পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

লক্ষ্যভেদ

লক্ষ্যভেদ

ভাগবত সরখেল টাকার কুমির। কুমির না বলে হাঙ্গর বলাই ভালো। কুমির তো খপ করে শিকার ধরে জলে ডুবিয়ে তাকে মেরে তারপর যা করার করে। কিন্তু হাঙ্গর জ্যান্ত প্রাণীর গা থেকেও মাংস খুবলে নেয়। তিলে তিলে মারে।

ইদানীং সরখেল মশাই এদিকে আবার সিমেন্ট লোহালক্কড়ের গুদাম বানিয়েছে। বড় ছেলে ব্যবসা দেখছে। দু-তিনটে গাড়ি। আর ছোট ছেলে আমাদের চেয়ে বেশ বড়, স্কুলে পড়ে । আজ ছ-বছরের বেশি ক্লাস টেনে-এর টেস্টে এলাউ হয়নি।

ভাগবত সরখেল আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবে মাঝে মাঝে দু-একটাকা চাঁদাও দেয় ৷ বলে, —পল্লি উন্নয়ন করো। খেলাধুলা করো—দেশকে গড়তে হবে।

আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের লাগোয়া একটা বুনোগাছ ভর্তি জায়গা পড়েছিল। হোঁৎকাই সেদিন উদ্যোগ করে পাড়ায় ঘুরে কিছু পয়সা উঠিয়েছে তার বাকিটা জোগান দেয় পটলা । কুল্যে প্রায় পঞ্চাশ টাকা খরচা করে আর আমাদের ক্লাবের পাঁচজন পাণ্ডা ও বত্রিশজন কুচো-কাঁচার পাঁচদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে, মাঠটা ধোপদুরস্ত হয়ে উঠল।

সাইনবোর্ড টাঙিয়ে এবার বেশ ধুমধাম করে মাঠের উদ্বোধন করা হল এখানে প্রিয় জননেতা গিরিধারীদাকে দিয়ে।

তারপর থেকেই মাঠে খেলছি আমরা। এবার সেভেন সাইড শিল্ড খেলার আয়োজনও করা হল ।

কদিন পর শিল্ডের খেলা, মাঠে গোলপোস্টে জাল পড়েছে। পটলাদের চুনের গোলা থেকে হাত সাফাই করে আনা বালতি কয়েক চুন দিয়ে মার্কিং হচ্ছে। মহাভারতও এখন আমাদের দলে ভিড়েছে। তার বাবার কথামত হোঁৎকার কাছে ডন বার-এর খেলা শিখতে আসছে নিয়মিত।

হোঁৎকা ইদানীং নতুন চ্যালা পেয়ে খুব খুশি। সকালেই আসে ওমলেট, মাখনরুটি কলা । হোঁৎকা বলে, —মহাভারত, ও তুই ভাবিস না। তোকে চাবুক কইরা দিমু। হুম্—

মহাভারত লাল ল্যাঙট পরে বিশাল দেহ নিয়ে ডন দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। ঘামছে গলগল করে। এহেন সময় সরকার ও আরো দুজন লোককে নিয়ে এসে হাজির হয়েছে ভাগবত সরখেল !

মহাভারতকে খালি গায়ে তখন আখড়ার মাটিতে ওই ধুলো মাখা অবস্থায় গড়াগড়ি খেতে দেখে ভাগবত সরখেল গর্জে ওঠে, বলি, হচ্ছে কি? আমার ছেলেকে মাটিতে আছড়ে ফেলবে, কাপড়চোপড় কেড়ে নেবে, কার এতবড় বুকের পাটা!

হোঁৎকা এগিয়ে এসে তাড়াতাড়ি একগাল হেসে বলে,— না মেসোমশাই, মহাভারত এক্সসারসাইজ করতাসে। বডি ফিট হইবো, মেদ কমাবো ।

পটলা বলে, —শরীর ভা-লো-লো…

পটলার ব্রেক ফেল করেছে যথারীতি।

ভাগবত সরখেল গর্জে ওঠে, – থামো। শোনো ছোকরারা, তোমরা তো জানো না এ মাঠ আমার। ওহে বসন্ত, ফিতেতে মেপে নাও। এই যে ম্যাপ দেখ

পটলা জমিজায়গার খোঁজ রাখে। সে বলে, –এ জায়গার মালিক ছিল হরি দে। ত-ত তার …

অ্যা-ভাগবত সরখেলের বিশাল দেহ কেঁপে ওঠে, যেন হিমালয় পর্বতে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। ভাগবত সরখেল কাগজটা দেখিয়ে বলে, হরি দে-র পুত্রবধূর কাছ থেকে এ জায়গা খরিদ করেছি হে!

হোঁৎকা বলে, ট্যাহা দিসেন তারে, না দেনা আর সুদ মিলাইয়া এই দখল লিসেন?

শাট আপ! ভাগবত সরখেল ইংরিজিতে ধমক দেয়।

দু-চারজন লোকও জুটে গেছে। পাড়ার মিত্তির মশাই, যাদববাবু, নরেন ঘোষরাও এসেছে। নরেন ঘোষ বলে পাড়ার ছেলেরা খেলাধুলো করে, এ মাঠ নিয়ে আপনার কি হবে?

ভাগবত সরখেল বলে, – কিনেছি এখানে ফেল্যাট বাড়ি বানাবো। কই রে খোঁটা পোত ! হোঁৎকা বলে, —শিল্ডের খেলা হইব না ?

ভাগবত সরখেল দন্ত কিড়মিড় করে ওঠে, না! হইব না। ওইসব শিলনোড়া নিয়ে এখানে খেলা চলবে না। দরকার হয় একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করবো এখানে।

তারপর ছেলে মহাভারতের দিকে ফেরে ভাগবত, অনেক হয়েছে। কাপড়চোপড় পরে নিয়ে বাড়ি চল। ব্যবসা দেখবি।

ম্লান মুখে কাপড়চোপড় কাঁধে ফেলে বাবার পিছনে পিছনে বাধ্য ছেলের মত চলে গেল মহাভারত।

গদাই বলে—কী হবে রে !

হোঁৎকা বলে, –যা করার করুক, বাধা দিমু।

পটলা বেশ উত্তেজিত। সে বলে, –রক্ত দেব, শহিদ হব—তবু মাঠ দেব না।

এতবড় বিপর্যয় ঘটতে দিতে পারি না। পটলা শহিদ হলে আমাদের ক্লাবই উঠে যাবে। তাই গিরিধারীদের কাছে এসেছি আমি আর গদাই ।

গিরিধারীদা সদাব্যস্ত মানুষ। বসার ঘরে একদল লোক তাকে ঘিরে আছে। খালের জল কি করলে পানীয় জলে পরিণত হতে পারে, তাই নিয়ে আলোচনা চলছে। আড়চোখে আমাদের দেখলেন তিনি।

গিরিধারীদা আমাদের কথা শুনে বলেন, সে কী! খেলার মাঠ দখল করবে এইভাবে ভাগবত সরখেল। ছিঃ ছিঃ। লোকটাকে নিয়ে আর পারলাম না। এক নম্বর আগ্রাসী মনোভাবের লোক। ঠিক আছে আমি দেখছি।

খেলা হবে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বিকেলে যথারীতি খেলা শুরু হয়েছে। সাদা কালো প্যান্টজামা কেডস পরে এসেছে রেফারিং করতে। দর্শকও অনেক জুটে গেছে।

খেলার শেষে আমাদের ক্লাবঘরের সামনে জামগাছের নীচে বসে হোঁৎকা বীরদর্পে বলে, —মাইট ইজ রাইট। মাঠ কে লয় দেহি।

পটলাও এখন ভরসা পেয়েছে। বলে, – সি-সিওর।

এমন সময় জিপটা এসে আমাদের সুমুখে থামে। পুলিশের লাল জিপ। তার থেকে নামলেন থানা অফিসার শ্রীকান্তবাবু। শ্রীকান্তবাবু আমাদের চেনেন, এখানে ওখানে ভলেনটিয়ারি করতে দেখেছেন।

-একটা খারাপ খবর আছে হোঁৎকা ।

হোঁৎকা বলে, –কয়ে ফেলান স্যার, তয় কইতাসি জান্ লইয়া যান, কিন্তু মাঠ ছাড়তি পারুম না ।

শ্রীকান্তবাবু বলেন, –মাথা গরম করো না হোঁৎকা। তোমরা বাপু মাঠ নিয়ে এখন গোলমাল করো না। কদিন বরং খেলা বন্ধ রেখে ভাগবতবাবুর সঙ্গে একটা মীমাংসার চেষ্টা করো।

গদাই বলে, গিরিধারীবাবুকেও বলেছি স্যার। তিনি বললেন খেলা চালাও গে।

শ্রীকান্তবাবু অবাক হল, সে কী! তিনি বলেছেন তোমাদের এই কথা? তবে যে দেখলাম ভাগবতবাবুর গাড়িতে তিনিও গেলেন থানায়। ভাগবতবাবুর হয়ে তিনিও অনেক কথা বললেন।

আমরা তো অবাক—হতবাক!

শ্রীকান্তবাবু বলেন, তাই এসেছিলাম। ওরা বাধা দিলে খেলা বন্ধ রেখো কদিন ।

জিপ হাঁকিয়ে থানার পুলিশ থানাতে ফিরে গেল। আমরা তখন পড়েছি অকূল পাথারে। হোঁৎকা গর্জে ওঠে—গদা! তরে কিল করুম! ক্যান গেসলি ওই গিরিধারীডার কাছে? ও ব্যাটা অ্যাহন মৌকা পাইয়া ভাগবতেরে চাপ দিইয়া কিছু ম্যানেজ কইরা আমাগো পথে বসাইব!

গদাইও বুঝতে পারে ব্যাপারটা। মিনমিন করে সে, –তাইতো দেখছি ।

আমি বুদ্ধি বাতলাই, পটলা তোদের বাগানের এদিকের মাঠটায় আপাতত খেলা হবে। তোর ঠাকমাকে বলিগে চল। তোকে সুইসাইড করতে হবে না পটলা ।

হোঁৎকা এতক্ষণ কথাটা ভাবেনি। এবার তার মাথাতেও আসে কথাটা ।

—তাই চল। এ বছর শিল্ড খেলা করনের লাগবোই। তয় তোরে কইছি সমী, ও মাঠ লমুই। মাঠের ব্যাপারে এক কথায় পটলার বাবা রাজি হবেন তা ভাবিনি। পটলের ঠাকুমা আর ওর বাবাকে প্রণাম করে আসি।

পরদিন সকালে দেখি সারা মাঠে এখানে ওখানে হাঁটু ভোর গর্ত। আর রাজ্যের ভাঙা কাচ মাঠে পড়ে আছে। চলাফেরা করা বিপজ্জনক। ওপাশের আবর্জনা স্তূপ করে রাতারাতি ফেলেছে মাঠে।

হোঁৎকা আড়ালে বলে, —ওটা করছি আমিই। চুপ মাইরা থাক্।

অবাক হই, –তুই!

হোঁৎকা বলে, –নালি হুট কইরা মাঠ ছাইড়া গেলে লোকে কইব কাউয়ার্ডের মত পালাইয়া গেছি। তাই পাবলিক সিমপ্যাথি লইয়া ওই নতুন মাঠে খেলা শুরু করুম। গদাই বলে, – বেশ ভালোই করছিস হোঁৎকা ।

হোঁৎকা বলে—পথ হোঁৎকা ভালোই বাইর করে। আর একটা চান্স লইতি হইব ।

পটলা বলে, —বরং চ-চল্ এখন ভাগবতের কাছে। যেন সারেন্ডার করেছি এই বলে যদি কিছু টাকা ম্যানেজ হয় ।

টাকার দরকার তো আছেই, তাছাড়া, ভাগবতের আসল মতলবটাও একটু আঁচ করা দরকার। শেষ পর্যন্ত পটলার কথাতে সবাই সায় দিই ।

মহাভারতও আমাদের দেখে একটু অবাক হয়।

হোঁৎকা বলে দরদীকণ্ঠে, —ক্লাবে যাস না ক্যান? আরে তগোর জমি তো ছাইড়াই দিমু । তুই আমাগোর ফেরেন্ড। চল—তোর বাবাকে কথাটা জানাইয়া দিমু।

ভাগবত সরখেল ভাবতে পারেনি আমরা আসবো। মনে মনে খুশি হয় সে। হোঁৎকা পরম বিনয়ের সঙ্গে মোলায়েম করে বলে, আপনি বলার পর আমরা ভাইবা দেখলাম, মহাভারত আমাদের মেম্বার। তার বাবা এতবড় মানী লোক, আপনার কথা ফেলুম ক্যান। তাই ক্লাবের মিটিং-এ ঠিক করছি ওই মাঠে খেলুম না।

আমি বলি, –অন্য মাঠে খেলছি, কিন্তু সে মাঠের একটা ডোবা বুজিয়ে ফেলতে হবে—এজন্য কিছু টাকা দরকার।

ভাগবত এখন দরাজ দিল। বিনাবাধায় কাজ হাসিল হতে দেখে ভাগবত বলে, তা সত্যি ! ঠিক আছে শ তিনেক দিচ্ছি এই দিয়েই কাজ চালিয়ে নাও। পরে দরকার হলে আরও কিছু দেব না হয় ৷

মহাভারতও খুশি হয়েছে, সেও মাঠে যাবে আবার। তিনশো টাকাই দিয়েছে ভাগবতবাবু। সেদিন দেখি ট্রাক বন্দি ইট আসছে। মাঠের দেওয়াল তুলছে মিস্ত্রিরা। ভাগবত সরখেলকে হঠাৎ ওখানে গাড়ি থেকে নামতে দেখলাম। আমরা নির্বাক, শোকে মুহ্যমান ।

হঠাৎ ভাগবত সরখেলকে আমাদের দরমা ঘেরা ক্লাবের জামতলার দিকে পায়ে পায়ে চলন্ত পিপের মত আসতে দেখে অবাকই হই ।

ফটিক দৌড়ে ঘরের মধ্য থেকে একটা লোহার ফোল্ডিং চেয়ার এনে দিল। বলে, বসুন মেসোমশাই ৷

ভাগবতবাবু বলে, –মহাভারতের বিয়ে এই সতেরোই শ্রাবণ। তবে কলকাতার বাইরে বর্ধমান–পাল্লা রোডের ওপারে, মানে দামোদর নদী পার হয়েই গ্রামটা। এখান থেকে সোজা গাড়ি যাবে পাল্লায় নদীর ধার অবধি। তারপুর নৌকায় পার হয়েই গ্রাম। তোমরা যাবে কিন্তু চলি তাহলে।

ভাগবতবাবু ফোল্ডিং চেয়ার ছেড়ে ওঠে।

পটলা কি ভাবছিল। সেও বলে—সি-সিওর যামু। ওই ভাগবতবাবুর কাছাকাছি থাকবি । কাৎ-এ পেলে ওকে একবার চেপে ধরতে হবে। লাস্ট ট্রাই করবো মাঠটার জন্যে।

পটলা দুহাত তুলে প্রণাম করে, জয় মা-ক-ক

ওই জিবটা মাকরুণাময়ীই যেন স্বয়ং টেনে ধরেছেন। আমিও প্রণাম জানাই-মা লাস্ট চান্স, মুখ রেখো মা করুণাময়ী, পাঁচ সিকের মানসিক নয় মা, আস্ত পাঁঠাই দেব।

কলকাতার বাইরে বরযাত্রী যাবার জন্য একটু আনন্দও বোধহয়। মহাভারত ক্লাবে আসছে এখন ঘনঘন। কদিন ধরে বেচারা ভাবনায় পড়েছে। বলে-তোরা সঙ্গে যাবি কিন্তু।

এর মধ্যে মহাভারত আমাদের ক্লাবের সকলের দাদা হয়ে গেছে। পটলা বলে—নিশ্চয় যাব মহাভারতদা।

ছেলের বিয়ের দিনে নিজেদের গাড়ি করে, ভাগবতবাবু বিরাট হৈ চৈ করেই বর ও বারযাত্রীদের নিয়ে চলেন বর্ধমানে। শ্রাবণ মাস-এর মধ্যে বৃষ্টি নেমেছে এবার। কলকাতা থেকে গাড়িতে যেতে দেখা যায় পথের দুধারে সবুজ ধানক্ষেত ও গাছগাছালি।

শক্তিগড়ে এলে জি টি রোড ছেড়ে গাড়িগুলো চলে সরু পাকা রাস্তা ধরে। পিচ-এর রাস্তাই। তবে মাঝে মাঝে গর্ত হয়ে গেছে। দুদিকে ধানক্ষেত। সবুজ ধান মাথা নাড়ে বাতাসে । আকাশে শাওনের কালো মেঘগুলো ঘুরছে। মাঝে মাঝে দু-এক পশলা বৃষ্টি আসছে। ঝড়ো হাওয়া বয় এলোমেলো।

সামনে শাওনের দামোদর নদী।

বড় নৌকায় উঠেছে বরযাত্রীর দল। প্রায় সত্তর-আশিজন লোক। ব্যান্ড তাসা জয়ঢাক ইত্যাদি বাদ্যি বাজনা আর মালপত্রতে ওই নৌকা বোঝাই হয়ে গেছে।

বরকর্তা-বর ও বরের বন্ধুদের জন্য রয়েছে একটা অন্য নৌকো। খাতির করে তাতেই তুলেছে আমাদের। ভাগবতবাবু, গিরিধারীদাও রয়েছেন ওই নৌকোয় ।

হোঁৎকা পটলা তখনও নৌকোয় ওঠেনি। কি যেন কথা বলছে ওরা।

তাড়া দিই, –উঠে আয় হোঁৎকা, পটলা।

ওরা দুজনে এসে উঠল, তারপরই নৌকোয় পদার্পণ করল ভাগবতবাবু। নৌকো কেঁপে ওঠে থরথরিয়ে। নৌকা জলের বর্ডার লাইন ছুইছে।

ওদিকের নৌকোয় বাজি ফাটছে। হ্যাঁ, বাজির মত বাজি। শূন্যে উঠে দুমদাম শব্দে ফাটছে বাজি। ভাগবত সরখেল মাঝে মাঝে নৌকোয় উঠে পড়ে তারিফ করছে।

ওঁর দোল নিতে মাঝি হুঁশিয়ার করে, –নড়বেন না বাবু।

ওদিকে হঠাৎ বড় নৌকো থেকে বোমা জড়ানো হাউই একটা শূন্যে না উঠে কিভাবে নদীর উপর দিয়ে গাইডের মিসাইল-এর মত সোঁ সোঁ শব্দ করে আমাদের নৌকোর দিকেই ধেয়ে আসছে…

হাউইটাকে আসতে দেখে ভাগবত ওই নৌকোর উপর লম্ফ দিয়ে গর্জাচ্ছে-অ্যাই খবরদার!

মাঝি চিৎকার করে ওঠে, –বা-বু–

বাবার সঙ্গে ছেলে মহাভারতও লাফ দিয়ে উঠেছে। ওই বিশাল দুটো মৈনাকের লম্ফে নৌকোটা একদিকে পুরো কাত হয়ে যায়, গড়িয়ে পড়ে চলন্ত পিপের মত টপটপ করে স্বয়ং ভাগবত সরখেল—আরও কজন ৷

আমরাও বেগতিক দেখে নদীতে লাফ দিয়েছি। আমাদের নৌকো কার্নিক খাওয়া কাটা ঘুড়ির মত লাট খেতে খেতে ভেসে চলেছে।

নদীর এদিককার চিৎকার শুনে চাইলাম। নদীর স্রোতে একটা পিপে যেন গড়িয়ে ভেসে চলেছে, কখনও ডুবছে আবার জেগে উঠে শূন্যে দুটো হাত তুলে চিৎকার করে।

হোঁৎকা বলে, –ভাগবতবাবুরে—

ইতিমধ্যে ঘূর্ণিতে পড়ে তখন ভাগবত সরখেল পাক খাচ্ছে। সে চিৎকার করে, –বাঁচা হোঁৎকা বাঁচা। ওরে, খেলার মাঠ তোদেরই দেব।

পটলা নিরাপদ দূরত্বে রয়েছে ওর থেকে। গোবদা হাতে একবার ধরতে পারলে ডুবিয়ে দেবে তাকেও। ডুবন্ত মানুষ আরও বিপজ্জনক।

ভাগবতবাবু ঘূর্ণিতে বনবন করে ঘুরছে, এগিয়ে যাচ্ছে ঘূর্ণির কেন্দ্রের দিকে। দুহাত উপরে তুলে চিৎকার করে, বলেন, –ভাগবতের দিব্যি, ও মাঠ গিয়েই ছেড়ে দেব। বাঁচা-ও ওক্ক…।

পটলা মাছের মত সাঁতরে গিয়ে ভাগবতবাবুর ঘূর্ণায়মান দেহটাকে এক ধাক্কা দিতেই, বয়ার মত ভাসমান দেহটা ঘূর্ণি থেকে ছিটকে বের হয়ে যায়। ওদিকে হোঁৎকা তখন ভাগবতবাবুর কাদামাখা চুল মুঠি করে ধরেছে খপ করে। আমি ও গদাই দুদিকে ভাগবত-এর দুটো হাত ধরেছি। আমরা ভাগবতবাবুকে ভাসিয়ে নিয়ে স্রোতের টানে এবার তীরের দিকে চলেছি।

আমরা নদীর তীরে এনে পুরু পলিকাদার উপর ভাগবতবাবুর বিশাল লাশকে টেনে তুলি। টর্চের আলো পড়ে, লোকজন ছুটে আসে।

—বেইমশাই!

বেয়াইমশাইয়ের দরাজ গলার ডাক শুনে ভাগবতবাবু উঠে বসেন। তাঁর সারা মাথায় মসৃণ প্রলেপ। আদ্দির পাঞ্জাবি জলে ভিজে গায়ে চেপে বসেছে। জুতো নেই, –পায়ে মোজা ঠিক আছে।

গর্জে ওঠে ভাগবতবাবু, –– বেইমশায় অ্যাঁ ডুবিয়ে মারতে চান? মেয়ের বিয়ে দিয়ে আমাকে শেষ করে, আমার সম্পত্তি দখল করার মতলব!

ভদ্রলোক চমকে ওঠেন—সে কী কথা !

ভাগবত সরখেল বলে, – ছেলেরা না থাকলে ডুবেই যেতাম! উঃ এখানে ছেলের বিয়ে দেব না। যাইহোক আমাদের মধ্যস্থতায় শেষপর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই বিয়ের পর্ব মিটে যায়। দুই তরফই খুব খুশি।

ভাগবতবাবু তাঁর কথা রেখেছিলেন। ফিরে এসেই ওই মাঠের দখলস্বত্ব পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবকে লিখে দিয়েছেন। সেদিন ঘটা করে শিল্ড ফাইনালের খেলা হল ওই মাঠেই। প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন ভাগবতবাবু। এবার আর গিরিধারীবাবুকে আমরা ডাকিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *