র্যাডিস উইথ মোলাসেস
কেউ হয়তো বিশ্বাস করবেন না কিন্তু সত্যের খাতিরে আমাকে স্বীকার করতে হবে যে আমার এই সামান্য সাহিত্য-জীবনে গদ্য লেখা আমি আরম্ভ করেছিলাম ‘রন্ধন প্রণালী’ দিয়ে।
সে বড় দুঃখের কাহিনী। আমি তখন (এমনকী এখনও) রান্নার ‘র’ পর্যন্ত জানি না। আমি নিতান্ত অর্থলোভে এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তখন দৈনিক কাগজের রবিবাসরীয়তে নিয়মিত ‘রন্ধন প্রণালী’, যেমন মানকচুর কাটলেট কিংবা সজনের চাটনি এই জাতীয় বিচিত্র খাদ্য প্রস্তুতের প্রক্রিয়া, প্রকাশিত হত। আমি কী করে কোথায় যেন শুনেছিলাম যে প্রতিটি রন্ধনপ্রণালীর জন্যে পাঁচ টাকা করে দেওয়া হয়।
তখন পাঁচ টাকার অনেক দাম। চার্মিনার সিগারেট প্রতি প্যাকেট পুরনো সাত পয়সা, বড় দোকানে পাঁচ প্যাকেট একসঙ্গে পাইকিরি দাম আট আনা। তার মানে পাঁচ টাকা ছিল পঞ্চাশ প্যাকেট সিগারেটের সমান। সুতরাং পাঁচ টাকার জন্য লোভ করা নিশ্চয় খুব অন্যায় ছিল না। তখন কী যে টাকার টানাটানি ছিল, সে শুধু ঈশ্বর জানেন আর জানেন কয়েকজন সুহৃদ যাঁদের সেই সময়ের ঋণ এখনও পর্যন্ত শোধ করা হয়নি। আর এখন শোধ দেবই বা কী করে, পঁচিশ বছর পরে তো দশ আনা পয়সা কিংবা উনিশশো ষাট সালের একটা ডাবল ডিমের ওমলেটের দাম শোধ দিতে গেলে তারা চমকে উঠবে, ভাববে নতুন কোনও উদ্দেশ্য আছে। আর তাঁদের সবাইকে খুঁজে বার করতে গেলে দিশেহারা হয়ে যাব, শুধু মর পৃথিবীতে নয়, স্বর্গ-মর্ত্য-নরক তোলপাড় করতে হবে।
সে যা হোক, মোদ্দা কথা হল কোনও অভিজ্ঞতা ছাড়াই শুধুমাত্র টাকার জন্যে রন্ধনপ্রণালী রচনার অসাধু কর্মটি আমি করেছিলাম। তবে কাজটা ছিল খুব সোজা।
বটতলার প্রকাশিত ‘সচিত্র রন্ধন প্রণালী’ নামে একটি চমৎকার বই, মাত্র এক টাকা কি দেড় টাকা মূল্য, কালীঘাট মন্দিরের সামনে যেখানে শনির পাঁচালি, লক্ষ্মীর ব্রতকথা ইত্যাদি বিক্রি হয়, সেখান থেকে কিনেছিলাম। আশ্চর্যের বিষয় বইটি কোনও মহিলা লেখেননি, কোনও পাচক ঠাকুরও নন। বইটি লিখেছিলেন দামোদর ধর কিংবা ওই রকম নামের এক ভদ্রলোক। বইটির রঙিন মলাটে অবশ্য জনৈকা রন্ধনরতা মহিলার ছবি ছিল যিনি একটি বিশাল কড়াইতে আস্ত একটি রুইমাছ (আঁশ সমেত) ভাজছেন কিংবা সাঁতলাচ্ছেন।
ডাল, ভাত, ভাজা ইত্যাদি বিষয় থেকে শুরু করে এঁচড়ের মুড়িঘণ্ট, পেঁপের হালুয়া পর্যন্ত একশো আটটি রান্নার পদের বর্ণনা ছিল এই শ’ দেড়েক পাতার গ্রন্থে।
আমার কাজ ছিল একেবারে পরিষ্কার। বইটি থেকে যে কোনও একটি পদ বেছে নিয়ে শুধু ব্যবহৃত বস্তুগুলোর নাম বদলিয়ে দিতাম। সঙ্গে থাকত সুললিত ভাষ্য, যেটা আমার নিজের সংযোজন। যেমন ধরা যাক, পটলের কোর্মা বানানোর পদ্ধতি ছিল বইটিতে। আমি লিখলাম কুমড়োর কোর্মা। লেখা ছিল আধসের পটল, আধ পোয়া তেল। আমি করে দিলাম তিন পোয়া কুমড়ো, আর খাদ্যটি সুস্বাদু করার জন্যে তেলের বদলে তিন ছটাক ঘি।
দু’-চারটি লেখার পরে শেষের দিকে সাহস বেড়ে গেল, তখন ওই দামোদরবাবুর বইটির সাহায্য ছাড়াই নিজের বুদ্ধিমতো নিত্য নতুন খাদ্য কল্পনা করতাম। সব সময় সব লেখা ছাপা হত না। তবে এখনও আমার কাছে দু’-একটা পেপার কাটিং রয়েছে, তাতে দেখছি ঢ্যাঁড়সের মালাইকারি ও বেগুনের বোঁটার চাটনি রয়েছে।
বেগুনের বোঁটার চাটনি বলতে গিয়ে মনে পড়ল তখন আমি এতটা প্রতিক্রিয়াশীল ছিলাম না, গরিবদের কথা ভাবতাম। ফেলে দেওয়া বেগুনের বোঁটা, দুটো কাঁচালঙ্কা, একটু নুন আর একটা তেঁতুল দিয়ে আমি যে চাটনির নির্দেশ দিয়েছিলাম সেটা খেয়ে কতজন গরিব গৃহস্থ তৃপ্ত বা আহ্লাদিত হয়েছিলেন তা বলতে পারব না কি শেষাশেষি আমি খুব বিপদে পড়েছিলাম।
আমি রন্ধন প্রণালীর লেখাগুলো পাঠাতাম আমার নামের মধ্যপদ লোপ করে তারা রায় নামে। ছোটবেলায় মেয়েদের ইস্কুলে হাতেখড়ি, আমার হাতের লেখাও একটু মেয়েলি ধরনের হেলানো, ফলে সম্পাদক মহোদয় খুব সম্ভব আমাকে কোনও প্রবীণা, রন্ধন পটিয়সী সুগৃহিণী ভেবে নিয়েছিলেন। ভালই ছাপা হচ্ছিল দু’-চারটে লেখা কিন্তু কাঁচা টোপাকুলের পায়েস পাঠানোর পর একটি ছোট পোস্টকার্ড পাঠিয়ে রবিবাসরীয় সম্পাদক মহোদয় ডেকে পাঠান। আমাকে দেখে, আমার কথা শুনে সেই প্রবীণ ভদ্রলোকের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সেটা লেখা আমার পক্ষে মোটেই সম্মানজনক নয়। সোজা কথা, রন্ধন প্রণালী রচনার সেখানেই ইতি।
রন্ধন প্রণালী রচনার সময়ে দু’-একবার সততার স্বার্থে যে জিনিস লোককে খেতে বলেছি তা নিজে বানিয়ে খাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে এক অসম্ভব চেষ্টা। উনুন ছাড়া তো রান্না করা যাবে না আমি তখন একা থাকি, বাইরে খাই। তবু একটা মাটির উনুন কিনে নিয়ে এলাম এবং বহু দুঃখের মধ্যে আবিষ্কার করলাম কয়লার উনুন ধরাননা পৃথিবীর কঠিনতম কাজ। আমার দুঃখের কথা শুনে একজন জনতা স্টোভ কেনার কথা বললেন। তখন সদ্য জনতা স্টোভ বেরিয়েছে, কিনে দেখলাম জনতা স্টোভ জ্বালানো তেমন কঠিন নয়, কিন্তু নেবানো অসম্ভব। কয়লার উনুন ধরানোর চেয়ে জনতা স্টোভ নেবানো শতগুণ কঠিন। অবশ্য ইলেকট্রিক হিটার বা গ্যাস চেষ্টা করে দেখতে পারতাম কিন্তু সে সংগতি ছিল না। তা ছাড়া পাঁচ টাকার জন্যে কেউ এত খরচা করে না।
আমি আর কখনওই রান্না করার চেষ্টা করে দেখিনি। পারতপক্ষে রান্নাঘরের ভিতরে প্রবেশ করি সে খুবই বিপজ্জনক জায়গা। যত দূর মনে পড়ে বছর কুড়ি আগে শেষবার ওই নিষিদ্ধ পৃথিবীতে প্রবেশ করেছিলাম।
কারণটা খুব সামান্য ছিল না।
তখন শনিবার দেড়টার সময় আমাদের অফিস ছুটি হত। এই রকম এক শনিবারে ছুটির আধঘণ্টা খানেক আগে আমার এক বন্ধু তিনটি সাহেব যুবক এবং এক মেম যুবতীকে আমার অফিসে নিয়ে এলেন। এঁদের সঙ্গে আমার বন্ধুটির সদ্য আলাপ হয়েছে। ছেলেমেয়ে চারজনই নিউ ইয়র্কের, অল্প কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছে। নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে কলকাতা এসে পৌঁছেছে। কালীঘাট দেখবে। আমার কালীঘাটে বাড়ি, বন্ধু ভদ্রলোক সেই জন্যে আমার কাছে ওদের নিয়ে এসেছে, যদি আজ বিকেলে ওদের কালীঘাট ঘুরিয়ে দেখাই খুবই ভাল হয়। এই সব বলে বন্ধুটি এই চারজনকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
দেড়টার সময় রাস্তায় নামলাম। দেখি ওরা নিজেদের মধ্যে কী সব চাপা ফিসফাস আলোচনা করছে। একে ইংরেজি; তার উপরে মার্কিনি উচ্চারণ, তার উপরে ফিসফাস কিছুই বুঝতে পারলাম না। বাধ্য হয়ে আমার বাঙাল ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী ব্যাপার?’ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর বুঝতে পারলাম, ওরা হাংরি, ক্ষুধার্ত। কোথাও খেয়ে নিয়ে তারপর কালীঘাট যেতে চায়। আমি বোঝালাম, কালীঘাটেই আমার বাড়ি, আমাদের বাড়িতেই কিছু না কিছু খাবার আছে, চলে গিয়ে দেখা যাক।
এইখানেই আমার ভুল হয়েছিল। সেই দিন সকালেই আমার কিঞ্চিৎ নবোঢ়া পত্নীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুদের এবং আমার বান্ধবীদের একটি দীর্ঘ তুলনামূলক আলোচনা করেছিলাম। তখন বুঝতে পারিনি, বাড়ি ফিরে টের পেলাম; আমাদের কালীঘাট বাড়ির আট বাই নয় ছোট ঘরেও চারটি সাহেব-মেম দেখে তিনি একবারও লেপের নীচ থেকে বেরিয়ে এলেন না।
প্রসঙ্গত, উল্লেখ করা উচিত, সেটা ছিল শীতকাল। কলকাতার সেই অসামান্য সময়। দু’-তিনবার বৃথা চেঁচামেচির পর আমি বুঝলাম আজ যদি এই সাদা অতিথিদের খাওয়াতে হয় তার বন্দোবস্ত আমাকেই করতে হবে। অনেক রকম ভাবনা-চিন্তার পরে সাহেব-মেমদের বারান্দায় বসিয়ে, আমি রান্নাঘরের রহস্যময় পৃথিবীতে প্রবেশ করলাম।
রান্নাঘরে ঢুকে প্রথমেই দরজার পাশে দেখলাম একটা বিরাট গোল হাঁড়ি। মনে পড়ল, আমার দিদিমা মাস দুয়েক আগে এই গুড়ের হাঁড়িটা পাঠিয়েছিলেন। হাঁড়িটার অভ্যন্তরে উঁকি দিয়ে দেখলাম এখনও হাঁড়িটার গায়ে কিছু গুড় লেগে আছে। এর পরে তরকারির ঝডিতে উকি দিলাম, সেটা ওই গুড়ের হাঁড়ির পাশেই। দেখলাম প্রায় কিছুই নেই। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে এক আনা জোড়া যত মুলো কিনে এনেছি সব সেই ঝুড়িতে। বুঝতে পারলাম আমার স্ত্রী মুলো পছন্দ করেন না, তাই এই অবস্থা।
এরপরে আমার একটু পরিশ্রম। মুলোগুলো কুচি কুচি করে কাটলাম। সাত দুগুনে চোদ্দোটা মুলো, অনেক হল। এর পরে সেই কুচি মুলো গুড়ের হাঁড়িতে ঢেলে খুব মাখামাখি করলাম। তারপর বিয়েতে উপহার পাওয়া ডিনার সেট থেকে চারটে প্লেট বার করে সমান ভাগ করে সেই মুলোগুড় সাহেব-মেমদের দিয়ে দিলাম, বললাম, ‘র্যাডিস উইথ মোলাসেস, এ বেঙ্গলি জেলকেসি।’ সেই নিউ ইয়র্কীয় যুবক-যুবতীরা এত আনন্দ করে এই আশ্চর্য খাবার খেল তা বলার নয়। তারা আজও আমাকে ভোলেনি। প্রত্যেক বছর বড়দিনে এখনও আমাকে শুভেচ্ছা পাঠায়। সেই চারজনের মধ্যে একজন, ওই মেমললনাটি নিউ ইয়র্কের এক গলিতে একটি রেস্তোরাঁ করেছে। সেই রেস্তোরাঁর খাদ্য তালিকায় ইন্ডিয়ান একসোটিক ফুডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলছে মুলো-গুড়, ‘র্যাডিস উইথ মোলাসেস।’