রোবীন
রিস্ট-বাজারে ভোঁ ভোঁ রব….
এমন সময় তো কারও আসার কথা নয়।
ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটাকে রেখে রোবীন উঠে দাঁড়িয়েছে। আপ-জে-নি* টিভি স্ক্রিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। (* আগন্তুকের-পরিচয়-জেনেনিন)।
রো! রো! হঠাৎ গলা চড়িয়ে ধমক দিল প্রবীর।
রোবীন কিন্তু থামল না। ওর শ্রবণী-সার্কিট দিনে দিনে দুর্বল হচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে তিষ্ঠ ভঙ্গিতে ডান হাত উঁচু করতে তবে থমকে দাঁড়াল রোবীন। প্রবীর হাত নেড়ে তাকে সরে যাবার নির্দেশ দিল। রোবীনের কপালে সবুজ চোখে দু-বার ঝিলিক। বুঝতে পেরেছি।
বাজারটা আবার অধৈর্য হয়ে ডাক দিচ্ছে। রোবীন গুটিগুটি হাঁটছে। ঘরের দরজা না পেলে ক্লোজ-সার্কিট টিভি-র গ্রাহক ও প্রেরক যন্ত্র চালু করা ঠিক হবে না। বারোতলা নীচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলেও আগন্তুকের নজর ঘরের চার কোণ ছুঁয়ে যাবে।
আপ-জে-নি-কে ড্রয়িং রুমের বাইরের করিডরে বসানোর প্রয়োজনটা নতুন করে টের পেল প্রবীর। অবশ্য তাতে প্রবীরের দৌড়ঝাঁপ বাড়বে। কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের লোক তা করে না।
পায়ের চাপে সুইচ টিপে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ভাগ্যিস সময়মতো সরিয়ে দিয়েছে রো-কে।
আপাদমস্তক নীল সিন্থেটিক পোশাকে ঢাকা চেহারাটা পর্দা জুড়ে ভাসছে। নাগরিক সমিতির গোয়েন্দা। অবশ্য গোয়েন্দা শব্দটা ওরা ব্যবহার করে না, গাল ফুলিয়ে বলে, আমরা জাস্টিস অব কমফোর্ট। আমাদের কর্তব্যই হল আপনাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তারক্ষা।
কৃত্রিম হেসে জাস্টিস বলল, রুটিন চেকিং স্যার!
প্রবীর কাটা-কাটা উত্তর দিল, ধন্যবাদ। দরকার পড়লে জানাব।
-থ্যাংক ইউ। হিউম্যানয়েডের লাইসেন্সটা একবার দেখাতে হবে।
প্রবীর মনে মনে হাসল। এর জন্য সে প্রস্তুত। ঘরের বাঁদিকে ছোট্ট একটা টেবিলে রাখা ডকুমেন্ট ফাইলের কিবোর্ডে আঙুল দিয়ে সংকেত পাঠাতেই খরু-র শব্দে বেরিয়ে এল লাইসেন্স।
লাইসেন্স পরীক্ষা করে আরেকবার কৃত্রিম ধন্যবাদ ও মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানিয়ে জাস্টিস সরে পড়ল।
বুকভরে শ্বাস নিল প্রবীর। কিন্তু এভাবে আর ক-দিন চলবে? মাস তিনেক পরেই তো আবার রিনিউ করতে হবে লাইসেন্স। আগে করতে হত পাঁচ বছর অন্তর। নতুন নিয়মে সেটা কমিয়ে এক বছর করা হয়েছে। হয়তো এরপর ছ-মাস অন্তর করে দেবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা–লাইসেন্স সেন্টারের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর পোস্ট থেকে শ্যামলেন্দু অন্য ডিপার্টমেন্টে বদলি হয়ে গেছে। গত বছর শ্যামলেন্দু নিজের হাতে কম্পিউটার বর্তনীর অংশবিশেষ অচল করে দিয়ে রীতিমতো বেআইনিভাবে কাজ সেরেছিল। রো-র ভাগ্য ভালো। অবশ্য বন্ধুত্বের খাতিরে শ্যামলেন্দু তা করেনি। শ্যামলেন্দুর একশো আটত্রিশতলার ফ্ল্যাটে তিন দিন বিনি পয়সায় খাটতে হয়েছে প্রবীরকে। কম করে পনেরো দিনের মাইনে বাঁচিয়েছিল শ্যামলেন্দু৷ প্রবীর এখনও ঘুষ দিতে রাজি। কিন্তু সে রাজি হলেও শ্যামলের মতো রিস্ক নেবার মতো লোক কি সামনের বার পাবে? অর্থাৎ রো-র ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একজন লোভী লাইসেন্স অফিসারের সন্ধান পাওয়া, না-পাওয়ার ওপর।
গোঁও-গোঁও শব্দে ভুরু কুঁচকে গেল প্রবীরের। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার হাতে রোবীন আবার ঘর সাফাইয়ের কাজ শুরু করেছে। কিন্তু এত কাতরাচ্ছে কেন? কালই তো ওর গোড়ালি, হাঁটু আর কোমরের জয়েন্টগুলোয় সুপার-থ্রি-এক্স মোবিলিটি-লুব্রিকেটিং তেল দিয়েছে।
ইনডাকশনে ডাক পাঠাল প্রবীর। রো ধীরে ধীরে ঘরে এসে ঢুকল।
-সত্যিই তুই বুড়ো হয়ে গেছিস রো!
হাত নেড়ে কাছে ডাকল রো-কে। পেটের ওপর বোতামটা ছুঁতেই রো-র প্রাণের লক্ষণ মুছে গেল। এখন সে সেকেলে গাঁইয়া মডেলের একটা ইস্পাতের খোলে মোড়া বৈদ্যুতিক মগজবিশিষ্ট যন্ত্রমানুষ।
এলান-কি দিয়ে প্রবীর রো-র পায়ের জোড় খুলে ফেলল। এখান থেকেই আসছে বিশ্রী শব্দটা। না, অয়েল-স্পঞ্জ তো ভিজে–তেল রয়েছে। তাহলে? মাই গড–ডানদিকের পাঁচ নম্বর স্কু-টা যে অর্ধেক খুলে বেরিয়ে এসেছে। ক্রু-ডাইভার দিয়ে পাক খাইয়ে ওটাকে বসিয়ে দিতে হবে। এক পাক–দুই-তিন–চার পাক–কী হল আবার? তবে কী? বাঁ হাতের দু-আঙুলে স্কু-র মাথা ধরে একটু টান দিতেই সেটা সট করে বেরিয়ে এল। এই ভয়টাই করছিল। প্যাঁচ কেটে গেছে।
ম্যাগনেটিক টুল-হোল্ডার বক্স নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল প্রবীর। ফাইন বিএ স্ট্যান্ডার্ডের থ্রেডে। লম্বায় এক ইঞ্চি এই যন্ত্রাংশ সরঞ্জামের কল্যাণেই রো এখন বেঁচে আছে। এসব লোহালক্কড়ের জিনিস গত কুড়ি বছর ধরে আর তৈরি হচ্ছে না। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বাবাই এসব সংগ্রহ করেছিলেন। না হলে প্রবীরের চেয়েও দশ বছরের সিনিয়র পঁয়তাল্লিশ বছরের বুড়ো রো-কে… প্রবীর ভাবে, সত্যি কথাটা যদি প্রকাশও হয়ে যায়, প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না। পঁয়তাল্লিশ বছর!
ড্যানবেরি, কানেকটিকাটের হিউম্যানিমেশন ইনকর্পোরেশনের আধুনিক ডোমেস্টিক রোবটদের আয়ু দু-বছর। ব্যকবাক রোবট। ব্যবহার-করে-বাতিল-করো রোবট। নো রিপেয়ারিং! যদি দু-বছরের মধ্যে খারাপ হয়, কোম্পানি নতুন রোবট দেবে রিপ্লেসমেন্ট। শুনতে বেশ ভালোই লাগে, কিন্তু এর পেছনে কিছু সূক্ষ্ম হিসেব আছে, হিউম্যানিমেশন এর রোবটরা গত ক-বছরে আর সব রোবট-নির্মাতাকে প্রায় লাটে তুলে দিয়েছে। তা ছাড়া সরকারি মহলও পরোক্ষভাবে হিউম্যানিমেশনকেই মদত জোগাচ্ছে। তাদের সুবিধা অনুসারে আইনকানুন বানাচ্ছে। না হলে দু-বছরের পুরোনো রোবটদের লাইসেন্স রিনিউ–করার কী কারণ থাকতে পারে? বেশি শক্তিক্ষয়? অ্যাবসার্ড। বাজে কথা। বুড়ো রো অবধি এখনও যেটুকু শক্তি খরচ করে তা হিউম্যানিমেশনের যে-কোনও এ-ক্লাস রোবটের চেয়ে কম। আরও একটা কথা। সরকারি তরফ থেকেও মেকানিক্যাল রোবটদের বিপজ্জনক বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউ যদি রো-র অস্তিত্বের কথা টের পায়–ব্যাস!
প্রবীর কিছুতেই ভেবে পায় না, কেন লোকে বিনা প্রশ্নে সব মেনে নিচ্ছে। তারা কি একবারও খেয়াল করছে না যে, নতুন রোবটগুলোর সঙ্গে কোনও ফ্লপি ডিস্ক দেওয়া হচ্ছে না। কোম্পানি রোবটদের সঙ্গে যে কটা স্মৃতিধারক ডিস্ক সরবরাহ করে তার এক্তিয়ারের বাইরে আর তাকে কিছুই শেখানো সম্ভব নয়। এ যেন সেই পুরোনো আমলের গ্রামোফোনের মতো। গ্রামোফোন কোম্পানির তৈরি রেকর্ডের গানই শুধু শোনা যাবে। ইচ্ছেমতো ভালো-লাগা গান যে রেকর্ড করে নেবে, তার উপায় নেই।
রোবীনের পুরো রবীন্দ্রনাথ মুখস্থ। ঊর্মির ইচ্ছে ছিল, জীবনানন্দও শেখাবে। কিন্তু ঊর্মি…
প্রিন্টারের সঙ্গে জুড়ে দিলে রবীন্দ্র-রচনা রোবীন মারফত ছেপে বার করে নেওয়া যায়। কিংবা টিভি-রিডারে যুক্ত করে স্ক্রিনেও পড়া সম্ভব। প্রবীর বেশ কয়েকবার খোঁজ নিয়ে হতাশ হয়েছে, হিউম্যানিমেশন-এর মেমারি ডিস্কে রবীন্দ্রনাথ অনুপস্থিত।
তন্নতন্ন করে যন্ত্রপাতির বাক্স ঘেঁটেও এত সূক্ষ্ম মাপের ডাই পেল না প্রবীর। উপযুক্ত মাপের স্টিল পিন আছে, কিন্তু ডাই না পেলে প্যাঁচ কাটবে কী দিয়ে পুরোনো স্কুটাকেই আবার লাগিয়ে দিল প্রবীর। মেটালসিল, টিউব থেকে এক ফোঁটা লোহাজোড়া পলিমার সেরামিক আঠা ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ নেহাতই সাময়িক ব্যবস্থা। দিন দুয়েকের মধ্যেই ফের ঢিলে হয়ে যাবে। এখন থেকে ভ্যাকুয়াম-স্পঞ্জ হাতে দিয়ে রো-কে সিঁড়ি মুছতে পাঠানো যাবে না। কথাটা মনে রাখতে হবে। হাঁটু গেড়ে বসা-ওঠা করা ওর পক্ষে ক্ষতিকর।
রো-কে চালু করে দিল প্রবীর। আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। চা-প্রবীরের নির্দেশ শুনতে পায়নি। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলতে হল। এই অসুখ দুরারোগ্য। একটা ট্রায়োড নষ্ট হয়ে গেছে। লাখ টাকা দিলেও সংগ্রহ করা যাবে না।
মিনিট দশেকের মধ্যেই চা নিয়ে এল রো।
প্রবীরের প্রিয় হালকা রঙের গোলাপ ফুলের ছবি-আঁকা কাগজের মতো পাতলা পোর্সিলিন কাপে। একটা চুমুক দিতেই বিষণ্ণতার ভার যেন কিছুটা কমে এল। কী স্বাদ! অথচ প্রবীর এবার আর্থ কোয়ালিটি চা আনেনি। মঙ্গল গ্রহের কৃত্রিম বাগানে তৈরি কৃত্রিম সস্তা দামের চা। তবু রো-র হাতের গুণে…।
না–রো নয়–ঊর্মি! বারো বছর ছ-মাস সতেরো দিন ধরে ঊর্মি রোবীনকে চা তৈরি করতে শিখিয়েছে। সময়ের হিসেবে ভুল হতে পারে না। ঊর্মিকে ঠিক এইটুকু সময়ই কাছে পেয়েছে প্রবীর। মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে হাসিখুশি ছটফটে ঊর্মি তাকে ফেলে কেন যে চলে গেল, প্রবীর বুঝতে পারে না।
ঊর্মিরও হার্ট ফেল করার বয়স হয়নি! ডাক্তার সান্ত্বনা দিয়েছিল, এই বয়সে হার্ট অ্যাটাক রেয়ার, কিন্তু হলে কেউ বাঁচে না।
প্রবীর চুমুক দেয়।
রোবীনকে পাশে রেখে চা তৈরি করত ঊর্মি। যখনই চা করত, ওকে ডেকে আনত, যাতে রো-র স্মৃতি-চাকতিতে তার বিবরণ ধরা থাকে। ফলে এখন যে ধরনের চায়ের পাতাই হোক, দুধ যা-ই হোক–গন্ধ শুঁকে আর ঘনত্ব, রং ইত্যাদি বিচার করে রো যা বানাবে–আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। সেটা শুধু ঊর্মিই পারত।
ঊর্মি কি কিছু বুঝতে পেরেছিল আগে থেকে, তাই তার যোগ্য প্রতিনিধিকে ধীরে ধীরে তৈরি করেছিল? তা নয়, অন্তত একটা স্নেহ ছিল ঊর্মির স্বভাবে। আর সারল্য। না হলে কেউ লোহালক্কড়ের তৈরি একটা যন্ত্রমানুষকে কখনও আদর করে শেয়াল–আমার শেয়ালবাবু! বলে ডাকতে পারে! যতই তার মেমারি থাক আর হাঁটুক-চলুক, তবু তো… কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার–রো-ও ঊর্মির শেয়াল ডাকে সাড়া দিত। অথচ শেয়াল ডাকে সাড়া দেবার জন্য তাকে প্রোগ্রামিং করা হয়নি। নিশ্চয় গলার স্বর থেকেই সে কিছু অনুমান করত।
হাত কেঁপে কয়েক ফোঁটা চা চলকে পড়ল পাজামায়। ইশ! এই দাগ তো আর তোলা যাবে না। এ তো সিন্থেটিক কাপড় নয়, খাঁটি সুতি। সুতির কাপড়ের উৎপাদন যে-কোনও দিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে শুনেই ঊর্মি তিনটে থান কিনে রেখেছিল। আজও চলছে তা-ই দিয়ে। বাড়িতে প্রবীরকে সিন্থেটিক পরতে হবে না। যা আছে, তাতে তার জীবন কেটে যাবে। ঊর্মি শুধু সুতির কাপড়ই কিনে রাখেনি। রো-কে সেলাই করতেও শিখিয়েছিল। পারবে হিউম্যানিমেশন-এর এ-গ্রেড প্রোডাক্ট?
-বুঝলি বুড়ো, তুই বোধহয় এখন পৃথিবীর একমাত্র দর্জি।
কিন্তু এই পাজামাটাকে চিহ্ন দিয়ে আলাদা করে রাখতে হবে। না হলে কখনও যদি বাইরের লোকের সামনে (টিভি স্ক্রিনের মধ্যবর্তিতায় হলেও) এটা পরে বেরিয়ে পড়ে–ধরা পড়ে যাবে। সিন্থেটিক স্পটলেস, কোনও দাগ লাগে না। সুতির জিনিস ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
চার্জিং টাইম! চার্জিং টাইম!–স্বয়ংক্রিয় ঘোষক হেঁকে উঠল। রোবীন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ন-মুখো প্লাগটার কাছে। দেওয়ালের সামনে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে এক পা পিছোতেই ফ্লেক্সিবল তারটা নড়েচড়ে এগিয়ে প্লাগটাকে রোবীনের পিঠে গুঁজে দিল। দিনের এই নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীর যত রোবট বিদ্যুৎ পান করে, চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। যা করার এই বেলা। এরপরে হেলিপ্যাডে ভিড় বাড়বে। ভ্যাকুয়াম-স্পঞ্জ আর ক্লিনার নিয়ে প্রবীর তাড়াতাড়ি কাজ সারে। কারণ রোবীন আজ সাফাইয়ের কাজ করবে না, কালকেও পরিষ্কার করা হয়নি। দিন তিনেক ধুলো জমলেই দেওয়ালে বসানো অটো-পলিউশন রেকর্ডার সে সংবাদ পাঠিয়ে দেবে কেন্দ্রীয় পরিবেশ দূষণ নিবারণ সংস্থায়। সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই কাজ সেরে প্রবীর বাইরে বেরোবার জন্য তৈরি হয়ে নিল। ঘরের বাইরে পা রাখতেই ফোটো-সেল-ক্লোজার দরজা টেনে দিল।
কে যেন ডাকল মনে হল পেছন থেকে। ঘরের মধ্যে থেকে। নিশ্চয় শোনার ভুল। কারণ রো-র পক্ষে কথা বলা সম্ভব নয়। প্রবীর নিজে হাতে তাকে বোবা করে দিয়েছে। তার কথা বলার বর্তনী অচল। আধুনিক রোবটদের মতো কথা বলার ক্ষমতা নেই তার। একটু নাকি, যান্ত্রিক সুরে বলে। ধরা পড়ার ভয় আছে বলেই বাধ্য হয়ে প্রবীরকে অপ্রিয় কাজটা করতে হয়েছে।
.
মাঝ-আকাশেই হেলিকপ্টারটা গড়গড় শুরু করে দিল। কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে সংযোগ করল প্রবীর। –M K 706 কলিং! M K 706! Engine Fault Over!
নির্দেশ এল মুহূর্তের ব্যবধানে। এইটাই চেয়েছিল প্রবীর। হেলিফিল্ড গ্রিন-অরেঞ্জ নাম্বার সেভেনে এমার্জেন্সি ল্যান্ডিং-এর অনুমতি। হেলিকপ্টারে উঠেই অয়েল প্রেশারের নিড়লটাকে টিপে বেঁকিয়ে দিয়েছিল। ফলে ইঞ্জিনের সব ঠিক থাকলেও মিটারটা ভয় দেখাচ্ছে।
রিপেয়ারিং কর্মীদের হাতে হেলিকপ্টার সঁপে প্রবীর বেরিয়ে এল। কাজ শেষ হলে এরাই পৌঁছে দেবে বাড়ির ছাতে হেলিপ্যাডে। আরেকটা হেলিকপ্টার ভাড়া নিতে চেয়েছিল– জানতই যে শুনতে হবে–দুঃখিত! নিরুপায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাঁটতে শুরু করল প্রবীর। যেন বেশ চটিতং! এখন গুটিগুটি পায়ে টার্মিনাসে গিয়ে দাঁড়ানো।
কিন্তু টার্মিনাসে যাবে না প্রবীর, যাবে জামিলের বাড়ি। বুড়ো মিস্তিরি–অনেক দিনের চেনা। আগেও দু-একবার সাহায্য করেছে প্রবীরকে। রো-র জন্যে প্রবীর নিজে ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত, কিন্তু আর কাউকে বিপদে ফেলতে চায় না। সেই জন্যই এত কাণ্ড। সরাসরি হেলিকপ্টারে চেপে এখানে এলে সবটাই রেকর্ড হয়ে থাকত লগ বুকে! যে-কোনও পুলিশি তদন্তের আগে তো ওইটাই খুঁটিয়ে দেখা হয়। প্রতিটি হেলিকপ্টারের মধ্যে সিল করা থাকে লগ-বুক। হাত দেবার কোনও উপায় নেই।
বাড়িতেই ছিল জামিল। স্টিল পিন দুটো হাতে নিয়ে বলল, পাঁচ মিনিট বসুন। করে দিচ্ছি। প্রবীর জানিয়ে দিল, এটা বিএসএফ–আইন থ্রেডে।
.
ঘরে পা দিয়েই আর্তনাদ করে উঠল প্রবীর। মুখে হাত রেখে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে। বাইরের দরজাটা আপনা থেকে বন্ধ হয়ে গেল।
যেমন দেখে গিয়েছিল, রো এখনও একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেয়ালে পিঠ রেখে। ধূসর ইস্পাতের চাদরে ঢাকা শরীরটা বেগুনি হয়ে উঠেছে। দু-ঘণ্টা চার্জিং-এ থাকার কথা, তার বদলে আট ঘণ্টা। সব সার্কিট জ্বলেপুড়ে শেষ। এ কী করে সম্ভব! এতগুলো প্রোটেক্টর, রিলে, সুইচ–সব একসঙ্গে বিগড়ে গেল!
প্রবীর ছুটে এল। সুইচ অফ করে দিতেই সোজা সামনের দিকে হেলে হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছিল রো–কোনওরকমে সামলেছে প্রবীর। ব্যালান্স নষ্ট হয়ে গেছে। রো-র বুকের কাছে এমার্জেন্সি সেলফ রেকটিফায়ারের সুইচটা ঘোরাবার চেষ্টা করল। নবটা আটকে গেছে। ভালো করে নজর করতেই বুঝতে পারল রোবীনের ফোটোসেলের চোখজোড়া চুরচুর।
রোবীনকে সামনে নিয়ে কতক্ষণ বসে ছিল, খেয়াল নেই। বাঁ হাতের মুঠোয় তখনও জামিল মিস্ত্রির তৈরি স্টিলের স্ক্রু দুটো! একটা দরকার, কিন্তু তৈরি করেছিল দুটো স্পেয়ার হিসেবে রাখবে বলে।
এমার্জেন্সি টিভি চ্যানেল সবাক হয়ে উঠতে হুঁশ ফিরল। খুব গুরত্বপূর্ণ কোনও ঘোষণা না থাকলে এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হয় না।
কম্পিউটারাইজড শেভারে চেঁচেপুঁছে দাড়ি-কামানো ঝকঝকে চেহারার তরুণ সংবাদপাঠক হেসে তাকাচ্ছে–নমস্কার! অসময়ে বিরক্ত করার জন্য মার্জনা করবেন। পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনকেন্দ্রে যান্ত্রিক গোলযোগের দরুন আজ বৈদ্যুতিক সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। সরবরাহের স্বাভাবিক কম্পাঙ্ক অর্থাৎ ফ্রিকোয়েন্সি যেখানে পঞ্চাশ, আজ তার জায়গায় তিনশো ফ্রিকোয়েন্সিতে ভুলক্রমে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হয়েছিল। তবে সেটা মাত্র কুড়ি মিনিটের জন্য। এর ফলে কোনও ক্ষয়ক্ষতির তেমন সম্ভাবনাও নেই। যদি-বা সেরকম কিছু ঘটেও থাকে, তার পূর্ণ দায়িত্ব জাতীয় সরকার গ্রহণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে, এইমাত্র হিউম্যানিমেশন ইনকর্পোরেশন থেকে খবর এসেছে–ফ্রিকোয়েন্সির এই রদবদলের দরুন উক্ত কোম্পানির তৈরি কোনও হিউম্যানয়েড ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। যন্ত্রের মধ্যেই এই বিশেষ অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য প্রতিরোধব্যবস্থা আছে। নমস্কার। শুভরাত্রি।
প্রবীরের চোখ দুটো কুঁচকে ছোট হয়ে এসেছে। বিকৃতস্বরে সে ভেংচি কাটল–শুভরাত্রি। চমৎকার! চমৎকার ফন্দি! একটিও প্রমাণ রইল না, কিন্তু নির্মূল হয়ে গেল যত প্রাচীন রোবট।
এখন শুধু….
আবার রো-র দিকে নজর পড়ল। বেরোবার মুখে একবার মনে হয়েছিল, রো তাকে ডাকছে। অগ্রাহ্য করেছিল তখন। সেটাই স্বাভাবিক। রো-র পক্ষে কি ডাকা সম্ভব!
প্রবীর উঠে দাঁড়াল। দেয়ালের যেখানটায় রোবীন দাঁড়িয়েছিল, তারই পাশে ওয়াল পেপারটা এভাবে ছিঁড়ল কী করে? চকিতে ঘুরে দাঁড়াল প্রবীর। নিচু হয়ে পরীক্ষা করল রোবীনকে। রো ডান হাতটা মুঠো করে রেখেছে। আর মুঠোর কাছে লেগে রয়েছে ছেঁড়া ওয়াল-পেপারের ফালি।
হার্ট অ্যাটাকের সময়ে ঊর্মির বাকশক্তি লোপ পায়। খাটের কিনারায় হাত ঠুকে সে রো র দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। রোবীনই তখন খবর দিয়েছিল প্রবীরকে।
রো-ও ভেবেছিল, প্রবীর তার ডাক শুনতে পাবে। ফিরে আসবে।
[ফ্যানট্যাসটিক বার্ষিকী, ১৯৮৭ সেপ্টেম্বর]