রেল-ডাকাতি নিরোধের অব্যর্থ উপায়
পূর্ব রেলের হাওড়া ও শিয়ালদহ ডিভিশনে ঘন ঘন যে-সব ট্রেন ডাকাতি হচ্ছে, তা নির্মূল করার জন্য রেল কর্তৃপক্ষ অবশেষে অব্যর্থ এক উপায় বের করেছেন।
পূর্ব রেলের ঘনিষ্ঠ মহলের ধারণা, রেল-ডাকাতি নিরোধকল্পে তাঁরা যে উপায়টি বের করেছেন, এটা এমনই অব্যর্থ যে কালক্রমে সব রেলই অর্থাৎ বিশ্বে যে-যে রেলে ডাকাতি হয় তাঁরা সবাই নিজ নিজ এলাকায় রেল-ডাকাতি নির্মূল করার জন্য পূর্ব রেল আবিষ্কৃত পদ্ধতিটি প্রয়োগ করতে বাধ্য হবেন।
আন্তর্জাতিক রেল সম্মেলনে, পূর্ব রেলের ঘনিষ্ঠ মহলের জনৈক মুখপাত্র জানালেন, আমাদের আবিষ্কৃত রেল-ডাকাতি নিরোধক এই পদ্ধতিটি নিয়ে দুই দিনব্যাপী আলোচনা হয়। অবশেষে এই বিষয়ে সকলেই একমত হন যে, রেল-ডাকাতির মতো জটিল এক সমস্যার সমাধানে এই পদ্ধতিটি ফল দিতে পারে। তাই আন্তর্জাতিক রেল সম্মেলন পরীক্ষামূলকভাবে এই পদ্ধতিটি প্রয়োগ করার জন্য পূর্ব রেলের হাওড়া এবং শিয়ালদহ এই দুটি ডিভিশনকেই বেছে নিয়েছেন।
পৃথিবীর এত জায়গা থাকতে রেল-ডাকাতি নিরোধের জন্য নতুন পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্র হিসাবে পূর্ব রেলের হাওড়া এবং শিয়ালদহ এই দুইটি ডিভিশনকেই বা বেছে নেওয়া হল কেন? বিশ্বের আর কোনও রেলে কি ডাকাতি হয় না? সাংবাদিকদের এই সকল প্রশ্নের উত্তরে আন্তর্জাতিক রেল সম্মেলনের মুখপাত্র জানান, মুখ্যত দুটি কারণে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যথা : (এক) চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম, আমাদের এই নীতি অনুসারে আবিষ্কর্তাকেই তাঁর পদ্ধতি প্রয়োগের প্রথম সুযোগ দেওয়া উচিত। এবং (দুই) পূর্ব রেলের রেল-ডাকাতির নেচার একেবারে আলাদা। তার সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোনও রেল-ডাকাতির তুলনা করা চলবে না। ইন্ ফ্যাকট্, পূর্ব রেলে যে-সব ডাকাতি বলা যায় কি না, সেটা বিবেচনা করার জন্য আন্তর্জাতিক রেল সম্মেলনের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক আইনবিদ সম্মেলনকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। পূর্ব রেলের রেল-ডাকাতির সমস্যা শুধু ডাকাতির সমস্যা নয় মশাই, সমস্যা তার থেকেও জটিল।
আন্তর্জাতিক আইনবিদ সম্মেলনের মুখপাত্র স্বীকার করেন যে, তাঁরা এই কেস পেয়েছেন। এবং পূর্ব রেলের ঘটনাগুলোকে ডাকাতির ঘটনা বলা যাবে কি না, এই নিয়ে আইনবিদ সম্মেলনের সদস্যদের মধ্যে গুরুতর মতভেদ দেখা দিয়েছে। বামপন্থী সদস্যরা রায় দিয়েছেন, এগুলো সাধারণ ডাকাতির কেস নয়, সাধারণ ডাকাতরা লুটপাট করে সরে পড়ে। তাদের মুখে সমাজ পরিবর্তনের কথা কখনোই শোনা যায়নি।
অথচ দেখুন আন্তর্জাতিক আইনবিদ সম্মেলনের বামপন্থী মুখপাত্র জানালেন সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে, এই সব তথাকথিত ডাকাতেরা ট্রেনযাত্রীদের যথাসর্বস্ব লুট করে তক্ষুনি পালিয়ে যায়নি, তারা দেশাত্মবোধক এবং সমাজ-সচেতক ভাষণও দিয়েছে। এই দেখুন, জনৈক যাত্রী জানাচ্ছেন, জমি বিক্রি করে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে আমি কলকাতায় যাচ্ছিলাম মেয়ের বিয়ের বাজার করতে। ওই ছিল আমার শেষ সম্বল। ওরা আমার সর্বস্ব লুট করে নিল। তারপর যখন নিশ্চিন্ত হল যে আমার কাছে আর এক কানাকড়িও নেই তখন ওদের দলপতি এক ভাষণ দিল। সেই ভাষণ এই রকম : বন্ধুগণ, ও মা মাসি বোনেরা! আমরা আপনাদের সর্বস্ব লুট করলাম বটে, তা বলে ভাববেন না আমরা আপনাদের শত্রু। আসলে আমরা শিক্ষিত বেকার, আমরা সব গ্রেজুয়েট বাঙালি। আপনাদের এই যে সব গেল, এর জন্য আমরা দায়ী ভাবছেন? আদৌ নয়। আজকের সমাজ ব্যবস্থাই দায়ী। আপনারা যদি আপনাদের সব কিছু বাঁচাতে চান, তবে আসুন আপনারা এবং আমরা মিলে এই সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলি, বদলে ফেলি। আর দেখুন, একটু আগে আপনাদের টাকা-কড়ি গহনা ঘড়ি সবই ছিল। তখন আপনারা ছিলেন কায়েমি স্বার্থের প্রতিভূ। এখন আপনারা সর্বহারা। তাই আমাদের দলে। আমাদের নীতি হচ্ছে বড়লোক মেরে গরিবকে বাঁচাও। এখন আপনি গরিব, তাই আমরা এখন আপনার দিকে। এই নিন, একটা টাকা নিন, কিছু কিনেটিনে খাবেন। এই বলে ডাকাত দলের নেতা আমাকে একটা টাকা এবং ওই কামরায় আরও যাঁদের লুট করেছিল তাঁদের সবাইকে কিছু কিছু দিয়ে নেমে পড়ল।
এখন বলুন, বামপন্থী মুখপাত্র বললেন, এদের ডাকাত বলবেন?
রেল পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, এই প্রশ্ন তাঁদেরও। মশাই এমন প্রগতিশীল যাঁদের কথাবার্তা রেল পুলিশের ঘনিষ্ঠ মহল বললেন, কদিন পরে তাঁরা তো মশাই মিনিস্টার হবেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ৩৯৫ ধারা (ডাকাতি) দিয়ে কি ভবিষ্যৎ খোয়াব? তাই পারতপক্ষে আমরা কেস লিখাই না। কিন্তু মাঝে মাঝে ত্যাঁদড় পাবলিকও দু এক জন জুটে যায়। ডাকাতের হাতে সর্বস্ব খুইয়েও তাঁদের শিক্ষে হয় না, জানেনা? আমাদের কাছে রগড়ানি না খাওয়া পর্যন্ত বাবুদের ত্যাঁদড়ামি যায় না। বলে কেস লেখাও। এঃ, আমরা যেন ওর তালুকে চাকরি করি! যাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে— কত বলি, ডাকাতের হাতে পড়া তবু ভালো, কিন্তু পুলিশের হাতে পড়েছেন কি, হয়রানির শেষ থাকবে না— ফেরাতে কিছুতেই পারিনে, তার কেস খাতায় লিখতেই হয়। তবে এসব ক্ষেত্রে আমরা বেশিরভাগই ৩৮১ ধারা (ছিনতাই) করে দিই। যাতে আইনও বাঁচে আবার ডাকাত ভাইয়েরাও বেশি সাজা না পেয়ে তাঁদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা বজায় রাখতে পারে।
পূর্ব রেলের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানালেন, আমরা রেল-ডাকাতি নিরোধের যে অব্যর্থ পন্থা আবিষ্কার করেছি তাতে পুলিশ ফুলিশ কারোরই আর দরকার হবে না। পুলিশের অসুবিধা আমরা সমবেদনার চোখেই দেখি। আফটার অল আমরা সবাই তো গভর্নমেন্ট সারভেন্ট।
ব্যাপারটা আপনাকে বুঝিয়ে বলি। তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে আমার কাছে তাঁর মনটা মেলে ধরলেন। আমার মতে তিনি বললেন ডাকাতও নয় পুলিশও নয় এই নাটকের খল নায়ক হচ্ছে রেলযাত্রীরাই। ওরাই আসল অপরাধী।
বলেন কি! আমি চমকে উঠি।
তিনি বললেন, অফকোর্স। রেল যাত্রীদের লুট করতেই রেল-ডাকাতরা আসে। নয়, কি?
আমি বললাম, অবশ্যই।
তিনি বললেন, তাহলেই বুঝে দেখুন। আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ল্যাবাকান্ত যাত্রীদের জন্যই রেল-ডাকাতি বাড়ছে এবং রেলের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। আমাদের আবিষ্কারটা এই সিদ্ধান্তের উপরই দাঁড়িয়ে আছে। তাই আমরা ঠিক করেছি, কোয়ালিফায়েড যাত্রী ছাড়া কাউকে আর রেল ভ্রমণ করতেই দেওয়া হবে না। যে পুরুষ অথবা রমণী যুযুৎসু, জুডো এবং কারাটি বিদ্যায় পারদর্শিতা দেখাতে পারবেন, কেবলমাত্র তাঁকেই কোয়ালিফায়েড যাত্রী বলে রেল কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে নেবেন। এইসব বিদ্যা জানা দলকে কাবু করা সম্ভব হবে। এবং রেলও ধীরে ধীরে ডাকাতি শূন্য হয়ে উঠবে। এবং প্রকৃত কোয়ালিফায়েড যাত্রীরাই যাতে রেলের টিকিট কিনতে পারেন সেইজন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন যুযুৎসু, জুডো এবং কারাটি বিদ্যা বিশারদগণকে রেলে চাকরি দিয়ে দিয়ে টিকিট কাউন্টারের সামনে মোতায়েন করে রাখা হবে। যে যাত্রী তিনি পুরুষ বা রমণী যেই হোন তাঁদের পরাস্ত করতে পারবেন একমাত্র তাঁকেই টিকিট বেচা হবে।
ভবিষ্যতের রেল ভ্রমণকে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত করবার মোক্ষম পন্থা যে একমাত্র এইটাই পূর্ব রেলের ঘনিষ্ঠসূত্র জানালেন এবং একেবারে ত্রুটিহীন আশা করি সে কথা স্বীকার করবেন।
ভদ্রলোকের সঙ্গে একমত আমাকে হতেই হল।
৩০ জানুয়ারি ১৯৭৪