রোডসসাহেবের হিরে – রাজেশ বসু

রোডসসাহেবের হিরে – রাজেশ বসু

দু-দিন ধরে টানা বৃষ্টি। চারিদিকে জল থই থই অবস্থা। গরমের ছুটি চলছে বলে স্কুলও বন্ধ। বাইরে বেরতে হবেই, এমন কোনও ব্যাপার নেই। বাজার-টাজারও অঢেল করা আছে। অতএব বাড়ি বসে বর্ষার আনন্দ উপভোগ করছি। বাবা-মা বাড়ি নেই। ওঁরা গিয়েছেন দক্ষিণ ভারত ভ্রমণে। আমরাই বাড়ির কর্তা এখন। আমরা মানে আমি আর ইন্দ্রদা। ও-ও আজ কলেজ ছুটি নিয়েছে।

এখানে ইন্দ্রদার কথা একটু বলে নিই। ও আসলে বাবার ছোটোবেলার বন্ধু সুদর্শনকাকুর ছেলে। ভালো নাম সন্দর্শন রায়। কাকুর বদলির চাকরি। এখন আছেন দিল্লিতে। ইন্দ্রদা কলকাতায় ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে যাওয়াতে আমাদের বাড়িতে থেকে গিয়েছে। ভাগ্যিস, কাকুদের সঙ্গে ও-ও দিল্লি চলে গেলে দারুণ মিস করতাম ওকে। ওর থেকে আমি সাত-আট বছরের ছোটো হলে কী হবে, দারুণ ভাব আমাদের।

যা হোক, রান্নার মাসি না আসাতে নিজেরাই দুপুরের খাবার করেছি। খিচুড়ি আর ডিমভাজা। সঙ্গে আমের চাটনি। স্নান-টান সেরে খেতে বসেছি দু-জনে। ইন্দ্রদা দুর্দান্ত মুডে আছে। কারণ একটার পর একটা কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে যাচ্ছে খালি। মেজাজ ফুরফুরে হলেই ওর এমন প্রশ্ন করার বাতিক চেপে বসে। আমার অবশ্য ভালোই লাগে। সাংঘাতিক নলেজ ওর। ডাক্তারির ছাত্র হলে কী হবে, এমন কোনও বিষয় নেই যাঁর খোঁজ রাখে না ও। সঙ্গে থাকলে নিজেরই সাধারণ জ্ঞানের স্টক বাড়ে। এখন যেমন বলল, ‘ক্রিপটোগ্রাফি ব্যাপারটা কি জানিস তুই?’

শব্দটা চেনা চেনা লাগছিল। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারলাম না। মাথা নাড়তে হল। ও অবশ্য ধরেই নিয়েছিল আমি জানি না। উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, ‘ইট মিনস, সিক্রেট রাইটিং। সাঙ্কেতিক লেখনি। শব্দটা এসেছে দুটো গ্রিক-ওয়ার্ড থেকে। ক্রিপ্টোস আর গ্রাফোস। ক্রিপটো মানে সিক্রেট, আর গ্রাফোস মানে রাইটিং। মিলে হল ক্রিপটোগ্রাফি।’

ডিমভাজার মধ্যে লংকা ছিল। কামড় দিয়ে ফেলেছি। বেশ ঝাল আছে লংকাটা। চোখে জল আসার অবস্থা। কোনোমতে সামলে নিয়ে বললাম, ‘ডাক্তারিতে তোমাদের এসবও পড়তে হয় নাকি?’

ইন্দ্রদা সরাসরি উত্তর দিল না। হেঁয়ালি করে বলল, ‘সব কিছু জেনে রাখা ভালো রে। কখন যে কোনটা দরকারে লাগে। বিশেষ করে আমার শখের জন্যে তো বটেই।’

কথাটা ঠিক। কারণ ডাক্তারিটা ওর পেশা হলেও ওর আসল নেশা বা শখটা গোয়েন্দাগিরি। মাত্র সাড়ে-তেইশ বছর বয়স ওর। সবে ইর্ন্টানশিপ শেষ করেছে। কিছুদিনের মধ্যে সাইকোলজি নিয়ে পোস্ট-গ্রাজুয়েশন করবে। আপাতত হাউজস্টাফশিপ করছে। অর্থাৎ পুরোদস্তুর ডাক্তার হতে বছরখানেক দেরি। কিন্তু এর মধ্যেই চেনামহলে অল্পবিস্তর নাম করে ফেলেছে ও।

বললাম, ‘নতুন কিছু রহস্যের সন্ধান পেলে নাকি?’

‘ঠিক রহস্যের না। বোঝানো-টোঝানোর ব্যাপার। কাউন্সেলিং আর কি। ওজস্বিতা ঘোষকে চিনিস তো তুই। আমাদের কলেজের। ফাইনাল এম বি দেবে এবার। ওর একটা পারিবারিক সমস্যার ব্যাপারে কথা বলবে বলছিল। আমি পুরোটা জানি না এখনও। বৃষ্টি কমলে আজ বিকেলেই আসতে পারে ও।’

ওজস্বিতা ঘোষ। হ্যাঁ। মনে পড়েছে। খুব সুন্দর দেখতে দিদিটিকে। খুব লম্বা। আমি সাড়ে-পাঁচ ফিট। আমার চেয়েও দু-তিন ইঞ্চি লম্বা হবে। নোটসের জন্যে ইন্দ্রদার কাছে এসেছিল। মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে থাকে। আসল বাড়ি নদিয়া জেলার মদনপুরে।

বললাম, ‘বাব্বা, তুমি আমাকে কিচ্ছু বলনি!’

‘বললে কী হত, সারপ্রাইজের মজাটা পেতিস। তাছাড়া ব্যাপারটায় মগজের ব্যায়াম কিছু নেই। প্লেন ডাক্তারি।’

‘তবে নিলে কেন?’

‘বা:, বন্ধুকে হেল্প করব না?’ বলল ইন্দ্রদা, ‘অবশ্য একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে। — সিসিল জন রোডসের নাম শুনেছিস?’

‘না।’

‘ডি বিয়ার কোম্পানি?’

‘এটা জানি, ওয়ার্ল্ড ফেমাস ডায়মণ্ড কোম্পানি।’

‘ঠিক। সিসিল রোডস ছিলেন এই কোম্পানির একজন প্রতিষ্ঠাতা। নাইনটিন্থ সেঞ্চুরিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশাল ব্যাবসা গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ইনফ্যাক্ট, এককালের নর্থ এবং সাউথ রোডেশিয়া, যা নাকি এখন জাম্বিয়া এবং জিম্বাবোয়ে নামে পরিচিত, তা এই রোডসসাহেবের নামেই নামাঙ্কিত হয়েছিল একসময়ে। তবে টাকা উপায় করলেও দানে মন ছিল রোডসসাহেবের। অর্থনীতির গবেষণার জন্য ইংল্যাণ্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রচুর টাকা দান করেন। রোডস স্কলারশিপ নামে যা এখনো পরিচিত। ঘটনা হল, ওজস্বিতার দাদু রতনমোহন ঘোষের সঙ্গে এই রোডসসাহেবের পরিচয় ছিল। রতনমোহন বিলেতে ডাক্তারি শিখে রোডসসাহেবের অধীনে কাজ করেছিলেন কয়েক বছর। তাঁর ডাক্তারি জ্ঞানে খুশি হয়ে রোডসসাহেব তাকে একটি দশগ্রাম ওজনের হিরে উপহার দেন। সেহিরে তিনি বিক্রি করেননি। নিজের কাছে রেখেছিলেন। সেটিকে তিনি পয়মন্ত মনে করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর হিরে আসে ওজস্বিতার বাবা মণিফাল্গুনীবাবুর হাতে। তিনিও এটিকে সযত্নে রেখেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি বয়স এবং অসুস্থতার কারণে তিনি এটিকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। কারণ হল ওজস্বিতার দাদা ওম। সেনাকি সাংঘাতিক বেয়াড়াগোছের। পড়াশোনা তেমন করেনি। মণিফাল্গুনীবাবুর কাপড়ের ব্যবসায় ঢুকেছে। কিন্তু অপটুত্ব এবং বেহিসেবি খরচের জন্যে ব্যাবসাটিকে প্রায় তুলে দেওয়ার জায়গায় নিয়ে এসেছে। ইদানিং সেএই হিরে পেতে মরিয়া। হিরে কোথায় আছে তা অবশ্য মণিফাল্গুনীবাবু কাউকে বলেননি। তাঁর বেডরুমে একটি লোহার সিন্দুক আছে। চাবি তাঁর নিজের কোমরেই বাঁধা থাকে। হিরে হয়তো সেখানেই আছে। ওজস্বিতার ভয় দাদা যা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে হিরে নিয়ে যে-কোনো মুহূর্তে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমার কাছে তাই পরামর্শ চায় সে।’

ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং বটে। কিন্তু ইন্দ্রদা ওদের পারিবারিক ঝামেলায় কদ্দুর কী করতে পারে বুঝলাম না। বললাম, ‘যা বৃষ্টি হচ্ছে, আসতে পারবে সে?’

‘দেখা যাক।’

বললাম, ‘আমরাও তো ওর হোস্টেলে যেতে পারি।’

‘পারি। কিন্তু বারণ করেছে। ব্যাপারটা পাঁচকান হোক, চায় না ও।’ বলল ইন্দ্রদা।

খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। উঠে পড়লাম আমরা। বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই এখন।

কিন্তু কী কান্ড! বিকেল অবধি অপেক্ষা করতে হল না। খেতে বসেছিলাম দুপুর দেড়টায়। বৃষ্টি থেমে ঝকঝকে রোদ উঠে গেল তিনটের মধ্যেই। ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে বাড়ির সামনের জমা জলও নেমে গেল তরতর করে। কিন্তু যার জন্যে অপেক্ষা সেই ওজস্বিতা ঘোষের কোনো খবর নেই। ইন্দ্রদাকেও একটু উদগ্রীব লাগছে। ছ-টা বাজতে ও নিজেই ফোন করতে যাচ্ছিল। কাকতালীয় ভাবে ঠিক তখনই ওর মোবাইল বেজে উঠল। ফোনটা হাতে নিয়েই ইশারায় বুঝিয়ে দিল ওজস্বিতাদি। চার-পাঁচমিনিট কথা হল। তাতে বুঝলাম আমাদের মদনপুরে যেতে হবে। ওজস্বিতাদির বাড়ি। ঘটনা হল ওজস্বিতাদির বাবা মণিফাল্গুনীবাবু নাকি হঠাৎ মারা গিয়েছেন। আজ দুপুরেই। স্বভাবতই ওজস্বিতাদিকে বাড়ি যেতে হয়েছে। ভদ্রলোকের হার্টের অসুখ ছিল বটে। একবার স্ট্রোকও হয়ে গিয়েছে। তবে ইদানিং সুস্থই ছিলেন। ওজস্বিতাদি বলেছিল আগামীকাল সকালে আসলেও হবে। ইন্দ্রদা বলল মদনপুর এমন কিছু দূর না। শিয়ালদা থেকে ট্রেনে ঘণ্টাদেড়েকের রাস্তা। সাতটা-সাড়েসাতটার মধ্যে ট্রেনে উঠতে পারলে নটা-সাড়েনটার মধ্যে পৌঁছে যাবো। সুতরাং যেমন কথা তেমন কাজ। বাড়িঘরদোর ভালো করে তালাটালা দিয়ে ছোটো একটা ব্যাগ কাঁধে সাতটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম দু-জনে। আজ শনিবার। কাল বিকেলেই ফিরব।

মদনপুর স্টেশনে পৌছোলাম ঠিক রাত সাড়ে দশটায়। লাইনে কীসব গন্ডগোল ছিল। খামোকা ঘণ্টাখানেক দেরি হয়ে গেল। ওজস্বিতাদির বাড়ি আবার স্টেশন থেকে অনেকটা দূর। রিক্সায় লাগে আধঘণ্টা। তবে দেখলাম ওজস্বিতাদির বাবা মণিফাল্গুনী ঘোষ এ অঞ্চলের বেশ পরিচিত ব্যক্তি। নাম বলতেই রিক্সাওয়ালারা এগিয়ে এল। এমনকি তিনি যে আজ দুপুরে মারা গিয়েছেন, সেখবরও তাদের জানা।

যা হোক, আমরা যখন শেষমেষ ওদের বাড়ি পৌঁছোলাম রাত তখন এগারোটা পেরিয়েছে। সাবেকি আমলের দু-তলা বিশাল বড়ো বাগানঘেরা বাড়ি। তাক লেগে যাওয়ার মতো ব্যাপার। পিছনে দুটি পুকুরও আছে শুনলাম। ওজস্বিতাদি অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। দাহকার্য সব শেষ। ইন্দ্রদা প্রথমেই ওর দাদা ওমের খোঁজ নিল। ওজস্বিতাদি বলল সেএখনও বাড়ি ফেরেনি। পরিস্থিতি এমন গম্ভীর, এসে পড়ে কেমন অস্বস্তি লাগছে। এর মধ্যেও দেখছি আতিথেয়তার ত্রুটি রাখেনি ওজস্বিতাদি। ঘরটর গুছিয়ে-টুছিয়ে রেডি করে রেখেছে আমাদের জন্যে। তবে মেন্টালি স্টেডি থাকার চেষ্টা করলেও সদ্য বাবা হারানোর শোকটা ঠিক ঢাকতে পারছিল না। চোখেমুখে ফুটে উঠছিল। স্বভাবতই বিশেষ কথা হল না। যেটুকু জানলাম তা হল, মণিফাল্গুনীবাবুর হার্টের অসুখ ছিল। বছর দুয়েক আগে স্ট্রোকও হয়েছিল একবার। সাবধানে থাকার কথা। কিন্তু তা নাকি তিনি থাকতেন না। খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম তো বটেই, অযথা কায়িক পরিশ্রমও করতেন। ঘটনার দিন সকালেই নাকি হঠাৎ কি মনে করে বাড়ির গাছের নারকোল ছুলতে বসেছিলেন। সুবল বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের লোক, সে-ও অনেক বারণ করেছিল। মণিফাল্গুনিবাবুর শোনেননি নাকি। সত্তর বছরে ধকল নিতে পারেননি। সকাল দশটা নাগাদ হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওজস্বিতাদি খবর পেয়ে বাড়ি আসার আগেই সব শেষ। ছেলে ওম সেসময় বাড়ি ছিল না। ব্যাবসার কাজে রানাঘাট গিয়েছিল। সেখবর পায় সুবলের কাছে। অর্থাৎ গোটা ব্যাপারটা দুঃখজনক হলেও প্রকৃতির নিয়মেই হয়েছে। অবশ্য ইন্দ্রদার মুখ দেখে মনে হল ও যেন অন্য কিছু একটা ভাবছে। আমাকে খালি বলল, ‘বেশি চিন্তা করিস না টুকান। সোজা শুয়ে পড়। কাল সকালে দেখব মগজে কত ঘিলু জমিয়েছিস।’

আমি আর কী করি। শুয়েই পড়লাম। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসতে চাইছে না। নিঝুম শোকস্তব্ধ বাড়ি। মনের মধ্যে অস্বস্তি হচ্ছে কেমন একটা। বড়ো একটা জামদানি খাটে পাশাপাশি শুয়েছি দু-জন। ইন্দ্রদা মনে হচ্ছে এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মৃদু নাকডাকার শব্দ পাচ্ছি। হঠাৎ মনে হল কারা যেন চাপাস্বরে ঝগড়া করছে। আমাদের ঠিক ওপরের ঘরের থেকেই আওয়াজটা আসছে। ওটা যে ওজস্বিতাদির ঘর সেটা জেনেছি। কান খাড়া করে শুনলাম। কথা কাটাকাটির আওয়াজ। কে যেন বলল,—কেন আমার ঘর ঘেটেছিস তুই? উত্তরে মহিলা কন্ঠে কিছু বলা হল। বুঝলাম না। তবে গলাটা যে ওজম্বিতাদির তাতে সন্দেহ নেই। তাহলে ছেলের গলাটা ওর দাদা ওমের? নাকি চাকর সুবলের। কিন্তু সুবল বাড়ির দিদিমণির সঙ্গে ঝগড়া করবে কেন? তাছাড়া তুই বলেও সম্বোধন করতে পারে না। তাহলে ওর দাদারই। আর তো কেউ নেই এ বাড়িতে। কিন্তু এমন শোকাচ্ছন্ন পরিবেশে ভাইবোনে কথা কাটাকাটিই বা করবে কেন? কী একটা ঝুপ করে পড়ল জানালার বাইরে। মাথার ওপরেই জানালা। স্পষ্ট শুনলাম। অবশ্য গাছের পাতাটাতাও পড়তে পারে। একটু পর অবশ্য আওয়াজ থেমে গেল। আবার সব শুনশান। নিস্তদ্ধ। ঘুমিয়ে পড়লাম একসময়। মাঝে একবার যেন ঘুম ভেঙেছিল। কে যেন কাঁদছে খুব। বুঝলাম না। আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম ভাঙল পাখির আওয়াজে। একটা দুটো না, একশ পাখির তিনশরকমের ডাকাডাকিতে। কলকাতায় আমাদের ঢাকুরিয়ার বাড়িতে কাক চড়াই আর শালিক ছাড়া চতুর্থ কোনও পাখির ডাক কদাচিৎ শুনেছি। আর এখানে কি চমকপ্রদ ব্যাপার। ইস, একটা বাইনোকুলার আনলে পাখিগুলো ওয়াচ করা যেত। —যা:, কি যা-তা ভাবছি, স্থান-কাল-পাত্র সব ভুলে বসে আছি। উঠে বসলাম বিছানায়। দেখি ইন্দ্রদা আগেই উঠে পড়েছে। বাইরে গিয়ে একচক্কর হেঁটেও এসেছে মনে হল। গালে-মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমেছে।

‘উঠে পড়ুন টুকানবাবু। ওজস্বিতা নিজেই চা নিয়ে আসছে। বলেছে কনফিডেনশিয়াল টক আছে।’ বলল ও।

আর একটু গড়ানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এ কথার পর আর কি আলসেমি করা যায়। তড়াক করে উঠে পড়লাম। ফ্রেশ হয়ে ফিরতে মনে পড়ল গতকাল রাতের ঝগড়ার কথা। তাড়াতাড়ি বললাম ইন্দ্রদাকে। জানালার নীচে কী একটা ঝুপ করে এসে পড়েছিল, সেই তুচ্ছ ইনফরমেশনটাও বাদ দিলাম না। শুনেই ও যে গতিতে বেরিয়ে গেল বুঝলাম ভালো তথ্যই দিতে পেরেছি।

‘ভেরি গুড অবজারভেশন। উন্নতি করেছিস।’ একটু পরেই ফিরে এসে বলল ইন্দ্রদা। ঝুপ করে কী পড়েছিল সেটাই দেখতে গেছিল বুঝি। পেল কিনা জিজ্ঞাসা করতে যাব, দেখি আমাদের জানালার বাইরে হিন্দি সিনেমার হিরোর মতো একজন যুবকের আবির্ভাব ঘটেছে। আঠাশ-উনত্রিশ বছর বয়স। ফর্সা রং।

গালে দু-একদিনের না কামানো গোঁফদাড়ি। জিম করা পেটানো চেহারা। হাতে বালা। কানে দুল। লম্বা চুল পনিটেল করে বাঁধা। অশৌচের সাদা পোশাকে বড়োই বেমানান লাগছিল তাকে। নীচু হয়ে কিছু একটা খুঁজছে মনে হল। বুঝলাম এই হল ওজস্বিতাদির দাদা ওম। আমাদের দিকে একবার জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে চলে গেল সে। যা খুঁজছিল পাওয়া গেল না বোধহয়। এর মধ্যে চায়ের ট্রে নিয়ে দরজায় হাজির ওজস্বিতাদি। গতকালের থেকে অনেকটাই ফ্রেশ লাগছে ওকে। নীলরঙের একটা হাউজকোট পরে এসেছে।

‘গুডমর্নিং সন্দর্শনদা। গুডমর্নিং টুকান।’ মিষ্টি করে বলল সে।

আমরাও প্রত্যুত্তর দিলাম।

ইন্দ্রদা বলল, ‘তুই আবার এসব ঝামেলা করলি কেন। আমরা বাইরে বেরিয়ে খেয়ে নিতাম।’

ওজস্বিতাদি কিছু বলল না। মুখের ভঙ্গি হঠাৎ সিরিয়াস। ঘরে একটা পড়ার টেবিল রয়েছে। তাতেই চায়ের ট্রে-টা রাখল সে। তারপর আমাদেরকে দু-কাপ চা দিয়ে নিজে এককাপ নিল। বিস্কুট ছিল। আমি খালি নিলাম। ওরা দুজন কেবল চা।

ওজস্বিতাদি চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘কি বলব আমি, বাবা যে এমনি করে চলে যাবে! কোনো চান্সই দিল না। ম্যাসিভ মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন। দাদা লোকাল একজন ডাক্তার ডেকেছিল। আমি এসে নার্সিংহোমে নিয়ে যাই। তখন সেন্স প্রায় ছিলই না। নার্সিংহোমে অল্পসময়ের জন্যে জ্ঞান এসেছিল। কথা বলতে পারেনি। হাত দেখিয়ে বলল কিছু বলতে চায়। লেখার ভঙ্গি করল। কাগজ আর পেন দিতে কতকগুলো আবোল-তাবোল কথা লিখল।’

 মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন শব্দদুটির মানে জানি। সাডেন ডেথ অব হার্ট-মাসল। হৃদপিন্ডের ধমনিতে আকস্মিক কারণে রক্তপ্রবাহ বিঘ্নিত হলে এমনটা হয়। পরিণতি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আমরা যে স্ট্রোক বলে থাকি এটার আসল ডাক্তারি টার্ম এটাই।

ইন্দ্রদা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী কথা?’

কী বলব, ভেরি ফানি। — ও আর ও মৌমাছি। প্লেন বাংলাতে। তারপর ড্যাশ দিয়ে ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটার্সে X L X L M F G ।

‘বাপরে।’ বলল ইন্দ্রদা। ‘তোর ঠিক মনে আছে? সেকাগজটা কোথায়?’

‘নেই। দাদা হাত থেকে কেড়ে নেয়। লেখাটা দেখে মাথাটা গেছে বলে সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে ফেলে। আমার কিন্তু একদম মুখস্ত হয়ে গেছিল।’

‘হুঁ। বোঝাই যাচ্ছে ওইরকম অবস্থার মধ্যেও হুঁশ ছিল ভিতরে। কথাগুলো হয়তো আগে থেকেই ভাবা ছিল।’ বলল ইন্দ্রদা। ‘একটা ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করি। গতকাল রাতে তোদের ভাইবোনের মধ্যে কোনো অশান্তি হয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’ মাথা নামিয়ে বলল ওজস্বিতাদি।

‘কী নিয়ে বলা যাবে কি?’

‘কী আর, ওই রোডসের হিরে নিয়ে। দাদার ধারণা বাবা ওটা আমাকে দিয়ে গেছে। বাবা মারা গেছে চব্বিশটি ঘণ্টাও হয়নি, এর মধ্যেই বাবার সিন্দুক হাতড়েছে ও। অমানুষ। হার্টলেস।’

‘একটু আগে বাগানে এসেছিল মনে হল।’ ইন্দ্রদা চেহারার ডেসক্রিপশন দিল।

ওজস্বিতাদির মুখে হঠাৎ একটা চিন্তার ছায়া দেখলাম। ‘হ্যাঁ দাদাই। — তুমি কথা বলবে ওর সঙ্গে?’

‘ভালো হত।’

‘ঠিক আছে। বলে দেখি। যা মেজাজ তার। একটু পরে ব্যাঙ্কে যাবে বলছে। বাবার নামে কোনো সেফ-ডিপোজিট লকার ছিল না জানি। তবু ব্যাঙ্কে গিয়ে খোঁজ নিতে চায় সে। তুমি কথা বলতে পারো। তবে সৌজন্যতা বা ভদ্রতার নিশ্চয়তা দিতে পারব না। তোমরা আসাতে মোটেই খুশি না সে। বলেছি আমার সিনিয়ার দাদা। বাড়ি কৃষ্ণনগরে। সেখানে যাওয়ার পথে আমার সঙ্গে দেখা করতে মদনপুরে নেমেছে। বাড়িতে যে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে জানত না।’

ইন্দ্রদা কী একটা ভাবল। তারপর বলল, ‘বাড়িতে আর কে কে আছে তোদের?’

‘সুবলকাকার কথা তো বলেছি। চল্লিশ বছরের পুরোনো কাজের লোক। ষাটের ওপর বয়স। পরিবারেরই একজন বলা চলে। আর আছে রান্নার মাসি অনিতা। সেঅবশ্য কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছে। সুবলকাকাই রান্নার পাটটা সামলাচ্ছে এখন।’

‘ঠিক আছে। তুই তবে প্লিজ একটা কাজ কর। সুবলকাকাকে পাঠিয়ে দে। একটু কথা বলে নিই।’

চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। কাপগুলো ট্রে-তে রেখে দিয়েছি। ওজস্বিতাদি ট্রে-টা তুলতে যেতে ইন্দ্রদা বারণ করল। ‘ওটা রেখে যা। সুবলকাকা এসে নিয়ে যাবে। তখন কথা বলে নেব।’

‘রাইট।’ বলল ওজস্বিতাদি। ‘তবে বেশি দেরি করো না। দাদার ঠিক নেই। ব্যাঙ্ক খুলতে দেরি আছে তিনঘণ্টা, তবে ও যে কখন কোথায় বের হয়, কোনো ঠিক নেই।’

‘ডোন্ট ওরি।’ বলল ইন্দ্রদা।

আমার দিকে একটু হেসে বেরিয়ে গেল ওজস্বিতাদি। আর ঠিক তিনমিনিটের মধ্যে এল সুবলকাকা। দেখে বোঝা যায় না ষাটের ওপর বয়স। বেশ শক্তপোক্ত চেহারা। কেবল মাথার চুল আর খোঁচা-খোঁচা দাড়িগুলো সব সাদা। ওজস্বিতাদি মনে হয় বলে দিয়েছে ইন্দ্রদা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে, চায়ের ট্রে না উঠিয়ে তাই মনে হয় সরাসরি বলল, ‘বলেন ডাক্তারবাবু।’

‘ঘটনাটা ঘটল কখন?’

‘কী বলব ডাক্তারবাবু। বাবুর যে কী খেয়াল। সকালবেলা ওমদাদাবাবু বেরোনর পরেই আচমকা ঝুনো নারকোল নিয়ে বসলেন ছাদের ওপর।’

‘নারকোল কোথায় পেলেন, বাড়ির গাছের?’

‘তা তো বটেই। মাঝে মাঝে পাড়া হয়। বাবুর পালঙ্কের নীচেই তো ডাঁই করে রাখা কতগুলো — কত মানা করলাম। শুনলে তো। আসলে বাবুর যখনই রাগ হয় নিজেকে কষ্ট দিতে শুরু করেন। বাগানে নেমে মাটি কোপাবেন, কী পাতকুয়ো থেকে বালতি বালতি জল তুলে চান করবেন।’

‘গতকালের রাগের কারণটা কী? বাবুর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল?’

সুবল একটু কাঁচুমাচু মুখ করল — ‘কী বলব ডাক্তারবাবু, ঝগড়া তো বলতে গেলে রোজই লেগে আছে। কাল সক্কালে একচোট হল। ফোন নিয়ে। বাবুর মোবিল ফোনটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে দিনদশেক ধরে। ওমদাদাবাবু কোনো একটা দোকানে সারাতে দিয়েছিলেন। নিয়ে আর আসেন না। সেনিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল খুব।’

‘ল্যাণ্ডফোন নেই?’ আমি মাঝপথে জিজ্ঞেস করলাম।

‘ছিল। ওমদাদাবাবু বাবুকে না বলে ছেড়ে দিলেন যে।’

‘হুঁ।’ মুখটা গম্ভীর করে বলল ইন্দ্রদা, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কি। সকাল আটটা সাড়ে-আটটা হবে। ওমদাদাবাবু বেরিয়েছেন সাতটার সময়। বাবু নারকোল ছুলেটুলে ব্যাগে ভরে নিজের ঘরে গেলেন। তারপর দরজা বন্ধ করে বসে রইলেন। ওমদাদাবাবু ফিরে এসে আবার চেঁচামেচি। বাবু ভিতর থেকে সাড়া দিলেও দরজা খুললেন না। কী বলব, ওমদাদাবাবু বাইরে থেকেই ঝগড়া শুরু করলেন আবার।’

‘কি নিয়ে?’

‘কী আর বলি। সম্পত্তি নিয়ে।’ গলা নামিয়ে বলল সুবল। ‘সেভাবল বাবু নতুন উইল লিখছেন। যা হোক কিছুক্ষণ পর বাবু নিজেই দরজা খুললেন। তখন আবার একচোট ঝগড়া। বাবু খুব ঘামছিলেন। চোখ বুজে শুয়ে পড়েছিলেন। ওমদাদাবাবু রেগে গিয়ে ঘর লন্ডভন্ড করলেন। বইপত্র ছড়িয়ে জামাকাপড় ফেলে, এমনকি দেরাজ খুলে বাবুর ওষুধও ফেলে দিচ্ছিলেন। আমি তখন প্রায় জোর করেই ওমদাদাবাবুকে ঘর থেকে বের করে আনি। তিনি আবার বাইক নিয়ে বেরিয়ে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যে বাবুর শরীর আরোও খারাপ হয়। আমি তখন বাইরে বেরিয়ে টেলিফোনবুথ থেকে ওমদাদাবাবু আর লিলি দিদিমণিকে ফোন করি।’

‘লিলিদিদিমণিকে?’

‘ওমা, উনিই তো আপনার বন্ধু। ওমদাদাবাবুর বোন। ডাকনাম লিলি।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কি। বাড়ি এসে দেখি। বাবুর মুখে গ্যাঁজলা। হুঁশ নেই কোনো। শরীল অসাড়। ছুটে গিয়ে মাধবডাক্তারকে খবর দিয়ে আসি। তিনিও বাড়ি ছিলেন না। কী অবস্থা! এলেন সেই বেলা এগারোটার সময়। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে ওমদাদাবাবুও এলেন। কিছুক্ষণ পর লিলি দিদিমণিও এলেন। তারপর তো সব শুনেছেন।’

‘ঠিক আছে। আপনি উপরে গিয়ে একটু দিদিমনিকে পাঠিয়ে দিন।’

‘যে আজ্ঞে, ’ বলে চলে গেলেন সুবলকাকা।

ওজস্বিতাদি আসতে আমরা এবার ওর বাবার ঘরে এলাম। ইন্দ্রদার ইচ্ছা ছিল প্রথমে ওর দাদার সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু আমরা ঘর থেকে বেরনোর আগেই মোটরসাইকেলের শব্দ শুনলাম। ওজস্বিতাদি বলল, ‘দাদাকে বলেছিলাম তোমাদের কথা। শুনেই মনে হয় বেরিয়ে গেল।’

ইন্দ্রদা ভাবলেশহীন। কিছু বলল না। আমরা উঠে এলাম দু-তলায়। দু-তলাতেও নীচের মতো অনেকগুলি ঘর। মণিফাল্গুনীবাবু থাকতেন একদম শেষে দক্ষিণের ঘরটিতে। বেশ বড়ো ঘর। কড়িবড়গার ছাদ। গোটাকয়েক বড়ো বড়ো জানালা। ঘরের একদিকের দেয়াল ঘেঁষে সুবিশাল সাবেকি পালঙ্ক। সুবলকাকা বিছানা পরিষ্কার করে মাথার বালিশের ওপরে মণিফাল্গুনীবাবুর একটি বড়ো ল্যামিনেটেড ফোটো শুইয়ে রেখেছে।

‘ছবিটা মাসতিনেক আগে আমিই ল্যামিনেট করাই কলকাতা থেকে। তখন কী জানতাম —’ আঁচলে মুখ ঢাকল ওজস্বিতাদি।

ছবিতে বোঝা যাচ্ছে সত্তর বছরেও যথেষ্ট সুপুরুষ ছিলেন মনিফাল্গুনিবাবু। তবে ভাঙা চোয়াল দেখে বোঝা যায় শরীরে ভাঙন ধরেছিল। কারণ দেয়ালে আর একটি ছবি আছে তাঁর, ওজস্বিতাদির মায়ের সঙ্গে। সেটা শুনলাম বছরচারেক আগের। সেটিতে স্বাস্থ্য যথেষ্টই ভালো।

ইন্দ্রদা দ্রুত ঘরের চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছে। খাটের নীচটাও দেখল। নারকোলের কথা মনে হতে আমিও ঝুঁকে দেখে নিলাম। সত্যি, একগাদা ঝুনো নারকোল ডাঁই করে রাখা আছে। বেশ কয়েকটির ছোবড়া ছাড়ানোও দেখলাম।

ইন্দ্রদার নজর আবার চারিদিকে পাক খাচ্ছে। ঘরের এককোণে সেই বিখ্যাত লোহার সেফ। যার কথা আগেই শুনেছি। সেটার চাবি শুনলাম এখন ওমের কাছে। সিন্দুকে রোডসসাহেবের হিরে আছে কিনা কে জানে! সম্ভবত নেই। কারণ কাল রাত্তিরে ভাইবোনে ঝগড়ার এটাই নাকি কারণ ছিল। মানে, যা আমাদের বলল ওজস্বিতাদি।

বিছানার পাশেই বড়োসড়ো একটা রাইটিংটেবিল। তাতে একগাদা বই ম্যাগাজিন পিরিওডিক্যালস অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে আছে। এ ছাড়াও পেন-পেনসিল ডায়েরি স্টেপলার হজমিগুলির বোতল জোয়ানের শিশি এরকম সব জিনিস। ইন্দ্রদা একটা জিনিস হাতে তুলল, কাছে সরে এসে দেখলাম গাম মানে আঠা। টিউবটা বিদেশি মনে হল।

ওজস্বিতাদি বলল, ‘বিদেশে বাবার একজন বন্ধু আছেন। শেখরকাকু। জার্মানিতে থাকেন। মাঝে মাঝে বাবাকে ফরেনমেড টুকিটাকি জিনিসপত্র পার্সেল করেন। ইস, কাকুকে কীভাবে যে বলব! এবার পুজোর সময়ে দেশে আসবেন বলেছিলেন।’

ইন্দ্রদা হঠাৎ বলল, ‘যা ভেবেছিলাম।’

‘কী?’ আমি আর ওজস্বিতাদি দুজনেই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠেছি।

‘কিছু না।’ এড়িয়ে গেল ইন্দ্রদা। ওর হাতে মণিফাল্গুনীবাবুর একটা ডায়রি। অনেকগুলো কাগজপত্র ঘেঁটে এটা সবে হাতে তুলেছে। সেটারই একটা পাতায় চোখ রেখে বলল, ‘উনি ওয়ার্ড-জাগলিং করতে খুব ভালোবাসতেন দেখা যাচ্ছে।’

‘হ্যাঁ। বাবার নেশা ছিল ওটা।’ ওজস্বিতাদি বলল। আমি উঁকি দিয়ে দেখলাম ইন্দ্রদা যে পাতাটা দেখছে তাতে এ বি সি ডি ওয়ান টু থ্রি ফোর এসব হিজিবিজি লেখা।

ইন্দ্রদা ডায়রিটা বন্ধ করে ওজস্বিতাদির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নার্সিংহোমে যে শব্দগুলো লিখেছিলেন উনি আর একবার বল তো।’

‘ও আর ও মৌমাছি, ড্যাশ দিয়ে ইংরেজিতে এক্স এল এক্স এল এম এফ জি।’

ইন্দ্রদা ডায়রির পাতাটা আবার খুলল, মিনিট তিনেক হিজিবিজি অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে ডায়রিটা বন্ধ করল।

‘কিছু ক্লু পেলে?’ ওজস্বিতাদি জিজ্ঞেস করল।

‘তোর দাদার পুরো নামটা কী?’

‘ওঙ্কাররঞ্জন।’

‘মানে O R হতে পারে, ওঙ্কাররঞ্জন। আর O হল ওজস্বিতা। সব তোদের নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর। O-দিয়েই তো লিখিস না কি?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু মৌমাছি আর X L X L M F G ?’ বললাম আমি।

‘এগুলোই তো গোলমেলে। কেবল এম এফ জি-টা মনে হচ্ছে ওজস্বিতার বাবার পুরো নামের ইনিশিয়ালস। মণিফাল্গুনী ঘোষ।’

‘গ্রেট!’ বলল ওজস্বিতাদি, ‘তুমি মনে হচ্ছে এখুনি পাজলটা সলভ করে ফেলবে।’

‘দেখি।’ বলল ইন্দ্রদা, ‘একটা দরকারি কথা, ওনার ওষুধপত্র কোথায় থাকত?’

‘এই টেবিলের ড্রয়ারেই।’

টেবিলের দু-ধারে যে বিশাল-বিশাল দুটি ড্রয়ার রয়েছে লক্ষ করিনি। ওজস্বিতাদি ডানদিকেরটি খুলল। নানারকমের ওষুধ আর প্রেসক্রিপসনে ভরতি সেটা। ইন্দ্রদা খুব মন দিয়ে সব দেখল।

‘প্রেসক্রিপশন তো ঠিকই আছে। লাইফসেভিং ড্রাগ দেওয়াই ছিল। ওষুধ কি ছিল না? স্ট্রোকটা কিন্তু এড়ান যেত তবে। আমার মনে হয় ওষুধটা তিনি পাননি।’

ওজস্বিতাদি কিছু বলল না। ওর মুখটা দেখলাম হঠাৎ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে এল।

আমরা আবার নীচে নেমে এলাম। তার আগে অবশ্য ইন্দ্রদা ছাদটাও একবার দেখে নিল। আমাদের ঘরের ঠিক ওপরের ঘরটা ওজস্বিতাদির। সেঘরটাও ইন্দ্রদা দেখে নিল চট করে। কাল যে এঘরেই ভাইবোনে কথা উত্তপ্ত আলোচনা হচ্ছিল সেটাও ইন্দ্রদা কনফার্ম করে নিল। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল একটুক্ষণ। এ জানালার ঠিক নীচেই আমাদের ঘরের জানালা। বাহারি কচুপাতার ঝোপ ওখানটাতে। এইখানেই কী একটা ঝুপ করে পড়েছিল কাল রাতে। ইন্দ্রদা মনে হয় সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে। কে জানে।

ওজস্বিতাদি একদম চুপ হয়ে গিয়েছে। সেকি আমাদের উপস্থিতি আর পছন্দ করছে না? মণিফাল্গুনীবাবুর মৃত্যুটা কি তবে স্বাভাবিক নয়? জানি না কী। তবে রহস্য আছে। এবং সেরহস্যের দরজায় ইতিমধ্যেই ইন্দ্রদা এসে দাঁড়িয়েছে। কারণ ও নিজেও খুব গম্ভীর হয়ে গিয়েছে।

‘কলকাতায় ফেরার ট্রেন ক-টায়?’ জিজ্ঞেস করল হঠাৎ।

‘সেকি তুমি এখুনি যাবে। অন্তত দুপুরের খাওয়াটা…’ ওজস্বিতাদি বলল। আমার মনে হল খুব একটা ইচ্ছার সঙ্গে কথাটা বলা হল না।

ইন্দ্রদা বলল, ‘না রে। এসময়ে তোদের বেশি ডিস্টার্ব করা উচিত না। পরে আসব একদিন।’

ওজস্বিতাদি এবার একটু অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘না। তা হবে না। এখন সবে সাড়ে-আটটা। ট্রেন তো অনেক আছে। দুপুরে খেয়েই যেতে হবে। আমি সুবলকাকাকে বলে দিচ্ছি।’

ইন্দ্রদা অবশ্য শুনল না। শেষে ঠিক হল জলখাবার খেয়ে আমরা এগারোটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব। ইন্দ্রদা ঘরে ফিরে এসে ওর রাইটিংপ্যাড নিয়ে বসল।

আমাকে বলল, ‘যা বাইরে বাগান-টাগান ঘুরে দ্যাখ।’

বুঝলাম একমনে ভাবতে চায় ও। মানে আমার অনুমান ঠিক। রহস্য আছেই একটা। অন্তত হেঁয়ালির মানেটা উদ্ধার করাও তো বিশাল ব্যাপার।

প্রায় একঘণ্টা এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে এসে দেখি ইন্দ্রদার স্নানটান সব শেষ। একটা চটের বিগ-শপারে গোটাকয়েক নারকোল পুরছে। খালি নারকোলই না। পাকা পেঁপে আর পেয়ারাও রয়েছে গোটাকয়েক। পাশেই সুবলকাকা দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝলাম তিনিই এগুলো সাপ্লাই করেছেন।

বললাম, ‘কী গো তুমি, এখান থেকে এসব বয়ে নিয়ে যাবে নাকি?’

ইন্দ্রদা হেঁ হেঁ করে বিচ্ছিরি বোকাবোকা হাসি দিল একটা। সুবলকাকা বললেন, ‘খোকাবাবু এসব গাছপাকা জিনিস। তোমাদের কলকাতায় মিলবে না। এর স্বাদ-ই আলাদা।’

‘ওজস্বিতাদিকে বলেছ?’

‘সেকি রে, তুই আমাকে কী ভাবছিস।’ বলল ইন্দ্রদা।

সুবলকাকা বললেন, ‘কি যে বলেন খোকাবাবু, ডাক্তারবাবু মুখ ফুটে চেয়েছেন, দিদিমণিই বললেন বেছেবুছে ভালো দেখে দিতে। তা অবিশ্যি উনি নিজে হাতেই বেছেটেছে নিলেন। বাবু নিজেই তো কতগুলো ছুলে রেখেছিলেন। অতিথি খাবেন। আহা, তার আত্মার শান্তি হবে। এ বাড়িতে তো কেউ কিছু খায় না।’

আমি বললাম, ‘দিদিমণি কোথায়?’

‘স্নানে গিয়েছেন। ওই আসছেন, দেখেন।’

পিছন ফিরে দেখি স্নানটান সেরে লালপাড় একটা সাদা শাড়ি পরেছে ওজস্বিতাদি। ফর্সা রঙে খুব সুন্দর লাগছে ওকে। হাতে লুচি বেগুন ভাজার প্লেট।

সুবলকাকা হা হা করে উঠল।

‘তুমি আবার হাত দিলে কেন দিদিমণি?’

‘হাত আর কি দিলাম। সব তো করেই রেখেছিলে। ভেজে নিলাম খালি।’ বলল ওজস্বিতাদি।

ইন্দ্রদা কী রকম যেন হয়েছে আজকে হঠাৎ।

‘থ্যাঙ্ক ইউ!’ বলে খেতে শুরু করে দিল সটান। আমাকেও বলল, ‘খেয়ে নে টুকান। এখুনি বের হব।’

আমার ঠিক এমন আবহাওয়ায় খেতে ইচ্ছে করছিল না। তবু খেলাম। ওজস্বিতাদি ইন্দ্রদার সঙ্গে ডাক্তারিসংক্রান্ত কথাটথা বলতে লাগল।

রেডি হয়ে বেরনোর মুখে ইন্দ্রদা বলল, ‘কথাগুলোর মানে এখনও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারিনি ওজস্বিতা। তবে খুব বেশি সময় লাগবে না। তুই বরং কলকাতায় ফিরে আমার সঙ্গে একবার দেখা করিস। বাড়িতে হলেই ভালো। সলভ হয়ে গেলেই ফোন করব আমি।’

আজ রোববার। আগামীকাল বাবা-মা ফিরবেন। ওজস্বিতাদির বাড়ি থেকে ফিরেছি পুরো দু-সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। নারকোলগুলো কিছু খাওয়া হয়েছে। কিছু বাকি আছে। পেঁপে পেয়ারা সব শেষ। মণিফাল্গুনীবাবুর পারলৌকিক কাজটাজ সব শেষ। ইন্দ্রদা কাল সকালেই ফোন করেছিল আসতে বলেছিল ওকে। মণিফাল্গুনীবাবুর ‘ক্রিপটোগ্রাফ’-এর পাঠোদ্ধার করেছে বলে। বলাবাহুল্য, ওজস্বিতাদি হাজির। এখন সকাল দশটা। ইন্দ্রদার ঘরেই কথা হচ্ছে। অধীর আগ্রহ, একরাশ কৌতূহল নিয়ে আমি আর ওজস্বিতাদি ওর রিডিং টেবিলের সামনে রাখা চেয়ার দুটোতে ভাগাভাগি করে বসেছি। ও বসেছে ওর বিছানায় পা ঝুলিয়ে। না, ইন্দ্রদা আমাকেও কিছু বলেনি। সাসপেন্সে রেখেছে।

‘প্রথমেই বলি রোডসসাহেবের হিরে তুই কখনও নিজের চোখে দেখেছিলি?’ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করল ইন্দ্রদা।

‘হ্যাঁ। খুব ছোটোবেলায়। ক্লাস এইট না নাইনে পড়ি তখন। বাবা হাতে করে দেখিয়েছিল। সুপুরির সাইজের একটা নীলচে পাথর। খুব ব্রাইট। আলো ঠিকরে যায়। ঠাকুরদাকে স্বয়ং সিসিল রোডস দিয়েছিলেন। কেবল দামিই নয়, খুব পয়মন্তও নাকি। বাবা খুব সাবধানে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আর কোনোদিন দেখাননি। ইদানিং দাদা ওটার পিছনে পড়েছিল। তবে বাবা আমায় বলতেন ও হিরে আমি ওম-কে দেব না। বিক্রি করে ফেলবে। হিরে পাবে লিলি। মানে আমি। কিন্তু, সেসময়ই তো পেলেন না।’

‘কথাটা ঠিক।’ বলল ইন্দ্রদা, ‘তবে হীরে যাতে তার মেয়ের কাছে পৌঁছতে পারে তাতে তার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। এবং তার বিশ্বাস ছিল তার বুদ্ধিমতী মেয়ে বাপের সংকেত উদ্ধার করতে পারবে। পারলি না, সেটা তোর ডিসক্রেডিট। অবশ্য একবার দেখেই যে নির্ভুল মনে রাখতে পেরেছিস, এটাও কম ক্রেডিটের না।’

আমরা চুপ। বুকের মধ্যেটা ধকধক করছে।

ইন্দ্রদা বলে চলল, ‘এনিওয়ে, আর কথা বাড়াব না। ও আর ও মৌমাছি-র মানে উদ্ধার করেছি। প্রথমে যা ভেবেছিলাম, তা নয়। মানে ওঙ্কাররঞ্জন আর ওজস্বিতার নামের আদ্যক্ষর নয়। এটা আসলে কেবল তোর একার নাম। গুডনেমটা নয় ডাকনামটা। অর্থাৎ লিলি। কোড ল্যাঙ্গুয়েজে লিখেছিলেন। – OROB। বি-টা হল মৌমাছি। bee-র উচ্চারণটা ব্যবহার করেছিলেন। অর্থাৎ ও আর ও মৌমাছি হল OROB, কিন্তু OROB লিলি হবে কী করে?’

নিজে প্রশ্ন করে থামল ইন্দ্রদা। আমাদের ভ্যাবাচাকা মুখগুলোর ওপরে দৃষ্টি বুলিয়ে রিডিংটেবিল থেকে ওর লুপিন কোম্পানির রাইটিং প্যাডটা বের করল। সেটার একটা পেজমার্ক করা পাতা বের করে ধরল ওজস্বিতাদির সামনে। আমিও সরে এলাম দেখতে। ইংরেজিতে ABCD লেটার্সগুলো পর পর লিখেছে। আর ঠিক নীচেই আবার ZYXW পরপর লিখেছে।

‘এটা হল সেই সিক্রেট রাইটিং লেখার প্রণালী। এবার দ্যাখ, LILY-র করেসপন্ডিং লেটার্সগুলো, এবিসিডির অর্ডারটাকে উলটো করে লিখলে কী হয়, এল হবে ও, আই হবে আর, এল আবার ও, এবং ওয়াই হল বি। অর্থাৎ কিনা লিলি। মানে আমাদের ওজস্বিতা।’

‘আর বাকিগুলো,— XLXLMFG?’ বললাম আমি। অক্ষরগুলো আমারও মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। আসলে আমি নিজেও জট ছাড়ানোর কম চেষ্টা তো করিনি।

‘এটাই আসল কথা। হিরে কোথায় আছে, ওই অক্ষরগুলোতেই তার সংকেত আছে। তবে উনি যদি ওজস্বিতার নাম না লিখতেন, তবে এর মানে আমি ওকে বলতাম না। সেক্ষেত্রে হিরের মালিক কে হত সেঅন্য প্রশ্ন।’

থামল ইন্দ্রদা। টেবিলে রাখা জাগ থেকে একটু জল খেল উঁচু করে।

‘এনিওয়ে। এটা বলার আগে এই জিনিসটা ভালো করে দ্যাখ।’ ওর আলমারি থেকে একটা নারকোল বের করল ইন্দ্রদা। ওজস্বিতাদের বাড়ি থেকে আনা নারকোলগুলোর একটা। মণিফাল্গুনীবাবুই ছোবড়া ছাড়িয়ে ছিলেন। এখনও কিছু কিছু লেগে আছে।

‘এই হল সিসিল জন রোডসের দেওয়া হীরক খন্ড।’ ওজস্বিতাদির হাতে নারকোলটা ধরিয়ে বলল ইন্দ্রদা।

‘মানে… আমি কিছু…’ নারকোলটা বারকয়েক কানের কাছে নাড়িয়ে বলল ওজস্বিতাদি।

‘বলছি।’ বলে নারকোলটা নিজের হাতে নিল ইন্দ্রদা। ‘দুর্দান্ত বুদ্ধি করেছিলেন মণিফাল্গুনীবাবু। একটু রিস্কি ছিল ঠিকই। তবু প্রশংসা না করলে মহা অন্যায়। বাউণ্ডুলে ছেলের হাত থেকে হিরে বাঁচানোর আর কোনো উপায় খুঁজে পাননি তিনি।  XLXLMFG লেখাগুলো কী নির্দেশ করছে আর কী বলার দরকার আছে আমার?’

সত্যি দরকার ছিল না। যেভাবে লিলি লেখা হয়েছে, সেভাবেই XLXLMFG হবে COCONUT। অর্থাৎ কিনা কোকোনাট। মানে নারকোল।

ওজস্বিতাদিও বুঝেছে। ওর মুখেও বিস্ময়ের রেখা।

ইন্দ্রদা এবার নারকোলটা টেবিলে আলতো করে ঠুকতেই দু-টুকরো হয়ে গেল। জল নেই। ভিতরে কাগজে ঠাসা। সেগুলো খুলতে যা বের হল তাতে এবার আমাদের তিনজনের তিনজোড়া চোখই ধাঁধিয়ে গেল।

একটি মার্বেল-সাইজের ঝলমলে নীলরঙা পাথর। ঘরের মধ্যেও তা থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে।

‘তু… তুমি কি করে বুঝলে…’ উত্তেজনায় মুখের কথা আটকে যাচ্ছে ওজস্বিতার।

‘সিম্পল। নাকের কাছে নে। বিদেশি আঠার গন্ধ পাবি। খুব সিম্পল ব্যাপার। নারকোল কেটে তার মধ্যে হিরে পুরে আবার আঠা দিয়ে নিখুঁতভাবে জুড়ে দিয়েছিলেন মালাদুটো। টেবিলের ওপর গ্লু-য়ের টিউব দেখে একটা ক্ষীণ সন্দেহ উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছিল। নীচে এসে হেঁয়ালিটা সলভ করে ফেলতেই নিশ্চিন্ত হলাম। এতটাই নিশ্চিন্ত যে একদম তোদের সামনেই নারকোলটা ফাটালাম। অবশ্য অন্য যে গুলোতে আঠার গন্ধ পাইনি, সেগুলোতো আগেই ফাটিয়ে খেয়ে ফেলেছি।’

‘ইন্দ্রদা, ইটজ সপ্লেনডিড। ইউ আর রিঅ্যালি জিনিয়াস।’ বলল ওজস্বিতাদি। ‘তবে একসঙ্গে আট-দশটা নারকোল ছুলতে গেল কেন বাবা?’

‘এটার কারণ যাতে কেউ সন্দেহ না করে। মানে বাড়ির লোককে দেখানো রেগে গিয়ে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছি আমি। এমন অভ্যেস তো তার ছিলই।’

আমার মনে হল। যাই হোক, এই মুহূর্তে যা আনন্দ হচ্ছে, বলার না। দুর্ধর্ষ বুদ্ধি বটে ইন্দ্রদার। সেদিনই বুঝে গেছিল!

‘তবে একটা কথা। যেটা না বললেই নয়।’ গলাটা হঠাৎই গম্ভীর করে বলল ইন্দ্রদা।

‘কী?’ ওজস্বিতাদি একটু ঘাবড়ে গিয়েছে।

‘মণিফাল্গুনীবাবুর মৃত্যুটাকে একেবারে স্বাভাবিক বলা যাচ্ছে না। এবং সেটা তুই নিজেও জানিস। এতে তোর হয়তো কোনো ভূমিকা নেই। তবে সত্যি গোপন করাটাও একটা অপরাধ কিন্তু।’

ওজস্বিতাদির মুখ ব্লটিংপেপারের মতো সাদা।

ইন্দ্রদা বলে চলল, ‘তুই ভালো করেই জানিস ঠিক সময়ে লাইফসেভিং ওষুধটা জিভের তলায় রাখলে উনি হয়তো বেঁচেও যেতে পারতেন। কিন্তু ওষুধটা পাননি তিনি। পাবেন কী করে, বাপের সঙ্গে রাগারাগি করে ওষুধের শিশি তো ওম ওঁর ড্রয়ার থেকে সরিয়ে ফেলেছে। আসলে একঘণ্টা ধরে ঘর বন্ধ রাখায় সেভেবেছিল বাবা নতুন উইল লিখতে বসেছে। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে এক ফাঁকে ড্রয়ার থেকে ওষুধটা সরিয়ে ফেলে সে। এবং ডাক্তারি বুদ্ধিতে আমার যেভাবে সন্দেহটা হয়, সেভাবে তোর নিজেরও হয়েছিল। শেষে দাদার ঘরে গিয়ে ওষুধের শিশিটা তুই খুঁজে পাস। দাহকার্য শেষ করে বাড়ি ফিরে ওম সেটার আঁচ পায়। তোর ঘরে আসে। একচোট ঝগড়া হয়। এবং সম্ভবত তখনই তোর হাত থেকে ওষুধের শিশিটা নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ঘটনাক্রমে টুকান সেই ছোট্ট শব্দটা শুনতে পায়। আর পরদিন সকালে আমি নিজেই সেই শিশিটা খুঁজে পাই। ক্রাইম বললে ভেরি সিলি কেস। ক্রুয়েলটির কথা বললে ন্যক্কারজনক। পরদিন সকালে ওম হয়তো সেটাই খুঁজতে এসেছিল। কিন্তু তার আগেই সেটা আমার হাতে এসে গেছিল। এই সেই শিশি।’

ইন্দ্রদা ওর জিনসের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোটো কাচের শিশি টেবিলের ওপরে রাখল। ওজস্বিতা তাকাল না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

‘কী করব বল? বাবা তো চলেই গেছেন। দাদাকে হারাতে সাহস পেলাম না। মাঝরাতে সেএসে আমার পায়ে পড়ল। ক্ষমা চাইল। রাগের মাথাতে ভুলটা করে ফেলেছে। ঝগড়াঝাঁটি প্রায় রোজই করত। কিন্তু সত্যি যে বাবার আবার স্ট্রোক হতে পারে, তা নাকি ও ভাবতেই পারেনি! তাই যখন দিব্যি করে বলল সত্যি সত্যি এবার নিজেকে শুধরে নেবে, তখন আর কী বলি!’

আমার হঠাৎ মনে হল মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে যে কান্নাকাটির আওয়াজটা পাচ্ছিলাম, সেটা তবে স্বপ্ন নয়, সত্যি!

পরে ইন্দ্রদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ওম কি শুধরোতে পারবে নিজেকে?’

ইন্দ্রদা বলল, ‘নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে ও স্বভাবটাই ওরকম করে ফেলেছে। এটা কিন্তু আমাদের অনেকের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে আজকাল। গুরুজনদের মিনিমাম সম্মানটুকুও করি না আমরা—ওম হয়তো পালটাতেও পারে। একেবারে ইনকরিজিবল হয়তো হয়নি সে। যাই করুক, বাপকে পুরোপুরি অমান্য করত না কিন্তু। মনে রাখিস মণিফালগুনীবাবুর কোমরে সিন্দুকের চাবি বাঁধা থাকত। কখনও গায়ের জোরে কেড়ে নেয়নি সে। দেখা যাক কী হয়। লেটস হোপ ফর দ্য বেস্ট।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *