে।’
ইফতির কথায় লগ্ন মনে সাহস পেল।
সে কড়া গলায় বলল, ‘কী ভেবেছিলে? তুমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করে ফেলার পর আমি তোমাকে পরকীয়ার প্রস্তাব দেবো?’
হিমেল আর একটি কথাও না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে লগ্ন জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার জানতে ইচ্ছে করছে না এই অসভ্যটাকে আমি কীভাবে ভালোবেসেছিলাম?’
ইফতি ঠোঁট উলটে বলল, ‘না তো।’
‘কেন?’
‘ভালোবাসা তো এমনই। কোনো যুক্তি থাকে না।’
লগ্ন আর কিছু বলল না। সত্যিই তো। ভালোবাসা ব্যাপারটাই খুব অযৌক্তিক।
ইফতি একটু থেমে বলল, ‘আমারও ছিল এমন অযৌক্তিক ভালোবাসা। তাই খুব ভালোভাবেই বুঝি।’
ইফতিও তারই মতো ধোঁকা খাওয়া দলের লোক জেনে কেমন মায়া হচ্ছে লগ্নর, আহারে! কিন্তু ইফতি হিমেল সম্পর্কে একটা বিষয়ে জিজ্ঞেস না করলেও, ইফতির পুরোনো প্রেমিকা সম্পর্কে তার একশোটা বিষয় জানতে ইচ্ছে করছে। নারী মন কী অদ্ভুত!
৪
বিয়ের তিন-চার দিন আগে থেকেই লগ্নদের বাড়ি লোকসমাগমে ভরে উঠল। দূরের আত্মীয়স্বজনেরা সব আসতে শুরু করেছে। এ যেন শুধু বিয়ে নয়, বিরাট এক উৎসব!
লাবণ্য এক অনলাইন পেজ থেকে অর্গানিক মেহেদি এনেছে। এই মেহেদির রং নাকি অসম্ভব গাঢ় এবং এক মাস স্থায়ী হবে। একারণেই রং হতেও দুদিন সময় লাগবে। তাই বিয়ের দুদিন আগেই মেহেদি উৎসবের আয়োজন করা হলো। রাজশাহী থেকে দুজন মেহেদি আর্টিস্ট এসেছে বাড়ির সব মেয়েদের হাতে মেহেদি লাগাতে। লগ্নর মেহেদি দেয়া প্রায় শেষ, তখনই ফোন এলো ইফতির। ইফতির নম্বর দেখেই সবাই খ্যাপাতে লাগল। লগ্ন একটু লজ্জা পেল, তবে সারাদিন সে যার ফোনের অপেক্ষায় থাকে তার ফোন না ধরে থাকবে কী করে? সেসবে তোয়াক্কা করল না, ফোন ধরল।
‘হ্যালো লগ্ন?’
‘বলো।’
‘একটু নিচে নামতে পারবে?’
চমকে উঠল লগ্ন। বলল, ‘তুমি কি দিনাজপুর এসেছ? বাসার সামনে?’
‘এলাম একটু।’
‘তাহলে উপরে আসছো না কেন?’
‘না না উপরে আসব না। তুমি নিচে এসো। তোমাদের বাসার পাশের নার্সারিটাতে আছি। আর…’
‘আর কী?’
ইফতি ইতস্তত করে বলল, প্লিজ কাউকে বোলো না যে আমি এসেছি।’
ইফতি লজ্জা পাচ্ছে তাই হাসি পেল লগ্নর। তবুও ভালো লাগল এই ভেবে যে, লজ্জা পেলেও দেখা করতে তো এসেছে!
বিয়ের কনের পক্ষে সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া সম্ভব না। তাই লাবণ্যর সাহায্য নিল। লাবণ্য একটু হাসিতামাশা করলেও সুযোগ করে দিলো।
লগ্নদের বাসার সাথেই বিরাট এক নার্সারি। নানান গাছের সমাহার। লগ্নর বাবা সেখান থেকে গাছ সংগ্রহ করেই গড়েছে তার শখের বাগান। সেখানেই ঘুরঘুর করছিল ইফতি। লগ্নর চোখে চোখ পড়তেই হাসি বিনিময় হলো। লগ্ন কাছাকাছি গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার হঠাৎ দিনাজপুর আগমন?’
সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিতে পারল না ইফতি। সে মগ্ন হয়ে আছে লগ্নর সৌন্দর্যে। বহুরঙা একটা লেহেঙ্গা পরেছে, চুল খোলা, হাতভর্তি মেহেদি। এমন সাজে লগ্নকে এই প্রথম দেখছে ইফতি। চোখ ফেরানো দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে।
ইফতি উত্তর না দেওয়ায় লগ্ন আবার প্রশ্ন করল, ‘কী হলো চুপ করে আছ যে?’
এবার ইফতি বলল, ‘এলে যে এক পরিকে দেখতে পাব এ কথা আগে জানলে আরো আগেই আসতাম। ছবি দিলে না কেন আমাকে?’
লগ্ন ভেংচি কেটে বলল, ‘হুহ! বুঝি বুঝি সবই নতুন বউ পটানোর ধান্দা।’ ইফতি হেসে বলল, ‘এখন আর পটানোর কী আছে? বিয়ে তো কনফার্ম। পটিয়েছি তো প্রথম দিন। যাতে বিয়েটা পাকাপাকি হয়ে যায়।’
‘ও তার মানে সেদিনের সব কথা ছিল পটানোর জন্য? মিথ্যে কথার জাল? লগ্নর গলায় নিপাট অভিমান। ইফতি হেসে বলল, ‘সব পটানিমূলক বাক্য মিথ্যে হওয়া জরুরি নয়। আর পটিয়েছি তো তোমাকে পাওয়ার জন্য এটা ভাবলে না?’
লগ্ন লাজুক হেসে বলল, ‘হয়েছে হয়েছে এবার বলো হঠাৎ এত রাতে দিনাজপুর কী ভেবে এলে?’
‘রাত কোথায় কেবল তো সন্ধ্যা। ঠাকুরগাঁও থেকে আসা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হলো, তাই চলে এলাম।’
লগ্ন এবার অভিমানী সুরে বলল, ‘ধুর তুমি অভ্যাস খারাপ করছ। নিজের এবং আমারও। কদিন পর তো চলে যাবে। তখন থাকব কেমন করে?’
ইফতি হেসে বলল, ‘মাত্র তো কয়েকটা মাস। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।’
‘যাবে না। এই কদিনে তুমি এত আপন হলে কেন? অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, দূরের মানুষ দূরের হয়েই থাকতে। এখন কেমন লাভ ম্যারেজ লাভ ম্যারেজ মনে হচ্ছে।
‘লাভ হলে ক্ষতি কী?
‘লাভে কোনো লাভ নেই, সবটাই ক্ষতি।’
হো হো করে হেসে উঠলো ইফতি। তারপরেই চোখ পড়ল লগ্নর মেহেদি পরা হাতের দিকে। বলল, ‘কী ব্যাপার আমার জন্য মেহেদি পরলে আর আমাকেই দেখাচ্ছ না যে?’
লগ্ন মুচকি হেসে হাত দুটো মেলে ধরল। হাতভর্তি নকশার ঠিক মাজখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘ইফতেখার’।
ইফতি দাঁতে জিভ কেটে বলল, ‘তুমি তো শেষ, প্রেমে একদম মজে গেছ।
প্রতিবাদ করল লগ্ন, ‘ইশ একদম না। এটা নিয়ম। বরের নাম লিখতে হয় তাই লিখেছি। কোনো প্রেমফ্রেম নেই এখানে।’
এবার ইফতি তার হাত মেলে ধরল। কোনো নকশা নেই, শুধু হাতের মাঝখানে মেহেদি দিয়ে লেখা ‘লগ্নজিতা’। দেখে হেসে দিল লগ্ন।
তারপর বলল, ‘এখন বোঝা যাচ্ছে আসলে কে মজেছে প্রেমে।’
ইফতি মাথা নেড়ে বলল, ‘আমার স্বীকার করার সৎ সাহস আছে। প্রেমে মজেছি বলেই তো এতকিছু। এক পলক দেখার জন্য ঠাকুরগাঁও থেকে ছুটে আসা।’