রোদ-বৃষ্টি-ঘাম
রাতে তিনটে রুটি খান কেয়া। কিন্তু আজ একটা খাওয়ার পর থেকেই অদ্ভুত একটা অস্বস্তি শুরু হল। খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেন একটু, পায়চারি করলেন মিনিট দুয়েক, তারপর আবার টেবিলে ফিরে এসে আর একটা রুটি খাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। অর্ধেকটা খেয়ে উঠে পড়লেন। মুখ ধুয়ে টেবিল থেকে তুলে দুটো বাটি ফ্রিজের ভিতর রাখলেন, টিফিন ক্যারিয়ারটা টেবিলের ওপরেই রইল। কাল সকালে চামেলি যখন কাজ করতে আসবে, ওকে বলতে হবে যেন ভাল তরকারিটা রুটির সঙ্গে খেয়ে নিয়ে বাটিগুলো টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে হোম- ডেলিভারির ছেলেটাকে ফেরত দিয়ে দেয়।
দরজাটা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন কেয়া। ভুলু রাতের খাওয়া শেষে আবারও ঘুমোনোর তোড়জোড় করছে। নিজে খেতে বসার আগেই ভুলুকে খেতে দিয়ে যান কেয়া। আগে শিখাই দিত। কিন্তু তখন তো বাড়ির সকলের রান্না একসঙ্গেই হত। ভুলু সদাঘুমন্ত চোখে কেয়াকে দেখে লেজটা নাড়িয়ে নেচে উঠল একটু। কেয়া ভাবলেন ওই আধখানা রুটিও ভুলুকে খাইয়ে দেবেন কিনা। তারপর ভুলু শুয়ে পড়েছে দেখে, নিরস্ত হলেন। ভালই হল। নিজের এঁটো অন্য যে কাউকেই খাওয়াতে খুব খারাপ লাগে। মানুষই হোক আর জানোয়ার!
চামেলি যখন প্রথম কাজে ঢুকে বাসি রুটির খোঁজ করছিল, ধমকে উঠেছিলেন কেয়া। সকালে ওঁর টুকটাক কাজ করে দেওয়ার জন্য সংস্থিতা পাঠিয়েছে যে-লোককে, সে বাসি খাবে কেন? কিন্তু চামেলি বলল যে, টাটকা ওদের হজম হয় না। ভোররাতে উঠে পান্তার গায়ে লেগে থাকা জলটা চুমুকে সাবাড় না করলে এনার্জিই পাবে না কোনও। কেয়া সারাজীবন নিজে বাসি খাননি, অন্যকেও খেতে দেননি। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তাই? বাসি জিনিসের এত গুণ?
চামেলি বলল, হ্যাঁ গো মা। টাটকা জিনিসের অনেক ঝামেলা। সঙ্গে এটা লাগে, ওটা লাগে। কিন্তু তুমি ছালন দিয়ে পান্তা সাঁটিয়ে দাও না। জিভে লেগে থাকবে। ওই বাসি রুটি কী মচমচে! কত ভাল লাগে চায়ে ডুবিয়ে খেতে। ওর কাছে তোমাদের কিরিমকেকার!
সত্যিই তো! কেয়া লজ্জা পেয়ে যান।
সেই লজ্জা শতগুণ হয়ে আছড়ে পড়ল আজ ওর ওপর, যখন রমেন চামেলির ছেলেকে ধরে মারল। ছেলেটা পাশ করেছে শুনে ওকে নতুন বই কিনে দেওয়ার জন্য চামেলিকে তিনশো টাকা দিয়েছিলেন কেয়া। সেই টাকায় কেনা বইগুলো কেয়াকে দেখাতে এসেছিল চামেলির ছেলে ভাস্কর।
অনেকক্ষণ কেয়ার সঙ্গে কথা বলে ছেলেটা উঠল। ওকে সিঁড়ির মুখ অবধি এগিয়ে দিয়ে ঘরে ফিরে এসে কেয়া বাথরুমে গেলেন। বাথরুমের ভিতরেই আওয়াজ শুনছিলেন, বেরিয়ে শুনলেন চেঁচামেচি। কাউকে মারার আওয়াজ। তারপরই কান্নার শব্দ। পূর্ণিমা আসছে, হাঁটুর ব্যথাটা যথারীতি বেড়েছে। কেয়া পাত্তা না দিয়ে নীচে নামতে শুরু করলেন।
আপনি নেমে এসেছেন, ভালই করেছেন, এই চোরটা তো আপনার কাছেই গিয়েছিল? রমেন বলল। কেয়া দেখলেন ফুঁপিয়ে কাঁদছে ভাস্কর। ওর গালে স্পষ্ট পাঁচ আঙুলের দাগ।
মাথায় রক্ত উঠে গেল কেয়ার, তুমি এই বাচ্চাটাকে মারলে কেন রমেন?
মারব না তো কি আদর করব? ভর সন্ধেবেলা গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করছে, রমেন অবজ্ঞার স্বরে বলল।
ভাস্কর বলল, আমি চুরি করিনি দিদা, মাটিতে পড়ে ছিল, কুড়িয়ে নিয়েছি।
হ্যাঁ কুড়িয়ে নিয়েছে না ছাই! মিথুক কোথাকার! কোত্থেকে সব চোর, চোরের বাচ্চা এসে কাজে লেগেছে এখন, শিখা বারান্দার রেলিং ধরে এগিয়ে এল।
কেয়া লক্ষ করলেন শিখার পেটটা অস্বাভাবিক বড়। ওর হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।
রমেন ভাস্করের কানটা ধরে বলল, এই বাড়ির ত্রিসীমানায় যেন আর কখনও না দেখি।
কেয়ার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল, রমেন তুমি ছেলেটার কান ছাড়ো, এই মুহূর্তে ছাড়ো। নইলে আমি আবার থানায় ফোন করতে বাধ্য হব।
অত কথায় কথায় থানা দেখাবেন না। আপনার দৌড় আমার জানা আছে, রমেন থক করে থুতু ফেলল।
জানা নেই। কিন্তু আমার বাড়িতে আমার কাছে আসা কারও গায়ে যদি তুমি ভবিষ্যতে হাত দাও…
শিখা ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, চুরি করল বলেই তো বিন্তির বাবা মারতে গেল, মাসিমা।
চুরি করুক, যা ইচ্ছে করুক আমার গাছ থেকে করেছে। আমি গাছটা তোদের লিখে দিইনি শিখা।
শুনে নাও, শুনে নাও, মাস্টারনি লেখাপড়ার কথা বলছেন, রমেন সেই ব্যঙ্গের গলাতেই বলল। তবে ভাস্করের কানটা ছেড়ে দিয়ে বলল।
তুমিও ভাল করে শোনো রমেন। আর কোনওদিন যদি এই ছেলেটার গায়ে হাত তোলো, তা হলে তোমার জামিন দু’দিন কেন দু’মাসেও যাতে না হয়, তার ব্যবস্থা আমি করব, বলে কেয়া ওঁর কাছে এসে দাঁড়ানো ভাস্করের মাথায় হাত বুলিয়ে, রমেন এবং শিখার দিকে আর দৃকপাত না করে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।
তখন আগু-পিছু না ভেবে নেমে গিয়েছিলেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই রমেন আর শিখার সঙ্গে ঝঞ্ঝাটে না গেলেই পারতেন। কিন্তু ওদের বাধা না দিলে ওরা যে ওই বাচ্চাটাকে আরও মারত? ছি ছি! কেয়া নিজের প্রতি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেন। কিন্তু ওই লজ্জা ছাপিয়ে অস্বস্তিটা বেড়ে উঠল। কীরকম মনে হচ্ছে, একটা ঠেলাগাড়িকে কেউ যেন ঠেলে ঠেলে বুক থেকে পিঠের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নাকি পিঠ থেকে বুকের দিকে? ঠাহর করতে না পেরে আরও আধখানা প্রেশারের ওষুধ খেলেন কেয়া। হজমের ওষুধ খেলেন গোটা দুই। তারপর একটা ফোন লাগালেন সংস্থিতাকে। কিন্তু সংস্থিতার মোবাইল বন্ধ, আশ্চর্য! পড়ার টেবিলের ওপর রাখা ডায়েরিটা হাতড়ে ওর ল্যান্ডলাইনের নম্বরটা বের করলেন কেয়া। ফোনটা একবার বেজে গেল। দ্বিতীয়বার যে-ফোনটা ধরল, কেয়া আন্দাজে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, শ্রীতমা?
পিউ বলল, হ্যাঁ বলছি, আপনি?
তোমার ফিরে আসার কথা চলছিল, আমি জানতাম। তুমি কি ফাইনালি ফিরে এসেছ?
পিউ একটু অবাক গলায় বলল, হ্যাঁ। পরশুদিন এসেছি। আপনি কি…
কেয়া ওর বিহ্বলতার গায়ে দাঁড়ি টেনে বললেন, আমি কেয়া মৈত্র।
পিউ উচ্ছ্বাসের গলায় বলল, আমি বুঝেছি ম্যাম। দিদির মুখে হাজারবার আপনার কথা শুনেছি। আমি যাব একদিন আপনার কাছে, কেমন?
নিশ্চয়ই আসবে। তবে তার আগে তুমি যে মনের জোর দেখিয়েছ, তার জন্য তোমাকে আর একবার শাবাস জানাই। ওয়েল ডান, মাই গার্ল।
পিউ নিচু গলায় “থ্যাঙ্ক ইউ’ বলল।
কেয়া মৈত্র টের পেলেন ঠেলাগাড়িটা বুকের ভিতর একটু জোরেই চলতে শুরু করেছে। উনি জিজ্ঞেস করলেন, সংস্থিতা কি ধারেকাছে আছে শ্রীতমা?
পিউ একটু লজ্জার গলায় বলল, দিদি আসলে ঘুমিয়ে পড়েছে।
এত তাড়াতাড়ি?
না, মানে ওদের অফিসের সুন্দরবনে ক্যাম্প চলছে তো, ওখান থেকে ফিরেই বলল যে ভীষণ টায়ার্ড লাগছে… আপনি ধরুন একটু ম্যাম, আমি ডেকে দিচ্ছি ওকে।
খবরদার না, কেয়া মৈত্র বাধা দিলেন।
ডাকব না?
না ও ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক। তুমি আমাকে একটা কথা বলো তো, রাতে অস্বস্তি হলে তোমরা কী ওষুধ খাও?
কী অস্বস্তি, কেমন অস্বস্তি কিছুই জিজ্ঞেস না করে পিউ সরল বিশ্বাসে একটা অ্যান্টাসিডের নাম বলল আর কেয়া মৈত্র ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোনটা রেখে দিলেন।
ফোনটা রেখে দিয়ে কেয়ার খুব মনে পড়ল আশুতোষবাবুর কথা। বহুদিন যাবৎ তিনি শুধু কেয়ার ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানই ছিলেন না, যে-কোনওরকম সমস্যা থেকে উদ্ধার করে দেওয়া কাণ্ডারীও ছিলেন। শেষবার জ্বর হয়েছে শুনে কেয়াকে দেখে ফিরে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, আমার নিজের একটা ছোট্ট অসুখ হয়েছে বুঝলেন, আমি ক’দিনের জন্য মুম্বই যাচ্ছি, ফিরে এসে আপনাকে একটা ভিটামিন প্রেসক্রাইব করব।
সেই ছোট্ট অসুখটার নাম, ফুসফুসের ক্যান্সার। আশুতোষবাবু সেখান থেকে আর ফেরেননি। সেই ভিটামিনও আর খাওয়া হয়নি কেয়ার। ওঁর একমাত্র ছেলে দাঁতের ডাক্তার। দেখা হলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। কিন্তু এই অস্বস্তিটা নিয়ে ওকে বিব্রত করা কি ঠিক হবে?
এই সময় একটা ফোন দু’বার এসে কেটে গেল। কার ফোন? ভাবতে ভাবতে কেয়া আমেরিকায় বাবানের বাড়ির নম্বরটা ডায়াল করলেন। ফোনটা বেজে বেজে বাবানের গলায় স্থির হয়ে গেল। বাবান ইংরেজিতে বলল, সরি আমি কিংবা মালবিকা এই মুহূর্তে আপনার কলটা রিসিভ করতে পারছি না। আপনার যদি জরুরি কোনও প্রয়োজন থাকে, তা হলে আপনার নামটা বলে। রাখুন। আমরা আমাদের সুবিধেমতো আপনাকে ফোন করে নেব।
আবারও ফোন করে ভয়েস রেকর্ডে বাবানের গলাটা আবার শুনতে শুনতে কেয়ার মনে পড়ল চামেলি বলে যে, ওর কেয়ার সঙ্গে কথা বলতে ভারী ভাল লাগে।
কেন রে? কেয়া জিজ্ঞেস করেছিলেন।
তুমি মানুষটা বাসি তো। তোমার সোয়াদই আলাদা, চামেলি বলেছিল।
নিজের চুলে, ঘাড়ে, মুখে দু’-তিনবার করে হাত বুলিয়ে কেয়া টের পেলেন সত্যিই অনেক পুরনো, অনেক বাসি হয়ে গেছেন তিনি। তাই তাঁর হাতে এত সময়। টাটকা মানুষদের এত সময় কই? তারা তো ফোনই ধরতে পারে না।
তবুও আরও একবার বাবানকে ফোন করলেন কেয়া। ভাবলেন, বাড়িতে না থাকলে তো বলত বাড়িতে নেই। নিশ্চয়ই বাড়িতে থেকেও ব্যস্ত। তাই বলছে ‘এই মুহূর্তে ধরতে পারছি না। কী করছিস কী বাবান? কীসের এত ব্যস্ততা তোর? একবার একটু মায়ের সঙ্গে কথা বল। ইংরেজিতে নয়, বাংলায় বল। সেই ছোটবেলার মতো আধো আধো কথা বল। বাবানের গলাটা ইংরেজিতেই বলতে থাকল। ফোনটা কেটে গেল।
ঘড়িতে প্রায় বারোটা। কেয়ার মনে হল অস্বস্তিটা যেন একটু কম। শোওয়ার ঘরে গিয়ে আলোটা জ্বালিয়ে গীতবিতান তুলে নিলেন হাতে। ওটা বালিশের পাশেই থাকে বরাবর। প্রথমে ভাবলেন বিছানাতেই বসবেন, আবার কী ভেবে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলেন। পাতা ওলটাতে ওলটাতে থামলেন একটা পাতায়। সামনের প্যাডটা টেনে লিখতে শুরু করলেন। লেখা শেষ হয়ে গেলে প্যাডটা একটা খামের ভিতরে ভরলেন। গুছোনো বলে প্রায় সবকিছুই হাতের সামনে থাকে ওঁর। কিন্তু সেই কুপনটা কোথায়? হ্যাঁ, আলমারিতে। স্টিলের আলমারির লকারটা খুলে কুপন দুটো বের করলেন কেয়া। সযত্নে খামের ভিতরে ঢোকালেন। খামের ওপরে বড় করে লিখলেন, ‘সংস্থিতা। তারপর আঠা দিয়ে খামের মুখটা বন্ধ করে ওটা হাতে নিয়েই শোয়ার ঘরে গেলেন। জল খেলেন। প্রতি রাতের আধখানা ঘুমের ওষুধের বদলে একটা গোটা ঘুমের ওষুধ খেলেন। খামটার অর্ধেকটা বাইরে রেখে গীতবিতানের মধ্যে ঢোকালেন। আর গীতবিতানটা বালিশের পাশে রেখে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন।
ঘুম আসা, না-আসার আগের মুহূর্তগুলোয় রমেনের বন্ধু মন্টুর মুখটা ভেসে উঠল। মন্টু বলেছিল, ‘মাসিমা রাত-বিরেতে কিছু হলে ডাক্তার কোথায় পাবেন? আমাদের এজেন্সির ফোন নম্বরটা রেখে দিন। আমরা চব্বিশ ঘণ্টা অ্যামবুলেন্স, অক্সিজেন সাপ্লাই দিই।’ কোথায় সেই লিফলেটটা, যেখানে ফোন নম্বরটা লেখা ছিল? নাকি লাগবে না বলে ফেলে দিয়েছেন? না, ফেলে কেন দেবেন? তা হলে কি ওটাই ভরে রাখলেন খামটার ভিতর? ইস, সংস্থিতা কী ভাববে? সকালে উঠেই বের করে ফেলতে হবে।
ভোরের কিছুক্ষণ আগেই ঘুম ভেঙে গেল কেয়ার। চোখ না খুলেই বুঝলেন উনি একটা মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আচ্ছা এত ঘাম হচ্ছে কেন? ভাবতে ভাবতেই পরদা উঠে গেল। কেয়া দেখলেন, ম্যাকবেথের দিকে এগিয়ে আসছে একটা গোটা জঙ্গল। কিন্তু ভাল করে দেখার আগেই দৃশ্যটা পালটে গেল। ওই যে মিরান্ডা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে তার ফার্দিনান্দের দিকে। কিন্তু না, ‘টেম্পেস্ট’ তো নয়! কিং লিয়ার ঝড়ের রাতেও হাসছেন আর কে যেন কাকে কার একটা রূপ বর্ণনা করতে করতে বলছে, ‘ইউ হ্যাভ সিন রেন অ্যান সানশাইন অ্যাট ওয়ান্স।’
সেই বৃষ্টি আর রোদ একসঙ্গে দেখবেন বলে কেয়া উঠে পড়লেন। আর তখনই ওঁর সামনে এসে দাঁড়াল স্ট্রাটফোর্ড আপন অ্যাভনের সেই চেয়ার। কেয়া সেই চেয়ারে বসে দেখলেন শেক্সপিয়র স্বয়ং ওঁর পাশে বসে রয়েছেন। কেয়া জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা আমার এত ঘাম হচ্ছে কেন?
শেক্সপিয়র বললেন, যেখান থেকে রোদ আর বৃষ্টি একসঙ্গে নেমে আসে পৃথিবীতে, তুমি আমার সঙ্গে সেখানে যাবে?
কেয়া বললেন, তা হলে আর ঘাম হবে না? শেক্সপিয়র মাথা নাড়লেন।
সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো লোক এসে সেই চেয়ারটাকে একটা ইলেকট্রিক নাগরদোলার মধ্যে বসিয়ে দিয়ে গেল। সেই লোকগুলোর মধ্যে রমেন, শিখা, মন্টু, ভাস্কর, চামেলি। কেয়া বললেন, সংস্থিতা কোথায়, সংস্থিতা?
শেক্সপিয়র ওর ঠোঁটে নিজের আঙুল চাপা দিলেন। চেয়ারটা সাঁ করে উঠে গেল শূন্যে। শরীর, কার একটা বাসি পান্তা শরীর ধপ করে পড়ে গেল বিছানা থেকে মেঝেতে। নাগরদোলা ঘুরতে থাকল, ঘুরতেই থাকল।
বাইরে ভুলু ঘুমের মধ্যে ডেকে উঠল একবার।
বিদেশ থেকে যেসব টাকা আসে তার বেশ কিছুই এদিক-ওদিক হয়। শুধু ওদের এনজিও-তে নয়, প্রায় সব এনজিও-তেই। কিন্তু তারপরও যা টাকা থাকে, তা দিয়ে কাজ হয়। সংস্থিতা বরাবরই ফিল্ডওয়ার্কে উৎসাহী। সুন্দরবনে স্বাস্থ্য-শিবিরগুলো সেই সুযোগই এনে দেয় ওর কাছে। সেই কোন ভোরবেলা অটো বা ট্যাক্সিতে ও একটা নির্দিষ্ট জায়গায় চলে আসে আর সেখান থেকে কোনও বড় গাড়ি বা জিপে চেয়ার, টেবিল, ওষুধপত্র, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি আনষঙ্গিক জিনিস নিয়ে ওরা রওনা দেয়। ডাক্তাররা থাকেন, নার্সরা থাকে, এনজিও-র ওরা তো থাকেই, তা ছাড়াও নেহাতই উৎসাহী স্বেচ্ছাসেবক কিংবা মিডিয়ার লোকও থাকে দু’-একজন। গ্রাম তস্য গ্রামে কোনও একটা বড় মাঠে চেয়ার-টেবিল পেতে অসংখ্য মানুষের ঝটিতি চিকিৎসার মধ্যে সাফল্য যতটুকুই থাক, রোমাঞ্চ অনেকটাই। কিন্তু সেই উৎসব চালানোর খাটনি হাড়ভাঙা। সংস্থিতার তবু ভাল লাগে। জিপের থেকে নেমে পায়ে হেঁটে মহিষমারি, কঙ্কণদীঘি, চুপড়িঝাড়া, দেবীপুরের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় ও যে-কোনও শপিং মলে ঘোরার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ পায়।
গতকালও পেয়েছিল। কিন্তু সেই বেঁচে ওঠার শ্রান্তিতে ঘুমে ঢুলে আসছিল ওর চোখ, রাত ন’টা বাজতে না বাজতেই। এমনিতেই পিউ ওই যক্ষপুরী থেকে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে চলে আসার পর বাড়িতে সারাদিন হা- হুতাশ। কী সর্বনাশ হল আর কেন হল। খানিকটা ওই ভাঙা রেকর্ড এড়াবে বলেই সংস্থিতা ‘খেয়ে এসেছি’ বলে শুয়ে পড়েছিল তাড়াতাড়ি। ঘুমিয়েও পড়েছিল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ভোর ছ’টায় অ্যালার্ম দেওয়া ছিল। কিন্তু ওর ঘুম ভেঙে গেল ছ’টার একটু আগেই। চুপ করে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বালিশের তলা থেকে মোবাইলটা বের করে চালু করল। দিন শুরু করার আগে সংস্থিতা ‘দুর্গাস্তোত্র’ শোনে। ওর মোবাইলেই লোড করা আছে। কিন্তু সেই অবধি যাওয়ার আগেই মিস্ড কল অ্যালার্ট থেকে দুটো বিপ বিপ এল। কী একটা কৌতূহলে সংযুক্তা কল হিস্ট্রিতে ঢুকে দেখল, কেয়া মৈত্রর ল্যান্ডলাইনের নম্বর। সংস্থিতাকে ফোন করেছিলেন? ঠিক আছে, পরে কল ব্যাক করবে ভেবে সংস্থিতা দুর্গাস্তোত্রটা চালু করেছে সদ্য, হঠাৎ ওদিক থেকে একটা অচেনা নম্বর। একবার কেটে দিল সংস্থিতা। কিন্তু আবার রিং হতে শুরু করল তখনই। কে রে বাবা! একেবারে সাতসকালে!
হ্যালো, আপনি শুনছেন? একটা অল্পবয়সি ছেলের গলা কাঁপছিল ওপাশে।
আমাকে ফোন করেছেন, আমি শুনব না তো কে শুনবে? বিরক্ত গলায় বলল সংস্থিতা।
না, মানে রমেনদার বউ আপনার নম্বরটা দিয়ে ফোন করতে বলল, ছেলেটা বলল।
রমেনদার বউ ঠিক কে, সেটা খুঁজে পাচ্ছিল না সংস্থিতা। খুঁজে পাওয়ার আগেই ছেলেটার ফোন কেটে গেল। সংস্থিতা আগুপিছু না ভেবে ওই নম্বরে নিজে ফোন করল আর এবার একটা হেঁড়ে গলা, বিন্দুমাত্র গৌরচন্দ্রিকা ছাড়া, বলল, আপনি চলে আসুন। দোতলার দিদা এক্সপায়ার করেছে।
রমেনদা, রমেনদার বউ, দোতলার দিদা…সংস্থিতা আতঙ্ক আর অবিশ্বাসের গলায় শুধু বলল, হোয়াট?
আধঘণ্টার ভিতরে ম্যামের বাড়ির সামনে পৌঁছোনোমাত্ৰ সংস্থিতা বুঝল ওর কী, কেন, হোয়াই, হোয়াটের উত্তর দেওয়ার জন্য এখানে কেউ প্রস্তুত নয়। শিখা নিজের অনেকখানি উঁচু পেটের ওপর একটা হাত রেখে বলল, আমার এই অবস্থা, তার ভিতরে মাসিমা চলে গেলেন। কী যে করলেন!
সংস্থিতা জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ চলে গেলেন? কোনও শরীর খারাপ বুঝতে পারোনি?
রমেন কড়া গলায় বলল, কী করে বুঝব বলুন? উনি কি আমাদের সঙ্গে মিশতেন?
সংস্থিতা রাগে ফেটে পড়ে বলল, মিশতে পারেন সেরকম পরিস্থিতি ছিল? আপনারা রেখেছিলেন?
রমেন অবজ্ঞার স্বরে বলল, সে আপনি যা খুশি ভাবতে পারেন। বলেই, গেটের ভিতরে-বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তিন-চারজনের উদ্দেশে বলল, ডাক্তারটা তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলে নিয়ে যাই।
ওই কথায় সংস্থিতা যেন সংবিৎ ফিরে পেল। প্রায় ছুটে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বলল, আপনারা আর কিছু করবেন না, কোথাও নিয়ে যাবেন না। এবার যা করার আমি করব।
বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ কেয়া মৈত্র যখন ওঁর বাড়ি থেকে শেষবারের মতো বেরিয়ে যাচ্ছেন তখন ওঁর আগে-পিছে লোকারণ্য। প্রাক্তন সহকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী, নানা বয়সের বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত। সেই তুলনায় আত্মীয়-স্বজন নেহাতই কম। কিন্তু আত্মীয়তা কি শুধু বিয়ে-থা কিংবা রক্তের সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? সংস্থিতা ভাবছিল। সেই ভাবনাকে আরও উসকে দিল ম্যামের ছেলের কথাবার্তা। উনি বললেন যে, ওঁর মা যখন আর নেই তখন শুধু শুধু মায়ের বডি বরফের মধ্যে গুঁজে রেখে লাভ নেই, সৎকার করে দেওয়াই ভাল। অবশ্য খুব ভদ্রভাবে এও জানালেন যে, টাকা-পয়সা যা লাগে উনি পাঠিয়ে দেবেন।
আপনার তো ছেলে হিসেবে কিছু কাজ আছে, মানে মায়ের পারলৌকিক কাজ। সংস্থিতা বলল।
কেয়া মৈত্রর ছেলে বললেন, ও সব আমি আমেরিকাতেই সেরে নেব।
যা সেরে ফেলা যায় না, সারাজীবন যাকে বয়ে বেড়াতে হয়, তাকে কী বলে, স্মৃতি? সেই স্মৃতির সঙ্গে ভবিষ্যতের লড়াইয়ে যা রেফারির কাজ করে, সেই তো বর্তমান। সংস্থিতা সেই বর্তমানের একটা মুহূর্ত থেকে আর একটা মুহূর্তকে আলাদা করতে করতে ম্যামের শরীরে এসে পড়া ফুলের মালাগুলোকে ম্যামের থেকে আলাদা করতে করতে বুঝতে পারল কেয়া মৈত্র না থাকায় ওর থেকে কলকাতা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ও এবার স্বচ্ছন্দে ওর পিছনে ঘুরঘুর করতে থাকা প্রোমোশনের হাত ধরে চেন্নাই চলে যেতে পারে। আসলে তো অনেক বড় প্রোমোশন কেয়াদি ঘটিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সংস্থিতার হৃদয়ে, কথাবার্তায়, চিন্তাভাবনায়। বিনিময়ে ও কী দিতে পেরেছে ওই ভদ্রমহিলাকে? কিছু না। এমনকী শেষ রাতের ফোনটুকুও ধরে উঠতে পারেনি। কী ভাবছিলেন কেয়াদি সেই মুহূর্তে ওর সম্পর্কে? দায়িত্বজ্ঞানহীন? কিন্তু পিউ যে বলল, উনি সংস্থিতাকে ঘুম থেকে ডাকতে বারণ করেছিলেন? সেই বারণ কি অভিমানসঞ্জাত?
সংস্থিতা পিউকে দরজা বন্ধ করতে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিল, কিন্তু ম্যামের খবর শুনে ওকে একা ওভাবে বেরোতে দেয়নি পিউ। মাকে ডেকে তুলে দিয়ে সঙ্গ নিয়েছিল দিদির। কেয়া মৈত্রর ভস্মাবশেষ গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার পর যখন ভিড়টা টুকরো টুকরো হতে শুরু করেছে আর একটা টুকরোর অন্তর্ভুক্ত ওরা দু’জন চেপে বসেছে বাড়ি ফেরার ট্যাক্সিতে, পিউ সংস্থিতার হাতে একটা খাম তুলে দিয়ে বলল, তোকে লেখা ম্যামের চিঠি বোধহয়। ওঁর বালিশের পাশে রাখা গীতবিতানটার মধ্যে ছিল। একজন কাউকে মৃতদেহ ছুঁয়ে বসে থাকতে হয় বলে সংস্থিতা পিউকে বসিয়ে রেখেছিল কেয়াদির পাশে। কিন্তু ও আরও কী ছুঁল? ভাবতে ভাবতে খামটার মুখ ছিঁড়ল সংস্থিতা। হাতে উঠে আসা কাগজটা স্পষ্ট হয়ে উঠল রাস্তার আলোয়
“সহসা দারুণ দুখতাপে
সকল ভুবন যবে কাঁপে,
সকল পথের ঘোচে চিহ্ন
সকল বাঁধন যবে ছিন্ন
মৃত্যু-আঘাত লাগে প্রাণে
তোমার পরশ আসে কখন কে জানে।।”
পাতার ওপরে বাঁ দিকে ‘সংস্থিতা’ আর নীচে ডান দিকে ‘কেয়াদি’ শব্দ দুটো এক রাত্রির ব্যবধানে উত্তরমেরু, দক্ষিণমেরু হয়ে গেল। মৃত্যু এত অসেতুসম্ভব কেন?
হঠাৎ পিউ বলল, দিদি খামটার ভিতরে আরও কিছু আছে রে!
সংস্থিতা হাত ঢোকাতেই বেরিয়ে এল দুটো কুপন। লন্ডনের বিখ্যাত চা- কোম্পানি, যারা ভারতের সর্বোৎকৃষ্ট চা নিয়ে সারা পৃথিবীতে ব্যাবসা করে, তাদের একমাত্র কলকাতা আউটলেট থেকে আগামী দু’বছর নিখরচায় বছরে তিন কেজি পর্যন্ত চা পাওয়ার কুপন। কুপনদুটো হাতে নিয়ে সংস্থিতার মনে হল কেয়াদি বারেকাছেই আছেন। ও গলা নামিয়ে বলল, চা পাতাটা কতক্ষণ ভেজাব ম্যাম?