লক্ষ মার্কের বরমান

লক্ষ মার্কের বরমান

সম্প্রতি জর্মন সরকার ঘোষণা করেছেন যে, কেউ যদি এমন খবর দিতে পারে যার সাহায্যে মার্টিন বরমান নামক লোকটাকে গ্রেফতার করা যায় তবে তাকে এক লক্ষ জর্মন মার্ক পুরস্কার দেওয়া হবে।

তাই নিয়ে একখানি মাসিক পত্রিকা ফলাও করে উক্ত হত্যার বরমান সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। পত্রিকাখানি চোদ্দটি ভাষায় প্রকাশিত হয় এবং শতাধিক দেশে পড়া হয় বলে পত্রিকার কর্তৃপক্ষ দম্ভ করে থাকেন। প্রবন্ধ-লেখক তাই বলেছেন, হয়তো-বা আপনিই বরমানকে ধরার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন, কারণ হিটলারের মৃত্যুর পর বরমান কোথায় যে উধাও হয়ে গিয়েছে কেউ জানে না। সর্বশেষে প্রবন্ধ-লেখক বরমানের একটি বর্ণনা দিয়েছেন যাতে করে আপনি তাকে অল্পায়াসে বা অনায়াসে চিনে নিতে পারেন।

আমরা বরমান সম্বন্ধে যেটুকু জানি, তাতে মনে গভীর সন্দেহ হয়, লেখক বরমানের যে বর্ণনা দিয়েছেন সে অনুযায়ী চললে তাকে আদৌ চিনতে পারবেন কি না, বরঞ্চ হয়তো তাঁকে পালাবার সুযোগই দেওয়া হবে বেশি।

ইতোমধ্যে আরেকটি কথা বলে রাখি, উক্ত পত্রিকার ভারতীয় সংস্করণ বলেছেন, এক লক্ষ জর্মন মার্ক যে আপনি পাবেন তার ভারতীয় মূল্য এক লক্ষ টাকা। আমরা যতটুকু জানি, তার মূল্য অন্তত এক লক্ষ দশ হাজার টাকা সাদা বাজারেই। এই হল প্রবন্ধটির বিসমিল্লাতে গলদ। এর পর অন্যসব গলদে আসছি। তার পূর্বে বরমানটির পরিচয় কিঞ্চিৎ দিই।

হিটলারের জীবনে শেষের দু বছর বরমান ছিলেন তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি। তার পূর্বেই তিনি নাৎসি পার্টির সেক্রেটারি হয়ে গিয়েছিলেন। নাৎসি পার্টিই যে জর্মনি চালাত সে-কথা। সবাই জানেন– অন্য কোনও পার্টির অস্তিত্ব পর্যন্ত বেআইনি বলে গণ্য হত এবং হিটলার ছিলেন তার সর্বময় কর্তা। এবং তার পরেই বরমান।

আইনত হিটলার হঠাৎ মারা গেলে কিংবা কোনও কারণে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেললে তাঁর জায়গায় বসার কথা ছিল গ্যোরিঙের। ওদিকে নাৎসি পার্টির সশস্ত্র বাহিনীর (এস.এস.) বড়কর্তা ছিলেন হিমলার। তিনি আবার ছিলেন দেশের সামরিক বেসামরিক সর্ব রিজার্ভ ফোর্সের অধিপতি এবং সর্ব কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ছিল সম্পূর্ণ তাঁরই জিম্মায়। শেষের দিকে গ্যোরিঙ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন এবং দেশের আপামর জনসাধারণ জানত, হিটলারের হঠাৎ কিছু একটা হয়ে গেলে হিমলারই দেশের ফুরার–লিডার–বা নেতা হবেন। আইষমান যা কিছু করেছেন সেসব হিমলারের হুকুমেই।

তা ছাড়া ছিলেন গ্যোবেলস। যদিও তিনি প্রপাগান্ডা মিনিস্টার কিন্তু তিনি হিটলারের বিশেষ প্রিয় আমির ছিলেন। শেষদিন পর্যন্ত তিনি ও হিমলার যদি হিটলারের সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন তবে বরমানও সেটা ঠেকাতে পারতেন না। বিশেষ করে গ্যোবেলকে। বরমান সেটি জানতেন, এবং হিমলারকে যদিও তিনি শেষপর্যন্ত কোণঠাসা করে এনেছিলেন তবু গ্যোবেলসকে ঠেকাতে পারবেন না জেনে তাঁর সঙ্গে একটি চুক্তি (ওয়ার্কিং এরেঞ্জমেন্ট– মডুস ভিভেন্ডি) করে নিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, হিটলারের জীবনের শেষের বছরখানেক বরমান ছিলেন সর্বেসর্বা। হিটলারের তাবৎ হুকুম তারই মারফতে বেরুত। তাঁর ইচ্ছেমতো তিনিও হিটলারকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নিতেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী খ্রিস্টধর্মের এমনই কট্টর শত্রু ছিলেন যে, তারা খ্রিস্টানদের মাবার জন্যে যেসব ব্যবস্থা করতে চাইতেন তার দু-একটি হিটলারের মতো ধর্মদ্রোহীর মনেও বিরক্তির সঞ্চার করেছিল।(১)

এ বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই, গ্যোরিঙের পতনের জন্য বরমানই দায়ী। এমনকি হিটলারের বিনানুমতিতে তিনি হুকুম পাঠান যেন গ্যোরিঙকে গুলি করে মারা হয়। কিন্তু নাৎসি রাজ্য পতনের দিন আসন্ন দেখে যে কাপ্তানের ওপর সে আদেশ দেওয়া হয়েছিল তিনি সেটা অমান্য করেন।

হিটলারের মাত্র একটি খাস দোস্ত ছিলেন। চক্রান্ত করে বরমান তাঁকেও প্রায় ছ মাস ধরে হিটলারের কাছ থেকে দূরে রাখেন। হিটলারকে বলেন, তিনি সংক্রামক টাইফুঁসে ভুগছেন। হিটলারের মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে তিনি কোনও গতিকে হিটলারের সাক্ষাৎটা পান– শেষবারের মতো। চক্রান্ত ধরা পড়ে। হিটলার কিন্তু বরমানকে কিছুই বললেন না। বরঞ্চ দোস্ত হফমানকে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন দয়া করে এ প্রসঙ্গ উত্থাপন না করেন।(২)

এই যে এত শক্তিশালী বরমানকে লোকে খুঁজে পাচ্ছে না? আইষমান তাঁর অনেক নিচের নিচে কর্মচারী ছিলেন। তাঁকেও ইহুদিরা ধরতে পেরেছে। এঁকে পারছে না কেন?

যে বিখ্যাত মাসিকপত্রের উল্লেখ করে এ প্রবন্ধ আরম্ভ করেছি সেখানে এ প্রশ্নটির উল্লেখ নেই। যদিও হিটলার-বরমান নিয়ে যারাই আলোচনা করেন তাঁদের সবাই এর উত্তর জানেন।

তার একমাত্র কারণ বরমান পাবলিসিটি বা খ্যাতি চাইতেন না। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল শক্তি, ক্ষমতা মানুষের জীবনমরণের ওপর অধিকার আয়ত্ত করা।

হেস, গ্যোরিঙ, গ্যোবেলস, হিমলার, রিবেনট্রপ এমনকি হিটলারের আমির ওমরাহ চুনোপুঁটিরাও কাগজে কাগজে যখন আপন আপন ফোটোগ্রাফ ছাপাচ্ছেন, যত্রতত্র ভাষণ দিচ্ছেন, বেতারে তরো-বেতরো বক্তৃতা ঝাড়ছেন, মোকা-বেমোকায় কেতাব ছাপাচ্ছেন, পরব-পার্টি ডে-তে চোখ ঝলসানো ইউনিফর্ম পরছেন, তখন মান হিটলারের ছায়ায় দাঁড়িয়ে– তা-ও বাড়ির বাইরে জনসমাজে না– কলকাঠি নাড়ছেন, দিনের পর দিন আপন শক্তি বাড়িয়ে যাচ্ছেন। বড় বড় জেনারেল সিভিলিয়ানরা যখন ডাঙর ডাঙর মেডেলের জন্য হিটলারের সামনে হুটোপুটি করছেন তখন বরমান তার স্ত্রীকে লিখেছেন এ কী পাগলামি।(৩)

তাই জর্মন-অজর্মন সাধারণজন তাকে চিনত না। তখনকার দিনে এবং আজও তার ফোটোগ্রাফ দুষ্প্রাপ্য ছিল এবং আছে।

হিটলার যখন তাঁর খ্যাতির মধ্যগগনে অর্থাৎ স্তালিনগ্রাদের পরাজয় তখনও তাঁকে স্বীকার করে নিতে হয়নি সে সময়ে খানাপিনার পর হিটলার ইয়ারবক্সিদের সঙ্গে গালগল্প করতেন। অবশ্য হিটলারই কথা বলতেন বেশি। বরমান তখন ব্যবস্থা করেন যে দুজন শর্টহ্যান্ড এককোণে বসে সেগুলো যেন লিখে নেন। পরে বরমান সেগুলো কেটেছেটে ধোপ-দুরুস্ত করে দিতেন। এগুলো হিটলারের মৃত্যুর পর তার টেবল-ট (table talk) রূপে প্রকাশিত হয়েছে। প্রাগুক্ত বিশ্ববিখ্যাত মাসিকের প্রবন্ধ-লেখক বলেছেন, বরমান যে এ ব্যবস্থা করেছিলেন তার উদ্দেশ্য ছিল so that he could know and fulfil Hitlers every whim. এ উদ্দেশ্যও হয়তো তার ছিল কিন্তু এই টেবল-ট পড়লেই বোঝা যায় সেটা অত্যন্ত গৌণ। আসলে বরমান মনে করতেন হিটলার যা করেন যা বলেন তার চিরন্তন ঐতিহাসিক মূল্য আছে এবং পরবর্তী যুগের নাৎসি তথা বিশ্ববাসীর জন্য অমূল্য নিধি। নিধি হোক আর না-ই হোক– এ-কথা সত্য যারা হিটলারকে ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে চিনতে চান তাদের পক্ষে হিটলারের স্বরচিত মাইন কাপ পুস্তকের পরেই এর স্থান। এসব ১৯৪১-৪২-এর কথা।

১৯৪৫ সালে হিটলার যখন আসন্ন পরাজয়ের সম্মুখীন তখন বরমান হিটলারকে দিয়ে আবার কথা বলিয়ে নেন। একথা সত্য, আত্মহত্যার কুড়ি-বাইশ ঘণ্টা পূর্ব পর্যন্ত হিটলার জয়াশা সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারেননি। তবু এই শেষ talk-গুলোতে হিটলার যেন আপন মনে চিন্তা করছেন, কেন তাঁর পরাজয় হল? এবং শুধু তাই নয়, পরাজয় যদি নিতান্তই হয়ে যায় তবে ভবিষ্যতে ইয়োরোপ-আমেরিকার কী অবস্থা হবে, তখন জর্মন রাজনীতি কোন পন্থা অনুসরণ করবে সে সম্বন্ধেও হিটলার ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন। আশ্চর্য, তার অনেকগুলিই আজ ফলে যাচ্ছে। চীন যে চিরকাল জড় হয় পড়ে থাকবে এটা তিনি স্বীকার করেননি। বরঞ্চ বলেছেন, চীনের কোটি কোটি লোক ওই দেশে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে না। তবে তার বিশ্বাস ছিল, চীন আমেরিকার পানে ধাওয়া করবে (তার পূর্বে রুশ-মার্কিনে যুদ্ধ হয়ে আমেরিকা ছারখার হয়ে যাবে); চীন যে ভারতপানে ধাওয়া করবে সে ভবিষ্যদ্বাণী তিনি করেননি।

বলতে গেলে টে-টও বরমানেরই অবদান।

কিন্তু এহ বাহ্য।

প্রাগুক্ত প্রবন্ধ-লেখক বলেছেন, বরমান মদ এবং কফি খেতেন না, পাতলা চা খেতেন এবং কৃচিৎ কখনও মাংস (drinking neither alcohol nor coffee, just week tea, and eating sparingly of meat)!

অর্থাৎ কাল যদি আপনি কলকাতায় (প্রবন্ধ-লেখক বলেছেন he could be in Canada or Mexico even in India), কিংবা কেউ যদি আর্জেন্টাইনে দেখে একটা লোক এক ঢাউস গেলাসভর্তি বিয়ারের সঙ্গে বিরাট একটি কাটলেট খাচ্ছে তবে তার বরমান হবার সম্ভাবনা নেই।

বস্তুত বরমান মাংস খেতেন প্রচুর। মদের তো কথাই নেই।

তবে প্রবন্ধ-লেখকের এ ভুল ধারণা এল কোথা থেকে?

সকলেই জানেন হিটলার মাছ মাংস মদ খেতেন না। তিনি যখন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে খেতে বসতেন তখন তার সামনে থাকত নিরামিষ, এবং অন্যদের জন্য মাছ মাংস মদ। অবশ্য কেউ যদি হিটলারের মতো নিরামিষ খেতে চাইত তবে তাকে সানন্দে তাই দেওয়া হত।

হিটলার-সখা হফমান–যার পুস্তকের কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি–বলছেন, গ্যোরিঙও এসব খানাতে প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন না। তিনি বলতেন, আহারাদির ব্যাপারে প্রভুর সঙ্গে আমার রুচির অমিল। এবং এসব নিরামিষ অন্য কেউ কখনও খেতে চায়নি। এক বরমান ছাড়া। প্রভুকে খুশি করার জন্য সেই কর্তাভজাটা তার সঙ্গে ওই কচুঘেঁচু খেত। এবং তার পর আপন কামরায় গিয়ে সেটা কাছেই ছিল পরমানন্দে শুয়োরের চপ (বিরাট মাংসের টুকরো– এর সঙ্গে আমাদের আলুর চপের কোনও মিল নেই) বা বাছুর মাংসের কাটলেট গব গব করে গিলত। (৪)

প্রাগুক্ত প্রবন্ধ-লেখক তাঁদেরই ওপর নির্ভর করেছেন যারা বরমানকে শুধু বাইরের থেকে দেখেছেন। তাই কবি বলেছেন, বাহ্যদৃশ্যে ভোলো না রে মন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, হন্ আর বরমানে ছিল আদায়-কাঁচকলায়। তাই তিনি দুশমনি করে এসব নিন্দে রটিয়েছেন। কিন্তু ভুললে চলবে না, যখন হফমানের বইখানি প্রকাশিত হয় তখন বরমানের প্রাইভেট সেক্রেটারি, স্টেনো, চাকর, প্রাপ্তবয়স্ক একাধিক ছেলেমেয়ে স্বাধীনভাবে জর্মনিতে চরে বেড়াচ্ছেন। তাদের কেউই কোনও আপত্তি জানাননি।

এবারে মদের ব্যাপারে। হিটলারের খাস চাকর (ভ্যালে) লিঙে দশ বছর রুশদেশে কারাবাস করে, ১৯৫৫ সালে খালাস পেয়ে দেশে ফিরে হিটলার সম্বন্ধে অনেক কথা লিখেছেন। হিটলার নাকি প্রায়ই তাকে বলতেন, দেখ লিঙে, রাত্রে আপন ঘরে তুমি যত খুশি মদ খেয়ে যেমন খুশি মাতলামো কর, আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু সমাজে সাবধানে খেয়ো। বরমানও তাই সাবধানে মদ খেতেন।

আমার এই প্রবন্ধের তিন নম্বর ফুটনোটে যে চার নম্বরের লেখকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তিনি বলট।

পূর্বেই বলেছি হিটলার আত্মহত্যা করার ছাব্বিশ ঘন্টা পূর্বে তিনি হিটলার আর সাঙ্গোপাঙ্গদের ভূগর্ভ-নিবাস (বুঙ্কার) ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচান। এই ভূগর্ভ-নিবাস বহু কামরায় বিভক্ত ছিল। তারই একটাতে থাকতেন তিনি আর তার সহকর্মী শরিংহফেন। হিটলারের আত্মহত্যার দু-তিন রাত্র পূর্বে ভোরের দিকে তার সহকর্মী তাঁকে জাগিয়ে বলেন, কান পেতে শোন, কী সব হচ্ছে। পাশের কামরায় তিন ইয়ার বরমান, জেনারেল বুর্গড আর জেনারেল ক্রেী মদ্যপানের সঙ্গে তর্কাতর্কি করছেন। রাশানরা তখন বার্লিনে ঢুকে গিয়েছে এবং কয়েকদিনের ভেতর যে তাদের জীবনমরণ সমস্যা দেখা দেবে সেটা জানতে পেরে বিশেষ করে বুর্গডফের আত্মগ্লানি দেখা দিয়েছে এবং তার জন্য তিনি প্রধানত নাৎসি পার্টি ও তার কর্তা বরমানকে দায়ী করছিলেন। বরমান আত্মপক্ষ সমর্থন করতে করতে বলছেন, এস, দোস্ত, আরেক পাত্তর হয়ে যাক–বুর্গ অধিকাংশ সময়ই মত্তাবস্থায় থাকতেন।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বলটু তার পর ঘুমিয়ে পড়েন।

দুপুরের দিকে বল্টু তার সহকর্মীর সঙ্গে গেলেন মিলিটারি কনফারেন্স রুমে–বুঙ্কারের ক্ষুদ্র-পরিসর কামরাগুলোর মধ্যে এইটেই ছিল সবচেয়ে প্রশস্ত। সেখানে গিয়ে দেখেন, হিটলার, এফা এবং গ্যোবেলস্ বসে আছেন, আর সামনের তিনখানা সোফাতে হিটলারের তিন ওমরাহ-বরমান, বুর্গড, ক্রেস্– লম্বা হয়ে, পা ফাঁক করে সর্বাঙ্গে কম্বল জড়িয়ে, সোফার ফাঁকা জায়গাগুলো কুশন (তাকিয়া-বালিশ) দিয়ে ভর্তি করে ঘরঘর করে প্রচুর নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছেন।

পূর্ব রাত্রির এবং সেই সকালের অত্যধিক সুমিষ্ট দ্রাক্ষারস পানের ধকল কাটিয়ে তখনও তারা জেগে উঠতে পারেননি। মদ্যপানশেষে তিন ইয়ার একসঙ্গে শোবার জন্য বড় ঘরটাই বেছে নিয়েছিলেন। বলট বলছেন, গ্যোবেলস্ তার দিকে এগুতে গিয়ে এদের নিদ্রাভঙ্গ না করার জন্যে প্রায় সার্কাস খেলোয়াড়ের মতো তাঁদের পা বাঁচিয়ে এক রকম ডিঙিয়ে এলেন। তাই দেখে এফা একটু মৃদু হাস্য করলেন। (পৃ. ৮১, ৮২)

এর পরও যদি প্রাগুক্ত প্রবন্ধ-লেখক বলেন বরমান মদ খেতেন না তা হলে আমরা সত্যিই নিরুপায়।

অবশ্য একথা ঠিক যে বরমান যতক্ষণ-না হিটলার ঘুমিয়ে পড়েন ততক্ষণ সচরাচর মদ খেতেন না। পাছে হিটলার ডেকে পাঠান। এমনকি স্বয়ং বরমানই তার স্ত্রীকে লিখছেন ফেব্রুয়ারি মাসে– (হিটলার আত্মহত্যা করেন ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫, অপরাহ্র সাড়ে তিনটেয়; হিটলারের ভ্যালে খাস চাকর- লিঙের মতে ৩-৫০) ভাগ্যিস কাল রাত্রে এফার জন্মদিন পরবে আমি মদ্যপান করিনি, কারণ রাত সাড়ে তিনটেয় হিটলার আমাকে ডেকে পাঠালেন; আমি তাই সাদা চোখেই তার সঙ্গে কথাবার্তা কইতে পারলুম।

 প্রাগুক্ত প্রবন্ধ-লেখক বলেছেন, বরমান হালকা চা খেতেন!

সে-ও সর্বজন সমক্ষে, হিটলারকে খুশি করার জন্য যেমন তিনি কচুঘেঁচু খেতেন তেমনি। কারণ, আর সবাই যখন মদ্যপান করতেন তখন হিটলার ঘন্টার পর ঘন্টা হালকা চা খেতেন, চীনারা, রুশোরা, কাবুলিরা যেরকম করে থাকে।

বরমান যে মদ্যপান করেন সেকথা হিটলারের অজানা ছিল না। বস্তুত বুঙ্কারের অনেকেই শেষের দিকে পরাজয় আসন্ন জেনে সুরাতে দুশ্চিন্তা ভোলবার চেষ্টা করছিলেন। সখা হফমান যখন হিটলারকে এপ্রিলের মাঝামাঝি শেষবারের মতো দেখতে আসেন তখন তাঁর জন্য শ্যাম্পেন অর্ডার দিয়ে হিটলার এই মন্তব্য করেন।

এ প্রবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য আমার এ নয় যে প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন করে বরমানকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করা। তদুপরি বরমানের এই বঙ্গদেশে আগমন অসম্ভব। ধরা পড়লে ভারত সরকার তাঁকে পয়লা প্লেনেই জর্মনি পাঠিয়ে দিতে কোনও আপত্তি করবেন না। তিনি থাকবেন ওইসব দেশেই যেসব দেশ আসামি বদলের চুক্তি জর্মনির সঙ্গে করেনি– অর্থাৎ নাৎসিদের প্রতি এখনও যাদের কিছুটা দরদ আছে। অবশ্য বরমান তার প্রাপ্য শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পান সেটাও আমার উদ্দেশ্য নয়।

আমার উদ্দেশ্য, এইসব চৌদ্দ আর বাইশ ভাষায় প্রকাশিত মার্কিন কাগজগুলোকে যেন বঙ্গসন্তান চোখ-কান বন্ধ করে বিশ্বাস না করেন। বিশেষ করে যখন তারা স্বাস্থ্য সম্বন্ধে নানা প্রকারের উপদেশ দেয়।

———–

১. অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস বলতে হবে, নাস সাম্রাজ্য পতনের প্রায় এক বছর লুকিয়ে থাকার পর বরমানের স্ত্রী এক ক্যাথলিক পাদ্রির সাহায্য নেন, এবং মৃত্যুর পূর্বে আপন ডজনখানেক ছেলেমেয়েকে তাঁরই হাতে সঁপে দেন। এবং নির্মমতম পরিহাস– তাঁর বড় ছেলে ক্যাথলিক পাদ্রি হয়েছে।

২. এই দোস্ত হফমানকেই হিটলার পাঠিয়েছিলেন মস্কোতে, রিবেট্রপের সঙ্গে, নাৎসি-কম্যুনিস্ট চুক্তি সই করার সময় স্তালিন কী রকম লোক সে তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ করার জন্য। হিটলারের মৃত্যুর পর ইনি হিটলার উয়োজ মাই ফ্রেন্ড নামক একটি পুস্তক লেখেন। ইনিই হিটলারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন তাঁর ফোটোগ্রাফ ল্যাবরেটরির আসিসটেন্ট শ্রীমতী এফা ব্রাউনের সঙ্গে। আত্মহত্যা করার চল্লিশ ঘণ্টা পূর্বে হিটলার এফাঁকে বিয়ে করেন– পনেরো বছরের বন্ধুত্বের পর। এফাও একইসঙ্গে আত্মহত্যা করেন। উভয়কে একই চিতায় পোড়ানোর পর একই কবরে গোর দেওয়া হয়। রাশানরা স্কেলিটেনগুলো খুঁড়ে বের করে।

 ৩. বরমান এতই গোপনে থাকতেন যে তাঁর সম্বন্ধে কেউই সবিস্তর কিছু লিখতে পারেননি। রনবের্গ মোকদ্দমায় সবাই তার বিরুদ্ধে গায়ের ঝাল ঝেড়েছেন বটে কিন্তু তথ্য বিশেষ কিছু দিতে পারেননি। এছাড়া আছে (১) বরমান লেটার্স– স্ত্রীকে লেখা বরমানের পত্রগুচ্ছ। স্ত্রীর মৃত্যুর পর এগুলো প্রকাশিত হয়েছে। (২) ট্রেভার-রোপার লিখিত লাস্ট ডে অব হিটলার। (৩) প্রাগুক্ত হফমান লিখিত হিটলার উয়োজ মাই ফ্রেন্ড। (৪) গেরহার্ট বলটু কৃত ডি লেৎসতেন টাগে ড্যার রাইসকানৎসলাই (অর্থাৎ জর্মন প্রধানাবাসের শেষ কটি দিন)। এই বলটু হিটলার ভবন (মাটির গভীরের অ্যার রেড শেলটার– বুঙ্কার) ত্যাগ করেন হিটলারের মৃত্যুর মাত্র ছাব্বিশ ঘন্টা পূর্বে।

8. Goering too was a rare guest. Hitlers culinary confections he declared was not to his taste. But the lick-spittling Borman dutifuly consumed raw carrots and leaves in his masters company,–and then he would retire to the privacy of his own room and devour with relish his pork chop or a fine Wiener Schnitzel (calf cutlet); Hoffmann, p 202.

৫. অধিকাংশ লোকের বিশ্বাস, হিটলারের মৃত্যুর দু দিন পরে যখন বুঙ্কার রাশান সৈন্য দ্বারা অধিকৃত হয় তখন বুর্গড এবং ক্রেবস্ আত্মহত্যা করেন। বরমান পালান। গোড়ায় তাঁর সঙ্গে পলায়মান যারা পরে বন্দি হন তাঁরা বলেন, বরমান রাশান দ্বারা নিহত হন। পরে নানা সন্দেহের অবকাশ দেখা দিল। তাই আজ জর্মন সরকার এক লক্ষ মার্ক পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তাঁর পলায়ন সম্বন্ধে সবিস্তার বর্ণনা, তিনি বেঁচে আছেন কি না সে সম্বন্ধে সবচেয়ে ভালো আলোচনা পাঠক পাবেন, ট্রেভার-রোপার লিখিত পুস্তকে, পৃ ২২১।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *