রোগী কাহিনী
বাংলা ভাষায় দুটি শব্দ আছে, রোগ এবং অসুখ। রোগের মানে হল অসুস্থতা আর সুখের অভাব হল অসুখ। এই অসুখ শব্দটি খুব চমৎকার। আমরা রোগ হয়েছে একথা বলতে গিয়ে বলি, ‘আমার অসুখ হয়েছে’, অর্থাৎ ‘আমি অসুস্থ হয়েছি।’
কিন্তু অন্য দিকে কেউ যদি কখনও বলে, ‘আমি অসুখী’, তার মানে এই নয় যে তার রোগ হয়েছে, সে রোগী, তার জন্যে ডাক্তার ডাকতে হবে বা ওষুধ আনতে হবে।
সুখ-অসুখের ব্যাকরণ নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে বরং সরাসরি রোগী কাহিনীতে প্রবেশ করি।
রোগ, রোগী ও চিকিৎসক নিয়ে গল্পের শেষ নেই। ডাক্তার আর রোগী, চিকিৎসা ও অচিকিৎসা এই সব নিয়ে হাজার হাজার মজার গল্প। শুধু অসুখ বা ডাক্তার বা নার্স নিয়ে বিলিতি জোকবুকের সংখ্যাও কম নয়।
সব চেয়ে বড় কথা, এই সুপ্রাচীন বিষয়ে আমি নিজেও আবার অবসরে অল্প-বিস্তর লিখেছি। বাংলা ভাষায় পরশুরাম কিংবা শিবরাম, এমনকী বাংলা রসিকতার পিতামহ ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত অসুখ ও চিকিৎসা নিয়ে অত্যন্ত সব সরস রচনা উপহার দিয়ে গেছেন। সুতরাং আমি হয়তো খুব অনধিকার চর্চা করছি না, তবে এঁদের নামের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার ঔদ্ধত্যের অপরাধে যদি কোনও কুটিল পাঠক আমাকে অপরাধী সাব্যস্ত করেন, সে বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।
সে যা হোক, খুব বেশি পুরনো নয় আবার খুব বেশি পরিচিতও নয় এমন একটা তরল কাহিনী দিয়ে শুরু করছি। ডাক্তারি শিক্ষা দিয়েই আরম্ভ করা যাক।
কল্পিত ডাক্তারি ক্লাসে অধ্যাপক-চিকিৎসক ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, মনে করো, তোমাদের মধ্যে কারও কাছে একজন রোগী এসেছেন, তাঁকে দেখে ঠিক অসুস্থ মনে হচ্ছে না। তিনি অনেক রকম রোগবালাই উপসর্গের কথা বললেন। কিন্তু তুমি যথেষ্ট পরিমাণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মল-মূত্র, রক্ত-থুতু, শর্করা-রক্তচাপ ইত্যাদি গবেষণা করেও কোনও অসুখ ধরতে পারলে না। তোমার সন্দেহ হল রোগীর কোনও অসুখই হয়নি, এটা একেবারে মনের বাতিক। তখন তুমি কী করবে?’
একে একে সব ছাত্রই জবাব দিল, ‘ওঁকে মাথার ডাক্তারের কাছে পাঠাব। ওঁর চিকিৎসা করতে হবে মনোসমীক্ষা দিয়ে।’
শুধু একটি চতুর ছাত্র বলল, ‘তা করব কেন? আমি তাঁকে ওষুধ দেব, এমন ওষুধ যা খেয়ে তিনি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তখন আমি তাঁকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলব।’
শুনে অধ্যাপক মোহিত হয়ে গেলেন, বললেন, ‘আশ্চর্য! সাধু, সাধ! তুমি ক্লাসে বসে অযথা কী সময় নষ্ট করছ। তুমি সোজা প্র্যাকটিস করতে চলে যাও। তোমার হবে।’
এর চেয়ে মারাত্মক গল্প ডাক্তার বিধানচন্দ্রের ঘাড়ে চাপানো আছে। মহাপুরুষদের নামে অনেক অলৌকিক এবং ততোধিক অমূলক গল্প চলে। খুব সম্ভব এ গল্পটাও তাই।
প্রবাদপ্রতিম সেই মহাচিকিৎসক নাকি একবার তাঁর পরিচিত এক স্নেহভাজনকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘তোমার শরীর খারাপ হলে তুমি অবশ্যই ডাক্তার দেখাবে, ভিজিট দিয়ে ডাক্তার দেখাবে, কারণ ডাক্তারবাবুকে তো বাঁচতে হবে। তারপর ডাক্তারবাবু নিশ্চয় তোমার মল-মূত্র-রক্ত, এক্স-রে, ই-সি-জি এসব করতে বলবেন; এসবও করবে, তুমি নিশ্চয় এসব করাবে কারণ এসব যাঁরা করেন তাঁদেরও তো বাঁচতে হবে। তারপর তোমার ডাক্তারবাবু সব দেখেশুনে অনেক মাথা ঘামিয়ে তোমাকে অনেক ওষুধ দেবেন। তুমি অবশ্য-অবশ্য সেসব ওষুধ কিনবে, কারণ এসব ওষুধ যাঁরা বানান, যাঁরা বেচেন, তাঁদের তো পয়সা চাই, তাঁদের তো বাঁচতে হবে।’
‘আর তারপর?’ এবার একটু গম্ভীর হয়ে মহামহিম ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় শ্রীমান স্নেহভাজনের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন, তারপর গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, ‘তুমি ওসব ওষুধ মোটেই খাবে না। কারণ তোমাকেও নিশ্চয় বাঁচতে হবে।’
প্রায় এই গল্পই, একটু অন্য কায়দায় সেটা উপস্থাপন করা, একটা পুরনো ডাক্তারি জোকবুকে আমি পেয়েছি। সে বইটি পেটেন্ট-পূর্ব ড্রাগিস্ট অ্যান্ড কেমিস্টের যুগের, যখন প্রেসক্রিপশন মানেই দাগান্বিত শিশি। যার গায়ে লেখা, ‘খাইবার পূর্বে ঝঁকাইবেন।’
এবং/ অথবা ‘ছিপি শক্ত করিয়া বন্ধ রাখিবেন।’
যা হোক, ওই পেটেন্ট-পূর্ব যুগের গল্পে ডাক্তারবাবু তাঁর রোগীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনাকে অনেক ভাল দেখছি আজ, যা যা বলেছি সব ঠিকঠাক করে যাচ্ছেন?’
রোগী হেসে বলল, ‘হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, যা যা বলেছেন সব ঠিকঠাক করে যাচ্ছি।’ হঠাৎ ডাক্তারবাবুর রোগীর বিছানার পাশের টেবিলের ওপরে নজর পড়ল। সেখানে ওষুধের শিশি অক্ষত, অটুট রয়েছে। বিস্মিত ডাক্তারবাবু বললেন, ‘কয় শিশি ওষুধ কিনেছিলেন?’
রোগী শিশির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কেন, ওই এক শিশিই তো যথেষ্ট?
বিমূঢ় ডাক্তারবাবু একটি অতি ক্ষীণ প্রশ্ন করলেন, ‘তবে?’
সরল রোগী বললেন, ‘তবে আবার কী? আপনিই তো বলে দিয়েছেন, ছিপি শক্ত করে বন্ধ রাখতে।’
ওষুধের শিশির গায়ের দ্বিতীয় নির্দেশটির গল্প প্রথমে চলে এল। প্রথম নির্দেশটি আরও স্পষ্ট, ‘খাইবার পূর্বে ঝাঁকিবেন।’
এ বিষয়ে প্রচলিত গল্পটি অতি রদ্দি। শুধু লিখে রাখার জন্যে লিখছি। কোথাকার কে এক রোগী নাকি ওষুধ খাওয়ার সময়ে শিশি ঝাঁকানোর কথা খেয়াল করেনি। তার পরে ওষুধ পান করে শিশি নামাতে গিয়ে উক্ত নির্দেশটি তার দৃষ্টিতে আসে। তখন তো আর ওষুধের শিশি ঝাঁকিয়ে কোনও লাভ নেই, তাই তিনি নিজের বাড়ির বাইরের বাগানে লাফাচ্ছিলেন পেটের মধ্যে ঢুকে যাওয়া ওষুধটাকে ঝাঁকানোর জন্যে।
এতগুলি অস্বাভাবিক কাহিনী লেখার পরে এবার অন্তত একটা স্বাভাবিক কাহিনী লিখতে হয়। এক সার্জনের কাছে এক রোগী তাঁর অসুখের ব্যাপারে পরামর্শের জন্য যান। রোগীটিকে যথাবিহিত পরীক্ষার পরে সার্জন সাহেব বললেন, ‘অপারেশন ছাড়া গতি নেই।’
কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে তারপর রোগী বললেন, ‘স্যার, আমার এই অপারেশনে কত খরচা হবে?’
সার্জন সাহেব জবাব দিলেন, ‘তা আট-দশ হাজার টাকা লাগবে মোটামুটি।’
আট-দশ হাজার টাকা কম টাকা নয়, রোগী মাথায় হাত দিলেন, তারপর বললেন, ‘এ তো অনেক টাকার ব্যাপার। আমার তো এখন অত টাকা নেই।’
সার্জন সাহেব দেখলেন রোগী পালাতে পারে, তিনি নরম করে বললেন, ‘না পারলে একবারে সব টাকা দেবেন না, ধীরেসুস্থে দেবেন।’
রোগী এবার একটু আশ্বস্ত বোধ করলেন, একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘ধীরে-সুস্থে কীরকম?’
ডাক্তার বললেন, ‘এই দরুন, এখন হাজার তিনেক টাকা দিলেন। তারপর মাসে মাসে এই পাঁচশো করে এক বছর।’
রোগী বললেন, ‘আমার শালা ইনস্টলমেন্টে কালার টিভি কিনেছে, সেটার কিস্তিটা যেন অনেকটা এইরকম।ֹ’
সার্জেন সাহেব একটু গম্ভীর হলেন, রুমালে মুখ মুছে বললেন, ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমি সত্যিই কিস্তিতে একটা রঙিন টিভি কিনছি।’
রোগী কাহিনী যখন শেষ পর্যন্ত কালার টিভি পর্যন্ত গড়াল, তাহলে অবশেষে আমরা সেই পুরনো রোগীটিকে আরেকবার স্মরণ করি।
সে এক মহাভিতু রোগী, সব সময়ে নিজের রোগ নিয়ে মাথা ঘামায়, একের পর এক ডাক্তার দেখিয়ে যায়।
একদিন সে এক ডাক্তারবাবুকে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আমি অসুখ নিয়ে চিন্তা করতে করতে পাগল হয়ে গেলাম। একেক সময় মনে হয় নিজেকে খুন করে ফেলি।’
ডাক্তারবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘দয়া করে এ ব্যাপারটা আমার উপরে ছেড়ে দিন।’
রোগী কাহিনীর শেষ গল্পে ডাক্তারবাবুই বলতে গেলে রোগী। তিনি তাঁর নতুন মডেলের হালফ্যাশনের গাড়ি কেনার পরেই খারাপ হয়ে যাওয়ায় গ্যারেজে সারাতে দিয়েছেন। সারানোর পর মিস্ত্রি যা বিল করলেন সেটা আগের পুরনো গাড়ির দ্বিগুণ। ডাক্তারবাবু কপালে চোখ তুলে বললেন, ‘এত?’
সুরসিক মিস্ত্রি বললেন, ‘দেখুন ডাক্তারবাবু, আমাদের কাজ তো আর আপনাদের মতো নয়, সেই আদ্যিকালের পুরনো চেনা মডেল নিয়ে আপনাদের কারবার। আর আমাদের দিন-দিন নতুন মডেল, নতুন ঝামেলা। পয়সা তো কিছু বেশি লাগবেই।’