রেফ্রিজারেটর

রেফ্রিজারেটর

সুপ্রভা স্থির হয়ে বসে আছে। সে নড়াচড়া করতে পারছে না। এই অবস্থাতেই সে ঠিক করেছে, নিজে কোনও সিদ্ধান্ত নেবে না। হাসি বা কান্না যেটা আগে আসবে সেটাই সে সহজভাবে মেনে নেবে।

সুপ্রভা পিঁড়িতে বসতে পারে না, কোমরে লাগে। তবু সে এখন পিঁড়িতে বসে আছে। আজ ভোরে গ্যাস ফুরিয়ে গেছে। সুপ্রভাকে স্টোভ জ্বালাতে হয়েছে। স্টোভে রান্না করতে হলে পিঁড়িতে বসা ছাড়া উপায় নেই। তা ছাড়া পিঁড়িতে বসা তাকে অভ্যেস করতে হবে। কোমরে লাগলেও করতে হবে। কারণ, গ্যাস করে নেওয়া যাবে বলা যাচ্ছে না। মনে হয় না খুব তাড়াতাড়ি। বুলি-গদাইয়ের বাবার অফিসে সমস্যা চলছে। গতমাসের পনেরো তারিখ আদ্দেক বেতন হয়েছিল। আর এ-মাসে একুশ তারিখ হতে চলল, এখনও কিছুই হয়নি। তবে সুপ্রভাকে কোনও দোষ দেওয়ার নেই। সে সকালেই বিশ্বনাথের কাছে গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলেছে। বিশ্বনাথ গম্ভীর হয়ে বলে, ‘আঃ, বিরক্ত কোরো না তে। কাগজ পড়তে দাও।’ বিশ্বনাথের এই একটা ব্যাপার হয়েছে। মাইনে নিয়ে যত গোলমাল হচ্ছে, তত সে কাগজ পড়ায় মন দিচ্ছে। যেটুকু সময় বাড়িতে থাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে কাগজ পড়ে। দু’মাসের টাকা বাকি থাকায় গত সপ্তাহে হকার খবরের কাগজ দেওয়া বন্ধ করেছে। এতে বিশ্বনাথের কোনও অসুবিধে হয়নি। সে আলমারির মাথা থেকে পুরনো কাগজ নামিয়ে নিয়েছে। সুপ্রভা ঠিক করেছিল, আজ পুরনো কাগজ সব বিক্রি করে দেবে। কিন্তু আজ আর কিছুই হবে না। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

সুপ্রভার সামনেই স্টোভে-বসানো দুধ উথলে পড়েছে ডেকচি থেকে। উপচে-পড়া দুধ গড়িয়ে চলেছে রান্নাঘরের লাল সিমেন্টের মেঝেতে। পাশেই পড়ে আছে মুড়ির ছেঁড়া প্যাকেট। কয়েকটা মুড়ি ছড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে, কয়েকটা আবার গা ভাসিয়েছে গড়ানো দুধে। এই দৃশ্য দেখার পক্ষে খারাপ নয়। ফুলোফুলো মুড়িগুলোকে সেভাবে দেখলে হয়তো মনে হতে পারত, দুধ-সাদা সাগরে পক্ষীরাজ নৌকো চলেছে পাল উঁচিয়ে!

সুপ্রভা অবশ্য সেদিকে দেখছে না। সে দেখছে তার হাতে ধরা কাগজের টুকরোটা। একচিলতে হলুদ রঙের কাগজ। চারপাশে সোনালি বর্ডার। তাতে লাল রং দিয়ে সামান্য কয়েকটা লাইন ছাপা হয়েছে। তিন ভাষাতেই রয়েছে, বাংলা, ইংরেজি এবং হিন্দিতে। বাংলাটাই শুধু পড়েছে সুপ্রভা। একবার-দু’বার নয়, গুনে গুনে সাত-সাতবার পড়েছে। প্রথমবার পড়বার সঙ্গে ছিল চরম অবহেলা ফালতু কাগজের টুকরো ফেলে দেওয়ার আগে যেভাবে পড়তে হয়। তারপর পড়ল পরপর দু’বার। সেই পড়ার পেছনে ছিল গভীর অবিশ্বাস। নিজের ওপর গভীর অবিশ্বাস। নিশ্চয় চোখের ভুল। চোখের ভুল নয়, মনের ভুল। মনের ভুল হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। অভাবের সময়ে মানুষের মনে চাপ থাকে। সেই চাপ নানারকম ভুল জিনিস দেখায়। এও নিশ্চয় সেরকম একটা ঘটনা। সে স্থির হয়ে গেছে।

কী করবে এখন? বুলিকে ডাকবে? বুলি পাশের ঘরেই আছে। বেলা হয়ে গেলেও বিছানা ছাড়েনি। দু’দিন ধরে জ্বর মেয়েটার। একটু আগেই সুপ্রভা ও-ঘরে গিয়েছিল দেখতে। আবছা অন্ধকারে বুলি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। সুপ্রভা পায়ের কাছের জানলাটা খুলল। খুলে তেমন লাভ হল না। এ-বাড়ির জানলা-দরজাগুলো সব আশ্চর্যরকম ছোট ছোট। ভাল করে আলো বাতাস ঢুকতে পারে না। বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময়, বিষয়টা সুপ্রভার নজরে এসেছিল। বিশ্বনাথকে কথাটা বলতে সে বলল, ‘বাড়িটার এটাই যে ডিফেক্ট বলতে পারো। সামান্য ডিফেক্ট। জানলা-দরজাগুলো একটু ছোট মাপের। শাড়িতে যেমন ছোটখাটো গোলমাল থাকলে তোমরা সেল পাও। এই বাড়িটারও তেমন। জানলা দরজার গোলমালে, ভাড়াটা কম হল। সেটাও তো দেখতে হবে। আমি অবশ্য তেমন কিছু ছোট দেখছি না। ধ্যাড়ধ্যাড়ে জানলা-দরজা দিয়ে হবেটা কী? বলো হবেটা কী? এটা তো দার্জিলিং নয় যে জানলা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবে।’

‘তা বলে সদর দরজাটা এত নিচু হবে? মনে হচ্ছে ঢুকতে গেলে মাথা ঠুকে যাবে।’

বিশ্বনাথ হেসে বলল, তুমি এমনভাবে বলছ যেন আমাদের বাড়িতে রোববার রোববার অমিতাভ বচ্চন আসবে। তা ছাড়া ও তোমার মনে হচ্ছে, আসলে ঠুকবে না। ক’দিন যেতে-না-যেতে অভ্যেস হয়ে যাবে। একবার অভ্যেস হয়ে গেলে দেখবে ছোট-বড় সব এক লাগে।’ সুপ্রভা বলল, ‘তা বলে চিরটা কাল এভাবে মাথা বাঁচিয়ে ঢুকতে-বেরোতে হবে?’ বিশ্বনাথ এবার সুপ্রভার কাঁধে হাত রাখল। বলল, ‘ক’টা দিন চালিয়ে দাও সুপ্রভা। পরে মাইনেটাইনে বাড়লে বাসা বদলে নেওয়া যাবে। শুনেছি, প্রমোশনের পর কোম্পানিতে হাউস বিল্ডিং লোনেরও প্রভিশন আছে। বলা তো যায় না, সেরকম হলে রাজারহাটের দিকে একটা ফ্ল্যাটও তো নিয়ে নিতে পারি। সাউথফেসিং ফ্ল্যাট। আরে বাবা, সুযোগের জন্য অনেক অপেক্ষা করতে হয়।’

বারো বছর হতে চলল সেই সুযোগ এখনও আসেনি। বাড়ি বদল হয়নি। তবে অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন আর দরজা-জানলা ছোট লাগে না। মাঝেমধ্যে সুপ্রভার মনে হয় নিজেরাই বুঝি ছোট হয়ে গেছে!

জানলা খোলার শব্দে বুলি কম্বল সরাল। আহা, দু’দিনের জ্বরে মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেছে। মেয়ের প্রতি সুপ্রভার বাড়তি দুর্বলতা আছে। আজকাল তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুশ্চিন্তা। ইদানীং মনে হচ্ছে, এ-বাড়িতে বুলিকে ঠিক মানাচ্ছে না। গরিবের সংসারে কালো মেয়ে সুন্দর আর বুদ্ধিমতী হওয়া ভাল কথা নয়। যত তাড়াতাড়ি এ-মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় তত মঙ্গল। বুলির বাবার সঙ্গে কথা বলা দরকার। মেয়ে সবে কলেজে ঢুকেছে। তাতে অসুবিধে কিছু নেই। আজকাল বিয়ে করেও অনেক মেয়ে পড়াশোনা করে। বুলিও করবে। তা ছাড়া, পড়াশোনায় সে তো খুবই ভাল। সমস্যা হল, যে-মেয়ের বাবার বেতন নিয়ে বড় ধরনের গোলমাল শুরু হয়েছে, তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে নিয়ে আলোচনা করতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? নিজের অজান্তেই সুপ্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুলি শুয়ে শুয়েই বলল, ‘কী বাইসনের মতো ফোঁসফোঁস করছ মা? ওরকম কোরো না তো, আমার ঠান্ডা লেগে যাবে।’ সুপ্রভা মেয়ের কপালে হাত রাখলেন। ছ্যাঁকছ্যাঁক করছে। টাইফয়েড নয় তো? বুলি কপালে রাখা মায়ের হাতটা ধরল। হাসিমুখে বলল, ‘বাইসন বললাম বলে রাগ করলে মা?’ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সুপ্রভা গম্ভীর মুখে বলল, ‘না রাগ করব কেন? খুশি হয়েছি। যে-সংসারে কুকুর-বেড়ালের মতো খাটতে হয়, সেখানে বাইসন তো একটা ভাল জিনিস। নে ওঠ, বিছানাটা করতে দে।’ বুলি আবার হাসল। বলল, ‘ওফ মা, তুমি সবকিছু এত সিরিয়াসলি নাও কেন?’ সুপ্রভা বলল, ‘না না, সিরিয়াসলি নেব কেন? খুবই হালকাভাবে নিই। এই যেমন রান্নার গ্যাস ফুরিয়ে গেছে, আমি কি সিরিয়াসলি নিয়েছি? কখনই নয়। তারপর ধর, মনে হচ্ছে তোর টাইফয়েড ধরনের বড় কিছু একটা হয়েছে, ভাল ডাক্তার দেখানো দরকার। অথচ তোর বাবার কোনও খেয়ালই নেই। তাও কি আমি সিরিয়াসলি নিচ্ছি? একটা কথাও বলতে দেখছিস আমাকে? বরং বেশ হাসিই পাচ্ছে বলতে পারিস। সামনের সোমবার ছোড়দির ননদের ছেলের মুখেভাত। যত সামান্যই হোক সোনার কিছু দিতে হবে। কোন মুদির দোকানে বাকিতে সোনার আংটি পাওয়া যায় তা নিয়ে আমার এখন সিরিয়াসলি ভাবতে বসা উচিত ছিল। আমি কি তা ভাবছি? একেবারেই ভাবছি না। আর একটা কথা যদি বলি, তা হলে তুইও হাসতে হাসতে খাট থেকে গড়িয়ে পড়বি। কোমরে এমন লাগবে যে, চুন-হলুদ গরম করে লাগালেও কমবে না। আচ্ছা, তাও শোন। খাটটা শক্ত করে ধর, ধরে তারপর শোন। আজ একুশ তারিশ হয়ে গেল তোর বাবা এখনও অফিস থেকে মাইনে পায়নি। পরে বলে মনে হচ্ছে না। কেমন মজা বল তো? হাসি পাচ্ছে না?’

বুলি উঠে বসল। গম্ভীর মুখে বলল, ‘মা, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই আবার একটা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর শুরু হবে। আর ভূমিকম্পের মতো সেই দুর্ভিক্ষের এপিসেন্টার হবে এই বাড়িটি। আড়াইশো ‘হর পরে টরেন্টো বা মিশিগান ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা পটাটো চিপস আর মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাতে নিয়ে এই বাড়ির ধ্বংসস্তুপ দেখতে আসবে। হিস্টোরিকাল এক্সকারশন। আমাদের বাড়িওয়ালা নিতাই এখন বেঁচে থাকবেন না। কিন্তু তাঁর ভূত বেঁচে থাকবে। সেই ভূত মাথা চাপড়াবে আর কাঁদবে, ইস কেন বেঁচে থাকতে থাকতে টিকিটের ব্যবস্থা করে এলাম না গো। হা হা।’ বিছানা তুলতে তুলতে সুপ্রভা বলল, ‘ঠাট্টা করছ করো। তোমাদের বাবা এমন একটা ঠাট্টার সংসারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, তোমাদের আর দোষ কী?’

শরীর দুর্বল, তবু বুলি খাট থেকে একরকম লাফ দিয়ে নামল। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা, তোমাকে কতবার বলেছি না, সকালবেলা বেশি রাগ করবে না। দিনের শুরুতেই চট করে সব রাগ ফুরিয়ে গেলে পরে কী করবে? কিছু খেতে দাও দেখি। খিদেতে পেট চুঁইচুঁই করছে। আমার শরীর এখন একদম ভাল। পুরো ঝরঝরে। পেট পুরে খাব। খাওয়ার পর গদাইকে পাঠাব সোহিনীকে ডেকে আনতে। আজ সোহিনীর সঙ্গে ম্যারাথন গল্প করবার প্রোগ্রাম। এমন গল্প করব যে, সন্ধেবেলা গিনেস বুক থেকে আমাদের ছবি চেয়ে পাঠাবে। তোমার কাছে আমার একটা ভাল ছবি পাওয়া যাবে কি?’

কাল রাতের ক’টা রুটি আছে। সুপ্রভা ভাবল, অল্প ঘি মাখিয়ে রুটিগুলো গরম করে বুলিকে দেবে। ক’টা আলু চিরে ভেজে নেবে। সামান্য সাঁতলে দুটো কাঁচা লঙ্কা দিলে আরও ভাল। জ্বরের মুখে অরুচি ছাড়বে। রান্নাঘরে এসে সুপ্রভা দেখল, ঘি নেই। আলু পড়ে আছে মাত্র একটা। রুটিগুলোও শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে গেছে। তা হলে বুলিকে কী দেবে? দুধ-মুড়ি দিলে কেমন হয়? দুর্বল শরীরে দুধ খাওয়া ভাল। ডেকচির ঢাকা সরিয়ে সুপ্রভা দেখল, দুধের অবস্থাও খুব খারাপ। একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। মুড়ির কৌটোতে মুড়ি রয়েছে মোটে এক মুঠো। সুপ্রভা নিজের মনেই যেন একটু হাসল। বুলি তা হলে ঠিকই বলেছে। দুর্ভিক্ষ মনে হয় সত্যি শুরু হয়ে গেল। জল ঢেলে দুধ বাড়াতে বাড়াতে সে গদাইকে ডাকল।

গদাই ছাদে। তার কোলের ওপর ইতিহাস বই। গদাইয়ের পড়ার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, এক সপ্তাহ পরেই তার বার্ষিক পরীক্ষা শুরু। আসল ঘটনা উলটো। তার পরীক্ষা শেষ হয়েছে এক সপ্তাহ আগে। পরীক্ষা দিতে দিতেই গদাই বুঝতে পেরেছে, এবারও সে ক্লাস সেভেনে উঠতে পারছে না। তাই সময় নষ্ট না করে সে আগামী বছরের জন্য তৈরি হচ্ছে। প্রতিবারই সে এমন করে। ফল প্রকাশের আগেই পুরনো ক্লাসের পড়া শুরু করে ফেলে। গদাই পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। তবু রহস্যজনক কোনও কারণে তার পাশ করা হয় না। সেই রহস্য নিয়ে গদাই অবশ্য মাথা ঘামায় না। তার কাজ পড়া, সে পড়ছে। যেমন এখন গদাই পড়ছে, শের শাহের কীর্তি। একটু বেশি চেঁচিয়ে পড়ছে। এবার ইতিহাস পরীক্ষা খারাপ হয়েছে তাই বেশি চেঁচাচ্ছে। সেই চিৎকার ছাপিয়ে মায়ের ডাক শুনতে তার সময় লাগল। খুবই বিরক্তির সঙ্গে সে নীচে আসে এবং সুপ্রভার কথামতো ছুটে গিয়ে গলির মুখের দোকান থেকে মুড়ি নিয়ে আসে। গোটা সময়টা তার বগলে ইতিহাস বই ছিল।

মুড়ি হাতে নিয়ে সুপ্রভা আকাশ থেকে পড়ল। এ কী! এটা মুড়ি না অন্য কিছু? ঝলমলে প্লাস্টিকের প্যাকেট। প্যাকেটের মুখ সিল করা। গায়ে কোম্পানির সিলমোহর। দেখে মনে হচ্ছে মুড়ি নয়, বড়দিনের কেক। প্যাকেটের গায়ে দাম ছাপা আছে, সাড়ে আট টাকা। অ্যাঁ! সাড়ে আট টাকা দিয়ে মুড়ি! মুড়ি হবে আট আনা, খুব বেশি হলে এক টাকা কি দু’টাকা। এই অভাবের সময় পয়সা নষ্ট! ইস, গাধাটাকে দশ টাকার নোট দেওয়াই ভুল হয়ে গেছে। সুপ্রভা স্টোভে দুধ চাপাতে চাপাতে গম্ভীর গলায় গদাইকে বলল, ‘বাবা কত বেতন পায় জানো? কী হল, জানো কত পায়? মনে হয় না জানো। বাবার বেতন জানা থাকলে তুমি সাড়ে আট টাকার মুড়ি আনতে পারতে না। যাও, এ জিনিস ফেরত দিয়ে এসো। দোকানদারকে বলবে, ঠোঙায় দু’টাকার মুড়ি দিন।’ গদাই বলল, ‘আমি বলেছিলাম। রবীনকাকু বলল, ‘ওসব ঠোঙাফোঙা উঠে গেছে, এখন সব প্যাকেট সিস্টেম।’ সুপ্রভা বলল, ‘ঠিক আছে পড়তে যা। আমি নিজে দোকানে যাব। ওর সিস্টেম আমি বের করে ছাড়ছি।’

গজগজ করতে করতে সুপ্রভা মুড়ির প্যাকেটে টান মারল। টানার জোরে হাওয়ায় কয়েকটা মুড়ি ছিটকে মেঝেতে পড়ল। সেই সঙ্গে পড়ল একচিলতে হলুদ কাগজ। কাগজ না বলে কাগজের টুকরো বলাই ভাল। সুপ্রভা অবহেলায় সেই কাগজ তুলে ফেলে দিতে গেল। দলা পাকানোর মুহূর্তে চোখ পড়ল কাগজের ওপর। সোনালি দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা —‘অভিনন্দন! অভিনন্দন! অভিনন্দন!! মাননীয়া গৃহিণীকে আমাদের কোম্পানির পক্ষ থেকে শত কোটি অভিনন্দন। শত কোটি প্রণাম। শত কোটি সেলাম। প্রতি দশ লক্ষ মুড়ির প্যাকেটের মধ্যে মাত্র একটিতে আমরা রেখেছি এই পুরস্কারের কুপন। আপনি সেই ভাগ্যবতী গৃহিণী, যিনি কুপনটি পেয়েছেন। আপনাকে আবার অভিনন্দন। আবার প্রণাম। আবার সেলাম। নীচের ঠিকানায় এই কুপন দেখালে আপনি বিনামূল্যে একটি রেফ্রিজারেটর পাবেন। রেফ্রিজারেটরটি ট্রিপল ডোরের। ডিপফ্রস্ট সুবিধাযুক্ত।

পুনশ্চ: শোরুম থেকে উপহার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার খরচ আপনার নিজের। এ ব্যাপারে কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা বাঞ্ছনীয় নয়।’

এই লেখা মানুষকে স্থির করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। সুপ্রভা তাই স্থির হয়ে আছে। কোথা থেকে যেন পোড়াপোড়া গন্ধ ভেসে আসছে। কিছু কি পুড়ছে? পুড়ুক, পুড়ুক, যত খুশি পুড়ুক। এমন ভয়ংকর ঘটনার কাছে পুড়ে যাওয়া কিছুই নয়। মুড়ির প্যাকেটে আস্ত একটা রেফ্রিজারেটর!

দুধ ধরার গন্ধে বুলি রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অবাক হয়ে বলল, ‘একী মা! কী হয়েছে তোমার? এরকম স্ট্যাচু হয়ে গেছ কেন?’ সুপ্রভা কোনওরকমে ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়ের দিকে তাকাল। তারপর কাগজের টুকরোটা বাড়িয়ে দিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘কী হবে বুলি? কী হবে আমাদের?’

গলির মুখেই টেলিফোন বুধ। বুথ এত সকালে খোলে না। তবু গদাইকে দেখতে পাঠানো হয়েছে। বুথ খোলা থাকলে সে এসে জানাবে। তারপর সুপ্রভা বিশ্বনাথের অফিসে টেলিফোন করতে যাবে। বাড়িওয়ালা নিতাইবাবুর ফোন আছে। কিন্তু বুলিরা গেলেই সেই ফোন খারাপ হয়ে যায়। তাই বাইরে যাওয়া।

হতভম্বের প্রথম স্তর পেরিয়ে সুপ্রভা এখন দ্বিতীয় স্তরে ঢুকেছে। প্রথম স্তরের হতভম্বভাবে মানুষের যেমন নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়, দ্বিতীয় স্তরে তেমনি নড়াচড়া বেড়ে যায়। সুপ্রভারও তাই হয়েছে। এখন তার নড়াচড়া বেড়ে গেছে। ঘর বারান্দা করছে। একবার চটি পরছে, একবার খুলছে। তার হাতে কিছু খুচরো পয়সা। টেলিফোন করবার পয়সা। মাঝেমধ্যেই সুপ্রভা সেই পয়সা গুনছে, পরক্ষণেই মনে হচ্ছে গোনা ভুল হয়েছে। আবার গুনছে।

খাটের ওপর বসে আছে বুলি। তার হাতে প্লেট। তাকে মুড়ি দেওয়া যায়নি। মুখ বন্ধ করে মুড়ির প্যাকেট তুলে রাখা হয়েছে আলমারিতে। বুলিকে বাসি রুটিই দেওয়া হয়েছে। একটু আগে তার খিদে পাচ্ছিল। রুটি ছেঁড়ার পর আর মুখে তুলতে ইচ্ছে করছে না। তার এখন শুধু মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। মাকে এত আনন্দ পেতে সে বহুদিন দ্যাখেনি। তার খুব ভাল লাগছে। এত ভাল লাগছে যে, চোখে জল এসে যাচ্ছে।

সুপ্রভা বলল, ‘হ্যাঁরে বুলি, আর একটু বেশি পয়সা নিয়ে যাব?’ বুলি রুটি সরিয়ে শুধু আলুভাজার একটা টুকরো মুখে দিল। বলল, হ্যাঁ, বেশি করে নিয়ে যাও। একেবারে ডাক্তার দেখিয়ে, ওষুধ কিনে ফিরবে।’

‘ডাক্তার! ডাক্তার দেখাব কেন?’

‘কেন দেখাবে, সে আর নিজে বলতে হবে না। ডাক্তারবাবু তোমাকে দেখলেই বুঝতে পারবেন। পাগলের ডাক্তারদের অসুখের কথা মুখে বলতে হয় না। আলুভাজাটা আর একটু কড়া করবে তো। একেবারে প্যাতপ্যাত করছে। তোমার যা অবস্থা দেখছি, তাতে ক’দিন বাড়িতে কাঁচাকাঁচা সব খেতে হবে মনে হচ্ছে।’

সুপ্রভা বলল, ‘ফাজলামি করছিস?’

‘ফাজলামি করব কেন? অমন একটা জিনিস বিনাপয়সায় পেলে মাথা খারাপ হওয়া মোটেই আশ্চর্য কিছু নয়। লটারির টাকা পেয়ে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঘটনা তো আকছার ঘটে। কাগজে পড়ো না? তোমার তো অল্পই হয়েছে। ব্রেন অ্যাটাক। তুমি একটা রেফ্রিজারেটরের দাম জানো?’

সুপ্রভা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘জানব না কেন? তোর বাবা তো আমাকে সব সময়ই এটা-সেটা কিনে দিচ্ছে। এই তো সেদিন একটা ওয়াশিং মেশিন দিল। ক’দিন আগে বলল, তোমার মশলা বাটতে কষ্ট হয়, তোমাকে ছোড়দির মতো একটা মিকসি কিনে দেব। ওমা, বিকেলে দেখি উনি ব্যাগে ঝুলিয়ে মিকসি কিনে এনেছেন! আমি রেফ্রিজারেটরের দাম জানব না তো কে জানবে?’

বুলি শব্দ করে হেসে উঠল। সে উঠে এসে মায়ের হাত ধরল, একরকম টেনেই খাটে এনে বসাল। বলল, ‘দারুণ, ওয়ান্ডারফুল, আমার সঙ্গে থেকে থেকে তোমার দেখছি খুব উইট সেন্স গ্রো করেছে। আমার পাশে চুপ করে বোসো তো। এমন ছটফট কোরো না, অসুস্থ হয়ে পড়বে। মাথাফাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে গেলে একটা কেলেঙ্কারি। আগে জিনিসটা বাড়িতে আসুক। তারপর যত ইচ্ছে অজ্ঞান হও। তখন বরফের কোনও অভাব হবে না। ফ্রিজ থেকে বের করব আর মাথায় ঘষব।’

‘হ্যাঁরে বুলি, সত্যি তো? কাগজটা দেখালেই একটা সত্যিকারের রেফ্রিজারেটর দিয়ে দেবে? পয়সাকড়ি কিছু চাইবে না বলছিস?’

বুলির সন্দেহ আছে। অঞ্জনার মেজকাকার একবার এরকম হয়েছিল। রেডিয়োর বদলে পার্শেলে রেডিয়োর খোল পেয়েছিল। সে ঘটনা জানাজানি হয়ে যায়। পাড়ার ছেলেরা অঞ্জনার মেজকাকাকে পেছন থেকে ‘রেডিয়োকাকা’ বলে ডাকত। মা’র বেলাতেও যে সেরকম কিছু ঘটবে তাতে বুলির কোনও সন্দেহ নেই।

তবু মাকে এখন এসব কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মানুষটা যেটুকু সময় খুশিতে থাকে থাক না। বুলি মাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সত্যি কেন হবে না? তা ছাড়া দোকানে খোঁজ নিলেই তো জানা যাবে। ঠিকানা তো দেওয়াই আছে।’

‘আমি বাবা দোকানটোকানে যেতে পারব না। ভীষণ ভয় করছে। যা করবার তোর বাবা এসেই করবে।’

‘সেই জন্যই তো বলছি, এখনই লাফালাফি কোরো না। যত কম লোকে জানে তত ভাল। শেষে সবাই হাসবে। সেরকম হলে তোমাকে ‘রেফ্রিজারেটর মাসিমা’ বলেও ডাকতে পারে। আর যদি সত্যি হয়, তা হলে তো দারুণ। পাড়ার সবাইকে ডেকে একদিন পেট ভরে বরফের কিউব খাইয়ে দেব।’

সুপ্রভা চোখ সরু করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বরফ খাওয়াব মানে? আবার ফাজলামি করছিস নাকি?’

‘কী যে বলো মা, রেফ্রিজারেটরের জন্য তো বরফই খাওয়াতে হবে, গরম কিছু খাওয়ালে তো চলবে না। দেখো না, সবাই কেমন খুশিতে বরফ চুষবে আর বলবে, আহা, কী জিনিস খাওয়ালেন দিদি। বরফ তো কম খাইনি কিন্তু এমন ঠান্ডা বরফ খাইনি কখনও।’

গদাই হাসিহাসি মুখে ফিরে এসে জানাল, বুথ এখনও খোলেনি। তবে সে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে এসেছে। সুপ্রভা আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘কী করে এসেছিস? কথাটা কাউকে বলেছিস নাকি? কী সর্বনাশ!’ গদাই বলল, ‘কী যে বলো না মা। আমাকে তুমি বোকা পেয়েছ? ফ্রিজের কথা বলতে যাব কেন? ফোনের কথা বলেছি। পল্টুদা চায়ের দোকানে ছিল। আমাকে বলল, কী রে ছুটছিস কেন? আমি বললাম, বাবার অফিসে এক্ষুনি ফোন করতে হবে। পল্টুদা বলল, তাই নাকি? কী হয়েছে? আমি বললাম, দারুণ একটা ব্যাপার হয়েছে। কাউকে বলা যাবে না। পল্টুদা বলল, ঠিক আছে তুই যা আমি সাইকেল নিয়ে আসছি।’ বুলির মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সে বলল, ‘কেন, সে আসবে কেন? সে কি সঙ্গে টেলিফোন নিয়ে আসবে?’

সুপ্রভা পল্টু নামের যুবকটিকে মোটেও পছন্দ করে না। একে তো বেকার, তার ওপর কেমন যেন হাঁদা ধরনের। বাড়িতে এলে বুলির বাবা তাকে নানা ধরনের ফাইফরমাশ করে। ঘরের কাটা বাল্‌ব বদলে দাও, গদাইয়ের খাতার মলাট দিয়ে দাও, ইলেকট্রিকের বিল জমা দাও, কলের মিস্ত্রি ডাকো। হাঁদাটাও মহাউৎসাহে সে সব করে। কেন যে করে সুপ্রভা বুঝতে পারে না, তবে বুলি পারে। আর তাই দু’দিন আগে পল্টুকে কড়ারকমের অপমান করেছে সে৷ মশারির পেরেক লাগাতে গিয়ে পল্টু নিজের বুড়ো আঙুলে হাতুড়ির বাড়ি দিয়ে ফেলেছিল সেদিন। আঙুলের অনেকটা নীল হয়ে ওঠে। গাধাটা হাসিহাসি মুখে বলল, ‘বুলি, ডেটল হবে নাকি? একটু দেবে?’ বুলি গম্ভীর গলায় বলে, ‘হবে, কিন্তু দেওয়া যাবে না। ডেটলের দাম জানেন? কাজের লোকদের অত দামের জিনিস দেওয়া যায় না। আপনি জল ঢেলে নিন।’

বুলি ভেবেছিল, এই অপমানের পর পল্টুর আসা কমবে। এখন বোঝা যাচ্ছে, ছেলেটা সত্যি গাধা।

পল্টুর কথা শুনে সুপ্রভা বলল, ‘আহা, আসুক না। বিপদের সময় বাড়িতে একটা পুরুষমানুষ থাকলে ভাল হয়।’

‘বিপদের সময়! বিপদ কোথায়?’

‘ওই হল, তুই চুপ কর তো। ও এলে ঠিক একটা ব্যবস্থা হবে।’

‘কী ব্যবস্থা হবে? তুমি ওর সাইকেলের কেরিয়ারে চেপে ফোন করতে যাবে? তোমাদের কিছু করতে হবে না। আমি সোহিনীর বাড়ি থেকে বাবার অফিসে ফোন করে দিচ্ছি। গদাই, তোর পল্টুদা এলে বলবি, ধন্যবাদ, ফোন করা হয়ে গেছে। আপনি নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারেন।’

সোহিনীর বাড়ি পর্যন্ত যেতে হল না। বুথ খুলে গেছে। রিসিভার হাতে নিয়ে বুলি চট করে ভেবে নিল, বাবাকে কী বলবে। যে-মানুষটা বাড়িতে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে সারাক্ষণ খবরের কাগজে মুখ লুকিয়ে বসে থাকছে, তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে গেলে একটু ভেবে নেওয়া ভাল।

তিনজনের হাত ঘুরে ফোন যখন বিশ্বনাথের কাছে পৌঁছোল, তখন সে টাকা গুনছে। তিনবার গোনা শেষ হয়েছে, এবার চতুর্থবার গুনছে। সাধারণভাবে এক হাজার টাকা চারবার গোনার মতো অত টাকা নয়। কিন্তু এটা সাধারণ টাকা নয়। পুরো বেতনের বদলে প্রত্যেককে আজ কোম্পানি এক হাজার টাকা করে নগদ দিয়েছে। আর দিতে পারবে কিনা সন্দেহ। এই টাকা চারবার গোনা আশ্চর্যের কিছু নয়। এই অবস্থায় মেয়ের কথা ভাল করে বুঝতে পারল না বিশ্বনাথ। তবু বলল, ‘আমি আসছি।’ ফোন নামিয়ে তার কেমন সন্দেহ হল। পাশ ফিরে বলল, ‘দত্তদা, মুড়ির মধ্যে কাঁকর হয় শুনেছি, কিন্তু রেফ্রিজারেটর ব্যাপারটা কী?’ দত্তদা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কী বললে?’ বিশ্বনাথ বলল, ‘রেফ্রিজারেটরের মধ্যে মুড়ি, না মুড়ির মধ্যে রেফ্রিজারেটর— ব্যাপারটা কী বলতে পারেন?’ দত্তদা এবার বিশ্বনাথের দিকে ঘুরলেন। মুখ দিয়ে চুক চুক ধরনের আওয়াজ করলেন। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, ‘তুমি বাড়ি যাও বিশ্বনাথ। বাড়ি গিয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। শোকে চিন্তায় এরকম হয়, মাথার ভেতর তাল বেতাল হয়ে যায় সব। চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

এদিকে বুথ থেকে বেরিয়ে বুলি দেখল সাইকেলে হেলান দিয়ে পল্টু দাঁড়িয়ে আছে। একগাল হেসে বুলির দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। বলল, ‘কনগ্রাচুলেশন।’ বুলি মুখ ফিরিয়ে নিল। গাধাটার হাসিটা বড় সুন্দর। এই হাসির দিকে বেশিক্ষণ তাকানো ঠিক নয়।

সুপ্রভা নীল পাড় দেওয়া সিল্ক বের করেছে। সঙ্গে ম্যাচ-করা নীল ব্লাউজ। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁরে, মানিয়েছে?’ বুলি বলল, মানিয়েছে বলে মানিয়েছে। মা, তোমাকে মনে হচ্ছে ভবানীপুরের রানি। তুমি একটা নীল টিপ পরে নাও মা, মুকুটের মতো লাগবে।’ সুপ্রভা লজ্জা পেল। বলল, ‘ধ্যাত, বাজে কথা বলিস না তো! অত বড় দোকানে যাচ্ছি, ওরকম দামি একটা জিনিস নেব, ভিখিরির মতো গেলে চলে? হ্যাঁরে, তোর কাছে নীল টিপ আছে কিনা? ছোট দিবি কিন্তু।’

বিশ্বনাথ অন্তত কুড়িবার কাগজের টুকরোটা বের করে পড়েছে। তারপর চেয়ারে বসে পা নাড়াচ্ছে আর অনর্গল কথা বলছে। মনে হচ্ছে গত দু’মাসের চুপ করে থাকা পুষিয়ে নিতে চাইছে।

‘হতেই পারে না। অসম্ভব, ইমপসিবল্‌। একেবারে চিটিং। রাম চিটিং। ওরা নিশ্চয় আগে থেকে এ-বাড়ির গিন্নির আইকিউ সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিল, তারপর মুড়ির প্যাকেটে এই কাগজ ভরে দিয়েছে। বুলি, এককাপ চা দিবি নাকি? দুধ নেই? নো প্রবলেম লিকার দে। এখন থেকে বুঝলি লিকার খাব। তোরাও খা। লিকারে তোর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। ক্যান্সারের যম। তোরা তো কাগজ পড়িস না, জানবি কী করে, মূর্খের দল। আরে, তখন থেকে কী অত সাজছ বলো তো? আমার শার্টটা ইস্ত্রি করা নেই। ইস এটা পরে যাওয়া যায়? বুলি, তুই গেলে ভাল করতিস।’ বুলি বলল ‘আমি গিয়ে কী করব বাবা? জিনিসটা কি আমি ঘাড়ে করে আনব?’ বিশ্বনাথ বলল, ‘আহা তা নয়, রংটা তো চয়েস করতে পারতিস। রং চয়েস হল আসল ব্যাপার। কী বলো পল্টু। পল্টু সেই যে সকালে এসেছে এখনও আছে। প্লাগ পয়েন্ট, সুইচ এসব হাঙ্গামা করতেই তো কেটে গেল। দুপুরে খাওয়াদাওয়া হয়নি। তবে এই মুহূর্তে তার খিদে বোধ কিছু নেই। হাসিহাসি মুখে টুল টেনে বিশ্বনাথের সামনে বসে আছে। এখন তার এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সে বিশ্বনাথ এবং সুপ্রভার সঙ্গে রেফ্রিজারেটর আনতে যাচ্ছে। অত বড় একটা জিনিস, লোক লাগবে না? টেম্পো ঠিক করতে হবে, মাল তুলতে নামাতে হবে। এ-বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে তার অনেক রাত হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। পল্টুর খুশিখুশি লাগছে। সে বলল, ‘ঠিকই তো, রংটাই আসল। বুলি চলুক না অসুবিধে তো নেই।’

বুলি কড়া চোখে পল্টুর দিকে তাকাল। বলল, ‘না, অসুবিধে আছে।’

গদাইয়ের হাতে এখনও ইতিহাস বই। তার এসব ভাল লাগছে না। পড়ার সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস তাকে কেউ যাওয়ার কথা বলছে না।

সুপ্রভা বলল, ‘দুর, এর থেকে একটা কালার টিভি দিলে ভাল করত। কতদিন আর অন্যের বাড়িতে টিভি দেখতে যাওয়া যায়।’ ন্যাকড়া দিয়ে জুতোর ধুলো মুছতে মুছতে বিশ্বনাথ বলল, ‘বাজে কথা বোলো না তো৷ টিভি দিয়ে কী হবে? ফ্রিজ মানে জানো? জানো মানে? সাতদিনের বাজার এনে ফেলে দেব। ডিপ ফ্রিজে মাছ-মাংস চিকেন রেখে দেবে। ডিম আনাজপাতির জন্য সব সেপারেট জায়গা। রান্না করেও রাখতে পারো। রাতে গরম করে খেয়ে নাও। ব্যস ঝাড়া হাত পা। তা না, টিভি চাই। যত্তসব হাবিজাবি কথা।’

তেলে টান আছে, বুলি চায়ের সঙ্গে পাঁপড় সেঁকে আনল। পল্টুর এটাই অদ্ভুত লাগে। বুলি কী করে জানল সেঁকা পাঁপড় তার প্রিয়তম খাবার? আশ্চর্য! ভারী আশ্চর্য! বলি পল্টুকে বলল, ‘নিন, আজ পাঁপড় খান। পরের দিন আইসক্রিম খাওয়াব। আইসক্রিম আপনার সহ্য হয়? টনসিল নেই তো?’

বেরোবার সময় সুপ্রভা ঠাকুরের ছবিতে প্রণাম করল। বিশ্বনাথ কাগজের টুকরোটা সাবধানে বুকপকেটে রাখল। মুড়ির প্যাকেট নিল ব্যাগে। মুড়ি লাগবার কথা নয়, তবু যদি লাগে। পল্টু বলল, ‘দিন মেসোমশাই, ব্যাগটা ধরি।’ বিশ্বনাথ বলল, ‘না, এতে দরকারি জিনিস আছে। তুমি বরং এগিয়ে গিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরো।’

বাবা-মা বেরিয়ে যাওয়ার পর বুলি খাটে উঠে পড়ল। বলল, ‘গদাই, আমার শরীরটা ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে, আবার জ্বর আসছে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।’ গদাই বলল, ‘সেকী রে দিদি। ঘুমিয়ে পড়বি কী? জিনিসটা যদি চলে আসে?’ বুলি চাদর মুড়ি দিতে দিতে বলল, ‘খেপেছিস, ওসব কখনও সত্যি হয়? কোনওদিনও আসবে না।’ গদাই খুশি মনে বই খুলে বসল। না এলেই ভাল। আসার আগেই পড়াশোনার যা অসুবিধে হচ্ছে, এলে না জানি কী হবে।

সকাল থেকে রেফ্রিজারেটর নিয়ে কথা হচ্ছে, আজ বুলির উচিত ছিল ঠান্ডা কিছু নিয়ে কোনও স্বপ্ন দেখা। অথচ সে দেখল গরম মরুভূমির স্বপ্ন। বেদুইনরা চলেছে উটের সারি নিয়ে। সেই দলে সে নিজে যেমন আছে তেমনই আছে বাবা, মা, গদাই, পল্টু, সোহিনী, এমনকী বাড়িওয়ালা নিতাইবাবু পর্যন্ত। সকলে বসে আছে উটের পিঠে। পল্টুর কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। বুলিরও খুব গরম লাগছে। পল্টু জিজ্ঞেস করল, ‘মরূদ্যান আর কত দূরে প্রিয়তমা? আর যে পারি না। সূর্যের প্রখর তাপে প্রাণ যে যায়।’ বুলি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আপনাকে না প্রিয়তমা ডাকতে নিষেধ করেছি।’ পল্টু বলল, ‘আমায় ক্ষমা করো।’ বুলির খুব করুণা হল। সে বলল, ‘ঠিক আছে, ক্ষমা করলাম। এখন দেখুন তো আমার গা গরম হয়েছে কিনা। মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে।’ পল্টু হাত বাড়িয়ে হাতটা ধরতেই বুলির ঘুম ভেঙে গেল।

মা তার হাত ধরে টানছে, ‘ওঠ, ওঠ বুলি। উঠে দ্যাখ। রেফ্রিজারেটর নিয়ে এসেছি রে। কী সুন্দর রং, স্কাই ব্লু। এখন অবশ্য কাগজেটাগজে মোড়া আছে। ঘরে ঢুকিয়ে খুলব।’

বুলি ধড়মড় করে উঠে বসল। বলল, ‘ওমা, তোমরা এসে গেছ। এত তাড়াতাড়ি চলে এলে? বাবা কোথায়?’

‘এত তাড়াতাড়ি কোথায়? সন্ধে হয়ে গেছে। তুই বোধহয় অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছিস।’

‘মা, সত্যি রেফ্রিজারেটর এসে গেছে। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। চলো তো বাইরে গিয়ে দেখি।’

বাড়ির বাইরে বিশ্বাস না-হওয়ার মতোই ঘটনা ঘটছে। গেটের বাইরে একটা টেম্পো দাঁড়িয়ে। বিশ্বনাথ টেম্পোর ড্রাইভার আর তার হেল্পারের সঙ্গে ভুল হিন্দিতে প্রচণ্ড ঝগড়া করছে— এমনি এমনি তুমকো সাতশো রুপায়া দিয়া? বোলে এমনি এমনি দিয়া? তুমকো সাথ কেয়া বাত থা? ঠিক হয়েছিল, তুম মাল ঘরমে ঘুসা দিয়ে তব যায়গা। অথচ আভি বোল হায় নেই পারে গা। কিঁউ, মামাবাড়িকা আবদার পায়া?’

ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করতে করতে নির্ভুল বাংলায় বলল, ‘চোখ রাঙাবেন না, একদম চোখ রাঙাবেন না! হরিদাস পাল, শালা দরজা বানিয়েছে এইটুকু, পায়রার খোপের মতো, মানুষ ভাল করে ঢুকতে পারে না, এখন বলছে ছ’ফুটের মাল ঢোকাও। সরুন, সরুন। অ্যাই ভজা, গাড়িতে ওঠ।’

কাঁদোকাঁদো গলায় সুপ্রভা বলল, ‘কী হবে?’

বিশ্বনাথ বলল, ‘আঃ, বিরক্ত কোরো না তো? ঠিক হবে। এ-মাল আমি ঘরে ঢুকিয়ে ছাড়ব। দরকার হলে বাড়িওলার কাছে পারমিশন নেব, নিয়ে দরজা ভাঙব। অ্যাই পল্টু, হাঁ করে কী দেখছ? মিস্ত্রি পাওয়া যাবে?’

রাত অনেক হয়েছে। দরজা ভাঙার কাজ এখনও শেষ হয়নি। শেষ হওয়ার কথাও নয়। অনেক খুঁজে একজনকে মাত্র জোগাড় করা গেছে। সে রাজি হয়েছে, তবে লোকটা রোগভোগ। দিনেরবেলা বোধহয় কাজ পায় না। হাতে তেমন জোর নেই। তাই অনেক সময় লাগছে।

সদর দরজার মুখের আলোটা নষ্ট হয়ে গেছে অনেকদিন। অন্ধকার দলা মেরে থাকে। সেই অন্ধকারের মধ্যেই কাগজ বোর্ড থার্মোকলে ঢাকা বিশাল রেফ্রিজারেটর দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হচ্ছে, এ-বাড়িতে কোনও দৈত্য এসেছে। দোরগোড়ায় অপেক্ষা করছে, কখন ঢুকতে পারবে।

গদাই দিদির দিকে সরে এল। তারপর হাতটা ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘ভয় করছে দিদি, আমার ভয় করছে।’ ছেনি-হাতুড়ির শব্দ হচ্ছে, ঢং ঢং ঢং।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *