রোমহর্ষক
১৩৪০ সালের কথা।
তখন বর্ষাকাল। সেদিন আবার সকাল থেকেই দুর্যোগ। পানপুর গ্রামের ধনা পণ্ডিত হঠাৎ সর্পাঘাতে মারা গেল। ধনা পণ্ডিত নাম হলেও আসলে সে ছিল চাঁড়াল পাড়ার বাসিন্দে। তখনকার দিনে সর্পাঘাতে কোনও লোক মারা গেলে তাকে না পুড়িয়ে নদী অথবা খালের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হত। ধনা পণ্ডিতের বেলাতেও সেইরকমের তোড়জোড় হতে লাগল। বড় বড় কয়েকটা কলাগাছ কেটে তারই মাঞ্জাসে ধনা পণ্ডিতকে দড়ি দিয়ে বেঁধে শুইয়ে দেওয়া হল। তারপর সন্ধের একটু আগে প্রবল বর্ষণে ভিজতে ভিজতে সকলে মিলে ধনা পণ্ডিতকে গ্রামের প্রান্তে কানা নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে এল।
ধনা পণ্ডিতের বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। স্ত্রী এবং দুটি ছোট মেয়ে ছাড়া আর কেউ ছিল না ধনার। ধনার বউ সারারাত ধরে কান্নাকাটি করতে লাগল।
এর ঠিক দু’দিন বাদে হঠাৎ দুপুরবেলা হইহই করে উঠল গ্রামের লোক। কী ব্যাপার? না, ধনা পণ্ডিত ফিরে এসেছে। তবে জীবিত অবস্থায় নয়, মৃতই। যারা খবর দিল তাদের মুখে এই কথা শুনে সবাই ছুটল নদীর ধারে। গিয়ে দেখল সেই কলার মাঞ্জাস আবার ফিরে এসেছে এবং মাঞ্জাসে ধনা পণ্ডিত মৃত ও একই রকম অবস্থায় শুয়ে আছে একভাবে। সত্যিই চমকপ্রদ ব্যাপার। এই তিনদিনে ধনা পণ্ডিতের চেহারার এতটুকু বিকৃতি ঘটেনি।
ধনার বউ তো ধনাকে দেখে আবার আছাড়-কাছাড় করে কান্নাকাটি শুরু করল। ধনার বউ বলল, “ও নিশ্চয়ই মরেনি। সাপের বিষে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তোমরা ভাল রোজা বদ্যি ডাকো। ঘরে নিয়ে চলো কর্তাকে।”
কিন্তু ঘরে নিয়ে চলো বললেই তো নিয়ে যাওয়া যায় না। গ্রামে ঘরে শুভ অশুভর বিচার একটা আছে।
অবশেষে অনেক ভাবনাচিন্তার পর সকলে ঠিক করল, গ্রামের বাইরে শ্মশানের ধারে একটা চালাঘর আছে। সেই চালাঘরে ধনাকে নিয়ে গিয়ে রাখা হবে এবং সকলে মিলে পালা করে দিবারাত্র জেগে পাহারা দেবে ধনাকে। এবং সেই ফাঁকে ভিন গাঁ থেকে কিছু রোজা বদ্যি নিয়ে এসেও দেখাবে। এই যুক্তি করে সবাই মিলে ধরাধরি করে ধনাকে শ্মশানের চালাঘরে নিয়ে এসে রাখল।
ধনার বউ বলল, “কর্তাকে অমন করে বেঁধে রাখবার দরকার নেই। বাঁধনটা খুলে দাও।” তাই করা হল।
ধনার বউ বলল, “একটু গরম দুধ খাইয়ে দিলে হত না?”
এ ব্যাপারে অবশ্য আপত্তি করল অনেকেই। বলল, “মরা মানুষকে আবার কে কবে দুধ খাওয়ায়? আর দুধ খাইয়ে লাভই বা কী? মৃতের মুখে ঢাললেও সে দুধ তার পেটে যাবে কেন?”
ধনার বউ বলল, “তবু দেখিই না! যদি ভেতরে প্রাণ থাকে? যদি খায়!” এইসব করতে করতেই সন্ধে গড়িয়ে গেল। একটা চিমনি লণ্ঠন জ্বেলে গ্রামের জনাচারেক যুবক সেই রাত্রিটা ধনাকে পাহারা দিয়ে জেগে থাকতে রাজি হল।
রোজাও এল। এসে বলল, “না বাপু, এ মরেই গেছে। একে বাঁচানো আমার কর্ম নয়। যাও, আবার একে ভাসিয়ে দিয়ে এসো।” এর পর একজন কবিরাজ এলেন। বললেন, “নাঃ। তিনদিন আগেই মরেছে মানুষটা। কিন্তু কেন যে পচন ধরেনি তা তো ভেবে পাচ্ছি না।”
পাশের গ্রাম থেকে বড় একজন সাপের যাই হোক, সন্ধের পর ধনার বউ একবাটি গরম দুধ নিয়ে এল। সঙ্গে নিয়ে এল ছোট মেয়ের দুধ খাওয়াবার ঝিনুকটা। এ ছাড়া খাওয়াবেই বা কী করে? ধনা তো চুমুক দিয়ে খেতে পারবে না। ধনার বউ তবু জেদ করেই ঝিনুকভর্তি দুধ নিয়ে ধনার মুখে গুঁজে দিল।
আশ্চর্য ব্যাপার! যেন কোনও এক জাদুমন্ত্রবলে সেই দুধ শুষে নিতে লাগল ধনা। সে দুধ শেষ হতেই আবার দুধ এল। ফের এল। খবর রটে গেল গ্রামময়। তখন মানুষের পুকুর ভরা মাছ ছিল। মরাই ভরা ধান ছিল। গোয়াল ভরা গোরু ছিল। কাজেই দুধের অভাব ছিল না। প্রায় প্রত্যেক বাড়ি থেকেই দু-এক ঘটি করে দুধ আসতে লাগল ধনার জন্য। গ্রামের লোকেরাও ঘরের কাজ ফেলে রেখে সবাই এসে সেই রাতদুপুরে জড়ো হল শ্মশানে ধনার দুধ খাওয়া দেখতে। সর্বসাকুল্যে হিসেব কষে দেখা গেল প্রায় সের তিরিশ দুধ খাওয়ানো হয়েছে ধনাকে। অথচ পেটে হাত দিয়ে দেখা গেল যেমনকার পেট তেমনই পড়ে আছে।
এ একটা রীতিমতো ভয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। প্রত্যেকে একবাক্যে বলল, নিশ্চয়ই কোনও দানোতে ভর করেছে ধনাকে। অতএব আর নয়! এবার ওকে চিতার আগুনে পুড়িয়ে দাও।
এই কথা শুনেই ধনার বউ তো কেঁদে ককিয়ে উঠল। সকলের পা জড়িয়ে ধরে বলল, “না গো না। আমার কর্তা ঠিক বেঁচে উঠবে। ওর কিছু হয়নি। দোহাই তোমাদের, ওকে বেঁচে ওঠবার একটু সময় দাও। তা ছাড়া ও তো কারও ক্ষতি করেনি। না হয় ওর দুধ খাওয়ার পরিমাণটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। হাজার হলেও তিনদিনের খিদে।”
গ্রামের লোক সকলে না হলেও অনেকেই বলল, “তা অবশ্য ঠিক। আর গ্রামের ভেতরেও যখন নেই তখন দেখাই যাক না শেষ পর্যন্ত কী হয়।” এই বলে সবাই ফিরে এল।
রইল শুধু চারজন।
রাত্রি তখন কত তা কে জানে?
বর্ষাকাল। আকাশ এক সময় মেঘে ঢেকে গেল এবং শুরু হল প্রবল বর্ষণ। সেইসঙ্গে দমকা ঝোড়ো বাতাসে সবকিছু যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। ঘরের ভেতরে যে চিমনি লণ্ঠনটা ছিল সেটাও একসময় নিভে গেল ধুপ করে।
ওদিকে গ্রামের ভেতর থেকে তখন প্রচণ্ড এক কোলাহল ভেসে আসতে লাগল। সেই কোলাহলের শব্দ শুনে এরা চারজনেই তখন পরস্পর পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। কী হল কে জানে? যা বর্ষার দাপট! বান এল? না ঝড়ে কারও চালা উড়িয়ে নিয়ে গেল? কিন্তু তাই যদি হয়, তা হলেই বা এত হট্টগোলের কী আছে? আর বানই যদি আসবে তা হলে তো বানের জল এতক্ষণে এখানেও গড়িয়ে আসত।
একজন বলল, “মনে হচ্ছে গ্রামে কোনও বিপদ ঘটেছে।”
আর একজন বলল, “ডাকাত ফাকাত পড়েনি তো?”
“না। না। এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগে ডাকাতি? তা ছাড়া আমাদের এই গ্রাম হচ্ছে গরিব দুঃখীর গ্রাম। এ গ্রামে ডাকাত পড়তে যাবে কেন?”
“তা হলে কী করা যায়?”
“কিছু তো ভেবে পাচ্ছি না রে ভাই। এ যা দুর্যোগ, এই দুর্যোগে কেউ যে একজন গিয়ে একটু খোঁজখবর নিয়ে আসব তাও তো সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে এইরকম অবস্থায় পাহারাদারি ফেলে রেখে যাওয়াটাও ঠিক নয়।”
এরা যখন এইসব আলোচনা করছে ওদিকের কোলাহল তখন আরও তীব্র রূপ ধারণ করেছে।
অবশেষে ঠিক হল ওদের ভেতর থেকে দু’জন বসে এখানে পাহারা দেবে এবং দু’জনে গিয়ে খবর নিয়ে আসবে ব্যাপারটা কী এবং কীসের এত গোলমাল।
এমন সময় হঠাৎ সশব্দে একটা বাজ পড়ে বিদ্যুৎ চমকাল। আর বিদ্যুৎ চমকাতেই সেই আলোয় যে দৃশ্য ওরা দেখতে পেল তাতে চারজনেই লাফিয়ে উঠল একসঙ্গে। দেখল শূন্য মাঞ্জাসটাই শুধু পড়ে আছে সেখানে কিন্তু মৃতদেহের অস্তিত্বও নেই।
যেই না দেখা অমনই তো বাবা রে মা রে করে দৌড় দিল সব একসঙ্গে। কিন্তু এই জলে ঝড়ে কি কাদার রাস্তায় ছোটা যায়? তবুও প্রাণপণে ছুটল সব গ্রামের দিকে। তখন শেষ রাত।
গ্রামসুদ্ধু লোক তখন লাঠি সড়কি কাস্তে কুড়ুল নিয়ে ছুটোছুটি করছে চারদিকে। কী ব্যাপার? মাঝরাত্তিরে হঠাৎ নাকি ধনা পণ্ডিত এসে লাথি মেরে ঘরের দরজা ভেঙে ওর বউয়ের কাছ থেকে ছোট মেয়েটাকে কেড়ে নিয়ে চলে গেছে।
সেইজন্যই এত ছোটাছুটি ও খোঁজ খোঁজ রব। কিন্তু সারা গ্রাম তোলপাড় করেও কোথাও মেয়েটির বা ধনা পণ্ডিতের কোনও হদিসই পাওয়া গেল না। এরা চারজনও তখন ধনা পণ্ডিতের অন্তর্ধান রহস্যটা বলল সকলকে।
শুনে সবাই খুব বকাবকি করল ওদের। বলল, “কোথায় ছিলে তোমরা, ঘুমোচ্ছিলে নাকি? চোখের সামনে থেকে মৃতদেহটা উঠে এল আর তোমরা কেউ দেখতে পেলে না? যদি তোমাদেরকেই মেরে ফেলত? আমরা তো ভেবেছিলাম তোমাদের চারজনকে শেষ করেই ও এখানে এসেছে। তাই শ্মশানের দিকে তোমাদের খোঁজ নিতেও কেউ যাইনি।”
এইভাবেই ভোর হল। এবং দুর্যোগও একটু কমল। সকলে তখন অনেক খোঁজাখুঁজির পর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে শ্মশানের সেই চালাঘরের দিকেই চলল। গত রাত্রের ব্যাপারে সকলেই খুব আতঙ্কিত। কেননা ধনা পণ্ডিতকে কোনওরকমে খুঁজে বের করতে না পারলে সমূহ বিপদ।
তাই সবাই চালাঘরের কাছে এসেই স্তম্ভিত হয়ে গেল। দেখল চালাঘরের ভেতর কলার মাঞ্জাসে কর্দমাক্ত ধনা পণ্ডিত আগের মতোই শুয়ে আছে। আগের মতোই সে মৃত। তবে তার সারা দেহে চাপ চাপ রক্তের দাগ। গালের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা। উঃ, কী বীভৎস সেই দৃশ্য! ও রক্ত যে কার, তা বুঝতে পারল সকলেই। কিন্তু আর তো কোনও উপায় নেই। অনেক দেরি হয়ে গেছে তখন। তবুও ধনাকে যে পাওয়া গেছে এই রক্ষে! গ্রামবাসীরা আর একটুও দেরি না করে ধনা পণ্ডিতের দেহটা চিতার আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে ফেলল।