লখিন্দরের ভেলা

লখিন্দরের ভেলা

এক

গদখালির খেয়াঘাটে কিংশুক বলল, ‘ওই দ্যাখ কালকেতু, বোট নিয়ে সুব্রত দাঁড়িয়ে আছে৷ চল উঠে পড়ি৷ ঘণ্টা দুই-আড়াইয়ের মধ্যে আমরা পাখিরালায় পৌঁছে যাব৷’

সকাল সেই সাতটায় কিংশুক আমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছে৷ গলফগ্রিনে গাড়িতে ওঠার সময় বলেছিল, পাখিরালায় পৌঁছোতে বেলা এগারোটার বেশি লাগবে না৷ কিন্তু তার লক্ষণ আমি মোটেই দেখতে পাচ্ছি না৷ যানজটের কারণে গাড়ি একবার অনেকক্ষণ আটকে রইল বারুইপুরের ফ্লাইওভারের আগে৷ তারপর ফের বাধা৷ বাসন্তী থানার সামনে কী কারণে যেন বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন স্থানীয় মানুষরা৷ মাদার টেরিজার গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল ইনোভা৷ গদখালি পৌঁছোতেই বেজে গেল বেলা দশটা৷

বোটে ওঠার পর মনে মনে হিসেব করতে লাগলাম৷ বেলা একটার আগে কিছুতেই আমরা পৌঁছোতে পারব না কিংশুকের স্কুলে৷ পাখিরালায় একটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল আছে৷ কিংশুক সেখানে জুলজি পড়ায়৷ ও আমার ছোটবেলাকার বন্ধু৷ ওর যা ডিগ্রি আছে, তাতে কলকাতার যে কোনো নামী কলেজে পড়াতে পারত৷ কিন্তু কিংশুক বরাবর একটু পাগলাটে টাইপের৷ ও মনে করে, সুন্দরবনের যা বায়ো-ডাইভারসিটি, তাতে ওর বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ওটাই সেরা জায়গা৷ লাল রঙের কাঁকড়া নিয়ে ও ইদানীং রিসার্চ করছে৷ একবার বলেছিল, রাজকাঁকড়া নিয়ে ওর লেখা নাকি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকাতেও বেরিয়েছে৷

সুন্দরবনে এর আগেও আমি বেশ কয়েকবার এসেছি৷ সন্দেশখালি, সজনেখালি থেকে শুরু করে গিয়েছি দোবাঁকি পর্যন্ত৷ কিন্তু কখনও গোসাবায় যাইনি৷ পাখিরালা হল ওই দ্বীপেরই একটা অংশ৷ ওখানে নাকি খুব সুন্দর একটা রিসর্ট আছে৷ নাম, দ্য সলিটারি ন্যুক৷ কিংশুক প্রায়ই আমাকে বলত, ‘সুযোগ পেলেই তোকে আমি নিয়ে যাব ওই রিসর্টে৷ দিন তিন-চারেকের জন্য ওখানে গিয়ে থাকলে, তুই একেবারে ফ্রেশ হয়ে যাবি৷’ সাংবাদিকতা নিয়ে ব্যস্ত থাকি চবিবশ ঘণ্টা৷ আমার অবসর আর ওর সুযোগের মেলবন্ধনটা ঠিকঠাক হচ্ছিল না৷ অ্যাদ্দিনে সেটা হল৷ ওদের টেগোর ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশান৷ চিফ গেস্ট করে কিংশুক আমাকে নিয়ে যাচ্ছে৷ পাখিরালায় অবশ্য দু-রাত্তিরের বেশি আমি থাকতে পারব না৷ কেননা, কোপা আমেরিকা ফুটবল শিগগিরই শুরু হয়ে যাবে৷

দুর্গাদুয়ানি নদীর উপর দিয়ে বোট ভেসে যাচ্ছে৷ ডেক-এ আমি আর কিংশুক বসে আছি৷ কিংশুকের গলায় ডিএসএলআর ক্যামেরা, ও পটাপট ছবি তুলছে৷ নদীর ডান পারে গভীর বন, নাইলনের জাল দিয়ে এমনভাবে ঘেরা, যাতে বাঘ জঙ্গল থেকে হুটহাট বেরিয়ে, নদী সাঁতরে, লোকালয়ে গিয়ে হামলা করতে না পারে৷ জোয়ারের জল আছড়ে পড়ছে গর্জনের ঠেসমূল, ক্যাওড়ার ঝোপ, পর্ণমোচী পশুর আর সুন্দরী গাছের কাণ্ডে৷ নদীর বাঁদিকের পাড়ে, ঘন জনবসতি৷ কোথাও জেলেদের গ্রাম, পাড়ে ছোটো ডিঙি অথবা নৌকো বাঁধা৷ মেয়েরা হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে মীন ধরায় ব্যস্ত৷ কোথাও, উঁচু বাঁধ৷ নদীর লোনা জল যাতে খেতে ঢুকে যেতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা৷ ক্যামেরা বের করার সময় কিংশুক বলেছিল, ‘জল-জঙ্গল হল ছবি তোলার আদর্শ জায়গা, বুঝলি কালকেতু৷ কত ম্যাজিক্যাল মোমেন্টস যে ক্যামেরায় ধরা পড়ে, তার ইয়ত্তা নেই৷ আমার কালেকশনে এমন কিছু ছবি আছে, তুই দেখলে অবাক হয়ে যাবি৷’

প্রায় চার বছর ধরে কিংশুক ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে মাস্টারি করছে৷ সুন্দরবনে ওর অভিজ্ঞতার কথা আমায় বলতে শুরু করল৷ সুন্দরবন বলতেই রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে৷ মানুষ-খেকো এই ভয়ানক বাঘ দেখার টানে দেশ-বিদেশ থেকে লোক ছুটে আসে৷ ‘তুই কি কখনও দেখেছিস?’ প্রশ্নটা করতেই কিংশুক বলল, ‘নিজের চোখে বাঘ কখনও দেখিনি৷ তবে, এমন অনেক মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, যারা মধু আনতে গিয়ে বাঘের মুখে পড়েছে, মারাত্মক জখম হয়ে যারা ফিরে আসতে পেরেছে৷ তাদের সঙ্গে তুই যদি কথা বলতে চাস তো, নিয়ে যেতে পারি৷’ বাঘ আর কুমিরের গল্প করতে করতেই কিন্তু কিংশুক মাঝে মাঝে লেন্সের দিকে চোখ রেখে শাটার টিপে যাচ্ছে৷ হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে ও বলে উঠল, ‘ওই পাখিটার দিকে একবার তাকা, কালকেতু৷ কোথাও এই দৃশ্য তুই দেখতে পাবি না৷’

তাকিয়ে দেখি, একটা পাখি বিশাল ডানা মেলে নীচের দিকে নেমে আসছে৷ প্রথমেই আমার আলবাত্রোসের কথা মনে হল৷ জার্মানিতে বিশ্বকাপ করতে গিয়ে ওই রকম বিরাট পাখি দেখেছি৷ কিন্তু, পরক্ষণেই ভাবলাম, যাঃ, এই বাদাবনে আলবাত্রোস আসবে কোত্থেকে? পরিযায়ী হতে পারে৷ হয়তো সাইবেরিয়া থেকে এসেছে৷ পাখিটা গোঁত খেয়ে এসে দাঁড়াল ফাঁকা জায়গায়৷ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, প্রায় পাঁচ ফুটের মতো লম্বা৷ গায়ের রং ফ্যাকাশে কালো৷ চৌকুনো ঠোঁট হলুদ৷ গলার কাছে চামড়ার ঝুলি৷ ইউক্যালিপটাস গাছের ফাঁক দিয়ে পাখিটা মাস্তানের ভঙ্গিতে কয়েক গজ হেঁটে এল৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কী পাখি রে?’

‘হাড়গিলে৷ আগে বাংলার সর্বত্র দেখা যেত৷ এখন শুধু সুন্দরবনেই এদের দেখতে পাওয়া যায়৷ কত সুন্দর সুন্দর পাখি আছে এখানে, জানিস? সোনাজঙ্ঘা, গয়ার, কানঠুঁটি, বাটান, শামুকখোল, গগনবেড়৷ দেখলে তুই আশ্চর্য হয়ে যাবি৷’

‘এই পাখিরালা গ্রামের নামকরণটা কি…প্রচুর পাখি থাকত বলে?’

‘হবে হয়তো৷ শুনেছি, আগে প্রচুর পাখি দেখা যেত৷ বিশেষ করে মাইগ্রেন্ট বার্ড৷ লোকবসতি বেড়ে যাওয়ার পর থেকে পাখিরা দক্ষিণের দিকে সরে গেছে৷’

কথা বলতে বলতেই কিংশুক যতক্ষণ পারল, পাখিটাকে ক্যামেরাবন্দি করে রাখল৷ তারপর হঠাৎ বলে উঠল, ‘মাই গুডনেস! এখখুনি যে ছবিটা আমি পেলাম, ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফাররা সেটা পেলে ধন্য হয়ে যেত রে, কালকেতু৷ উরিব্বাস, এখনও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না৷’

কথাটা বলেই ক্যামেরার মনিটর আমার সামনে এগিয়ে দিল কিংশুক৷ তাকিয়ে দেখি, সত্যিই অবিশ্বাস্য একটা ছবি৷ জলের ঢেউ ফুঁড়ে শূন্যে প্রায় দু-ফুট লাফিয়ে উঠেছে একটা সাপ৷ তার মুখটা হাঁ করা৷ ঈষৎ বাঁকানো বিষদাঁত দুটো দেখা যাচ্ছে৷ সাপটার গায়ে হলুদ রঙের শিকলের মতো সারি, গোলাকার চাকা চাকা দাগ ঘিরে কালো রঙের বেড়৷ পেটের দিকটা সাদা৷ উপরে কালো ছোপ৷ মাথা চ্যাপ্টা ত্রিকোণা৷ সাপের হাঁ করা মুখের দু-তিন ইঞ্চির মধ্যেই শূন্যে ভেসে রয়েছে সবুজ রঙের একটা ব্যাং৷ তার সামনের দুটো পা দু-পাশে ছড়ানো৷ ভয়ে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে৷ ছবিটা দেখে বোঝাই যাচ্ছে, ব্যাং শিকার করার জন্য সাপটা ওত পেতে ছিল৷ কিন্তু সেটা টের পেয়ে, বাঁচার আকুল চেষ্টায় ব্যাং জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে৷ সত্যি, অসাধারণ একটা ছবি৷

জিজ্ঞেস করলাম, ‘সাপটার নাম কী রে?’

কিংশুক বলল, ‘রাসেলস ভাইপার৷ গোদা বাংলায়, চন্দ্রবোড়া৷ ফণাহীন, কিন্তু মারাত্মক বিষধর৷ সুন্দরবনে এখন এদের দেখা যায় না বললেই চলে৷ অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছি, চন্দ্রবোড়ার ছবি তোলার৷ আজ কী কপাল দ্যাখ, পেয়ে গেলাম৷ এই ছবিটা আমি একজিবিশনে পাঠাব৷’ ফোটোগ্রাফিক একজিবিশনে ওর পাঠানো কয়েকটা ছবি মনিটরে আমাকে দেখাতে লাগল কিংশুক৷ সত্যিই, দুর্লভ সব ছবি৷ আগে জানতাম না, কিংশুক এত ভালো ছবি তোলে৷ বোটের সারেং সুব্রত বলে ছেলেটা এতক্ষণ আমাদের কথা শুনছিল৷ হঠাৎ কিংশুককে বলল, ‘নেতি ধোপানির ঘাটে গেলে অনেক চন্দ্রবোড়া দেখতে পাবেন মাস্টারমশাই৷ সব চার-সাড়ে চার ফুট লম্বা৷ একবার ডিসকভারি চ্যানেলের সাহেবদের নিয়ে ওই ঘাটে গেসলাম৷ তখন দেখেচি, কিলবিল করছে৷’

আমার দিকে ফিরে কিংশুক বলল, ‘নেতি ধোপানির ঘাট বলতে সুব্রত কী বোঝাচ্ছে, জানিস?’

বললাম, ‘মনসামঙ্গলে পড়েছি৷ বেহুলা যেখানে ভেলা ভাসিয়ে লখিন্দরের ডেডবডি নিয়ে গেছিল, তাই না? ওখানেই তো নেতি ধোপানির দেখা পেয়েছিল৷’

‘কারেক্ট৷ এখান থেকে বোটে ঘণ্টাচারেক লাগে৷ আগে ট্যুরিস্টরা যেতে পারত৷ বছর তিন-চারেক হল, খুব কড়াকড়ি হয়েছে৷ নেতি ধোপানিতে যেতে গেলে এখন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের পার্মিশন নিতে হয়৷ তবে লোকজন যে একেবারে যায় না, তা নয়৷ জায়গাটার সঙ্গে একটা মিথ জড়িয়ে আছে৷ বাদাবনের লোক এখনও বিশ্বাস করে, সাপের কামড়ে মারা যাওয়া কাউকে ওখানে নিয়ে গেলে, মা মনসার কৃপায় লখিন্দরের মতো সেও বেঁচে উঠবে৷ ভেলায় ভেসে থাকা এমন দু-একটা ডেডবডি এখনও নদীতে কখনও কখনও দেখতে পাওয়া যায়৷’

কিংশুক আর সুব্রত মিলে সুন্দরবনের নানা মিথ নিয়ে কথা বলতে লাগল৷ তারপর আমার গোয়েন্দাগিরির গল্পও শুনতে চাইল৷ কোথা দিয়ে যে ঘণ্টাদুয়েক সময় কেটে গেল, টেরই পেলাম না৷ বেলা একটা বাজে৷ এমন সময় কাছাকাছি একটা খেয়াঘাট দেখিয়ে কিংশুক বলল, ‘পাখিরালায় পৌঁছে গেছি ভাই৷ এই ঘাটটার নাম টাইগার মোড়৷ এখানেই আমরা নামব৷’

দূর থেকেই আমরা দেখতে পেলাম, খেয়াঘাটে বেশ ভিড়৷ একটা ডিঙির সামনে চাপা উত্তেজনা৷ ঘাটে নেমে কিংশুক চেনা একজনকে জিগ্যেস করল, ‘কী হয়েছে ডিঙিতে?’

সেই লোকটা বলল, ‘লাশ পইড়ে রইয়েচে মাস্টারমশাই৷ বুধয়, সাপে কেইটেচে৷ তাই ভাইস্যে দিয়েচে৷’

শুনে কিংশুক আমার মুখের দিকে তাকাল৷ একটু আগেই এ নিয়ে কথা হচ্ছিল আমাদের মধ্যে৷ ছবি তোলার জন্য দ্রুতপায়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি টপকে কিংশুক জলের কাছাকাছি পৌঁছে গেল৷ মিনিট চার-পাঁচ করে যখন ফিরে এল, তখন ওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে৷ কোনোরকমে কিংশুক বলল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে রে, কালকেতু৷ লাশটা আমাদেরই স্কুলের এক ছাত্রের৷ নাম অর্জুন লাহিড়ি৷ এ বারের স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার৷ যার হাতে ট্রফি তুলে দেওয়ার জন্য তোকে নিয়ে এসেছি৷’

দুই

হাড়গিলে পাখি, রাসেলস ভাইপার মুহূর্তে মাথা থেকে উবে গেল৷ কৌতূহল মেটানোর জন্য আমিও লাশটাকে দেখার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামলাম৷ ডিঙির উপর কলাগাছের ভেলা৷ রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো৷ মাথায় চাঁদোয়া৷ ভেলার উপর শোয়ানো রয়েছে পনেরো-ষোলো বছর বয়সি এক কিশোরের নিথর দেহ৷ তার পরনে কাদামাখা পাজামা-পাঞ্জাবি৷ দেহে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই৷ যেন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে৷ সাপে কামড়ালে শরীরে বিষদাঁত ফোটানোর দাগ থাকার কথা৷ কিন্তু, তা পরীক্ষা করার কোনো উপায় নেই৷ ডেডবডিটা এক ঝলক দেখার পর মনের অ্যানটেনা সজাগ হয়ে উঠল৷ সত্যিই যদি স্কুলের ছেলেটা স্নেকবাইটে মারা গিয়ে থাকে, তা হলে ওকে ডিঙিতে ভাসিয়ে দেওয়ার কারণটা কী? স্কুল অথরিটি নিশ্চয়ই এই কাজটা করবে না৷ পোস্টমর্টেমের পর ডেডবডি ওর গার্জেনের হাতে তুলে দেওয়া উচিত৷ যারাই এই দুষ্কর্মটি করে থাকুক না কেন, পিছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে৷

ভিড়ের মধ্যে থেকে নানা টুকরো মন্তব্য কানে ভেসে আসছে৷ কে যেন বলল, ঘণ্টাখানেক আগে থানায় খবর দেওয়া হয়েছে৷ তবুও, পুলিশের পাত্তা নেই৷ পাখিরালা থেকে গোসাবা থানার দূরত্ব নাকি আট-নয় কিলোমিটারের মতো৷ রাস্তার অবস্থা বর্ষার পর থেকেই খুব খারাপ৷ মেশিন ভ্যান ছাড়া আসা-যাওয়ার কোনো উপায় নেই৷ পুলিশ বলেছে, হাসপাতাল থেকে ডোম জোগাড় করে টাইগার মোড়ে যেতে খানিকটা সময় লাগবে৷ এর মাঝে লাশে কেউ যেন হাত না দেয়৷ কিন্তু, অতি উৎসাহী মানুষের তো অভাব নেই৷ গাঁয়ের লোকেরা ধরাধরি করে লাশটাকে ডিঙি থেকে নামিয়ে আনল৷

ঘাটের সিঁড়ির উপর কিংশুক বসে পড়েছে৷ শূন্য চোখে ও তাকিয়ে রয়েছে ডিঙির দিকে৷ বোঝাই যাচ্ছে, ধাক্কাটা ও সামলাতে পারেনি৷ কাছে যেতেই বলল, ‘কাল রাত দশটার সময়ও ক্যাম্পাসে অর্জুনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল৷ একজিবিশন হল-এ ও তখন ছাত্রদের আঁকা ছবি সাজাচ্ছিল৷ অত রাতে হোস্টেলের বাইরে থাকার জন্য ওকে আমি বকাবকি করলাম৷ ভাবতেই পারছি না, এর মধ্যে কী করে এ সব হল?’

‘স্কুলে কি খবরটা গেছে?’

‘এখখুনি প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে কথা বললাম৷ লঞ্চে করে উনি মিনিট পনেরোর মধ্যেই আসছেন৷’

‘লঞ্চে করে…মানে?’

‘আমাদের স্কুলটা নদীর ঠিক ওপারে৷ দয়াপুর বলে একটা গ্রামে৷ ইচ্ছে করেই তোকে আমি স্কুলের গেস্ট হাউসে তুলতে চাইনি৷ এপারের রিসর্টে যাতে তুই নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারিস৷ তোর নামটা স্টুডেন্টরা সবাই জানে৷ তোকে নিয়ে ওদের এত আগ্রহ যে, অনেকেই তোকে বিরক্ত করত৷ যাক সে কথা৷ লাশটা দেখে প্রাইমারিলি তোর কি মনে হল, কালকেতু? তোর তো লাশ দেখার অভিজ্ঞতা আছে৷’

‘আনন্যাচারাল ডেথ৷ একটাই কারণে মনে হচ্ছে৷ স্রেফ স্নেকবাইট হলে ছেলেটার ডেডবডি হোস্টেলের রুমেই পাওয়া যেত৷ ডিঙিতে করে ভেসে আসত না৷ নিশ্চয়ই কেউ চেয়েছিল, ভাটার টানে ডেডবডিটা অনেক দূরে চলে যাক৷ আনক্লেইমড অবস্থায় দীর্ঘসময় পড়ে থাকুক৷’

‘তুই কি বলতে চাইছিস তা’লে! মার্ডার?’ কথাটা বলতে বলতে উত্তেজনায় কিংশুক উঠে দাঁড়াল৷

‘কীভাবে মৃত্যুটা হয়েছে, সেটা ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন ছাড়া বলা সম্ভব না৷ পুলিশের উচিত, ডেডবডিটা কলকাতার কোনো মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো৷’

‘কিন্তু, অর্জুনের মতো একটা ভালো ছেলেকে কেউ মার্ডার করতে চাইবে কেন? এটাই তো আমার মাথায় ঢুকছে না৷ ছেলেটা আমাদের স্কুলের বেস্ট বয় ছিল৷ যেমন লেখাপড়াতে, তেমনই খেলাধুলো আর গান-বাজনায়৷ খবরটা শুনে তো প্রিন্সিপাল স্যার মারাত্মক শকড৷ আমরা ধরে নিয়েছিলাম, এবার জিসিএসই পরীক্ষায় দারুণ র‍্যাংক করবে৷ কী ভালো ভায়োলিন বাজাতে পারত, জানিস?’

‘স্কুলে এমন কি কেউ থাকতে পারে যে, ওর সম্পর্কে জেলাস?’

‘বলতে পারব না৷ ওর ক্লাসমেটরা কেউ হয়তো জানে৷ কিন্তু, যতই জেলাস হোক, কেউ খুন করবে, ভাবতে পারছি না৷ আমাদের স্কুলে যারা পড়তে আসে, তারা বিরাট ধনী পরিবারের ছেলে-মেয়ে৷ ভরতি হওয়ার জন্য অ্যাপ্লাই করতেই দিতে হয় পঞ্চাশ হাজার টাকা৷ রেজিস্ট্রেশন ফি আড়াই লাখ৷ আর সারা বছরের জন্য ফি দশ থেকে বারো লাখ৷ ডিপেন্ড করছে সে কোন লেভেলে পড়ছে৷ গেলেই বুঝতেই পারবি, কেন আমাদের স্কুলটা ইন্ডিয়ার সেরা৷ কেনই বা এশিয়ার সেরা পঞ্চাশটা স্কুলের মধ্যে পড়ে৷ অর্জুন লাহিড়ি যদি সত্যিই মার্ডারড হয়, তা হলে স্কুলের খুব বদনাম হয়ে যাবে৷’

‘অর্জুন ছেলেটার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড কী?’

‘ওর বাবা ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের অফিসার৷ মা একসময় ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলিট ছিলেন৷ একমাত্র সন্তান অর্জুন৷ ওকে নিয়ে দুজনের অনেক আশা৷ আজ সকালে ওঁদের দয়াপুরে আসার কথা৷ হয়তো এতক্ষণে এসেও গেছেন৷ গতসপ্তাহে ওঁদের আমিই খবরটা দিয়েছিলাম, অর্জুন স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার হয়েছে৷ তুই প্রাইজটা দিতে আসছিস শুনে অর্জুনের মা আরও বেশি করে আগ্রহ দেখালেন, আসবেনই৷ তোকে উনি ভালো করে চেনেন৷ কী হবে বল তো? ওঁদের কাছে প্রিন্সিপাল স্যার এখন মুখ দেখাবেন কেমন করে?’

‘অর্জুনের মায়ের নামটা কী রে?’

‘মাথায় আসছে না৷ দেখলে তুই নিশ্চয়ই চিনতে পারবি৷ ভদ্রমহিলাকে নিয়ে একবার না কি তুই বিরাট একটা আর্টিকেলও লিখেছিলি৷ তারপরই সেন্ট্রাল এক্সাইজে উনি চাকরি পেয়ে যান৷’

কিংশুক কার কথা বলছে, আমি বুঝতে পারলাম না৷ গত কুড়ি বছরে কত প্লেয়ারকে নিয়ে কত লেখা লিখেছি৷ তাদের মধ্যে কার চাকরি হয়েছে, জানিও না৷ দেখলে নিশ্চয়ই চিনতে পারব৷ কিন্তু, কী পরিস্থিতিতে দেখা হবে, ভাবতেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল৷ আমি নিশ্চিত, অর্জুন ছেলেটাকে খুন করা হয়েছে৷ আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, খুনি বাইরের কেউ নয়৷ স্কুলেরই কেউ৷ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলগুলোতে নিয়মের খুব কড়াকড়ি৷ বাউন্ডারির বাইরে ছাত্র-ছাত্রীদের যেতে দেওয়া হয় না৷ কাল রাত দশটার সময় ছেলেটার সঙ্গে যদি কিংশুকের দেখা হয়ে থাকে, তা হলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, অকালমৃত্যুর রহস্যটা স্কুলের মধ্যেই লুকিয়ে আছে৷ ওর ক্লাসমেট, টিচার বা স্কুলের অন্য কর্মীদের সঙ্গে কথা না বললে, বা খুনের সময়টা জানতে না পারলে, কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারব না৷

সহপাঠীদের জেলাসি বা রাইভালরি একটা কারণ হতে পারে৷ মাস্টারমশাইদের চোখে ভালো ছেলে যে, সবার কাছে জনপ্রিয় হবে, সেটা কখনও সম্ভব না৷ আমি জানি, স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার হওয়ার জন্য এই ধরনের স্কুলে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে রেষারেষিটা কোন পর্যায়ে যায়! টিভিতে ‘পরভারিশ’ বলে একটা হিন্দি সিরিয়াল হত, সেখানে দেখেছি, স্টুডেন্টরা কে কাকে কীভাবে ল্যাং ম্যারে৷ জিগ্যেস করলাম, ‘তোদের স্কুলে বেস্ট স্টুডেন্ট বাছার ক্রাইটেরিয়াটা কী, বল তো?’

কিংশুক বলল, ‘আমাদের স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় হাজার দুয়েক৷ চারটে হাউস আছে…ব্লু, রেড, ইয়েলো আর পিংক৷ অনেকটা ইংলিশ পাবলিক স্কুলগুলোর ধাঁচে৷ লড়াইটা মূলত এই চারটে হাউসের মধ্যে৷ কম্পিটিশন লেভেল বাড়ানোর জন্যই আর কী৷ অনেকগুলো ক্রাইটেরিয়া আছে৷ পরীক্ষার রেজাল্ট তো ভালো হতে হবেই, প্লাস গুড কনডাক্ট, অ্যাটেনডেন্সও বিচার করা হয়৷ তা ছাড়া, একস্ট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসেও স্টুডেন্টরা নম্বর পায়৷’

‘একস্ট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস বলতে কী কী আছে?’

‘স্পোর্টস, মিউজিক, ডিবেট, পেন্টিং…এমন কী, ব্রেভারিও সিলেকশন ক্রাইটেরিয়ার মধ্যে পড়ে৷ আমাদের স্কুলটা দত্তা নদীর একেবারে গায়ে৷ এ বছরই বর্ষার সময় বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল৷ নদীর জলে গাঁয়ের একটা বাচ্চা ছেলে ভেসে যাচ্ছিল৷ অর্জুন জলে ঝাঁপিয়ে ওকে বাঁচায়৷’

‘মেন কম্পিটিশন কাদের মধ্যে হয়েছে?’

‘ব্লু হাউসের অর্জুন লাহিড়ি, রেড হাউসের অশোকা গুণতিলকে, ইয়েলো হাউসের শেরাব লেপচা আর পিংক হাউসের নির্মল ভাবনানির মধ্যে৷ তোকে বলা হয়নি, আমাদের স্কুলে প্রতিবেশী দেশের ছেলে-মেয়েরাও পড়তে আসে৷ প্রায় চল্লিশ শতাংশ বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী৷ গুণতিলকে ছেলেটা হল শ্রীলঙ্কার৷ ওর বাবা কলম্বোর নামকরা ব্যবসায়ী৷ লেপচা হল ভুটানের রাজপরিবারের ছেলে৷ কী একটা লতায়-পাতায় সম্পর্ক আছে যেন৷ আর ভাবনানি গুজরাতের ছেলে৷ ওর বাবা এখন গুজরাত বিধানসভার স্পিকার৷ বুঝতেই পারছিস, কাদের ছেলে-মেয়েরা আমাদের স্কুলে পড়তে আসে৷ এদের গার্জেনরা ইচ্ছে করলে ছেলে-মেয়েদের পাঠাতে পারতেন বিলেতে বা আমেরিকায়৷ কিন্তু আমাদের প্রিন্সিপাল স্যারের এমন সুনাম যে, দয়াপুরের মতো একটা অজ পাড়াগাঁয়ে সন্তানদের পাঠাতে ওঁরা দ্বিধা করেননি৷’

কিংশুক যে এইরকম একটা নামী স্কুলে পড়ায়, জানতামই না৷ প্রিন্সিপাল ভদ্রলোক সম্পর্কে মারাত্মক কৌতূহল হল৷ ভদ্রলোকের নিশ্চয়ই বিদেশের কোনো স্কুলে পড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে৷ প্রশ্নটা করতেই কিংশুক বলল, ‘অফকোর্স৷ উনি প্রায় তিন বছর সিঙ্গাপুরের ট্যাংলিন ট্রাস্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়িয়েছেন৷ তারও আগে দশ বছর ছিলেন থাইল্যান্ডের ভুমিবল স্কুলে৷ বাঙালি ক্রিশ্চান, নাম মাইকেল সঞ্জীব পুরকায়স্থ৷ আমাদের সাবজেক্টে প্রবাদপ্রতিম মানুষ৷ অ্যাকচুয়ালি ওঁর টানেই আমার এই স্কুলে চাকরি নেওয়া৷ মানুষটাকে দেখলেই তোর শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে হবে৷ একবার রাষ্ট্রপতির পদকও পেয়েছেন৷’

সিঙ্গাপুরের ট্যাংলিন ট্রাস্ট ইন্টারন্যাশনাল হল, বিশ্বের সেরা স্কুলগুলোর অন্যতম৷ সিঙ্গাপুরে বেশ কয়েকবার এশীয় কাপ ফুটবল কভার করতে গেছি বলে, আমি জানি৷ অত বড়ো একটা স্কুলের চাকরি ছেড়ে মাইকেল সঞ্জীব পুরকায়স্থ স্যার কেন সুন্দরবনের মতো জায়গায় এলেন, এই প্রশ্নটা করার কোনো মানে হয় না৷ কিছু আদর্শবাদী মানুষ আছেন, যাঁরা অনেক প্রশ্নের ঊর্ধ্বে৷ আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই নদীর দিকে তাকিয়ে কিংশুক, একটা লঞ্চকে এদিকে আসতে দেখে, বলে উঠল, ‘আমাদের স্কুলের লঞ্চটা আসছে৷ আমার মনে হয় না, ফাংশানটা আজ হবে৷ এই রকম একটা মিসহ্যাপ হয়ে যাওয়ার পর হবেই বা কী করে? দাঁড়া, প্রিন্সিপাল স্যার আসুন৷ ওঁকে জিগ্যেস করে, তারপর তোকে রিসর্টে নিয়ে যাব৷’

স্কুলের লঞ্চ টাইগার মোড়ের খেয়াঘাটে ভিড়তেই দ্রুত পায়ে কিংশুক নীচের দিকে নেমে গেল৷ লঞ্চ থেকে নেমে এলেন বয়স্ক এক ভদ্রলোক৷ শ্বেতশুভ্র চুল, দাড়ি-গোঁফ৷ শান্ত সৌম্য চেহারা৷ পরনে পাদ্রিদের মতো সাদা ঝোলা পোশাক৷ বয়স ষাটের কাছাকাছি৷ ইনিই তা হলে প্রিন্সিপাল মাইকেল সঞ্জীব পুরকায়স্থ৷ কিংশুকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক এগিয়ে গেলেন, যেখানে অর্জুনের ডেডবডি শোয়ানো রয়েছে সেইদিকে৷ প্রিন্সিপাল স্যারকে ঘিরে রয়েছে উঁচু ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী৷ ডেডবডি দেখে তাদের মধ্যে কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করেছে৷ দেখে মনে হল, এরা অর্জুনের ক্লাসমেট৷ হঠাৎই চোখ গেল, লঞ্চের দিকে৷ এক মাঝবয়সি মহিলাকে ধরে ধরে নামাচ্ছেন এক ভদ্রলোক৷ মুখের দিকে তাকাতেই তাকে চিনতে পারলাম৷ তখন নাম ছিল রেখা গাঙ্গুলি৷ বিয়ের পর পদবি বদলে লাহিড়ি হয়েছে৷ একটা সময় ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হার্ডলার ছিল৷ মাই গুডনেস! এই রেখাই তা হলে অর্জুনের মা!

তিন

রিসর্টে আর যাওয়া হল না৷ বেলা চারটে নাগাদ অর্জুনের ডেডবডি নিয়ে পুলিশ কলকাতার দিকে রওনা হল৷ আমি এটাই চাইছিলাম৷ কলকাতার কোনো মেডিক্যাল কলেজে ফরেনসিক তদন্ত হোক৷ গোসাবা থানার পুলিশ প্রথমে গাঁইগুঁই করছিল৷ ওদের পক্ষে ডেডবডি অ্যাদ্দূর নিয়ে যাওয়া সম্ভব না৷ কিন্তু, রেখার হাজবেন্ড চঞ্চল লাহিড়ি করিতকর্মা মানুষ৷ আয়কর দফতরে আছেন বলে অনেক গণ্যমান্য মানুষের সঙ্গে ওঁর জানাশোনা৷ উনিই ফোনাফুনি মারফত সব ব্যবস্থা করে ফেললেন৷ গদখালি খেয়াঘাটে অ্যাম্বুলেন্স এসে অপেক্ষা করবে৷ পাখিরালা থেকে লঞ্চ করে সেখানে পৌঁছোলে ডেডবডি এনআরএস হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হবে৷

টাইগার মোড় খেয়াঘাটে আমাকে দেখে রেখা প্রথমে খুব কান্নাকাটি করেছিল৷ কিন্তু, পরের দিকে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে শুরু করল৷ ভিড়ের মাঝখান থেকে রেখাকে সরিয়ে নিয়ে এসেছিলাম৷ ওর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলে কোনো ক্লু পাওয়ার জন্য৷ রেখা তখন বলেছিল, ‘অর্জুন কালই আমাদের সঙ্গে কলকাতায় চলে যাবে, এটা ঠিক ছিল৷ এক সপ্তাহ আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে ও এখানে ফিরে আসত৷ ভাবতেও পারিনি কালকেতুদা, ওর ডেডবডি নিয়ে আমাদের ফিরতে হবে৷’

‘তোমার সঙ্গে কি রোজই ওর কথা হত?’

‘সপ্তাহে দু-তিন দিন তো হতই৷ আমার সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছে কাল বিকেলবেলায়৷ ফোন করে ও বলেছিল, মা, আসার সময় আমার অটোগ্রাফের খাতাটা সঙ্গে নিয়ে এসো৷ চার-পাঁচ বছর ধরে অর্জুন সেলেব্রিটিদের অটোগ্রাফ জোগাড় করছে৷ পুজোর ছুটিতে সেই খাতাটা ও ফেলে এসেছিল কলকাতার বাড়িতে৷ আপনার একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল ওর৷ আপনার কথা ওকে আমি খুব বলতাম৷ ও বিশ্বাসই করতে চাইত না, আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে৷’

‘স্কুলের কারও সম্পর্কে কোনোদিন কমপ্লেন করেনি তোমাদের কাছে?’

‘কোনোদিনই না৷ অর্জুন সে টাইপের ছেলেই ছিল না৷ প্রতিদিনই বলত, আমাকে নিয়ে তোমারা চিন্তা কোরো না মা৷ প্রিন্সিপাল স্যার থেকে শুরু করে অন্য টিচিং স্টাফরা প্রত্যেকেই আমাকে ভালোবাসেন৷ হোস্টেলেও আমি খুব ভালো আছি৷ শুধু তোমার হাতের রান্নাটা মিস করি৷’

‘ক্লাসমেটদের মধ্যে কে ওর সবথেকে কাছের ছিল?’

‘দীপঙ্কর আচার্য বলে একটা ছেলে৷ ওর বাড়ি পাটনায়৷ সামার ভেকেশন বা ক্রিসমাসের ছুটির সময় যখন সবাই বাড়িতে যেত, তখন দীপঙ্কর একটা বেলা আমাদের বাড়িতে কাটিয়ে পাটনার প্লেন ধরত৷ ওর মুখেও আমরা কখনও শুনিনি, অর্জুন কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলায় জড়িয়েছে৷ হ্যাঁ, বন্ধুদের মধ্যে রাইভালরি যে ছিল না, তা নয়৷ কিন্তু, অর্জুন তো আমারই ছেলে৷ এটা ওর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম, সবসময় পারফরম্যান্সের লেভেলটা অন্যদের তুলনায় এগিয়ে রাখবি৷ সেটা পড়াশোনাতেই হোক অথবা খেলাধুলোতে৷ আপনি দীপঙ্করের সঙ্গে একবার কথা বলতে পারেন৷ এমনও হতে পারে, কোনো ব্যাপার হয়তো ও আমার কাছে চেপে গেছে৷ আপনাকে বলতে দ্বিধা করবে না৷’

‘শুনলাম, অর্জুন সব ব্যাপারেই খুব চৌখস ছিল৷’

‘নিজের ছেলে বলে বলছি না, কালকেতুদা৷ এ রকম একটা ছেলে লাখে মেলে৷ জিসিএসই পরীক্ষাটা কী টাফ, সেটা আপনি নিশ্চয়ই জানেন৷ গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডে পরীক্ষাটা হয়৷ অর্জুন ‘এ স্টার’ মার্কস পেতই৷ এবার ডিবেটে ফার্স্ট হয়েছিল বলে, ওর যাওয়ার কথা ছিল বেজিংয়ের ডালউইচ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে৷ ওখানে জিসিএসই বোর্ডের স্কুলগুলোর ডিবেট কম্পিটিশন হবে ক্রিসমাসের সাতদিন আগে৷ আপনি তো জানেন, আমি একবার চিনের ওয়াং বাওতে গেছিলাম, এশিয়ান মিটে নামতে৷ যেখানে ঊষাকে আমি হারিয়ে দিয়েছিলাম৷ তাই খুব আনন্দ হয়েছিল, যখন বেজিং ডিবেটের জন্য ছেলেটা সিলেকশন পেয়েছিল৷ কী কপাল দেখুন আমার৷ ছেলেটাই বেঁচে রইল না৷’

‘মিসহ্যাপের খবরটা কখন তোমরা শুনতে পেলে?’

‘আরে…সকালে গদখালি থেকেই ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম৷ কিন্তু ফোনে ওকে ধরতে পারছিলাম না৷ তখন মনে হয়েছিল, হয়তো নেটওয়ার্কের প্রবলেম৷ দয়াপুরে পৌঁছে আমরা শুনলাম, অর্জুনকে পাওয়া যাচ্ছে না৷ বেলা তখন এগারোটা বাজে৷ দীপঙ্কর গেস্ট হাউসে দেখা করতে এসে আমাদের বলল, ব্রেকফাস্টের সময় না কি অর্জুনকে ডাইনিং হলে দেখেনি৷ হোস্টেলে ওর রুম যে শেয়ার করে, সে শ্রীলঙ্কার ছেলে৷ বাবা মারা যাওয়ায় স্পেশ্যাল পার্মিশন নিয়ে সে দিনতিনেক আগে কলম্বোতে চলে গেছে৷ এ ক’দিন ঘরে অর্জুন একাই ছিল৷ আমরা খোঁজ শুরু করায় হোস্টেলের ওয়ার্ডেন মিঃ শ্রীবাস্তব বললেন, ভোরবেলা থেকেই না কি অর্জুন নিপাত্তা৷’

‘ওদের এখানকার রুটিনটা কী রকম?’

‘ভোর ছটায় একঘণ্টার জন্য সবাইকে জিমন্যাসিয়ামে যেতে হয়৷ সাতটা থেকে নটা পর্যন্ত পড়াশোনা৷ তারপর ব্রেকফাস্ট৷ বেলা দশটা থেকে একটা পর্যন্ত স্কুল৷ এরপর লাঞ্চের জন্য ছুটি এক ঘণ্টা৷ মিঃ শ্রীবাস্তব আমাদের বললেন, অর্জুন আজ জিমন্যাসিয়ামেও যায়নি৷ যেটা খুব রেয়ার ঘটনা৷ ফিজিক্যাল ফিটনেসের জন্য ও রোজ জিমে যেতই৷ তখনই ভদ্রলোকের সন্দেহ হয়, ছেলেটা তাহলে গেল কোথায়? প্রশ্নটা উঠতে উঠতেই বেলা দশটা বেজে গেছিল৷ মিঃ শ্রীবাস্তব তারপরই প্রিন্সিপাল স্যারকে খবরটা জানান৷ আসলে স্কুলের ফাংশান নিয়ে সবাই এমন ব্যস্ত যে, গত দু-দিন ধরে সবকিছু ঢিলেঢালা৷ অর্জুনের উপর দায়িত্ব ছিল, স্টুডেন্টদের পেন্টিং একজিবিশন কনডাক্ট করা৷ প্রিন্সিপাল স্যার ধরেই নিয়েছিলেন, এই কাজেই ও হয়তো কোথাও ব্যস্ত রয়েছে৷ স্কুলের এত বড়ো এরিয়া, এতগুলো বিল্ডিং৷ চট করে কারও হদিশ পাওয়া কঠিন৷ মনে হয়, কেউ ভাবতেই পারেননি, ছেলেটাকে এই অবস্থায় পাওয়া যাবে৷’

‘কাল রাতে অর্জুনকে শেষবার কে দেখেছিল, সে সম্পর্কে দীপঙ্কর কিছু বলেছে?’

‘জিজ্ঞেস করিনি৷ ক্লাসমেটদের কেউ হয়তো সেটা জানে৷ অথবা মিঃ শ্রীবাস্তব৷ রোজ রাত নটার মধ্যে নাকি ওদের হোস্টেলের গেটে তালা পড়ে যায়৷ এক হাউসের ছেলে, অন্য হাউসে পর্যন্ত থাকতে পারে না৷ মিঃ শ্রীবাস্তব নিজে চেক করেন, ছেলেরা ঘরে আছে কি না? কাল অবশ্য অতটা কড়াকড়ি ছিল না৷ অর্জুনদের ব্লু হাউসের মেন গেটে তালা পড়ে গেছিল৷ কিন্তু, পিছন দিকে ছোটো একটা গেট খোলা ছিল৷ কথাটা আমরা মিঃ শ্রীবাস্তবের মুখেই শুনলাম৷ এখানে প্রতিটা বিল্ডিংয়ের মেন গেটে সিসিটিভি লাগানো আছে৷ মিঃ শ্রীবাস্তব বলছিলেন, সিসিটিভির ফুটেজে রাত সোয়া দশটা নাগাদ না কি অর্জুনকে একজিবিশন হল থেকে বেরোতে দেখা গেছে৷ তারপরই সম্ভবত ও ব্লু হাউসের হোস্টেলে নিজের ঘরে চলে যায়৷ রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ সিকিউরিটি গার্ড ওকে ছোটো গেট দিয়ে হোস্টেলে ঢুকতে দেখেছে৷’

কিন্তু তারপর এমন কী হল? হোস্টেলের রুম থেকে অর্জুনের ডেডবডিটা পাখিরালার খেয়াঘাটে পৌঁছোল কী করে? এই প্রশ্নটারই উত্তর খুঁজতে হবে আমাকে৷ ছেলের ডেডবডির সঙ্গে কলকাতায় রওনা হওয়ার আগে রেখা আমাকে অনুরোধ করে গেল, ‘আপনি তো কত বড়ো বড়ো মার্ডার মিস্ট্রি সলভ করেছেন বলে শুনেছি৷ প্লিজ, আমার ছেলের খুনিকে আপনি ধরে দিন৷ যতদূর যেতে হয়, আমি যাব৷ তাকে ফাঁসিতে লটকাবই৷ প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে বোঝাচ্ছিলেন, খবরটা যেন প্রেসের কানে না যায়৷ তাহলে না কি স্কুলের ক্ষতি হয়ে যাবে৷ কিন্তু, ওঁর কথা আমি শুনব না৷ আজই কলকাতায় ফিরে আমি ডিজি সাহেবের কাছে যাব৷ তারপর মিডিয়ার লোকদের ডেকে পুরো ঘটনাটা জানিয়ে দেব৷’

পুলিশের ডিজি সদাশিব রামানুজন হলেন বাংলার অ্যাথলেটিক্স সংস্থার প্রেসিডেন্ট৷ রেখাকে উনি ভালোমতন চেনেন৷ ও গিয়ে যদি কমপ্লেন করে, তাহলে গোসাবা পুলিশের হাতে কেসটা আর থাকবে না৷ সোজা ভবানী ভবনের কোনো অফিসারের হাতে চলে যাবে৷ কথাগুলো বলার সময় রেখার মুখটা একবার দপ করে জ্বলে উঠল৷ ওর এই জেদি চেহারাটা আমি এর আগেও দু-একবার দেখেছি৷ হার্ডলস কম্পিটিশনে যখন নামত, তখন৷ তার মানে রেখা বদলায়নি৷ সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই ওকে বললাম, ‘আমি চেষ্টা করব, রেখা৷ কিন্তু, স্কুল অথরিটি যদি চান, তবেই কেসটা হাতে নিতে পারি৷’

রেখার কথাগুলো কিংশুক শুনেছিল৷ বিকেলে লঞ্চে করে আমাকে দয়াপুরে নিয়ে আসার সময় ও বলল, ‘আমিও রিকোয়েস্ট করছি, কালকেতু, দু-তিনটে দিন এখানে তুই থেকে যা৷ প্রিন্সিপাল স্যার তোর সঙ্গে কাল আলাদা করে কথা বলতে চান৷ আর পারিস তো, অর্জুনের মাকে তুই একটু বোঝা৷ যেন মিডিয়ার কাছে গিয়ে উনি বেশি হইচই না বাধান৷ এইটুকু সময়ের মধ্যে বুঝতে পারলাম, ভদ্রমহিলা তোকে খুব শ্রদ্ধা করেন৷ তোর অনুরোধ উনি ফেলে দেবেন না৷’

শুনে আমি কোনো উত্তর দিলাম না৷ দোতলার ডেক-এর সামনের দিকে প্রিন্সিপাল স্যার বসে আছেন৷ শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন জঙ্গলের দিকে৷ খেয়াঘাটে কিংশুক যখন আলাপ করিয়ে দেয়, ভদ্রলোক তখন পুলিশের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত৷ তা সত্ত্বেও, সৌজন্য দেখাতে ভোলেননি উনি৷ ব্রিটিশ উচ্চারণে ইংরেজিতে উনি বলেছিলেন, ‘স্পোর্টস নিয়ে আপনার লেখার সঙ্গে আমি খুব পরিচিত, মিঃ নন্দী৷ পরে ভালো করে আলাপ করা যাবে৷ দেখছেনই তো, কী একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি৷ ভেরি সরি, অ্যানুয়াল ফাংশানটা আজ পোস্টপোন করতে হল৷’

দিনের আলো কমে এসেছে৷ বেলা প্রায় পাঁচটার সময় আমরা টেগোর ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পৌঁছোলাম৷ সকালে সুইসাম রেস্তোরাঁ থেকে স্যান্ডউইচের প্যাকেট নিয়ে এসেছিল কিংশুক৷ সারা দিনে সেই স্যান্ডউইচ আর ডাবের জল ছাড়া পেটে আর কিছু পড়েনি৷ ওইরকম একটা দুর্ঘটনার পর কারই বা খাওয়ার কথা মনে থাকে! স্কুলের ঘাটে নামার পরই কিংশুক বলল, ‘গেস্ট হাউসে ঢোকার আগে, চল ডাইনিং হল-এ গিয়ে কিছু খেয়ে নিই৷ এখানে সব রকম ডিশ পাওয়া যায়৷ কী খাবি বল৷’

এত বাছবিচার করার সময় নেই৷ বললাম, ‘চট করে যা পাওয়া যায়, নিয়ে নে৷’

ডাইনিং হল-এ ঢুকে আমার চোখ কপালে ওঠার পালা৷ বিশাল হলঘর৷ উজ্জ্বল আলোয় একেবারে ঝকঝকে, তকতকে৷ প্রায় হাজারখানেক লোক একসঙ্গে বসে খেতে পারে৷ সুদৃশ্য টেবল ঘিরে চারটে করে চেয়ার৷ টেবলগুলোও নামি রেস্তোরাঁর মতো সাজানো৷ হলঘরের চার কোণে চারটে বড়ো কাউন্টার৷ কোথায় কী পাওয়া যায়, ছবি দিয়ে লেখা আছে৷ ইন্ডিয়ান, চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল, ইতালিয়ান, থাই, এমন কী ভিয়েতনামিজ খাবারও পাওয়া যায়৷ আমাকে বসিয়ে রেখে কিংশুক বলল, ‘এখানে খুব ভালো পিৎজা পাওয়া যায়৷ টেস্ট করে দেখতে পারিস৷ পরে ডিনারের সময় না হয় পছন্দমতো খাবার খাস৷’

ডাইনিং হল-এ ঢুকেই আমার বোঝা হয়ে গেল, স্কুলটা কাদের জন্য৷ বৈভবশালী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা ছাড়া কারও পক্ষে এর চৌকাঠ পেরোনো সম্ভবই না৷ হলঘরের এদিক-ওদিকে, নানা দেশের কিছু ছেলে-মেয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে৷ এরাই হয়তো স্কুল থেকে বেরিয়ে হায়ার এডুকেশন নিয়ে, যে যার দেশে ফিরে গিয়ে সরকারি অথবা বেসরকারি সংস্থার হাল ধরবে৷ আমি নিজে যে স্কুলে পড়াশোনা করেছি, শোভাবাজারের সেই সারদাচরণ আর্য বিদ্যালয়ের সঙ্গে মনে মনে টেগোর ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের তুলনা করছি, এমন সময় একটা ছেলে সামনে এসে দাঁড়াল৷ ছেলেটাকে পাখিরালার খেয়াঘাটে রেখার সঙ্গে কথা বলতেও দেখেছি৷ হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে ছেলেটা বলল, ‘অর্জুনের মুখে আপনার কথা খুব শুনতাম৷ স্যার, আমার নাম দীপঙ্কর আচার্য৷ আপনাকে আমি কিছু ইনফর্মেশন দিতে চাই৷’

দীপঙ্করের নাম একটু আগে রেখার মুখে শুনেছি৷ ভালোই হল, ছেলেটা নিজে থেকে এগিয়ে এল৷ কিন্তু, ও মুখ খোলার আগেই বাধা পড়ল৷ কিংশুককে এদিকে আসতে দেখে দীপঙ্কর চাপা গলায় বলল, ‘এখন নয় স্যার৷ রাতে গেস্ট হাউসে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব৷ তখন আলাদা করে কথা বলা যাবে৷’ কথাগুলো বলেই দ্রুত পায়ে ও সরে গেল৷

চার

পিৎজা খাওয়ার ফাঁকে স্কুল নিয়ে খুব গর্ব করতে লাগল কিংশুক৷ মাঝে মাঝে আপশোশও৷ ‘ফাংশানটা যদি হত, তাহলে বুঝতে পারতি, কালকেতু, কী গ্রাঞ্জারে হত৷’ কিংশুক বলতে লাগল, ‘পুরো প্ল্যানিংটা করেন প্রিন্সিপাল স্যার৷ হোল ওয়ার্ল্ডে যত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল আছে, এই ধরনের অকেশনে তাদের মধ্যে কালচারাল এক্সচেঞ্জ হয়৷ আজই যেমন বাহরিনের একটা ট্রুপের পারফর্ম করার কথা ছিল৷ দশ বছরের স্টুডেন্টদের অর্কেস্ট্রা৷ কাল রাতে ওরা আমাদের অপেরা হাউসে রিহার্সাল দিচ্ছিল৷ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, পা যেন কেউ স্ক্রু দিয়ে আটকে দিয়েছে৷ ওইটুকুন সব বাচ্চা, অথচ কী তাদের ট্যালেন্ট!’

কিংশুকের কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না৷ মন পড়ে রয়েছে অর্জুনের ডেডবডিটার দিকে৷ ওর খুনের রহস্যটা আমাকে উন্মোচন করতেই হবে৷ এতক্ষণে নিশ্চয়ই গদখালি থেকে ডেডবডি কলকাতার দিকে রওনা হয়ে গেছে৷ কাল সকালে যদি ফরেনসিক তদন্তটা হয়, তা হলে বিকেলের মধ্যে রিপোর্টটা পুলিশের পেয়ে যাওয়ার কথা৷ রেখা আর ওর হাজবেন্ড চঞ্চলের মোবাইল নাম্বারগুলো নিয়ে রেখেছি৷ ওদের মাধ্যমেই জেনে নিতে হবে, এনআরএস হসপিটালে কে ফরেনসিক পরীক্ষা করেছেন৷ অনেক এক্সপার্টকেই আমি চিনি৷ তাঁদের মধ্যে কেউ একজন করলে, সরাসরি তাঁর সঙ্গে কথাও বলে নিতে পারি৷

কিংশুক স্কুলের গুণগান করেই যাচ্ছে৷ আমার মনোযোগ টানার চেষ্টায় বলল, ‘আমাদের স্কুলের কালচারাল প্রোগ্রামগুলোও দুর্দান্ত, বুঝলি কালকেতু৷ কয়েকটা নাচের প্রোগ্রাম তো বিদেশে খুব হিট৷ যেমন, টেগোরের তাসের দেশ, চণ্ডালিকা৷ অর্জুনও বেশ কয়েকবার ট্রুপের সঙ্গে বিদেশে গেছে৷ ও ভায়োলিন বাজাত…৷’

প্রশ্ন করতে হয়, তাই করলাম, ‘কোথায় হয় তোদের এই কালচারাল প্রোগ্রাম?’

‘এখানেই৷ কাল তোকে আমাদের অপেরা হাউসে নিয়ে যাব৷ প্রায় আড়াই হাজারের মতো সিট৷ দেখবি, সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামের থেকে কোনো অংশে কম না৷ ইস, মিসহ্যাপটা যদি না হত, তা হলে কাল এতক্ষণে অপেরা হাউসের কাছাকাছি অঞ্চলটা গমগম করত৷’

পিৎজা খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর ডাইনিং হল-এর বাইরে এসে দেখি, অন্ধকার নেমে এসেছে৷ রাস্তাঘাট ভিজে৷ তার মানে এই সময়টুকুর মধ্যে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে৷ বাদাবনের আবহাওয়ায় এটাই বৈশিষ্ট্য৷ কখন যে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে, আন্দাজ করা কঠিন৷ স্কুলের খেয়াঘাট থেকে একটা ন্যানো গাড়ি করে আমরা ডাইনিং হল-এ এসেছিলাম৷ সেই গাড়িতেই আমাকে গেস্ট হাউসে পৌঁছে দিয়ে কিংশুক বলল, ‘সারাটা দিন মারাত্মক ধকল গেল, না রে? স্নান না করলে চলবে না৷ আমি এখন টিচার্স কোয়ার্টার্সে চলে যাচ্ছি৷ রাত সাড়ে আটটার সময় ফের তোর কাছে আসব৷ ততক্ষণে তুইও ফ্রেশ হয়ে নে৷’

রিসেপশন থেকে রুমের চাবি নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি, এমন সময় কে যেন পিছন থেকে ডাকলেন, ‘আরে, মিঃ নন্দী আপনি এখানে?’

ঘুরে তাকিয়ে দেখি, অবধীশ গানেরিওয়াল৷ বাংলার আইস স্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট৷ বছর দু-এক আগে ভদ্রলোক কলকাতায় ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ করেছিলেন৷ তখন থেকেই ওঁর সঙ্গে আলাপ৷ শুনেছি, উনি হিরের ব্যবসায়ী৷ কোটি কোটি টাকার মালিক৷ নিশ্চয়ই ওঁর ছেলে বা মেয়ে কেউ এই স্কুলের স্টুডেন্ট৷ হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনার কে পড়ে এখানে?’

‘মেয়ে…ময়ূরী৷’ অবধীশ গানেরিওয়ালের পাশেই দাঁড়িয়ে পনেরো-ষোলো বছর বয়সি একটা মেয়ে৷ তাকে উনি বললেন, ‘এই আংকল খুব ফেমাস জার্নালিস্ট৷ মিঃ কালকেতু নন্দী৷ একে পরনাম করো বেটা৷’

ময়ূরী হাতজোড় করে প্রণাম জানিয়ে বলল, ‘আপনার নাম আমি ইনভিটেশন কার্ডে দেখেছি, আংকল৷ খুব ইচ্ছে ছিল, আপনার কাছ থেকে আমরা লিও মেসির গল্প শুনব৷’

বললাম, ‘তুমি ফুটবল ভালোবাসা নাকি?’

‘অফকোর্স৷ আমি লিও মেসির অন্ধ ভক্ত৷’

হাসিমুখে মিঃ গানেরিওয়াল বললেন, ‘মেয়েটাকে আমি আইস স্কেটিংয়ে দিতে চেয়েছিলাম৷ কিছুতেই আমার পছন্দের খেলায় এল না৷ এই স্কুলের বেশির ভাগ ছেলে-মেয়ে রিয়েল মাদ্রিদ আর রোনাল্ডোর ফ্যান৷ কিন্তু, আমার মেয়ে লড়ে যাচ্ছে মেসির জন্য৷’ আমাকে কথাগুলো বলেই মিঃ গানেরিওয়াল মেয়েকে বললেন, ‘যাও বেটা, বন্ধুদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলো৷ আংকলের সঙ্গে আমার কথা আছে৷’

ময়ূরী চলে যাওয়ার পরই আমার দিকে ঘুরে মিঃ গানেরিওয়াল বললেন, ‘ব্যবসার কাজে অ্যাদ্দিন ব্রাসেলসে ছিলাম৷ মেয়ের স্কুলের ফাংশান দেখার জন্যই দেশে ফিরেছি৷ কিন্তু, এখানে এসে মেয়ের মুখে যা শুনলাম, তাতে আর এই স্কুলে পড়াতে ভরসা পাচ্ছি না৷’

আমার ইন্দ্রিয়গুলো সচেতন হয়ে উঠল৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভয় পাচ্ছেন কেন?’

‘আগে ভাসাভাসা শুনেছিলাম৷ এবার কনফার্মড হলাম৷ কারণটা হল, স্টুডেন্টদের মধ্যে ড্রাগ অ্যাডিকশন৷ বিশেষ করে উঁচু ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে৷ যে ছেলেটা মার্ডারড হয়েছে, সে ময়ূরীর ক্লাসমেট৷ ছেলেটা নাকি অ্যান্টি ড্রাগ ক্যাম্পেন করতে গিয়ে ভিক্টিম হল৷ আপনি তো জার্নালিস্ট৷ খোঁজ নিলেই সব জানতে পারবেন৷’

‘কী বলছেন আপনি! প্রিন্সিপাল স্যার কি ড্রাগ অ্যাবিউসের কথা জানেন?’

‘নিশ্চয়ই জানেন৷ আজ দুপুরে আমরা কয়েকজন গার্জেন মিলে ঠিক করলাম, কাল ওঁর সঙ্গে দেখা করব৷ আমাদের আশঙ্কার কথা ওঁকে জানানো দরকার৷ যদি পজিটিভ কিছু শুনতে না পাই, তাহলে মেয়েকে নিয়ে গিয়ে দুবাইয়ের স্কুলে ভরতি করে দেব৷’

ভদ্রলোক আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন৷ এক মহিলাকে কাছে আসতে দেখে চুপ করে গেলেন৷ আমিও কথা না বাড়িয়ে করিডর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম৷ ড্রাগ অ্যাবিউস কথাটা মাথায় গেঁথে গেল৷ হ্যাঁ, খুনের এটা একটা কারণ হতেই পারে৷ নামী স্কুল-কলেজগুলোতে মাদক সমস্যাটা বিরাট৷ মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্টদের হোস্টেলে আকছারই ড্রাগ ধরা পড়ার কথা শুনি৷ দয়াপুরের এই স্কুলে যারা পড়তে আসে, তাদের এই পাপ স্পর্শ করা স্বাভাবিক৷ দীর্ঘদিন ধরে তারা পারিবারিক বৃত্তের বাইরে থাকে৷ স্বজন-বিচ্ছিন্ন জীবন, কম্পিটিশনের দৌড়…এ সব থেকে খানিকটা সময় নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য হয়তো এরা মাদক সেবনে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে৷ ঠিকই করে নিলাম, দীপঙ্কর বলে ছেলেটা যখন কথা বলতে আসবে, তখন সরাসরি প্রশ্নটা করব৷

গেস্ট হাউসের রুমগুলো, কিংশুক ঠিকই বলেছিল, থ্রি স্টার হোটেলের ঘরের মতো৷ বাথটাব-এ শুয়ে খানিকক্ষণ স্নান করার পর সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল৷ অফিসে ফোন করে তথাগতর কাছ থেকে জেনে নিলাম, কোপা আমেরিকা নিয়ে কী কী খবর এসেছে৷ আজ ইডেনে গোলাপি বল দিয়ে লিগ ম্যাচ শুরু হয়েছে৷ ক্রিকেট দুনিয়ায় এই প্রথম৷ খবরটা যাতে ভালো করে ডিসপ্লে হয়, সেই নির্দেশ দিয়ে টিভি চালিয়ে দিলাম৷ সন্ধে সাতটা বাজে৷ রেখারা মনে হয় কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছে৷ দুটো দিন এখন ওদের থানা আর হাসপাতালে দৌড়োদৌড়ি করতে হবে৷ ওদের চৌখস ছেলেটা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল! এর থেকে দুঃখের আর কী হতে পারে?

টিভিতে খবর দেখছি, এমন সময় ডোরবেলের শব্দ৷ উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি, দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে৷ ওর সঙ্গে সমবয়সি একটা মেয়েও রয়েছে৷ দীপঙ্কর ঘরে ঢুকে বলল, ‘আপনাকে ডিসটার্ব করলাম না তো?’

বললাম, ‘বিন্দুমাত্র না৷ বলো, তখন কী বলতে চেয়েছিলে?’

‘আগে ইন্দিরার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই৷ আমাদের ক্লাসমেট৷ এর বাবাকে আপনি হয়তো চেনেন৷ সুনির্মল বাগচি, এমপি৷ ইন্দিরাও আপনাকে কিছু বলতে চায়৷’

সুনির্মল বাগচি রুলিং পার্টির এমপি৷ প্রায়ই উনি আমাদের কাগজের অফিসে আসেন৷ তাঁকে বিলক্ষণ চিনি৷ কথাটা বলেই দুজন ঘরে ঢুকে সোফায় বসে পড়ল৷ তখনই লক্ষ করলাম, ইন্দিরার চোখ-মুখ ফোলা৷ সম্ভবত খুব কান্নাকাটি করেছে৷ দীপঙ্কর বলল, ‘কিংশুক স্যারের সামনে তখন আমি কিছু বলতে চাইনি৷ কেননা, উনি প্রিন্সিপাল স্যারের খুব ক্লোজ৷ আমরা চাই না, যা বলতে এসেছি, তা প্রিন্সিপাল স্যারের কানে যাক৷’

‘এত ইতস্তত কোরো না৷ আমরা জার্নালিস্ট৷ আমাদের বাঁ হাতও জানতে পারে না, ডান হাত কী করছে৷’

‘থ্যাংক ইউ স্যার৷ অর্জুনের মা আমাকে বলছিলেন, আপনি গোয়েন্দাগিরিও করেন৷ তাই, কিছু জানানোর আগে আপনাকে একটা প্রশ্ন করি৷ অর্জুনের মৃত্যুর কারণটা কী, আপনি কি কিছু আন্দাজ করেছেন?’

‘ডেডবডি দেখে মনে হল, পয়েজন৷ তবে কী ধরনের পয়েজন, ফরেনসিক রিপোর্ট না দেখে বলতে পারব না৷’

কথাটা শুনে দীপঙ্কর আর ইন্দিরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল৷ তারপর ইন্দিরা বলল, ‘আপনি কি জানেন, অর্জুনের মৃত্যুটা সুইসাইড বলে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে?’

এটা আমার কাছে একটা খবর! চেষ্টা করলেই কি সুইসাইড বলে চালানো যাবে নাকি? কোনো অপরাধ চাপা দেওয়া যায় না৷ ক্রাইম নেভার পেইস৷ কিন্তু, নিজের মনোভাব ব্যক্ত না করে প্রশ্ন করলাম, ‘চেষ্টাটা কে করছেন, ইন্দিরা?’

‘প্রিন্সিপাল স্যার৷ উনি নাকি চান না, স্কুলের বদনাম হোক৷ কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, সত্যটাকে উনি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করবেন কেন? অর্জুনকে উনি ড্রাগ অ্যাডিক্ট বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন৷ শুনলাম, উনি পুলিশকে এমন কথা বলেছেন৷ দিস ইজ আটারলি লাই৷ ফ্যাক্ট রিমেইন্স, একমাত্র অর্জুনই চেষ্টা করেছিল, স্কুলের ক্যাম্পাসকে ড্রাগ ফ্রি করার৷ এ নিয়ে ডেপুটেশনেও গিয়েছিল প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে৷ ক্যাম্পাসে যারা ড্রাগ বিক্রি করে, তাদের একবার ও তাড়িয়েও দিয়েছিল৷ আমরা তখন ওর সঙ্গে ছিলাম৷’

‘ক্যাম্পাসে কারা ড্রাগ বিক্রি করে, তোমরা জানো?’

এবার দীপঙ্কর বলল, ‘ফোর্থ ক্লাস একজন স্টাফ ইনভলভড৷ তার কোয়ার্টারে ড্রাগ কিনতে পাওয়া যায়, নাম আফজল৷ সে-ই রাতে প্রয়োজন হলে, ঘরে ঘরে ড্রাগ সাপ্লাই দিয়ে আসে৷ ওয়ার্ডেন মিঃ শ্রীবাস্তব সবই জানেন৷ কিন্তু, ওঁকে একবার গোসাবা বাজারে ডেথ থ্রেট দেওয়া হয়েছিল৷ তারপর থেকে প্রাণের ভয়ে উনি চোখ বুজে আছেন৷’

‘এই নেশাটা স্কুলে কতদিন ধরে চলছে?’

‘বছর দু-তিনেক তো বটেই৷ আমাদের স্কুলে কয়েকজন কম্বোডিয়ান, ভিয়েতনামিজ আর নাইজিরিয়ান স্টুডেন্ট আছে৷ ওরাই প্রথম গোপনে দেশ থেকে ড্রাগ নিয়ে আসত৷ নেশাটা ওরাই ধরিয়েছে৷ তবে, এখন লোকাল সাপ্লাই অফুরন্ত৷ ড্রাগ আসে বাংলাদেশ থেকে নদীপথেও৷ স্টক রাখে লোকাল গুনস-রা৷ তিনগুণ-চারগুণ চড়া দামে তা বিক্রি করে স্টুডেন্টদের কাছে৷ স্যার, এর একটা বিহিত হওয়া দরকার৷ আপনি কিছু করুন৷’

ইন্দিরা বলল, ‘স্যার, এর আগে আরও একবার অর্জুনের উপর অ্যাটেম্পট হয়েছিল৷ ভাগ্যক্রমে ও বেঁচে যায়৷ দত্তা নদীর দিকে আমরা দু-তিনজন ঘুরতে গেছিলাম৷ আমাদের সঙ্গে প্রিন্সিপাল স্যারের মেয়ে অ্যাঞ্জেলাও ছিল৷ তখন বিকেল বিকেল৷ নৌকো থেকে দুটো লোক নেমে এসে অর্জুনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল৷ ঘটনাটা প্রিন্সিপাল স্যারকে আমরা জানিয়েও ছিলাম৷ কিন্তু উনি পুলিশে কমপ্লেন না করে আমাদেরই বকাবকি করেছিলেন৷’

‘স্কুলের কাউকে তোমাদের সন্দেহ হয়?’

‘পিংক হাউসে নির্মল ভাবনানি বলে একটা ছেলে আছে৷ যে খুব চেষ্টা করেছিল স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার হওয়ার৷ কিন্তু হতে পারেনি৷ অর্জুনকে ও সহ্যই করতে পারত না৷ স্যার, ওর বাবা খুব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল৷ সেই কারণে নির্মলকে প্রিন্সিপাল স্যার আলাদা চোখে দেখেন৷ একবার ওর ঘর থেকে ড্রাগ পাওয়া গেছিল৷ কিন্তু, প্রিন্সিপাল স্যার কোনো স্টেপ নেননি৷’

‘এই নির্মল ভাবনানিকে কি ক্যাম্পাসে পাওয়া যাবে?’

দীপঙ্কর বলল, ‘তাকে আপনি আর পাবেন না স্যার৷ ফাংশান দেখার জন্য ওর মা এসেছিলেন সুরাত থেকে৷ বিকেলেই ওকে নিয়ে, তাড়াহুড়ো করে তিনি কলকাতায় চলে গেছেন৷’

‘তোমাদের কি আর কিছু বলার আছে? তাড়াতাড়ি বলো৷ এখুনি কিংশুক স্যার আমার কাছে আসবেন৷’

শুনে ভয় পেয়ে দুজনে উঠে দাঁড়াল৷ তারপর ইন্দিরা বলল, ‘স্যার আপনি যদি ইনভেস্টিগেট করেন, তাহলে আমরা হেল্প করতে রাজি৷ কিন্তু, আবার বলছি, আমরা যে আপনার কাছে এসেছি, কিংশুক স্যার যেন তা জানতে না পারেন৷’ কথাগুলো বলেই দ্রুত পায়ে ইন্দিরারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷

পাঁচ

প্রিন্সিপাল মাইকেল সঞ্জীব পুরকায়স্থ বললেন, ‘ইট’স আ ক্লিয়ার কেস অফ সুইসাইড৷’

উনি যে এ কথা বলবেন, সেটা কাল রাতেই ইন্দিরার মুখে শুনেছি৷ যে ছেলেটা স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার-এর পুরস্কার পেতে যাচ্ছে, সে কেন খামোখা আত্মহত্যা করতে যাবে, এই প্রশ্ন আমার পালটা করা উচিত৷ কিন্তু এই পরিস্থিতিতে প্রশ্নটা করার কোনো মানে হয় না৷ লাঞ্চের পর প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসে আমাকে নিয়ে এসেছে কিংশুক৷ উনি তো ওঁর মতো করেই দুর্ঘটনার ব্যাখ্যা দেবেন৷ ঘরটা খুব সুন্দর সাজানো-গোছানো৷ একেবারে কর্পোরেট কর্তাদের অফিসের মতো৷ একদিকের দেওয়াল জুড়ে কাচের আলমারি, তাতে নানা ধরনের শিক্ষামূলক বই৷ অন্যদিকে ঝোলানো ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, ড. জাকির হোসেন, আব্দুল কালাম আজাদের মতো বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের ছবি৷ মাঝে আর-একটা ছবিও চোখে পড়ল৷ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে প্রিন্সিপাল স্যার পুরস্কার নিচ্ছেন৷ ঘরের এক কোণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ মূর্তিও দেখলাম রয়েছে৷

কথাটা বলে প্রিন্সিপাল স্যার আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ আমি ওঁর সঙ্গে সহমত কি না, বোধহয় সেটা বোঝার চেষ্টা করছেন৷ ফাঁদে পা না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলাম, ‘স্যার, পুলিশ কি একই কথা বলছে?’

‘কেসটা গোসাবা পুলিশ হ্যান্ডেল করলে কোনো সমস্যাই হত না৷ কিন্তু, এখন ওদের হাতে নেই৷ পুলিশ মিনিস্টারের এক ভাগ্নি আমাদের স্কুলে পড়ে৷ সেইসূত্রেই ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে৷ কাল রাতে মিনিস্টারের সঙ্গে আমি নিজে কথা বলেছি৷ ডিজি সাহেবের সঙ্গে কথা বলে পরে মিনিস্টার আমাকে ফোন করে বললেন, সিআইডি-র এক অফিসারকে আজ পাঠাবেন৷’

‘অর্জুন কী কারণে সুইসাইড করল বলে আপনার মনে হয়?’

‘সত্যি বলতে কী, সেটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়৷ ওর ক্লাসমেটদের কাছে শুনেছি, ইদানীং ড্রাগ অ্যাডিক্ট হয়ে পড়েছিল৷ এ নিয়ে একবার ওর শ্রীলঙ্কান রুমমেট আমার কাছে কমপ্লেনও করে৷ হয়তো ড্রাগ ওভারডোজ হয়ে গেছিল৷’

‘অর্জুন কি ক্যাম্পাসের মধ্যেই ড্রাগ নিত?’

‘নো৷ আমার স্কুলে এই ভাইসেসটা নেই৷ প্রায় একশোজন সিকিউরিটি গার্ড আছে ক্যাম্পাসে৷ স্টুডেন্টদের মধ্যে কেউ ড্রাগ নিলে, গার্ডদের কারও না কারও চোখে ধরা পড়ে যেত৷ ক্যাম্পাসের বাইরে যে তিনটে গ্রাম আছে, হয়তো লুকিয়ে সেখানে গিয়ে অর্জুন ড্রাগ নেওয়ার হ্যাবিটটা করেছিল৷’

‘ওর ড্রাগ নেওয়ার সঙ্গে সুইসাইড কী করে রিলেট করছেন, স্যার?’

শুনে সামান্য থমকালেন প্রিন্সিপাল স্যার৷ প্রশ্নটা বোধহয় আশা করেননি৷ অসহিষ্ণুু হয়েই উনি বলে উঠলেন, ‘আই ডোন্ট রিয়েলি নো৷ অ্যাডোলেসেন্ট পিরিয়ডটা খুব জটিল৷ দেখছেন তো, কত সামান্য কারণে টিনএজাররা আজকাল সুইসাইড করে৷ হয়তো ফ্যামিলি প্রবলেম হতে পারে৷ শুনেছি, অর্জুনের মা ওর বাবার সঙ্গে থাকেন না৷ ওঁদের সেপারেশন পিরিয়ড চলছে৷ এ নিয়ে অর্জুন একটা সময় খুব ডিসটার্বড ছিল৷ ওকে আমি ছেলের মতো ভালোবাসতাম৷ ও আমাকে মনের কথা খোলাখুলি বলত৷ একবার বলেওছিল, স্যার আমি হয়তো আর স্কুলে কন্টিনিউ করতে পারব না৷ আপনি এখানে এসে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, আমাদের এই স্কুলটা ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য৷’

‘কেমন ছিল অর্জুন ছেলেটা?’

‘সত্যি বলতে কী, এতদিন টিচিং প্রোফেশনে রয়েছি, অথচ অর্জুনের মতো একজন অলরাউন্ড ট্যালেন্ট খুব কমই চোখে পড়েছে৷ ও ডিসকন্টিনিউ করলে আমার খুব খারাপই লাগত৷ মাঝে মাঝে অবশ্য ওকে আমার হেডস্ট্রং বলে মনে হত৷ ওর কার্যকলাপে আমি প্রবলেমে পড়তাম৷ তা সত্ত্বেও, ওকে আমি পছন্দ করতাম৷ কেননা, এই একটা ছেলে আমার হাতে ছিল যে, আমার স্কুলের নাম রোশন করতে পারত৷ জানেন, অতীতে ওর নামে বেশ কয়েকজন পেরেন্ট আমার কাছে কমপ্লেন করেছেন৷ কিন্তু আমি পাত্তা দিইনি৷’

প্রিন্সিপাল স্যারের কথাগুলো শুনে আমি মনে মনে হাসছি৷ প্রথমে আমাকে খানিকটা ভয়ই দেখালেন উনি৷ এই বলে যে, পুলিশ মিনিস্টারের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ আছে৷ তদন্ত করে আমি যে সিদ্ধান্তেই পৌঁছোই না কেন, তাতে কোনো ক্ষতি হবে না৷ তারপর উনি একদম উলটো কথা বোঝানোর চেষ্টা করলেন, অর্জুন ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছিল৷ এখন বলছেন, রেখার সঙ্গে চঞ্চলের সম্পর্কটা খারাপ৷ সেই কারণে অর্জুন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল৷ কাল অবশ্য দুজনকে দেখে আমার মনে হয়নি, ওরা সেপারেশনে আছে৷ তবুও রেখার সঙ্গে একবার কথা বলে সত্যি-মিথ্যে যাচাই করে নিতে হবে৷

কলকাতা থেকে গোসাবার দূরত্ব একশো মাইলের বেশি হবে না৷ অথচ কত পিছিয়ে রয়েছে এই অঞ্চলটা৷ ভাগ্যিস আমি কাল এসেছিলাম৷ জোর করেই অর্জুনের ডেডবডিটা পাঠিয়েছিলাম ফরেনসিক তদন্তের জন্য৷ না হলে গোসাবা হাসপাতালেই পোস্ট মর্টেম করে, আত্মহত্যার ঘটনা বলে, পুড়িয়ে দেওয়া হত মৃতদেহটাকে৷ কিংশুক কাল বলছিল, এইসব অঞ্চলে কেউ মারা গেলে, ডাক্তারের সার্টিফিকেট অথবা পঞ্চায়েত প্রধানের সম্মতি পেলেই দাহ করা যায়৷ অর্থাৎ কেউ যদি খুন করে, কাউকে দাহ করতে চায়, এক ঘণ্টার মধ্যে দুষ্কর্মটি সেরে ফেলতে পারে৷ হাসপাতাল ছাড়া এখানে এমবিবিএস ডাক্তারও নেই৷ গ্রামে গ্রামে সব কোয়াক ডাক্তারে ভর্তি৷ খেয়াঘাটে কাল এমনই একজন ডাক্তারকে গ্রামবাসীরা ডেকে এনেছিল৷ ডেডবডি পরীক্ষা করে তিনি রায় দিয়েছিলেন, হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে৷

প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে বেরিয়ে এলাম৷ মনে হল, ভদ্রলোক একটা অদ্ভুত সমস্যার মধ্যে পড়েছেন৷ তাঁর এক প্রিয় ছাত্রের অকালবিয়োগ হয়েছে, তাতে তিনি খুবই দুঃখিত৷ এতবড়ো একজন জ্ঞানীগুণী মানুষ, তিনিও বুঝতে পারছেন, মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু তার থেকেও তিনি বেশি আতঙ্কিত স্কুলের ভাবমূর্তি নিয়ে৷ কোনো মূল্যেই সেটা নষ্ট করতে তিনি রাজি নন৷ সম্ভবত, অভিভাবকরা ওঁর সঙ্গে একপ্রস্থ কথা বলে গেছেন৷ সেই কারণে প্রিন্সিপাল স্যার আরও বেশি করে বোঝাতে চাইছেন, অর্জুনের মৃত্যুর জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই দায়ী নয়৷

প্রিন্সিপাল স্যারের অফিস রুম থেকে বেরিয়েই কিংশুক বলল, ‘চল কালকেতু, পুরো ক্যাম্পাসটা তোকে ঘুরিয়ে দেখাই৷ দেখলে বুঝতে পারবি, ইংলিশ পাবলিক স্কুলগুলো থেকে আমাদের ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোনো অংশে কম না৷ সকালে তুই কুয়ালালামপুরের গার্ডেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কথা তুলেছিলি৷ আমাদের ক্যাম্পাস দেখলে তোর গর্ব হবে৷’

বছর চারেক আগে বব হাউটন যখন ইন্ডিয়ান ফুটবল টিমের কোচ ছিলেন, তখন মারডেকা টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়েছিলেন৷ আমি খবর করার জন্য সেবার কুয়ালালামপুরে গেছিলাম৷ অর্গানাইজাররা ইন্ডিয়ান টিমের প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করেছিলেন ওই গার্ডেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মাঠে৷ আজ সকালে হঠাৎ মনে পড়ায় ওই স্কুলের খুব প্রশংসা করেছিলাম কিংশুকের কাছে৷ মনে হয়, ও হজম করতে পারেনি৷ বেলা আড়াইটায় চড়া রোদ্দুরের মধ্যে গাড়িতে তুলে ও আমাকে ক্যাম্পাসে ঘোরাতে লাগল৷ দয়াপুরে দত্তা নদীর ধার থেকে হেড়োভাঙার ঘন জঙ্গল৷ প্রায় দুশো একর জমির উপর স্কুল৷ এক চক্কর মারতেই চক্ষু চড়কগাছ৷ নাহ, সত্যি গর্ব করার মতো একটা স্কুল৷ নদীর পাশ দিয়ে ইটের পাঁচফুট গাঁথনির উপর লোহার রেলিং৷ পাশ দিয়ে পিচ বাঁধানো রাস্তা৷ সবুজের মাঝে স্কুলের অনেকগুলো বিল্ডিং, হোস্টেল, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, অফিস, স্টাফ কোয়ার্টার্স ছাড়াও কী নেই! দুটো ফুটবল মাঠ, ঘাস খুব মসৃণভাবে ছাঁটা৷ একটাতে তিন-চার হাজার আসনের গ্যালারিও আছে৷ ইন্ডোর হল, তাতে সব ধরনের ইন্ডোর গেমস খেলার ব্যবস্থা রয়েছে৷ পাশেই মেডিকেল সেন্টার আর স্পোর্টস শপ৷ এটিএম ব্যাংক, এসটিডি বুথ, বেশ কয়েকটা ক্যাফেটেরিয়া, শপিং সেন্টার৷ সবথেকে ভালো লাগল অপেরা হাউস দেখে৷ এটা বিরাট একটা থিয়েটার হল-এর মতো৷ চারদিকে সুন্দর সাজানো বাগান৷ এতদিন জানতাম, সুন্দরবন অঞ্চলের সবথেকে বড়ো সমস্যা দুটো৷ পানীয় জল আর বিদ্যুৎ৷ সেটা এরা মেটায় কী করে? প্রশ্নটা করতেই কিংশুক বলল, ‘আমাদের কোনো প্রবলেম নেই৷ স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ড-এর সঙ্গে আমাদের আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে৷ অন্য কোথাও কারেন্ট থাকুক বা না থাকুক, আমাদের কখনও যাবে না৷ তা ছাড়া ইমারজেন্সিতে জেনারেটর চালানো হয়৷ আর জলের কথা বলছিস? নদীর লোনা জল পিউরিফাই করার জন্য মেশিন আছে৷’

কথাগুলো বলতে বলতেই গাড়ি থামাল কিংশুক৷ বলল, ‘চল, ফাদার উইলির সঙ্গে তোর আলাপ করিয়ে দিই৷ উনি তোর লাইনের লোক৷ স্কটল্যান্ডের সেলটিক ক্লাবের হয়ে একটা সময় স্কটিশ লিগ খেলেছেন৷ ফিজিক্স পড়ানো ছাড়াও, উনি আমাদের গেমস উইংটা দেখেন৷’

ফুটবল মাঠের চারপাশে চারশো মিটার ইট রঙের সিন্থেটিক টার্ফ৷ একপ্রান্তে কয়েকজন ছেলে-মেয়েকে প্র্যাকটিস করাচ্ছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক বিদেশি৷ একমাথা সাদা চুল, গায়ের রং লাল৷ তাঁর কাছে নিয়ে গিয়ে কিংশুক আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল৷ হ্যান্ডশেক করে ফাদার উইলি বললেন, ‘আপনার কথা মাইকেলের মুখে শুনেছি৷ দেখা হয়ে ভালো লাগল৷’

বললাম, ‘এখানে যে সিন্থেটিক টার্ফ আছে, জানতামই না৷’

‘প্রতি বছর ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড মিটে আমাদের ছেলে-মেয়ে পাঠাতে হয়৷ সিন্থেটিক টার্ফে প্র্যাকটিস করে না গেলে ওখানে ভালো রেজাল্ট করা মুশকিল৷ তাই বছর দুয়েক আগে আমিই ইনিসিয়েটিভ নিয়ে টার্ফ বসিয়েছি৷ এবার নভেম্বরে মিট হবে চিলির সান্তিয়াগোতে৷ ভেবেছিলাম, মেডেল পাব৷ কিন্তু, কাল এমন একটা ঘটনা ঘটল, আমার সব উদ্যম নষ্ট হয়ে গেল৷’

‘আপনি কি অর্জুন লাহিড়ির মৃত্যুর কথা বলছেন?’

‘অফকোর্স৷ হোয়াট আ গ্রেট লস! ছেলেটা হান্ড্রেড মিটার রেস দৌড়চ্ছিল টেন সেকেন্ড ফ্র্যাকশনে৷ ওকে নিয়ে যেতে পারলে ডেফিনিটলি মেডেল পেতাম৷’

খানিকটা দূরে কিংশুক ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কথা বলছে৷ ফাদার উইলির সঙ্গে কথা বললে কিছু সূত্র পাওয়া যেতে পারে৷ সুযোগটা নিয়ে আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘অর্জুনের মৃত্যুটা কি আপনার স্বাভাবিক বলে মনে হয়?’

ফাদার উইলি বললেন, ‘অফকোর্স নট৷ কাল সকালে ওকে জিম-এ দেখতে না পেয়ে আমার সন্দেহ হয়েছিল৷ মনে হয়েছিল, এটা গত পরশু দিনের ঘটনার রেশ৷ যা ভয় পেয়েছিলাম, সেটাই ঘটে গেল৷’

‘কী ঘটেছিল গত পরশু দিন?’

‘মিঃ ন্যান্ডি, এই স্কুলের বাইরের দিকে যতটা চাকচিক্য, ভিতরটা ততই অন্ধকার৷ ডিসিপ্লিনের কোনো বালাই নেই৷ স্কুলটা দেখে কি আপনার মনে হয়, এটা একটা বেটিং ডেন? হাজার হাজার টাকার বেটিংয়ে স্টুডেন্টরা ইনভলভড? গত সপ্তাহে হারারেতে ইন্ডিয়ার ওয়ান ডে ম্যাচের সিরিজ ছিল জিম্বাবোয়ের সঙ্গে৷ সেই ম্যাচগুলো নিয়ে বেটিং৷ নির্মল ভাবনানি বলে একজন স্টুডেন্ট নাকি বেটিংয়ে লাখ টাকা হেরেছিল৷ টাকাটা দিতে না পারায় হোস্টেলে এসে ছেলেটাকে বেটিং সিন্ডিকেটের দুজন বুকি ভয় দেখায়৷ সেই খবরটা শুনে অর্জুন বুকিদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছিল৷ তখনই বুকিরা ওকে থ্রেট করে, মেরে ফেলবে৷’

‘এখানে বেটিং সিন্ডিকেট কোত্থেকে অপারেট করে?’

‘গোসাবা থেকে আসার সময় নদীর ধারে দেখবেন একটা লজ আছে৷ তার নাম গোধূলি৷ ওখানে ডিসকো-কাম-বার আছে৷ কলকাতা থেকে লোকে ওখানে স্ফূর্তি করতে আসে৷ বেটিং সিন্ডিকেটটা সেখান থেকেই চালায় রমজান আলি বলে একজন৷ ওরা জানে, আমাদের স্কুলের ছেলেদের হাতে প্রচুর টাকা৷ নেশাটা ধরিয়ে দিয়েছে৷’

‘কিন্তু, বাইরের লোকদের কি স্কুল ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া হয়?’

‘আটকাবেন কী করে? রোজই প্রচুর ভেন্ডার সাউথ এন্ড গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকে৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলি ওরা সাপ্লাই দিতে আসে৷ তা ছাড়া, নদীর জলে ইস্টার্ন গেটের পাড় ধসে গেছে৷ এখনও সারাই করা হয়নি৷ সেই ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে বাজারের লোকজন শর্টকাটে ক্যাম্পাসে চলে আসে৷ মাইকেলকে আমি অনেকবার বলেছি, বাইরের লোকদের এন্ট্রি বন্ধ করে দাও৷ ও কানেই দেয়নি৷’

কিংশুককে এ দিকে আসতে দেখে ফাদার উইলি চুপ করে গেলেন৷ তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে৷ গাড়িতে ওঠার পর কিংশুক জিজ্ঞেস করল, ‘প্রিন্সিপাল স্যারের নামে কি ফাদার উইলি কিছু বলছিলেন?’

বললাম, ‘তেমন কিছু না৷’

কিংশুক বলল, ‘আসলে প্রিন্সিপাল স্যারের উপর ফাদার উইলির প্রচণ্ড রাগ৷ ওঁরই প্রিন্সিপাল হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু সিঙ্গাপুর থেকে প্রিন্সিপাল স্যার এসে এই স্কুলে জয়েন করার পর ফাদার উইলির নামটা বাতিল হয়ে যায়৷ সেই রাগটা মাঝে মাঝেই উনি প্রকাশ করে ফেলেন৷ ওঁর কোনো কথা তুই সিরিয়াসলি নিস না৷ আর শোন, একটা কথা তোকে বলতেই ভুলে গেছি৷ আজ তুই আমার ওখানে ডিনার করবি৷ প্রিয়া কিন্তু কোমর বেঁধে তোর জন্য দুপুর থেকে রান্না করছে৷’

ছয়

বেলা পাঁচটার সময় গেস্ট হাউসে ঢুকে দেখি, রিসেপশনে দাঁড়িয়ে আছে সৌম্য ঠাকুর৷ চোখাচোখি হতেই একগাল হেসে ও বলল, ‘আমি শুনেছি, আপনি এখানে এসেছেন৷ এক্ষুনি রিসেপশনে আপনার খোঁজ করছিলাম৷ আপনি কোন ঘরে আছেন কালকেতুদা?’

বললাম, ‘বারো নম্বরে৷ তুমি?’

‘ঠিক আপনার উলটো দিকে৷ চোদ্দো নম্বরে৷’

‘তুমি তো যাদবপুর থানায় ছিলে৷ সিআইডি-তে বদলি হলে কবে?’

‘ডিজি সাহেব নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে৷ মাস দু-এক হল, উনি আমাকে সিআইডি-তে নিয়ে গেছেন৷’

‘তুমিই কি অর্জুন লাহিড়ির কেসটার ইনভেস্টিগেশন করতে এসেছ?’

‘হ্যাঁ কালকেতুদা৷ চলুন, আপনার ঘরে গিয়ে একটু বসি৷ আপনার কাছ থেকে জেনে নিই, কোত্থেকে শুরু করব৷ ডিজি সাহেব বলে দিয়েছেন, ইনভেস্টিগেশনে যেন কোনো ফাঁক না থাকে৷ এই স্কুলের সঙ্গে অনেক ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোক ইনভলভড৷ তাই সাবধান করে দিয়েছেন৷’

‘চলো তা হলে৷’

করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা দুজন বারো নম্বর রুমের দিকে এগোলাম৷ গতকাল বিকেলে এই সময়টায় এই করিডর অভিভাবক আর ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়ে গমগম করছিল৷ আজ একেবারে ফাঁকা৷ সৌম্য ঠাকুর তদন্ত করতে আসায় আমার খানিকটা সুবিধেই হল৷ ওকে আমি বছর দু-এক ধরে চিনি৷ পুলিশ ফোর্সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুদীশ নাগ যখন যাদবপুর থানার ওসি ছিল, তখন এই সৌম্য ছিল এসআই৷ বয়স তিরিশের কাছাকাছি৷ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরে আর পরিশ্রম করতে পারে৷ মাসখানেক আগে সুদীশ সিঙ্গাপুরে ইউনিসেফ-এর কী একটা ট্রেনিং নিতে চলে যাওয়ার পর সৌম্য তিনটে কেসে আমাকে খুব সাহায্য করেছিল৷ তার মধ্যে গলফ গার্ডেন্সে একটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং কিডন্যাপিংয়ের কেস৷ সুদীশ আমার সম্পর্কে ওকে কী বলে গেছে, কে জানে? সৌম্য আমার অন্ধ ভক্ত হয়ে গেছে৷

ঘরে ঢুকে সোফায় বসে সৌম্য বলল, ‘এখানে আসার আগে আজ সকালে আমি একবার এনআরএস হসপিটালে লাশ দেখতে গেছিলাম৷ বডিতে কোনো এক্সটারনাল ইনজুরির চিহ্ন নেই৷ গোসাবা পুলিশ বলছে, ছেলেটা নাকি প্রচুর ড্রাগ কনজিউম করার কারণেই মারা গেছে৷ কিন্তু, শুনে আমার বিশ্বাস হয়নি৷ মৃত্যুর কারণ যদি ড্রাগই হত, তা হলে ডেডবডিটা ডিঙিতে ভাসিয়ে দিল কে?’

বললাম, ‘তুমি ঠিকই ধরেছ৷ আমার ধারণা, ছেলেটাকে মার্ডার করা হয়েছে৷ কে করেছে, বা কেন করেছে, সেটাই তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে৷’

‘কালকেতুদা, যে ডিঙিতে ছেলেটার ডেডবডি পাওয়া গেছে, তার মালিকের নাকি হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না৷’

‘কী বলছ তুমি? সেটা কী করে হয়?’

‘আসার আগে আমি গোসাবা থানায় গেছিলাম৷ পুলিশ ফোর্সে কারা আজকাল ঢুকছেন দেখুন, আইও বলল, এই অঞ্চলে নদীর উপর প্রচুর আন-অথরাইজড নৌকো-ডিঙি ঘুরে বেড়ায়৷ লোকাল লোকেরা খুব ভোরে মাছ ধরতে বেরোয়, সেগুলো নিয়ে৷ মালিককে ধরা খুব কঠিন৷ আইও কী ক্যালাস দেখুন, ডিঙিটার ছবি পর্যন্ত তুলে রাখেনি৷’

ছবির প্রসঙ্গ ওঠায় আমার কিংশুকের কথা মনে পড়ল৷ কাল টাইগার মোড় খেয়াঘাটে ও কিছু ছবি তুলেছিল৷ সেই ছবি সৌম্যকে হেল্প করতে পারে৷ তাই বললাম, ‘ডিঙির ছবি তুমি পাবে৷ আমার এক বন্ধু কিংশুক, এখানকার টিচার৷ সে তুলেছে৷ সে যাক, গোসাবা থানা থেকে আর কী তুমি জানতে পারলে?’

‘ভেরি ইন্টারেস্টিং একটা পয়েন্ট৷ গোসাবা থানায় সুন্দরবনের একটা ম্যাপ টাঙানো ছিল৷ সেটা দেখতে দেখতে পয়েন্টটা আমার মাথায় এল৷ স্কুলের ধারে দত্তা নদী থেকে কেউ যদি ডেডবডি ভাসিয়ে দিয়ে থাকে, তাহলে আপনাআপনি কখনই ডিঙিটা গোমতী নদীর পাখিরালার ঘাটে পৌঁছোত না৷ এখানে নদীতে ছয় ঘণ্টা অন্তর জোয়ার-ভাটা হয়৷ জলের টান বিচার করলে ডিঙিটার দোবাঁকির দিকে চলে যাওয়ার কথা৷ কী করে সেটা পাখিরালায় গেল? নিশ্চয়ই কেউ ডিঙি চালিয়ে গোমতী নদীতে ছেড়ে দিয়ে গেছে৷ যাতে ভাসতে ভাসতে ডিঙিটা আননোন ডেস্টিনেশনে চলে যায়৷ কোনো খাঁড়ির ভিতর ঢুকে গেলে চার-পাঁচ দিনের আগে কারও চোখেই পড়ত না৷ এই কারণে খুব জরুরি, ডিঙির মালিককে খুঁজে বের করা৷ আমরা যদি ধরেই নিই, ছেলেটাকে খুন করা হয়েছে, তাহলে খুনির সঙ্গে আরও কেউ আছে৷ এটা একজনের কাজ নয়৷’

এই পয়েন্টটা আমার মাথায় আসেনি৷ মনে মনে সৌম্যর প্রশংসা করে বললাম, ‘খুব ভালো অবজারভেশন৷ আমি তো ইনভেস্টিগেশন শুরুই করতে পারছি না, ফরেনসিক রিপোর্টটা না পাওয়া পর্যন্ত৷ ওটা কে করছেন, তুমি কি তা জানো?’

‘ডক্টর অভিনব মহান্তি৷ আপনি ওঁকে চেনেন৷ কাল সকালের মধ্যে মনে হয় রিপোর্ট তৈরি হয়ে যাবে৷ আমি ওঁর কন্টাক্ট নাম্বারটা নিয়ে এসেছি৷ এখান থেকেই জেনে নেওয়া যাবে৷’

গত দু-দিনে দয়াপুরে এসে যা দেখেছি বা শুনেছি, তা নিয়ে সৌম্যর সঙ্গে আলোচনা করলাম৷ শুনে সৌম্য বলল, ‘ড্রাগ সিন্ডিকেটের আফজলকে ধরে কাল ভালো করে রগড়াব৷ কোস্টাল গার্ডদের থানায় আমার এক বন্ধুর মুখে শুনেছি, এখান দিয়ে অনবরত বাংলাদেশি জাহাজ কলকাতা পোর্টের দিকে যাওয়া-আসা করে৷ ওদের মারফত ড্রাগ এদিকে আসে৷ আর গোধূলি গেস্ট হাউসের রমজান আলি পুরোনো পাপী৷ আগে গড়িয়ায় ওর ঠেক ছিল৷ পুলিশের তাড়া খেয়ে এখন সোনারপুরে চলে গেছে৷ শুনেছিলাম, ওখানে প্রোমোটারি করছে৷ এদিকে যে বেটিং সিন্ডিকেট চালায়, জানতাম না৷’

বললাম, ‘একটা ইম্পরট্যান্ট কাজ বাকি রয়ে গেছে সৌম্য৷ ব্লু হাউস হোস্টেলের যে রুমে অর্জুন লাহিড়ি থাকত, সেটা তল্লাশি করা হয়নি৷ অ্যাজ ইট ইজ লকড অবস্থায় রয়েছে৷ আমি একবার ওই ঘরে যেতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু কিংশুক আগ্রহ দেখায়নি৷ বলেছিল, প্রিন্সিপাল স্যারের পার্মিশন দরকার৷’

সৌম্য হঠাৎ অধৈর্য হয়ে বলল, ‘মাই ফুট! পার্মিশনের আমি তোয়াক্কা করি না৷ চলুন, এখনই গিয়ে ওই ঘরের ছানবিন করি৷’

সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে সৌম্য রিসেপশনে ফোন করে হোস্টেলের ওয়ার্ডেন মিঃ শ্রীবাস্তবকে চাইল৷ মিনিটখানেক ফোনটা ধরে থাকার পর, নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আমি এখখুনি আপনাদের ব্লু হাউসের হোস্টেলে যেতে চাই৷ আপনি ওখানে আমার জন্য ওয়েট করবেন৷’

ও প্রান্তে মিঃ শ্রীবাস্তব সম্ভবত গাঁইগুঁই করছিলেন৷ সৌম্য খুব রাগি গলায় বলল, ‘যা বলছি, তাই করুন৷ না হলে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অপরাধে আপনার এগেনস্টে আমাকে স্টেপ নিতে হবে৷’

মিনিট কুড়ি পর সৌম্য আর আমি যখন অর্জুন লাহিড়ির ঘরে ঢুকলাম, তখন একটা কটু গন্ধ নাকে এল৷ দশ বাই বারো ফুটের ঘর৷ দু-পাশে জানলা লাগোয়া দুটো বেড৷ একটাতে টানটান হালকা নীল রঙের বেডকভার পাতা৷ আগেই শুনেছি, অর্জুনের রুমমেট কলম্বোতে চলে যাওয়ায় সেদিন হোস্টেলে ছিল না৷ অন্য বিছানার চাদরটা কোঁচকানো৷ অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, কেউ শুয়েছিল৷ তার মানে, এটাই অর্জুনের বেড৷ ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, বেডকভারটা নেই৷ বালিশের কাছাকাছি একটা জায়গায় বেডশিটে হালকা হলদে রঙের দাগ৷ হয় অর্জুন বমি করেছিল, নয়তো ওর মুখ দিয়ে লালা ঝরেছিল৷ বেডের পাশেই পড়ার টেবল৷ তাতে ল্যাপটপ খোলা অবস্থায় পড়ে আছে৷

ঘরে আমাদের সঙ্গে আর রয়েছেন ওয়ার্ডেন মিঃ শ্রীবাস্তব৷ সৌম্য বিছানা উলটেপালটে তল্লাশি চালাতে লাগল৷ গদিটা তুলেই পলিথিনের একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করে এনে বলল, ‘এই দেখুন কালকেতুদা, ড্রাগের প্যাকেট৷ বাপ-মা কত আশা করে ছেলেকে এত বড়ো স্কুলে পাঠিয়েছে৷ আর ছেলে এসে এখানে হেরোইনের নেশা করছে! এখন তো দেখছি, গোসাবা থানার আইও ঠিকই বলেছিল৷’

বললাম, ‘আমার তা মনে হয় না৷’

শুনে সৌম্য একটু অবাক হয়েই আমাদের দিকে তাকাল৷ ওর সন্দেহ নিরসনের জন্য বললাম, ‘অনেক সময় আমরা সাধারণ চোখে যা দেখি, বাস্তবের সঙ্গে তার অনেক পার্থক্য থাকে৷ অর্জুনের বন্ধুদের কেউ আমায় বলেনি, ও ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছিল৷ আমার মনে হয়, হেরোইনের প্যাকেটটা বিছানার তলায় ইচ্ছে করেই রেখে দেওয়া হয়েছে, পারফেক্ট অ্যালিবাই তৈরি করার জন্য৷’

সৌম্য জিগ্যেস করল, ‘ঘরে ঢোকার পরই একটা কটু গন্ধ পেলেন কালকেতুদা?’

বললাম, ‘পেয়েছি৷ ওটা সম্ভবত বমির গন্ধ৷ দরজা-জানলা বন্ধ ছিল বলে মিলিয়ে যায়নি৷ তুমি কি লক্ষ করেছ, মেঝেতে বমির দাগ রয়েছে?’

অর্জুনের ওয়ারড্রোব খুলে তন্নতন্ন করে সৌম্য খুঁজতে লাগল৷ জামা-প্যান্ট আর স্পোর্টসের সরঞ্জাম ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না৷ আমি র‍্যাকের বইপত্তর নামিয়ে উলটেপালটে দেখতে লাগলাম৷ একটা বইতে দেখলাম, লেখা আছে, ‘টু অর্জুন, উইথ লাভ, অ্যাঞ্জেলা৷’ বইটার নাম ‘আ নাইট ইন এ কল সেন্টার’৷ অ্যাঞ্জেলা নামটা কোথাও শুনেছি বলে মনে হল৷ হ্যাঁ, মেয়েটার কথা বলেছিল ইন্দিরা৷ অর্জুনের সঙ্গে কোথায় যেন ঘুরতে গেছিল৷ তখন কে বা কারা অর্জুনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ এই অ্যাঞ্জেলা মেয়েটা কি অর্জুনের গার্লফ্রেন্ড? সে কি এই স্কুলের ছাত্রী?

তল্লাশি শেষ হয়ে যাওয়ার পর ঘরে আমি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ গত পরশু রাতে এই ঘরে যা ঘটতে পারে, মনে মনে তা কল্পনা করতে লাগলাম৷ কিংশুকের কথামতো এগজিবিশন হল থেকে অর্জুন রাত সাড়ে দশটায় বেরিয়ে এসেছিল৷ সিকিউরিটি গার্ডের বক্তব্য অনুযায়ী, ও সোয়া এগারোটায় পিছনের ছোট গেট দিয়ে হোস্টেলে ঢোকে৷ এগজিবিশন হল থেকে হোস্টেলে পৌঁছোনোর জন্য ওর দশ মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়৷ তাহলে মাঝের পঁয়তিরিশ মিনিট ও কোথায় ছিল?

এগজিবিশন হল থেকে বেরোনোর সময় কি ওর সঙ্গে আরও কেউ ছিল? থাকলে সে বা তারা নিশ্চয়ই স্কুলেরই কেউ৷ এরপর অর্জুন যে ঘরে এসেছিল, সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই৷ ল্যাপটপ-এর ডালা খোলা অবস্থায় রয়েছে৷ তার মানে, ও কিছু লিখে রাখছিল অথবা কারও সঙ্গে চ্যাট করছিল৷ সেই মানুষটি কে হতে পারে? মিঃ শ্রীবাস্তব বলছিলেন, রাতে কোনো রুমের দরজাই বন্ধ থাকে না৷ তাহলে ঘরের দরজা বন্ধ করল কে? অর্জুন শুয়ে পড়ার পর কি কেউ ওর ঘরে এসে ঢুকেছিলেন? আরও প্রশ্ন, কী এমন ওর পেটে গিয়েছিল, যাতে অর্জুনকে বমি করতে হয়েছিল?

সাত

কিংশুকের বউ প্রিয়াকে আমি বহুদিন ধরে চিনি৷ কলেজ লাইফে ওরা যখন বন্ধু ছিল, তখন থেকে৷ কিংশুক কালই কথায় কথায় বলেছিল, প্রিয়া এখন এই স্কুলের স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার অফিসার৷ চাকরিটা ও পেয়েছে, প্রিন্সিপাল স্যার এখানে আসার পর৷ কাল বিকাল থেকে প্রিয়া অন্তত বারচারেক আমাকে ফোন করেছে৷ শেষবার বলল, ‘তোর খুব ঘ্যাম হয়েছে, না রে? নাম-টাম হয়ে গেলে মানুষ সত্যিই বদলে যায়৷ কী এমন রাজকার্যে তুই ব্যস্ত যে, এত ডাকছি, তবুও আসছিস না?’

প্রিয়ার অভিমান যাতে রাগে পরিণত না হয়, সেই কারণে ওর নেমন্তন্ন রক্ষা করতে এসেছি৷ পাঁচ-ছ’বছর পরে দেখা৷ প্রিয়া বেশ মুটিয়ে গেছে৷ দেখা হতেই ও বলল, ‘আমি জানি, তুই মাছ খেতে ভালোবাসিস৷ সেই কারণে তোর জন্য আজ শুধু মাছের প্রিপারেশন৷ কিন্তু, আগেই বলে রাখি, এখানে মিঠে জলের মাছ পাওয়া যায় না৷ জেলেরা ভেটকি, পারশে আর পাঙাশ মাছ দিয়ে গেছে৷ তিনটে মাছই তোকে খেতে হবে৷’

ঠাট্টা করে বললাম, ‘আর কোনো মাছ পাওয়া যায়নি?’

‘নিয়ে এসেছিল৷ খরশুলা, দাঁতনে, গাঙ খয়রা, ভাঙন, ভোলা, ফ্যাঁসা, আড়, লোটে…সব সুন্দরবনের লোনা জলের মাছ৷ কত চাই তোর? যাক গে, এখনই খেতে বসবি, না কি খানিকক্ষণ আড্ডা মারবি? তোর গোয়েন্দাগিরির গল্প শোনার জন্য বসে আছি৷’

সবে রাত আটটা৷ দশটা-সাড়ে দশটার আগে ডিনার করার অভ্যেস আমার নেই৷ তাই বললাম, ‘এখন নয়৷ তোর বরের কী একটা লেখা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে বেরিয়েছে৷ সেটা দেখাবে বলে আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে৷’

হেসে প্রিয়া বলল, ‘এ নিয়ে বোধহয় পাঁচশো ঊনসত্তরজনকে ডেকে ডেকে ও নিজের আর্টিকেল দেখাল৷ তা হলে তোরা ড্রইং রুমে গিয়ে বোস৷ খাবারগুলো গরম করে, ডিনার টেবল সাজিয়ে, তারপর তোদের ডেকে নিচ্ছি৷’

ড্রয়িং রুমে গিয়ে ঢোকার পর কিংশুক কম্পিউটার খুলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ওয়েবসাইটে ওর আর্টিকেল দেখাতে লাগল৷ লেখাটা বিরল প্রজাতির কাঁকড়া নিয়ে৷ নাম হর্স শু ক্র্যাব৷ বাংলায় বলে রাজকাঁকড়া৷ গায়ের রং লাল, পিছন দিকে লেজের মতো আছে৷ সুন্দরবনের দক্ষিণ দিকের দ্বীপগুলোতে নাকি প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়৷ কিংশুক বলল, ‘কোর এরিয়ায় ঘন জঙ্গল৷ সাধারণ লোককে ঢুকতে দেওয়া হয় না৷ ওখানকার আইল্যান্ডসে প্রাণীজগতের এমন অনেক স্পেসিস আছে, যা এখনও ডিসকভারড হয়নি৷’

আমার মন পড়ে রয়েছে অর্জুনের ঘর থেকে আনা ল্যাপটপটার দিকে৷ যদি কোনো অজানা তথ্য উদ্ধার করা যায়, সেইদিকে৷ এই প্রজন্মের ছেলে- মেয়েরা খুব কম্পিউটার ব্যবহার করে৷ ফেসবুকে সারাক্ষণ চ্যাট করে৷ মেল মারফত মনের কথা আদানপ্রদান করে৷ কিন্তু, অর্জুনের ল্যাপটপ থেকে কোনো সূত্রই পাব না, যতক্ষণ না পাসওয়ার্ড জানতে পারব৷ সেই সমস্যার সমাধান করে দিয়ে গেছে দীপঙ্কর৷ আধঘণ্টা আগে ছেলেটা লুকিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল৷ বলল, অর্জুন বেশ কয়েকবার ওর পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করেছিল৷ শেষবারেরটা করে সপ্তাহখানেক আগে৷ দীপঙ্করই বদলে দিয়ে করেছিল, স্টুডেন্টঅফদ্যইয়ার৷ শোনার পর থেকে আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে৷ মন বলছে, এমন কোনো ক্লু পাব, যাতে খুনি ধরা পড়বে৷ ঠিক করে রেখেছি, কিংশুকের বাড়িতে ডিনার সেরে, ফিরে গিয়েই আমি ল্যাপটপটা নিয়ে বসব৷

কথায় কথায় হঠাৎ কিংশুক বলল, ‘আমাদের প্রিন্সিপাল স্যারের একটা আর্টিকেল বেরিয়েছে মায়ামির ওয়ার্ল্ড সার্পেন্টেরিয়াম ম্যাগাজিনে৷ লেখাটা কী রকম অ্যাপ্রিশিয়েটেড হয়েছে, তোকে দেখাচ্ছি৷’

চট করে ও ওয়েবসাইটটা খুলে ফেলল৷ তারপর আমাকে বোঝাতে লাগল, ‘মায়ামির এই সার্পেন্টেরিয়ামটা হচ্ছে ওয়ার্ল্ডের বেস্ট৷ ওখানকার ম্যাগাজিনে একটা লেখা বেরোনো মানে, দারুণ প্রেস্টিজের ব্যাপার৷ আমাদের স্যার হলেন প্রথম ইন্ডিয়ান, যাঁর লেখা ওখানে বেরিয়েছে৷’

লেখার ভিতর কয়েকটা সাপের ছবি আছে৷ বুঝতে না পেরে জিগ্যেস করলাম, ‘লেখার সাবজেক্টটা কী রে?’

‘এই সুন্দরবন অঞ্চলে ভয়ংকর এক প্রজাতির বিষধর সাপ আছে৷ তার নাম ব্যাঙ্গারাস কারুলিয়াস বা কমন ক্রেট৷ বাংলায় এর নাম কালাচ৷ প্রিন্সিপাল স্যার এই কালাচ নিয়েই গবেষণা করছেন৷’

‘এই প্রজাতির সাপ কি শুধু সুন্দরবনেই দেখা যায়?’

‘তা নয়৷ কোথাও কোথাও লোকে একে শিয়রচাঁদা বা কালচিতিও বলে৷ লেখার মাঝে ছবিটা ভালো করে লক্ষ কর৷ সাপের গায়ের রং নীলচে কালো৷ আড়াআড়ি জোড়ায় জোড়ায় চল্লিশটার মতো সাদা ডোরা দাগ আছে৷ এই সাপগুলো তিন-সাড়ে তিন ফুট লম্বা হয়৷ ফণা তুলতে পারে না৷ খুব নিরীহ ধরনের, মূলত নিশাচর৷ রাত্তিরবেলাতেই এরা বেরোয়৷’

লেখার মধ্যে আর-এক ছবিতে একজন আদিবাসী লোক কালচে দাগ গলায় ঝুলিয়ে আছে৷ তাকে দেখিয়ে কিংশুক বলল, ‘এই লোকটার নাম জীয়ন মুর্মু৷ কাছেই জেমসপুর বলে একটা গ্রাম আছে৷ সেখানে বেদেপাড়ায় থাকে৷ এ লোকটা সাপ ধরে বেড়ায়৷ সুন্দরবনে প্রায় বাইশ ধরনের সাপ দেখতে পাওয়া যায়৷ তার মধ্যে ছয় প্রজাতি বিষধর৷ এই জীবন মুর্মু ডিঙি নিয়ে গ্রামে গ্রামে, জলে-জঙ্গলে ঘুরে, সাপ ধরে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে বিক্রি করে৷’

‘তোদের প্রিন্সিপাল স্যার সাপ পোষেন না কি? সাপ পোষা কিন্তু এখন ইল্লিগ্যাল৷’

‘স্যার ওঁর ল্যাবরেটরির জন্য কেনেন৷ উনি একটা ইউনিক রিসার্চ করছেন৷ বিষয়টা কী, দুটো ভিন্ন প্রজাতির সাপের মধ্যে যৌন মিলন ঘটিয়ে নতুন প্রজাতির সাপের জন্ম দেওয়া৷ যেমন টাইগার আর লায়ন মিলিয়ে হয়েছে টাইগন৷ তেমনই চন্দ্রবোড়া আর কালাচ মিলিয়ে চন্দ্রকালা টাইপের কিছু৷ ওয়ার্ল্ডের কোনো হারপেটোলজিস্ট নাকি এই চেষ্টায় সফল হননি৷ প্রিন্সিপাল স্যারের বাংলোতে যদি যাস, তা হলে ল্যাব-এ গোটা তিরিশ নানা প্রজাতির সাপ দেখতে পাবি৷’

‘প্রিন্সিপাল স্যারের এই আর্টিকেলটার একটা প্রিন্ট আউট দিতে পারবি?’

কিংশুক খুব খুশি হয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই৷ তুই ডাইনিং টেবলে বসে প্রিয়ার সঙ্গে খানিকটা সময় আড্ডা মার৷ আমি এখুনি প্রিন্ট করিয়ে আসছি৷’

ডাইনিং টেবলে বসে আমি আর প্রিয়া গল্প করতে লাগলাম৷ দেখলাম, ও আমার রহস্যভেদের অনেক কাহিনি পড়েছে৷ কথায় কথায় হঠাৎ ও বলল, ‘অর্জুনের মিস্টিরিয়াস ডেথ-এর কারণটা কী রে, জানিস?’

বললাম, ‘এখনও কোনো ক্লু পাইনি৷’

‘ইস, ওর বন্ধুগুলোর দিকে আমি তাকাতে পারছি না রে৷ বিশেষ করে অ্যাঞ্জেলা৷ মেয়েটা খুব ভেঙে পড়েছে রে৷’

বললাম, ‘অর্জুনের সঙ্গে কি ওই মেয়েটার অ্যাফেয়ার চলছিল?’

‘হ্যাঁ৷ ক্লাস ফাইভ থেকে ওরা একসঙ্গে পড়ছে৷ বন্ধুত্ব থেকে প্রেম৷ আমি এমন একটা ডিপার্টমেন্টে কাজ করি, স্টুডেন্টদের সববাইকে চিনি৷ বিশেষ করে, উঁচু ক্লাসের স্টুডেন্টদের৷ কার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক, সব জানি৷ পড়ায়, খেলায়, বাজনায় অর্জুনের মতো ছেলে ক্যাম্পাসে ছিল না৷ ফলে অনেক মেয়েই ওকে চাইত৷’

‘অ্যাঞ্জেলা মেয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড কী?’

‘ও প্রিন্সিপাল সাহেবের মেয়ে৷ ভারী মিষ্টি মেয়েটা৷ আমি ওদের প্রেমের ব্যাপারটা জানতাম৷’

‘তোর সঙ্গে অর্জুনের শেষ কবে দেখা হয়েছিল রে?’

‘কাল বিকেলে৷ আমার অফিসে খুব মনমরা অবস্থায় এসেছিল৷ প্রিন্সিপাল স্যারের স্ত্রী বেটসি নাকি ওকে যাচ্ছেতাই অপমান করেছিলেন৷ কারণটা কী, জানতে চেয়েছিলাম৷ কিছুতেই অর্জুন বলতে চাইল না৷ বেটসি নাকি ওকে এমনও ভয় দেখান, ওর লাইফ হেল করে দেবেন৷ এমন ফলস কেসে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন, যাতে ও পাঁচ-সাত বছরের আগে জেল থেকে বেরোতে না পারে৷ বলতে বলতে অর্জুন কেঁদে ফেলেছিল৷’

আড্ডা মারার ফাঁকে হঠাৎ সৌম্যর ফোন এল৷ মোবাইল অন করতেই ও বলল, ‘এইমাত্তর ডাঃ মহান্তিকে ফোন করেছিলাম কালকেতুদা৷ উনি ফরেনসিক রিপোর্ট সাবমিট করেছেন৷’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘ফাইন্ডিংস কী?’

‘স্নেকবাইট৷ সাপের কামড়ে অর্জুন মারা গেছে৷ ওর শরীরে নিউরোটক্সিন এফেক্ট হয়েছে৷ গোখরো, কালাচ, কেউটে, শঙ্খচূড় ধরনের কোনো সাপ ওকে কামড়েছিল৷ এই অঞ্চলে হতেই পারে৷ হয়তো কোনোভাবে সাপটা অর্জুনের ঘরে ঢুকে পড়েছিল৷’

‘ফরেনসিক রিপোর্টে টাইম অফ ডেথ সম্পর্কে কিছু আছে?’

‘স্নেকবাইটের এক ঘণ্টার মধ্যে৷ ধরুন, সেই রাত্তিরে সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে৷ আমার মনে হচ্ছে, আর ইনভেস্টিগেশনের কোনো মানে হয় না, কালকেতুদা৷ ডিজি সাহেবের সঙ্গে কথা বলে কাল সকালেই আমি ফিরে যাব ভাবছি৷ আপনিও আমার সঙ্গে ফিরে যেতে পারেন৷’

বললাম, ‘আমি কিংশুকের বাড়িতে ডিনার করতে এসেছি৷ ওর কাছ থেকে পাখিরালার খেয়াঘাটের ছবিগুলো নিয়ে যাব৷ তুমি ততক্ষণ জেগে থেকো৷ একটা কথা বলি, এত তাড়াতাড়ি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছিও না৷ আমি আসছি৷’

কথাটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারলাম, রহস্যের জাল কেটে বেরোনোর রাস্তাটা মনে হয় দেখতে পেয়েছি৷

আট

সকাল দশটার সময় কিংশুক হঠাৎ ফোন করে বলল, ‘কালকেতু, তুই কি কলকাতায় ফিরে যেতে চাস? আমাদের একটা লঞ্চ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গদখালির দিকে যাবে৷’

শুনে একটু অবাকই লাগল৷ কাল ডিনার করার সময় কিংশুক আর প্রিয়া আমাকে বারবার অনুরোধ করছিল, আরও দুটো দিন থেকে যেতে৷ আমাকে নেতি ধোপানির ঘাট পর্যন্ত ঘুরিয়ে দেখাবে৷ হঠাৎ কী হল, আমাকে কলকাতায় ফেরত পাঠানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে? অর্জুনের মৃত্যুরহস্যের খানিকটা আভাস পেয়েছি জেনেই কি ও আমাকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে বলছে? কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোর জন্য আমার এখানে থাকা দরকার অন্তত বিকেল পর্যন্ত৷ তাই বললাম, ‘আমাকে নিয়ে তুই ব্যস্ত হোস না৷ সৌম্য ঠাকুর বিকেলের দিকে কলকাতায় চলে যাবে বলছে৷ গোসাবা থানার লঞ্চ থেকে গদখালি পৌঁছে দেবে৷ ওর সঙ্গে না হয় আমি চলে যাব৷’

‘সৌম্য ঠাকুর…মানে ওই সিআইডি অফিসার? ওঁকে তুই চিনিস নাকি?’

সত্য গোপন করে বললাম, ‘না, এখানেই আলাপ হল৷’

‘ভদ্রলোক কী বলছেন রে?’

‘ওর ধারণা, সাপের কামড়ে অর্জুন মারা গেছে৷’

শুনে খুব খুশি হয়েছে মনে হল কিংশুক৷ বলল, ‘তোকে তো আগেই বলেছিলাম, স্কুল অথরিটির কোনো দোষ নেই৷’

‘সেটা ঠিক৷ কিন্তু একটা প্রশ্ন তো থেকেই যায়, ফার্স্ট ফ্লোরে অর্জুনের ঘরে সাপ পৌঁছোল কী করে?’

‘তোর কী দরকার ভাই, এইসব প্রশ্ন তোলার? পুলিশকে মাথা ঘামাতে দে৷ প্লিজ, শখের গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে আমার চাকরিটা খাস না৷ আর শোন, তুই কলকাতায় রওনা হওয়ার আগে দয়া করে একবার আমাকে ফোন করে যাস৷’

‘নিশ্চয়ই৷’ বলে ফোনটা আমি ছেড়ে দিলাম৷

কাল রাত থেকে রহস্যের জট আমার কাছে একটু একটু করে খুলতে শুরু করেছে৷ ড্রাগ, বেটিং, স্নেকবাইট নিয়ে অনেক ভেবেছি৷ রাত দশটার সময় সৌম্যর ঘরে গিয়ে ওকে কয়েকটা কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলাম৷ যে কাজগুলো পুলিশ ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব না৷ এক, ড্রাগ সেলার আফজলকে গোসাবা থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে রামধোলাই দেওয়া৷ ওর কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা, অর্জুনের বিছানার নীচে হেরোইনের প্যাকেট কে রেখেছিল? দুই, ব্লু হাউস হোস্টেল আর প্রিন্সিপাল স্যারের বাংলোর সিসিটিভির ফুটেজ খুঁটিয়ে দেখা৷ অর্জুনের মৃত্যুর রাতে সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত কারা ওই দুই বিল্ডিংয়ে গিয়েছিল, সেটা জানা৷ তিন, বেটিং সিন্ডিকেটের পান্ডা রমজান আলিকে তুলে নিয়ে গিয়ে উত্তমমধ্যম ধোলাই দেওয়া৷ ওর কাছ থেকে জানতে চাওয়া, সত্যিই ওর কোনো বুকি অর্জুনকে খুনের পিছনে আছে কি না? চার, জেমসপুরের বেদেপাড়ায় গিয়ে খোঁজ করা, লখিন্দরের ভেলা ওদের কাছ থেকে কেউ ওই রাতে কিনতে গিয়েছিল কি না৷ দীপঙ্করদের মুখে শুনেছি, অর্জুনকে যে ভেলায় তুলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোকে বলে লখিন্দরের ভেলা৷ সেগুলো শুধুমাত্তর ওই বেদেপাড়াতেই রেডিমেড কিনতে পাওয়া যায়৷

সৌম্য খুব সকালে গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে গিয়েছে৷ বেলা নটার সময় ফোন করে আমায় বলেছে, ‘আফজল আর রমজান আলিকে তুলে গোসাবা থানায় নিয়ে এসেছি৷ এখন দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে যাচ্ছি জেমসপুরের দিকে৷ ওখানে কী হল, পরে আপনাকে জানাচ্ছি৷’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘সিসিটিভির ফুটেজগুলো দেখার কি সময় পেয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ কালকেতুদা৷ আপনাকে বলতে ভুলে গেছি৷ কাল রাতেই মিঃ শ্রীবাস্তবকে ধমকে সিসিটিভি মনিটর রুমে গেছিলাম৷ রাত সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে ব্লু হাউস হোস্টেল আর প্রিন্সিপাল স্যারের বাংলোর ভিডিয়ো ফুটেজ মন দিয়ে দেখেছি৷ দুটো বিল্ডিংয়েই একজন লোককে ঢুকতে দেখা গেছিল৷ লোকটার পিঠে ক্যানভাসের লম্বা ব্যাগ একটা ছিল৷ সে প্রিন্সিপাল স্যারের বাংলো থেকে বেরিয়ে, তারপর ব্লু হাউস হোস্টেলের দিকে যায়৷ আশ্চর্যের ব্যাপার, দুটো বিল্ডিংয়ে সিকিউরিটি গার্ডরা লোকটাকে এন্ট্রি দিয়েছিল৷ তার মানে সে পরিচিত মুখ৷ আর-একটা কথা, ওই সময় ব্লু হাউস হোস্টেলের গেটের বাইরে একটা ন্যানো গাড়ি দাঁড়িয়েছিল৷ গাড়ির নাম্বার প্লেটটা আমি টুকে নিয়েছি৷’

‘ফুটেজের সিডি কি কালেক্ট করেছ?’

‘হ্যাঁ কালকেতুদা৷ আপনাকে বলি, লোকটাকে কিন্তু আমার সন্দেহজনক বলে মনে হল৷ তাই ওর ছবির একটা প্রিন্ট আউট নিয়েছি৷’

‘জেমসপুরের বেদেপাড়ায় তো যাচ্ছই৷ পারলে ছবি দেখিয়ে ওই লোকটার খোঁজ করো৷ যদি তাকে পাও, তুলে থানায় নিয়ে যাবে৷ আমি বেলা বারোটার সময় একবার গোসাবা থানায় যাব৷’

জেমসপুরে কী হল, সৌম্য এখনও আমায় কিছু জানায়নি৷ হাতে ঘণ্টাখানেক সময় আছে৷ তাই গেস্ট হাউসের রুমে বসে আমি অর্জুনের ল্যাপটপ খুলে ফেললাম৷ ওর মেল চেক করতে গিয়ে দেখি, শেষ মেসেজটা প্রিন্সিপাল স্যারের মেয়ে অ্যাঞ্জেলার৷ লিখেছে, ‘মাম্মির আচরণে তুই দুঃখ পাস না৷ কাল তোর জীবনে একটা স্মরণীয় দিন৷ তুই স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার হচ্ছিস৷ আগামীকালের কথা ভাব৷’

উত্তরে অর্জুন লিখেছে, ‘উনি আমার সঙ্গে যত দুর্ব্যবহার করুন না কেন, ওঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা অটুট থাকবে৷’

মেল-এ অর্জুনের চ্যাট যতই পড়তে লাগলাম, ততই অবাক হতে থাকলাম৷ দয়াপুরের মতো জায়গায় বসে অর্জুন মেল মারফত কত বিখ্যাত লোকের সঙ্গেই না যোগাযোগ রাখত৷ সত্যিই পৃথিবীটা কত ছোটো হয়ে গেছে৷ এই বিখ্যাত লোকেদের মধ্যে একজন হলেন উসেইন বোল্ট৷ অলিম্পিক আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্প্রিন্টার৷ বোল্টকে বোধহয় কোনো প্রশ্ন পাঠিয়েছিল অর্জুন৷ উত্তরে উনি লিখেছেন, ‘ভালো স্প্রিন্টার যদি হতে চাও, তা হলে আমাদের জ্যামাইকায় এসে গ্লেন মিলস-এর কোচিং স্কুলে ভরতি হয়ে যাও৷ যা টাইমিং পাঠিয়েছ, তা দেখে আমার মনে হচ্ছে তোমার মধ্যে সম্ভাবনা আছে৷’ আরো দুজন বিখ্যাত লোকের মেল দেখতে পেলাম৷ তার একজন হলেন নোবেল প্রাইজজয়ী জার্মান বিজ্ঞানী উরস স্টেগনথলার৷ উনি লিখেছেন, ‘স্কুলের গন্ডি পেরোনোর পর তুমি অবশ্যই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে৷’ অন্যজন সান্তিয়াগো সাম্পাওলি৷ ইনি জিসিএসই বোর্ডের চেয়ারম্যান৷ থাকেন বার্সেলোনাতে৷

অর্জুনের মেল দেখতে দেখতেই টের পেলাম, রহস্যের জট ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে৷ যা আন্দাজ করেছিলাম, সেটাই ঠিক৷ এখন শুধু দরকার, প্রমাণ সংগ্রহ করা৷ সেই কাজটা করার দায়িত্ব সৌম্য ঠাকুরের৷ আমার বিশ্বাস, তথ্যগুলো ও আমার হাতে তুলে দেবে৷…মোবাইল ফোনটা বাজছে৷ হাত বাড়িয়ে টেবল থেকে সেটটা তুলতেই দেখি, পর্দায় রেখার হাসবেন্ড চঞ্চলের নাম৷ ‘বলো’, বলতেই ও পাশ থেকে হাউহাউ করে কান্নার আওয়াজ৷ চঞ্চল বলল, ‘সব শেষ কালকেতুদা৷ ছেলেটাকে দাহ করে শ্মশান থেকে এখনই বাড়িতে ফিরে এলাম৷’ চঞ্চলের কান্না শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল৷ এই পরিস্থিতিতে কী-ই বা বলা যায়? একটু চুপ করে থেকে, নিজেকে সামলে নিয়ে চঞ্চল ফের বলল, ‘আপনার সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই কালকেতুদা৷ আমার ল-ইয়ারও সঙ্গে থাকবেন৷’

বললাম, ‘কিন্তু আমি তো এখনও দয়াপুরে৷ কাল দেখা কোরো৷ রেখা কোথায়?’

‘ওকে নার্সিং হোমে ভরতি করতে হয়েছে কালকেতুদা৷ মারাত্মক ডিপ্রেশন৷ এ দিকে, ফরেনসিক রিপোর্টে কি আছে, নিশ্চয়ই শুনেছেন৷’

‘শুনেছি৷ তবে, অর্জুনের মৃত্যুটা নিছক স্নেকবাইটের জন্য হয়েছে, আমি বিশ্বাস করি না৷’

‘কে ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী, সেটা কি জানতে পেরেছেন?’

‘আজ বিকেলের মধ্যে জানতে পেরে যাব৷’

‘কে সেই বাস্টার্ড? আমরা কিন্তু তাকে ছাড়ব না৷’

পুত্রশোকের জ্বালা থেকে চঞ্চল আরও উত্তেজিত কথা বলতে লাগল৷ এর মধ্যেই টের পেলাম, ফোনে পি পি শব্দ হচ্ছে৷ কেউ আমাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছে৷ সৌম্য ঠাকুর হতে পারে৷ চঞ্চলকে সান্ত্বনা দিয়ে তাড়াতাড়ি ফোনটা আমি ছেড়ে দিলাম৷

নয়

বিকেল পাঁচটা বাজে৷ প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসে আমরা বসে আছি৷ বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে৷ সেইসঙ্গে কড়াৎ কড়াৎ করে বাজ পড়ার শব্দও৷ ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ৷ দুপুরে একবার গোসাবা থানা থেকে ঘুরে আসার পরই আমি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছিলাম৷ থানার ওসিকে বলেছিলাম, বিকেল চারটের সময় প্রিন্সিপাল স্যারের ঘরে কয়েকজনকে ডেকে নিতে৷ আমার কিছু বলার আছে৷ বৃষ্টির জন্য ওসি সাহেব ঘণ্টাখানেক দেরি করে ফেলেছেন৷ উনি নাকি নদী পেরোতে ভয় পাচ্ছিলেন৷ একে বাজ পড়ার ভয়, তার উপর জলে চোরা ঘূর্ণি৷

ঘরে সৌম্য ঠাকুর ছাড়াও হাজির ফাদার উইলি, মিঃ শ্রীবাস্তব, কিংশুক আর স্কুলকর্তাদের আরও দু-তিনজন৷ ঘরে ঢোকার আগে সৌম্য ফিসফিস করে আমায় বলেছিল, প্রিন্সিপাল স্যার নাকি প্রথমে আসতে চাননি৷ কিন্তু দুপুর থেকেই টিভিতে অর্জুনের রহস্যজনক মৃত্যুর খবর আর রেখার বাইট টেলিকাস্ট হতে থাকায় প্রিন্সিপাল স্যার মত বদলান৷ স্কুলের বদনাম হয়ে যাচ্ছে৷ সম্ভবত, কলকাতা থেকে কেউ ওঁকে পরামর্শ দিয়েছেন, পালটা কিছু বলার জন্য৷ প্রিন্সিপাল স্যার মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন৷ কিংশুকের মুখ ফ্যাকাশে৷ ঘরের নৈঃশব্দ্য প্রিন্সিপাল স্যার নিজেই ভাঙলেন, ‘বলুন মিঃ নন্দী, আপনার কী বলার আছে? একটু পরেই বারুইপুর থেকে প্রেসের লোকেরা হাজির হবেন৷ আমি ওঁদের কিছু বলতে চাই৷’

বললাম, ‘স্যার, আমারও তাড়া আছে৷ অর্জুনের মৃত্যু নিয়ে কয়েকটা কথা বলে আমিও চলে যেতে চাই৷ আমার মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না৷ কিন্তু, পাখিরালার খেয়াঘাটে অর্জুনের মা…যাকে আমি বহুদিন ধরে চিনি…তিনি আমাকে অনুরোধ করে যান, সত্য উদঘাটন করার জন্য৷ সত্যি বলতে কী, ভেলায় ভাসতে থাকা অর্জুনের ডেডবডি দেখে, প্রথমেই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল৷ উত্তরটা খুঁজতে গিয়ে আরও বড়ো একটা রহস্যের সমাধান করে ফেললাম৷’

প্রিন্সিপাল স্যার একটু অধৈর্য হয়েই বললেন, ‘এত ভূমিকা করবেন না৷ যা বলার, তাড়াতাড়ি বলুন৷’

শুনে মুচকি হাসলাম৷ ভদ্রলোক সৌজন্যবোধও হারিয়ে ফেলেছেন৷ বললাম, ‘গতকাল আপনি বলেছিলেন, ইটস আ ক্লিয়ার কেস অফ সুইসাইড৷ আরও বলেছিলেন, অর্জুন ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছিল৷ সম্ভবত, ওভারডোজ নিয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলেছে৷ সত্যিই, ওর রুম তল্লাশি করার সময় বিছানার নীচে আমরা হেরোইনের প্যাকেট পেয়েছিলাম৷ আপনার দেওয়া তথ্য সত্যি বলে ধরে নিয়ে, সিআইডি অফিসার সৌম্য ঠাকুর তদন্ত শুরু করেন৷ স্কুল ক্যাম্পাসের চার দেওয়ালের মধ্যে যে লোকটি ড্রাগ বিক্রি করত, সেই আফজলকে তুলে নিয়ে গিয়ে গোসাবা থানায় উনি জেরা করেছেন৷ মারের মুখে আফজল স্বীকার করে, অর্জুনের উপর ওর রাগ ছিল৷ কেননা, ক্যাম্পাসকে ড্রাগ ফ্রি করার জন্য অর্জুন উঠে পড়ে লেগেছিল৷ আফজল আরও স্বীকার করেছে, অর্জুনের ঘরে গোপনে হেরোইন রেখে দিয়ে আসার জন্য কেউ একজন ওকে চাপ দিয়েছিলেন৷ তাঁর নামটি আফজল আমাদের বলে দিয়েছে৷’

কথাগুলো বলেই সামনে বসে থাকা মুখগুলোর দিকে আমি চোখ বুলিয়ে নিলাম৷ প্রিন্সিপাল স্যার ভাবলেশহীন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন৷ বাকিরা কৌতূহল নিয়ে৷ বললাম, ‘ফরেন্সিক রিপোর্ট বলছে, অর্জুনের শরীরে ড্রাগের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি৷ ফলে এ নিয়ে আলোচনার কোনো মানে হয় না৷ রিপোর্ট অনুযায়ী, অর্জুনের মৃত্যুর কারণ স্নেকবাইট৷ গোখরো, কালাচ, কেউটে, শঙ্খচূড় ধরনের কোনো সাপের কামড়ে ও মারা গেছে৷ এটা একটা অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ বলে ধরে নেওয়া উচিত৷ তা সত্ত্বেও, আমার মনে হয়েছিল, এর পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে৷ কেননা, ওই রাতে ব্লু হাউস হোস্টেলে একজন বেদেকে ঢুকতে দেখা গিয়েছিল৷ তার কাঁধে একটা স্নেকব্যাগ ছিল৷ সিসিটিভি ফুটেজ থেকে তার ছবি বের করে সৌম্য ঠাকুর খোঁজ করে জানতে পারেন, তার নাম জীয়ন মুর্মু৷ জেমসপুরের বেদেপাড়া থেকে তাকে অ্যারেস্ট করে, থানায় নিয়ে গিয়ে জেরা করতেই, জীয়ন স্বীকার করে, হ্যাঁ, ওই দিন রাত বারোটার সময় অর্জুনের ঘরে গিয়েছিল৷ স্নেকব্যাগ থেকে বের করে, ঘরে একটা কালাচ সাপ সে ছেড়ে দিয়ে আসে৷ পাঁচ হাজার টাকার লোভে সে এই কাজটি করেছে৷

‘আপনাদের অবগতির জন্য জানাই, কালাচ হল বিশ্বের একমাত্র সাপ, যারা বিছানায় কামড়াতে ভালোবাসে৷ মানুষের ঘামের গন্ধ তাদের বিছানায় টেনে নিয়ে যায়৷ এই সুন্দরবন অঞ্চলে কালাচের কামড়ে মৃত্যুর হারই সবথেকে বেশি৷ বিশ্বের সবথেকে বিষধর সাপেদের মধ্যেও এরা অন্যতম৷ আশ্চর্যের ব্যাপার হল, অন্য কোনো সাপ কামড়ালে বিষদাঁত ফোটানোর চিহ্ন শরীরে পাওয়া যায়৷ কালাচ হল ব্যতিক্রম৷ অনেক ক্ষেত্রেই চিহ্নটা দেখতে পাওয়া যায় না৷ আক্রান্ত মানুষটা কোনোরকম জ্বালা-যন্ত্রণা অনুভব করে না৷ কালাচ কামড়ালে আধঘণ্টার মধ্যেই মারাত্মক ঘুম ঘুম ভাব আসে৷ আক্রান্ত নেশাগ্রস্ত হয়ে যায়৷ নড়াচড়ার কোনো ইচ্ছে থাকে না৷ এরপর মুখ দিয়ে লালা ঝরতে থাকে৷ কখনও বমিও হতে পারে৷ অর্জুনের ঘর তল্লাশি করার সময় বালিশে লালা এবং মেঝেতে বমির চিহ্ন আমরা দেখতে পেয়েছি৷ রাতে যখন কালাচ সাপটা অর্জুনকে কামড়ায়, তখন ও ঘর থেকে বেরোনোর চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু, বাইরে থেকে দরজার হ্যাজবোল্ট টেনে দিয়েছিল জীয়ন মুর্মু৷ সে স্বীকারও করে নিয়েছে, ঘণ্টাখানেক বাইরে অপেক্ষা করার পর, ফের ঘরে ঢুকে সাপটাকে ও ব্যাগে পুরে ফেলে৷’

এইসময় মিঃ শ্রীবাস্তব বলে উঠলেন, ‘এ আপনি কী সব বলছেন মিঃ ন্যান্ডি!’

বললাম, ‘আদৌও মনগড়া কাহিনি নয়৷ আগে বলুন, ব্লু হোস্টেলের গেট কেন সেই রাতে দেড়টা পর্যন্ত খোলা ছিল? জীয়ন মুর্মু এবং নাইট গার্ড…দুজনে মিলে চাদরে মোড়া একটা ভারী বস্তু, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ন্যানো গাড়িতে কেন তুলে দিয়েছিল? সেই নাইট গার্ড আর গাড়ির ড্রাইভার এখন গোসাবা থানার লক আপে রয়েছে৷ দুজনেই স্বীকার করেছে, অর্জুনের ডেডবডিটা ওরা স্কুলের খেয়াঘাট পর্যন্ত নিয়ে গেছিল৷ সেখানে লখিন্দরের ভেলায় সাজিয়ে, একটা ডিঙিতে অপেক্ষা করছিল জীয়ন মুর্মুর এক শাগরেদ৷ সে ডিঙি নিয়ে গোমতী নদীতে পৌঁছে, তারপর অন্য জেলেদের বোটে উঠে মাছ ধরতে চলে যায়৷ ওদের প্ল্যান ছিল, গোমতী নদীতে ভাটার সময় ডিঙি ছেড়ে দিলে, সেটা ভাসতে ভাসতে মোহনার দিকে চলে যাবে৷ লখিন্দরের ভেলা দেখে লোকে ভাববে, নেতি ধোপানি ঘাটের দিকে সাপে কাটা মড়া ভেসে যাচ্ছে৷ কারও মনে কোনো সন্দেহ হবে না৷ কেননা, আকছারই এই রকম ভেলা নদীতে ভেসে যেতে দেখা যায়৷ কিন্তু মানুষ ভাবে এক, ঘটে অন্যরকম৷ স্রোতের টানে সেই ডিঙি যে পাখিরালার ঘাটে গিয়ে আটকে যাবে, জীয়ন মুর্মু বা যার নির্দেশে সে এই অপরাধটা করেছে, তারা স্বপ্নেও ভাবেনি৷’

ফাদার উইলি বলে উঠলেন, ‘ড্যাম ইট, আপনি মাস্টার মাইন্ডের নামটা করছেন না কেন?’

বললাম, ‘আমি বলব? নাকি প্রিন্সিপাল স্যার বলবেন?’

পাশ থেকে কিংশুক রাগে বলে উঠল, ‘কালকেতু, তুই কাকে কী বলছিস? উনি জানবেন কী করে?’

হাত তুলে ওকে থামিয়ে বললাম, ‘উনি জানেন৷ কেননা, গোটা ঘটনাটা ওঁর নির্দেশেই ঘটেছে৷ ফরেনসিক রিপোর্ট শোনার পর দুটো জিনিস আমার মাথায় স্ট্রাইক করেছিল৷ কালাচ সাপের কামড়, আর জীয়ন মুর্মু৷ তোর নিশ্চয়ই মনে আছে, মায়ামির সার্পেন্টেরিয়াম ম্যাগাজিনে প্রিন্সিপাল স্যারের যে আর্টিকেলটা কাল রাতে তুই আমাকে দেখিয়েছিলি, তাতে এই জীয়ন মুর্মুর ছবি ছিল৷ তখনই আমার মনে হয়, বেদে জীয়ন মুর্মুর পক্ষে এই দুষ্কর্মটি করা সম্ভব৷ কাজটা এমনভাবে সে করতে পারে, যাতে কেউ টের পাবে না৷ তখনই হোস্টেলের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে বলি৷ এবং আগেও বলেছি, তখনই প্রমাণ পাই, গভীর রাতে জীয়ন মুর্মু হোস্টেলে গিয়েছিল৷ তুই জিজ্ঞেস করতে পারিস, প্রিন্সিপাল স্যার কেন জীয়ন মুর্মুকে দিয়ে অর্জুনকে পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দিলেন? আমি চাই, সেই কথাটা উনি নিজেই সবার সামনে বলুন৷’

প্রিন্সিপাল স্যার জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দিস ইজ আটারলি রাবিশ৷ ইউ আর টকিং ননসেন্স৷’

বললাম, ‘ঠিক আছে৷ এই কেন-র উত্তরটা তা হলে আমিই দিয়ে দিই৷ প্রিন্সিপাল স্যারের মেয়ে অ্যাঞ্জেলা আর অর্জুনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল৷ প্রিন্সিপাল স্যার এবং ওঁর স্ত্রী যা একেবারেই পছন্দ করছিলেন না৷ ওঁরা চাইতেন না, অর্জুন অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে মিশুক৷ এর একটাই কারণ, অর্জুন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে৷ বারবার বারণ করা সত্ত্বেও, অর্জুন ও অ্যাঞ্জেলার মেশামেশি ওঁরা আটকাতে পারেননি৷ বিরক্তি থেকে ক্রোধ৷ যা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, পরশু রাতে একজিবিশন হল থেকে ওদের দুজনকে একসঙ্গে ফিরতে দেখে৷ রাগে অন্ধ হয়ে প্রিন্সিপাল স্যার বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে অর্জুনকে চড়থাপ্পড়ও মারেন৷ এই কথাটা আমি জানতে পারি, অর্জুনের ল্যাপটপ ঘেঁটে৷ অর্জুনের দুর্ভাগ্য, সেদিনই রাতে জীয়ন মুর্মু একটা কালাচ সাপ বিক্রি করতে এসেছিল স্যারের কাছে৷ তার পরের ঘটনা তো আগেই বলেছি৷ প্রিন্সিপাল স্যার, আমার কথা যদি আপনার পছন্দ না হয়, তাহলে সাফাইটা না হয় দেবেন পুলিশ হেফাজতে গিয়ে৷’

এর পরেই নাটক৷ ড্রয়ার থেকে একটা মাকারভ পিস্তল বের করে প্রিন্সিপাল স্যার চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘পুলিশ কাস্টোডি! মাই ফুট৷ আপনারা সবাই এক্ষুনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাবেন৷ না হলে আমি শ্যুট করে দেবো৷’

সৌম্য বোধহয় আন্দাজ করেছিল এই রকম আচমকা কিছু ঘটবে৷ সঙ্গে সঙ্গে ও রিভলবার তাক করে বলল, ‘কেন অযথা রক্তক্ষয় করবেন? এই ঘরে আরও দুজনের সঙ্গে পিস্তল আছে৷ আপনার দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেলে আপনার স্ত্রী বেটসি আর মেয়ে অ্যাঞ্জেলার কী হবে?’

ফাদার উইলি লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘অ্যারেস্ট হিম ইম্মিডিয়েটলি জেন্টেলম্যান৷ অর্জুনের মতো একজন ছেলেকে যে কোল্ডব্লাডেড মার্ডার করতে পারে, জেসাস তাকে কোনোদিন ক্ষমা করবেন না৷ মাইকেল মাস্ট গো বিহাইন্ড দ্য বার৷’

হেসে বললাম, ‘আপনাকে একটা চমকপ্রদ খবর জানাই ফাদার উইলি৷ যাঁকে আপনি মাইকেল সঞ্জীব পুরকায়স্থ বলে ভাবছেন, তিনি ইনি নন৷ এঁর নাম উইলিয়াম রাজীব পুরকায়স্থ৷ মাইকেল সঞ্জীব পুরকায়স্থের যমজ ভাই৷ দুজনের চেহারায় এমন সাদৃশ্য যে, এক-এক সময় এঁদের মাও বুঝতে পারতেন না, কে সঞ্জীব, কে রাজীব৷ দুজনেরই ব্রিলিয়ান্ট অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার৷ যৌবনে থাইল্যান্ডের ভুমিবল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে চাকরি করার সময় রাজীব পা পিছলে অপরাধ জগতে ঢুকে পড়েছিলেন৷ ড্রাগ সংক্রান্ত অপরাধে জড়িয়ে একবার জেলও খেটেছেন৷ জেল থেকে বেরিয়ে রাজীব এর পর স্ত্রী বেটসি ও মেয়ে অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে ভাইয়ের কাছে সিঙ্গাপুরে চলে যান৷ এর পরের গল্প একেবারে সিনেমার মতো৷ সিঙ্গাপুরেও ড্রাগের কারবার চালিয়ে যাচ্ছিলেন রাজীব৷ একটা সময় সঞ্জীব সেটা জানতেও পারেন৷ উনি হুমকি দেন, পুলিশকে সব জানিয়ে দেবেন৷ তখন সঞ্জীবকে খুন করে ও তাঁর লাশ বাড়ির দেওয়ালে গুম করে ইনি পালিয়ে আসেন ভারতে৷ দেখতে একই রকম হওয়ায় কারও মনে সন্দেহ জাগেনি৷ এখানে সঞ্জীবের পরিচয় দিয়েই ইনি এই স্কুলে প্রিন্সিপালের চাকরিটি পেয়ে যান৷ আর-একটা কথা বলি, এখানে স্কুল ক্যাম্পাসে ড্রাগ আমদানি করার পিছনে রয়েছেন এই নকল প্রিন্সিপাল স্যার৷ আফজল আমাদের কাছে জবানবন্দি দিয়েছে৷’

কিংশুকের বোধহয় বিশ্বাস হয়নি কথাগুলো৷ ও প্রশ্ন করল, ‘তুই এ সব জানলি কী করে?’

বললাম, ‘গুড কোয়েশ্চেন৷ আমার এক পুলিশ অফিসার বন্ধু সুদীশ নাগ এখন ট্রেনিং নিতে সিঙ্গাপুরে গেছে৷ মাইকেল সঞ্জীব পুরকায়স্থর অতীত সম্পর্কে ওকে খোঁজ নিতে বলেছিলাম৷ মেল করে আজ দুপুরে ও আমাকে জানায়, সঞ্জীব বেঁচে নেই৷ দু-বছর পর দেওয়াল খুঁড়ে ওর লাশের সন্ধান পায় সিঙ্গাপুর পুলিশ৷ কিন্তু তার অনেক আগেই বেটসি ও অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে রাজীব এখানে চলে আসেন৷ সিঙ্গাপুর পুলিশ তার পর ফাইল ক্লোজ করে দেয়৷ এই ঘরে আসার আগে অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে আমি কথা বলেছি৷ ও আমাকে সব খুলে বলেছে৷’

গোসাবা থানার পুলিশ উইলিয়াম রাজীব পুরকায়স্থকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর, আমি আর সৌম্য কলকাতায় ফেরার জন্য লঞ্চে উঠে পড়লাম৷ এমন সময় প্রিয়ার ফোন, ‘প্লিজ, তুই একবার আমাদের কোয়ার্টারে আয়৷ কিংশুক হঠাৎ অদ্ভুত বিহেভ করছে৷ বলছে, চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে যাবে৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *