রেললাইনের পাহারাদার
হঠাৎ মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে গেল, ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল অরূপ৷ একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখেছে৷
স্বপ্নটা ছোট৷ মাধ্যমিক পরিক্ষার রেজাল্ট বেরুবার কথা, কোনো কারণে সোমবার বিকেলেই বেরিয়ে গেছে৷ অরূপ তা জানতেও পারেনি৷ সে বিকেলবেলা খেলার মাঠ থেকে ফিরছে, শ্রীনিকেতনের মোড়ে দেখতে পেল তার তিন বন্ধু, রবি, অলোক আর সায়ন্তন হৈ হৈ করে যাচ্ছে, তাদের হাতে একটা বড় ভাঁড়, টপাটপ রসগোল্লা তুলে খাচ্ছে৷
অরূপ চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই তোরা কোথায় যাচ্ছিস রে? রসগোল্লা কে দিল?
সায়ন্তন বলল, আজ রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে, জানিস না? রবি তিনটে লেটার পেয়েছে৷ ওর ঘাড় ভেঙে রসগোল্লা খাচ্ছি!
অরূপ দারুণ অবাক হয়ে বলল, সে কি? আজই রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে? তোরা আমায় ডাকলি না? আমার রেজাল্ট কী হয়েছে?
তিন বন্ধু থমকে গেল৷ তাকাল এ ওর মুখের দিকে৷ তারপর চলে গেল হনহন করে, অরূপকে কিছুই বলল না৷
স্বপ্ন এখানেই শেষ৷
অরূপ ঝিম মেরে বসে ভাবতে লাগল, এর মানে কী?
ওরা তার এতই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ওরা কথা না বলে চলে যাবে? তাকে একটা রসগোল্লাও দিতে এল না?
রবি তিনটে লেটার পেয়েছে, সে তো এমন কিছু ভালো ছাত্র নয়৷ যাই হোক, পেয়েছে, খুব আনন্দের কথা৷ কিন্তু ওরা অরূপের রেজাল্টটা দেখে আসেনি?
এবারে অরূপের সারা শরীর কেঁপে উঠল৷
এ স্বপ্নের একটাই মানে হয়৷ অরূপ ফেল করেছে৷
এর আগে, পরিক্ষা শুরু হবারও আগে, অরূপ আর একটা ভয়ের স্বপ্ন দেখেছিল৷ সেটা পরিক্ষার হলের স্বপ্ন৷ কোশ্চেন পেপার দেওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু অরূপ খাতায় কিছু লিখতে পারছে না৷ তার পেনে কালি নেই৷ আর একটা পেন জোগাড় হল, তবু এগোচ্ছে না লেখা৷ সব জানা প্রশ্ন, তবু মনে আসছে না উত্তর৷ লাস্ট বেল পড়ে গেল, তখনো অরূপ একটা উত্তরও শেষ করতে পারেনি৷
এ স্বপ্নটা অবশ্য মেলেনি৷ সব কটা পরিক্ষায় অরূপ সব প্রশ্নেরই উত্তর লিখতে পেরেছে৷ শুধু ভূগোলে বাদ গেছে পাঁচ নম্বর৷ সেটা এমন কিছু না৷
কিন্তু এবারের স্বপ্নটা অন্যরকম৷ বন্ধুরা কেন তাকে ত্যাগ করল?
সত্যিই কি অরূপ ফেল করতে পারে? সবাই জানে, সে ভালো ছাত্র৷ কিন্তু এবারের অঙ্ক পরিক্ষাটা অন্যরকম৷ কাটা কাটা উত্তর দিতে হবে৷ একটা ভুল হলেই পর পর অনেকগুলোই ভুল হতে পারে৷ যদি এবারে সেরকম ভুল হয়ে থাকে? তার মানে কি অঙ্কে ফেল?
অনেক স্বপ্নই সকালবেলা আর মনে থাকে না৷
কিন্তু এই স্বপ্নটা অরূপের মনে গেঁথে রইল৷ যত বেলা বাড়ছে, ততই তার ধারণা হচ্ছে, সত্যিই অঙ্ক পরিক্ষা তার খুব খারাপ হয়েছে৷ সব উত্তরই ভুল৷ অঙ্কে ফেল মানে তো একেবারেই ফেল৷
এমন মন খারাপ হয়ে গেল যে, সে আর বাড়ি থেকেই বেরুল না৷ খেলতেও গেল না৷ রবি আর সায়ন্তনরা ডাকতে এল, তাও গেল না সে৷ জানলার কাছে বসে রইল চুপ করে৷ রাস্তা দিয়ে কত মানুষ-জন যাচ্ছে, কেউ হাসছে, কেউ গল্প করছে৷ কাল বাদে পরশুই এই লোকগুলো এ বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলবে, এ বাড়ির ছেলেটা ফেল করেছে৷
পাশের বাড়ির দীপাও পরিক্ষা দিয়েছে এবার৷ সে এইমাত্র অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে চলে গেল পাশ দিয়ে৷
অন্য দিন হলে অরূপ ওকে ঠিক ডাকত৷ আজ নিজে সরে গেল জানলা থেকে৷ দীপা ভালো ছাত্রী৷ নিশ্চয়ই ভালো রেজাল্ট করবে৷ ফেল করা ছেলে অরূপ ওকে মুখ দেখাবে কী করে?
দীপা ভর্তি হবে উচ্চ মাধ্যমিকে, আর অরূপ পড়ে থাকবে সেই পুরোনো স্কুলে? টিচাররাও ভালো করে কথা বলবেন না তার সঙ্গে৷ ইংরিজির স্যার কত ভরসা করেছিলেন তার ওপরে৷
মা আজ বিকেলে একটা নতুন জামা কিনে এনেছেন৷ ফেল করার খবর পেয়ে মা কি ওই নতুন জামাটা আর পরতে বলবেন?
বাবা এখানে নেই৷ অফিসের কাজে গেছেন দিল্লি৷ বাবা কত আশা করে বসে আছেন৷ যাবার আগে বাবা বলে গিয়েছেন, খোকা, তোকে কিন্তু দশজনের মধ্যে স্ট্যান্ড করতে হবে৷
একা একা অনেকক্ষণ কাঁদল অরূপ৷ তারপর অন্ধকার নামলে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে৷ মাকে বলল, এক বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছে৷
একা একা অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়াল রাস্তায় রাস্তায়৷ এক জায়গায় কিসের একটা ফাংশান হচ্ছে, কেউ গাইছে বেশ ভালো একটা গান, অরূপ সেখানে একটু দাঁড়াল৷ তার ভালো লাগল না৷ আজ তার কিছুই ভালো লাগছে না৷
গরম গরম সিঙাড়া ভাজছে একটা দোকানে৷ অরূপ সিঙাড়া এত ভালোবাসে, কিন্তু এখন ইচ্ছেই করল না৷ পৃথিবীতে তার ভালো লাগার মতন আজ কিছুই নেই৷
একসময় সে এসে পড়ল রেললাইনের ধারে৷
সেই লাইন ধরেই হাঁটতে লাগল৷ স্টেশান ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে৷ জায়গাটা একেবারে নির্জন৷ অরূপ মন ঠিক করে ফেলেছে, এই জায়গাটাই সবচেয়ে সুবিধেজনক৷ হয়তো কাল সকালের আগে কেউ টেরও পাবে না৷
সে প্রথমে বসল৷ তারপর দু’লাইনের মাঝখানে গিয়ে, একটা লাইনে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল৷ সে আর বেঁচে থাকতে চায় না৷
একটু পরেই আসবে বিশ্বভারতী প্যাসেঞ্জার৷ এই ট্রেনটা সাধারণত লেট করে না৷
চিত হয়ে শুয়ে আছে অরূপ৷ দেখতে পাচ্ছে আকাশ৷ আজ আকাশে মেঘ নেই, জ্বলজ্বল করছে অনেক তারা৷ মানুষ মরে গেলে কোথায় যায়? এই সব তারাগুলো পেরিয়ে, আরও দূরে? কিংবা কোথাও যায় না, এখানেই সব শেষ?
একটু পরেই শোনা গেল ট্রেনের শব্দ৷ আসছে, আসছে, লোহার রথ৷ বেশি ব্যথা লাগবে না, এক মিনিটেই ওপর দিয়ে চলে যাবে৷ ফেল করে বেঁচে থাকার চেয়ে, এই মৃত্যু অনেক ভালো৷
ট্রেনটা একেবারে কাছে এসে গেছে, শোনা যাচ্ছে ফোঁস ফোঁস শব্দ৷ আর কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র৷ অরূপ গুনছে, এক—দুই—তিন৷
হঠাৎ বিকট শব্দ করে থেমে গেল ট্রেনটা৷
কী ব্যাপার, এ ভাবে তো ট্রেন থামে না৷ অন্ধকারে তাকে দেখতে পাওয়ার কথা নয়৷ সার্চলাইটে দেখতে পেলেও থামানো যায় না৷
অরূপ মুখ ফিরিয়ে দেখল, একজন বেশ লম্বা, কুচকুচে কালো চেহারার মানুষ, তার হাতে একটা লাঠি, দু’হাত তুলে হেঁড়ে গলায় বলে উঠল, এই রেল, আরও একটু দাঁড়িয়ে থাক!
তারপর সেই লোকটি অরূপের কাছে এসে তার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল৷
বিকটভাবে বলল, হতভাগা ছেলে, পরিক্ষায় ফেল করেছিস নিশ্চয়ই? সারা বছর পড়াশুনোর নাম নেই, রেজাল্ট বেরুবার আগে অমনি সুইসাইড করার চেষ্টা! দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা!
বেড়াল যেমন তার বাচ্চাকে ঘাড় কামড়ে নিয়ে যায়, এই লোকটিও তেমনি এক হাতে অরূপের জামার কলার ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে চলল৷ লোকটি খুবই শক্তিশালী বোঝা যায়! অন্য হাত তুলে সে আবার বলল, এই রেল, এবার যা!
লোকটি গজগজ করে বলতে লাগল, মরতে চাস ভালো কথা৷ আমার রেললাইন নোংরা করবি কেন? ফেল করেছিস, শাস্তি পেতে হবে৷ আরও অনেক কষ্ট করে মরতে হবে৷ তোকে আমি জলে ডুবিয়ে মারব৷
খানিকটা দূর গিয়ে সে অরূপকে দু’হাতে তুলে ছুড়ে দিল একটা পুকুরে৷
কিন্তু অরূপ জলে ডুবে মরবে কী করে, সে সাঁতার জানে৷
অরূপ সাঁতার কেটে পুকুরের অন্য একটা দিকে ওঠবার চেষ্টা করতেই লোকটি সেখানে দৌড়ে এসে হাতের লাঠিটা দিয়ে অরূপকে আবার জলে ফেলে দিল৷
অরূপ আবার সাঁতরে গেল অনেকটা দূরে৷
আর একটা দিকে উঠতে যেতেই লোকটি সেখানেও এসে লাঠির খোঁচা দিল৷
এই রকম চলল কয়েকবার৷
আর একবার অরূপ পাড়ে ওঠার চেষ্টা করতেই লোকটি আর বাধা দিল না৷
সে বলল, নাঃ, তুই ভালোই সাঁতার জানিস দেখছি৷ জলে ডুবে মরবি না৷ তুই তালগাছে চড়তে পারিস?
অরূপ বলল, না৷
লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, কোনোদিন চড়িসনি?
অরূপ বলল, না৷ কখনো চেষ্টাও করিনি৷
লোকটি খলখল করে হেসে উঠে বলল, বাঃ! তা হলে তো আর একটা ভালো উপায় পাওয়া গেছে৷
এবারে লোকটি অরূপকে তুলে নিয়ে সরসর করে একটা তালগাছে উঠে গেল৷
একেবারে ওপরের একটা ডালে অরূপকে বসিয়ে দিয়ে সে আবার নেমে গেল তাড়াতাড়ি৷
তারপর হাততালি দিতে দিতে বলল, এইবার? এখন কী করবি বল!
তালগাছটা খুব উঁচু৷ তলার দিকে তাকালেই বুক কাঁপে৷ এখান থেকে অরূপ নামবে কী করে?
এই লোকটিই বা কে? ভূত কিংবা দৈত্য? যাঃ, ওসব আবার কিছু আছে নাকি? মানুষই নিশ্চয়ই৷ কিন্তু এ কীরকম মানুষ!
অরূপ বলল, আমি এখান থেকে নামতে পারব না৷ আমায় একটু সাহায্য করুন, প্লিজ!
লোকটি বলল, কেন সাহায্য করব! তুই তো মরতেই চেয়েছিলি!
অরূপ বলল, কিন্তু এখান থেকে পড়ে গেলে যদি না মরি? হাত-পা ভেঙে চিরকালের মতন পঙ্গু হয়ে থাকব৷ সে তো আরও খারাপ৷
লোকটি বলল, সে আমি কী জানি! কোনটা খারাপ, কোনটা ভালো, তা তুই বুঝবি!
এত লম্বা গাছ বেয়ে নামার সাধ্য অরূপের নেই৷ নির্ঘাৎ হাত পিছলে যাবে৷ পড়ে গিয়ে মাথায় চোট লাগলে অনেকে মরে না৷ কিন্তু ব্রেন নষ্ট হয়ে যায়৷ মানুষ চেনা যায় না, কোনো কিছু মনে রাখা যায় না৷ তার এক কাকা আছে এই রকম৷ তাঁকে দেখলেই কষ্ট হয়৷
অরূপ ভাবল, তার চেয়ে এই ডালে বসে থাকাই অনেক ভালো৷ এই লোকটা নিষ্ঠুর৷ কিন্তু সকাল হলে অন্য কেউ না কেউ নিশ্চয়ই তাকে উদ্ধার করবে৷ শুধু দেখতে হবে, ঘুম না এসে যায়৷
নাঃ, অরূপ কিছুতেই ঘুমোবে না৷
লোকটি যেন ঠিক তার মনের কথাটা বুঝে ফেলেছে৷
হাসতে হাসতে বলল, তুই বুঝি ভেবেছিস, গাছের ডালে বসেই সারারাত কাটিয়ে দিবি? সে গুড়ে বালি৷ ওই গাছের কোটরে দুটো বিষাক্ত সাপ আছে৷ বেশি নড়াচড়া করলেই তারা বেরিয়ে আসবে৷ সাপের কামড়ে মরতে চাস তো তাই মর!
অরূপ আঁতকে উঠে বলল, সাপ?
লোকটি বলল, আমি মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছি না৷ সত্যি দুটো সাপ আছে!
অরূপ এ পৃথিবীতে সাপকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পায়৷ সাপ দেখলেই তার গা গুলোয়৷ শেষ পর্যন্ত সাপের কামড়ে মরতে হবে!
এবারে অরূপ কাঁদো কাঁদো ভাবে বলল, আপনি আমাকে বাঁচিয়ে দিন৷ আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি৷
লোকটি বলল, আমার ক্ষতির প্রশ্ন হচ্ছে না৷ তুই রেললাইন নোংরা করছিলি৷ মরতে চেয়েছিলি, যে কোনো একটা ভাবে মরলেই তো হল৷
অরূপ বলল, আমি ভুল করেছি৷ বাড়িতে আমার মা-বাবা আছেন৷ একটা ছোট বোন আছে৷ তারা খুব কষ্ট পাবে!
লোকটি বলল, ও, যখন রেললাইনে মাথা দিয়েছিলি, তখন বুঝি মা-বাবার কথা মনে ছিল না?
অরূপ বলল, তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না৷ আমি মরে গেলে আমার মা-ও কেঁদে কেঁদে মরে যাবে!
লোকটি বলল, ওসব আমি জানি না৷ সাপের কামড়ে মরবি, না তালগাছ থেকে পড়ে মরবি, এই দুটোর একটা বেছে নে!
অরূপের মনে হল, সে যেন হিস হিস শব্দ শুনতে পাচ্ছে৷ মনের ভুল? নাকি সত্যিই সাপ দুটো বেরিয়ে আসছে?
অরূপ অবশ্য এটা জানে যে সাপকে আঘাত না করলে কিংবা ভয় না দেখালে তারা এমনি এমনি কামড়ায় না৷ সাপ দুটো যদি বেরিয়ে পড়ে, তাহলে নিশ্বাস বন্ধ করে একেবারে চুপ করে বসে থাকতে হবে৷ একটুও নড়াচড়া করলে চলবে না৷
কিন্তু সেভাবে কি সারারাত বসে থাকা যায়?
হিস হিস শব্দ হচ্ছে ঠিকই৷ মনের ভুল নয়৷
অরূপ আর দেরি করল না৷
খুব সাবধানে, প্রায় শব্দ না করে সে ডালটা ছেড়ে গাছের গুঁড়িটা জড়িয়ে ধরল৷ নামতে গিয়ে যদি পড়ে যায়, যদি হাত-পা ভাঙে, সেও সাপের বিষের চেয়ে ভালো৷
দু’হাতে তালগাছের গুঁড়িটা জড়িয়ে ধরেছে, পা দুটোও আঁট করে রেখেছে, তারপর অরূপ নীচে নামছে একটু একটু করে৷
হাত দুটো জ্বালা করছে, পা দুটোও খুলে যাচ্ছে মাঝে মাঝে৷ তবু অরূপ দাঁতে দাঁত চেপে আছে৷ তাকে নামতেই হবে৷ খুব বেশি মনে পড়ছে মায়ের মুখখানা৷
প্রায় অর্ধেকটা নেমে এসেছে অরূপ৷ হঠাৎ বেশ জোরে ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনতে পেল৷ ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, একটা গাছের ডাল ধরে ঝুলছে একটা লম্বা সাপ৷
আজ জ্যোৎস্না রাত, দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট৷
ব্যস, সেই সাপ দেখেই অরূপের মনের জোর শেষ হয়ে গেল৷ আলগা হয়ে গেল হাত৷ পায়েও আর জোর নেই৷
সে পড়ে যাচ্ছে৷ সেই কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যেও সে ভাবল, মাথায় যেন চোট না লাগে! হাত-পা সবই কি ভাঙবে?
অরূপের শরীরটা মাটি ছুঁল না, তার আগেই তাকে লুফে নিয়েছে সেই কালো লোকটি৷
অরূপকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সে বলল, বাঃ, প্রায় তো পেরে গিয়েছিলি৷ প্রথমবারের পক্ষে ভালোই৷ সাপ দেখে অত ভয় পেলি কেন? সাপ চিনতে হয়৷ ওটা ঢ্যামনা সাপ, ওর বিষ নেই, সহজে কামড়ায়ও না৷
অরূপ কোনো কথা বলতে পারছে না৷ সে এখনো যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না যে সে বেঁচে আছে৷ তার হাত-পা কিছুই ভাঙেনি!
লোকটি অরূপের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, এটা তো হল! এরপর তোকে আর কোন ভাবে মারব? গায়ে আগুন লাগিয়ে দেব?
অরূপ লোকটির দু’হাত জড়িয়ে ধরে আকুল ভাবে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন, প্লিজ! আমার মা আমার জন্য অপেক্ষা করছে৷ আমি বাড়ি যাবো৷
সে বলল, বাঃ, তুই তো মরতেই চেয়েছিলি! তোর তো আর বাড়ি ফেরার কথা না! আগে মায়ের কথা মনে পড়েনি?
অরূপ বলল, ওসব আর জিজ্ঞেস করবেন না৷ দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন৷
সে বলল, তুই এত ভালো সাঁতার কাটতে পারিস, তালগাছ থেকেও নামতে পারিস, আর পরিক্ষায় পাশ করতে পারিস না? একবার না পারলে দু’বারেও তো পাশ করা যায়৷ যেমন কেউ একবারে সাঁতার শেখে না৷ তালগাছেও একবারেই ওঠা-নামা শেখা যায় না৷
অরূপ বলল, আমি সামনের বছর আবার পরিক্ষা দেব! এখন আমি বাড়ি যাই?
সে বলল, ইশ, আর দেরি সইছে না৷ প্রাণটা চলে গেলে কী হত? একবার গেলে আর কি প্রাণ ফেরত পাওয়া যায়? যাঃ, এবারের মতন ছেড়ে দিলাম৷ বাড়ি যা৷
অরূপ কয়েক পা চলে গিয়েও ফিরে দাঁড়াল৷
কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আপনি কে? জিজ্ঞেস করতে পারি?
সে বলল, কে আবার? আমি রেললাইনের পাহারাদার৷ এই পরিক্ষা-টরিক্ষার রেজাল্ট বেরুবার সময় আমাকে বেশি করে পাহারা দিতে হয়৷ এই সময়েই তো কয়েকটা ন্যাকা ছেলেমেয়ে ফেল করবার ভয়ে রেললাইন নোংরা করতে আসে৷ ওদের দেখলেই আমার এত রাগ হয় যে ইচ্ছে করে আমি নিজেই লাঠি মেরে ওদের মাথা গুঁড়ো করে দিই৷ শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেলে সবাই তখন মায়ের কথা বলে৷ আর ওই মায়ের কথা শুনলেই আমার মনটা দুর্বল হয়ে যায়৷ যা, দৌড়ো, দৌড়ো, মা অপেক্ষা করছে তোর জন্য!
অরূপ দৌড় শুরু করল৷
কখনো সে বাড়ি ফিরতে এত রাত করে না৷ তার মা আর ছোট বোন চিন্তিত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে৷
জল-কাদা মাখা অরূপের প্যান্ট-শার্ট দেখে মা অবাক৷ জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গিয়েছিলি?
অরূপ আমতা আমতা করে বলল, এক বন্ধুর বাড়িতে৷ খুব বৃষ্টিতে ভিজতে হল, এক জায়গায় মাঠের মধ্যে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলাম৷
ক’দিন ধরে ঝড়-বৃষ্টির নাম নেই, সবাই গরমে ছটফট করছে৷ তবু অরূপ বৃষ্টিতে ভিজবে কী করে?
মা আর বেশি কথা বাড়ালেন না৷
রেজাল্ট বেরুল ঠিক বুধবারেই৷
অরূপ রেজাল্ট দেখতে যায়নি৷ সে তো জানেই সে ফেল করেছে৷ সে ঠিক করে ফেলেছে, পরের বছর আবার পরিক্ষা দেবে৷
বিকেলের দিকে হৈ হৈ করতে করতে এল দশ-বারোজন স্কুলের বন্ধু৷ অরূপের স্বপ্নটা একেবারেই মিথ্যে হয়ে গেছে৷
সে তো পাশ করেছে বটেই, চারটে লেটার মার্ক পেয়েছে৷ তার মধ্যে একটা অঙ্কে৷
সে প্রথম দশজনের মধ্যে আসতে পারেনি বটে, কিন্তু বীরভূম জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে অরূপ ঘোষাল!
একটা বাজে স্বপ্নের জন্য অরূপ যে কী ভুল করতে যাচ্ছিল, তা আর বলল না কারুকে৷ মা যখন সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে, তখন অরূপ মনে মনে ভাবছে, রেললাইনের ধারে আর একদিন যেতে হবে রাত্তিরবেলা৷ দেখতে হবে, সত্যিই সেরকম কোনো পাহারাদার আছে কি না৷ নাকি সেটাও স্বপ্ন৷
আর যদি তার দেখা পাওয়া যায়, তাহলে তাকে একটা প্রণাম করে আসতে হবে৷
—