রোমের পতন
একের পর এক আশপাশের দেশগুলোর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়া। লুঠ করে আনা অগাধ ধনরত্ন, আর সেই সঙ্গে লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাস। আর তারপর, এই ক্রীতদাসদের ঘাড়ে মেহনত করবার সবটুকু দায় চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা ফুর্তি করা। রোম-সভ্যতার এইটেই হলো আসল চেহারা। দিগ্বিজয় আর দাসপ্রথা।
এমনিতে মনে হতে পারে, অন্যান্য দেশের পক্ষে এ-ব্যবস্থা যতো অন্যায়ই হোক না কেন, অন্তত রোমানদের পক্ষে এমনতরো ব্যবস্থা তো প্ৰায় ভূস্বর্গের মতো! রোমানরা অপরের দেশ লুঠ করে আনা দেদার ধনসম্পদ ভোগ করবে, অন্য দেশ থেকে বন্দী করে আনা মানুষগুলোকে জানোয়ারের মতো খাটিয়ে নিয়ে নিজেরা আয়েস করবে।— রোমানদের পক্ষে এর চেয়ে মজাদার ব্যাপার। আর কি হতে পারে?
আসলে কিন্তু তা নয়। মানুষের গল্পের এমনই ব্যাপার যে শেষ পর্যন্ত এই ব্যবস্থার দরুনই ঘনিয়ে আসতে লাগলো। ওদের নিজেদের সর্বনাশও। কেমন করে তা দেখা যাক।
দিগ্বিজয়। কিন্তু অন্যের দেশ জয় করতে হলে ঝাকে ঝাঁকে দেশের ছেলেদের বিদেশে পাঠিয়ে দিতে হয়। এই পাঠানো কিন্তু চিরকালের মতো। কেননা, তারা আর দেশে ফিরে আসবে না। ফিরে আসবে না কেন? কেননা, তারা চলেছে। দিগ্বিজয়ের জন্যে, অর্থাৎ কিনা অন্য দেশের সঙ্গে লড়াই করবার জন্যে। আর লড়াইতে তাদের কায়দাকানুন যতো ভালোই হোক না কেন, তাদের মধ্যে অনেককে তো মরতে হবেই। না মরে উপায় নেই। অবশ্য সবাই নিশ্চয়ই মরবে না। কিন্তু যারা মরবে না তারাও আর ফিরে আসবে না নিজের দেশে। তা কেন? কেননা, একটা দেশ শুধু জয় করলেই তো আর হলো না; দেশটাকে জয় করবার পর শাসনেও রাখতে হবে। আর শাসনে রাখতে হবে বলেই সে দেশে ঘাটি পাততে হবে—সৈন্যসামন্তের ঘাটি। তাই যুদ্ধের পর যারা মরলো না তারাও দেশে ফিরতে পারলো না, রয়ে গেলো। ওই ঘাঁটিগুলোয়।
তাই, এই দিগ্বিজয়ের খাতিরেই দেশ থেকে দেশের ছেলেরা ঝাকে ঝাকে উজাড় হয়ে যেতে লাগলো। ফলে ক্রমশ দেখা গেলো, দেশের মানুষের সঙ্গে দেশের জমিজমা, দেশের চাষবাস, দেশের শিল্প, দেশের বাণিজ্য— সব কিছুর সম্পর্ক যাচ্ছে ঘুচে। আর যদি তাই হয়, তাহলে চাষবাসই বলো আর শিল্প-বাণিজ্যই বলো, সবকিছুর দশাই ক্রমশ সঙ্গীন হয়ে উঠবে না কি? রোমের বেলায় দেখা গেলো ক্রমশ তাই হয়ে উঠছে।
তাই ইতিহাসের বই লিখতে বসে হালের একজন খুব নামকরা পণ্ডিত বলেছেন: দূর দেশে গিয়ে মরবার জন্যে ইতালী বিসর্জন দিতে লাগলো তার নিজের সন্তানদের, আর ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার জুটলো লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাস!
ক্রীতদাস। দাসপ্রথা। প্রথম দিকটায় মনে হয়েছিলো ভারি লাভের ব্যাপার বুঝি! ওরা থাকবে চাবুকের আগায়, মরবো হাড় কালি করে। কিন্তু ওদের দেওয়া হবে নিছক সেইটুকু যেটুকু নইলে কোনোমতেই জান বাঁচে না। আর ওদেরই মেহনত দিয়ে তৈরি বাকি সবটুকু জিনিসই একেবারে উজাড় করে নেওয়া হবে ওদের কাছ থেকে। দারুণ লাভের ব্যাপার নয় কি?
যতোই দিন যায় ততোই চোখে পড়ে, আসলে কিন্তু তা নয়। আর শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো। এই দাসপ্রথা একেবারে অচল হয়ে পড়েছে। কেমনভাবে— তাই বলি ।
ক্রীতদাসীরা হলো প্রভুর সম্পত্তি। গোরুর মতো, গাধার মতো। বাঁচবার ব্যাপারে। তার নিজের কোনোরকম অধিকার নেই। সে যেন হাল-লাঙলের মতো আর পীচ রকম হাতিয়ারের মধ্যে একটা হাতিয়ার মাত্র। তফাতের মধ্যে শুধু এই, যে এহাতিয়ারটা কথা কইতে পারে, এর ধড়ে প্রাণ আছে। তার নিজের গতির দিয়ে তৈরি জিনিসের ওপর তার নিজের কোনো রকম অধিকার নেই। আর যদি তাই হয়, তাহলে এই ক্রীতদাসের পক্ষে পৃথিবীকে আরো বেশি করে জয় করবার, পৃথিবীর সঙ্গে আরো ভালো করে লড়াই করবার, সত্যিই কি কোনো রকম তাগিদ থাকতে পারে? কী লাভ মাটির বুকে বেশি করে ফসল ফলিয়ে? কী লাভ খনি খুঁড়ে বেশি। করে জিনিস তুলে এনে? কামারশালে কামার, তাঁতশালে তাঁতি-কারুর পক্ষেই বেশি জিনিস তৈরি করবার কোনো রকম উৎসাহ থাকতে পারে না! কেননা, যতো। বেশি জিনিসই সে তৈরি করুক না কেন, তাতে তার নিজের কপাল একটুও ফিরবে: না। তাই, চাবুকের ভয়ে যতোটুকু মেহনত না করলেই নয়। শুধু ততোটুকু মাত্র মেহনত করা। তার মানে, মেহনতের কোনো গা নেই, উৎসাহ নেই।
মোটের ওপর ফলটা দাঁড়ালো কী রকম? আবিষ্কারের অভিযানটা যেন থমকে থেমে গেলো। পৃথিবীকে বেশি করে আর ভালো করে জয় করবার কায়দা নিয়ে কার মাথাব্যথা? কারুরই নয়। ক্রীতদাসদের মধ্যে সে-উৎসাহ ঘুচে যেতে কেন বাধ্য তা তো দেখতেই পেলে। আর মালিকের দল? পরের মেহনতের ওপর নির্ভর করতে করতে তারা তো দিনের পর দিন অকৰ্মণ্যই হয়ে চললো; হাতে-কলমে কাজ করবার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই পৃথিবীকে জয় করবার নতুন কায়দা, বের করবার কথা তাদের বেলাতে তো ওঠেই না!
তা ছাড়া, ক্রীতদাসদের আমন অমানুষিকভাবে শোষণ করে মালিকরা যে সম্পদটা পেতো সেটার কথাও একবার ভেবে দেখো। কী হতো সেই ধনরত্নের? পৃথিবীকে নতুন কায়দায় জয় করবার উৎসাহে কী রকম ভাঁটা পড়েছে! তাই ওই অগাধ ধনসম্পদ নিয়ে মালিকদের পক্ষে শুধুই ফুর্তি করা, ওটাকে যেন খই-কলা করে খরচ করে ফেলা, উড়িয়ে দেওয়া। তার মানে, ওই ধনসম্পদের কোনো আদায়ই থাকে না, দেশের কোনো রকম মঙ্গল হয় না ও থেকে। কথাটা ভালো করে বুঝছো তো? যেমন ধরো, আমাদের দেশে আজ যদি কেউ এক কোটি টাকা পায়, আর সেই টাকাটা দিয়ে সে যদি কোনো কারখানা ফাঁদে, তাহলে তাতে নিশ্চয়ই দেশের লাভ হবে। কেননা তাতে মোটের ওপর দেশের সম্পদ খানিকটা তো বাড়বেই। কিন্তু তার বদলে সে যদি ওই টাকাটা শুধু ফুর্তি করে ফুকে দেয় তাহলে তাতে দেশের কোনোই লাভ নেই। কেননা, এ থেকে পৃথিবীকে বেশি করে জয় করবার ব্যাপারে দেশের মানুষকে এগিয়ে চলতে কোনো রকম সাহায্যই করা হবে না ।
রোমের প্রভুরা জানতো শুধু বিলাসিতা। আর ওই রকম বিলাসিত করে সমস্তটুকু ধনসম্পদ উড়িয়ে দিতো বলেই তার থেকে দেশের কোনো রকম উন্নতি হতো না। শুধু তাই নয়, লুঠতরাজের ভাগবঁটরা করা নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যেই ক্রমশ শুরু হয়ে গেলো দারুণ মারপিট, লড়ালড়ি। আর তাই টুকরো টুকরো হয়ে যেতে লাগলো রোমের দম্ভ!
দাসপ্রথা কীভাবে একেবারে অচল হয়ে পড়তে লাগলো তার আরো একটা মস্ত জরুরী দিক আছে। ক্রমশ দেখা যেতে লাগলো, ক্রীতদাস কেনবার বাজার-দর যতোই পড়ে যাক না কেন, নেহাত নামমাত্র দামে হাজার হাজার ক্রীতদাস কিনেও প্রভুদের আর তেমন লাভ হচ্ছে না। কেননা, ওরা আর মুখ বুজে জানি কবুল করে মালিকদের জন্যে মেহনত করতে রাজি হচ্ছে না। তার বদলে বরং জান কবুল করে। ওরা রুখে দাঁড়াচ্ছে মালিকদের বিরুদ্ধে। তারা দল বাঁধতে শিখছে, জারি করছে বিদরোহ। এ-সব বিদরোহ সত্যিই খুব ছোটোখাটো রকমের বিদরোহ নয়। ক্রীতদাসরা যখন একজোট হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে তখন একেবারে দুর্বর হয়ে উঠেছে তাদের শক্তি, কেঁপে উঠেছে রোম সাম্রাজ্যের ভিত্তিটা! এই সব বিদরোহ দমন করবার জন্যে বহুত বহুত পাইক-পেয়াদা আর সেপাই-লস্কর দরকার। এর জন্যে খরচা বড়ো কম নয়। তাই, যতোই দিন যায় মালিক-প্রভুরা ততোই স্পষ্টভাবে দেখতে পায় যে নেহাত জলের দরে ক্রীতদাস খরিদ করেও শেষ পর্যন্ত যেন পোষায় না। এদের শাসনে রাখতে হলে খরচা করতে হয় দেদার।
এইভাবে, নানান দিক থেকে দেখা যেতে লাগলো, দাসপ্রথা একেবারে অচল হয়ে পড়ছে। তাই ঘনিয়ে আসতে লাগলো রোমের পতন।