আমরা মনে করি, বিশ্বাসের উপর কিছুমাত্র নির্ভর না করিয়া কেবলমাত্র যুক্তির হাত ধরিয়া আমরা জ্ঞানের পথে চলিতে পারি। অনেক ন্যয়রত্ন এই বলিয়া গর্ব করেন যে– সমস্ত জীবনে তাঁহারা যত কাজ করিয়াছেন, তাহাতে বিশ্বাসের কোনো হাত নাই। ইঁহারা ইহা বুঝেন না যে, বিশ্বাস না থাকিলে যুক্তি এক দণ্ড টিকিয়া থাকিতে পারে না। যুক্তিকে বিশ্বাস করি বলিয়াই তাহার এত জোর, নহিলে সে কোথাকার কে? যুক্তিকে কেন বিশ্বাস করি, তাহার একটা যুক্তি কেহ দেখাইতে পারে? কেহই না। অতএব দেখা যাইতেছে যুক্তির উপর আমাদের একটা যুক্তিহীন বিশ্বাস, অন্ধ বিশ্বাস আছে। আমরা দৃশ্যমান পদার্থকে বিশ্বাস করি কোন্ যুক্তি অনুসারে? স্পৃশ্যমান বস্তুর উপরে অটল বিশ্বাস স্থাপন করি কোন্ যুক্তি অনুসারে? তথাপি আমাদের বিশ্বাস, যুক্তিই সর্বেসর্বা, বিশ্বাস কেহই নয়। ইহা হইতে একটা তুলনা আমার মনে পড়িতেছে। যুক্তি হচ্ছে, স্টিম-এঞ্জিন, আর বিশ্বাস হচ্ছে রেলের রাস্তা। বিশ্বসুদ্ধ লোকের নজর এঞ্জিনের উপরে; সকলে বলিতেছে– “বাহবা, কী কল বাহির হইয়াছে। অত বড়ো গাড়িটাকে অবাধে টানিয়া লইয়া যাইতেছে।’ নীচে যে একটা রেল পাতা রহিয়াছে, ইহা কাহারো চোখে পড়ে না, মনেও থাকে না। বিশ্বাসের রেলের উপর একটা বাধা স্থাপন করো, একটা গাছের গুঁড়ি ফেলিয়া রাখো, অমনি গাড়ি থামিয়া যায়; দুটি ক্ষুদ্র নুড়ি রাখিয়া দেয়, অমনি গাড়ি উল্টাইয়া পড়ে, ইহা কেহ মনে ভাবিয়া দেখে না কেন? যেখানে বিশ্বাসের রেল, সেইখানেই যুক্তির গাড়ি চলে, যে রাস্তায় রেল পাতা নাই, সে রাস্তায় চলে না, ইহা কাহারো মনে হয় না কেন? তাহার কারণ আর-কিছু নয়; স্টিম-এঞ্জিনটা বিষম শব্দ করে, তাহার একটা সারথি আছে, তাহার শরীর প্রকাণ্ড, তাহার মধ্যে কত-কী কল উঠিতেছে, পড়িতেছে, এগোইতেছে, পিছাইতেছে; তাহার চোখ দিয়া আলো, নাক দিয়া ধোঁয়া বাহির হইতেছে, পদভরে মেদিনী কম্পমান। আর, রেল কত দিন হইতে পাতা রহিয়াছে, কে পাতিয়াছে, তাহার ঠিকানা নাই; অধিক শব্দ করে না, বরঞ্চ শব্দ নিবারণ করে; নিঃশব্দে রাস্তা দেখাইয়া দেয়, বহন করিয়া লইয়া যায়। সে পথ, সে বিঘ্ন-অপহারক সে ধ্রুব,নিশ্চল, পুরাতন, ভারবহ। সে কাহারো নজরে পড়ে না; আর,একটা ধূমন্ত, ফুঁসন্ত, জ্বলন্ত, চলন্ত পদার্থকে সকলে সর্বেসর্বা বলিয়া দেখে।
রেলের গাড়ির তুলনা যদি উঠিলে, তবে ও বিষয়ে যত কথা উঠিতে পারে, উঠানো যাক। সাহিত্যের রেল গাড়িতে ভাবগণ বা ভাবুকগণ আরোহী। যশের এঞ্জিনে কালের রাস্তায় চলিতেছে। যে যত মূল্য দিয়াছে, সে তত উচ্চ-শ্রেণীতে স্থান পাইয়াছে, কেহ ফার্স্ট ক্লাসে, কেহ সেকেণ্ড ক্লাসে, কেহ থার্ড ক্লাসে। যে যত মূল্য দিয়াছে, সে সেই পরিমাণে দূরে যাইতে পারিবে। কোন্ কালে বাল্মীকি ফার্স্ট ক্লাসে টিকিট লইয়া গাড়িতে চড়িয়াছেন, এখনও পর্যন্ত তাঁহার স্টেশন ফুরায় নাই। আমাদের ক্ষীণ দৃষ্টি যতদূর চালনা করিয়া কিয়ৎ পরিমাণে অলংকার দিয়া এইরূপ বলিতে পারি যে, যেখানে কালের Terminus– যাহার ঊর্ধ্বে আর স্টেশন নাই, যে স্টেশনে চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র আসিয়া থামিবে, সেই স্টেশনে যাইবার টিকিট তিনি ক্রয় করিয়াছেন। গাড়ির গার্ড পাঠক সম্প্রদায়, সমালোচক। ইঁহারা যে নিজের কাজ যথেষ্ট মনোযোগ দিয়া করেন না, তাহা সকলেই জানেন। আরোহীদের প্রতি সর্বদাই বিশেষ অন্যায় ব্যবহার করিয়া থাকেন। কত শত ভাব তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট কিনিয়া গোলমালে প্রথম শ্রেণীতে উঠিয়া পড়ে; সকলেই তাহাকে খাতির করে, সেলাম করে, অভ্যর্থনা করে। এমন দু-এক স্টেশনে গিয়া কেহ কেহ ধরা পড়ে, গার্ড তৎক্ষণাৎ তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া বাহির করে, তাহার যথোপযুক্ত গাড়িতে উঠাইয়া দেয়; কেহ কেহ এমন কত স্টেশন পার হইয়া যায় কেহ খোঁজ লয় না। ইহা তো কেবলমাত্র অমনোযোগিতা, কিন্তু গার্ডেরা ইহা অপেক্ষাও অন্যায় কাজ করিয়া থাকেন। আলাপ থাকিলে, বন্ধুতা থাকিলে অনেক থার্ড ক্লাসকে ফার্স্ট ক্লাসে চড়াইয়া দেন। এমন সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়, নালিশ করি কাহার কাছে? যিনি দোষী, তিনিই বিচারক। কত শত মুখচোরা, ভীরুস্বভাব, সংকোচ-পরায়ণ বেচারি ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কিনিয়া, ভিড়ে, গোলেমালে, ঠেলাঠেলিতে শশব্যস্ত হইয়া থার্ড ক্লাসে উঠিয়া পড়েন, কত শত স্টেশন পার হইয়া সহসা গার্ডের নজরে পড়েন ও তাঁহারা উপযুক্ত শ্রেণীতে স্থান পান। এই-সকল বে-বন্দোবস্ত কোনো কালে যে দূর হইবে, এমন ভরসা হয় না। সকল বিষয়েই দেখো, জগতে মূল্য দিয়া তাহার উপযুক্ত সামগ্রী খুব কম লোকেই পাইয়াছে; হয় দোকানদার তাহাকে ঠকাইয়াছে, নয়, সে দোকানদারকে ঠকাইয়াছে। এ-সকল কেবল অসাবধানিতার ফল। যত দিন রেলগাড়ি থাকিবে, তত দিন শত শত ফার্স্ট ক্লাসের আরোহী থার্ড ক্লাসে চড়িবে, থার্ড ক্লাসের আরোহী ফার্স্ট ক্লাসে চডিবে, ইহা নিবারণের উপায় দেখিতেছি না। কিন্তু ইহা অপেক্ষা আর-একটা আমার দুঃখ আছে। রেলোয়ের কর্মচারীগণ বিনা টিকিটে সেকেন্ড ক্লাসে ভ্রমণ করিত পারেন। তাঁহারা চিরদিন পরের টিকিট সমালোচনা করিয়াই কালযাপন করিয়াছেন, নিজে একখানি টিকিটও ক্রয় করেন নাই। ইহা কি সত্য নয় যে, তিনি নিজে আপনাকে যত বড়ো ব্যক্তিই মনে করুন-না, যতক্ষণে না তিনি ট্যাঁকের পয়সায় টিকিট কিনিবেন, ততক্ষণে তিনি চতুর্থ শ্রেণীর আরোহী অপেক্ষাও অল্প সম্মান পাইবার যোগ্য। কিন্তু এই সমালোচকবর্গ যে বিনা পয়সায় দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকিট-ক্রেতাদিগের সমতুল্য সম্মান পাইয়া থাকেন, ও অহংকারে এতখানি ফাঁপিয়া উঠেন যে, পাঁচটা আরোহীর জায়গা একা জুড়িয়া বসেন, ইহা সর্বতোভাবে ন্যায়-বিরুদ্ধ। অনেকে বিনা টিকিটে অসংকোচে গাড়িতে চড়িয়া বসেন, ভাব দেখিয়া সকলেই মনে করে, অবশ্য ইহার কাছে টিকিট আছে, কেহ সন্দেহও করে না, জিজ্ঞাসাও করে না। গার্ড দেখিল, তাঁহার পাকা দাড়ি, পাক চুল; অনেকদিন হইতে ফার্স্ট ক্লাসে চড়িয়া আসিতেছেন; তাঁহাকে টিকিটের কথা জিজ্ঞাসা করিতে প্রবৃত্তও হইল না সাহসও হইল না। কাহারো বা হীরার আংটি, ঘড়ির চেন, জরির তাজ দেখিল– আর টিকিট দেখিল না। সাহিত্য রেলোয়ে কোম্পানিতে এইরূপ বহুবিধ অনিয়ম ঘটিতেছে; আমি বরাবর বলিয়া আসিতেছি, যত বড়ো লোকই হউন-না কেন টিকিট নিতান্ত মনোযোগ সহকারে আলোচনা না করিয়া কাহাকেও ছাড়া উচিত নহে। কিন্তু অত পরিশ্রম করে কে? আবার, অধিক কড়াক্কড় করিলেও নিন্দা হয়।
যাঁহারা টিকিট কিনিয়া ট্রেন মিস্ করেন, তাঁহাদের জন্য বড়ো মায়া করে। তাঁহারা ঠিক সময়ে আসেন নাই। সময়মাফিক আসিয়াছিল বলিয়া কত থার্ড ক্লাসের লোক গাড়িতে উঠিল, এমন-কি, কত লোক টিকিট না কিনিয়াও গাড়িতে উঠিল; অসময়ে আসিয়াছেন বলিয়া কত ফার্স্ট ক্লাসের লোক পড়িয়া রহিলেন। যাহা হউক, তাহাদের জন্য ভবিষ্যৎ আছে, দ্বিতীয় ট্রেন আসিলে তাঁহারা চড়িতে পাইবেন। কিন্তু ইঁহাদের অনেকে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ হইয়া বাড়িতে ফিরিয়া যান, স্টেশনে অপেক্ষা করেন না। এইরূপে কত প্রথম শ্রেণীর ব্যক্তি বিরক্ত হইয়া তাঁহাদের টিকিট ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছেন, পকেটে পয়সা আনিয়া টিকিট ক্রয় করেন নাই, তাঁহাদের সংখ্যা গণনা কে করিবে? জেফ্রি যে ট্রেনে গার্ড ছিলেন, বাইরন যে ট্রেনে আরোহী ছিলেন, সেই ট্রেন ধরিবার জন্য ওয়ার্ড্স্বার্থ ও শেলী স্টেশনে উপস্থিত হইলেন, কিন্তু তখন গাড়ি দ্রুতবেগে চলিয়াছে; তাঁহারা ট্রেন মিস্ করিলেন; দ্বিতীয় ট্রেন আসিলে পর তাঁহারা স্থান পাইলেন। আমাদের বঙ্গীয় সাহিত্যে সম্প্রতি যে ট্রেন চলিতেছে, অনেক বড়ো বড়ো ব্যক্তি সে ট্রেনটা মিস্ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহারা কেন নিরাশ হইতেছেন? দশ মিনিট সবুর করুন আর-একখানা ট্রেন এল বলে!
বঙ্গীয় সাহিত্য ট্রেনে ফার্স্ট সেকেণ্ড ক্লাসে আরোহী নিতান্তই কম, অন্যান্য ক্লাসে অত্যন্ত ভিড়। এই নিমিত্ত গার্ডেরা বাছিয়া বাছিয়া দুই-এক জনকে ফার্স্ট ক্লাসে বসিতে দেয়। তাহারা যদিও ফার্স্ট ক্লাসে বসিয়াছে, তথাপি গার্ড জানে যে, তাহারা থার্ড ক্লাসের আরোহী। তাহাদের বলে, বাংলার মিল্টন, বাংলার বাইরন, বাংলার ফসেট্ ইত্যাদি, অথচ মনে মনে সকলেই জানে যে, তাহারা মিল্টন, বাইরন, ফসেটের সমতুল্য নহে; অনুগ্রহ করিয়া এক ক্লাসে বসিতে দিয়াছে মাত্র। কিন্তু এমন করিবার আবশ্যক কী? ইহাতে বুদ্ধিমান লোকের নিতান্ত সংকোচ জন্মিবার কথা। তাহাদের জন্য স্বতন্ত্র গাড়ির বন্দোবস্ত করিয়া দিলেই তো ভালো হয়।
বঙ্গীয় সাহিত্য কোম্পানিতে, খুচরা, টুকরা মাল-বোঝাই গোটা কতক মালগাড়ি অর্থাৎ খবরের কাগজ, এরকম বেশ চলিতেছে। কিন্তু ভাব-আরোহীদিগের জন্য আরোহী-শকট অর্থাৎ মাসিক প্রবন্ধ-পত্র ভালো চলিতেছে না। গাড়ি চলিবার জন্য এঞ্জিনে শ্বেতবর্ণ খনিজ কয়লার আবশ্যক। কোথায় পাইবে বলো! সাহিত্য এঞ্জিন কেন, দেশে সহস্র এঞ্জিন বেকার পড়িয়া আছে ভারতবর্ষের রাজা-গঞ্জে রাণী-গঞ্জে কয়লা যে নাই, এমন নহে, কিন্তু এত গভীর অকালে নিহিত যে, সহস্র মাথা খুঁড়িলেও পাইবার কোনো সম্ভাবনা নাই। আর এক উদ্যমের কয়লা আছে, তাহাও বাংলা দেশে এমন বিরল ও বাংলার কয়লার এত অধিক ধোঁয়া হয় ও এত কম আগুন জ্বলে যে, দুই পা গিয়াই গাড়ি চলে না। আমারও কলমের কয়লা ফুরাইয়া গিয়াছে, এইখানেই চলা বন্ধ করিয়াছে; স্টেশন যদিও দূরে আছে, কথা যদিও বাকি আছে, কিন্তু আর লিখিতে পারিতেছি না, কয়লা নিভিয়া গিয়াছে।
ভারতী, অগ্রহায়ণ, ১২৮৮