রোবু আর ভুতো
দেখে দেখে ঠিক আজকেই মা অফিস থেকে ফিরতে বেজায় দেরি করছেন। দীপ বারবার উঁকি মারছে বারান্দা থেকে। নতুন কিছু করে ফেলার পর এই এক মুশকিল। কাউকে না দেখানো অবধি শান্তি নেই।
বুলাকে দীপ একরকম টেনে নিয়ে এসেছে খাওয়ার ঘরে। টেবিলের ওপর আচারের একটা খালি বোতল আর প্লেট-ঢাকা দুটো জলের গেলাস। আর প্রত্যেকটার মধ্যে একটি করে বন্দি মাকড়সা।
ধমক খেল রিনার মা, দেখলেই যখন এই কাণ্ড চলছে, আরও দুটো খালি বোতল খুঁজে পেলে না? ভাবো তো, ওই গেলাস দুটো কখনও যদি খাওয়ার গেলাসের মধ্যে মিশে… কথা শেষ করার আগেই শিউরে উঠল বুলা।
দুটো খালি বোতল জোগাড় করা, দীপকে বুঝিয়েসুজিয়ে মাকড়সা দুটো তাতে ট্রান্সফার এবং বিষাক্ত গেলাস দুটো ভেঙে বাতিল করার আধ ঘণ্টা পরে বাড়ি ফিরেছে অলোক।
মায়ের চেয়ে বাবা ঢের সায়েন্টিফিক। এক ঘণ্টা ধরে খুব আগ্রহ নিয়ে শুনেছে এই ভয়ানক জন্তুদের বন্দি করার কলাকৌশল। কিন্তু শিখিয়ে কোনও লাভ হয়নি। একটা ফাঁকা বোতল এগিয়ে দিতেই বাবার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। নিজে হাতে মাকড়সা ধরার সাহস নেই।
দীপ টিভি দেখছে। পাশের ঘরে এসে অলোক বলল, বুলা, কাল তোমার মা-কে একবার জিজ্ঞেস করো তো, ফ্যামিলির মধ্যে কোনও পাগলামির নজির আছে কি না!
আগে তুমি তোমার বাড়িতে সেই খবর নাও। কেন, দু-বছর আগে যে বলতে, এটা প্রতিভার লক্ষণ!
আহা, পিঁপড়ে আর মাকড়সা কি এক হল? পিঁপড়েদের আচার-আচরণ স্টাডি করা, সেটা তো সত্যিই এনকারেজ করার মতো। কত বিজ্ঞানী এই নিয়ে…
হয়েছে। কোনও কিছুরই বেশি বাড়াবাড়ি ভালো নয়। কেরোসিন দিয়ে পিঁপড়ে মারার পর কী কাণ্ড বাধিয়েছিল, মনে আছে? তা-ও তো লুকিয়েই করেছিলাম। দু-দিন বাদে পিঁপড়েরা নিজে থেকে দেখা না দিলে বোধহয় বাড়িই ছাড়তে হত। পিঁপড়েওয়ালা বাড়ি খুঁজতে হত!
অলোক বলল, ব্যাপারটা খুব সোজা। ক্লাস টু-এ জীববিজ্ঞান, তারপর এক বছর গ্যাপ, এবার আবার…
ভাগ্য ভালো যে, রসায়নবিদ্যার হাত থেকে রেহাই পাওয়া গিয়েছে।
গত বছর দীপ প্রতি মাসে গড়ে একটা করে গ্যাস সিলিন্ডার ফাঁকা করেছে জলটল ফোঁটাতে আর রেফ্রিজারেটারটাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে।
অলোক ভুরু কুঁচকে বলল, ওহ্, সে কথা হচ্ছে না। ব্যাপারটা জীববিজ্ঞান বা কেমিস্ট্রি নয়। আসলে ওর কিছু করার নেই। সেই দুপুর বারোটা থেকে ছটা। অফিস থেকে আমাদের বাড়ি না-ফেরা অবধি। বড় হচ্ছে–রিনার মা তো আর ঠিক বন্ধু নয়।
কী করতে বলো?
পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলুক বিকেলবেলা। কিছু ক্ষতি হবে না। অন্তত বাড়িতে আটকে রাখার চেয়ে বেটার।
.
গলির মোড়ে পা রাখতেই একটা বেজায় হেঁড়ে গলার চিৎকার বহু দুর থেকে কানে। এসেছিল। বাড়ির সামনে পৌঁছোবার পর বুলা একসঙ্গে একাধিক আবিষ্কার করল। আওয়াজটা আসছে তাদেরই তিনতলার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে। আওয়াজটা তৈরি করছে দীপ। মা-কে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যই গলা মোটা করে জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালের কলি গাইতে লাগল।
অলোক বাড়ি ফিরতেই বুলা ঘোষণা করল, সাপ ধরুক কি ব্যাং, বাড়িতেই থাকতে হবে ওকে। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে কিছুতেই মিশতে দেব না। পড়াশোনায় গোল্লা পাক, তাতেও কিছু যায়-আসে না। এসব চলবে না বলে দিচ্ছি।
সাত দিন সময় চেয়েছিল অলোক। কিন্তু তিন দিনের মাথায় রোবুকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। দীপের সঙ্গী। বাড়িতে থাকবে। সারাক্ষণের সঙ্গী।
রোবুর সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জমে গিয়েছে দীপের। রোবু মানেই যে রোবট, সেটা দীপ ভালোই জানে। যন্ত্রমানুষ। কিন্তু চেহারা দেখে ধরার উপায় নেই। সেকেলে নাটবোল্ট আর রিভেট-মারা খটমটে নকল মানুষ নয়। এরা হিউম্যানয়েড। গায়ে হাত রাখলে নরম চামড়ার তলায় রক্তের আমেজ অবধি অনুভব করা যায়। বেজায় মানুষ।
সবচেয়ে বড় কথা, দীপের ক্লাসের বন্ধুদের মধ্যে বারোজনের রোবু-বন্ধু আছে। তাদের অনেক গল্প সে শুনেছে।
চাইনিজ চেকারের বোর্ড পেতে রোবুকে ডাক দিল। পরপর চারবার জিতেছে দীপ। আবার খুঁটি সাজাচ্ছে দেখে রোবু বলল, ন-টা বাজে। খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।
লাস্ট দান।
রোবু এই প্রথম জিতল। দীপের রোখ চড়ে গেল, প্লিজ, আর-একবার।
তুমি কিন্তু বলেছিলে লাস্ট।
এবার সত্যি লাস্ট।
হেরে গেলেও তো?
হ্যাঁ।
আবার দীপ হেরে গেল। রোবুর অবাধ্য হলে তাকে হারানো সম্ভব নয়। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে রোবু ক্রিকেট কোচিং শুরু করেছে। বল ও ব্যাট–দুটোতেই চৌকশ। রোবুর দেখাদেখি এ পাড়ায় দীপের আরও তিন বন্ধুর একটি করে রোবট-সঙ্গী জুটেছে। বাদ পড়ে গেছে নীল। রোবট-সঙ্গীর দাম তো কম নয়।
জাম গাছের তলায় বসে আধ ঘণ্টা ওদের ক্রিকেট খেলা দেখার পর উঠে দাঁড়াল নীল। বেশ কয়েকবার বলেছে, কিন্তু রোবটগুলো স্বার্থপর। কিছুতেই নীলকে ওরা দলে নেবে না।
নীল ভুতোদার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। দাঁত-বের-করা পোড়ো বাড়ি। চারধারে কাঁটাঝোঁপ। বুনো হলদে ফুল এখানে-সেখানে। এককালে জায়গাটায় ভাগাড় ছিল বলে কেউ বড় একটা ঘেঁষতে চায় না। না হলে কবে আকাশছোঁয়া বাড়ি উঠে যেত।
দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা বহুকাল আগেই ধসে গেছে। ভুতোদা সিঁড়িটিড়ির ধার ধারে না, কিন্তু নীলের তো আর সে ক্ষমতা নেই, কাঁঠাল গাছটাই ওর ভরসা। ওটা বেয়েই ছাতে গিয়ে নামে। প্রথম দিনেও তাই করেছিল। অবশ্য সে দিন এসেছিল গুপ্তধনের সন্ধানে। বাড়িটার চেহারা দেখেই তার সন্দেহ হয়েছিল, এর মধ্যে নিশ্চয় চোরাকুঠুরি আছে। তার মানেই ধনরত্ন৷ গুপ্তধন না পেলেও ভুতোদার দেখা পেয়েছিল নীল।
বেশ ক-টা তোবড়ানো সুটকেস, ঠ্যাং-ভাঙা খাট আর চেয়ার, ফুটিফাটা কাঁচওয়ালা একটা ড্রেসিং টেবিল। সমস্ত জিনিসের ওপর ধুলো আর মাকড়সার কারিকুরি। কিন্তু ধুলো মাখা মেঝের ওপর অনেক টাটকা পায়ের ছাপ। মিশমিশে কালো বেড়ালটা নীলকে দেখেই আড়মোড়া ভেঙে এমনভাবে ম্যাঁও করল যেন অনেকদিন বাদে বন্ধুর সঙ্গে দেখা। এখনও দিনের আলো পড়েনি, তাই ভুতোদাকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু শূন্যে একবিন্দু আগুন মাঝে মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে আর ধোঁয়া পাক খেয়ে উঠছে তারপরেই। ধূমপান করছে ভুতোদা।
স্প্রিং-ভাঙা চেয়ারটা ক্যাঁচক্যাঁচ করে উঠল। নড়েচড়ে বসেছে ভুতোদা, আরে নীল। এসো এসো। অনেকদিন পরে।
গল্পে যেরকম পড়া যায়, ভুতোদর কথায় তেমন কোনও টান নেই। চন্দ্রবিন্দু যোগ করার প্রাচীন সংস্কার বর্জন করেছে।
ভুতোদা জিজ্ঞেস করল, তা হঠাৎ অবেলায়? খেলা ছেড়ে?
কী করব বলো? ওরা তো খেলতেই নিচ্ছে না।
ওরা বলতে কারা থেকে শুরু করে নীলের কাছ থেকে রোবটদের কথা সব খুঁটিয়ে জেনে নেয় ভুতো। শেষে থমথমে গলায় বলে, ভাগ্যিস আমি রিটায়ার করেছি, তাই খুব বেঁচে গেল!
তার মানে?
রিটায়ার করার পর ভূতেরা আর ভয় দেখায় না। না হলে রোবটদের দফা…
সত্যি ভুতোদা, দিনরাত ঘরে বসে বসে বুদ্ধি তোমার একেবারে গিয়েছে। আরে, রোবটরা কি মানুষ, যে ভূতের ভয় পাবে?
একটু থমকে গেল ভুতোদা। নিশ্চয় আত্মসম্মানে লেগেছে। অবশ্য তারপরেই হেঁকে উঠেছে, ভয় না পাক, একশোবার অবাক হবে। চলো, দেখি কে কীরকম বীর?
ভুতোদার ঠান্ডা হাত ধরে নীল খেলার মাঠে এসে দ্যাখে, দীপের হাতে বল, রোবু ব্যাট করছে।
ক্রিকেট খেলার নিয়মটা ছোট্ট করে বুঝিয়ে দিয়ে নীল বলল, দেখছ তো, দীপ কিছুতেই ওকে আউট করতে পারছে না। উইকেট না পড়লে…
নীলের কথা শেষ হয়নি। যেন এক অদৃশ্য বলের আঘাতে উইকেট তিনটে ছিটকে গেল।
চমকে উঠল রোবু আর দীপ। নীল কিন্তু ভুতোর ওপর বেজায় খাপ্পা, যাহ্, তুমি এক্কেবারে আনাড়ি। দীপ হাত থেকে বলটা ছাড়ার আগেই উইকেট ফেলে দিলে কী করে হবে! বল করবে, ব্যাটসম্যান মিস করবে, তারপর সেটা উইকেটে লাগলে তবে না…।
এদিকে নীলকে দেখতে পেয়েই দীপ চ্যাঁচাতে শুরু করেছে, এটা কী হচ্ছে নীল? ঢিল ছুঁড়ে উইকেট ভাঙলি কেন?
নীল দেখল, রোবুও বেশ বুক ফুলিয়ে দীপের পাশে এসে পোজ দিচ্ছে।
ভুতোদা বলে উঠল, উইকেট আবার ভাঙল কোথায়? আস্তই তো দেখছি।
ভুতোদা কোন ফাঁকে উইকেটগুলো যথাস্থানে ফিট করে দিয়েছে, কেউই লক্ষ করেনি। দীপ এখন ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে। রোবুর মাথায় অন্য চিন্তা, আপন মনে বিড়বিড় করছে, স্পষ্ট দু-জনের গলার স্বর শুনেছি। অসিলোস্কোপের বিশ্লেষণ। ভুল হতে পারে না। অথচ একজনকে শুধু চোখে দেখছি। ব্যাপারটা কী?
ব্যাপারটা অতি সোজা। আমি ভূত।
ভূত? টাইটেল কী?
শোনো কথা! ভুতোদা রেগে টং, এ ব্যাটা ভূতের নামই শোনেনি রে নীল!
রোবু তবু থামে না, আপনার বাবা-মা-র নামটা কী, জিজ্ঞেস করতে পারি?
নিশ্চয় পারিস। তার আগে তোর মা-বাবার নাম বল দেখি।
রোবু দমেনি, আমি কি মানুষ যে…
তাহলে তুই কোন আক্কেলে আমাকে সেই প্রশ্ন করিস?
মানে, অদৃশ্য মানুষ বলে কিছু থাকার তো লজিক নেই, তাই জানতে চাইছি।
আবার বলে মানুষ! বলছি আমি ভূত, তবু সেই এক কথা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান।
দীপ রোবুর হাত টেনে ধরে, প্লিজ রোবু, শিগগির বাড়ি চলো। আমার ভয় করছে।
দীপের কথা ঠেলতে পারে না। খেলার সাজসরঞ্জাম গুটিয়ে রোবু ফিরতি পথে পা বাড়ায়। তার মাথায় এখন ইলেকট্রন উঠে গেছে।
নীলের বন্ধুরা সকলেই ভুতোদার কথা একটু-আধটু জানে। জানে, নীলের সঙ্গে তার বেজায় ভাব। কিন্তু ভুতোদা ভূত হলেও আজ অবধি কাউকে ভয় দেখায়নি। রাত্রিবেলা ইচ্ছে করলেই মিশমিশে দাড়িওয়ালা কঙ্কাল হয়ে হাজির হতে পারে, কিন্তু করে না। এইসব বলতে বলতেই যাচ্ছিল দীপ৷
একদম অবাস্তব। অসম্ভব ব্যাপার। কোনও পদার্থবিদ্যায় এমন কথা পড়িনি। রোবু মানতে চায় না।
তুমি না পড়লে কী হবে! নিজের চোখে দেখেছি। ছিল তিনটে গোল্ডফিশ। হয়ে গেল কুচকুচে কালো পপি।
সত্যি বলতে, এরপর থেকেই নীলের পেছনে লাগা বন্ধ করেছিল দীপ। দোষের মধ্যে দীপ একদিন বলেছিল, আচ্ছা নীল, তোর চৌবাচ্চায় আছে তো ক-টা তেলাপিয়া। অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছ পোর তুই কী জানিস? অ্যাঞ্জেল দেখেছিস? তিন-তিনটে আছে আমার।
নীল হঠাৎ দৌড় লাগিয়েছিল। আবার ফিরেও এল হাঁপাতে হাঁপাতে। বলল, খুব গুল মারছিস তাহলে আজকাল? ভুতোদা বলেছে, তোর একটাও অ্যাঞ্জেল নেই। আছে তিনটে বিচ্ছিরি কেলে মলি।
বাড়ি ফিরে দীপ দেখল, সত্যিই…।
রোবু বাধা দিল, প্লিজ দীপ, আজগুবি গল্পগুলো এবার থামাও। না হলে আমার মাথাটাই বিগড়ে যাবে।
পরের দিন দীপের বাবার কাছ থেকে তিন দিনের ছুটি চেয়ে নিল রোবু। ভূতের এসপার-ওসপার না করে ছাড়বে না সে। দু-দিন পড়ে রইল ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। ভূত সম্বন্ধে ছাপার হরফে কিছু আর বাদ রাখেনি। সব পড়ে রোবু বুঝেছে, মোদ্দা কথা একটাই। যারা সত্যিকার ভৌতিক কাণ্ড দেখেছে, তারা স্বীকার করে যে, ভূত আছে। আর যারা বলে ভূত নেই, তারা কখনও স্বচক্ষে ভৌতিক কাণ্ড দেখেনি।
রোবুকে সবচেয়ে নিরাশ করেছে পদার্থবিদরা। ভূতের অস্তিত্বের সম্ভাবনা-তত্ত্ব নিয়ে আজ অবধি কেউ একটা থিয়োরিটিক্যাল পেপার লিখল না!
সায়েন্স কলেজে শোরগোল ফেলে দিল রোবু, হয় ভূত থাকবে, নয়তো আমি। ভূত যা তা কাণ্ড চালিয়ে যাবে আর আমি তার কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাব না, এটা কী করে হয়? আর লোকেই বা তাহলে রোবট রাখবে কেন এত খরচ করে? বইয়ে তো দেখছি, অনেকেই বলছে যে, রোজ দু-তিনটে পচা মাছ কড়া করে ভেজে খাওয়ালেই ভূতেরা দিব্যি পোষ মানে।
হাই লেভেল মিটিং-এর পরে সায়েন্স কলেজের প্রফেসার তরফদার ভূত-বিরোধী কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন। সাত দিনের মধ্যে তিনি রিপোর্ট পেশ করবেন।
তরফদারের রিপোর্ট পড়ার পর ভরসা ফিরে পেল রোবু। ভারী প্রাঞ্জল কোয়ান্টাম ভাষায় তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, কেন ভূত বলতে যা বোঝায়, সেরকম কোনও জীবের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। শুধু বিজ্ঞানী আর রোবটদের মনের খোরাক জোগালেই তো চলবে না, সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছোতে হবে। তরফদার জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি নিজে বিভিন্ন জনসভায় হাতেনাতে এক্সপেরিমেন্টের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে দেবেন, ভূত নেই।
তথাকথিত উপদ্রুত এলাকার ওপরেই জোর দিতে চান তরফদার। প্রথম জনসভার আয়োজন হয়েছে দীপদের পাড়ায়। সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা উদযাপন সমিতির উদ্যোগে।
ব্লান্ডার করল রোবু, দীপের কথায় কান দিয়ে। ভুততাদা হয়তো এসব নিয়ে মাথাই ঘামাত না। কিন্তু ভুতোকে ওরা একেবারে ঘরছাড়া করে দিয়েছে। দীপের কথা ঠেলতে পারেনি রোবু। ভূত নেই জেনেও ভূতুড়ে বাড়িটাকে তারা কর্পোরেশনের মিস্ত্রি লাগিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। অবশ্য ভূতের নাম করেনি, বলেছে যে, বাড়িটার কন্ডিশন বিপজ্জনক।
নীল সময়মতো বিকল্প ব্যবস্থা না করলে ভুতোদাকে কোথায় যে যেতে হত, বলা মুশকিল। চোদ্দোতলা একটা বাড়ি পিসার হেলানো টাওয়ারের একটু অনুকরণ করার চেষ্টা করেছিল। ফলে পাঁচ বছর সেটা ফাঁকাই পড়ে আছে। সেইখানেই আপাতত আস্তানা গেড়েছেন তিনি। আর তৈরি হয়ে আছেন…।
মা দুর্গার বিসর্জনের পর ফাঁকা মঞ্চে একের পর এক ম্যাজিক দেখিয়ে যাচ্ছেন। জাদুসম্রাট হরতন সরখেল। কাটা মুণ্ডুর খেলা, পায়রার ডিমের খেলা, ওয়াটার অব গ্যাঞ্জেসের খেলা। প্রফেসার তরফদার আসছেন খেলার ফাঁকে ফাঁকে। বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কীভাবে জাদুকর লোক ঠকাচ্ছেন।
শেষ খেলা শেষ হওয়ার পরে একটি বিনয়ী নমস্কার হাতে করে মঞ্চে এলেন তরফদার। বারো বছর ডুসেলডর্কে গবেষণা করার পর থেকে বাংলায় কথা বলতে গেলেই ভাষাটা তাঁর শুদ্ধ হয়ে যায়। তরফদার শুরু করলেন, হে দর্শকবৃন্দ, আপনারা নিশ্চয় উপলব্ধি করিয়াছেন যে, জাদুকর অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী নহেন। এবং একই যুক্তি সম্প্রসারিত করিলেই প্রমাণিত হইবে যে, ভূত বলিয়াও কিছু নাই, থাকিতে পারে না, বিশ্বাসী মানুষের কল্পনাকে নির্ভর করিয়াই শুধু ভূতপ্রেতের…।
প্যান্ডেলের টিউবলাইটগুলো ঠিক এই সময়ে এমন দপদপ করে নেচে উঠল যেন তরফদারের অসমাপ্ত বাক্যের শেষে ডট-ডট-ডট। আচমকা আলো নিবে যাওয়ার চেয়ে ব্যাপারটা অনেক বেশি গা-ছমছমে। তরফদার বোঝাবার চেষ্টা করেন, ভোল্টেজের এবংবিধ লম্ফঝম্প দেখিয়া আপনারা ভ্রান্ত অনুমানের…।
আবার বাধা। টিউবলাইটের আলো অপরাজিতার মতো নীল হয়ে উঠল।
ইহারও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজিয়া বাহির করা অসম্ভব নহে।
কিন্তু তরফদারের ব্যাখ্যা শোনার জন্য খুব একটা আগ্রহ দেখা গেল না। জনা পঁচিশ ছিল তখনও। আলো নীল হয়ে ওঠার ব্যাপারটা বোধগম্য হবে-হবে করছে, সভাগৃহ জবা ফুলের মতো লাল হয়ে উঠল। এবং সভাভঙ্গ।
রোবু নীলকে চোখে চোখে রেখেছে সারাক্ষণ। সভা ভাঙার পরেই সে পেছন থেকে এসে নীলের হাত চেপে ধরল, প্লিজ, তোমার ভুতোদার সঙ্গে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দাও।
রোবু বোঝেনি যে, পাশেই ভুতো রয়েছে। ভুতো বেশ বিরক্ত, যা বলার এখনই সেরে ফেল।
সসম্ভ্রমে বলল রোবু, দেখুন, আপনি যে আছেন তা তো বারবারই টের পাচ্ছি। কিন্তু এইসব আশ্চর্য ক্ষমতা অর্জন করলেন কীভাবে? কিছু না ছুঁড়েই উইকেট ভেঙে দিলেন। আলোর রংই বা বদলে গেল কী করে?
ওং হ্রীং টকাস!
অ্যাঁ?
কিংবা অন্যরকমও আছে। এই ধর, ক্রিং কোরাম ফস।
এগুলো মন্ত্র বুঝি?
কে জানে! কোনটার যে কী মানে তা-ও ভুলে মেরে দিয়েছি। তবে এটা ঠিক যে, এগুলো খুব পাওয়ারফুল। এই তো আজকে কীং কোয়া বঙ্গাই বলতেই আলো লাল হয়ে গেল। আর আগের বার ওটা বলতেই তোর উইকেট চিতপটাং।
তার মানে কোন মন্ত্র কী ঘটাবে তা আপনি নিজেও জানেন না? রোবুর গলায় হতাশা।
কারেক্ট। তোর মাথায় বুদ্ধি আছে দেখছি।
তাহলে আর আমাদের কোনও আশা নেই। ভেবেছিলাম, হয়তো শিখেটিখে নেওয়া যাবে। এবার সত্যিই আমাদের চাকরি নিয়ে টানাটানি। শুধু তো আমার একার সমস্যা নয়। আমার মতো কুড়ি হাজার রোবট যদি বেকার হয়ে যায়…।
সামাজিক সমস্যা দেখা দেবে। কিন্তু তা বলে আমায় দোষ দিয়ে কী লাভ?
তুমিই তো দায়ী। এবার তো সবাই নীলের বিখ্যাত ভুতোদার মতোই সঙ্গী খুঁজবে, তাই না?
খুঁজতে পারে, কিন্তু লাভ হবে না। নীলের মতো যাদের রোবট নেই, তাদের সঙ্গেই শুধু আমাদের ভাব।
[আনন্দমেলা, পূজাবার্ষিকী ১৯৯১]