2 of 3

রেলের কামরার গল্প

রেলের কামরার গল্প

প্রত্যেক ট্রেনের কামরাতেই একটা গল্প আছে। বিশেষত রাত্রির যাত্রায়। একটা ছোট্ট ঘেরাটোপের মধ্যে, ওপর-নীচের চারটি শয্যায় সম্পূর্ণ অচেনা চারজন মানুষ একটা রাত কাটিয়ে যায়, এর মধ্যে গল্প থাকবে না?

সম্প্রতি আমাকে পুরুলিয়া জেলায় যেতে হয়েছিল, চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার, রাতের জার্নি। রাত দশটার পর ছাড়বে, সুতরাং খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে ট্রেনে ওঠা। আমি নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে পৌঁছে দেখি, আর দুজন যাত্রী আগেই এসে গেছেন, একটি বার্থ খালি। একজন বেশ সপ্রতিভ অবাঙালি যুবক, আর একজন মহিলা, তাঁর সঙ্গে একটি ছোট মেয়ে। ট্রেন না ছাড়লে শুয়ে পড়ার প্রশ্ন নেই, প্রথম পাঁচ মিনিট কেউ কোনও কথা বলে না, আমার মতো অনেকেই একটা বই খুলে বসে।

প্রথমে কথা বললেন মহিলাটি। কী করে যেন তিনি চিনতে পেরে গেলেন আমাকে। নমস্কার বিনিময়ের পর জানা গেল, তাঁর ছেলে পড়ে পুরুলিয়ার সৈনিক স্কুলে, তিনি ছেলেকে দেখতে যাচ্ছেন। শুনতে-শুনতে আমি কল্পনায় দেখতে পেলুম এক ব্যাকুল কিশোরের মুখ, আগেই চিঠি পেয়ে যেন সে ছটফট করছে মায়ের প্রতীক্ষায়। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় আমি কখনও হস্টেলে থাকিনি। এখন মনে হল, ইস, কেন থাকিনি।

যুবকটিও আমাদের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিল। সে আসছে দিল্লি থেকে, যাবে বোকারাতে, মাঝখানে একবার বদল করতে হবে। অনেক বিষয়ে সে আগ্রহী, বাংলা সম্পর্কে খুব কৌতূহল। এই তিনজনের কথাবার্তা গল্প সহজ স্বাভাবিক, বেসুরো কিছু নেই। এরপর চতুর্থ যাত্রীর আগমন।

তিনি এলেন সদলবলে, অন্তত চার-পাঁচজন লোক তাঁকে তুলে দিতে এসেছে। মনে হয়, বেশ হোমরাচোমরা ব্যক্তি। তাঁর লটবহরেরও শেষ নেই, কুলিরা বাক্স-প্যাঁটরা আনছে-তো-আনছেই, জায়গাটা প্রায় ভরে গেল। একবার তিনি এক কুলিকে ধমক দিয়ে বললেন, এই হারামজাদা, ঠিক করে রাখ!

কুলিদের সঙ্গে যারা এরকম ব্যবহার করে, তাদের সম্পর্কে প্রথম থেকেই আমার মনে একটা বিরূপতা গড়ে ওঠে। গালাগালি দেওয়া তো অন্যায় বটেই। ওদের সঙ্গে তুই-তুকারি করাটাও আমি ঘোরতর অপছন্দ করি। এই ব্যক্তিটির এমনই প্রতাপ যে কুলিটিও আপত্তি জানাল না।

ট্রেন চলতে শুরু করতেই সেই প্রতাপশালী ব্যক্তিটি একটি নীচের বার্থে বিছানা পাততে শুরু করে দিলেন। আমাদের সঙ্গে একটিও কথা বললেন না। হয়তো কথা বলার যোগ্যও মনে করলেন না। কিন্তু আমার একটু খোঁচা মারার ইচ্ছে হল। আমার টিকিটে লেখা আছে লোয়ার বার্থ, ভদ্রমহিলাটি মেয়েকে নিয়ে নীচেই শোবেন নিশ্চয়ই, তাহলে ওই লোকটি একটি নীচের বার্থ আগেভাগেই দখল করে নিলেন কী করে? সে কথা জিগ্যেস করতেই তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, হ্যাঁ, আমি নীচেই শোবো! আমি তখনই ঠিক করলুম, টিকিট চেকারকে ডেকে ওই লোকটিকে স্থানচ্যুত করতেই হবে। ডাকতে হল না, চেকার তখনই উঁকি দিলেন। এবং জানালেন, ওই প্রতাপশালী ব্যক্তিটি নীচের বার্থেরই অধিকারী। আমি তৎক্ষণাৎ মহিলাটির দিকে ফিরে জানালুম, আপনি নীচেই থাকবেন, আমার ওপরে যেতে কোনও অসুবিধা নেই।

ব্যাপারটি তা ঘটল না। মহিলাটির পুরো কনফারমেশন ছিল না, তাঁর জন্য ব্যবস্থা হল, কিন্তু পাশের কিউবিকলে যেতে হল। তাঁর জায়গায় এলেন একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি, ইনিও বেশ আলাপী। জানা গেল, ইনি রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে জড়িত। আমরা তিনজন আরও কিছুক্ষণ আড্ডা চালালুম, সেই প্রতাপশালী ব্যক্তিটি আমাদের অগ্রাহ্য করে, একটিও বাক্য বিনিময় না করে নাকডাকিয়ে ঘুমোতে লাগলেন। চারটি চরিত্র। তার মধ্যে তিনজন একদিকে। আর একজন মূর্তিমান ব্যতিক্রম। সবাই একরকম হলে, গল্প জমবে কী করে।

একটু পরে সবাইকেই শুয়ে পড়তে হল। বেশ শীতের রাত। আমাকে নামতে হবে আদ্রা স্টেশনে, ভোর সাড়ে পাঁচটায়। শীতের ভয়ে সব জানলা বন্ধ, আর চোর-ডাকাতের ভয়ে দরজাও বন্ধ। অন্ধকারের মধ্যে কখন সাড়ে পাঁচটা বাজবে, বুঝব কী করে? কন্ডাক্টর গার্ডকে যদিও ডেকে। দিতে বলা হয়েছে, কিন্তু তিনিও যদি ঘুমিয়ে থাকেন? ঠিক করলুম, ঘুমবই না, মাঝে-মাঝে উঠে ঘড়ি দেখতে হবে। মাঝে-মাঝে তন্দ্রা আসছে, তবু জোর করে ঘুম তাড়াচ্ছি। এইরকম অবস্থায় যা হয়, শেষ রাত্রে হঠাৎ গাঢ় ঘুম এসে যায়।

হঠাৎ একসময় মনে হল, চতুর্দিকে দুমদাম শব্দ হচ্ছে। কারা যেন চ্যাঁচামেচি করছে বাইরে। প্রথমেই মনে হয়, ডাকাত? ইদানীং ট্রেন ডাকাতি খুব সহজ পেশা হয়ে গেছে। আমার কখনও ডাকাত দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি, মনে-মনে শখ আছে, একবার ডাকাতের পাল্লায় পড়লে মন্দ হয় না। ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়। ডাকাতরা আমার কাছ থেকে আর কী নেবে? আমি তো আর বীরপুরুষ সেজে তাদের প্রতিরোধ করতে যাব না যে তারা আমাকে ছুরি মারবে? বিদ্যাসাগরমশাই একবার ডাকাতের ভয়ে পালিয়েছিলেন বাড়ি ছেড়ে, আমি বিদ্যাসাগরের চ্যালা।

না, ডাকাত নয়, কয়েকজন বাইরে থেকে আমাদের ঘুম ভাঙাতে চাইছে, আদ্রা স্টেশনে থেমে আছে ট্রেন। ঘুম চোখে হুড়োতাড়া করে কম্বল চাদর গুছিয়ে নিতে হল। বইটা পড়ে গেছে। মেঝেতে… প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই বুঝি ট্রেন ছেড়ে দিল! কোনক্রমে নেমে পড়লুম প্ল্যাটফর্মে, কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য, এগিয়ে গেলুম তাদের দিকে। হঠাৎ দেখি, সেই প্রতাপশালী ভদ্রলোকটি ছুটে আসছেন, কাছে এসে বললেন, আপনার চশমা। আপনি চশমা ফেলে যাচ্ছেন!

আমি স্তম্ভিত! চশমা ছাড়া আমি প্রায় কানা, একটা অক্ষরও পড়তে পারি না। ভদ্রলোক আমার এই দারুণ উপকার করলেন কেন? তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলেন, তাঁর গন্তব্য আরও অনেক দূরে। লোকের চ্যাঁচামেচিতে তাঁর ঘুম ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু পাশ ফিরে শোওয়াই স্বাভাবিক ছিল।

তবু আমার চশমাটা ফেরত দিতে শীতের মধ্যে তিনি গেঞ্জি পরে ছুটে এলেন…মানুষকে কীভাবে বিচার করব? মানুষ বড় রহস্যময়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *