লক্ষ্মী

লক্ষ্মী

বোর্ডিং-এর মাসিমা মাখনের কৌটো, জ্যামের শিশি, সব জালের আলমারিতে বন্ধ করে বললেন, “লক্ষ্মী বড় দুষ্ট মেয়ে। কেউ এসে খাবার টেবিলে বসবার আগেই কোথাকার এক পাতি বেড়ালকে অর্ধেক মাখন জ্যাম খাইয়ে দিয়েছে। কেন?”

লক্ষ্মী বলল, “ওর যে খিদে পেয়েছিল, ম্যাও-ম্যাও করে কাঁদছিল।”

মাসিমা রেগেমেগে বললেন, “তাহলে বেড়াল নিয়ে আজ তুমি আমার স্নানের ঘরে বন্ধ থাক। আমরা সকলে ঝরনাতলায় চড়ি ভাতি করতে যাচ্ছি।”

শুনে লক্ষ্মী এমনি অবাক হয়ে গেল, সে আর কি বলব। তারপর যখন মণি, ফেণি, ললিতা, বুলু, এমনকী বোকা মুকুল পর্যন্ত মাসিমার সঙ্গে ঝরনাতলায় যাবার জোগাড় করতে লেগে গেল, লক্ষ্মীর মুখে কথা সরে না।

হিংসুটি মালতী একটা টফির বাক্সে শুকনো পাঁউরুটি আর এক বোতল জল স্নানের ঘরের তাকের ওপর রেখে, ফ্যাচ্‌ ফ্যাচ্‌ করে হাসতে হাসতে বলল, “এই রইল তোমার খাবার। আমরা লুচি, কপি ভাজা, আলুর দম আর ক্ষীরের সন্দেশ নিয়ে যাচ্ছি।” তখন তার চুলের মুঠি ধরে দেয়ালে দুবার মাথা ঠুকে দিয়ে, ঠেলে দরজার বাইরে বের করে না দিয়ে লক্ষ্মী করে কী?

মালতীটা এমন ছিঁচকাঁদুনে যে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে করতে অমনি চলল নালিশ করতে।

লক্ষ্মী স্নানের ঘরের দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে, একটা জলচৌকিতে ভাবতে বসল। ভুলে জানলা বন্ধ করেনি, সেখান দিয়ে বড় মেয়ে অনুদিদি যেই না মুখ বাড়িয়ে বলতে শুরু করেছে, “ছিঃ! তোমার কি লজ্জাও নেই! কিন্তু মাসিমা বলেছেন আর যদি কখনো এমন খারাপ কাজ না কর, তাহলে তোমাকে ক্ষমা—” এই অবধি বলে আর কিছু বলা হল না, কারণ টবের হাতলে একটা বড় মাকড়সা বসেছিল, লক্ষ্মী সেটাকে ঠ্যাং ধরে ঝুলিয়ে অনুদির মুখে ছুঁড়ে মারল।

অনুদি আঁউ-আঁউ করতে করতে দৌড়ে পালাল। লক্ষ্মী জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে, তাক-ঢাকা কাগজ পাকিয়ে নল বানিয়ে নলের মাথা ভিজিয়ে সাবানের গায়ে ঘষে, রাশি রাশি ছোট ছোট বুদবুদ ওড়াতে লাগল।

দেখতে দেখতে ঘরময় সাবান-জলের ফোঁটা পড়ে বিশ্রী দেখতে হয়ে গেল। তা ছাড়া আর বুদবুদ ওড়াতে ভালো লাগছিল না। লক্ষ্মী দু-হাত কনুই অবধি ডুবিয়ে জল ঘাঁটতে বসে গেল, কাপড়চোপড় ভিজে চুপ্পুড়।

যাবার আগে মাসিমা নিজে এসে দরজায় ঠেলাঠেলি করতে লাগলেন, “দরজা খোলো, লক্ষ্মীটি, সত্যি কি আর তোমাকে ফেলে যেতে পারি আমরা। ঐ একটু শিক্ষা দিলাম। চলো, আমরা এবার রওনা হব।”।

লক্ষ্মী জানালাটা একটু ফাঁক করে মাসিমাকে কাঁচকলা দেখাল। মাসিমার নরম ফরসা গালটা রাগের চোটে লাল শক্ত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, “বেশ তো তবে থাকো ওখানে!”

বলে বাইরে থেকে দরজা জানলার শিকলি তুলে দিয়ে দুম্‌ দুম্‌ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। একটু পরেই বাইরে ওদের কলকল শব্দ শোনা গেল। সবাই রওনা হয়ে গেল, চৌকিদারের ছেলে সাঁইলা ওদের খাবারদাবার নিয়ে চলল। জানলা ফাঁক করে লক্ষ্মী সব দেখল।

ওরা সত্যি সত্যি চলে গেলে পর বোর্ডিং-বাড়িটা এক্কেবারে চুপচাপ হয়ে গেল। সে কী ভয়ংকর চুপচাপ যে ভাবা যায় না, কানের মধ্যে কী রকম ঝিম-ঝিম শব্দ হতে লাগল। কাঠের সিঁড়ি, কড়ি বরগা থেকে কেমন মট্‌-মট্‌ আওয়াজ শোনা গেল।

চৌকিদার, মালী, এদের ঘর অনেক দূরে, ডাকলেও কেউ শুনতে পাবে না। জ্যেঠি বলে যে বুড়ি ওদের রান্নাবান্না করত, সে-ও এ বেলার মতো কাজ সেরে নিশ্চয় নিজের ঘরে চলে যাবে। তিনটের আগে তার টিকির ডগা দেখা যাবে না। চারটের সময় চড়ি ভাতিওয়ালীরা ফিরবার আগে চা জল-খাবার বানাবে। লক্ষ্মীর কথা হয়তো তার মনেও থাকবে না।

রেগে গিয়ে লক্ষ্মী মাসিমার চুল কালো করার ওষুধের শিশি থেকে সব ওষুধটা নর্দমায় ঢেলে দিয়ে, শিশিটা টবের পিছনে লুকিয়ে রাখল। বুঝুক মাসিমা খারাপ ব্যবহার করার ফল!

টবের পিছনের দেওয়ালটা কিন্তু বেশ অদ্ভুত। রঙটাতে কেমন ছোপ ধরে বিকট সব মুখ হয়ে আছে। এই বাড়িটাই একটু অদ্ভুত, আগে নাকি এখানে এক চা-বাগানের সায়েব থাকত, তার স্ত্রীরা সবাই মরে যেত। তার পর থেকে রাতে কী সব আওয়াজ হত, বড় বাড়িতে চাকর-বাকররা শুতে চাইত না। এ-সব জ্যেঠির মুখে শোনা। শেষটা টিকতে না পেরে বাড়িটা বাস্তু বিভাগকে দান করে সায়েব বিলেত চলে গেল। সে-ও প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলল।

সেই ইস্তক বাড়ি খালি পড়ে ছিল। পয়সা দিলেও কেউ থাকত না। জ্যেঠিকে একশো টাকা দিলেও রাত দশটার পর সে এ-বাড়িতে থাকতে রাজী নয়। দশ বছর আগে মেরামত করে সাজিয়ে-গুজিয়ে এই সরকারি স্কুল হয়েছে। একজন মোটা মন্ত্রী নিজে এসে লাল রেশমী ফিতে কেটে ইস্কুল খুলে দিয়েছিলেন। বড় লোকরা ভালো কাপড়চোপড় পরে, হাততালি দিয়েছিলেন। নতুন চৌকিদাররা মুরগি বলি দিয়ে দেওয়ের পূজো দিয়েছিল। হুঁঃ। তাতে তো ভারি ফল হল! যাক গে জ্যেঠি এ নিয়ে কিছু বলতে চান না। এক্ষুনি মাসিমা আসবেন।

বেড়ালটাকে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না। এই ছিল, এই নেই। ঘরের দরজা-জানলা তো বন্ধ তাহলে সে গেল কোথায়। আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে লক্ষ্মী স্নানের ঘরের বাইরের জানলাটা খুলে চারদিকে দেখতে লাগল। ঠিক সেই সময় রান্নাঘরের দরজা খুলে জ্যেঠি বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে এই বড় একটা তালা লাগিয়ে দিল। তারপর দোতলায় লক্ষ্মীর দিকে চোখ পড়তেই, ঠোঁট কুঁচকে বলল, “নাও এবার বোঝ ঠেলা! রোজ রোজ আমার দুধের সর ছিঁড়ে খাওয়া, ময়লা আঙুলে ময়দা ঘাঁটা, কলের জল খুলে রাখা, এবার বেরুচ্ছে সব!”

শুনে লক্ষ্মী এমনি অবাক হয়ে গেল যে শুধু জিব ভ্যাংচানো ছাড়া কিছু করতেই পারল না। কারণ ও-সব ও মোটেই করেনি। কিন্তু যে করেছে সে বেশ করেছে, খুব ভালো কাজ করেছে, লক্ষ্মী খুব খুশি হয়েছে। জ্যেঠি খোবানি গাছের তলা দিয়ে ঘুরে সামনের গেটের দিকে চলে গেল।

লক্ষ্মী বাইরে চেয়ে রইল। নীল আকাশের ওপর বরফের পাহাড়গুলোকে মনে হচ্ছে আঁকা। রান্নাঘরের পেছনের রাস্তা বেজায় পিছল। তার ওপারে ছোট্ট একটা ঝরনা, অনেক ওপর থেকে পড়ছে। কান খাড়া করলে তার ঝুর-ঝুর শব্দ শোনা যায়। ওর নাম নাকি “মণি-ঝোরা”। জ্যেঠি বলে মনে পাপ থাকলে, মণি-ঝোরার জল খেলেই পেট কামড়ায়।

মণি-ঝোরার দিকে যাওয়া বারণ। অনেক বছর আগে প্রকাণ্ড ধ্বস নেমে মণি-ঝোরার ও-পারের পাহাড়ের গা খসে, বাড়ি-ঘর লোকজন নিয়ে, এক্কেবারে নীচে, সেই সোনোরি-চঙে পড়ে গেছিল। আগে ওখানে নাকি খুব ভালো একটা ফলের বাগান ছিল, মস্ত একটা বাড়ি ছিল, সেখানে দুষ্ট মেয়েদের ভালো হতে শেখানো হত। মাসিমা একদিন বলেছিলেন সেটা এখন থাকলে লক্ষ্মীকে ভরতি করে দিতেন। ভেবেও এমনি রাগ হল লক্ষ্মীর যে মাসিমার সুগন্ধি সাবানটা টবের জলে ফেলে দিয়ে, গোলাপ-এসেন্সের তেলটার অর্ধেক নিজের মাথায় আর পায়ে মেখে ফেলল।

তারপর আবার জলচৌকিতে বসে রইল। হঠাৎ কানে এল বাইরে ধূপধাপ, কল-কল শব্দ। এ আবার কী? অমনি জানালার কাছে গিয়ে দেখে কি না আজ ছুটির দিন এক পাল মেয়ে এসে স্কুল-বাড়ির বাগানে ঢুকেছে। নিশ্চয় পেছনের কাঠের গেট দিয়ে। সামনের দিকে তো চৌকিদারের ঘর। ওদের দেখেই লক্ষ্মীর মনটা খুশি হয়ে ওঠে। মেয়েগুলোর সব কটার দুটো করে বেণী বাঁধা, গায়ে গাঢ় নীল জামা-পরা, এই শীতের দেশেও খালি পা। কিন্তু কী দুষ্ট, কী দুষ্ট! এসেই মাসিমার শাকের গাছ মাড়িয়ে গাঁদাফুল গাছ উপড়ে তরতর করে গাছে চড়ে কাঁচা খোবানি ছিঁড়ে, সে যে কী অসভ্যতা আরম্ভ করে দিল দেখে লক্ষ্মীর চুল খাড়া।

শেষটা আর থাকতে না পেরে ওপর থেকে ডেকে বলল, “অ্যাই অসভ্য মেয়েরা! আমাদের বোর্ডিং-এ এসে কী লাগিয়েছিস? পালা বলছি!”

তাই শুনে ওপর দিকে তাকিয়ে তারা হেসেই কুটোপাটি! “কেন, মারবি নাকি? তাহলে অত বোলচাল না ঝেড়ে নেমে এসে মার না।” এই বলে ভেংচি কেটে, বক দেখিয়ে, এক পায়ে নেচে, দু’কানে দুই বুড়ো আঙুল পুরে আঙুল নেড়ে, যাচ্ছেতাই কাণ্ড বাধাল।

স্নানের ঘরের কাঠের সিঁড়ি দিয়ে যে কটা উঠে আসছিল, লক্ষ্মী তাদের গায়ে এক মগ ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিল। তারা যে কী খারাপ কথা বলতে লাগল সে ভাবা যায় না! তারপর টপটপ করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে এসে, বৃষ্টির জল যাবার পাইপ ধরে ঝুলতে লাগল।

লক্ষ্মী বলল, “আমাকে যদি ছেড়ে দাও, তাহলে আমি আর তোমাদের সঙ্গে ঝগড়া করব না।”

মেয়েগুলো থমকে থেমে গেল। “ঘরে বন্ধ? ছুটির দিনে তোমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছে! কী খারাপ! কী খারাপ! দাঁড়াও এক্ষুনি খুলে দিচ্ছি।” এই বলে পাইপ থেকে দোল খেয়ে দুটো রোগা মেয়ে স্নানের ঘরের জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকল। লক্ষ্মী একেবারে হাঁ! পকেট থেকে পুরনো একটা চাবি বের করে, কাঠের সিঁড়ির মাথায় স্নানের ঘরের বন্ধ দরজায় মাসিমা যে তালা লাগিয়ে গেছিলেন, সেটাকে ক্কট করে খুলে ফেলল।

লক্ষ্মী অবাক হয়ে বলল, “ও কী রকম চাবি ভাই, বিলিতী তালাও খোলে?”

ওরা খিলখিল করে হেসে বলল, “সব তালা খোলে এই চাবি দিয়ে। তোমাদের রান্নাঘরের তালাও!”

লক্ষ্মী যেন আকাশ থেকে পড়ল, “তোমরাই তাহলে জ্যেঠির সব ছেঁড়ো, ময়দা ছড়াও?”

ওরা বেজায় হাসতে লাগল, “তাছাড়া উনুনে জল ঢেলে রাখি, মুরগি ছেড়ে দিই, দুধে তেঁতুল ফেলি, আরো কত কী করি।”

লক্ষ্মী একটু গম্ভীর হয়ে গেল, “কোথায় থাকো তোমরা?”

ওরা বলল, “কেন, আমাদের ইস্কুলে! মণি-ঝোরার ওপারে।”

লক্ষ্মী বলল, “দেখেছ, মাসিমা কী খারাপ! বলে নাকি ওদিকে যেয়ো না, ওদিকে কিচ্ছু নেই।”

মেয়েগুলো এ-ওকে ঠেলা দিয়ে বলল, “কিছু নেই তো, তুমি দেখবে চলো।”

তাই নিয়ে গেল ওরা পেছনের পিছল রাস্তা দিয়ে, মণি-ঝোরার ঝরনার ঠিক মাথার ওপর দিয়ে। সেখানে দাঁড়িয়ে সবাই আঁজলা আঁজলা জল খেয়ে নিল। তারপর খাড়া খানিকটা পাহাড় বেয়ে উঠল। সেখানে ঝোপে-ঝাড়ে থোপা-থোপা লাল কালো বেরি হয়েছিল। কী মিষ্টি, কী মিষ্টি! একটাতেও পোকা নেই। তাই শুনে মেয়েগুলো কী খুশি! “ঠিক তাই! একটা খারাপ জিনিস পাবে না আমাদের ইস্কুলে।”

বাস্তবিকই তাই। চারদিকে ফুল-ফলের বাগান ফুটফুট করছে। গাছে গাছে পাকা কমলা, কলা, আপেল, ঝোপেঝাপে লাল, সাদা, গোলাপী, হলদে গোলাপ ফুল। মস্ত লম্বা একটা একহারা বাড়ি। তার সব দরজা-জানলা খোলা।

ঘরের মধ্যে তাকের ওপর সারি সারি ছবির বই, গল্পের বই, বোয়াম-বোঝাই লজঞ্জুস, টফি, ভাজা মশলা, কুলের আচার, চীনেবাদামের তক্তি, আমসত্ত্ব। যার যত খুশি নাও আর খাও।

চারদিকে কত কুকুর, কত বেড়াল, কত ছাগলছানা, কত মুরগির বাচ্চা। কেউ বন্ধ নেই, সবাই ছাড়া। তাদের মধ্যে সেই পাতি বেড়ালটাও ছিল।

লক্ষ্মী একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, “আমরা মণি-ঝোরার জল খেলাম, পেট-ব্যথা করবে না?” ওরা বলল, “দূর বোকা! ব্যথা তো থাকে পেটে, জলে থাকবে কেন?” তাইতো, এ-কথা তো লক্ষ্মীর আগে মনে হয়নি।

লক্ষ্মী তখন বলল, “তোমরা বড় ভালো, তোমাদের নাম কী ভাই?” ওরা বলল, “আমরা তোমার বন্ধু।”

বলে তরতর করে এক গাছে উঠে, ডাল ধরে ঝুলে আরেক গাছ দিয়ে নামল। ওরা নাকি খিদে পেলেই খায় আর ঘুম পেলেই ঘুমোয়।

লক্ষ্মী বলল, “তাহলে পড় কখন?” ওরা হেসেই কুটোপাটি, “কী যে বলো! দুষ্টু মেয়েরা আবার পড়ে নাকি? যে বইতে ছবি নেই, সে-বই আমরা পড়ি না। আর যে বইতে ছবি আছে, সে-বই তো পড়ার বই নয়। তবে আর পড়াশুনোর কথা কেন বল!” এই বলে দৌড়, দৌড়, দৌড়! যাদের সাহস বেশি তারা মণি-ঝোরার জলের ধারা বেয়ে বেয়ে নীচে নেমে যেতে লাগল, আবার জলের ধারের রডোডেনড্রন গাছের ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে ফিরে এল।

শেষটা কখন যে বিকেল হয়ে এল লক্ষ্মীর খেয়াল নেই। যেই না গুম্ফার লামা ঘণ্টা পিটল, অমনি লক্ষ্মী লাফিয়ে উঠল, এই রে! চারটে বাজে যে। মাসিমারা এক্ষুনি ফিরবেন।

ওরা সবাই হাসতে হাসতে ওকে হাত ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে বোর্ডিং-এর মাসিমার স্নানের ঘরের কাঠের সিঁড়ির ওপরে পৌঁছে দিয়ে বলল, “তুমি একটু বসো! আমরা সব সাফ করে দিই।” এই বলে তারা স্নানের ঘরে ঢুকে গেল।

লক্ষ্মী বলল, “ওরা ধরে ফেলত।” মাসিমা হেসে বললেন, “কারা ধরত রে? কাঠের সিঁড়িতে ওর পাশে বসে পড়ে, ওর পিঠে হাত রেখে বললেন, “ও মা! কোথায় যাব। একলা একলা সারাদিন কাটল, এখন সিঁড়ির মাথায় বেড়ালকোলে ঘুমিয়ে রইলি। যদি গড়িয়ে পড়ে যেতিস?”

লক্ষ্মী বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। মাসিমার ডাকে ওর ঘুম ভাঙল। মাসিমা, “স্বপ্ন দেখছিলি বুঝি? চল, মাংসের সিঙ্গাড়া কিনে এনেছি। সারাদিন কিছু খায়নি, আহা রে যাই! স্নানের ঘরে তালা দিতে ভুলে গেছিলাম নিশ্চয়ই, পালিয়ে যাসনি যে বড়?”

বেড়ালটা বলল, ‘মিউ’। অর্থাৎ, পালিয়ে গেছিল বৈকী!

স্নানের ঘরের ভিতরটা পরিষ্কার ঝকঝক করছিল। যেটি যেমন ছিল ঠিক তেমনটি আছে। তাকের ওপর চুল-কালো-করার-ওষুধের শিশিটাও। মাসিমা জল গরম করে ওর হাত মুখ ধোয়ালেন। বললেন, “কী জানি, চোখটা কেমন চকচক করছে, জ্বরটর আসবে না তো। তুই বরং শুয়ে থাক, আমি তোর লুচি, কপিভাজা, আলুর দম, ক্ষীরের সন্দেশ রেখে গেছিলাম যে। শিকলি তো লাগাইনি, ডুলিতে দেখলি না কেন?”

আরো পরে জ্যেঠি খাবার নিয়ে এসে, ওর থুতনির নীচে আঙুল রেখে, চোখের দিকে চেয়ে বলল, “জ্বর না আরো কিছু! তুমি মণি-ঝোরার জল খেয়েছ, এবার থেকে তুমি যা নেই তাই দেখবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *