রেলগাড়ি ঝমাঝম

আমার শিশুবেলার প্রধান খেলা ছিল ‘রেলগাড়ি খেলা’। বাসার কাঠের চেয়ারগুলোকে একটির পেছনে আরেকটি সাজাতাম। প্রথম চেয়ারটায় আমি গম্ভীর মুখে বসে ট্রেনের চাকার শব্দের অনুকরণে ‘ঝিকঝিক ঝিকঝিক’ করতাম।
শৈশবের অতি আনন্দময় সময় আলাদা করতে বললে আমি সঙ্গে সঙ্গে বলব–ট্রেনে করে দাদার বাড়ি, নানার বাড়ি যাওয়া। তখনকার ট্রেনের ইঞ্জিন ছিল কয়লার। জানালার পাশে বসে মাথা বের করলে অবধারিতভাবে চোখে পড়ত ইঞ্জিনের ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে আসা কয়লার টুকরা। কাজেই বড়দের প্রধান চেষ্টা ছিল শিশুদের জানালা দিয়ে মাথা বের করতে না দেওয়া। বড়দের সব নিষেধ অগ্রাহ্য করে আমি শুধু যে মাথাই বের করতাম তা না, শরীরের অর্ধেকটা জানালা দিয়ে বের করে রাখতাম। বড় মামার দায়িত্ব ছিল শক্ত করে আমার পা চেপে ধরে রাখা। চিরকুমারের মতো চিরবেকার বড় মামা আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। আমাদের সঙ্গেই ঘুরে বেড়াতেন। অবসরে কবিতা ও জারিগান লিখতেন। কবিতাগুলোতে সুর বসিয়ে গান বানিয়ে শিশুমহলে দারুণ চাঞ্চল্য তৈরি করতেন।

ট্রেন ভ্রমণে ফিরে যাই। শিশুবেলা কাটিয়ে আমি বালকবেলায় পড়লাম, রেলগাড়ির প্রতি আকর্ষণ মোটেই কমল না। বরং বাড়ল। আমার দুষ্টুমি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ট্রেন-ভ্রমণে সব সময় আমাকে বসতে হতো বাবার পাশে। বাবা ছিলেন নীরব শিক্ষক। তিনি খুব কায়দা করে নানান তথ্য তাঁর বালকপুত্রের মাথায় ঢোকাতেন। যেমন–টেলিগ্রাফের তারে বসে থাকা কোন পাখির কী নাম। কেন রাস্তায় ট্রেন চলতে পারে না, ট্রেনের চলার জন্য রেললাইন লাগে।
এক ট্রেন-ভ্রমণে অদ্ভুত তথ্য দিয়ে তিনি তাঁর বালকপুত্রকে চমকে দিলেন। তিনি বললেন, ট্রেন কত মাইল স্পিডে যাচ্ছে বলতে পারবি?

আমি বললাম, না।

বাবা বললেন, খুব সোজা। ট্রেলিগ্রাফের ২৭টা (সংখ্যায় ভুল হতে পারে, এখন মনে পড়ছে না) খাম্বার দূরত্ব হলো এক মাইল। তুই ঘড়ি হাতে নিয়ে দেখবি ২৭টা খাম্বা পার হয়ে যেতে কত সময় লাগে। সেখান থেকে বের করবি ট্রেন ঘণ্টায় কত মাইল বেগে যাচ্ছে।

এর পর থেকে আমার প্রধান কাজ হলো ঘড়ি হাতে বসে টেলিগ্রাফের খাম্বা গুনে ট্রেন কত মাইল স্পিডে যাচ্ছে তা বের করা। বালক বয়সে তিনি বিশাল এক বিস্ময় আমার ভেতর তৈরি করে আমাকে অভিভূত করলেন। আমি চেষ্টা করতে থাকলাম এই জাতীয় কোনো বিস্ময় আমার পুত্র নিষাদের ভেতর তৈরি করতে পারি কি না। সমস্যা হচ্ছে, নিষাদের বয়স চার। এ বয়সের শিশুরা সব সময় বিস্ময়ের ভেতর থাকে। তাদের আলাদা করে বিস্মিত করা যায় না। হঠাৎ সুযোগ হয়ে গেল। আমি শ্রীলঙ্কায় ট্রেনে করে কলম্বোর দিকে যাচ্ছি। পুত্র নিষাদকে মনে হচ্ছে আমার শৈশবের ফটোকপি। ট্রেন ভ্রমণের আনন্দে আমার মতোই উদ্বেলিত। আমি তাকে বললাম, বাবা, মন দিয়ে শোনো ট্রেনের চাকা কী বলছে?

সে কিছুক্ষণ চাকার শব্দ শুনে বলল, জানি না তো কী বলছে?

আমি বললাম, ট্রেনের চাকা তোমাদের দুই ভাইয়ের নাম বলছে। চাকা বলছে_নিষাদ-নিনিত, নিষাদ-নিনিত। নিষাদ-নিনিত, নিষাদ-নিনিত।

নিষাদ আবারও কিছুক্ষণ কান পেতে থেকে অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ বলছে তো!

পাঠকদের ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই, তাঁরা জানেন যেকোনো ছন্দময় শব্দ ট্রেনের চাকার সঙ্গে মিলবে। পুত্র নিষাদ ব্যাপারটা জানে না। সে বিস্ময়ে এবং আনন্দে অভিভূত হয়ে গেল। সে বলল, বাবা, শ্রীলঙ্কার ট্রেন আমার নাম কিভাবে জানল?

আমি বললাম, সব ট্রেন তোমাদের দুই ভাইয়ের নাম জানে। বাংলাদেশের ট্রেনও জানে।

বাংলাদেশে ফিরে সে আবার ট্রেনে চাপল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার আনন্দধ্বনি। সে অবাক হয়ে বলল, ট্রেন বলছে নিষাদ-নিনিত, নিষাদ-নিনিত।

আচ্ছা, আমি কি ছোট একটি বাচ্চার সঙ্গে প্রতারণা করলাম না? এই শিশুটি একদিন বড় হয়ে জানবে ট্রেন তার নামে গান করে না। সে কি তখন নিজেকে প্রতারিত মনে করবে না? পৃথিবীর সব দেশেই নানান ভাবে শিশুরা প্রতারিত হয়। পড়ে যাওয়া দাঁত ইঁদুরের গর্তে রাখলে ইঁদুর সুন্দর দাঁত উপহার দেয়। তারা বিশ্বাস করে, সান্তাক্লজ এসে তাদের উপহার দিয়ে যায়। শিশুদের কাছে একসময় প্রতারণা ধরা পড়ে, তারা তখন (আমার ধারণা) বড়দের ক্ষমা করে দেয়।

আমরা বড়রাও প্রতারিত হই। প্রতারণা করেন রাজনীতিবিদরা। ইলেকশনের আগে কত সুন্দর সুন্দর কথা বলেন। বৈতরণী পার হওয়ার পর সব কিছুই ভুলে যান। বিস্মৃতি ব্যাধি হয়। এ ব্যাধি পাঁচ বছর থাকে। পাঁচ বছর পর রোগ সারে। আবার পূর্ণোদ্যমে পুরনো কথা বলতে থাকেন, আমরা আবারও প্রতারিত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি। ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়। আমরা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বেলতলায় যাই। বেলতলায় যেতে আমাদের বড় ভালো লাগে।

আচ্ছা এ রকম হলে কেমন হয়–বাংলাদেশের সব মানুষ যদি ঠিক করে ভোট দিয়ে লাভ তো কিছু নেই, কাজেই এই নির্বাচনে আমরা কেউ ভোট দেব না। ইলেকশন হয়ে গেল, একটি ভোটও পড়ল না। তখন কী হবে? বাংলাদেশ কি সরকারবিহীন হয়ে পড়বে? আইন কী বলে?

পাদটীকা
‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’ নামে আমি একটি স্কুল দিয়েছি। আমি কল্পনায় যে সুন্দর স্কুল দেখি এই স্কুলটি সে রকম। চার বছর ধরে স্কুলটি চলছে। পাসের হার শতভাগ। ড্রপ আউট শূন্য। স্কুল দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন আসে, কিন্তু আমার এলাকার নির্বাচিত এমপি এবং মহিলা এমপি কেউই দুই মিনিটের জন্যও স্কুলে আসেননি। আমি কিছুদিন আগে একদল লেখক, কবি, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীকে স্কুলে নিয়ে গেলাম। আমার এলাকার এমপিদের অনুরোধ করে চিঠি পাঠালাম তাঁরাও যেন আসেন। দুজনের কেউই এলেন না। এমপিদের নানান কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকতে হয়। বললেই তো তারা সময় বের করতে পারেন না। টার্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে, এখনো শুল্কমুক্ত গাড়ির ব্যবস্থা হলো না–এটা নিয়েও হয়তো ব্যস্ততা আছে।

‘আমাদের সন্তানেরা থাকুক দুধে-ভাতে
আমাদের এমপিরা থাকুক ট্যাঙ্ ফ্রি গাড়িতে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *