গৌড়ানন্দ কবি ভনে

রেলগাড়ি চালু রাখার মিশ্র পদ্ধতি

রেলগাড়ি চালু রাখার মিশ্র পদ্ধতি

সম্প্রতি রেল ভবনের বিশেষজ্ঞগণ বিনা বাধায় রেলগাড়ি চালু রাখার যে-পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন, রেলযাত্রী মাত্রেই তাতে উপকৃত হবেন, পাবলিকের পক্ষে এ একটা আনন্দের খবর। এই ব্যাপারে রেলভবন থেকে শীঘ্রই এক ঘোষণা করা হবে। ঘোষণার খসড়াটিও প্রস্তুত। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়েছে এই নূতন পদ্ধতিটির নাম মিশ্র পদ্ধতি। প্রকাশ, নয়াদিল্লির রাজ জ্যোতিষীর কাছে খসড়াটি পাঠানো হয়েছে। তিনি সবুজ সংকেত দিলে খসড়াটি রেলভবনের বিশেষজ্ঞদের হাতে ফিরে আসবে। তারপর রেলভবনের বিশেষজ্ঞগণ পারচমেন্ট কাগজের উপর ওই খসড়াটি চূড়ান্তরূপে লিপিবদ্ধ করে ফেলবেন। তারপর ঘোষণার চূড়ান্ত লিপিটি রেল বোরডের চেয়ারম্যানের হাতে অর্পণ করা হবে। তারপর রেল বোরডের চেয়ারম্যান ঘোষণা লিপিটি ভালো করে বাঁধিয়ে রেলমন্ত্রীর করকমলে উৎসর্গ করবেন। তারপর রেলমন্ত্রী মহোদয় আকাশবাণীর বিশেষ অনুষ্ঠান মারফৎ স্বকণ্ঠে পাঠ করে শোনাবেন।

রেল ভবনের যে বিশেষজ্ঞদল রেলগাড়ি চালাবার এই মিশ্র পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন তাঁদের চেয়ারম্যান শ্রীগড়গড়ি জানান, এই মিশ্র পদ্ধতি প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় রেলে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা দেবে।

সাংবাদিকগণের প্রশ্নের উত্তরে শ্রীগড়গড়ি বলেন, ‘আমরা শুধু এইটুকু বলতে পারি যে আমরা প্রস্তুত। এখন সবুজ সংকেত পেলেই আমরা ভারতীয় রেলে মিশ্র পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফেলতে পারি।’

সাংবাদিকগণ মিশ্র পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত সংবাদ জানতে চাইলে শ্রীগড়গড়ি বলেন, ‘মাননীয় রেলমন্ত্রীই তাঁর ঘোষণা মারফৎ এই সম্পর্কে যাবতীয় জ্ঞাতব্য আপনাদের জানাবেন।’ অতঃপর তিনি আর কিছু জানাতে অসম্মত হন।

রেল ভবনের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, মিশ্র পদ্ধতির প্রয়োগের পর রেলের চাকা বধের প্রশ্নই আর উঠবে না।

রেল ভবনের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা এই ইংগিতটি উপর ভিত্তি করে সংবাদপত্রের সন্ধানী প্রতিবেদকগণ যে নিবিড় তদন্ত চালান তাতে একটা বিষয়ে সকলেই একমত হন যে, রেল ভবন উদ্ভাবিত এই যুগান্তকারী মিশ্র পদ্ধতির সঙ্গে রেলের চাকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কারণ, একটা বিষয় তো পরিষ্কার যে, রেলের চাকাই হচ্ছে ভারতীয় রেলের সব চাইতে দুর্বল জায়গা। পূর্ব পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে যে রেলের চাকা বন্ধ হলেই রেলগাড়ি অচল হয়ে পড়ে। চাল অথবা কয়লার চোরা কারবারীই হোক কি ওয়াগন ব্রেকার হোক, কি রেল ডাকাতই হোক, তারা তাদের দুষ্কর্ম হাসিল করার জন্য পথের মাঝখানে অর্থাৎ তাদের সুবিধাজনক স্থানে রেলের চাকা বন্ধ করে দেয়। ফলে রেলগাড়িকে অসহায় অবস্থায় থেমে পড়তে হয়। এবং দুষ্কৃতকারীরা নিজেদের কাজ বাগিয়ে নিয়ে তারপর সহজেই গা ঢাকা দেয়। অতএব দেখা যাচ্ছে রেলগাড়ি চলাচলের পক্ষে রেলের চাকা আদৌ নির্ভরযোগ্য নয়।

‘ডোনট কোট মি’ রেলের দায়িত্বশীল মহলের একজন কেউ-কেটা জনৈক নাছোড়বান্দা বিশেষ প্রতিবেদককে জানান, ‘স্বার্থপর রেলকর্মীরাও মাঝে মধ্যে রেলের চাকা বন্ধ করো, এই ধরনের আওয়াজ তুলে- যদিও সুখের কথা যে এই ধরনের স্বার্থপর রেলকর্মীদের সংখ্যা অতি নগণ্য, এবং রেলকর্মীদের উপর তাদের প্রভাব অতি সামান্য— যাত্রী সাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এতে একটা জিনিস এই বোঝা গেল যে রেলের চাকা যতক্ষণ আছে ততক্ষণ রেল চলাচল অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। নয় কি?

‘তার মানে’, উক্ত উৎসাহী বিশেষ প্রতিবেদক প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা কি রেলগাড়ির চাকাকে আপদ স্বরূপ মনে করছেন?’

‘ওয়েল, নট একজ্যাকটলি।’ দায়িত্বশীল মহলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তিটি বলেন, ‘তবে ব্যাপারটি কি তাই দাঁড়াচ্ছে না। দেখছেন না, ইচ্ অ্যানড্ এভরি স্কাউনড্রেলের ঐ চাকার দিকে নজর।’

‘চোরের নজর যেমন বোঁচকার দিকে।

‘ভালো বলেছেন। চাকা যে রেলের একটা ভালনারেবল অংশ, সেটা স্বীকার করেন তো।’

‘আপনার কথা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে। তা রেলের চাকা কি এখন খুবই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে?’

‘কই না তো। কেন, আপনার কি তাই মনে হচ্ছে? এখন আমাদের চাকা নিয়ে কোনোই সমস্যা নেই। এখন নরম্যাল টাইম থেকেও অফিসিয়ালি আমাদের অবস্থা খুব ভালো। রোজই অন্য দিনের চাইতে যাত্রী ও মালগাড়ির চাকা বেশি সংখ্যায় চলছে। এখন আমাদের কোনও ওয়ারি নেই।’

‘তাহলে চাকা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?’

‘ওটা ভাবছি নরম্যাল টাইমের জন্য। নরম্যাল টাইমেই তো আমাদের ঝঞ্ঝাট বেশি।’

‘তা চাকা সমস্যা সম্পর্কে আপনারা কিছু ভাবছেন?’

রেলের দায়িত্বশীল মহল, এ ব্যাপারে হ্যাঁ না কিছুই বলতে রাজি হননি।

অন্য সূত্রে পাওয়া এক খবরে জানা গেল, রেল চলাচল যাতে কোনও অবস্থাতেই বন্ধ না থাকে তার জন্য রেল ভবন যে মিশ্র পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন, তা নাকি গোপনে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। এবং যেখানে এই পরীক্ষা হয় সেখানে রেলমন্ত্রী এবং অতি বিশ্বস্ত কিছু উচ্চপদস্থ অফিসার ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরীক্ষার ফল দেখে রেলমন্ত্রী খুবই সন্তুষ্ট হয়েছেন।

এই মিশ্র পদ্ধতি সম্পর্কে এক অসমর্থিত খবরে প্রথমে জানা গিয়েছিল যে, রেলের চাকা ভবিষ্যতে কেউ যাতে বন্ধ করতে না পারে সেই জন্য রেল ভবনের নির্দেশে রেলগাড়ি থেকে সব চাকা খুলে নেওয়া হবে। পরে শোনা গেল, রেল ভবন এখনই অতদূর যেতে চান না। তাঁরা এখন ব্রেকের উপরই পরীক্ষা চালাচ্ছেন। রেল বিশেষজ্ঞরা নাকি বলেছেন, রেলের চাকা বন্ধ হবার জন্য চাকার ততটা ত্রুটি নয়। ত্রুটি হচ্ছে ব্রেকের। ব্রেকই চাকাকে থামিয়ে দেয়। এবার থেকে তাই কোনও গাড়ি এমন কি ইঞ্জিনেরও ব্রেক থাকবে না। রেলগাড়ি চালাবার এইটেই নাকি মিশ্র পদ্ধতি।

রেলমন্ত্রী পরীক্ষার ফলাফল দেখে এমনই উৎসাহ বোধ করছেন যে অবিলম্বে এই মিশ্ৰ পদ্ধতি উদ্বোধনের ঘোষণা করতে চান। কিন্তু রাজ জ্যোতিষী সবুজ সংকেত দেখাতে পারছেন না কারণ রেলে এখন সবুজ সংকেত দেখাবার লোকের নাকি অভাব ঘটেছে।

১৫ মে ১৯৭8

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *