রেড ফিঙ্গার – ৫

অধ্যায় ৫

নিচতলায় নেমে এলো আকিও, কিন্তু ডাইনিং রুমে গেল না। দরজার পাশের তাতামি ঘরটার স্লাইডিংটা পাশে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। বাড়ি ফিরে ইয়াইকোকে এখানেই পেয়েছিল ও। ভেতরে একটা কফি টেবিল, টেলিভিশন আর ছোট একটা ওয়ার্ডোব। গোটা বাড়ির এই একটা জায়গাতেই যা একটু শান্তি লাগে আকিওর। ইয়াইকো-ও একই কারণে এখানে আসে।

কফি টেবিলটার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো ও। একবার ভেবেছিল বাইরে গিয়ে মেয়েটার মৃতদেহ আরেকবার কাছ থেকে দেখবে। কিন্তু পা দু’টো নির্দেশ মানেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলারও শক্তি নেই এখন।

উপর থেকে কোন শব্দ আসছে না। ইয়াইকো কি আদৌ নাওমির মুখ থেকে সত্যটা বের করতে পারবে?

সবসময় যেরকম নরম সুরে কথা বলে এখনও নিশ্চয়ই সেভাবেই কথা বলছে। যেন দামড়া ছেলে নয়, তিন চার বছরের অভিমানী কোন শিশু। একদম ছোট থেকেই বাবা-মা’কে দৌড়ের উপর রাখত নাওমি। পান থেকে চুন খসলেই জুড়ে দিত চিৎকার-চেঁচামেচি। তাই বাধ্য হয়েই তার সাথে ওভাবে কথা বলতো ইয়াইকো। আকিও’র বিষয়টা পছন্দ না হলেও স্ত্রী’কে কিছু বলার সাহস ছিল না। আসলে বাড়িতে এই বিষয়ে কথা বলার মত অবস্থানই ছিলনা ওর কখনো।

এখন সেটার খেসারত দিতে হচ্ছে?

ঠিক কি ঘটেছে সেটা মোটামুটি অনুমান করতে পারছে আকিও। ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে পারত কিনা, সেটা অবশ্য বলা যায় না। আসলে মাস দুয়েক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাই ওকে এভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বলা যায়।

ইয়াইকোর মুখ থেকে সবকিছু শুনেছিল। সেদিন বাজার থেকে ফিরে উঠোন পেরিয়ে সরাসরি ডাইনিং রুমে ঢুকে পড়েছিল সে। কিন্তু ভেতরের দৃশ্যটা দেখার জন্যে তৈরি ছিল না মোটেও। একটা ছোট্ট মেয়েকে পাশে বসিয়ে কাপে করে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল নাওমি। মা’কে দেখা মাত্র কাপের তরলটা বাগানে ছুড়ে দেয় সে। তখনও কিছু সন্দেহ করেনি ইয়াইকো, কিন্তু একটু পরেই খেয়াল করে যে সাকের বোতলটায় তরলের পরিমাণ আগের চেয়ে কমে গেছে।

“আমার মনে হয় মেয়েটাকে ইচ্ছে করে মাতাল বানিয়ে ফায়দা লুটতে চেয়েছিল ও.” ইয়াইকো বলে ওকে।

শুনে হেসে ওঠে আকিও, বলে ইয়াইকোর ভুল হচ্ছে। আসলে মনে মনে ও চায়নি যে স্ত্রী’র কথাটা সত্যি হোক। কিন্তু ইয়াইকোর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা দেখে বুঝতে পারে আন্দাজে কিছু বলেনি সে।

“আমার ধারণা ও ছোট মেয়েদের পছন্দ করে। রাস্তায় বের হলে যতবার এই বয়সী কাউকে দেখে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ওইযে সেদিন শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানটায় গিয়ে ছোট্ট এরিকার সাথে কেমন শুরু করেছিল, মনে আছে? কেবল এলিমেন্টারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে মেয়েটা। তোমার কাছে অদ্ভুত লাগেনি ব্যাপারটা?“

আকিও স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে আসলেও অদ্ভুত ছিল বিষয়টা কিন্তু এরকম একটা সমস্যার কিভাবে সমাধান করা যেতে পারে, সেটা বুঝতে পারেনি। আসলে চিন্তাটাই এতটা অস্বস্তিদায়ক যে মাথা কাজ করছিল না ওর। এক পর্যায়ে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে গোটা বিষয়টাই ইয়াইকোর কল্পনা।

“আপাতত আমাদের চোখ কান খোলা রাখতে হবে,” কোনমতে বলে শেষে।

ইয়াইকোর চেহারা দেখেই বোঝা যায় যে কথাটা বিশেষ পছন্দ হয়নি তার। কিন্তু লম্বা সময় চুপ থাকার পর মাথা নেড়ে সায় দেয় সে-ও।

এরপর আসলেও ছেলের উপরে নজর রাখে আকিও, কিন্তু সেরকম অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। তবে ও যে নাওমির বিষয়ে সবকিছু জানে সেটা হলফ করে বলা সম্ভব না। জানতে হলে কাছাকাছি থাকতে হয়, সময় দিতে হয়। অথচ দিনের বেশিরভাগ সময় অফিসেই কাটায় আকিও, বাড়ি ফিরেও খুব একটা দেখা পায়না ছেলের। শনি আর রবিবার কেবল দুপুর বা রাতের খাবারের সময় যা দেখা হয়। তখনও মাথা নিচু করে রাখে নাওমি। নেহায়েত দরকার না পড়লে কিছু বলে না।

আকিও এখন বলতে পারবে না নাওমির এরকম আচরণ শুরু করেছে ঠিক কবে থেকে। ছেলেটা বদমেজাজী, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আগে কিন্তু এরকমটা ছিল না সে। বাবা-মা’র কথা শুনতো। কথায় কথায় তর্ক করতো না। বকুনি দিলে মাথা নিচু করে শুনতো কেবল। কিন্তু একটা সময় নিজেকে একটা খোলসের ভেতরে গুটিয়ে নেয় নাওমি। বাবা কোন কিছু বলে পাত্তাই দেয় না। আকিও জোরাজুরি করলে হট্টগোল-ভাঙচুর জুড়ে দেয়।

তাই ও এখন যতটা সম্ভব এড়িয়েই চলে নাওমিকে। নিজেকে এই বলে স্বান্তনা দেয় যে সব বয়সের দোষ। এক সময় ঠিক হয়ে যাবে।

ইয়াইকো যখন ছোট মেয়েটার বিষয়ে জানায় ওকে, তখনও খুব সহসা সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে কিছু ভাবেনি আকিও। এখন আফসোস হচ্ছে সেজন্যে। কিন্তু কিইবা করতে পারতো?

ক্যাচক্যাচ শব্দ কানে এলো এসময়। সিঁড়ি বেয়ে উপরতলা থেকে নিচে নামছে ইয়াইকো। তাতামি ঘরটায় প্রবেশ করে কফি টেবিলের পাশে বসে পড়লো সে। চেহারা লাল হয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল একবার।

“জিজ্ঞেস করেছো?”

“হ্যাঁ।”

“কি বললো?

“জবাব দেয়ার আগে একবার ঢোক গিলল সে।

“গলা টিপেই মেরেছে।”

হতাশায় চোখ আপনা আপনি বুজে এলো আকিওর। বিস্মিত হয়নি ঠিকই, কিন্তু মনে মনে যে আশাটা লালন করছিল, সেটার সলিল সমাধি ঘটলো ইয়াইকোর বলা কথাটায়। মেয়েটাকে আসলেও খুন করেছে নাওমি

“কোত্থেকে এসেছিল মেয়েটা?”

মাথা ঝাঁকায় ইয়াইকো।

“সেটা ও জানেনা। “

“অর্থাৎ, ও-ই নিয়ে এসেছিল।”

“আমাকে বললো মেয়েটাকে নাকি ও আসতে বলেনি, একাই পেছন পেছন এসেছে।”

“সেটা কি করে সম্ভব? কেউ বিশ্বাস করবে না এই কথা।”

জবাবে কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলো ইয়াইকো। কফির টেবিলে জোরে একটা কিল বসালো আকিও।

শিকারের আশায় বাইরের রাস্তায় ওঁত পেতে ছিল নাওমি? নাকি রাস্তা দিয়ে আসার সময় হঠাৎ বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে ভেতরের পশু জেগে ওঠে? যা-ই হোক না কেন, মেয়েটাকে সে এখানে নিয়ে এসেছে। বাচ্চাদের ছোট থেকেই সাবধান করে দেয়া হয় যেন অপরিচিত কারো সাথে কোথাও না যায়। বিগত বছরগুলোয় বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটায় এখনকার বাবা-মায়েরা আরো সাবধানী।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আকিওর নিজের ছেলেই ওই নরকের কীটগুলোর একটা।

মেয়েটাকে ওদের বাড়িতে আসার জন্যে কিভাবে রাজি করিয়েছে নাওমি, সেটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবলো আকিও। কোন প্রয়োজন হলে মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে, তা ভালো করেই জানা আছে ছেলেটার। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে হাসিমুখে কিছু বলতেও নিশ্চয়ই পিছপা হবে না।

“মেয়েটাকে মেরেছে কেন?”

“ও যে খেলার কথা বলেছিল, সেটা খেলতে রাজি হয়নি। তখন ভয় দেখানোর জন্যে গলা চেপে ধরেছিল। মারতে চায়নি।”

“এরকম দামড়া ছেলে একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে কি খেলবে?”

“জানি না, আমাকে বলেনি।”

“জিজ্ঞেস করোনি তুমি?”

চুপ করে রইলো ইয়াইকো। যেন সে বুঝতে পারছে না আকিও এমন একটা প্রশ্ন কিভাবে করতে পারে।

চোখ গরম করে স্ত্রী’র দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে আকিও। ইয়াইকো ই হয়তো ঠিক। টেলিভিশনে প্রায়ই ‘শিশু নিপীড়ন’ কথাটা ব্যবহৃত হতে দেখেছে, কিন্তু শব্দ দু’টোর অর্থ কি হতে পারে, সেটা ভাবেনি। এখনও ভাবতে চায় না।

তবে এটা নিশ্চিত যে নাওমি কেবল ভয় দেখানোর জন্যে মেয়েটার গলা চেপে ধরেনি। বাচ্চা মেয়েটা নিশ্চয়ই এক পর্যায়ে বুঝতে পারে নাওমির উদ্দেশ্য ভালো কিছু নয়। আত্মরক্ষার্থে হয়তো চেঁচিয়ে ওঠে। থামানোর জন্যে তখন তার গলা চেপে ধরে নাওমি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা যায় মেয়েটা।

“ওকে কোথায় মেরেছে?

“ডাইনিং রুমে।”

“ওখানে কেন?”

““দু’জন মিলে একসাথে ফলের জ্যুস খাবে ভেবেছিল নাওমি।”

আকিও বুঝতে পারে এবারেও খুব সম্ভবত জ্যুসের সাথে সাকে বা অন্য কিছু মিশিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল নাওমির।

“মেরে ফেলার পর কি করে?”

“উঠানে রেখে আসে। মেয়েটা প্রস্রাব করে ফেলেছিল। মেঝে যেন নোংরা না হয়, সেজন্যে আরকি।“

ডাইনিং রুমে দুর্গন্ধের কারণটা এতক্ষণে বুঝতে পারে আকিও।

“এরপর?”

“কিছু না।“

“কিছু না মানে?”

“নিজের ঘরে চলে যায় ও। কি করবে সেটা নাকি বুঝতে পারছিল না।“

আকিও’র মাথা রীতিমত ঘোরাচ্ছে এখন। কিছুক্ষণের জন্যে হুঁশ হারালে ভালোই হতো বরং। ওর ছেলে একটা বাচ্চা মেয়েকে খুন করেছে। কিন্তু তার চিন্তা ছিল মেঝে যেন নোংরা না হয়, সেটা!

তবে আকিও বেশ বুঝতে পারছে গোটা পরিস্থিতি কিভাবে দেখছিল নাওমি মেয়েটাকে হত্যার পর নিশ্চয়ই বিরক্ত মুখে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় ভেতর থেকে, যেন সমস্যাটার মুখোমুখি না হতে হয়। এর বেশি আর কিছু ভাবেনি। মেয়েটাকে বারান্দায় রেখে আসে। এরপর যা করার মা আর বাবা করবে।

ড্রেসারের পাশে রাখা ফোনটার দিকে হাত বাড়ায় আকিও।

“কি করছো?” চিৎকার করে জানতে চায় ইয়াইকো।

“পুলিশে ফোন দিব।”

“কিন্তু…“

আকিওর ফোনের দিকে বাড়ানো হাতটা চেপে ধরে সে। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয় ও।

“আর কোন উপায় নেই। বাচ্চা একটা মেয়েকে খুন করেছে ও, বুঝতে পারছ বিষয়টা?”

“কিন্তু…নাওমি…” আবারো আকিওর বাহু চেপে ধরে ইয়াইকো। “ওর কি হবে? বাকি জীবন খুনের আসামি হয়ে কাটাতে হবে ওকে।”

“কিছু তো করার নেই! ও আসলেই খুন করেছে।”

“ওকে ধরে নিয়ে গেলে তোমার ভালো লাগবে?“

“ভালো লাগবে কেন? এটা কেমন কথা! কিন্তু বিকল্প কোন উপায় জানা আছে তোমার? ও যদি আত্মসমর্পণ করে তাহলে শাস্তির মাত্রাটা কম হবে, কারণ এখনও প্রাপ্তবয়স্ক না তোমার ছেলে। ওর নামও কেউ জানবে না।”

“কি যা-তা বলছো? পেপারে হয়তো নাম ছাপাবে না। কিন্তু আশপাশের সবাই জানবে কি করেছে নাওমি। কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে না। সারাটা জীবন ধরে ভুগবে!”

আকিও ভাবে একবার বলবে যে নাওমির জীবন এখনও স্বাভাবিক নয়, কিন্তু সেই সাহস হলো না। পুলিশ স্টেশনের নম্বরে ডায়াল করতে শুরু করলো ও।

“থামো!”

“উফ, অনেক হয়েছে!”

ইয়াইকোকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল আকিও।

বিমর্ষ দৃষ্টিতে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে, এরপর আকিওকে অবাক ড্রেসারের ড্রয়ার খুলে একটা ধারালো কাঁচি বের করে আনলো।

“কি করছো তুমি?”

কাঁচির ধারালো ফলা গলার কাছে ধরলো ইয়াইকো।

“পুলিশে ফোন দিও না, প্লিজ।”

“পাগলামি থামাও তো। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?’

কাঁচিটা গলা না সরিয়ে কেবল মাথা ঝাঁকায় ইয়াইকো। “আমি তোমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছি ভাবলে ভুল করবে। নাওমি’কে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, এই দৃশ্য দেখার চাইতে মরে যাওয়া ভাল আমার জন্যে। এরপর তুমি যা ইচ্ছা করো।”

“থামো! কাঁচিটা নামাও।“

চোয়াল শক্ত করে চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে রইলো ইয়াইকো।

মনে হচ্ছে যেন স্বস্তা টিভি নাটক দেখছি, ভাবে আকিও। পরিস্থিতি এতটা গুরুতর না হলে হয়তো হেসেই ফেলত স্ত্রী’র এহেন আচরণে। বড্ড বেশি নাটকীয় ঠেকছে সবকিছু। এমনটা নয় যে ওর মনে হচ্ছে ইয়াইকো অভিনয় করছে। কিন্তু টেলিভিশনে দেখা কোন দৃশ্য বা উপন্যাসের কোন চরিত্র থেকেই অনুপ্রাণিত সে।

আকিও ঠাওর করতে পারছে না ইয়াইকোর মতিগতি। কিন্তু ওর পক্ষে মুখ ফুটে এই ব্যাপারে কিছু বলাও সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে উল্টোপাল্টা কিছু করে বসতে পারে ইয়াইকো।

“ঠিক আছে, আমি ফোনটা নামিয়ে রাখছি। তুমি কাঁচি নামাও।”

“না, আমি এটা নামিয়ে রাখা মাত্র তুমি পুলিশে ফোন দেবে।”

“কথা দিচ্ছি, ফোন দিব না,” রিসিভারটা আসলেই নামিয়ে রাখে আকিও।

কিন্তু কাঁচিটা নামায় না ইয়াইকো, হয়তো এখনও ওকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না সে। চোখ থেকে সন্দেহ দূর হয়নি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাতামি ম্যাটের উপরে পা ভাঁজ করে বসে পড়লো আকিও।

“এখন কি করবে তুমি, শুনি? সামনে পরিস্থিতি কিন্তু আরো জটিল হবে, এটা ভুলে যেও না।”

এবারেও মুখ খোলেনা ইয়াইকো। কিন্তু সে নিশ্চয়ই জানে আকিও ভুল কিছু বলেনি। ছোট্ট মেয়েটার বাবা-মা নিশ্চয়ই পুলিশে যোগাযোগ করবে।

স্টেশনের বাইরে দেখা লোকটার কথা মনে পড়ে গেল এসময়।

“মেয়েটার পরনে কি ছিল, সেটা দেখেছ?”

“পরনে কি ছিল?”

“গোলাপী সোয়েটশার্ট তো না?”

“আসলে…জানি না সোয়েটশার্ট কিনা, তবে গোলাপী। একথা জিজ্ঞেস করছো কেন?”

একবার মাথা চুলকায় আকিও। স্টেশনের সামনে দেখা লোকটার ব্যাপারে সব খুলে বলে।

“খুব সম্ভবত মেয়েটার বাবা। আমি নিশ্চিত এতক্ষণে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছে ভদ্রলোক। আর পুলিশ খোঁজখবর নেয়া শুরু করলে খুঁজে পেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তখন আর কিছু করার থাকবে না আমাদের। “

কারো আদরের মেয়ে ওদের উঠোনে এরকম অবস্থায় পড়ে আছে, ভাবতেই কেমন যেন লাগছে আকিওর।

লোকটাকে কেকের দোকানটার ওখানে কেবল পেছন থেকে দেখেছিল ও, কিন্তু তার দুশ্চিন্তার মাত্রা বোঝার জন্যে সেটুকুই যথেষ্ট। এরকম কেউ চুপ করে বসে থাকবে না। আবারো লজ্জায় ভরে উঠলো আকিওর মন।

ইয়াইকো এখনও গলার কাছে কাঁচিটা ধরে রেখেছে। বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো সে, ঠিক বুঝতে পারলো না আকিও।

“কি বলছো?

মাথা উঁচু করে ইয়াইকো।

“লাশটা রেখে আসো অন্য কোথাও।”

“কি?”

“‘মেয়েটার মৃতদেহ এখানে রাখা যাবে না,” বলে একবার ঢোক গিলে ইয়াইকো। “অন্য কোথাও রেখে আসতে হবে। আমি তোমাকে সাহায্য করবো এই কাজে। প্লিজ, কিছু একটা করো।” বাউ করার ভঙ্গিতে মাথা নিচু করলো ইয়াইকো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকিও। “বুঝে শুনে বলছো তো কথাটা?”

মাথা নিচু করেই রাখলো ইয়াইকো। যেন সে পণ করেছে ও তার কথা না মানা অবধি মাথা তুলবে না।

গুঙিয়ে উঠলো আকিও। “যত্তসব পাগলামি।”

ইয়াইকোর পিঠ কাঁপছে, কিন্তু মাথা তুললো না সে।

“যত্তসব পাগলামি,” আবারো বললো আকিও।

আসলে ওর মাথাতেও স্ত্রী’র মতন একই চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল এতক্ষণ ধরে। কিন্তু জোর করে দূরে রাখার চেষ্টা করছিল ভাবনাটা, কারণ কাজ আদৌ সম্ভব বলে মনে হয় না।

অসম্ভব, কোন ভাবেই পারব না, উল্টো ফেঁসে যাব, মনে মনে নিজের সাথে তর্ক করে আকিও।

“তাছাড়া,” মাথা নিচু করে রাখা অবস্থাতেই বলে ইয়াইকো। “আমাদের ভবিষ্যত বলে কিছু থাকবে না। নাওমি যদি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেও, আমাদের জীবন আর আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। ওর বাবা-মা হিসেবে সবাই আমাদের দোষারোপ করবে। বলবে একটা জানোয়ার জন্ম দিয়েছি। ও যদি দোষ স্বীকার করেও নেয়, যা ঘটে গেছে সেটার জন্যে কেউ আমাদের ক্ষমা করবে না। সব কিছু হারাতে হবে তখন।”

অনুভূতিশূন্য কন্ঠে কথাগুলো বলে গেল ইয়াইকো। ঘটনার পরিক্রমায় নিশ্চয়ই এখন আর কিছু অনুভব করতে পারছে না সে।

ইয়াইকো ভুল কিছু বলেনি, ভাবে আকিও। নাওমি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও কেউ ওদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখাবে না। হাজার হলেও নিরীহ একটা বাচ্চা মেয়ে খুন হয়েছে।

“তুমি তো বলছো মেয়েটাকে কোথাও রেখে আসতে। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব?

কথাটা বলামাত্র আকিও বুঝতে পারে এখন আর পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়। কোন কাজ করতে অস্বীকৃতি জানানো আর সেটাকে অসম্ভব বলা এক জিনিস নয়।

“মানে?”

“মেয়েটাকে কিভাবে নিয়ে যাব? খুব বেশি দূরে তো যাওয়ার সুযোগ নেই। “ আকিও’র ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে ঠিকই, কিন্তু গাড়ি নেই। ওদের বাড়িটা পুরনো, গ্যারেজ ছিল না কখনোই। তাছাড়া কখনো গাড়ির প্রয়োজনবোধও হয়নি ওর বা ইয়াইকোর।

“কোথাও না কোথাও তো লুকিয়ে ফেলা যায়….

““লুকিয়ে ফেলব মানে? এই বাড়িতে কোথাও লুকিয়ে রাখতে চাইছ নাকি? “ “আপাতত। এরপর সুযোগ বুঝে নাহয় সরিয়ে ফেলা যাবে।”

ইয়াইকোর কথা শেষ হবার আগেই মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিল আকিও। “নাহ, এভাবে হবে না। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই মেয়েটাকে নাওমির সাথে দেখেছে। আর তেমনটা হয়ে থাকলে পুলিশ অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের বাসায় আসবে। তল্লাশিও চালাতে পারে। তখন মেয়েটাকে খুঁজে পেলে আমাদের বলার কিছু থাকবে না।

চুপ হয়ে গেল আকিও, আবারো তাকিয়ে আছে ফোনটার দিকে। গোটা কথোপকথনই অর্থহীন লাগছে এখন। পুলিশ যদি আসলেই ওদের বাসায় আসে, মেয়েটার মৃতদেহ কোথায় আছে, তাতে আর কিছু যায় আসবে না তখন। শত চেষ্টা করেও মন থেকে ভয় দূর করতে পারল না ও।

“আজকে রাতের মধ্যে যদি কোথাও রেখে আসতে পারি, তাহলে হয়তো বেঁচে যাব। “

“কি?”

এবারে মাথা উঠালো ইয়াইকো। “খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। অন্য কোথাও রেখে আসলেই হবে…এমনটা বোঝাতে হবে যে সেখানেই খুন হয়েছে মেয়েটা। “

“অন্য কোথাও?”

“এই ধরো…” বলতে গিয়ে থেমে গেল ইয়াইকো। কথাটা কিভাবে শেষ

করবে বুঝতে পারছে না।

ঠিক এই সময় পেছন দিক থেকে একটা শব্দ কানে এলো আকিওর। বিস্মিত ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়ালো ও।

মাসায়ে বের হয়েছে তার ঘর থেকে। গুণগুণ করে একটা বাচ্চাদের ছড়াগান গাইছে সে। সুরটা আকিওর পরিচিত, কিন্তু গানটার নাম মনে এলো না। বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেল একটু পর। একারণেই উঠেছে মাসায়ে।

“উঠার আর সময় পেল না,” গজগজ করে বললো ইয়াইকো।

আকিও অবশ্য কিছু বললো না। কিছুক্ষণ বাদে ফ্লাশের শব্দ ভেসে এলো। বাথরুমের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো মাসায়ে। তার পদশব্দ মিলিয়ে গেল করিডোরের অন্যপাশে।

এখনো পানি পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছে ওরা। মাসায়ের ঘরের দরজা বন্ধ হবার শব্দ কানে আসা মাত্র উঠে দাঁড়ালো ইয়াইকো। দুদ্দাড় করে বাথরুমে গিয়ে কলটা বন্ধ করলো। শব্দও থেমে গেল সাথে সাথে। সবসময়ের মতন আজকেও সিঙ্কের কল বন্ধ করতে ভুলে গেছে মাসায়ে।

প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি শব্দ করে দরজা বন্ধ করলো ইয়াইকো। ভেতরে ঢুকে দেয়ালে হেলান দিয়ে নিচে বসে পড়ল, যেন দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও নেই। দুই হাতে চেপে ধরেছে কপাল। শব্দ করে শ্বাস নিচ্ছে।

“আর পারছি না আমি। মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”

যা ঘটেছে, সবকিছুর জন্য সে নিজেকে দোষারোপ করছে কিনা এটা জিজ্ঞেস করা থেকে নিজেকে বিরত রাখলো আকিও।

মেঝেতে পাতা বাদামী হয়ে আসা তাতামি ম্যাটগুলোর দিকে চোখ গেল ওর। এগুলো যখন চকচকে ছিল, সেই সময়কার কথা মনে পড়লো। তখন হাইস্কুলের ছাত্র ছিল ও। এরকম একটা বাসায় ওদের রাখার জন্যে নিজের বাবার প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা কাজ করতো ওর। পরিশ্রম কিন্তু কম করত না সে।

কিন্তু আমি? আমি কি করেছি? সেই তো ফিরে এসেছি এই শহরটায়। এমনকি পারিবারিক জীবনেও সুখী নই। এখন আমার পরিবারের কারণে অন্য একটা পরিবার তছনছ হয়ে গেল। নষ্ট হয়ে গেল একটা বাচ্চা মেয়ের জীবন।

সব দোষ আমার।

“ছোট পার্কটা কেমন হয়?” একটু পর বললো ও।

“ছোট পার্ক?

“হ্যাঁ। গিনকগো গাছগুলো আছে যেখানে।“

“ওখানে নিয়ে যাবে? “হ্যাঁ।”

“পার্কেই রেখে আসবে?”

“না, পার্কে না,” আকিও বলে। “ওখানে অনেকগুলো পাবলিক টয়লেট আছে। চাইলে সেখানে লুকিয়ে রাখতে পারি।’

“টয়লেটে….”

“তাহলে সাথে সাথে হয়তো কারো চোখে পড়বে না।”

“খারাপ বলোনি,” সামনে এগিয়ে এলো ইয়াইকো। “কখন করবো আমরা কাজটা?“

“মাঝরাতে। এই ধরো দু’টার দিকে।” ড্রেসারের উপরে ঝোলানো ঘড়িটার দিকে তাকালো আকিও। কেবল সাড়ে আটটার মতন বাজছে।

আলমারি থেকে বড় একটা কার্ডবোর্ডের বক্স বের করলো করলো ও। ড্রায়ার কেনার সময় পেয়েছিল বক্সটা। ইয়াইকো এটা রেখে দিয়েছিল কুশনগুলো রাখার জন্যে। কিন্তু শেষমেষ আর কিছু রাখা হয়নি। জিনিসটা যে কখনো ওদের কাজে আসতে পারে এটা মাথাতে আসেনি আকিওর।

বক্সটা বাগানে নিয়ে গেল ও। ছোট মেয়েটার মৃতদেহ একটা ময়লা ফেলার কালো ব্যাগের মধ্যে রাখা। সেটার পাশে বক্সটা নামিয়ে ভাঁজ খুলে ফেলল। ঠিকঠাকই আছে ওটা, কাজ চলে যাবে।

আবার ভেতরে চলে এলো আকিও। ডাইনিং রুমে বসে আছে ইয়াইকো। দুই হাতে চেপে ধরেছে মাথা। চুল এসে ঢেকে দিয়েছে মুখটা।

“হবে?”

“হ্যাঁ,” বললো আকিও।

“মেয়েটাকে বক্সে ঢোকাওনি।

“আরো পরে। এখন আমাকে বাগানে কেউ দেখে ফেললে সন্দেহ করতে পারে।”

ঘাড় ঘুরিয়ে সময় দেখে নিল ইয়াইকো।

“ঠিক বলেছো,” খসখসে শোনালো তার কন্ঠস্বর।

আকিও’র বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। তবে তেষ্টাটা পানির না। একটা ঠাণ্ডা বিয়ার বা হুইস্কি পেলে স্নায়ু শিথিল হতো কিছুটা। অনুভূতিগুলোও ভোতা হয়ে আসতো। যে প্রচণ্ড অপরাধবোধ কাজ করছে ভেতরে ভেতরে, সেটা একটু হলেও কমতো। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব না। জরুরী কাজ আছে অনেক।

একটা সিগারেট ধরিয়ে দ্রুত শেষ করলো।

“নাওমি কি করছে?”

ইয়াইকো’কে দেখে মনে হচ্ছে না আকিওর প্রশ্ন তার কানে ঢুকেছে। “তুমি একটু রুমে গিয়ে ওর সাথে কথা বলো না!”

লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে অবশেষে আকিও’র দিকে ঘাড় ফেরায় তার স্ত্রী। চোখজোড়া টকটকে লাল বেচারির।

“এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। “

“ঠিক কি ঘটেছিল, সেই ব্যাপারে ভালো মতন জানতে হবে আমাদের।”

“কি জিজ্ঞেস করবো ওকে?”

“ওদের কেউ একসাথে দেখেছিল কিনা, কয়টার সময় বাইরে বের হয়েছিল, কখন ফিরেছে- এসব।”

“কি লাভ এখন এসব জিজ্ঞেস করে?”

“কি লাভ সেটাও কি তোমাকে বোঝাতে হবে নাকি এখন? যদি ওদের কেউ একসাথে দেখে থাকে তাহলে পুলিশ এক না এক সময় জানবেই। তখন আমাদের আর নাওমিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসবে। পরিস্থিতি চলে যাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।”

“পুলিশ আসলেও,” মাথা নিচু করে বলে ইয়াইকো। “আমার ছেলের সাথে কথা বলতে দিব না।”

“তোমার কথা তো খুব মানবে পুলিশের লোকেরা। উলটো সন্দেহের পরিমাণ বাড়বে।”

“আমি নাওমিকে বলতে বলবো যে ও কিছু জানে না এই বিষয়ে। তাহলে আর পুলিশ ওকে সন্দেহ করবে না।”

“তোমার কি আসলেই মনে হচ্ছে যে ব্যাপারগুলো এত সহজ? পুলিশ যদি এমন কোন প্রত্যক্ষদর্শী খুঁজে পায় যে নাওমির সাথে দেখেছিল ছোট মেয়েটাকে, তখন কিন্তু হাল ছাড়বে না। আবার কেউ যদি মেয়েটাকে নাওমির সাথে দেখে কথা বলতে এগিয়ে আসে আর ও কোন জবাব না দেয়, তাহলে কিন্তু নাওমির কথা আলাদাভাবে মনে থাকভে তার।”

“এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কি আদৌ কোন লাভ আছে?’

“আছে বলেই তো জানতে চাইছি। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে যে

বাসায় আসার পথে ওদের কারো সাথে কথা হয়েছিল কিনা।”

এবারে ইয়াইকো পাল্টা কিছু বললো না। হয়তো পরিস্থিতির গুরুত্ব অবশেষে মাথায় ঢুকিচজে তার। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো।

“যাচ্ছ কোথায়?”

“উপরে। জিজ্ঞেস করে দেখি কারো সাথে কথা হয়েছিল কিনা।“

“নিচে আসতে বলো ওকে।”

“এসে কাজ নেই। এমনিতেও ঘাবড়ে গেছে।”

“এখন না নামলে…”

আকিওর কথা উপেক্ষা করে ডাইনিং রুমে থেকে বেরিয়ে গেল ইয়াইকো। হলওয়ে ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় তার পদশব্দ শোনা গেলেও সিড়িতে ওঠার পর আর কোন শব্দ এলো না। ছেলে যেন বিরক্ত না হয় এজন্যে পা টিপে টিপে উঠছে সে। এরকম পরিস্থিতিতেও স্ত্রী’র এহেন আচরণে ভীষণ বিরক্ত হলো আকিও।

সিগারেট নিভিয়ে উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে একটা বিয়ারের ক্যান বের করলো। পুনরায় বসার আগেই অর্ধেকটা খালি হয়ে ক্যান।

এসময় মেঝেতে রাখা বাজারের ব্যাগটার দিকে চোখ পড়লো ওর। কেনাকাটা সেরে বাসায় ফিরে মেয়েটাকে দেখে এতই চমকে গেছিল যে ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করতেও ভুলে গেছে।

ভেতরে সবজি আর কিমা করা মাংস চোখে পড়লো ওর। খুব সম্ভবত বার্গার বানানোর পরিকল্পনা ছিল ইয়াইকোর, নাওমির পছন্দের খাবার। সবজিগুলো রান্না করা অবস্থাতেই কেনা হয়েছে। শেষ কবে ওকে নিজে কিছু রান্না করে খাইয়েছিল, সেটা মনে নেই আকিওর।

সিড়ি থেকে কারও নিচে নেমে আসার শব্দ কানে এলো এসময়। কিছুক্ষণ পর দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল ইয়াইকো।

“কি বললো?“

“কারো সাথে দেখা হয়নি ওর,” বসতে বসতে বললো ই ইয়াইকো। “তাই আমি বলেছি পুলিশ যদি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করে, তখন যেন বলে যে ও কিছু জানেনা এই ব্যাপারে।”

বিয়ারে লম্বা একটা চুমুক দিল আকিও।

“পোক্ত কোন কারণ না থাকলে পুলিশ আমাদের সাথে দেখা করতে আসবে না। আর যদি আসে, তখন জানিনা বলে পার পাওয়া যাবে না।”

“না যাক, তবুও নাওমি এই কথাই বলবে।”

নাক দিয়ে শব্দ করলে আকিও। “তোমার কি মনে হয, পারবে ও?”

“কি পারবে?”

“পুলিশকে মিথ্যা বলতে। তারা কিন্তু আমাদের মতন না। অপরাধীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অভ্যেস আছে তাদের, এটাই তাদের কাজ। এরকম পেশাদার লোকের মুখোমুখি হলে কিন্তু ঘাবড়ে যাবে। আমাদের সাথে যতই হম্বিতম্বি করুক, ও কিরকম ভীতু তা নিশ্চয়ই ভালো করেই জানো।“

চুপ করে রইলো ইয়াইকো। ভুল কিছু বলেনি আকিও।

“তুমি লাই দিয়ে মাথায় তুলেছ।”

“মানে, সব দোষ আমার, তাই তো?”

“যখন যা আবদার করে, হোক সেটা অন্যায়, মানা করো না। ধৈর্য্য বলতে কিছু নেই ওর।”

“তোমার মুখে কিন্তু এসব কথা মানায় না। তুমি নিজে করোটা কি শুনি? কোন কাজ একটু ঝামেলা মনে হলেই হাত গুটিয়ে বসে থাকো বা বাসা থেকে পালাও।”

“পালাই মানে? কোথায় পালাই?”

“ও যখন প্রাইমারি স্কুলের শেষ বর্ষে ছিল, তখনকার ঘটনাটা মনে আছে?

‘প্রাইমারি স্কুলের শেষ বর্ষে? কোন ঘটনা?“

“দেখেছ? তোমার মনেও নেই। ওকে যে স্কুলে কয়েকটা ছেলে জ্বালাতন করতো, সেই কথা বলছি। তোমাকে জানানোর পর বলেছিলে ওর বয়সী একটা ছেলের নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা থাকা উচিৎ। স্কুলে যেতে চাইত না ও, কিন্তু তুমি জোর করতে। আমি কিন্তু মানা করেছিলাম যেতে।”

“ওর ভালোর জন্যেই বলেছিলাম।”

“মিথ্যে কথা। দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়াই তোমার স্বভাব। আর তুমি যে বুদ্ধি দিয়েছিলে, সেটায় কাজ হয়নি। ওকে জ্বালাতন করা থামায়নি ছেলেগুলো। টিচার যখন তাদের ধমক লাগায়, তখন কিছুদিনের জন্যে থামে। কিন্তু স্কুলের বাকি মাসগুলোয় ওর সাথে ঠিক মত কখনো কথাও বলেনি কেউ।”

আকিও কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। ও ভেবেছিল ছেলের এই সমস্যার সমাধান তখনই হয়ে গেছে।

“আমাকে বলোনি কেন তখন কিছু?”

“কারণ নাওমি মানা করেছিল। তাছাড়া আমারও বলার ইচ্ছা ছিল না। তুমি ওকেই বকতে। নিজের পরিবারের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তোমার।”

“এরকম একটা কথা কিভাবে বললে তুমি?”

“এটাই সত্যি। কারণ তখন তুমি অন্য একজনের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছ। আমরা গোল্লায় যাই না কি করি, সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই,” বিতৃষ্ণ স্বরে বললো ইয়াইকো।

“আবারো সেই একই কথা তুললে?

“তুমি খুব ভালো করেই জানো যে আমার এই ব্যাপারে কথা বলার কোন আগ্রহ নেই। কখনো ছিলও না। আমি শুধু চাই তুমি তোমার পরিবারের খেয়াল রাখবে। ঘরের বাইরে কি করে বেড়াও সেই ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই। তুমি তোমার ছেলেকে বোঝো না। এতদিন বলিনি, কিন্তু এবারে বলছি- নাওমির এখন অবধি স্কুলে কোন বন্ধু নেই। এলিমেন্টারি স্কুলে যারা ওকে জ্বালাতন করেছে, তারা এখনও পেছনে লেগে আছে। অন্যদের মাঝেও অতীতের কথা বলেছে বিধায় কেউ নাওমির সাথে বন্ধুত্ব করতে চায় না। বাবা হিসেবে তোমার দায়িত্ব ছিল নিজের ছেলেকে বাঁচানো। কিন্তু ওর দিকে ফিরে তাকাতেও যেন কষ্ট হয় তোমার।”

ইয়াইকোর চোখ আবারো ছলছল করছে। এবারে কষ্টের পাশাপাশি সেখানে অসন্তোষের ছাপও টের পেল আকিও।

ইচ্ছে করেই অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিল। “যথেষ্ট হয়েছে!”

“তুমিই শুরু করেছিলে,” ফিসফিস করে বলে ইয়াইকো।

বিয়ার শেষ করে ক্যানটা ফেলে দিল আকিও।

“আমাদের এখন প্রার্থনা করা উচিৎ যেন পুলিশ না আসে বাড়ি পর্যন্ত। একবার যদি নাওমির সাথে কথা বলে তারা…সব শেষ হয়ে যাবে। নিজেকে শক্ত করো।”

“প্রশ্নই ওঠে না!” ইয়াইকো বলে। “ওর সাথে কেউ কথা বলতে পারবে না।”

“পুলিশের লোক যদি কথা বলতে চায়, আমাদের কিছু করার থাকবে না। একদমই না।”

সোজা হয়ে বসে ওর দিকে তাকালো ইয়াইকো।

“সেক্ষেত্রে বলবো আমিই খুনটা করেছি।”

“কি?”

“বলবো আমি মেরেছি মেয়েটাকে। তাহলে নাওমিকে আর গ্রেফতার করবে না।”

“আজেবাজে কথা বোলোনা তো।”

“তুমি কি নিজের কাঁধে দোষ নেবে? নেবে না তো!” চোখ বড় করে বলে ইয়াইকো। “সেক্ষেত্রে আমার হাতে তো আর কোন উপায় নেই।”

“তুমি বা আমি কেন একটা নিরীহ বাচ্চা মেয়েকে হত্যা করবো? তুমি পার্ট টাইম চাকরি করো। আমিও করি। দু’জনেরই অ্যালিবাই আছে।”

“বলবো অফিস থেকে আসার পথে খুনটা করেছি। “

“তাহলেও কোন লাভ হবে না। ময়নাতদন্তে বেরিয়ে আসবে মেয়েটা ঠিক কখন মারা গেছে।”

“তাতে কিছু যায় আসে না। আমি বলবো মেয়েটাকে আমিই মেরেছি।”

“আজেবাজে কথা বোলো না,” আবারো একই কথা বললো আকিও। ঠিক সেই সময় একটা বুদ্ধি খেলে গেল ওর মাথায়। কয়েক সেকেন্ড নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলো, মাথার চাকাগুলো ঘুরছে বনবন করে।”

“কি হলো? আর কি নিয়ে কথা শোনাবে আমাকে?”

“কিছু না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বললো আকিও। মনে মনে প্রাণপনে চেষ্টা করছে, যে বুদ্ধিটা মাথায় এসেছে সেটাকে দূরে সরিয়ে দিতে। ভাবনাটা এতই জঘন্য যে নিজের প্রতিই ঘেন্না হচ্ছে ওর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *