লক্কর ঝক্কর

লক্কর ঝক্কর 

সকাল বেলা দাদি দই আর চিড়া দিয়ে নাশতা করে তার চায়ের কাপটাতে চুমুক দিয়ে ভুরু কুঁচকে তার ওষুধের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে অনেকটা আপন মনে বললেন, “আমি কি ওষুধ খেয়েছি?” 

ঝুমু খালা টেবিলে পানি রাখছিল, সে বলল, “খালা, সেইটা তো আমি খেয়াল করি নাই।” 

“মনে হয় খেয়েছি। তাই না? এই দেখো পানির গ্লাসটা খালি। তার মানে ওষুধ খেয়ে পানি খেয়েছি তাই গ্লাসটা খালি।” 

ঝুমু খালা বলল, “আপনি পানি খাইছেন কি না সেইটা মনে আছে?”

“না। সেইটাও মনে নাই। কিছুই মনে থাকে না।” 

মুনিয়া কাছে দাঁড়িয়ে দাদির (কিংবা নানির) সাথে ঝুমু খালার কথা শুনছিল, এবারে বলল, “দাদি, তোমার কিছুই মনে থাকে না কেন? আমার যদি একটা ওষুধ খেতে হয় সেটা সারা জীবন মনে থাকে।”

ঝুমু খালা বলল, “তোমার সারা জীবন মনে থাকে কারণ তোমার পিছন পিছন দৌড়াইয়া তোমারে ধরে চিৎ কইরা ফালাইয়া চাইরজন মিলে তোমার মুখ হা করে জোর কইরা ওষুধ খাওয়াইতে হয়। আর খালা প্রত্যেক দিন সকালে আর রাত্রে ওষুধ খায়, সেই জন্য তার মনে থাকে না—” 

দাদি বললেন, “ওইগুলা কিছু না। আমার বয়স হয়েছে। বয়স হলে মানুষের কিছু মনে থাকে না।” 

মুনিয়া বলল, “কেন দাদি? বয়স হলে কিছু মনে থাকে না কেন?”

“মনে হয় মগজ দুর্বল হয়ে যায়।” 

“কেন দাদি? মগজ দুর্বল হয় কেন?” 

দাদি মাথা নেড়ে বললেন, “মনে হয় কাজ করতে করতে মগজ দুর্বল হয়ে যায়। দেখিস না পুরানো বাস কীরকম লক্কর ঝক্কর মার্কা থাকে? সেই রকম। মানুষও লক্কর ঝক্কর হয়ে যায়।“

উত্তরটা মুনিয়ার পছন্দ হলো না, বলল, “না দাদি। তুমি মোটেও লক্কর ঝক্কর না! তুমি কোনোদিন লক্কর ঝক্কর হবে না।” 

দাদি হাসলেন। বললেন, “বলে লাভ নাই—মানুষের বয়স হলে লক্কর ঝক্কর হবেই, তারপর একদিন মানুষের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে।“

মুনিয়া আঁতকে উঠল, বলল, “তোমার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে?”

“হবে না? একদিন ইঞ্জিন বন্ধ হবে।” 

মুনিয়া মুখ শক্ত করে বলল, “না দাদি তোমার ইঞ্জিন বন্ধ করতে পারবে না। তোমাকে সবসময় তোমার ইঞ্জিন চালাতে হবে।” 

দাদি মুনিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। তাই তাড়াতাড়ি বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি আমার ইঞ্জিন চালিয়ে যাব।” 

ঝুমু খালা হাত নেড়ে তার প্যাটেন্ট কারা স্টাইলে ঝংকার দিয়ে বলল, “কিন্তু খালা যদি তার প্রেশারের ওষুধ খাইতে ভুইলা যায় তাহলে ইঞ্জিল চলবে কেমন করে? ইঞ্জিল কি এমনি এমনি চলে? ইঞ্জিলের মাঝে পেট্রল দিতে হয়।” 

মুনিয়া বলল, “ঝুমু খালা, তুমি ইঞ্জিনকে ইঞ্জিল কেন বল? আর দাদিরে তুমি কেমন করে পেট্রল দিবে?” 

ঝুমু খালা হেসে ফেলল, বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে। ইঞ্জিল না ইঞ্জিন। আর তোমার দাদুরে আমি পেট্রল দিব না। হেই তো খালি তোমার দাদু না, হেই আমারও খালা। তোমার দাদুরে আমি দেইখা শুইনা রাখব যেন ইঞ্জিন বন্ধ না হয়। ঠিক আছে?” 

মুনিয়া বলল, “ঠিক আছে। থ্যাংকু ঝুমু খালা।”

.

মুনিয়া যদিও ঝুমু খালার উপর দাদির ইঞ্জিন চালু রাখার দায়িত্ব দিয়ে চলে গেল কিন্তু দাদির কথাগুলো তার মাথার মাঝে কুটুর কুটুর করতে লাগল। তাই অন্য বাচ্চাদের কাছে সে তার দুশ্চিন্তার কথাটা জানাল। 

মুনিয়া যেহেতু ছোট তাই তার কথাবার্তাকে সাধারণত কেউ বেশি গুরুত্ব দেয় না, কিন্তু দাদিকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তাটাকে সবাই খুব গুরুত্ব দিয়ে নিল। 

শাহানাপু বলল, “বয়স হলে ভুলে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তখন ব্রেনের হিপোকাম্পাস ছোট হতে থাকে। হিপোকাম্পাস মেমোরি তৈরি করে। সাথে নিউরোট্রান্সমিটারও কমে যায়।” 

শাহানাপুর কথা কেউ কিছু বুঝল না কিন্তু বোঝার জন্য কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করল না, তাহলে শাহানাপু আরও জটিল কিছু বলে ফেলবে। 

মুনিয়া বলল, “দাদি তার ওষুধ খেয়েছে কি না সেটাও মনে রাখতে পারে না। আমি কোনোদিন ভুলি না—” 

শান্ত বলল, “তুই ভুলিস না কারণ তোকে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য সবাই মিলে যুদ্ধ করতে হয়—চারজন মিলে তোকে চেপে ধরে রাখতে হয়। তারপর চামুচে করে মুখে ওষুধ ঢালতে হয়।” 

টুম্পা বলল, “তারপর তুই যখন চিৎকার করিস, ওষুধটা তোর নাক দিয়ে বের হয়ে আসে।” 

টুনি বলল, “এইভাবে ওষুধ খেলে সবার মনে থাকত।” 

মুনিয়ার মুখটা হঠাৎ একশ ওয়াট বালবের মত জ্বলে উঠল, বলল, “আমরা সবাই মিলে দাদিকে এইভাবে ওষুধ খাওয়াই না কেন? তাহলে দাদি কখনও ভুলে যাবে না।” 

সবাই অবাক হয়ে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রমি বলল, “তোকে যেভাবে খাওয়ানো হয় সেইভাবে?” 

মুনিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।” 

“প্রথমে সবাই মিলে দাদিকে ধাওয়া করব, তারপর দাদিকে চোপ ধরে মুখ হা করে ওষুধ ঢেলে দিব? তারপর দাদি চিৎকার করবে আর তখন নাক দিয়ে ট্যাবলেটটা বের হয়ে আসবে?” 

এবারে মুনিয়াকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল, পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করে নিজেই বুঝতে পারল তার জন্য যে পদ্ধতিটা কাজ করেছে, দাদির বেলায় সেটা কাজ নাও করতে পারে। 

কিন্তু শান্ত হঠাৎ করে বলল, “মুনিয়া আসলে ভুল বলে নাই।” 

সবাই অবাক হয়ে শান্তর দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “ভুল বলে নাই?” 

শান্ত মুনিয়ার পক্ষ নিয়ে বলল, “মুনিয়া বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, দাদির ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারটার মাঝে যদি একটা নাটকীয় ঘটনা থাকে তাহলে দাদি সেটা ভুলবে না।” 

“যে রকম?” 

“মনে কর দাদি ঠিক যখন ট্যাবলেটটা মুখে দিচ্ছে তখন আমরা সবাই চিৎকার করে উঠলাম! দাদি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? আমরা বললাম, কিছু হয় নাই—তুমি ওষুধ খাচ্ছ! তাহলে দাদি ওষুধ খাওয়ার ঘটনাটা ভুলবে না!” 

সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল, প্রমি বলল, “আমরা প্রত্যেকদিন দাদির ওষুধ খাওয়ার সময় চিৎকার করব?” 

“প্রত্যেক বার চিৎকার না, একেকবার একেকটা। কোনোবার চিৎকার, কোনোবার গান, কোনোবার নাচ, কোনোবার একটা ঘণ্টা বাজানো এইরকম।”

সবাই এত অবাক হয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল যে, শান্ত শেষ পর্যন্ত বলল, “ঠিক আছে, সবাইকে করতে হবে না। যার ইচ্ছে করবে সে করবে।” 

টুম্পা বলল, “আমি করব।” 

মুনিয়া বলল, “আমি করব।” 

শান্ত খুশি হয়ে বলল, “এই তো দুইজন দিয়ে শুরু করলেই হবে। আস্তে আস্তে অন্য সবাই যোগ দিবে। আমিও যোগ দিব।” 

মুনিয়া শাহানাপুকে জিজ্ঞেস করল, “শাহানাপু, দাদি বলছে বয়স হয়েছে বলে দাদির শরীর নাকি লক্কর ঝক্কর হয়ে গেছে। দাদির লক্কর ঝক্কর শরীর কেমন করে ঠিক করা যায়?” 

শাহানাপু মাথা চুলকালো, বলল, “বয়সের তুলনায় দাদির শরীর যথেষ্ট ভালো। এখনও দাদি ঘুরাঘুরি করে সবার খোঁজখবর নেয়। মোটেও বুড়ো মানুষের মত ঘরে বসে থাকে না।” 

শান্ত বলল, “চুং চাং নামে একরকম চাইনিজ চা আছে যেটা খেলে আয়ু বাড়ে। এইজন্য চাইনিজরা দুইশ আড়াইশ বছর বাঁচে।” 

শাহানাপু ধমক দিয়ে বলল, “চাইনিজরা মোটেও দুইশ আড়াইশ বছর বাঁচে না। আমি চুং চাং নামে কোনো চায়ের নাম শুনি নাই। 

শান্ত বলল, “ঠিক আছে চুং চাং না হলে টুং টাং হবে। কিংবা ভুং চাং—কিছু একটা হবে।” 

টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, তুমি কোথায় কী পড় তার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই।”

প্রমি বলল, “আমি পড়েছি আয়ু বাড়াতে হলে ভালো করে ঘুমাতে হয় আর বেশি করে হাসতে হয়।” 

শাহানাপু বলল, “এইটা ঠিক আছে। একজন মানুষ যদি হাসিখুশি থাকে, শান্তিমত ঘুমায় তাহলে তার আয়ু বেশি হতেই পারে।” 

মুনিয়া বলল, “তাহলে আমরা দাদিকে হাসিখুশিও রাখতে পারি।”

শাহানাপু বলল, “সেটা কীভাবে করবি!” 

মুনিয়া মাথা চুলকালো। তখন শান্ত বলল, “আমার কাছে এক হাজার একটা জোকসের বই আছে, সেখান থেকে প্রত্যেকদিন দাদিকে জোকস পড়ে শুনাতে পারি।” 

মুনিয়া হাতে কিল দিয়ে বলল, “এইটাই সবচেয়ে ভালো।” তারপর শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল, “জোকসগুলি হাসির তো?” 

টুনি মাথা নেড়ে বলল, “শান্ত ভাইয়ার থেকে কোনো জোকসের বই নিবি না মুনিয়া, দেখবি সব আজেবাজে জোকস। আউলফাউল জোকস।” 

শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, “তুই জানিস না জোকস যত আউলফাউল হয় তত হাসির হয়?” 

“তাই বলে মুনিয়া দাদিকে আউলফাউল জোকস শুনাবে? কক্ষনো না।” টুনি মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোকে জোকস বলে দিব, মুনিয়া তুই দুশ্চিন্তা করিস না।” 

মুনিয়া কৃতজ্ঞ হয় বলল, “থ্যাংকু টুনি আপু।” 

পরদিন সকালে দেখা গেল দাদি তার ওষুধের প্যাকেটটি সামনে রেখে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। ঝুমু খালা এক সময় জিজ্ঞেস করল, “আপনি ওষুধ খাইছেন?” 

“না, এখনও খাই নাই। মুনিয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।” 

ঝুমু খালা অবাক হয়ে বলল, “মুনিয়ার জন্য অপেক্ষা করতেছেন? কেন?” 

“কাল রাত্রে আমাকে বলে রেখেছে সকালে সে না আসা পর্যন্ত আমি যেন ওষুধ না খাই।” 

ঝুমু খালা আরও অবাক হল, বলল, “কেন?” 

“জানি না।” 

ঝুমু খালা মাথা নেড়ে বলল, “এই বাসার পোলাপানের সমস্যাটা কী? আপনি একজন বুড়া মানুষ, কেনি আঙুলের সমান একটা বাচ্চা হুকুম না দিলে ওষুধটাও খাইতে পারবেন না? খালা, আপনি মনে হয় পোলাপানগো বেশি লাই দিতাছেন।” 

দাদি হাসলেন, বললেন, “এই পোলাপান ছাড়া আমার আছে কে? দেখি মুনিয়ার ঘটনাটি কী?” 

কিছুক্ষণ পর মুনিয়াকে দেখা গেল। ঘুম ঘুম চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। তার দুই হাতে দুটো বড় বড় ডেকচির ঢাকনা। সে এসে দাদির (কিংবা নানি) কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “দাদি, তুমি কি ওষুধ খেয়ে ফেলেছ?” 

দাদি বললেন, “না। এখনও খাই নাই।” 

“এখনই খেয়ো না, আমি যখন বলব তখন খেয়ো।” 

“ঠিক আছে।” 

মুনিয়া তখন তার হাতের ঢাকনা দুটো একটার সাথে আরেকটার ঠোকা দিয়ে বিকট ঝনঝন আওয়াজ করতে থাকে এবং এই শব্দ শুনে বাসার আরো কিছু মানুষ এসে উঁকি দেয়। মুনিয়া এক সময় শব্দ বন্ধ করে চিৎকার করে বলল, “এখন দাদি ওষুধ খাবে!” 

দাদি তার চোখ কপালে তুলে বললেন, “খাব? ওষুধ খাব?”

“হ্যাঁ দাদি খাও।” 

দাদি ওষুধ খেলেন। তখন মুনিয়া আবার চিৎকার করে বলল, “দাদি এইমাত্র তার ওষুধ খেয়েছেন।” 

তারপর আবার সে ঢাকনা দুটো একটার সাথে আরেকটা ঠুকে বিকট ঝনঝন শব্দ করতে থাকে। সবাই অবাক হয়ে মুনিয়ার কর্মকাণ্ড দেখতে থাকে। মুনিয়া এক সময় তার বিকট ঝনঝনানি বন্ধ করল। তারপর আবার ঘুম ঘুম চোখে যেভাবে এসেছিল সেভাবে ফিরে যেতে লাগল। মনে হয় তার অসমাপ্ত ঘুম সমাপ্ত করার জন্য। 

দাদি এত অবাক হয়েছেন যে, কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে কী ঘটেছে। যখন বুঝতে পারলেন তখন মুনিয়াকে ডাকলেন, “এই মুনিয়া শুনে যা।” 

মুনিয়া দাঁড়াল বলল,”কী হয়েছে?” 

“তুই এটা কী করলি? কেন করলি?” 

“মনে নাই, তুমি বলেছিলে যে ওষুধ খেয়েছ কি না তোমার মনে থাকে না? এখন থেকে তুমি আর ভুলবে না।”

দাদি বললেন, “প্রত্যেক দিন তুই এসে বাজনা বাজাবি?” 

“না। একেকদিন একেকজন আসবে।” 

দাদি বললেন, “কিন্তু কিন্তু—” কথা শেষ না করে কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বললেন, “কিন্তু কেন?” 

“মনে নাই তুমি বলেছিলে তোমার শরীর লক্কর ঝক্কর হয়ে যাচ্ছে? ঠিকমত ওষুধ খেলে লক্কর ঝক্কর হবে না।’ 

মুনিয়ার কথা শুনে দাদির চোখে পানি এসে গেল। নরম গলায় বলল, “মুনিয়া আমার কাছে আয়।” 

মুনিয়া কাছে এলে দাদি তাকে ধরে তার কানে ফিসফিস করে বললেন, “শোন তোকে গোপন কথা বলি। তোদের মত নাতি নাতনি যাদের আছে, ওষুধ না খেলেও তাদের শরীর কোনোদিন লক্কর ঝক্কর হয় না।” 

মুনিয়া চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি? সবাই যে বলে আমরা তোমাকে শান্তিমত থাকতে দিই না!” 

“ওরা কী জানে? ওরা কিছু জানে না!” 

মুনিয়া তখন দাঁত বের করে হেসে তার ঢাকনা দুইটা নিয়ে ঘুমুতে চলে গেল। 

.

ঘণ্টাখানেক পরে টুম্পা হাতে একটা মোটা বই নিয়ে দাদির কাছে হাজির হল। দাদি বললেন, “কী খবর টুম্পা? সকাল বেলা এখানে কী করিস? স্কুল যাবি না?” 

“যাব নানু। যাওয়ার আগে একটা কাজ করে যাই তোমার সাথে।”

“কী কাজ?” 

“তোমার দুই মিনিট সময় আছে?” 

“আছে।” 

“তাহলে শোনো।”

“কী শুনব।” 

“একটা জোকস।” 

দাদি চোখ বড় বড় করে বললেন, “জোকস? এই সকালে জোকস শুনব?” 

“হ্যা নানু। এই দেখ এইটা জোকসের বই। টুনি আপা দিয়েছে।”

টুম্পা তখন জোকসটা পড়তে শুরু করল : 

একজন মহিলা একদিন একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার সমস্যা কী?” 

মহিলা বললেন, “আসলে সমস্যা আমার নয়। সমস্যা আমার স্বামীর।” 

সাইকিয়াট্রিস্ট জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার স্বামীর কী সমস্যা?” 

মহিলা বললেন, “আমার স্বামী মনে করে সে একটি ফ্রীজ।”

সাইকিয়াট্রিস্ট খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “আপনার স্বামী যদি নিজেকে ফ্রীজ মনে করে তাহলে আপনার কী সমস্যা?” 

মহিলা বললেন, “আমার স্বামী রাত্রে মুখ হা করে ঘুমায়। তখন তার মুখের ভিতর আলো জ্বলে, সেই আলোতে আমি ঘুমাতে পারি না।”

টুম্পা পড়া শেষ করে দাদির মুখের দিকে তাকালো এবং দাদি হি হি করে হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, “তোর এই বইয়ে এইরকম হাসির জোকস আছে?” 

“হ্যাঁ।” 

“আমাকে দিস, যখন কাজকর্ম থাকবে না, তখন পড়ব।” 

তোমার পড়তে হবে না নানু, আমরা প্রত্যেকদিন পড়ে শোনাব। “ দাদি ভুরু কুঁচকালেন, “তোরা প্রত্যেক দিন পড়ে শোনাবি?” 

“হ্যাঁ, নানু।” 

“কেন?” 

“একজন মানুষ যদি হাসে তাহলে তার আয়ু বাড়ে। সেইজন্য আমরা ঠিক করেছি এখন থেকে আমরা তোমাকে জোকস পড়ে শোনাব।” 

দাদি কিছুক্ষণ টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর নরম গলায় বললেন, “টুম্পা, কাছে আয়।” 

টুম্পা কাছে গেল, দাদি তখন টুম্পাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তোদের হয়েছেটা কী? হঠাৎ করে তোরা আমার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে গেলি।” 

টুম্পা বলল, “তুমি নাকি বলেছ তোমার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে।” 

দাদি হাসলেন, “এইটা একটা কথার কথা। এইটা শুনে তোরা সব এত ঘাবড়ে গেলি? তোদের ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আমার ইঞ্জিন বন্ধ করার কোনো ইচ্ছা নাই। ঠিক আছে?” 

.

রাত্রি বেলা দাদি তার সোফায় বসে টিভি দেখছেন, ঝুমু খালা তার পায়ের কাছে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে একজন বউ আর তার শাশুড়ির ঝগড়া শুনছে এবং বউটির অপদার্থ স্বামীকে কঠিন ভাষায় বকাবকি করছে। বাচ্চারা তাদের অভ্যাসমত হুটোপুটি করছে, তখন দাদি হঠাৎ টিভি থেকে চোখ ফিরিয়ে বাচ্চাদের ডাকলেন, বললেন, “সবাই আয় আমার কাছে।” 

বাচ্চারা ধরেই নিল তাদের চেঁচামেচি বেশি হয়ে গেছে তাই তাদেরকে বকুনি দেওয়ার জন্য ডাকছেন। তারা আগেই কান ধরে বলল, “দাদি—আর গোলমাল করব না—খোদার কসম।” 

দাদি বললেন, “খোদাকে টানাটানি করতে হবে না। তোরা কাছে আয়।” 

বাচ্চারা কান ধরা অবস্থাতেই এগিয়ে এল। দাদি বললেন, সকালে মুনিয়া অ্যালার্ম বাজিয়ে ঘুম থেকে উঠে আমার কাছে এসেছে যেন আমি ওষুধ খেয়ে সেটা ভুলে না যাই। টুম্পা স্কুল যাওয়ার আগে আমার কাছে এসেছে, জোক পড়িয়ে শুনিয়েছে আমাকে হাসানোর জন্য। কেন এই দুইজন এগুলো করেছে তোরা জানিস।”

বাচ্চারা চেঁচালো, “জানি জানি।” 

একজন বলল, “এটা চলবে, চলবে।” 

আরেকজন বলল, “আস্তে আস্তে আরও ডালপালা ছড়াবে—”

দাদি (কিংবা নানি) হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে বললেন, “কেন তোদের হঠাৎ করে আমাকে নিয়ে এত টেনশন হয়েছে আমি জানি না। আমি তোদের টেনশন দূর করার জন্য বলতে চাই আমি যেন ওষুধ খেয়েছি কি না সেটা ভুলে না যাই সেইজন্য টুনি খুবই সোজা একটা কাজ করে দিয়েছে।” 

সবাই অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কী করে দিয়েছ?” 

টুনি বলল, “পার্মানেন্ট কলম দিয়ে ওষুধের উপর তারিখ লিখে দিয়েছি—এখন তাকালেই বুঝবে ওষুধটা আছে না খাওয়া হয়েছে—” 

বাচ্চারা মাথায় থাবা দিল, বলল, “হায় খোদা এত সোজা!” 

দাদি (কিংবা নানি) বললেন, “কাজেই তোদের কারো অ্যালার্ম দিয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার কাছে এসে লাফঝাঁপ চিৎকার করে ঘণ্টা বাজাতে হবে না। তোরা আরাম করে ঘুমা।” 

বাচ্চারা আনন্দের শব্দ করল। দাদি হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে বলল, “আর তোদেরকে আমাকে হাসানোর জন্য কষ্ট করে জোকসের বইটা থেকে জোকস পড়ে আমাকে হাসাতে হবে না। তার কারণ, তোরা সবাই এমনই ক্লাউন যে, আমি যখন একা একা থাকি তখন তোদের কাজকর্মের কথা মনে করে আমি নিজে নিজে হাসি!” 

বাচ্চারা আবার আনন্দের শব্দ করল। 

দাদি বললেন, “মানুষ হাসলেই যদি আয়ু বাড়ে তাহলে আমার মত লম্বা আয়ু এই দুনিয়াতে কারো কোনোদিন হবে না।” 

বাচ্চারা এবারে যত জোরে চিৎকার করল, বহুদিন তারা এত জোরে চিৎকার করে নাই। ঝুমু খালা পর্যন্ত সেই চিৎকারে যোগ দিল! 

দাদি তাদের দিকে তাকিয়ে মুখে আঁচল দিয়ে হাসতে থাকেন, হাসি আর থামাতে পারেন না! 

নিশ্চয়ই সেজন্য তার আয়ু তখনই খানিকটা বেড়ে গেল! 

-সমাপ্ত-

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *