রেড ফিঙ্গার – ৮

অধ্যায় ৮

পাঁচটা বাজার দশ মিনিট পর ফর্সা হতে শুরু করলো পশ্চিমাকাশ।

রান্নাঘরের টেবিলে বসে আছে আকিও। পর্দা গলে ভেতরে আসা আলোর ঔজ্জ্বল্য বাড়ছে ক্ষণে ক্ষণে।

ওর সামনে রাখা এঁটো প্লেটটায় একটা আধখাওয়া বার্গার। পাশেই বিয়ারের গ্লাস। এখনও বেশ কিছুটা বিয়ার রয়ে গেছে ওখানে। ক্ষুধা বা তৃষ্ণা কোনটাই অনুভব করছে না ও। নিজের জন্যে বানানো বার্গারে দুই কামড় দিয়েই নামিয়ে রেখেছে ইয়াইকো। অসুস্থবোধ করায় তাতামি রুমে গিয়ে শুয়ে আছে। ওদের মধ্যে একমাত্র নাওমির মুখেই আগের মতন রুচি আছে। তার ঘর থেকে ইয়াইকো যে প্লেটটা নিয়ে এসেছে, সেটা পুরো খালি। ছেলেকে ভর্তসনা করার মতন সামান্য শক্তিটুকুও এখন আর নেই আকিওর শরীরে। আজকের দিনটা ওর এবং ওর পরিবারের কেমন যাবে, সেই চিন্তাই অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়।

বাড়ির সামনের দিক থেকে শব্দ ভেসে এলো এসময়। নিশ্চয়ই খবরের কাগজ দিয়ে গেল হকার ছেলেটা।

উঠে দাঁড়িয়ে সাথে সাথেই আবার বসে পড়লো আকিও। শনিবারে এত সকালে গিয়ে খবরের কাগজ নিয়ে আসাটা ওর রুটিনের সাথে যায় না। কারো চোখে পড়লে ভ্রুকুটির উদ্রেক ঘটবে। সাধারণত ছুটির দিনগুলোতে বেলা করে ওঠার অভ্যাস ওর। তাছাড়া, প্রভাত সংস্করণের খবরের কাগজ ওর কোন কাজে আসবে না। বাচ্চা মেয়েটা সম্পর্কে কোন প্রতিবেদন যদি ছাপা হয়, তাহলে সেটা পাওয়া যাবে সান্ধ্যকালীন সংস্করণে।

ঘরের দরজা খুলে গেল এসময়। চমকে উঠে ঘুরে তাকালো ও। ইয়াইকো এসেছে।

“কি হলো তোমার আবার?”

“কিছু না…ভুলে গেছিলাম যে এই দরজাটা শব্দ করে।”

“এই দরজাটা?” বলে পাল্লাটা ধীরে ধীরে কয়েকবার সামনে পিছে করলো ইয়াইকো। “ওহ, এই শব্দের কথা বলছো। এটা তো নতুন না।”

“আচ্ছা, কিন্তু আমি আগে খেয়াল করিনি।”

“গত বছর থেকে এই অবস্থা,” টেবিলের থালাবাসনগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো ইয়াইকো। “আর কিছু খাবে?”

“না। সরিয়ে ফেল এসব, প্লিজ।”

ইয়াইকো সবকিছু পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আবারো দরজাটার দিকে তাকালো আকিও। বাড়ির সার্বিক অবস্থা নিয়ে কখনোই কেন যেন মাথা ঘামায়নি ও। তাই কোন দরজা শব্দ করছে বা কোন আসবাবপত্রে কি সমস্যা, সেটা জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না।

চারপাশে একবার নজর বুলালো ও, যেন প্রথমবারের মত দেখছে সবকিছু। অথচ জীবনের লম্বা একটা সময় এখানেই কেটেছে আকিওর।

লম্বা ফ্রেঞ্চ উইন্ডোটার সামনে ঠ্যাকাথাকা একটা পুরনো তোয়ালে চোখে পড়লো ওর।

“মেয়েটাকে এখানেই মেরেছে ও, তাই না?”

“কি বললে?”

রান্নাঘর থেকে পিছে ফিরে তাকালো আকিও। জামার হাতা দু’টো কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করে রেখেছে। নিশ্চয়ই বাসনগুলো পরিষ্কার করছে এখন।

“বাচ্চাটাকে এখানে খুন করেছে ও।”

“হ-হ্যাঁ,” কিছুক্ষণ ইতস্ততবোধের পর বললো ইয়াইকো।

“ওই তোয়ালেটা দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করেছ নাকি?” ওদিকে ইশারা করলো আকিও।

‘ওহহো! ওটা সরিয়ে ফেলতে হবে।”

সুপারমার্কেট থেকে নিয়ে আসা প্লাস্টিকের ব্যাগে তোয়ালেটা তুলে ফেলতে উদ্যোত হলো ইয়াইকো।

“অন্য আবর্জনার সাথে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দাও, যেন কারো নজরে না পড়ে।”

“আমিও সেটাই ভেবেছি।”

রান্নাঘরে ফিরে গেল ইয়াইকো। কিছুক্ষণ পর নন-রিসাইকেল-বিনটা খোলার শব্দ কানে এলো আকিওর।

পুরনো তোয়ালেটা যেখান থেকে তুলেছে ইয়াইকো, সেদিকে তাকালো ও। ছোট্ট মেয়েটার মৃতদেহ এখানেই পড়ে ছিল নিশ্চয়ই।

“অ্যাই!” স্ত্রী’র উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়ল ও।

“আবার কি?” এবারে বিরক্তি লুকানোর কোন চেষ্টা করলো না আকিও। “মেয়েটা বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিল, তাই না?”

“হ্যা। অর্থাৎ, নাওমি ওকে কোন প্রকার জোর করেনি। ওর নিজেরও কিছুটা দোষ….”

“তাহলে জুতা খোলেনি কেন?”

“জুতা?”

“মেয়েটার এক পায়ে জুতা পরা ছিল কেবল।” এমনটাও হতে পারে যে কেবল এক পায়ের জুতা খুলেছিল সে। কিন্তু সেটা একটু অদ্ভুত শোনায়।

চিন্তিত চোখে ওর দিকে তাকালো ইয়াইকো। হয়তো আকিও কি বোঝাতে চাইছে সেটা মাথায় ঢুকছে না তার। কিছুক্ষণ পর অবশ্য বদলে গেল তার অভিব্যক্তি। মাথা নাড়ল একবার।

“টেনিস শু’গুলোর কথা বলছো? আমি পরিয়ে দিয়েছিলাম।”

“তুমি?”

“হলওয়েতে রাখা ছিল, তাই তুলে এনেছিলাম।”

“কিন্তু এক পায়ে পরালে কেন?”

“অন্যটায় পরাতে পারছিলাম না। চাইনি কেউ আমাকে দেখুক। ময়লার ব্যাগের নিচে লুকিয়ে রেখেছিলাম ওটা। পাওনি তুমি?” চোখ বড় করে তাকালো আকিও।

“হ্যাঁ, পরিয়ে দিয়েছি।”

“ভালো করেছো।”

“আশা করি সত্যটাই বলছো তুমি আমাকে,” স্ত্রী’র চেহারার দিকে তাকিয়ে বললো আকিও।

“এসব বলছো কেন?”

“তুমি যখন প্রথমবার মেয়েটাকে দেখেছিলে, তখন কি কেবল ওর এক পায়ে জুতা ছিল? নাওমির সাথে ধস্তাধস্তির সময়ে অন্যটা খুলে যায়?”

বিরক্ত ভঙ্গিতে চোখ বাঁকাল ইয়াইকো।

“মিথ্যে বলবো কেন তোমাকে? আমিই ওর এক পায়ে জুতো পরিয়েছি।”

“তেমনটা হলেই ভালো।”

অবশ্য বাস্তবে এই কারণে খুব একটা হেরফের হবে বলে মনে হয় না।

“আচ্ছা…” খানিকবাদে বললো ইয়াইকো। “হারুমির ব্যাপারে কি করবে আজকে?”

“হারুমি?”

“গতকাল তো ওকে আসতে মানা করেছিলাম। কিন্তু আজকে? কপালে ভাঁজ পড়ল আকিওর। এই বিষয়ে কিছু ভাবেনি ও।

“বলবো যে আজকে আসতে হবে না। ছুটির দিন আজকে, আমিই দেখভাল করতে পারব।”

“ও কিছু সন্দেহ করবে না তো?”

“কি সন্দেহ করবে? ও তো কিছুই জানে না।”

“তা অবশ্য ঠিক।”

রান্নাঘরে গিয়ে কফি বানাতে শুরু করলো ইয়াইকো। কিছু না করে বসে থাকতে পারছে না সে। আকিও অবশ্য করার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। বাসায় থাকা সময়টা পুরোপুরি স্ত্রী’র উপরে নির্ভরশীল সে। পুরো জীবনে কখনো একবেলা রান্না করে খায়নি, ঘর গোছায়নি। কোন জিনিস বাড়ির কোথায় রাখা সেটাও বলতে পারবে না। ইয়াইকো একদিন সকাল সকাল পারিবারিক একটা কাজে বের হয়ে যাওয়ায় সাদা শার্টের সাথে যে কালো টাইটা পরবে, সেটা আর খুঁজে পায়নি ও।

খবরের কাগজটা নিয়ে আসার জন্যে উঠতেই পুলিশের সাইরেন কানে এলো। জমে গিয়ে স্ত্রী’র দিকে তাকালো আকিও। কফি কাপ হাতে ইয়াইকো’ও যেন মূর্তি হয়ে গেছে। চেহারা ফ্যাকাসে।

“আসছে,” ফিসফিস করে বললো আকি ও

“এত তাড়াতাড়ি আসবে ভাবিনি।”

“নাওমি কি করছে?”

“ও…”

“ঘুমাচ্ছে এখনও?”

“আমি কি করে বলবো? তুমি নিজে গিয়ে দেখ না!”

“না, এখন যাব না। “

দুধ আর চিনি ছাড়াই কফি খেল আকিও। ঘুম যেহেতু আসবে না, মাথাটা পরিষ্কার রাখতে হবে যে করেই হোক। এরকম গুমোট পরিবেশে কতক্ষণ থাকতে হবে কে জানে। মনে হচ্ছে বাইরে বেরুলেই সবাই বাঁকা নজরে তাকাবে ওর দিকে। পুলিশের লোকেরা যদি মেয়েটার মৃতদেহ থেকে ছোট কোন সূত্র ও খুঁজে পায়, তাহলে তদন্তে ঢিল দেবে না। ইদানিং সহিংস যেসব অপরাধ ঘটছে, সেগুলোর অনেকটাই অমীমাংসিত রয়ে যায়। কিন্তু সেজন্যে পুলিশকে দূর্বল ভাবলে ভুল হবে।

“তোমার এখন একটু ঘুমানো উচিৎ।”

“আর তুমি? তুমি ঘুমাবে না? নাকি পার্কে যাবে?”

“পার্কে গেলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না।“

“কিন্তু…”

“আমি আরো কিছুক্ষণ এখানে বসে থাকব। ঘুম আসলে ঘুমাব নাহয়।“

“ঠিক আছে। আমার মাথা খুব ভারি ভারি লাগছে।”

ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্যে উঠলেও শেষ মুহূর্তে একবার পিছে ফিরে তাকালো ইয়াইকো।

“তুমি উল্টোপাল্টা কিছু করবে না তো?

“উল্টোপাল্টা?”

“এই যেমন পুলিশকে ফোন করা।“

“না।”

“আসলেই? তোমাকে বিশ্বাস করবো?“

“এখন পুলিশের কাছে গিয়ে কি লাভ হবে শুনি?”

“তা ঠিক।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল ইয়াইকো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *