র্যাটকিলার
ক্যানটিন থেকে ফিরে এসে মুরারি দেখল, তার টেবিলের সামনে কেদার বসে আছে। কলকাতায় শীত নেই, শীতের ধুলোটুকুই পড়ে আছে। কেদারের গায়ে তবু করকরে জহরকোট, গলায় মাফলার, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। কেদার বেশ অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল। তার চোখ মুখ ময়লা, মাথার চুল উস্কোখুস্কো, রুক্ষ।
মুরারি বলল, “কিরে? তুই?”
কেদার বিরক্ত হয়ে বলল, “কোথায় গিয়েছিলি? কখন থেকে বসে আছি।”
চেয়ার টেনে বসতে বসতে মুরারি বলল, “ক্যানটিনে।”
কেদার কেমন আক্ষেপের মুখ করে বলল, “তোদের রাইটার্সে গভর্নমেন্ট যে কত বেকার-ভাতা দেয়!” বলে মুরারির আশপাশের টেবিলের দিকে তাকাল।
বেকার-ভাতা কথাটায় মুরারি হেসে ফেলল। “চা খাবি?”
“না না, এখন চা-ফা নয়। নে নে ওঠ্…অনেক লেট হয়ে গেল।”
মুরারি ইচ্ছে করেই টেবিলের ওপর রাখা কাগজপত্র টানতে লাগল, যেন তার অনেক কাজ, এখন আর ওঠার সময় নেই। সিগারেটের প্যাকেটটা কেদারের দিকে এগিয়ে দিল, অর্থাৎ কেদার বসে বসে সিগারেট খেতে পারে কিন্তু মুরারি এখন উঠতে পারবে না।
কেদার মুরারির ভাবভঙ্গি দেখে আরও অধৈর্য হয়ে বলল, “কী রে, ওঠ।”
“এখন কী করে উঠি, অনেক কাজ,” মুরারি নিরীহের মতন মুখ করে জবাব দিল।
“যা যা, কাজফাজ রেখে দে, তোদের রাইটার্সে আবার কাজ, নে নে উঠে পড় ; তিনটে বাজতে চলল, গিয়ে হয়ত দেখব, ও কেটে পড়েছে।”
মুরারি বেশ আরাম করে একমুখ ধোঁয়া টেনে নিয়ে তারপর আস্তে আস্তে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বার করতে করতে বলল, “তোমার ও তুমি বোঝ, আমার কী?”
কেদার দু মুহূর্ত বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “যাঃ, এ রকম করিস না। আমি শালা আসানসোল থেকে কত ঝামেলা করে আসছি, কী রকম হেলপ্লেস্। মাইন্ডের কী অবস্থা, আর তুই মাইরি আমায় স্ট্রেট্ কাটিয়ে দিচ্ছিস।”
মুরারি হেসে ফেলল। কেদার কেন এসেছে, তার এত ব্যস্ততা কিসের, ওর মাইন্ডের অবস্থাটাই-বা কেমন—কিছুই মুরারির অজানা নয়। তবু কেদারকে আরও একটু জব্দ করার জন্যে মুরারি বলল, “দেখো যাদু, তুমি করবে প্রেম; আর আমি গিয়ে তোমার ইয়েকে ডেকে দেব—তা হয় না। ইট্ ইজ্ ইওর বিজনেস… !”
কেদার এবার হাত বাড়িয়ে মুরারির কব্জি ধরে ফেলল। করুণ মুখ করে বলল, “এই শেষ বার, দিস ইজ্ দি লাস্ট্ টাইম ; মাইরি, আমি প্রমিস করছি, আর তোকে বলব না, আই উইল্ অ্যারেঞ্জ মাই ওউন ফিউন্যারেল।”
মুরারি বেশ উঁচু গলায় হেসে উঠল। তার হাসির শব্দে আশপাশের টেবিল থেকে অন্যরা তাকে লক্ষ্য করতে লাগল। মুরারি কেদারকে বলল, “তোর ফিউন্যারেলই বটে।”
“ঠাট্টা কোরো না ভাই,” কেদার বলল, “আমার এখন সেই অবস্থা।”
মুরারিকে উঠতে হল। কেদারও উঠে দাঁড়াল।
চেয়ার ছেড়ে যাবার সময় মুরারি পাশের সহকর্মীকে বলল, “প্রণব আমি একটু আসছি ; মিনিট কুড়ি।”
ঘর থেকে বেরিয়ে প্যাসেজ দিয়ে আসতে আসতে কেদার বলল, “মানসীদের সেক্শন ইনচার্জটা মহা হারামি ; ও বেটা সেক্শনের মেয়েদের নাড়িনক্ষত্রের খবর রাখে, শালা আমায় দেখেছে দু-চার বার, মানসীদের পাড়ার কাছাকাছিই থাকে, বুঝলি না। মানসী স্পটেড হতে চায় না, ভয় পায়। না হলে আমি নিজে গিয়েই স্ট্রেট্ ডাকতে পারতাম।”
মুরারি হাসিমুখে জবাব দিল, “তোমার মানসী ভাই তুমিই জানো। তবে ওদের বড়বাবু আমাকেই না দাগী করে দেয়।”
‘য়াঃ যাঃ, তোকে কী করবে? তোর ক্যারেকটারই আলাদা। তুই হলি মিস্টার ক্যারেকটার। জাস্ট লাইক মিস্টার ইউনিভার্স। এ সব ব্যাপারে পার্টি দেখলেই চেনা যায়। তুই সে-রকম পার্টি নয়, নট্ ইন্ দিস কেস।”
সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় আরও কটা কথা হল। তারপর রাস্তা। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কেদার তার মনের উচাটন অবস্থাটাকে বোঝাতে লাগল, আসানসোলে গিয়ে পর্যন্ত তার খাওয়াদাওয়া ঘুম সুখ স্বস্তি সবই গিয়েছে ; নিদারুণ অবস্থা, এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করে না। দারুণ অগ্নিবাণে দিন কাটছে।
“চিঠি-ফিটি লিখিস না?” মুরারি জিজ্ঞেস করল।
“কোথায় লিখব? অ্যাড্রেস কী? মানসীদের বাড়ির ঠিকানায় চিঠি লেখা চলে না, সেখানে ওর মনুমার্কা বাপ, তেমনি একখানা ফায়ারিং মা। অফিসের ঠিকানায় চিঠি লিখলে হাওয়া হয়ে যাবে, দু-চারটে পাজি টাইপের ছেলে আছে। বুঝলি মুরারি, মেয়ে দেখলেই কাটা ঘুড়ির মতন লটকে নিতে চায়। বলেছিলুম কোনো বন্ধুর ঠিকানা দিতে, তাও দেবে না, লজ্জা করে, ভয় করে। মেয়েদের মাইরি সব ব্যাপারে লজ্জা আর ভয়। মেজাজ খারাপ করে দেয়।…”
“তা মানসী তো তোকে চিঠি লিখতে পারে!”
“গোটা দুয়েক দিয়েছে। দূর, ওর দ্বারা চিঠি লেখা হবে না। এ সব কলাবিদ্যা ওর জানা নেই। ড্রাই মার্কা চিঠি লেখে, যেন শালা রেল অফিসের বাঁধাগত কয়েক লাইন লিখে ক্লেম রিপোর্ট ফেরত দিচ্ছে। থার্ড ক্লাস।”
লালদিঘি দিয়ে শর্টকাট করে এগিয়ে যাবার সময় কেদার বলল, “আজ আমি একটা ফাইন্যাল করে ফেলব। এই ছুটোছুটি আর ভাল লাগে না। আমি ডিটারমিন্ড হয়ে এসেছি, আজ একটা ডিসিশন চাই, ইয়েস অর নো। তুই ভাই একটু প্রেসার দিবি।”
মুরারি ট্যারা চোখে বন্ধুর দিকে তাকাল, বলল, “তোর মানসী, আমার প্রেসার দেওয়াটা কি উচিত হবে?”
কেদার প্রথমটায় ধরতে পারেনি। পরে বুঝে ফেলল। হেসে উঠে বন্ধুর কাঁধে ধাক্কা দিল, “যাঃ শালা, কী বলিস?”
মানসীর অফিস কাছেই, কয়লাঘাটায়। মুরারিকে কেদারের পাল্লায় পড়ে অনেকবারই আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। চেনাশোনাও দু চারজন আছে মুরারির। এখান ওখান দিয়ে পথ করে গলে গিয়ে, হই-হল্লা শুনতে শুনতে কাগজপত্রের গন্ধের মধ্যে দিয়ে দোতলায় চলে এল মুরারি। মানসীদের বসবার ঘরের গায়ে-গায়ে বিরাট করিডোর, মোটামুটি ফাঁকা। কেদার ঘরে ঢুকল না, করিডোরের এক প্রান্তে নিরিবিলি দেখে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে লাগল। মুরারি ঘরে ঢুকে গেল।
খানিকটা পরে মানসীকে দেখা গেল, তার পিছনে পিছনে মুরারি। কেদার চোখ মুখ ভয়ঙ্কর গম্ভীর করে তাকিয়ে থাকল।
মানসীকে দেখলেই মনে হয়, শান্ত লাজুক ধরনের মেয়ে। রোগাটে চেহারা, গায়ের রঙ ফরসা, ছোটখাট মুখ, মাথাতেও মোটামুটি। সুন্দরী না হলেও সুশ্রী। ঘাড়ে মস্ত বিনুনি দুলছে, শাড়ির রঙটা কমলা, হাতে সরু সরু বালা।
মুরারি মানসীকে কেদারের কাছে পৌঁছে দিয়ে বলল, “তোরা কথা বল, আমি যাই।”
কেদার মাথা নেড়ে বলল, “না না তুই থাক। তোর সঙ্গে দরকার আছে।”
“আবার কি দরকার?”
“আছে, ইম্পর্টেন্ট কথা আছে, তুই একটু ওয়েট কর কোথাও।”
মানসী একবার কেদারের মুখের দিকে তাকাল, তারপর মুরারির দিকে। অগত্যা মুরারি এক মুহূর্ত ভেবে বলল, “আমি তা হলে একজনের খোঁজ নিয়ে আসছি, মিনিট দশ পনেরো দেরি হবে।”
মুরারি চলে যাবার সময় মানসীকে একবার দেখল, কেদারের কাছাকাছি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রেম তরঙ্গের এও এক রঙ্গ। তার হাসি পাচ্ছিল।
আর-এক বন্ধুর সঙ্গে সামান্য আড্ডা মেরে ফিরে এসে মুরারি দেখল, কেদার আর মানসীর মধ্যে একটা প্রচণ্ডরকম অশান্তি চলছে। কেদার ভীষণভাবে হাত পা ছুঁড়ছে, মাথা নাড়ছে, আর মানসী যেন কিছু একটা বোঝাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।
মুরারি দেখতে পেয়েই মানসী তর তর করে এগিয়ে এল। তার চোখ মুখ বেশ ব্যাকুল, শুকনো, খানিকটা যেন ভীত।
কাছে এসেই মানসী করুণভাবে বলল, “আপনি ওকে একটু বোঝান তো। কেমন পাগলামি করছে!”
মুরারি কেদারের দিকে তাকাল। কেদার উঁচু আলসেয় হেলান দিয়ে বেঁকে নাটকের নায়কের মতন দাঁড়িয়ে আছে।
“হয়েছে কী?” মুরারি জিজ্ঞেস করল।
মানসী বলল, “ওকে জিজ্ঞেস করুন। এমন অবুঝ, যা তা বলছে।”
মুরারি কেদারের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেল।
“কিরে, কী হল?”
কেদার গম্ভীর মুখে বলল, “হবার কি আছে। আমার যা বলার ফাইন্যাল বলে দিয়েছি।”
মানসী পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, বলল, “বলে দিলেই সব হয়ে যায়! আচ্ছা, আপনি বলুন, আমাদের সকলকেই বাপ মা ভাইবোন নিয়ে সংসারে বাস করতে হয়। একটা পাগলামী করে ফেললেই হল।”
কেদার গম্ভীর গলায় বলল, “একজনের কাছে যা পাগলামী মনে হচ্ছে, আমার কাছে সেটা লাইফ অ্যান্ড ডেথ…”
“কিন্তু ঝগড়াটা কোথায়,” মুরারি বলল, “কি নিয়ে ফাটাফাটি?”
কেদার সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না, তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিগারেট বের করতে লাগল। পকেট থেকে প্যাকেটটা বের করে চোখ না তুলেই বলল, “আস্ক দি আদার পার্টি?”
মানসী মাথা নেড়ে বলল, “না না, যে বলেছে তাকেই জিজ্ঞেস করুন।”
মুরারি বলল, “কেদার, অফিসের মধ্যে হই-হল্লা করে লাভ নেই, সিন ক্রিয়েট হবে। কী হয়েছে?”
কেদার প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠুকতে লাগল। “আমার কাছ থেকে জানতে চাও?”
“হ্যাঁ।”
“বেশ। আমি ওকে বলেছি, এভাবে চলতে পারে না, বিয়ে করতে হবে, রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ ; পনেরো দিন টাইম।”
মানসী মুরারির হাত ধরে ফেলে আর কি! বিহ্বল মুখ করে বলল, “আচ্ছা বলুন এই ভাবে বিয়ে করা যায় নাকি! কথা নেই, বার্তা নেই, বিয়ে।”
“কথা নেই, বার্তা নেই মানে—?” কেদার যেন চার্জ করল মানসীকে, “তুমি আমাকে বিয়ে করবে না বলছ? আগে কোনোদিন তুমি একথা বলেছ? বরং তুমি আমায় এই অ্যাসুরেন্স দিয়েছ যে আমাকেই বিয়ে করবে।”
“কী মুশকিল! কী কথার কেমন মানে! আমি যা বলেছি তার থেকে না করছি না!”
“তা হলে কথা নেই, বার্তা নেই—এসব বাজে কথা বলবে না। কথা ছিল, কথা আছে, এখন আমি বিয়ে করতে বলছি,” কেদার গর্জে উঠল।
মানসী আর কথা বলতে পারল না, মানে—তার মাথায় এমন একটা যুক্তির কোনো জবাব আসছিল না।
মুরারি বন্ধুকে বলল, “কিন্তু তুই দুম করে একটা আলটিমেটাম দিচ্ছিস কেন?”
“দিচ্ছি, কারণ আমি আর পারছি না। এনডিওরেন্সের লিমিট ফুরিয়ে গেছে। আমায় একটা ফাইন্যাল করে নিতেই হবে।”
মানসী বলল, “এভাবে ফাইন্যাল হয়? আপনিই বলুন!”
মুরারি বলল, “কেদার, মাথা গরম করে কোনো ডিসিশন নেওয়া যায় না। স্কুল ফাইন্যালের মতন তুচ্ছ জিনিসই কতবার পেছোয়, আর বিয়ের মতন ভাইটাল ব্যাপারে এগিয়ে যাবার আগে ভাল করে ভেবে দেখা দরকার। মানসীর দিক থেকে নানা প্রবলেম থাকতে পারে।”
“ও প্রবলেম প্রবলেমই থাকবে,” কেদার কোনো আমল না দিয়েই বলল, “আমার বাবা খুব গোঁড়া, মা ভীষণ কড়া ; বামুনের মেয়ে কায়স্থ ছেলেকে বিয়ে করছি শুনলে বাবা কুরুক্ষেত্র করবেন—এসব বাজে ফাদার-মাদার প্রবলেম কোনো দিনই যাবে না। ধ্যুত্, ফ্যামিলি আজকাল কোনো প্রবলেম নাকি? সাহস একটু করতেই হবে, যার সাহস নেই সে কেন এতটা এগিয়ে আসে?”
মানসী আমার মুখের দিকে তাকাল। তার সমস্যাটা কেদার যেভাবে দেখছে, অত হাল্কা করে দেখায় সে রীতিমত ক্ষুন্ন। মানসী বলল, “বাঃ, আমাদের সংসারে আর কোনো ঝঞ্ঝাট নেই? বাবা স্কুলে মাস্টারী করে আর মাঝে মাঝে ছেলে পড়ায়। আমার কোনো বড় ভাই নেই, ভাইবোনেরা ছোট। আমার,চাকরিতে কত উপকার হয় সংসারের!”
“চাকরি ছাড়তে বলা হচ্ছে না—” কেদার জনান্তিকে উক্তি করার মতন করে বলল, বলে তার সিগারেট ধরিয়ে নিল।
মুরারি বন্ধুকে বলল, “ও যদি এখানে চাকরি করে আর তুই আসানসোলে থাকিস তা হলে বিয়ের জন্যে এখনই এই চাপ দিচ্ছিস কেন?”
কেদার নিস্পৃহ মুখ করে বলল, “আরে মেয়েদের আমি চিনি। আউট অফ সাইট্, আউট অফ্ মাইন্ড।”
মুরারি হেসে ফেলল।
মানসী ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “আমি কাউকে আউট্ অফ্ মাইন্ড করিনি!”
“তার প্রমাণ আমার কাছে আছে-” কেদার বলল, “যাক, এখন আন্নেসেসারী কথায় কাজ কি, আমি যা বলার বলে দিয়েছি, অ্যান্ড আই ওয়ান্ট মাই অ্যানসার।”
মানসী চুপ। মুরারিও নির্বাক। কেদার আচ্ছা প্যাঁচ কষেছে তো!
মুরারি মানসীকে সাহস দিয়ে বলল, “আপনি না হয় আরও একটু সময় নিন, ভেবেচিন্তে দেখুন।”
কেদার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে উঠল, “না, আর সময় নেওয়া চলবে না। আজ, এখনই আমাকে ডিসিশন জানাতে হবে, ইয়েস আর নো।”
মানসীর মুখের রঙ অনেকক্ষণ থেকেই ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল, কেদারের জেদ, গোঁ, গর্জনে তার কেঁদে ফেলার অবস্থা হল। মুরারিরও ভাল লাগছিল না, কেদারটা বড় বাড়াবাড়ি করছে, এরকম গোঁয়ারতুমির কোনো মানে হয় না।
মানসী চুপ করে দাঁড়িয়ে, আর মুখ তুলছে না। হয়ত অভিমান কিংবা দুঃখ সামলে নেবার চেষ্টা করছিল।
মুরারি বলল, “কেদার, তুই বড় বাড়াবাড়ি করছিস। একটু সেনসেবল হবার চেষ্টা কর।”
কেদার বলল, “আমি সেনসেবল, আমায় বলে লাভ নেই। আমি যা ডিসাইড করেছি তার থেকে এক পাও সরব না। কাউকে কোনো জোর করার প্রশ্ন এখানে নেই। ওর যদি আপত্তি থাকে ও আমায় স্পষ্ট বলে দিক, আমি আমার ব্যবস্থা করে নেব।”
মানসী মুখ তুলে বলল, “ব্যবস্থা করে নেবে মানে তুমি বিষ খাবে?”
“খাব।”
মুরারি অবাক হয়ে কেদারের দিকে তাকাল। “বিষ খাবি?”
মানসী ততক্ষণে সত্যি সত্যিই মুরারির হাত ধরে ফেলেছে, মুখ পাংশু। গাঢ়, কান্না-কান্না গলায় বলল, “জানেন, ও তখন থেকে বলছে, আমি বিয়ে করতে রাজি না হলে বিষ খাবে!”
“বিষ, না না, বিষ খাবে কেন?”
“খাবে। ও বলছে খাবে। ওর পকেটে বিষ রয়েছে।”
মুরারির মনে হল, তার মাথাটা হঠাৎ বোঁ করে ঘুরে গেল। কী সর্বনাশ, কেদার আবার বিষটিষও পকেটে করে নিয়ে এসেছে নাকি! ঘাবড়ে গিয়ে মুরারি কেদারকে বলল, “তুই পকেটে করে বিষ নিয়ে এসেছিস?”
কেদার আস্তে আস্তে মাথা দোলাল। “ইয়েস, এনেছি।”
“যাঃ, বাজে কথা!”
মানসী বলল, “না না বাজে কথা নয়, পকেটে আছে, আমায় দেখিয়েছে।”
“কী বিষ?” মুরারি কোনো রকমে বলল।
“কী বিষ যেন, আপনি দেখুন না। আমাকে তখন থেকে শাসাচ্ছে।”
মুরারি কেদারকে কিছু বলবার আগেই কেদার তার প্যান্টের পকেট থেকে ছাপ মারা একটা প্লাস্টিকের ছোট প্যাকেট বের করল। হাতের মুঠোয় প্যাকেটটা বার দুই নাচিয়ে বলল, “এটা দারুণ পয়জেনাস, খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে দু’ঘণ্টার মধ্যে ফিনিশ।”
“বলিস কি। পটাসিয়াম সায়নয়েড নাকি?”
“না, পটাসিয়াম সায়নয়েডে ডেথটা বোঝাই যায় না। ওটা পিসফুল ডেথ। আমি কত কষ্ট করে মরেছি, এটা দেখাতে চাই।”
“ওটা তা হলে কী?”
“এটা র্যাটকিলার।”
মুরারি অট্টহাস্য হেসে ফেলেছিল আর কি। সামলে নিল। তার গা ঘিন ঘিন করে উঠল। প্রায় শিউরে উঠে সে বলল, “মাই গড, তুই শেষ পর্যন্ত মানুষ হয়ে ইঁদুরের বিষ খাবি? ছি ছি!”
“ইঁদুরের বিষে যন্ত্রণা বেশি, নাড়িভুড়ি জ্বলে পুড়ে যায়, মিনিটে মিনিটে বমি, ভেরি ডেনজারাস। বীভৎস।”
কেদার বোম্বাই ফিল্মের শয়তানদের মতন দাঁড়িয়ে ট্যারা চোখে আমাদের দেখতে লাগল।
মানসীর হঠাৎ কি যেন হয়ে গেল, মুখ নিচু করে নিল, হাতের আঙুলে চোখের পাতা মুছল। কেদারের হৃদয়হীনতার পরিমাপ করছিল বোধ হয়, কিংবা বিষ খাওয়া কেদারের বীভৎস চেহারাটা কল্পনা করে কেঁদে ফেলছিল। মৃদু, অস্পষ্ট গলায় মানসী বলল, “বেশ, এতই যখন অবিশ্বাস, আমি বিয়ে করব। কিন্তু…”
কেদার অপেক্ষা করতে লাগল, মুরারিও।
একটু সামলে নিয়ে মানসী বলল, “কিন্তু—এ কথা আমরা ছাড়া এখন আর কেউ জানবে না।” বলে মানসী মুরারির দিকে তাকাল। “আপনার সামনে ও বলুক বিয়ের কথা কাউকে জানাবে না।”
কেদার বলল, “আমার জানাতে বয়ে গেছে।”
মানসী এবার মুরারির জামার হাত ধরে একটু টানল, টেনে কয়েক পা তফাতে চলে গেল। মুরারিকেও কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতে হল। মানসী বলল, “আমার বাড়ির কথা আপনি সব জানেন না। কথাটা একবার যদি কেউ জানতে পারে আমার যে কী অবস্থা হবে, কেউ বুঝতে পারছে না। আপনি আপনার বন্ধুকে একটু বুঝিয়ে বলুন, বিয়ে আমি করছি তবে কাকপক্ষীও যেন এখন কথাটা জানতে না পারে। ও এমন কিছু করতে পারবে না যাতে লোক জানাজানি হয়ে যায়। আপনি একটু বলুন। ওর কাছ থেকে কথা নিয়ে নিন।”
ভেবেচিন্তে মুরারি বলল, “চলুন, ওর কাছে যাই, কথাবার্তা হয়ে যাক।”
মুরারি সরে আসছিল, মানসী হঠাৎ বলল, “শুনুন।”
দাঁড়াল মুরারি।
গায়ের আচলটা অকারণে কোমরের কাছে গুঁজতে গুঁজতে মানসী বলল, “আপনি ওকে ওসব খেতে বারণ করবেন। আমি তো বিয়ে করতে রাজিই হয়ে গেলাম। আপনি ওটা ওর কাছ থেকে নিয়ে নেবেন।”
মুরারি ঠোঁট বন্ধ করে হাসল।
কেদারের কাছে এসে দাঁড়াল দুজনে।
মুরারি বলল, “কেদার, তুমি তোমার জবাব পেয়ে গিয়েছ। এখন মানসীর তরফে কয়েকটা শর্ত আছে। সেগুলোর কী হবে?”
“কী শর্ত শুনি?”
“বিয়েটা একেবারে সিক্রেট রাখতে হবে। কেউ জানবে না।”
“আমি আগেই বলেছি, বিয়ের কথা অন্তত আমার মুখ থেকে কেউ জানতে পারবে না। আই প্রমিস।”
“বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরই যে তুমি ওকে জ্বালাতে শুরু করবে, বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে বলবে—তা হবে না। সেরকম করলে ও বিপদে পড়ে যাবে। ব্যাপারটা এখন একেবারেই গোপন থাকবে ; পরে সময় এবং অবস্থা বুঝে যা করার মানসী করবে।”
“সেটা কতদিন?”
মুরারি মানসীর মুখের দিকে তাকাল। জবাবটা মানসীরই দেবার কথা। মানসী অন্যমনস্কভাবে বলল, “এখনই আমি কি করে বলব কতদিন। বছর দেড়-দুই কি তারও বেশি হতে পারে। ওই জন্যেই আমি বলছিলুম এখন থাক।”
কেদার বলল, “আমিও বলেছি, বিয়ে করেই আমি কাউকে লিগ্যালি ক্লেম করছি না। এক দেড় বছর যদি কারও নিজের বাবা-মাকে সামলাতে লাগে আমি তাতে পরোয়া করি না।”
মুরারি দুজনকে এক পলক দেখে নিল। বলল, “পরোয়া না করলেই হল। তুমি পরে কোনো ঝামেলা করতে পারবে না। ওয়ার্ড অফ অনার।”
কেদার মাথা নেড়ে ওয়ার্ড অফ অনার দিল।
মুরারি মানসীর দিকে তাকাল, জানতে চাইল আর কিছু শর্ত থাকবে কি না।
মানসী মৌন থাকল। মানে তার অন্য কোনো শর্ত নেই।
ঝামেলাটা মিটে যাওয়ায় মুরারি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ঘড়ি দেখল, অফিস থেকে পালিয়ে এসেছে ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল। না, আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। মুরারি অফিস ফিরে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। “আমি চলি, বড় দেরি হয়ে গেল।”
কেদার বলল, “দু মিনিট দাঁড়া, আমিও যাব। তুই একটু এগো, আমি আসছি।”
মুরারি মানসীকে বলল, “আমি চলি, সেই কখন অফিস থেকে এসেছি।” বলেই তার মনে পড়ল, মানসীর আর-একটা অনুরোধ রাখা হয়নি। কেদারের দিকে তাকিয়ে মুরারি বলল, “ভাল কথা, তোর র্যাটকিলারের প্যাকেটটা আমায় দিয়ে দে।”
কেদার বলল, “রাস্তায় আমি ফেলে দেব তোর সামনে। আচ্ছা তুই এগো, আমি আসছি।”
মুরারি আড়চোখে একবার মানসীকে দেখে নিয়ে প্যাসেজ দিয়ে হাঁটতে লাগল। কেদার আর মানসী কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
নিচে নেমে এসে মুরারি একটা সিগারেট ধরিয়ে দু-চার টান দিতে না দিতেই দেখল কেদার এসে গেছে।
রাস্তায় এসে মুরারি বলল, “বিয়েটা হবে কবে?”
“দেখি, একটা দিন ঠিক করে নিই। কাল সকালে তোর বাড়ি গিয়ে ফাইন্যাল করে নেব। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিস তো তোর জানা আছে, সৌমেনের বিয়ে দিয়েছিলি।”
“সৌমেন কেন, অনেকের দিয়েছি, তোদের মতন পার্টি আজকাল অঢেল।”
কেদার হাসতে লাগল।
“কি রে শালা, খুব আহ্লাদ, না?”
“তা তো একটু হবেই, ভাই।”
“কিন্তু, তুই কি বলে র্যাটকিলারের প্যাকেট পকেটে করে নিয়ে এলি? কী চিজ তুই?”
“আরে, ওটা প্রেসার ট্যাক্টিস। প্রেসার না দিলে মেয়েদের দিয়ে কোনো কাজ করানো যায় না।”
“মানসী যদি অরাজি হত কি করতিস?”
“জানি না। মরে যেতাম। ইন্যদি হয় নিজের ফ্যাকট আমি এভাবে ওকে কলকাতায় রেখে দিতে পারছিলাম না। বুঝছিস না, কোনো বাইন্ডিং নেই, হপ্তায় দু হপ্তায় একবার আসি, দেখা হয়, এতে কি আর ভাল লাগে? তা ছাড়া মেয়েদের ব্যাপার, কবে শালা অন্য খাপে ঢুকে যায়, নজর দেবার তো কম নেই।”
“এতে তোর খারাপ লাগছিল। কিন্তু শালা, বিয়ে করেও যখন দেখবি, বউ আর তোতে কোনো ইয়ে নেই, তখন কেমন লাগবে?”
“সে তখন দেখা যাবে। ফিউচার ইজ ফিউচার।…ওসব কথা যেতে দে, শোন—তোর সঙ্গে আমার অনেক দরকার। রেজিস্ট্রির ব্যাপারে একটা ফাইন্যাল করতে হবে। আজ সন্ধেবেলায় তোর সঙ্গে বসলে হত, কিন্তু মানসীর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফেললাম। ছুটির পর অন্নপূর্ণার কাছে দেখা করব। আজ আর হবে না, কাল সকালে তোর বাড়ি যাব। এখন একবার বউবাজারে গিয়ে মামার বাড়িতে একটু ফ্রেশ হয়ে নিই।”
কেদার বউবাজারের ট্রাম ধরল। মুরারি অফিসে ফিরতে ফিরতে নিজের মনেই হাসছিল।
দুই
খুব গোপনেই কেদারের বিয়ে হয়ে গেল। শিয়ালদার দিকে এক ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসে সে পর্বটা চুকিয়ে দিল মুরারি। জনা তিনেক সাক্ষী ছাড়া কাউকে আনা হয়নি। সাক্ষীর একজন মুরারি, অন্যজন মুরারির বন্ধু, দিল্লিতে থাকে, কলকাতায় এসেছিল দিদির কাছে। মুরারি তাকে জুটিয়ে এনেছিল, বিয়ের পরের দিনই তার দিল্লি চলে যাবার কথা। তৃতীয়জন মুরারির অফিসের আর এক বন্ধু। বিয়ে হয়ে যাবার পর রেস্টুরেন্টে একটু চা-টা খাওয়া হয়েছিল, তারপর মুরারিরা চলে এল ; কেদার মানসীকে নিয়ে ক্যানিং বেড়াতে চলল।
বিয়ের পর প্রথম প্রথম কেদার কলকাতায় এলে মুরারির অফিস বা বাড়িতে গিয়ে দেখা করত। গল্পটল্প হত। এখন আর কেদার মুরারির অফিসে এসে মানসীর কাছে গিয়ে ডেকে দেবার জন্যে জ্বালাতন করে না। ভেতরে ভেতরে ওদের আগে থেকেই কথাবার্তা ঠিক করা থাকে, সেই মতন দেখা-সাক্ষাৎ হয়।
মুরারি একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “মানসীর অফিসে তুই যাস না?”
“না। স্ট্রিক্টলি বারণ করে দিয়েছে।”
“কোথায় যাস তা হলে?”
“সে আছে। কলকাতায় জায়গার অভাব কি?”
“কলকাতায় এলেই দেখা করিস?”
“আলবাৎ। কলকাতায় কি আমি ছোলা ভাজতে আসি? এখন ও আমার বউ না? কত রকম গার্জেনগিরি করে! বেশ লাগে মাইরি, অন্য রকম একটা ফিলিং হয়। তুই এসব বুঝবি না, তোর তো এ লাইন নয়।”
মুরারি হো হো করে হেসে ওঠে। পরে বদমাইশি করে বলে, “তোর বউ এটা তুই বুঝিস কি করে?”
“কেন, বউকে বউ বুঝব না? কি বলছিস তুই?”
“না, মানে, ব্যাপারটা হল—বউ বোঝার একটা আলাদা ব্যাপার আছে, তোদের তো সে রকম করে বোঝার ব্যাপার নেই।”
কেদার হেসে ফেলে। “বলেছিস বেশ, মানসীকে বলব।” বলে চা খেতে খেতে লম্বা করে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে রহস্যময় হাসি হাসে কেদার, তারপর গানের সুরে বলে, ‘যদি হয় নিজের নারী, তার গড়ন পেটন চিনতে পারি।’
মুরারি হাসতে হাসতে বলল, “খুব সুখেই আছিস তা হলে।”
“ওই আছি।” কেদার আর কিছু বলে না।
কেদারের আসা-যাওয়া ক্রমশই কমতে লাগল। কোনো পাত্তাই আর পাওয়া যেত না। মানসীর সঙ্গে আচমকা অফিসপাড়ায় দেখা হয়ে গেলে মুরারি কেদারের খোঁজ করত।
“র্যাটকিলারের খবর কী?”
মানসী সলজ্জ হাসত। “আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি?”
“না, মাসখানেকেরও বেশি তার মুখ দেখিনি।”
“ওমা, আমায় যে বলল, আপনার বাড়ি যাবে!”
“কবে?”
“এই তো এবার যখন এসেছিল,” মানসী দিন তারিখ ভাঙতে চাইল না।
মুরারি ঠাট্টা করে বলল, “এবার মানে কি সেবার? কেমন আছে র্যাটকিলার?”
“এমনি ভালই। হোটেল মেসের খাবার খেয়ে খেয়ে পেট নিয়ে ভোগে।”
“তাই নাকি! বিয়ের পর পেট একটু ভোগায়।” মুরারি আড়চোখে মানসীর দিকে তাকাল।
মানসীর চোখ মুখ হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।
কথাটা বেফসকা বলে ফেলে মুরারিরই জিব কাটতে ইচ্ছে করছিল। কোনো রকমে সামলে নিয়ে বলল, “কেদার এলে একবার দেখা করতে বলবেন, যদি অবশ্য সময় পায়।”
মানসী মাথা এলিয়ে সায় দিল।
কেদার অবশ্য পরের সপ্তাহে এল। গল্প-গুজব করল। বলল, “ভাই, আমি একেবারে সময় পাই না। শনিবার দিন রাত্রে আসি, রবিবার একটু ঘোরাফেরা করি, আবার সোমবার ভোরের গাড়িতে চাপি। শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না।”
“মানসী বলছিল, তোর পেটের গোলমাল হচ্ছে?”
“ইন ফ্যাকট্, সেই রকমই। আসানসোলের জল সহ্য হচ্ছে না।”
“কলকাতার জল নিয়ে যাস্ না?”
কেদার রসিকতাটা বুঝতে পেরে চোখ মটকে হাসল।
খানিকটা বসেই কেদার উঠল। “চলি, একবার দক্ষিণেশ্বর যেতে হবে।”
“দক্ষিণেশ্বর? সে কি রে! তুইও কি রামকেষ্ট করতে যাস?”
“না না, যাব একবার। একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে।”
“মানসী?”
“কোথায় মানসী? তোরা আমার চারপাশে ওই মানসী দেখছিস।”
কেদার চলে গেল। আবার যথারীতি তার খোঁজখবর নেই। গরম পড়েছিল সাঙ্ঘাতিক, সেই গরম কেটে বর্ষা নামল। প্রথম বর্ষাও কেটে যাচ্ছে, মানসীর সঙ্গে এর মধ্যে বার কয়েক দেখাও হয়ে গেল মুরারির। মানসীর শরীর সেরে যাচ্ছে, আগের তুলনায় গায়ে মাংস হয়েছে সামান্য, মুখটা ভরাট হয়ে এসেছে, রঙ আরও উজ্জ্বল মনে হয়। ভালই লাগে মানসীকে দেখতে। মুরারির মনে হল, মানসীর শাড়ি-টাড়িও আগের তুলনায় সরেস হয়েছে। দুজনে অল্প কথাবার্তা হয়। মুরারি রসিকতা করে। মানসী লজ্জা পেয়ে কথা এড়িয়ে যায়। মানসীই বলল, কেদার এখন অ্যাকাউন্টেসি পরীক্ষার জন্যে পড়াশোনা করছে, সপ্তাহে সপ্তাহে আসতে পারছে না।
আবার যখন বর্ষা নামল, প্রবল বর্ষা, তখন একদিন মুরারি দেখল, হ্যারিসন রোডের ওপর দিয়ে আধো অন্ধকারের বৃষ্টির মধ্যে রিকশায় চেপে যুগল মূর্তি চলেছে, কেদার আর মানসী। একজন অন্যজনের মুখে বৃষ্টির জল ছিটিয়ে দিচ্ছে।
ডাকব ডাকব করেও মুরারি ডাকতে পারল না। তার একটু হিংসেই হল, কেদার শালা দিব্যি আছে, মহা ফুর্তিতে।
এর কয়েকদিন পরেই মুরারির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
অফিসে নিজের টেবিলেই ছিল মুরারি, বেয়ারা এসে বলল, এক মহিলা বাইরে বাবুর জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন, ভেতরে আসতে চাইছেন না।
মুরারির প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল, মানসীই এসেছে হয়ত। বাইরে এসে সে অবাক, বয়স্কা এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন।
মুরারি নানা রকম সন্দেহ নিয়ে মহিলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। “আপনি আমাকে খোঁজ করছিলেন?”
মহিলা একদৃষ্টে মুরারিকে দেখলেন কিছুক্ষণ। মুরারিও দেখল মহিলাকে। বেঁটে ধরনের গোল চেহারা, গায়ের রঙ ফরসা, তাঁতের সাদা খোলের শাড়ি, মাথায় কাপড়। চোখ মুখ দেখে মহিলাকে কড়া ধাতের মানুষ বলেই মনে হয়।
উনি বললেন, “ও, তুমিই সেই? আমি মানসীর মা।”
মুরারি চমকে গেল। সর্বনাশ! তার মনে হল, লালবাজার থেকে যেন পুলিশ এসে মুরারিকে ধরে ফেলেছে। শুকনো মুখে মুরারি ঢোঁক গিলল। “আজ্ঞে!” মর্মভেদী দৃষ্টি হানলেন মানসীর মা। “আমার মেয়েকে তুমি চেন না?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, দেখেছি।”
“দেখেছ? আর কিছু করোনি?”
কথাটা মুরারির কাছে খুব অশ্লীল ঠেকল। বুঝতে আর বাকি থাকছে না যে, শালা কেদার তাকে ফাঁসিয়েছে। মুরারি ঘামতে শুরু করেছিল। বলল, “আপনার মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ-টালাপ আছে।” বলেই মুরারি তার ঘরের দিকে তাকাল, যেন ঘরটা অনেক নিরাপদ। “আপনি ঘরে গিয়ে বসবেন চলুন।”
মানসীর মা মাথা নাড়লেন। “না, আমি এই হট্টগোলের মধ্যে যাব না। লোকজন নেই এমন জায়গায় চলো, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।”
মুরারির রাগ হচ্ছিল, কেদার এসে বলবে, মানসীকে একটু ডেকে দিবি চল, তার শাশুড়ি এসে বলবে, তোমার সঙ্গে কথা আছে ফাঁকায় চলো। ব্যাপারটা কী? মুরারি কি জগৎসুদ্ধু লোকের বেগার খাটবার জন্য বসে আছে! অথচ এসব কথা বলা যায় না, অন্তত এই বয়স্কা মহিলার সামনে।
মুরারি বলল, “ফাঁকা জায়গা অফিসে নেই। তবে ক্যানটিনের দিকে যেতে পারেন, এখন হয়ত ভিড় কম।”
মানসীর মা বললেন, “যা করেছ—কেলেঙ্কারি—সেটা তো আর ঢাক বাজিয়ে বলা যাবে না।”
মুরারি আবার কেমন যেন চমকে গেল। মানসীর মা কী ভাবছেন? তিনি কি ভাবছেন, মুরারিই কিছু করে ফেলেছে? যাঃ বাব্বা, কারবার করছে কেদার, আর মুরারির মাথায় সাইনবোর্ড।
ভয়ে ভয়ে মুরারি বলল, “চলুন দেখি, নিচের ক্যানটিনে জায়গা না পেলে বাইরে যেতে হবে।”
মানসীর মাকে নিচে নিয়ে এসে মুরারি একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে গেল।
মানসীর মা বসলেন।
মুরারি আতিথ্য করে বলল, “একটু চা খাবেন?”
“থাক, যেখানে সেখানে আমরা খাই না। কতরকম ছোঁওয়া ছুঁইয়ি থাকে।”
মুরারি আর অনুরোধ করল না। মানসীর মা মাথার কাপড় সামান্য টেনে নিচু গলায় বললেন, “তোমরা লেখাপড়া শিখেছ, অফিসে চাকরি কর, ভদ্রলোকের ছেলেপুলে, তোমরা গরীব-গেরস্থ বাড়ির এত বড় একটা সর্বনাশ করলে?”
মুরারির আলজিব পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। “আজ্ঞে আমি…।”
“তুমি আমার সর্বনাশ করেছ, এত বড় সর্বনাশ মানুষ তার শত্তুরেরও করে না।”
প্রতিবাদ করে মুরারি বলল, “আপনি কী বলছেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না !”
মানসীর মা চোখ রাঙিয়ে ধমক দিলেন, “ন্যাকা, তুমি কিছু বুঝতে পারছ না, ভাজা মাছ উল্টে খেতে জান না। শয়তান সব। পরের বাড়ির মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এনে সর্বনাশ করে এখন ন্যাকা সাজছ!”
মুরারির চোখমুখ তেতে উঠল। মাথা দপ্ দপ্ করতে লাগল। কোনো রকমে নিজেকে সামলাতে সামলাতে সে বলল, “আপনি নিজের খুশিমত যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছেন, এগুলো খুবই অপমানজনক। আমি কোনো ভদ্রবাড়ির মেয়ের সর্বনাশ করিনি।
“আমার মেয়ের সর্বনাশ কে করেছে?”
“আমি? কী বলছেন আপনি?”
“করেছে কে? আমি জানতে চাইছি, কে করেছে?”
মুরারি বেফসকা কিছু বলতে গিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে সামলে নিল। বলল, “আপনার মেয়ের সর্বনাশ কে করেছে তার জবাব আমি দেব? আপনার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করলে পারেন।”
“সে হারামজাদী আর এক কেউটে। কি মেয়েই জন্ম দিয়েছিলাম। বংশের মুখে কালি ঢেলে দিলে গো! তার চেয়ে মরল না কেন, বিষ জোটেনি হারামজাদীর?” মানসীর মা রাগের মাথায় হাতের ঝাপটা দিলেন।
মুরারি রীতিমত ভয় পেয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তাদের কাছাকাছি কেউ না থাকলেও তফাতে দু-একজন আছে ; আসছে যাচ্ছে কেউ কেউ। মানসীর মা’র এই গার্হস্থ্য-ভাষণ কারুর কানে গেলে কেচ্ছা হয়ে যাবে।
মুরারি অবস্থাটা সামলাবার চেষ্টা করে বলল, “আপনি অনর্থক আমার উপর রাগ করছেন। আমি কিছু করিনি। বরং ব্যাপারটা যদি বলতেন—”
মানসীর মা বসে বসে হাঁপাতে লাগলেন। মোটা চেহারা, ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এই রাইটার্স পর্যন্ত ধাওয়া করতে পেরেছেন এতেই তো তাঁর দম ফুরিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, তার ওপর এই উত্তেজনা ক্রোধ, ওপর নিচ, মহিলার এখন হার্ট অ্যাটাকও হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়।
বসে বসে খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে মানসীর মা বললেন, “ব্যাপার আমি কী বলবো? তুমি বলবে।”
“আমি?”
“দেখ বাপু, মিচকিমি করো না। তুমি যাও ডালে ডালে, আমি যাই পাতায় পাতায়। সব আমি খোঁজ পেয়েছি। জানো, তোমায় আমি পুলিশে দিতে পারি?”
ঘাবড়ে গিয়ে মুরারি বলল, “আমায় পুলিশে দেবেন! আমার অপরাধ?”
“তুমি আমার মেয়েকে দিয়ে এই অধর্ম করিয়েছ।”
“আমি?…কী মুশকিল, আপনি ফরনাথিং আমার কাছে এসে ঝামেলা করছেন, আমি আপনাকে বারবার বলছি, আমি কিছু করিনি…।”
“করোনি?”
“না।”
“কেদার কে?”
“আমার নাম কেদার নয়, মুরারি।”
“জানি বাছা, জানি। তোমার নাম ঠিকানা না জেনে কি তোমার অফিসে খোঁজ করতে এসেছি? আমায় অত মুখ্য ভেবেছ?”
মুরারি এতক্ষণে একটু হাঁফ ছাড়ল। যাক্ বাবা, কেদারের নামটা শোনা গেল। এতক্ষণ শালা মনে হচ্ছিল, মুরারি যেন মেয়ে ভাগিয়ে নেবার অপরাধ করেছে।
মুরারি বলল, “কেদার আমার বন্ধু।”
“তোমার প্রাণের ইয়ার। সে হারামজাদা এখানে থাকে না। আসানসোলে থাকে, রেলের চাকরি করে।”
মুরারি চমৎকৃত হল। আগাথা ক্রিস্টির চেয়ে কম কি মহিলা!
মানসীর মা বললেন, “ওই হারামজাদা আমার মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করেছে।”
“বিয়ে করেছে?”
“তুমি কিছু জানো না, না? ন্যাকামি করছ? তুমি হলে পালের গোদা! তোমার সব খবর আমি পেয়েছি। তুমি ওদের কানে মন্ত্র দিয়েছ। দাওনি?”
মুরারি বুঝতে পারল, আত্মরক্ষার চেষ্টা বৃথা, মহিলা সমস্ত খবরই জানেন। কথাটা কে ফাঁস করে দিল বোঝা যাচ্ছে না। মানসী নিজেই দিল নাকি? কেদারের কোনো চিঠিপত্র কি মানসীর মার হাতে পড়েছে? অত কাঁচা কাজ কি করবে কেদার? মুরারি কোনো রকম আঁচ করতে পারল না—খবরটা কেমন করে জানাজানি হয়ে গেল। এই জন্যেই বোধ হয় বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।।
নিজেকে বাঁচাবার কোনো উপায় নেই দেখে মুরারি এবার বেপরোয়া ভাবে আক্রমণের পথ নিল। বলল, “আপনার মেয়ে কচি খুকি নয়, কেদারও খোকা নয়, আমার মন্ত্র দেবার তোয়াক্কা তারা করেনি। বিয়ের ব্যাপারটা তারাই ঠিক করেছিল, আমি শুধু রেজিস্ট্রির সময় সাক্ষী ছিলাম।”
“বিয়ে বিয়ে করো না, ওটা বিয়ে নয়।”
“বাঃ বিয়েকে বিয়ে বলবো না? সাবালক ছেলে মেয়ে নিজেরা পছন্দ করে আইনমতে বিয়ে করেছে।”
মানসীর মা চটে উঠে বললেন, “আইনের মুখে আগুন। অমন বিয়ে আমাদের চলে মা।”
মুরারি নিস্পৃহ মুখে বলল, “আপনাদের না চললে আমি কি করব বলুন, আইন আইনই। আপনার আমার করার কিছুই নেই। আপনি না মানলেও আইন তো আপনার মেয়েকে কেদারের স্ত্রী হিসেবেই স্বীকার করবে। চাই কি, কেদারই কোর্ট কাছারি পুলিশ করে তার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে পারে আপনাদের কাছ থেকে।”
মানসীর মা কপালে হাত রেখে বসে বসে মুরারির কথা শুনলেন। তাঁর ঠোঁটে পানের রঙ শুকিয়ে খয়েরী হয়ে গিয়েছিল। মস্ত বড় এক নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন, “তোমাকে আর বক্তৃতা করে বোঝাতে হবে না। আমি সবই জেনেছি। তুমি ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে আমার এ শত্রুতা কেন করলে?”
মুরারি কথার জবাব দিল না। জবাব কিই বা আছে। কেদার আর মানসীর ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল।
মানসীর মা হঠাৎ বললেন, “তুমি তো নিজে বিয়ে-থা করোনি?”
“না ।”
“তা তুমি বাপু বামুনের ছেলে। বন্ধুর জন্যে দাতা কর্ণ না সেজে নিজেও তো কাজটা করতে পারতে, তবু জাত ধর্ম বাঁচত। যাকগে, মা বাপের দুঃখ বুঝতে পারবে না এখন, পরে বুঝবে, এখন ভাবছ খুব বাহবার কাজ করেছ, ছি ছি।”
মুরারি নীরবে ভৎসনা সহ্য করে নিল। কেদার বেটা যদি শোনে, তার শাশুড়ী মুরারিকে যেচে মেয়ে অফার করতে চেয়েছিলেন বেটা খেপে যাবে।
মানসীর মা চুপ করে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ কেঁদে ফেললেন। শব্দ হল না, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। মুরারি অপ্রস্তুত, তার ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল। ঘাবড়েও গেল বেশ।
শোক সামলে নিয়ে মানসীর মা আঁচলে চোখ মুছলেন। চোখ দুটি লাল হয়ে গিয়েছে। চোখের পাতা মুছতে মুছতে বললেন, “কেলেঙ্কারী যা হবার হয়েই গিয়েছে। লোক জানাজানি হতেও বাকি নেই। পাড়ায় পাঁচজনে সন্দেহ করছে, আত্মীয়-স্বজন জেনে ফেলেছে। মানসীর বাবা স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে নবদ্বীপ চলে গেছেন। এখন বলো আমি কী করি?”
মুরারি এবার খানিকটা সহানুভূতি বোধ করল। বলল, “কি করে লোক জানাজানি হল আমি তো বুঝতে পারছি না। কেদার আসানসোলে থাকে, অ্যাকাউন্টেসি পরীক্ষার পড়া তৈরি করছে। আপনার মেয়ে থাকে কলকাতার বাড়িতে। ওদের মধ্যে কথাই ছিল ব্যাপারটা এখন চাপা রাখবে। দুজনের মধ্যে দেখাশোনাও খুব একটা হয় বলে আমি জানি না।”
“রাখো—রাখো,” মানসীর মা মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “দেখাশোনা কম আবার হয় কোথায়! এত বড় বজ্জাত কালকেউটে মেয়ে আমার, আজ ক’মাস ধরেই দেখছিলাম তার হঠাৎ মাসির ওপর দরদ বেড়ে গেছে। ছুটিছাটায় মাসির বাড়ি চুঁচড়ো যাচ্ছি বলে বাড়ি থেকে চলে যেত। তারপর দেখি ফি শনিবার। প্রথমটায় তো বুঝিনি বাবা, সন্দেহও করিনি। ভাবতাম আমার বোনটা বড় একটেরে আছে, যাচ্ছে যাক, আমার বোনঝি রয়েছে, মেয়েরই সমবয়সী। দুজনে বেশ ভাবসাব, ছুটিছাটায় বেড়িয়ে আসুক। পরে ফি শনিবার মাসির বাড়ি রায়না জুড়তেই সন্দেহ হতে লাগল। যেতে না দিলে অশান্তি করত। তা ছাড়া মেয়ের আমার চালচলন ভাল, বাপ মা’র ওপর ভয় ভক্তি রয়েছে, কি করে বুঝব, ভেতরে ভেতরে এত ছিল। ছি ছি, শুনে পর্যন্ত গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করছে।”
মুরারি কৌতূহল বোধ করে বলল, “মাসির বাড়ি ও যেত না?”
“কোথায় যেত। বুড়ি ছুঁয়ে রাখার জন্যে দু-একবার গিয়েছে, তাও বড় একটা রাত কাটাত না। আমার বোনের কাছে খোঁজ করতেই সব ধরা পড়ে গেল।”
“আপনার নিজের বোন?”
“না না, জ্যাঠতুতো বোন, দেখাশোনা বছরে এক-আধবার।”
মুরারির শিস দিয়ে উঠতে ইচ্ছে করল। শালা কেদার, র্যাটকিলার খুব খেলা দেখিয়েছ। মানসীও তো আচ্ছা, অমন শান্ত, লাজুক, নরম-নরম দেখতে, তার ভেতর ভেতর এত বুদ্ধি! না ; মেয়েদের ওপর দেখে ভেতর বোঝা যায় না।
মুরারি আর পারল না, উঠে গিয়ে এক গ্লাস জল খেয়ে এল।
মানসীর মা বললেন, “এবার বলো, আমি কী করি?”
মুরারি ঘাড় চুলকোতে লাগল। “আমি কী বলব?”
“কেন বাপু, গেরস্থ বাড়ির সর্বনাশ করার সময় বন্ধুর কানে মন্ত্র দিতে পেরেছিলে, আর এখন বলছ আমি কী বলব?”
ঠোক্করটা হজম করে নিল মুরারি, বলল, “আপনি কী করতে চান?”
“আমার তো ইচ্ছে করে বঁটি দিয়ে মেয়েটার গলা কুপিয়ে দি। আর তোমার বন্ধু, সে জোচ্চোরটাকে হাতের কাছে পেলে তার শয়তানি আমি ভাঙতাম।…কিন্তু আমরা তো বুড়ো-বুড়ি হয়ে গিয়েছি। বাড়ির কর্তা সারাটা জীবন আহ্নিক জপতপ করে আর স্কুলে গাধা পিটিয়ে কাটালেন। বাড়িতে আরো তিনটে পোয্য। আমাদের সঙ্গতি কতটুকু, সামর্থ্যই বা কি! মেয়েটারও তো মুখ দেখাতে হবে। সমাজের লোকলজ্জাও বাঁচাতে হবে। আমি বড় দায়ে পড়ে এসেছি। বলো কী করি?”
মুরারির বাস্তবিকই এবার দুঃখ হচ্ছিল। কেদার বোধ হয় এভাবে বিয়ে করে ভাল করেনি। শালা একেবারে উল্লুক, হারামজাদা। মানসীও বা কেমন! রিফিউজ করলে পারত। র্যাটকিলারের প্যাকেট দেখে ভিরমি খেয়ে গেল। প্রেম-ফ্রেম এই জন্যেই এত বাজে।
মুরারি মাথা চুলকে বলল, “আমার তো মনে হচ্ছে, কেদারকে আপনি বাড়িতে ডেকে নিন, না হয় মেয়েকে আসানসোলে পাঠিয়ে দিন।”
“কি কথাই বললে—”, মানসীর মা নাক কুঁচকে বললেন, “—পাড়ায় এমনিতেই কানাঘুষো শুরু হয়েছে, লোকলজ্জায় মরছি, তার ওপর তোমার কেদারকে বাড়িতে এনে বসাই। ও-সব হয় না, আমাদের লোকলৌকিকতা আছে, সমাজ আছে। ওভাবে ফিরিঙ্গি বিয়ে আমাদের হয় না। ওদের আবার বিয়ে করতে হবে, আমাদের চোদ্দ পুরুষে যেমন হয়েছে, সেইভাবে।”
মুরারি চোখ তুলে বলল, “মানে, আপনি বলছেন, আবার টোপর মাথায় দিয়ে কেদারকে বিয়ে করতে যেতে হবে?”
“হ্যাঁ, আমাদের যেমনটি চলেছে এতকাল সেইভাবে।”
“কেদার কি রাজি হবে?”
“না হলে ওর বউ ও পাবে না। তুমি তোমার বন্ধুকে বলে দিও জেদ আমারও আছে?”
মুরারি আর কথা না বাড়িয়ে বলল, “কেদারের সঙ্গে আমার অনেকদিন দেখা হয়নি, তা সে ব্যবস্থা আমি করে নেব। ও যদি রাজি থাকে আপনাকে জানাব।”
“রাজি তাকে হতেই হবে। তুমি ওকে রাজি করাবে। ওকে বলো, মানসীর বাবাকে নয়ত আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারব না। ”
মুরারি সামান্য চুপচাপ থেকে বলল, “বেশ, আমি চেষ্টা নিশ্চয় করব। মানসীরও কি তাই ইচ্ছে?”
“তোমার সঙ্গে তো চেনাশোনা আছে। জিজ্ঞেস করে দেখো?”
বোঝা গেল মানসীরও ওই মত।
মানসীর মা শেষ পর্যন্ত উঠলেন। বললেন, “আমাদের ঘরবাড়িতে, পাড়ায় বিয়ের ব্যবস্থা হবে না। অন্য কোথাও ছোট একটু জায়গায় ব্যবস্থা করো। আমাদের ক্ষমতা নেই, সামর্থ্য নেই। সেই বুঝে যা করার করো। আমি আজ চললাম। আবার আসব, কবে আসব মেয়ের মুখে জানিয়ে দিও।”
মানসীর মাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে মুরারি আর অফিসে ফিরল না। মানসীর খোঁজ করতে তার অফিসে চলে গেল।
তিন
পরের শনিবারই নাচতে নাচতে কেদার এল মুরারির অফিসে। ফিটফাট চেহারা মুখ ভরতি হাসি। কেদারকে দেখে মুরারির গা জ্বলে গেল, প্রথম দর্শনেই মুরারি খেপে গিয়ে যাচ্ছেতাই গালাগাল দিল।
কেদার হাসতেই লাগল। “অত রাগ করছিস কেন মাইরি, নে নে সিগারেট খা, চা আনতে বল। বন্ধু লোককে এরকম করতে হয়! তোর কাছে আসতে পারি না, বাট আই অলঅয়েজ রিমেমবার ইউ। তুই একটা জুয়েল, এ ফ্রেন্ড ইনডিড।”
“চুপ কর শালা, আমি তোকে বিলক্ষণ চিনেছি। আমার কাছে এসেছিস কেন?”
“বাঃ বাঃ, মানসী আমায় আর্জেন্ট চিঠি লিখল, তোর সঙ্গে এসে দেখা করতে, তুই বলেছিস মানসীকে।”
“সঙ্গে সঙ্গে তুই আসানসোল থেকে চলে এলি?”
“এলাম, আজ শনিবার।”
“মানসী তোকে আর কিছু লেখেনি?”
“লিখেছে। মানে শুনলুম, তোর কাছে শাশুড়িমশাই এসেছিলেন…এই সব আর কি ।
“শাশুড়িমশাই?”
“আমার শাশুড়িকে মশাই বলাই কি ভাল নয়?”
মুরারি হেসে ফেলল।
চা সিগারেট খেতে খেতে মুরারী মানসীর মার আগমন থেকে প্রস্থান পর্যন্ত সব বিবরণ শোনাল। কেদার কিছু কিছু আগেই মানসীর চিঠিতে জেনেছে। তাকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল।
মুরারি শেষে বলল, “তুই না ওয়ার্ড অফ অনার দিয়েছিলি?”
“কিসের?”
“কিসের? শালা ন্যাকা সাজছিস?”
“ফর গডস্ সেক্, আমি কিন্তু ব্যাপারটা লিক আউট করিনি?”
“কে করেছে?”
“বোধ হয় মানসীর মাসির বাড়ি যাওয়া থেকেই সাম্ হাউ ওরা আন্দাজ করতে পেরেছিল। মানসী মাইরি এত মাসি-মাসি করত! তখনই বলেছিলাম, বেণী মাসির কান কেটেছিল, এই মাসিও তোমায় ডোবাবে…।”
“মানসী মাসির বাড়ি যেত না।”
“যেত না?”
“আবার শালা ন্যাকামি? তুই ওকে টেনে নিয়ে যেতিস!”
একটু চুপ করে কেদার একগাল হেসে বলল, “ভেরি ন্যাচারাল। বউকে টানব এর মধ্যে অন্যায় কী?”
“ভেরি ন্যাচারাল! এখন শালা ন্যাচারাল দেখাচ্ছিস! এরকম কথা কিন্তু ছিল না। তোর কনডিশান ছিল…”
“যা যা, কনডিশান রাখ। নিজে তে শালা বিয়ে করিসনি, কনডিশান দেখাচ্ছিস। একবার রাইট এসটাব্লিশড হয়ে গেলে কে কনডিশান মানে রে? প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধি তোর নেই মুরারি, তুই এখনও সাবালক হোসনি।”
মুরারি জোরে জোরে সিগারেট খেল, হাসল মনে মনে। পরে বলল, “তুই মানসীকে নিয়ে কোথায় যেতিস? থাকতিস কোথায়?”
কেদার বলল, “থাকতাম, থাকবার জায়গা কি পাওয়া যায় না? কত হোটেল-ফোটেল আছে?”
“হোটেলে থাকতিস? থাকতিস কি করে? মানসী তো মাথায় সিঁদুর দেয় না?”
“তুই অত এনকোয়ারি করিস না। বলছি ব্যবস্থা হত, ব্যাস।”
মুরারি কি ভেবে হঠাৎ হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করল, “তোরা শালা পকেটে করে বিয়ের রেজিস্ট্রির সার্টিফিকেটটা নিয়ে যেতিস নাকি?”
কেদার মুচকি মুচকি হাসতে লাগল, তার হাসির মমোৰ্ধার অসম্ভব।
মুরারি বলল, “যাক গে, তোদের ধর্ম তোরা করেছিস, এখন বিয়ের কী হবে? ঘরবাড়ি কোথায় পাব, ব্যবস্থাই বা কী করা যাবে?”
কেদার খুব নিশ্চিন্তে সিগারেটে টান দিল চোখ বুজে আয়েস করে। ধোঁয়া উড়তে উড়োতে বলল, “ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। ভাবছিস কেন।”
“কী ব্যবস্থা হবে সেটাই জানতে চাইছি।”
বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা দেখাল না কেদার, বলল, “চল না বিকেলে বেরোই, খোঁজাখুঁজি করলে একটা বেরিয়ে যাবে।”
ছুটির পর রাস্তায় নেমে কেদার বলল, “তোর নানুকে মনে আছে?”
“কে নানু?”
“আমাদের সঙ্গে বঙ্গবাসীতে পড়ত, লম্বা মতন দেখতে, মুখে বসন্তের দাগ।”
“ঠিক মনে পড়ছে না, মুখ দেখলে চিনতে পারব। নানুর কথা আসছে কেন হঠাৎ?”
“না, মানে—নানুর সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে গিয়েছিল। নানুর ভগিনীপতি শিয়ালদার দিকে নতুন একটা হোটেল করেছে। সুরি লেনের কাছাকাছি। নানু সেখানে প্রায়ই থাকে। হোটেলটায় খদ্দের এখনও তেমন জোটে না। নানুর কাছে গেলে একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারে।”
মুরারি স্পষ্ট করে বন্ধুর মুখ দেখল। কেদারের মুখ দেখে সবই বোঝা যায়। মুরারির আর কিছু জানার দরকার হল না। বলল, “হোটেলে বিয়ে করবি?”
কেদার বলল, “তাতে ক্ষতি কি? আসল বিয়ে তো হয়েই গেছে। এটা জাস্ট লোক দেখানো। মানসীদের পাড়া থেকে সুরি লেন পাক্কা আড়াই মাইল দূরে, আমার শাশুড়িমশাই কিছু বলতে পারবেন না। কম খরচে টোপর পরা, গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে যাবে।”
মুরারি হাঁ করে কেদারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কেদার যে এত বুদ্ধি ধরে জানা ছিল না মুরারির। বলল, “তোর শাশুড়ি তোকে হারামজাদা বলে, ঠিকই বলে ; বুঝলি, তুই শালা সেন্ট পার্সেন্ট হারামজাদা।”
কেদার কথাটায় কান দিল না। হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে বলল, “আমার শাশড়িমশাইকে বলবি, এটা ভাদ্র মাস, অরক্ষণীয়া কন্যার ভাদ্র মাসে বিয়ে হয়।”
চার
নানুর ভগিনীপতির হোটেলের দোতলার দুই ঘর বরপক্ষ আর কনেপক্ষ ভাগ করে নিল। তেতলার চিলেকোঠার পাশে ছাদনাতলা হল। মুরারির অফিসের রতন হল পুরুত। কেদারকে টোপর পরিয়ে দোতলা থেকে তিনতলায় হাজির করানো হল, মানসীকে কনের সাজ পরিয়ে তেতলায় তুলে আনল প্রণব। মানসীর মা দোতলায় থাকলেন, মাকে নাকি মেয়ের বিয়ে চোখে দেখতে নেই।
রতন তার বাবার পুঁথি আর পাঁজি খুলে খুলে বিয়ের মন্ত্র পড়িয়ে দিল। বামুনের ছেলে হলেও সংস্কৃত ভাষাটা তার মুখে আসে না। যতবার হোঁচট খায়, ততবার একবার করে শালা বলে। মধু বলল, “রতন, তুই কার বিয়ে দিচ্ছিস, তোর শালার নাকি?” হাসাহাসি, পুরুষালী গলায় উলুধ্বনি, মালা বদল, সিঁদুর পরা শেষ করে বিয়ের পর্ব চুকে গেল। আবার দোতলায়। মানসীর মা সামান্য মেয়েলী কাজ সারলেন। কনেপক্ষের একুনে জনা দশেক মাত্র এসেছিল। মানসীর বাবা আসেননি।
কেদার তার শাশুড়িকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই শাশুড়ি বললেন, “এবার বাছা তুমি তোমার বউ নিয়ে যেখানে খুশি যাও, আমার কর্তব্য শেষ হয়েছে।” বলে তিনি কেদারের মাথায় হাত রাখলেন একটু।
কেদার বলল, “আজ্ঞে, আমি ভাবছিলাম, আপনার মেয়ে এখন কলকাতাতেই থাক, আসানসোলে বাড়িটাড়ি খোঁজ করতে দেরি হবে। পরে না হয় নিয়ে যাব।”
মানসীর মা বললেন, “মেয়ে এখন তোমার কাছেই থাকবে। আসানসোলে বাড়ি যতদিন না পাচ্ছ, ওকে চুঁচড়োয় ওর মাসির বাড়িতে রেখে দিও। আমরা অন্য পাড়ায় বাড়ি দেখছি, বাড়ি পাই, তখন একবার মেয়েকে নিয়ে তোমার শ্বশুরমশাইকে প্রণাম করতে এস।”
কেদার নিরীহের মত মুখ করে বলল, “আমার জন্য আপনাদের বড় কষ্ট হল।”
“আর ন্যাকামি করো না, তোমায় আমি খুব চিনেছি।”
কেদার অধোমুখে দাঁড়িয়ে থাকল।
নানুর ভগিনীপতি ইয়ার-দোস্ত টাইপের লোক; হোটেলের খাবার ঘরে কলাপাতা পেতে খুরি গেলাস সাজিয়ে সকলকে খাইয়ে দিলেন।
সব পাট চুকে গেলে মুরারি বিদায় নেবার সময় দেখল, ঝিরঝির করে বৃষ্টি নেমেছে।
কেদার সিগারেট ফুকতে যুঁকতে বলল, “বৃষ্টি নেমে গেল যে রে?”
“তাতে আর তোর কি? তুই তো এখন ফুলশয্যা করবি।”
“দূর শালা, আবার ফুলশয্যে কি? সে সব কবে হয়ে গেছে।”
মুরারি চোখ টিপে বলল, “এই হোটেলে?”
কেদার হাসতে হাসতে বলল, “হোটেল কি রে—এ আমার শ্বশুরবাড়ি, এখানে আমার স্পেশ্যাল ঘর আছে, তক্তপোশ, বিছানা আর একটা আলনা পর্যন্ত—”
মরারি বলল, “সত্যি, তুই একটা জিনিয়স!”
বিয়ের পর মুরারির সঙ্গে কেদারের একবার দেখা হয়েছিল, তারপর আর পাত্তা নেই। মানসীর সঙ্গেও মুরারির দেখা হয় না। একদিন কয়লাঘাটায় গিয়ে খোঁজও করেছিল মুরারি, শুনল—মানসী ছুটি নিয়েছে।
মাস কয়েক পরে আবার এক শীত ফুরিয়ে আসার সময় মুরারি বাড়ি ফিরতেই তার মা বললেন, “ওরে, কেদার এসেছিল।”
“কেদার? কখন?”
“অনেকটা বেলায়, তুই অফিস চলে যাবার অনেক পরে।”
“কী বলল?”
“ও যে কী বলল আমি বুঝতে পারলাম না। ঠাকুরঘরে ছিলাম, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী-যে বলে গেল হাউমাউ করে, আমার মাথায় ঢুকল না। কিসের একটা কথা তোকে বলতে বলল, আট পাউন্ড করে।”
“আট পাউন্ড?”
“তাই তো বলল।”
হাসতে হাসতে মুরারি ঘরের দিকে পালাল। বেদম হাসি পাচ্ছিল তার। কেদারের বাচ্চা হয়েছে নিশ্চয়। সাবাস কেদার, তুই দেখালি বাবা। কিন্তু, ছেলে না মেয়ে? কেদার কিছু বলে যায়নি। হে ভগবান, ওর যাতে ছেলে না হয়—ছেলে হলেই তো আর একটা কেদার। জ্বালিয়ে মারবে। তার চেয়ে ও শালার মেয়ে হোক, ঠেলাটা বুঝতে পারবে।