অধ্যায় ৭
বাসায় ফেরার পর আকিও প্রথমে বুঝে উঠতে পারে না যে কার্ডবোর্ডের বাক্সটা নিয়ে কি করবে। ভেতর থেকে প্রস্রাবের গন্ধ আসছে এখনও। বাইরে ফেলে দেয়া সম্ভব না। সবচেয়ে ভালো হতো পুড়িয়ে ফেললে। কিন্তু এত দেরি করে কিছু পোড়ানোটা ঝুঁকিপূর্ণ। কেউ দেখলে পুলিশে ফোন করবে নিশ্চিত।
কালো ময়লার ব্যাগটা পড়ে আছে বাগানে। ইয়াইকো কাজটা করতে পারত ভাবতে ভাবতে সেটা তুলে নিয়ে ভেতরে বাক্সটা ভরে ফেলল আকিও। এরপর চলে এল বাড়ির ভেতরে।
মায়ের ঘরের সামনে এসে ধীরে ধীরে খুলল দরজাটা। কম্বল মুড়ি দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মাসায়ে। ভেতরে ঢুকে খুব সাবধানে বেডরুম ক্লোজেটের একদম উপরের তাকে তুলে রাখলো কালো ব্যাগটা। এত উপরে নাগাল পাবে না ওর মা। পুরোটা সময় কোন শব্দ করলো না মাসায়ে।
ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আকিও টের পেল ওর শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসছে। বাক্সটা নিয়ে যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই ওর শার্টও নোংরা হয়েছে। বাথরুমে গিয়ে পরনের জামা কাপড়গুলো খুলে ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে দিল। এরপর গোসল করলো লম্বা সময় ধরে। কিন্তু ও শরীরে যতই সাবান মাখুক না কেন, গন্ধটা যাচ্ছে না।
বেডরুমে গিয়ে নতুন জামাকাপড় পরে ডাইনিং রুমে ফিরে এলো কিছুক্ষণ পর। একটা গ্লাস আর বিয়ারের ক্যান কেবলই টেবিলে রেখেছে ইয়াইকো। সুপার মার্কেট থেকে কিনে আনা রেডিমেড খাবারটা মাইক্রোওয়েভে গরম করে প্লেটে ঢেলে দিয়েছে।
“এসব কি?”
“ভাবলাম এত কাজ করে তোমার ক্লান্ত লাগবে। তাছাড়া সারা দিনে কিছু খাওনি।”
আকিও বুঝতে পারল যে এভাবেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চেষ্টা করছে ইয়াইকো।
“ক্ষুধা নেই আমার,” বিয়ারের ক্যানটা খুলল ও।
গলা পর্যন্ত বিয়ার গিলে পাড় মাতাল হতে পারলে ভালো লাগত, তবুও আজকে রাতের ঘটনাগুলো ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না।
এসময় চপিং বোর্ডের উপরে ইয়াইকোর ছুরি চালানোর শব্দ কানে এলো ওর। “কি করছো এত রাতে?”
জবাব দেয় না ইয়াইকো। আকিও নিজেই উঠে উঁকি দিল রান্নাঘরে। কাউন্টারের উপরে একটা বাটি ভর্তি মাংসের কিমা।
“এখন রান্না করবে!”
“ওর নাকি ক্ষুধা লেগেছে।”
“ক্ষুধা লেগেছে!”
“হ্যাঁ, ঘর থেকে নেমেছিল একটু আগে আর…
মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল আকিওর।
“ক্ষুধা পেয়েছে আহাম্মকটার! এরকম একটা কাজ করে সবার জীবন নষ্ট করার পর ক্ষুধা পেয়ছে!”
লম্বা শ্বাস টেনে হনহন করে দরজার দিকে এগোলো আকিও।
“ওর কাছে যাবে না এখন!” গলা চড়িয়ে বললো ওর স্ত্রী। “নাওমির কি দোষ? এই বয়সে ক্ষুধা একটু বেশিই লাগে। দুপুর থেকে কিছু পেটে পড়েনি। ক্ষুধা পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
“কই আমার তো কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
“আমারও না। কিন্তু ও একটা বাচ্চা। তোমার আমার মত পরিস্থিতির গুরুত্ব ও বুঝতে পারবে না।“
“আমি বোঝাচ্ছি দরকার হলে।”
“এখন কি এসব বলার সময়?” ইয়াইকো এবারে আকিওর হাত ধরে বললো। “সব ঝামেলা মেটার পর যা বলার বোলো। ওর মানসিক অবস্থাও ঠিক নেই কিন্তু। হাজার হলেও, নাওমিও মানুষ। একারণেই কিন্তু আগে বলেনি যে ওর ক্ষুধা পেয়েছে।”
“তোমাকে বলেনি কারণ তখন আমি ছিলাম বাসায়,” আকিও বলে। “আমি বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ক্ষুধা পেয়ে গেছে নবাবের। কৃতকর্ম নিয়ে যদি বিন্দুমাত্র অনুতাপ থাকত, ওভাবে মুখ গোজ করে ঘরে বসে থাকত না।”
“সেধে বকা শুনতে কার ভালো লাগে বলো? আমার কথা শোনো। মাথা ঠাণ্ডা করে বসো একটু। পরে কথা বলো ওর সাথে। আপাতত আমি দেখছি।”
“তোমার কথা শুনবে ও?”
“হয়তো শুনবে না। কিন্তু এমনি এমনি বকাবকি করে তো লাভ নেই, তাই না? বকলে কি কিছু বদলাবে? এখন আমাদের ভাবতে হবে ওকে কিভাবে রক্ষা করা যায়।”
“তোমার মাথায় খালি এই এক চিন্তা!”
“এই চিন্তা থাকবে না তো কোন চিন্তা থাকবে? আমার ছেলেকে সবসময় আগলে রাখব আমি। সবসময় রক্ষা করবো। ও যদি খুন করেও থাকে, আমাকে পাশে পাবে। দোহাই লাগে, আজকে রাতে আর কিছু বোলো না। এই হাতজোড় করছি!”
ইয়াইকোর গাল বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে এখন। দু’চোখ টকটকে লাল। রাগ পড়ে গেল আকিওর। অচেনা এক ধরণের শূন্যতা জেঁকে বসলো মনে “ছাড় আমাকে। “
“না, ছাড়লেই তুমি…”
“ছাড়। ওর ঘরে যাব না।”
অবাক হলো ইয়াইকো।
“আসলেই?“
“হ্যাঁ। যথেষ্ট হয়েছে। দাও, যত খুশি বার্গার বানিয়ে দাও।”
ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে নিয়ে ডাইনিং রুমের টেবিলে ফিরে গেল আকিও। এক চুমুকে শেষ করে ফেলল গ্লাসের বিয়ার।
হতাশ ভঙ্গিতে রান্নায় ফিরে গেল ইয়াইকো। আকিওর ধারণা নিজের মানসিক অবস্থা ঠিক রাখার জন্যেই কাজে ব্যস্ত থাকছে ওর স্ত্রী।
“তোমার নিজের জন্যেও বানিও একটা। তোমাকেও তো খেতে হবে।”
“ক্ষুধা নেই আমার।”
“তবুও খাও। আবার কবে শান্তিমত খেতে পারবে সেটার কোন ঠিক নেই। আমারো ক্ষুধা নেই, কিন্তু খাব।”
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো ও।
“কিন্তু…”
“আগামীকাল সহজ যাবে না আমাদের কারোই। যতটা সম্ভব তৈরি থাকা দরকার।
“আকিওর কথা শুনে গম্ভীর ভঙ্গিতে একবার কেবল মাথা নাড়ল ইয়াইকো।