ক্ষীরো। | ধনী সুখে করে ধর্মকর্ম গরিবের পড়ে মাথার ঘর্ম। তুমি রানী, আছে টাকা শত শত, খেলাছলে কর দান ধ্যান ব্রত– তোমার তো শুধু হুকুম মাত্র, খাটুনি আমারি দিবসরাত্র। তবুও তোমারি সুযশ, পুণ্য– আমার কপালে সকলি শূন্য। |
নেপথ্য। | ক্ষীরি, ক্ষীরি, ক্ষীরো! |
ক্ষীরো। | কেন ডাকাডাকি– নাওয়া-খাওয়া সব ছেড়ে দেব না কি? রানী কল্যাণীর প্রবেশ |
কল্যাণী। | হল কী! তুই যে আছিস রেগেই। |
ক্ষীরো। | কাজ যে পিছনে রয়েছে লেগেই। কতই বা সয় রক্তমাংসে কত কাজ করে একটা মান্ষে! দিনে দিনে হল শরীর নষ্ট। |
কল্যাণী। | কেন, এত তোর কিসের কষ্ট? |
ক্ষীরো। | যেথা যত আছে রামী ও বামী সকলেরি যেন গোলাম আমি। হোক ব্রাহ্মণ, হোক শুদ্দুর, সেবা করে মরি পাড়াশুদ্ধুর। ঘরেতে কারো তো চড়ে না অন্ন, তোমারি ভাঁড়ারে নিমন্তন্ন, হাড় বের হল বাসন মেজে, সৃষ্টির পান-তামাক সেজে। একা একা এত খেটে যে মরি, মায়া দয়া নেই? |
কল্যাণী। | সে দোষ তোরি। চাকর দাসী কি টিঁকিতে পারে তোমার প্রখর মুখের ধারে? লোক এলে তুই তাড়াবি তাদের, লোক গেলে শেষে আর্তনাদের ধুম পড়ে যাবে,–এর কি পথ্যি আছে কোনোরূপ! |
ক্ষীরো। | সে কথা সত্যি। সয় না আমার– তাড়াই সাধে? অন্যায় দেখে পরান কাঁদে। কোথা থেকে যত ডাকাত জোটে, টাকাকড়ি সব দু হাতে লোটে। আমি না তাদের তাড়াই যদি তোমারে তাড়াত আমার বধি। |
কল্যাণী। | ডাকাত মাধবী, ডাকাত মাধু, সবাই ডাকাত, তুমিই সাধু! |
ক্ষীরো। | আমি সাধু! মা গো, এমন মিথ্যে মুখেও আনি নে, ভাবি নে চিত্তে নিই-থুই খাই দু হাত ভরি, দু বেলা তোমার আশিস করি– কিন্তু তবু সে দু হাত -‘পরে দু-মুঠোর বেশি কতই ধরে। ঘরে যত আনো মানুষ-জনকে তত বেড়ে যায় হাতের সংখ্যে। হাত যে সৃজন করেছে বিধি নেবার জন্যে, জান তো দিদি! পাড়াপড়শির দৃষ্টি থেকে কিছু আপনার রাখো তো ঢেকে, তার পরে বেশি রহিলে বাকি চাকর বাকর আনিয়ো ডাকি। |
কল্যাণী। | একা বটে তুমি! তোমার সাথি ভাইপো ভাইঝি নাৎনী নাতি– হাট বসে গেছে সোনার চাঁদের, দুটো করে হাত নেই কি তাঁদের? তোর কথা শুনে কথা না সরে, হাসি পায় ফের রাগও ধরে। |
ক্ষীরো। | বেশি রেগে যদি কম হাসি পেত স্বভাব আমার শুধরিয়ে যেত। |
কল্যাণী। | ম’লেও যাবে না স্বভাবখানি নিশ্চয় জেনো। |
ক্ষীরো। | সে কথা মানি। তাই তো ভরসা মরণ মোরে নেবে না সহসা সাহস করে। ওই-যে তোমার দরজা জুড়ে বসে গেছে যত দেশের কুঁড়ে– কারো বা স্বামীর জোটে না খাদ্য, কারো বা বেটার মামীর শ্রাদ্ধ। মিছে কথা ঝুড়ি ভরিয়া আনে, নিয়ে যায় ঝুড়ি ভরিয়া দানে। নিতে চায় নিক, কত যে নিচ্ছে– চোখে ধুলো দেবে সেটা কি ইচ্ছে? |
কল্যাণী। | কেন তুই মিছে মরিস বকে? ধুলো দেয়, ধুলো লাগে না চোখে। বুঝি আমি সব– এটাও জানি তারা যে গরিব, আমি যে রানি। ফাঁকি দিয়ে তারা ঘোচায় অভাব, আমি দিই– সেটা আমার স্বভাব। তাদের সুখ সে তারাই জানে, আমার সুখ সে আমার প্রাণে। |
ক্ষীরো। | নুন খেয়ে গুণ গাহিত কভু, দিয়ে-থুয়ে সুখ হইত তবু। সামনে প্রণাম পদারবিন্দে, আড়ালে তোমার করে যে নিন্দে! |
কল্যাণী। | সামনে যা পাই তাই যথেষ্ট, আড়ালে কী ঘটে জানেন কেষ্ট। সে যাই হোক গে, শুধাই তোরে কাল বৈকালে বল্ তো মোরে, অতিথিসেবায় অনেকগুলি কম পড়েছিল চন্দ্রপুলি– কেন বা ছিল না রস্করা? |
ক্ষীরো। | কেন করো মিছে মসকরা দিদিঠাকরুন। আপন হাতে গুনে দিয়েছিনু সবার পাতে দুটো দুটো ক’রে। |
কল্যাণী। | আপন চোখে দেখেছি পায় নি সকল লোকে, খালি পাত– |
ক্ষীরো। | ওমা, তাই তো বলি, কোথায় তলিয়ে যায় যে চলি যত সামিগ্রি দিই আনিয়ে। ভোলা ময়রার শয়তানি এ। |
কল্যাণী। | এক বাটি করে দুধ বরাদ্দ, আধ বাটি তাও পাওয়া অসাধ্য। |
ক্ষীরো। | গয়লা তো নন যুধিষ্ঠির। যত বিষ তব কুদৃষ্টির পড়েছে আমারই পোড়া অদৃষ্টে, যত ঝাঁটা সব আমারি পৃষ্ঠে, হায় হায়– |
কল্যাণী। | ঢের হয়েছে, আর না, রেখে দাও তব মিথ্যে কান্না। |
ক্ষীরো। | সত্যি কান্না কাঁদেন যাঁরা ওই আসছেন ঝেঁটিয়ে পাড়া। প্রতিবেশিনীগণের প্রবেশ |
প্রতিবেশিনীগণ। | জয় জয় রানী, হও চিরজয়ী। কল্যাণী তুমি কল্যাণময়ী। |
ক্ষীরো। | ওগো রানীদিদি, শোন্ ওই শোন্, পাতে যদি কিছু হত অকুলোন এত গলা ছেড়ে এত খুলে প্রাণ উঠিত কি তবে জয় জয় তান? যদি দু-চারটে চন্দ্রপুলি দৈবগতিকে দিতে না ভুলি। তা হলে কি আর রক্ষে থাকত, হজম করতে বাপকে ডাকত। |
কল্যাণী। | আজ তো খাবার হয় নি কষ্ট? |
প্রথমা। | কত পাতে পড়ে হয়েছে নষ্ট– লক্ষ্মীর ঘরে খাবার ত্রুটি? |
কল্যাণী। | হাঁ গো, কে তোমার সঙ্গে উটি? আগে তো দেখি নি। |
দ্বিতীয়া। | আমার মধু, তারি উটি হয় নতুন বধূ– এনেছি দেখাতে তোমার চরণে মা জননী। |
ক্ষীরো। | সেটা বুঝেছি ধরনে। |
দ্বিতীয়া। | প্রণাম করিবে এসো এ দিকে এই যে তোমার রানীদিদিকে। |
কল্যাণী। | এসো কাছে এসো, লজ্জা কাদের?
(আংটি পরাইয়া) আহা, মুখখানি দিব্যি ছাঁদের– |
ক্ষীরো। | মুখটি তো বেশ, তা চেয়ে তোমার আংটি সরেশ। |
দ্বিতীয়া। | শুধু রূপ নিয়ে কী হবে অঙ্গে, সোনাদানা কিছু আনে নি সঙ্গে। |
ক্ষীরো। | যাহা এনেছিল সবি সিন্দুকে রেখেছ যতনে, বলে নিন্দুকে। |
কল্যাণী। | এসো ঘরে এসো। |
ক্ষীরো। | যাও গো ঘরে, সোনা পাবে শুধু বাণীর দরে। |
[কল্যাণী ও বধূসহ দ্বিতীয়ার প্রস্থান |
|
প্রথমা। | দেখলি মাগীর কাণ্ড একি। |
ক্ষীরো। | কারে বাদ দিয়ে কারে বা দেখি। |
তৃতীয়া। | তা বলে এতটা সহ্য হয় না। |
ক্ষীরো। | অন্যের বউ পরলে গয়না অন্যের তাতে জ্বলে যে অঙ্গ |
তৃতীয়া। | মাসি, জান তুমি কতই রঙ্গ এত ঠাট্টাও আছে তোর পেটে, হাসতে হাসতে নাড়ী যায় ফেটে। |
প্রথমা। | কিন্তু যা বলো, আমাদের মাতা নাই তাঁর মতো এত বড়ো দাতা। |
ক্ষীরো। | অর্থাৎ কি না এত বড়ো হাবা জন্ম দেয় নি আর কারো বাবা। |
তৃতীয়া। | সে কথা মিথ্যে নয় নিতান্ত। দেখ্-না সেদিন কুশী ও খান্ত কী ঠকান্টাই ঠকালে মা গো! আহা মাসি, তুমি সাধে কি রাগো। আমাদেরই গায়ে হয় অসহ্য। |
চতুর্থী। | বুড়ো মহারাজ যে ঐশ্বর্য রেখে গেছে সে কি এমনি ভাবে পাঁচ ভূতে শুধু ঠকিয়ে খাবে। |
প্রথমা। | দেখলি তো ভাই, কানা আন্দি কত টাকা পেলে। |
তৃতীয়া। | বুড়ি ঠানদি জুড়ে দিলে তার কান্না অস্ত্র, নিয়ে গেল কত শীতের বস্ত্র। |
চতুর্থী। | বুড়ি মাগী তার শীত কি এতই? কাঁথা হলে চলে, নিয়ে গেল লুই। আছে সেটা শেষে চোরের ভাগ্যে– এ যে বাড়াবাড়ি। |
প্রথমা। | সে কথা যাগ্গে। |
চতুর্থী। | না না, তাই বলি হও-নাকো দাতা– তা বলে খাবে কি বুদ্ধির মাথা? যত রাজ্যের দুঃখী কাঙাল যত উড়ে মেড়ো খোট্টা বাঙাল কানা খোঁড়া নুলো যে আসে মরতে বাচ-বিচার কি হবে না করতে? |
তৃতীয়া। | দেখ্-না ভাই, সে গোপালের মাকে দু টাকা দিলেই খেয়ে প’রে থাকে, পাঁচ টাকা তার মাসে বরাদ্দ– এ যে মিছিমিছি টাকার শ্রাদ্ধ। |
চতুর্থী। | আসল কথা কি, ভালো নয় থাকা মেয়েমান্ষের এতগুলো টাকা |
তৃতীয়া। | কত লোকে কত করে যে রটনা– |
প্রথমা। | সেগুলো তো সব মিথ্যে ঘটনা। |
চতুর্থী। | সত্যি মিথ্যে দেব্তা জানে– রটেছে তো কথা পাঁচের কানে, সেটা যে ভালো না। |
প্রথমা। | যা বলিস ভাই, এমন মানুষ ভূভারতে নাই। ছোটো-বড়ো-বোধ নাইকো মনে, মিষ্টি কথাটি সবার সনে। |
ক্ষীরো। | টাকা যদি পাই বাক্স ভরে আমার গলাও গলাবে তোরে। “বাপু’ বললেই মিলবে স্বর্গ, “বাছা’ বললেই বলবি “ধর্ গো’। মনে ঠিক জেনো আসল মিষ্টি– কথার সঙ্গে রুপোর বৃষ্টি। |
চতুর্থী। | তাও বলি, বাপু, এটা কিছু বেশি– সবার সঙ্গে এত মেশামেশি। বড়োলোক তুমি ভাগ্যিমন্ত, সেইমত চাই চাল চলন তো? |
তৃতীয়া। | দেখলি সেদিন শশীর বাঁ গালে আপনার হাতে ওষুধ লাগালে! |
চতুর্থী। | বিধু খোঁড়া সেটা নেহাত বাঁদর, তারে কেন এত যত্ন আদর? |
তৃতীয়া। | এত লোক আছে কেদারের মাকে কেন বলো দেখি দিনরাত ডাকে। গয়লাপাড়ার কেষ্টদাসী তারি সাথে কত গল্প হাসি, যেন সে কতই বন্ধু পুরোনো। |
চতুর্থী। | ওগুলো লোকের আদর কুড়োনো। |
ক্ষীরো। | এ সংসারের ওই তো প্রথা, দেওয়া নেওয়া ছাড়া নেইকো কথা। ভাত তুলে দেন মোদের মুখে, নাম তুলে নেন পরম সুখে। ভাত মুখে দিলে তখনি ফুরোয়, নাম চিরদিন কর্ণ জুড়োয়। |
চতুর্থী। | ওই বউ নিয়ে ফিরে এল নেকী। বধূসহ দ্বিতীয়ার প্রবেশ |
প্রথমা। | কী পেলি লো বিধু, দেখি দেখি দেখি। |
দ্বিতীয়া। | শুধু একজোড়া রতনচক্র। |
তৃতীয়া। | বিধি আজ তোরে বড়োই বক্র। এত ঘটা করে নিয়ে গেল ডেকে, ভেবেছিনু দেবে গয়না গা ঢেকে। |
চতুর্থী। | মেয়ের বিয়েতে পেয়ারী বুড়ি পেয়েছিল হার, তা ছাড়া চূড়ি। |
দ্বিতীয়া। | আমি যে গরিব নই যথেষ্ট, গরিবিয়ানায় সে মাগী শ্রেষ্ঠ; অদৃষ্টে যার নেইকো গয়না গরিব হয়ে সে গরিব হয় না। |
চতুর্থী। | বড়োমান্ষের বিচার তো নেই। কারেও বা তাঁর ধরে না মনেই, কেউ বা তাঁহার মাথার ঠাকুর। |
প্রথমা। | টাকাটা সিকেটা কুমড়ো কাঁকুড় যা পাই সে ভালো, কে দেয় তাই বা। |
দ্বিতীয়া। | অবিচারে দান দিলেন নাই বা। মাথা বাঁধা রেখে পায়ের নীচে ভরি-কত সোনা পেলেম মিছে। |
ক্ষীরো। | মা লক্ষ্মী যদি হতেন সদয় দেখিয়ে দিতেম দান কারে কয়। |
দ্বিতীয়া। | আহা তাই হোক, লক্ষ্মীর বরে তোর ঘরে যেন টাকা নাহি ধরে। |
প্রথমা। | ওলো থাম্ তোরা, রাখ্ বকুনি– রানীর পায়ের শব্দ শুনি। (উচ্চৈঃস্বরে) |
চতুর্থী। | আহা জননীর অসীম দয়া, ভগবতী যেন কমলালয়া। |
দ্বিতীয়া। | হেন নারী আর হয় নি সৃষ্টি, সবা-‘পরে তাঁর সমানে দৃষ্টি। |
তৃতীয়া। | আহা-মরি, তাঁরি হস্তে আসি সার্থক হল অর্থরাশি। কল্যাণীর প্রবেশ |
কল্যাণী। | রাত হল তবু কিসের কমিটি? |
ক্ষীরো। | সবাই তোমারই যশের জমিটি নিড়োতেছিলেন, চষতেছিলেন, মই দিয়ে কষে ঘষতেছিলেন, আমি মাঝে মাঝে বীজ ছিটিয়ে বুনেছি ফসল আশ মিটিয়ে। |
কল্যাণী। | রাত হল, আজ যাও সবে ঘরে। এই ক’টি কথা রেখো মনে করে– আশার অন্ত নাইকো বটে, আর সকলেরই অন্ত ঘটে। সবার মনের মতন ভিক্ষে দিতে যদি হ’ত, কল্পবৃক্ষে ঘুণ ধরে যেত, আমি তো তুচ্ছ। নিন্দে করলে যাব না মুচ্ছো। তবু এ কথাটা ভেবে দেখো দিখি– ভালো কথা বলা শক্ত বেশি কি? [প্রস্থান |
চতুর্থী। | কী বলছিলেম ছিল সেই খোঁজে। |
ক্ষীরো। | না গো না, তা নয়, একটু সে বোঝে– সামনে তোমরা যেটুকু বাড়ালে সেটুকু কমিয়ে আনবে আড়ালে। উপকার যেন মধুর পাত্র হজম করতে জ্বলে যে গাত্র, তাই সাথে চাই ঝালের চাটনি নিন্দে বান্দা কান্না কাটনি। যার খেয়ে মশা ওঠেন ফুলে জ্বালান তারেই গোপন হুলে। দেবতারে নিয়ে বানাবে দত্যি কলিকাল তবে হবে তো সত্যি। |
চতুর্থী। | মিথ্যে না ভাই। সামলে চলিস যাই মুখে আসে তাই যে বলিস। পালন যে করে সে হল মা বাপ, তাহারই নিন্দে সে যে মহাপাপ। এমন লক্ষ্মী এমন সতী কোথা আছে হেন পুণ্যবতী। যেমন ধনের কপাল মস্ত তেমনি দানের দরাজ হস্ত, যেমন রূপসী তেমনি সাধ্বী, খুঁত ধরে তাঁর কাহার সাধ্যি। দিস নেকো দোষ তাঁহার নামে। |
তৃতীয়া। | তুমি থামলে যে অনেক থামে। |
দ্বিতীয়া। | আহা, কোথা হতে এলেন গুরু। হিতকথা আর কোরো না শুরু। হঠাৎ ধর্মকথার পাঠটা তোমার মুখে যে শোনায় ঠাট্টা। |
ক্ষীরো। | ধর্মও রাখো, ঝগড়াও থাক্, গলা ছেড়ে আর বাজিয়ো না ঢাক। পেট ভরে খেলে, করলে নিন্দে, বাড়ি ফিরে গিয়ে ভজো গোবিন্দে। [প্রতিবেশিনীগণের প্রস্থান ওরে বিনি, ওরে কিনি, ওরে কাশী! |
বিনি কিনি কাশীর প্রবেশ |
|
কাশী। | কেন দিদি। |
কিনি। | কেন খুড়ি। |
বিনি। | কেন মাসি। |
ক্ষীরো। | ওরে, খাবি আয়। |
বিনি। | কিছু নেই খিধে। |
ক্ষীরো। | খেয়ে নিতে হয় পেলেই সুবিধে। |
কিনি। | রসকরা খেয়ে পেট বড়ো ভার। |
ক্ষীরো। | বেশি কিছু নয়, শুধু গোটা চার ভোলা ময়রার চন্দ্রপুলি দেখ্ দেখি ওই ঢাকনা খুলি– তাই মুখে দিয়ে, দু-বাটিখানিক দুধ খেয়ে শোও লক্ষ্মী মানিক। |
কাশী। | কত খাব, দিদি, সমস্ত দিন। |
ক্ষীরো। | খাবার তো নয় খিদের অধীন। পেটের জ্বালায় কত লোকে ছোটে, খাবার কি তার মুখে এসে জোটে? দুঃখী গরিব কাঙাল ফতুর চাষাভুষো মুটে অনাথ অতুর কারো তো খিদের অভাব হয় না, চন্দ্রপুলিটা সবার রয় না। মনে রেখে দিস যেটার যা দর– খাবার চাইতে খিদের আদর! হাঁ রে বিনি, তোর চিরুনি রুপোর দেখছি নে কেন খোঁপার উপর? |
বিনি। | সেটা ও পাড়ার খেতুর মেয়ে কেঁদেকেটে কাল নিয়েছে চেয়ে। |
ক্ষীরো। | ওই রে, হয়েছে মাথাটি খাওয়া। তোমারও লেগেছে দাতার হাওয়া। |
বিনি। | আহা, কিছু তার নেই যে মাসি। |
ক্ষীরো। | তোমারই কি এত টাকার রাশি। গরিব লোকের দয়ামায়া রোগ সেটা যে একটা ভারি দুর্যোগ। না না, যাও তুমি মায়ের বাড়িতে– হেথাকার হাওয়া সবে না নাড়িতে। রানী যত দেয় ফুরোয় না, তাই দান করে তার কোনো ক্ষতি নাই! তুই যেটা দিলি রইল না তোর, এতেও মনটা হয় না কাতর? ওরে বোকা মেয়ে, আমি আরো তোরে আনিয়ে নিলেম এই মনে ক’রে কী করে কুড়োতে হইবে ভিক্ষে মোর কাছে তাই করবি শিক্ষে। কে জানত তুই পেট না ভরতে উল্টো বিদ্যা শিখবি মরতে?– দুধ যে রইল বাটির তলায় ওইটুকু বুঝি গলে না গলায়? আমি মরে গেলে যত মনে আশ কোরো দান ধ্যান আর উপবাস। যতদিন আমি রয়েছি বর্তে দেব না করতে আত্মহত্যে।– খাওয়া দাওয়া হল, এখন তবে রাত হল ঢের, শোও গে সবে। [কিনি বিনি কাশীর প্রস্থান কল্যাণীর প্রবেশ ওগো দিদি, আমি বাঁচি নে তো আর। |
কল্যাণী। | সেটা বিশ্বাস হয় না আমার। তবু, কী হয়েছে শুনি ব্যাপারটা। |
ক্ষীরো। | মাইরি দিদি, এ নয়কো ঠাট্টা। দেশ থেকে চিঠি পেয়েছি মামার বাঁচে কি না-বাঁচে খুড়িটি আমার– শক্ত অসুখ হয়েছে এবার, টাকাকড়ি নেই ওষুধ দেবার। |
কল্যাণী। | এখনো বছর হয় নি গত, খুড়ির শ্রাদ্ধে নিলি যে কত। |
ক্ষীরো। | হাঁ হাঁ, বটে বটে, মরেছে বেটী, খুড়ি গেছে তবু আছে তো জেঠি। আহা রানীদিদি, ধন্য তোরে, এত রেখেছিস স্মরণ করে। এমন বুদ্ধি আর কি আছে, এড়ায় না কিছু তোমার কাছে। ফাঁকি দিয়ে খুড়ি বাঁচবে আবার সাধ্য কি আছে সে তাঁর বাবার? কিন্তু কখনো আমার সে জেঠি মরে নি পূর্বে মনে রেখো সেটি। |
কল্যাণী। | মরেও নি বটে, জন্মে নি কভু। |
ক্ষীরো। | এমন বুদ্ধি দিদি তোর, তবু সে বুদ্ধিখানি কেবলই খেলায় অনুগত এই আমারি বেলায়? |
কল্যাণী। | চেয়ে নিতে তোর মুখে ফোটে কাঁটা! না বললে নয় মিথ্যে কথাটা? ধরা পড় তবু হও না জব্দ? |
ক্ষীরো। | “দাও দাও’ ও তো একটা শব্দ, ওটা কি নিত্যি শোনায় মিষ্টি? মাঝে মাঝে তাই নতুন সৃষ্টি করতেই হয় খুড়ি-জেঠিমার। জান তো সকলি তবে কেন আর লজ্জা দেওয়া? |
কল্যাণী। | অমনি চেয়ে কি পাস নি কখনো তাই বল্ দেখি? |
ক্ষীরো। | মরা পাখিরেও শিকার ক’রে তবে তো বিড়াল মুখেতে পোরে। সহজেই পাই, তবু দিয়ে ফাঁকি স্বভাবটাকে যে শান দিয়ে রাখি। বিনা প্রয়োজনে খাটাও যাকে। প্রয়োজনকালে ঠিক সে থাকে। সত্যি বলছি মিথ্যে কথায় তোমারো কাছেতে ফল পাওয়া যায়। |
কল্যাণী। | এবার পাবে না। |
ক্ষীরো। | আচ্ছা, বেশ তো, সেজন্যে আমি নইকো ব্যস্ত। আজ না হয় তো কাল তো হবে, ততখন মোর সবুর সবে। গা ছুঁয়ে কিন্তু বলছি তোমার খুড়িটার কথা তুলব না আর। [কল্যাণীর হাসিয়া প্রস্থান হরি বলো মন। পরের কাছে আদায় করার সুখও আছে, দুঃখও ঢের। হে মা লক্ষ্মীটি, তোমার বাহন পেঁচা পক্ষীটি এত ভালোবাসে এ বাড়ির হাওয়া, এত কাছাকাছি করে আসা-যাওয়া, ভুলে কোনোদিন আমার পানে তোমারে যদি সে বহিয়া আনে মাথায় তাহার পরাই সিঁদুর, জলপান দিই আশিটা ইঁদুর, খেয়ে দেয়ে শেষে পেটের ভারে পড়ে থাকে বেটা আমারই দ্বারে– সোনা দিয়ে ডানা বাঁধাই, তবে ওড়বার পথ বন্ধ হবে। লক্ষ্মীর আবির্ভাব কে আবার রাতে এসেছ জ্বালাতে, দেশ ছেড়ে শেষে হবে কি পালাতে? আর তো পারি নে। |
লক্ষ্মী। | পালাব তবে কি? যেতে হবে দূরে। |
ক্ষীরো। | রোসো রোসো দেখি। কী পরেছ ওটা মাথার ওপর, দেখাচ্ছে যেন হীরের টোপর। হাতে কী রয়েছে সোনার বাক্সে দেখতে পারি কি? আচ্ছা, থাক সে। এত হীরে সোনা কারো তো হয় না– ওগুলো তো নয় গিল্টি গয়না? এগুলি তো সব সাঁচ্চা পাথর? গায়ে কী মেখেছ, কিসের আতর? ভুর্ ভুর্ করে পদ্মগন্ধ– মনে কত কথা হতেছে সন্ধ। বোসো বাছা, কেন এলে এত রাতে? আমারে তো কেউ আস নি ঠকাতে? যদি এসে থাকো ক্ষীরিকে তা হলে চিনতে পার নি সেটা রাখি ব’লে। নাম কী তোমার বলো দেখি খাঁটি। মাথা খাও বোলো সত্য কথাটি। |
লক্ষ্মী। | একটা তো নয়, অনেক যে নাম। |
ক্ষীরো। | হাঁ হাঁ, থাকে বটে স্বনাম বেনাম ব্যবসা যাদের ছলনা করা। কখনো কোথাও পড় নি ধরা? |
লক্ষ্মী। | ধরা পড়ি বটে দুই দশ দিন, বাঁধন কাটিয়ে আবার স্বাধীন। |
ক্ষীরো। | হেঁয়ালিটা ছেড়ে কথা কও সিধে– অমন করলে হবে না সুবিধে। নামটি তোমার বলো অকপটে। |
লক্ষ্মী। | লক্ষ্মী। |
ক্ষীরো। | তেমনি চেহারাও বটে। লক্ষ্মী তো আছে অনেকগুলি, তুমি কোথাকার বলো তো খুলি। |
লক্ষ্মী। | সত্যি লক্ষ্মী একের অধিক নাই ত্রিভুবনে। |
ক্ষীরো। | ঠিক ঠিক ঠিক। তাই বলো মা গো, তুমিই কি তিনি? আলাপ তো নেই, চিনতে পারি নি। চিনতেম যদি চরণ-জোড়া কপাল হত কি এমন পোড়া? এসো, বোসো, ঘর করো’সে আলো। পেঁচা দাদা মোর আছে তো ভোলো? এসেছ যখন, তখন মাতঃ তাড়াতাড়ি যেতে পারবে না তো। জোগাড় করছি চরণ-সেবার; সহজ হস্তে পড় নি এবার। সেয়ানা লোকেরে কর না মায়া কেন যে জানি তা বিষ্ণুজায়া। না খেয়ে মরে না বুদ্ধি থাকলে, বোকারই বিপদ তুমি না রাখলে। |
লক্ষ্মী। | প্রতারণা ক’রে পেটটি ভরাও, ধর্মেরে তুমি কিছু না ডরাও? |
ক্ষীরো। | বুদ্ধি দেখলে এগোও না গো, তোর দয়া নেই কাজেই মা গো। বুদ্ধিমানেরা পেটের দায় লক্ষ্মীমানেরে ঠকিয়ে খায়। |
লক্ষ্মী। | সরল বুদ্ধি আমার প্রিয়, বাঁকা বুদ্ধিরে ধিক্ জানিয়ো। |
ক্ষীরো। | ভালো তলোয়ার যেমন বাঁকা তেমনি বক্র বুদ্ধি পাকা। ও জিনিস বেশি সরল হলে নির্বুদ্ধি তো তারেই বলে। ভালো মা গো, তুমি দয়া করো যদি বোকা হয়ে আমি রব নিরবধি। |
লক্ষ্মী। | কল্যাণী তোর অমন প্রভু তারেও দস্যু, ঠকাও তবু। |
ক্ষীরো। | অদৃষ্টে শেষে এই ছিল মোর– যার লাগি চুরি সেই বলে চোর। ঠকাতে হয় যে কপাল-দোষে তোরে ভালোবাসি বলেই তো সে। আর ঠকাব না, আরামে ঘুমিয়ো– আমারে ঠকিয়ে যেয়ো না তুমিও। |
লক্ষ্মী। | স্বভাব তোমার বড়োই রুক্ষি। |
ক্ষীরো। | তাহার কারণ আমি যে দুঃখী। তুমি যদি কর রসের বৃষ্টি স্বভাবটা হবে আপনি মিষ্টি। |
লক্ষ্মী। | তোরে যদি আমি করি আশ্রয় যশ পাব কি না সন্দেহ হয়। |
ক্ষীরো। | যশ না পাও তো কিসের কড়ি? তবে তো আমার গলায় দড়ি। দশের মুখেতে দিলেই অন্ন দশ মুখে উঠে ধন্য ধন্য। |
লক্ষ্মী। | প্রাণ ধরে দিতে পারবি ভিক্ষে? |
ক্ষীরো। | একবার তুমি করো পরীক্ষে। পেট ভ’রে গেলে যা থাকে বাকি সেটা দিয়ে দিতে শক্তটা কী। দানের গরবে যিনি গরবিনী তিনি হ’ন আমি, আমি হই তিনি, দেখবে তখন তাঁহার চালটা– আমারই বা কত উল্টো-পাল্টা। দাসী আছি, জানি দাসীর যা রীতি– রানী করো, পাব রানীর প্রকৃতি। তাঁরও যদি হয় মোর অবস্থা সুযশ হবে না এমন সস্তা। তাঁর দয়াটুকু পাবে না অন্যে, ব্যয় হবে সেটা নিজেরই জন্যে। কথার মধ্যে মিষ্টি অংশ অনেকখানিই হবেক ধ্বংস। দিতে গেলে, কড়ি কভু না সরবে– হাতের তেলোয় কামড়ে ধরবে। ভিক্ষে করতে, ধরতে দু পায় নিত্যি নতুন উঠবে উপায়। |
লক্ষ্মী। | তথাস্তু, রানী করে দিনু তোকে– দাসী ছিলি তুই ভুলে যাবে লোকে। কিন্তু সদাই থেকো সাবধান, আমার যেন না হয় অপমান। |
দ্বিতীয় দৃশ্য
|
|
রানীবেশে ক্ষীরো ও তাহার পারিষদবর্গ |
|
ক্ষীরো। | বিনি! |
বিনি। | কেন মাসি। |
ক্ষীরো। | মাসি কী রে মেয়ে! দেখি নি তো আমি বোকা তোর চেয়ে। কাঙাল ভিখিরি কলু মালী চাষি তারাই মাসিরে বলে শুধু মাসি। রানীর বোনঝি হয়েছ ভাগ্যে, জান না আদব! মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | রানীর বোনঝি রানীরে কী ডাকে শিখিয়ে দে ওই বোকা মেয়েটাকে। |
মালতী। | ছি ছি, শুধু মাসি বলে কি রানীকে? রানীমাসি বলে রেখে দিয়ো শিখে। |
ক্ষীরো। | মনে থাকবে তো? কোথা গেল কাশী। |
কাশী। | কেন রানীদিদি। |
ক্ষীরো। | চার-চার দাসী নেই যে সঙ্গে? |
কাশী। | এত লোক মিছে কেন দিনরাত লেগে থাকে পিছে? |
ক্ষীরো। | মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | এই মেয়েটাকে শিখিয়ে দে কেন এত দাসী থাকে। |
মালতী। | তোমরা তো নও জেলেনী তাঁতিনী, তোমরা হও যে রানীর নাতিনী। যে নবাববাড়ি এনু আমি ত্যেজি সেথা বেগমের ছিল পোষা বেজি, তাহারি একটা ছোটো বাচ্ছার পিছনেতে ছিল দাসী চার-চার, তা ছাড়া সেপাই। |
ক্ষীরো। | শুনলি তো কাশী? |
কাশী। | শুনেছি। |
ক্ষীরো। | তা হলে ডাক্ তোর দাসী। কিনি পোড়ামুখী! |
কিনি। | কেন রানীখুড়ি? |
ক্ষীরো। | হাই তুললেম, দিলি নে যে তুড়ি! মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | শেখাও কায়দা। |
মালতী। | এত বলি তবু হয় না ফায়দা। বেগমসাহেব যখন হাঁচেন তুড়ি ভুল হলে কেহ না বাঁচেন। তখনি শূলেতে চড়িয়ে তারে নাকে কাঠি দিয়ে হাঁচিয়ে মারে। |
ক্ষীরো। | সোনার বাটায় পান দে তারিণী। কোথা গেল মোর চামরধারিণী? |
তারিণী। | চলে গেছে ছুঁড়ি, সে বলে মাইনে চেয়ে চেয়ে তবু কিছুতে পাই নে। |
ক্ষীরো। | ছোটোলোক বেটী হারামজাদী রানীর ঘরে সে হয়েছে বাঁদি, তবু মনে তার নেই সন্তোষ– মাইনে পায় না ব’লে দেয় দোষ! পিঁপড়ের পাখা কেবল মরতে। মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | মাগীরে ধরতে পাঠাও আমার ছ-ছয় পেয়াদা, না না, যাবে আরো দুজন জেয়াদা। কী বল মালতী। |
মালতী। | দস্তুর তাই। |
ক্ষীরো। | হাতকড়ি দিয়ে বেঁধে আনা চাই। |
তারিণী। | ও পাড়ার মতি রানীমাতাজির চরণ দেখতে হয়েছে হাজির। |
ক্ষীরো। | মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | নবাবের ঘরে কোন্ কায়দায় লোকে দেখা করে? |
মালতী। | কুর্নিস ক’রে ঢোকে মাথা নুয়ে, পিছু হটে যায় মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে। |
ক্ষীরো। | নিয়ে এসে সাথে, যাও তো মালতী, কুর্নিস করে আসে যেন মতি। মতিকে লইয়া মালতীর পুনঃপ্রবেশ |
মালতী। | মাথা নিচু করো। মাটি ছোঁও হাতে, লাগাও হাতটা নাকের ডগাতে। তিন পা এগোও, নিচু করো মাথা। |
মতি। | আর তো পারি নে, ঘাড়ে হল ব্যথা। |
মালতী। | তিন বার নাকে লাগাও হাতটা। |
মতি। | টন্ টন্ করে পিঠের বাতটা। |
মালতী। | তিন পা এগোও, তিন বার ফের্ ধুলো তুলে নেও ডগায় নাকের। |
মতি। | ঘাট হয়েছিল এসেছি এ পথ, এর চেয়ে সিধে নাকে দেওয়া খত। জয় রানীমার, একাদশী আজি। |
ক্ষীরো। | রানীর জ্যোতিষী শুনিয়েছে পাঁজি। কবে একাদশী, কবে কোন্ বার লোক আছে মোর তিথি গোনবার। |
মতি। | টাকাটা সিকেটা যদি কিছু পাই জয় জয় বলে বাড়ি চলে যাই। |
ক্ষীরো। | যদি না’ই পাও তবু যেতে হবে– কুর্নিস করে চলে যাও তবে। |
মতি। | ঘড়া ঘড়া টাকা ঘরে গড়াগড়ি, তবু কড়াকড় দিতে কড়াকড়ি! |
ক্ষীরো। | ঘরের জিনিস ঘরেরই ঘড়ায় চিরদিন যেন ঘরেই গড়ায়। মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | এবার মাগীরে কুর্নিস করে নিয়ে যাও ফিরে। |
মতি। | চললেম তবে। |
মালতী। | রোসো, ফিরো নাকো, তিন বার মাটি তুলে নাকে মাখো। তিন পা কেবল হটে যাও পিছু, পোড়ো না উল্টে মাথা করো নিচু। |
মতি। | হায়, কোথা এনু, ভরল না পেট– বারে বারে শুধু মাথা হল হেঁট। আহা, কল্যাণী রানীর ঘরে কর্ণ জুড়োয় মধুর স্বরে– কড়ি যদি দেন অমূল্য তাই– হেথা হীরে মোতি সেও অতি ছাই। |
ক্ষীরো। | সে ছাই পাবার ভরসা কোরো না। |
মালতী। | সাবধানে হঠো, উল্টে পোড়ো না। |
[মতির প্রস্থান |
|
ক্ষীরো। | বিনি! |
বিনি। | রানীমাসি! |
ক্ষীরো। | একগাছি চুড়ি হাত থেকে তোর গেছে না কি চুরি। |
বিনি। | চুরি তো যায় নি। |
ক্ষীরো। | গিয়েছে হারিয়ে? |
বিনি। | হারায় নি। |
ক্ষীরো। | কেউ নিয়েছে ভাঁড়িয়ে? |
বিনি। | না গো রানীমাসি! |
ক্ষীরো। | এটা তো মানিস পাখা নেই তার। একটা জিনিস হয় চুরি যায়, নয় তো হারায়, নয় মারা যায় ঠগের দ্বারায়, তা না হলে থাকে–এ ছাড়া তাহার কী যে হতে পারে জানি নে তো আর। |
বিনি। | দান করেছি সে! |
ক্ষীরো। | দিয়েছিস দানে? ঠকিয়েছে কেউ, তারই হল মানে। কে নিয়েছে বল্। |
বিনি। | মল্লিকা দাসী। এমন গরিব নেই রানীমাসি! ঘরে আছে তার সাত ছেলে মেয়ে, মাস পাঁচ-ছয় মাইনে না পেয়ে খরচপত্র পাঠাতে পারে না– দিনে দিনে তার বেড়ে যায় দেনা, কেঁদে কেঁদে মরে– তাই চুড়িগাছি নুকিয়ে তাহারে দান করিয়াছি। অনেক তো চুড়ি আছে মোর হাতে, একখানা গেলে কি হবে তাহাতে। |
ক্ষীরো। | বোকা মেয়েটার শোনো ব্যাখ্যানা একখানা গেলে গেল একখানা, সে যে একেবারে ভারি নিশ্চয়। কে না জানে যেটা রাখ সেটা রয়, যেটা দিয়ে ফেল সেটা তো রয় না– এর চেয়ে কথা সহজ হয় না। অল্পস্বল্প যাদের আছে দানে যশ পায় লোকের কাছে– ধনীর দানেতে ফল নাহি ফলে, যত দেও তত পেট বেড়ে চলে– কিছুতে ভরে না লোকের স্বার্থ, ভাবে “আরো ঢের দিতে যে পারত’। অতএব বাছা, হবি সাবধান, বেশি আছে বলে করিস নে দান। মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | বোকা মেয়েটি এ, এর দুটো কথা দাও সমঝিয়ে। |
মালতী। | রানীর বোনঝি রানীর অংশ, তফাতে থাকবে উচ্চ বংশ; দান করা-টরা যত হয় বেশি গরিবের সাথে তত ঘেঁষাঘেঁষি। পুরোনো শাস্ত্রে লিখেছে শোলোক, গরিবের মতো নেই ছোটোলোক। |
ক্ষীরো। | মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | মল্লিকাটারে আর তো রাখা না। |
মালতী। | তাড়াব তাহারে। ছেলেমেয়েদের দয়ার চর্চা বেড়ে গেলে সাথে বাড়বে খরচা। |
ক্ষীরো। | তাড়াবার বেলা হয়ে আনমনা বালাটা-সুদ্ধ যেন তাড়িয়ো না।– বাহিরের পথে কে বাজায় বাঁশি দেখে আয় মোর ছয় ছয় দাসী। |
তারিণীর প্রস্থান ও পুনঃপ্রবেশ |
|
তারিণী। | মধুদত্তর পৌত্রের বিয়ে, ধুম করে তাই চলে পথ দিয়ে। |
ক্ষীরো। | রানীর বাড়ির সামনের পথে বাজিয়ে যাচ্ছে কী নিয়ম-মতে। বাঁশির বাজনা রানী কি সইবে! মাথা ধ’রে যদি থাকত দৈবে? যদি ঘুমোতেন, কাঁচা ঘুমে জেগে অসুখ করত যদি রেগেমেগে? মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | নবাবের ঘরে এমন কাণ্ড ঘটলে কী করে। |
মালতী। | যার বিয়ে যায় তারে ধরে আনে, দুই বাঁশিওয়ালা তার দুই কানে কেবলই বাজায় দুটো-দুটো বাঁশি; তিন দিন পরে দেয় তারে ফাঁসি। |
ক্ষীরো। | ডেকে দাও কোথা আছে সর্দার, নিয়ে যাক দশ জুতোবর্দার– ফি লোকের পিঠে দশ ঘা চাবুক সপাসপ বেগে সজোরে নাবুক। |
মালতী। | তবু যদি কারো চেতনা না হয়, বন্দুক দিলে হবে নিশ্চয়। |
প্রথমা। | ফাঁসি হল মাপ, বড়ো গেল বেঁচে, জয় জয় ব’লে বাড়ি যাবে নেচে। |
দ্বিতীয়া। | প্রসন্ন ছিল তাদের গ্রহ, চাবুক ক’ ঘা তো অনুগ্রহ। |
তৃতীয়া। | বলিস কী ভাই, ফাঁড়া গেল কেটে– আহা, এত দয়া রানীমার পেটে। |
ক্ষীরো। | থাম তোরা, শুনে নিজ গুণগান লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে কান। বিনি! |
বিনি। | রানীমাসি! |
ক্ষীরো। | স্থির হয়ে রবি, ছট্ফট্ করা বড়ো বে-আদবি। মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | মেয়েরা এখনো শেখে নি আমিরি দস্তুর কোনো। |
(বিনির প্রতি) |
|
মালতী। | রানীর ঘরের ছেলেমেয়েদের ছট্ফট্ করা ভারি নিন্দের। ইতর লোকেরই ছেলেমেয়েগুলো হেসেখুশে ছুটে করে খেলাধুলো। রাজারানীদের পুত্রকন্যে অধীর হয় না কিছুরই জন্যে! হাত-পা সামলে খাড়া হয়ে থাকো, রানীর সামনে নোড়ো-চোড়ো নাকো। |
ক্ষীরো। | ফের গোলমাল করছে কাহারা। দরজায় মোর নাই কি পাহারা। |
তারিণী। | প্রজারা এসেছে নালিশ করতে। |
ক্ষীরো। | আর কি জায়গা ছিল না মরতে! |
মালতী। | প্রজার নালিশ শুনবে রাজ্ঞী ছোটোলোকদের এত কি ভাগ্যি! |
প্রথমা। | তাই যদি হবে তবে অগণ্য নোকর চাকর কিসের জন্য। |
দ্বিতীয়া। | নিজের রাজ্যে রাখতে দৃষ্টি রাজারানীদের হয় নি সৃষ্টি। |
তারিণী। | প্রজারা বলছে, কর্মচারী পীড়ন তাদের করছে ভারি। নাই মায়া দয়া, নাইকো ধর্ম, বেচে নিতে চায় গায়ের চর্ম। বলে তারা, “হায় কী করেছি পাপ, এত ছোটো মোরা, এত বড়ো চাপ!’ |
ক্ষীরো। | সর্ষেও ছোটো তবু সে ভোগায়, চাপ না পেলে কি তৈল জোগায়। টাকা জিনিসটা নয় পাকা ফল, টুপ করে খ’সে ভরে না আঁচল, ছিঁড়ে নাড়া দিয়ে ঠেঙার বাড়িতে তবে ও জিনিস হয় যে পাড়িতে। |
তারিণী। | সেজন্যে না মা–তোমার খাজনা বঞ্চনা করা তাদের কাজ না। তারা বলে, যত আমলা তোমার মাইনে না পেয়ে হয়েছে গোঁয়ার। লুটপাট করে মারছে প্রজা, মাইনে পেলেই থাকবে সোজা। |
ক্ষীরো। | রানী বটি, তবু নইকো বোকা, পারবে না দিতে মিথ্যে ধোঁকা। করবেই তারা দস্যুবৃত্তি, মাইনেটা দেওয়া মিথ্যেমিথ্যি। প্রজাদের ঘরে ডাকাতি করে, তা বলে করবে রানীরও ঘরে? |
তারিণী। | তারা বলে রানী কল্যাণী যে নিজের রাজ্য দেখেন নিজে। নালিশ শোনেন নিজের কানেই, প্রজাদের ‘পরে জুলুমটা নেই। |
ক্ষীরো। | ছোটোমুখে বলে বড়ো কথাগুলা, আমার সঙ্গে অন্যের তুলা? মালতী? |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | কী কর্তব্য। |
মালতী। | জরিমানা দিক যত অসভ্য এক-শো এক-শো। |
ক্ষীরো। | গরিব ওরা যে, তাই একেবারে এক-শো’র মাঝে নব্বই টাকা করে দিনু মাপ। |
প্রথমা। | আহা, গরিবের তুমিই মা বাপ। |
দ্বিতীয়া। | কার মুখ দেখে উঠেছিল প্রাতে, নব্বই টাকা পেল হাতে হাতে। |
তৃতীয়া। | নব্বই কেন, যদি ভেবে দেখে– আরো ঢের টাকা নিয়ে গেল ট্যাঁকে। হাজার টাকার ন-শো নব্বই চোখের পলকে পেল সর্বই। |
চতুর্থী। | এক দমে ভাই এত দিয়ে ফেলা অন্যে কে পারে, এ তো নয় খেলা। |
ক্ষীরো। | বলিস নে আর মুখের আগে, নিজগুণ শুনে শরম লাগে। বিনি। |
বিনি। | রানীমাসী! |
ক্ষীরো। | হঠাৎ কী হল। ফোঁস ফোঁস করে কাঁদিস কেন লো। দিনরাত আমি বকে বকে খুন, শিখলি নে কিছু কায়দা কানুন? মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | এই মেয়েটাকে শিক্ষা না দিলে মান নাহি থাকে। |
মালতী। | রানীর বোনঝি জগতে মান্য, বোঝ না এ কথা অতি সামান্য। সাধারণ যত ইতর লোকেই সুখে হাসে, কাঁদে দুঃখশোকেই। তোমাদেরও যদি তেমনি হবে, বড়োলোক হয়ে হল কী তবে। একজন দাসীর প্রবেশ |
দাসী। | মাইনে না পেলে মিথ্যে চাকরি। বাঁধা দিয়ে এনু কানের মাকড়ি– ধার করে খেয়ে পরের গোলামি এমন কখনো শুনি নি তো আমি। মাইনে চুকিয়ে দাও, তা না হলে ছুটি দাও আমি ঘরে যাই চলে। |
ক্ষীরো। | মাইনে চুকোনো নয়কো মন্দ, তবু ছুটিটাই মোর পছন্দ। বড়ো ঝঞ্ঝাট মাইনে বাঁটতে, হিসেব-কিতেব হয় যে ঘাঁটতে। ছুটি দেওয়া যায় অতি সত্বর, খুলতে হয় না খাতাপত্তর– ছ-ছয় পেয়াদা ধরে আসি কেশ, নিমেষ ফেলতে কর্ম নিকেশ। মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | সাথে যাও ওর, ঝেড়ে ঝুড়ে নিয়ো কাপড়চোপড়– ছুটি দেয় যেন দরোয়ান যত হিন্দুস্থানি দস্তুর-মত। |
মালতী। | বুঝেছি রানীজি! |
ক্ষীরো। | আচ্ছা, তা হলে কুর্নিস করে যাক বেটি চলে। |
[কুর্নিস করাইয়া দাসীকে বিদায় |
|
দাসী। | দুয়ারে রানীমা দাঁড়িয়ে আছে কে, বড়োলোকের ঝি মনে হয় দেখে। |
ক্ষীরো। | এসেছে কি হাতি কিম্বা রথে? |
দাসী। | মনে হয় যেন হেঁটে এল পথে। |
ক্ষীরো। | কোথা তবে তার বড়োলোকত্ব? |
দাসী। | রানীর মতন মুখটি সত্য। |
ক্ষীরো। | মুখে বড়োলোক লেখা নাহি থাকে, গাড়িঘোড়া দেখে চেনা যায় তাকে। |
মালতীর প্রবেশ |
|
মালতী। | রানী কল্যাণী এসেছেন দ্বারে রানীজির সাথে দেখা করিবারে। |
ক্ষীরো। | হেঁটে এসেছেন? |
মালতী। | শুনছি তাই তো। |
ক্ষীরো। | তা হলে হেথায় উপায় নাই তো। সমান আসন কে তাহারে দেয়। নিচু আসনটা, সে’ও অন্যায়। এ এক বিষম হল সমিস্যে, মীমাংসা এর কে করে বিশ্বে? |
প্রথমা। | মাঝখানে রেখে রানীজির গদি তাহার আসন দূরে রাখি যদি? |
দ্বিতীয়া। | ঘুরায়ে যদি এ আসনখানি পিছন ফিরিয়া বসেন রানী? |
তৃতীয়া। | যদি বলা যায় “ফিরে যাও আজ– ভালো নেই আজ রানীর মেজাজ’? |
ক্ষীরো। | মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | কী করি উপায়। |
মালতী। | দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যদি সারা যায় দেখাশোনা, তবে সব গোল মেটে। |
ক্ষীরো। | এত বুদ্ধিও আছে তোর পেটে। সেই ভালো। আগে দাঁড়া সার বাঁধি আমার এক-শো পঁচিশটে বাঁদি। ও হল না ঠিক–পাঁচ পাঁচ করে দাঁড়া ভাগে ভাগে– তোরা আয় সরে– না না, এই দিকে– না না, কাজ নেই, সারি সারি তোরা দাঁড়া সামনেই– না না, তা হলে যে মুখ যাবে ঢেকে। কোনাকুনি তোরা দাঁড়া দেখি বেঁকে। আচ্ছা, তা হলে ধরে হাতে হাতে খাড়া থাক্ তোরা একটু তফাতে। শশী, তুই সাজ্ ছত্রধারিণী, চামরটা নিয়ে দোলাও তারিণী। মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | এইবার তারে ডেকে নিয়ে আয় মোর দরবারে। [মালতীর প্রস্থান কিনি বিনি কাশী স্থির হয়ে থাকো– |
কল্যাণী ও মালতীর প্রবেশ |
|
কল্যাণী। | আছ তো কুশলে? |
ক্ষীরো। | আমার চেষ্টা কুশলেই থাকি, পরের চেষ্টা দেবে মোরে ফাঁকি, এই ভাবে চলে জগৎ-সুদ্ধ নিজের সঙ্গে পরের যুদ্ধ। |
কল্যাণী। | ভালো আছ বিনি? |
বিনি। | ভালোই আছি মা, ম্লান কেন দেখি সোনার প্রতিমা! |
ক্ষীরো। | বিনি, করিস নে মিছে গোলযোগ, ঘুচল না তোর কথা-কওয়া রোগ? |
কল্যাণী। | রানী, যদি কিছু না কর মনে, কথা আছে কিছু– কব গোপনে। |
ক্ষীরো। | আর কোথা যাব, গোপন এই তো– তুমি আমি ছাড়া কেহই নেই তো। এরা সব দাসী, কাজ নেই কিছু– রানীর সঙ্গে ফেরে পিছু-পিছু। হেথা হতে যদি করে দিই দূর হবে না তো সেটা ঠিক দস্তুর; কী বল মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে, তাই তো, দস্তুরমত চলাই চাই তো। |
ক্ষীরো। | সোনার বাটাটা কোথায় কে জানে। খুঁজে দেখ্ দেখি। |
দাসী। | এই-যে এখানে। |
ক্ষীরো। | ওটা নয়, সেই মুক্তো-বসানো আরেকটা আছে সেইটেই আনো। [অন্য বাটা-অনয়ন খয়েরের দাগ লেগেছে ডালায়, |
কল্যাণী। | কথাটা আমার নিই তবে বলে। পাঠান বাদশা অন্যায় ছলে রাজ্য আমার নিয়েছেন কেড়ে– |
ক্ষীরো। | বল কী! তা হলে গেছে ফুলবেড়ে, গিরিধরপুর, গোপালনগর কানাইগঞ্জ– |
কল্যাণী। | সব গেছে মোর। |
ক্ষীরো। | হাতে আছে কিছু নগদ টাকা কি। |
কল্যাণী। | সব নিয়ে গেছে, কিছু নেই বাকি। |
ক্ষীরো। | অদৃষ্টে ছিল এত দুখ তোর! গয়না যা ছিল হীরে মুক্তোর, সেই বড়ো বড়ো নীলার কণ্ঠি, কানবালা জোড়া বেড়ে গড়নটি, সেই-যে চুনীর পাঁচনলি হার, হীরে-দেওয়া সিঁথি লক্ষ টাকার– সেগুলো নিয়েছে বুঝি লুটেপুটে? |
কল্যাণী। | সব নিয়ে গেছে সৈন্যেরা জুটে। |
ক্ষীরো। | আহা, তাই বলে, ধনজনমান পদ্মপত্রে জলের সমান। দামি তৈজস ছিল যা পুরোনো চিহ্নও তার নেই বুঝি কোনো? সেকালের সব জিনিসপত্র আসাসোটাগুলো চামরছত্র চাঁদোয়া কানাত– গেছে বুঝি সব? শাস্ত্রে যে বলে ধনবৈভব তড়িৎ সমান, মিথ্যে সে নয়। এখন তা হলে কোথা থাকা হয়। বাড়িটা তো আছে? |
কল্যাণী। | ফৌজের দল প্রাসাদ আমার করেছে দখল। |
ক্ষীরো। | ওমা, ঠিক এ যে শোনায় কাহিনী– কাল ছিল রানী, আজ ভিখারিনি। শাস্ত্রে তাই তো বলে সব মায়া, ধনজন তালবৃক্ষের ছায়া। কী বল মালতী! |
মালতী। | তাই তো বটেই, বেশি বাড় হলে পতন ঘটেই। |
কল্যাণী। | কিছু দিন যদি হেথায় তোমার আশ্রয় পাই, করি উদ্ধার আবার আমার রাজ্যখানি_ অন্য উপায় নাহিকো জানি। |
ক্ষীরো। | আহা, তুমি রবে আমার হেথায় এ তো বেশ কথা, সুখেরই কথা এ। |
প্রথমা। | আহা, কত দয়া! |
দ্বিতীয়া। | মায়ার শরীর! |
তৃতীয়া। | আহা, দেবী তুমি, নও পৃথিবীর। |
চতুর্থী। | হেথা ফেরে নাকো অধম পতিত, আশ্রয় পায় অনাথ অতিথ। |
ক্ষীরো। | কিন্তু একটা কথা আছে বোন! বড়ো বটে মোর প্রাসাদভবন, তেমনি যে ঢের লোকজন বেশি– কোনোমতে তারা আছে ঠেসাঠেসি। এখানে তোমার জায়গা হবে না সে একটা মহা রয়েছে ভাবনা। তবে কিছু দিন যদি ঘর ছেড়ে বাইরে কোথাও থাকি তাঁবু গেড়ে– |
প্রথমা। | ওমা, সে কী কথা! |
দ্বিতীয়া। | তা হলে রানীমা, রবে না তোমার কষ্টের সীমা। |
তৃতীয়া। | যে-সে তাঁবু নয়, তবু সে তাঁবুই, ঘর থাকতে কি ভিজবে বাবুই! |
পঞ্চমী। | দয়া করে কত নাববে নাবোতে, রানী হয়ে কি না থাকবে তাঁবুতে! |
ষষ্ঠী। | তোমার সে দশা দেখলে চক্ষে অধীনগণের বাজবে বক্ষে। |
কল্যাণী। | কাজ নেই রানী, সে অসুবিধায়– আজকের তরে লইনু বিদায়। |
ক্ষীরো। | যাবে নিতান্ত? কী করব ভাই! ছুঁচ ফেলবার জায়গাটি নাই। জিনিসপত্র লোক-লশকরে ঠাসা আছে ঘর–কারে ফস করে বসতে বলি যে তার জোটি নেই। ভালো কথা, শোনো, বলি গোপনেই, গয়নাপত্র কৌশলে রাতে দু-দশটা যাহা পেরেছ সরাতে মোর কাছে দিলে রবে যতনেই। |
কল্যাণী। | কিছুই আনি নি, শুধু হেরো এই হাতে দুটি চুড়ি, পায়েতে নূপুর। |
ক্ষীরো। | আজ এস তবে, বেজেছে দুপুর– শরীর ভালো না, তাইতে সকালে মাথা ধরে যায় অধিক বকালে। মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | জানে না কানাই স্নানের সময় বাজবে সানাই? |
মালতী। | বেটারে উচিত করব শাসন। |
[কল্যাণীর প্রস্থান |
|
ক্ষীরো। | তুলে রাখো মোর রত্ন-আসন– আজকের মতো হল দরবার। মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | নাম করবার সুখ তো দেখলি? |
মালতী। | হেসে নাহি বাঁচি– ব্যাঙ থেকে কেঁচে হলেন ব্যাঙাচি। |
ক্ষীরো। | আমি দেখো বাছা, নাম-করাকরি, যেখানে সেখানে টাকা-ছড়াছড়ি জড়ো করে দল ইতর লোকের জাঁক-জমকের লোক-চমকের যত রকমের ভণ্ডামি আছে ঘেঁষি নে কখনো ভুলে তার কাছে। |
প্রথমা। | রানীর বুদ্ধি যেমন সারালো, তেমনি ক্ষুরের মতন ধারালো। |
দ্বিতীয়া। | অনেক মূর্খে করে দান ধ্যান, কার আছে হেন কাণ্ডজ্ঞান। |
তৃতীয়া। | রানীর চক্ষে ধুলো দিয়ে যাবে হেন লোক হেন ধুলো কোথা পাবে! |
ক্ষীরো। | থাম্ থাম্ তোরা, রেখে যে বকুনি, লজ্জা করে যে নিজগুণ শুনি। মালতী! |
মালতী। | আজ্ঞে। |
ক্ষীরো। | ওদের গয়না ছিল যা এমন কাহারো হয় না। দুখানি চুড়িতে ঠেকেছে শেষে, দেখে আমি আর বাঁচি নে হেসে। তবু মাথা যেন নুইতে চায় না, ভিখ নেবে তবু কতই বায়না। পথে বের হল পথের ভিখিরি, ভুলতে পারে না তবু রানীগিরি। নত হয় লোক বিপদে ঠেকলে, পিত্তি জ্বলে যে দেমাক দেখলে। আবার কিসের শুনি কোলাহল। |
মালতী। | দুয়ারে এসেছে ভিক্ষুকদল– আকাল পড়েছে, চালের বস্তা মনের মতন হয় নি সস্তা, তাইতে চেঁচিয়ে খাচ্ছে কানটা। বেতটি পড়লে হবেন ঠাণ্ডা। |
ক্ষীরো। | রানী কল্যাণী আছেন দাতা। মোর দ্বারে কেন হস্ত পাতা। বলে দে আমার পাঁড়েজি বেটাকে ধরে নিয়ে যাক সকল-ক’টাকে, দাতা কল্যাণী রানীর ঘরে সেথায় আসুক ভিক্ষে করে। সেখানে যা পাবে এখানে তাহার আরো পাঁচ গুণ মিলবে আহার। |
প্রথমা। | হা হা হা, কী মজা হবেই না জানি। |
দ্বিতীয়া। | হাসিয়ে হাসিয়ে মারলেন রানী। |
তৃতীয়া। | আমাদের রানী এতও হাসান! |
চতুর্থী। | দু-চোখ চক্ষু-জলেতে ভাসান। |
দাসীর প্রবেশ |
|
দাসী। | ঠাকরুন এক এসেছেন দ্বারে, হুকুম পেলেই তাড়াই তাঁহারে। |
ক্ষীরো। | না না ডেকে দে-না। আজ কিজন্য মন আছে মোর বড়ো প্রসন্ন। |
ঠাকুরানীর প্রবেশ |
|
ঠাকুরানী। | বিপদে পড়েছি, তাই এনু চলে। |
ক্ষীরো। | সে তো জানা কথা। বিপদে না প’লে শুধু যে আমার চাঁদমুখখানি দেখতে আস নি সেটা বেশ জানি। |
ঠাকুরানী। | চুরি হয়ে গেছে ঘরেতে আমার– |
ক্ষীরো। | মোর ঘরে বুঝি শোধ নেবে তার? |
ঠাকুরানী। | দয়া করে যদি কিছু করো দান এ যাত্রা তবে বেঁচে যায় প্রাণ। |
ক্ষীরো। | তোমার যা-কিছু নিয়েছে অন্যে দয়া চাও তুমি তাহার জন্যে! আমার যা তুমি নিয়ে যাবে ঘরে তার তরে দয়া আমায় কে করে। |
ঠাকুরানী। | ধনসুখ আছে যার ভাণ্ডারে দানসুখে তার সুখ আরো বাড়ে। গ্রহণ যে করে তারি হেঁট মুখ, দুঃখের পর ভিক্ষার দুখ। তুমি সক্ষম, আমি নিরুপায়, অনায়াসে পার ঠেলিবারে পায়। ইচ্ছা না হয় না’ই কোরো দান, অপমানিতেরে কেন অপমান! চলিলাম তবে, বলো দয়া ক’রে বাসনা পুরিবে গেলে কার ঘরে। |
ক্ষীরো। | রানী কল্যাণী নাম শোন নাই? দাতা বলে তাঁর বড়ো যে বড়াই। এইবার তুমি যাও তাঁরি ঘরে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে এসো ভরে, পথ না জান তো মোর লোকজন পৌঁছিয়ে দেবে রানীর ভবন। |
ঠাকুরানী। | তবে তথাস্তু। যাই তাঁরি কাছে। তাঁর ঘর মোর খুব জানা আছে। আমি সে লক্ষ্মী, তোর ঘরে এসে অপমান পেয়ে ফিরিলাম শেষে। এই কথা ক’টি করিয়ো স্মরণ– ধনে মানুষের বাড়ে নাকো মন। আছে বহু ধনী, আছে বহু মানী– সবাই হয় না রানী কল্যাণী। |
ক্ষীরো। | যাবে যদি তবে ছেড়ে যাও মোরে। দস্তুরমত কুর্নিস করে। মালতী! মালতী! কোথায় তারিণী! কোথা গেল মোর চামরধারিণী! আমার এক-শো পঁচিশটে দাসী? তোরা কোথা গেলি বিনি কিনি কাশী! |
কল্যাণীর প্রবেশ |
|
কল্যাণী। | পাগল হলি কি। হয়েছে কী তোর। এখনো যে রাত হয় নিকো ভোর– বল্ দেখি কী যে কাণ্ড কল্লি। ডাকাডাকি করে জাগালি পল্লী! |
ক্ষীরো। | ওমা, তাই তো গা! কী জানি কেমন সারা রাত ধরে দেখেছি স্বপন। বড়ো কুস্বপ্ন দিয়েছিল বিধি, স্বপনটা ভেঙে বাঁচলেম দিদি! একটু দাঁড়াও, পদধূলি লব– তুমি রানী, আমি চিরদাসী তব। |
২৯ অগ্রহায়ণ, ১৩০৪